সংসার সমরাঙ্গন পর্ব-০১

0
1

#সংসার_সমরাঙ্গন (০১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘একসাথে সংসারটা বোধ হয় আর চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। শুধু অশান্তি আর অশান্তি। নেই বনিবনা। তাই আমি চাচ্ছিলাম,,,,,,

‘আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিতে।’ তাই তো?’

মাহমুদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোট্ট ডাইনিং রুমটায় ছোটখাটো বিস্ফোরণ ঘটায় তনয়া।

মাহমুদের বিমূঢ়, নির্লিপ্ত চাহনি। অনুভূতিশূন্য, গভীর চোখ জোড়া তনয়া তে নিবদ্ধ। তনয়া দুই ভ্রু সমানতালে নাচায়। রসিকতার সুর টানে গলায়।

‘তা কবে দিচ্ছো ডিভোর্স?’

মাহমুদ তখনও শূন্য দৃষ্টিতে তনয়ার দিকে চেয়ে আছে। চোখেমুখে এক আকাশসম অসহায়ত্ব।

‘আহ্! দুইজন কি শুরু করলি? মাহমুদের মতো তুমিও পাগল হয়ে গেলে নাকি তনু মা?’

তনয়া মুচকি হাসলো। বাটি থেকে এক চামচ লালশাক তুলে দিলো খালেকুজ্জামানের প্লেটে।

‘শুধু অশান্তিই যেহেতু হচ্ছে সংসারটা টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে আব্বা? তার চেয়ে ভালো না,,,’

খালেকুজ্জামান ব্যথিত স্বরে জবাব দেন,

‘সংসার ছেলেখেলা নয় মা। ঝগড়া থামাও আর খেতে বসো।’

‘ছেলেখেলা নয় তো আব্বা। তবে একটা সংসারে থাকতে গেলে মিলেমিশে থাকা যেমন জরুরি তেমনি মতের মিল থাকা আর মনের মিল থাকাও জরুরি।’

তনয়া চেয়ার টেনে বসে। মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তোমায় লালশাক দিবো?’

বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ায় মাহমুদ।

‘লালশাকে কিন্তু জলপাই দেওয়া। আগেই বলে দিলাম। পরে নাক সিটকাতে পারবে না।’

‘সমস্যা নেই।’

খাওয়া শুরু হলো। থেমে যায় আলোচনা। মেহেরুন্নেসা রাগে ফুঁসছেন। তিক্ত কিছু বলার আগে আলোচনা বন্ধ হওয়ায় ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। কোনো ছুঁতোও খুঁজে পাচ্ছেন না তনয়াকে কথা শুনানোর। অপেক্ষায় রইলেন বন্ধ হওয়া আলোচনা আবারও শুরু হওয়ার জন্য।

খালেকুজ্জামান লালশাকের বাটি টা কাছে আনলেন। আরো এক চামচ লালশাক ভাজি তুলে নিলেন নিজের প্লেটে। সাদা ভাতের সাথে লালশাক মাখাতেই মনে হলো ভাতগুলো র*ক্তস্নান করেছে। তৃপ্তি নিয়ে ভাতের লোকমা মুখে দিলেন তিনি।

‘মাহমুদের সাথে তোমার মতের মিল হয় না এ কথা তুমি গলায় ছু*রি ধরে বললেও বিশ্বাস করবো না। মান অভিমান হবেই। তবে আগপাছ না ভেবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি।’

তিনি স্নেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকালেন তনয়ার দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে করলেন সতর্ক।

‘নিজেদের ভেতরকার মনোমালিন্য ওই দরজার পিছনেই রাখো মা। দরজা ভেদ করে সেই মনোমালিন্য সকলের দৃষ্টিগোচর হলেই কেউ না কেউ এর সুযোগ নিতে চাইবে। আর হ্যা লালশাক ভাজি অনেক মজা হয়েছে।’

‘তুমি ওদের মধ্যে নাক গলাচ্ছো কেন মাহমুদের আব্বা?’ কথা শুনানোর সুযোগটা আসতেই যেন হামলে পড়লেন মেহেরুন্নেসা। মুখের খাবারটুকুও শেষ করলেন না।

খাওয়া থামিয়ে চোখ তুলে তাকালেন খালেকুজ্জামান।

‘আমার ছেলেটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে দেখেছো? মানসিক অশান্তিতে আছে। আমি মা। আমি বুঝি।’

লালশাকের শেষ অংশটুকু দিয়ে ভাত মেখে মুখে পুরে নিলেন তিনি। মুখটাকে করে ফেলেন বিকৃত। যেন জঘন্য কিছু না চাইতেও খাচ্ছেন।

‘তুমি স্বাদের কি বুঝো? কোনোদিন শুনেছো জলপাই দিয়ে লালশাক ভাজি করে? যা তা রান্না করে আর আমাদের মুখ মুখ বন্ধ করে খেতে হয়।’

‘এতোক্ষণ তো দিব্যি খাচ্ছিলে।’

থতমত খেয়ে গেলেন তিনি। ধরে পড়েও পড়তে চান না।

‘আমি কখনো এসব রান্না করেছি? না তোমার মা এসব রান্না করেছে?

খালেকুজ্জামান বিড়বিড় করে আওড়ালেন,

‘দুই দিন পর পর ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেলে দেখবে কিভাবে?’

কথাটা মেহেরুন্নেসার কান অব্দি না পৌঁছালেও তনয়া ঠিকই শুনে ফেলে। তবে বুঝতে দিলো না কাউকে।

‘মুনিরাও খেতে পারছে না এসব দিয়ে। প্লেটের ভাত একটাও নড়েনি। আর মাহমুদের প্লেটটার দিকে তাকাও একবার।’

মায়ের কথায় তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল মুনিরার। ভাতের লোকমাটা মুখের কাছে নিয়েও রেখে দিলো প্লেটে। তাকালো অসহায় চোখে।

টেবিলে নিচ দিয়ে মাহমুদের পায়ে আঙুল দিয়ে স্লাইস করে তনয়া। মাহমুদ বুঝতে পারলেও তাকালো না। মাথা নুইয়ে দৃষ্টি স্থির রাখে ভাতের প্লেটে। প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আবারও স্লাইস করে পায়ে। গোপন বার্তাটুকু চোখে চোখে দিতে চাচ্ছে সে। মাহমুদ তাকাতেই তনয়ার চাহনি সরু হয়। এক ভ্রু উঁচিয়ে কিছু একটা বুঝাতেই মাহমুদ চোখের ইশারায় বারণ করলো। তনয়া শুনলো না সে বারণ।

‘যারে দেখতে নারি। তার চলন বাঁকা।’ প্রবাদ টা আওড়ে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দেন খালেকুজ্জামান

নেকা সুর টানে তনয়া।

‘মুনিরা? তুমি লালশাক দিয়ে খেতে পারছো না? থাক কষ্ট হলে খাওয়ার দরকার নেই।’

‘ না না আমি খেয়ে নিচ্ছি ভাবি। খাবার নষ্ট করা ঠিক না।’

‘ওমা নষ্ট হবে কেন। আমি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি বরং ওই বাটিতে রাখা গরুর গোশত দিয়ে খাও।’

টুক করে মুনিরার প্লেটের শাক টুকু নিজের প্লেটে নিয়ে নিলো সে।

মেহেরুন্নেসা যেন আরো একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। গরুর গোশত না চেখেই বলে ফেললেন,

‘গোশত আদৌও খাওয়ার মতো? কৌটার সব নূন একেবারে ঢেলে দিয়েছে। ঝাল আর নূনের জন্য মুখেই নেওয়া যাচ্ছে না।’

খালেকুজ্জামান বিরক্ত হলেন। ত্যক্ত স্বরে বলেন,

‘মাহমুদের মা হয়েছে তো। একদিন রান্নায় একটু ঊনিশ বিশ হয়। তোমার হতো না? খেয়ে নাও।’

তনয়া ব্যাপারটা হজম করতে পারলো না। স্পষ্ট তার মনে আছে সবকিছু পরিমাণ মতো দিয়েছে। তবে কি কেউ অতিরিক্ত লবন আর ঝাল মিশিয়েছে? সে সন্দিহান নজরে তাকালো মেহেরুন্নেসার দিকে।

‘মুনিরা একটু তরকারি নিয়ে দেখো সব ঠিক আছে কি না। আমি তো সব পরিমান মতোই দিলাম।’

‘না আমি তো মিথ্যুক। মিথ্যে বলছি। কোনদিন জানি খাবারের নামে বি*ষ খাইয়ে দেয় আল্লাহ জানে।’

‘আহ্! মাহমুদের মা। থামবে তুমি?’

মুনিরা এক টুকরো গোশত মুখে নিলো। পাশ থেকে মেহেরুন্নেসা তাকে চিমটি কাটে। ইশারা বুঝতে পেরে সে মুখটা বিকৃত করে ফেলে। মুখ থেকে গোশতের টুকরো টা ফেলে দিয়ে এমন ভাব করলো যেন ঝালে ম*রে যাচ্ছে।

এক টুকরো গোশত মাহমুদের প্লেটে দেয় তনয়া।

‘খেয়ে দেখো তো একটু। আমি তো সব ঠিক ঠাকই দিলাম।’

মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরো একটা অশান্তির আগাম পূর্বাভাস সে পাচ্ছে। যত চায় এই দ্বন্দ্ব, অশান্তি কমুক ততই যেন বেড়ে চলেছে। গোশতের টুকরোটা মুখে দিতে দেরি আর মেহেরুন্নেসা আহাজারি করতে দেরি হলো না।

‘আহারে ঝালে কেমন চোখমুখ লাল গেলো ছেলেটার। নে বাবা আগে একটু পানি খা।’

পানি গ্লাসটা ধরলেন মাহমুদের মুখের সামনে। মাহমুদ বোকা বনে গেলো। অবাক চোখে তাকালো তার মায়ের দিকে। সে নিজেই তো এখনো ভালো করে গোশতের স্বাদ বুঝতে পারলো না। এইদিকে তার মা তার মুখের স্বাদ টের পেয়ে গেলো? মায়ের প্রতি থাকা বিশ্বাসটা যে তিনি নিজেই অবিশ্বাসে রূপান্তর করবে তা মাহমুদ কখনো কল্পনাও করেনি। সে তনয়ার কাছে বাজে ভাবে হেরে গেলো। সে কেবল তনয়ার কাছেই হারেনি হেরেছে নিজের কাছেও।

‘তরকারি কি আসলেই অনেক ঝাল হয়েছে মাহমুদ?’

মাহমুদ উত্তর দিলো না। উত্তর না পেয়ে তনয়া নিজে একটু তরকারি চেখে দেখলো। সব ঠিক মনে হওয়ায় এক চামচ দিলো খালেকুজ্জামানের প্লেটে ।

‘আব্বা আপনি একটু খেয়ে দেখেন তো। আমার তো সবকিছুর পরিমাণ ঠিকঠাকই লাগছে।’

‘দেখ বাবা দেখ। তোর বউ আমাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার জনে জনে খাইয়ে জিজ্ঞেস করছে। কেন আমি কি ঝাল আর নূনের মাপ বুঝি না?’

‘ কুটাবাছা থেকে শুরু করে আগুনের তাপে পুড়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমি রান্না করেছি। আমি জানি কোনটা কি পরিমানে দিয়েছি। আপনি যখন ভুল ধরেছেন তো দেখবো ওটা আসলেই ভুল কিনা।’

মেহেরুন্নেসা বিলাপ শুরু করলেন। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন,

‘রান্না কেমন হয়েছে আমি কি সেটা বলতেও পারবো না? এটা আমার অন্যায়? দেখ তোদের সামনেই তোর বউ আমার সাথে ঝগড়া করছে। আর তোরা না থাকলে তো।’

‘রান্না তো ঠিকই আছে। আর এমন ঝাল তো আমরা সব সময়ই খাই। আর গোশতে একটু আধটু ঝাল না হলে মজা লাগে নাকি?’

‘তুমি তো বলবেই। বশ করে রেখেছে যে।’

‘আব্বা তরকারির সব ঠিকঠাক তো?’

খালেকুজ্জামান সম্মতি জানাতেই তনয়া রান্নাঘর থেকে গিয়ে তরকারির পাতিল নিয়ে এলো। নিজেদের জন্য খানিক তুলে রেখে বাকি তরকারিতে এক গ্লাস পানি ঢেলে দেয়।

‘এবার গোশতে নূন আর ঝালের পরিমাণটা ঠিকঠাক হবে। আপনারা তিনজন এইবার বরং তৃপ্তি করে খান। আমরা শ্বশুর বউ না হয় এই জঘন্য তরকারি দিয়ে খেয়ে নিবো।’

চলবে।