#সংসার_সমরাঙ্গন (০৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
তনয়া পাশ ফিরে শোয়ার চেষ্টা করতেই ব্যথা অনুভব করলো ঘাড়ে আর কাঁধে। তবুও সে পাশ ফিরতে পারলো না। মনে হলো কেউ তাকে খুব শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। হঠাৎ কিছু অনুভব করে চমকে ওঠে তনয়া। মাহমুদের অস্তিত্ব, পরিচিত গায়ের গন্ধ। ঝট করে চোখ মেলে তাকালো সে। রাতের অভিমান আরও গভীর হলো তার। রাতে খুব করে চাইছিলো মাহমুদ সামান্য আহ্লাদ দেখাক। হয়তো সব ভুলে যেত সে। কিন্তু খামখেয়ালি সেই আশা পূরণ করলো না। অভিমানের ভারে জ্বলতে জ্বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, বুঝতেই পারেনি।
বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতেই মাহমুদের ঘুম ভেঙে যায়। তার দিকে তাকিয়ে মাহমুদ চমৎকার হেসে মাথাটা বুকের ওপর চেপে ধরে। প্রেমালিঙ্গণে মুহূর্তেই তার অভিমান গলে জল যায়। অনুভব করতে লাগলো প্রিয় মানুষটার স্পর্শ।
আমি তো নিচে শুয়ে ছিলাম। উপরে আনলে কেন?’
মাহমুদ মাথায় আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘বউ ছাড়া ঘুম আসে না। অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি ঘুমাবে আর আমি,,,
তনয়া সরে যেতে চাইলে দেখে, তার বালিশ নেই। দেখি ছাড়ো, বালিশটা নিয়ে আসি।’
‘আমার হাতেই মাথাটা রাখো না। এতে আমি তৃপ্তি পাই।’
তনয়া মলিন হেসে বলল, ‘তোমার কাছে যা তৃপ্তি, আমার কাছে সে জায়গাটা বড় নড়বড়ে।’
_______________________
তনয়া ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সিংক এঁটো থালা-বাটি। সাতসকালে এমন দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে তার, তাই সবসময় রাতে পরিষ্কার করে রাখে। তরকারির হাড়ির ঢাকনা খুলে দেখে, মাত্র দুটো আলুর পিস, একটু ঝোল, আর হাড়ের অংশ পড়ে আছে। তাতে থেকে আসছে এক উদ্ভট গন্ধ। কেন আসছে খুব ভালো করেই জানে সে। ভাতের পাতিলে ঢাকনা নেই। অবশিষ্ট ভাতের উপর তেলাপোকা ঘাপটি দিয়ে বসে আছে।
তাকে নাস্তানাবুদ করতে মা-মেয়ের এগুলো করেছে বুঝতে পেরে মলিন হাসি ফুটলো তনয়ার মুখে। ভেবেছিলো লাঞ্চে মাহমুদ কে গোশত দিবে। কিন্তু তা আর হওয়ার নয়। বাকি অপশন ডিম ভাজি। ভাত-ডাল বসিয়ে নাক-মুখ চেপে থালাবাটি পরিষ্কার করল।
এরপর পেঁয়াজ-রসুন বের করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে, ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।
তনয়া নিজের রুমে যায়। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মাহমুদ। তার এলোমেলো চুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে তনয়া। আলতো স্বরে ডাকলো,
‘শুনছো?’
ডাকটা মাহমুদের শ্রবণগোচর হলো না।
অপলক দৃষ্টিতে মাহমুদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তনয়া। খানিক ঝুঁকে কোমল ঠোঁটের ছোঁয়া এঁকে দিলো মাহমুদের কপালে।
মাহমুদ পিটপিটিয়ে চোখ মেলল। তনয়ার একটা হাতটা বুকে জড়িয়ে আবারও ঘুমের প্রস্তুতি নিতেই তনয়া বলে,
‘আজ লাঞ্চে ডিম ভাজি আর ডাল দিলে হবে?’
মাহমুদ ঘুম জড়ানো গলায় জবাব দেয়,
‘তুমি যা দিবে তাতেই হবে।’
হাত ছাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় তনয়া। যাওয়ার আগে মাহমুদ কে দিয়ে যায় হুমকি।
‘তুমি আর আধঘন্টা ঘুমাতে পারবে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না করেই চলে যাও। আজ শুধু বলে দেখো সময় নেই। তারপর দেখো আমি কি করি।’
মাহমুদ তনয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে।
‘জো হুকুম মহারানী।’
______________
সকালে নাস্তা সেরে মাত্রই রুমে গেলো মাহমুদ। তনয়া তখনও টেবিলে সবাইকে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো আর নিজেও নাস্তা করছিলো।
খাওয়া শেষ হতেই তনয়ার ডাক পড়লো। হাত ধুয়ে রুমে যায় সে। মাহমুদ হাতে ঘড়ি পড়ছে।
‘মানিব্যাগ টা কোথায় রাখলাম খুঁজে পাচ্ছি না।’
ড্রয়ারের ভেতর থেকে মানিব্যাগ বের করে মাহমুদের হাতে দিলো সে।
‘আর কিছু?
‘কোট টা।’ মাহমুদের ঠোঁটে লেগে আছে এক চিলতে হাসি।
মাহমুদ কে কোট পড়িয়ে দেয় তনয়া। বেজে উঠল কলিংবেল।
‘এই সময় আবার কে এলো?’
‘ময়লা নিতে এসেছে হয়তো। দাঁড়াও আমি দেখে আসি।’
দরজার দিকে বাড়াতেই হাতে টান পড়ে তনয়ার। পিছু ফিরে তাকালো সে। চোখের ইশারায় কারণ জানতে চাইলেই মাহমুদ জবাব দেয়,
‘সময় নাই আগে আমার কাজটা করতে দাও।’
তনয়ার মুখে এক টুকরো উজ্জ্বল হাসি ফোটে উঠলো। তনয়ার কপালের ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দেয় মাহমুদ। এক হাতে কোমর চেপে দুজনের মধ্যকার দৃশ্যমান দূরত্ব মিটিয়ে নিলো।
তনয়ার কপালে মাহমুদের ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করে মাত্রই তখন দরজা ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকে যায় মুনিরা। ছিটকে দুজন দূরে সরে যায়। তনয়া থতমত চোখে তাকিয়ে আছে।
মোবাইল পকেটে নিয়ে মাহমুদ বলে,
‘কারো রুমে নক করে ঢুকা এক ধরনের অভদ্রতা। আমার জানামতে এমন অভদ্রতা তোকে শিখাইনি।’
মাহমুদ রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তনয়াও ছুটলো তার পিছু পিছু।
মাহমুদের কথাটা হজম করতে পারলো না মুনিরা। সাপের মতো ফুঁসতে লাগলো।
‘কোথায় তোমার ছেলের বউ কোথায়?’
‘আরে আপা তুই এতো সাতসকালে?’
মাহমুদের কথায় তেড়ে আসে সুমনা।
‘কেন সাতসকালে এই বাসায় আসা কি আমার নিষেধ? তোর বউ কি নতুন নিয়ম করেছে?’
‘আজব! প্রশ্ন করলাম আমি। এখানে তনয়াকে টেনে আনছিস কেন?’
‘তোর বউয়ের নাম নিলাম বলে কি অন্যায় করে ফেললাম? মাফ চাইতে হবে?’
মাহমুদের পিছনে তনয়া এসে দাঁড়াতেই তেড়ে যায় সুমনা।
‘আমার মায়ের সাথে বেয়াদবি করার সাহস তোমায় কে দিলো।’
মেহেরুন্নেসা এক কোণায় দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছেন। চিৎকার চেঁচামেচিতে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন খালেকুজ্জামান।
‘আপা মাথা ঠান্ডা করেন। সকালে আসছেন আগে নাস্তা করে নিন।’
‘কিসের নাস্তা? তোমার হাতের নাস্তা খাওয়ার জন্য আমি এসেছি?’
‘দেখ মা দেখ তুই আসাতে কেমন মিনমিন করছে এখন। কিন্তু রাতে মুখ দিয়ে যেন খই ফুটছিলো।’
তনয়া ঝামেলা এড়াতে চাইলো। মাহমুদের অফিস যাওয়ার আগে কোনোরকম তর্ক বিতর্কে জড়াতে চায় না সে।
‘আপা আপনার ভাই এখন অফিসে যাবে। আমরা এগুলো নিয়ে পরে কথা বলি?’
‘ আমাকে এখনই কৈফিয়ত দিতে হবে তোমার। আমার ভাইকে হাত করে কি ভেবেছো? আমার মায়ের আগেপিছে কেউ নেই।’
তখনই কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে সামনে এসে দাঁড়ায় মুনিরা।
‘ আপা আমি নাকি অভদ্র।’
বলেই সুমনা কে জড়িয়ে মুনিরা। কান্না বেগ বাড়লো তার।
‘আপারে এই বাসায় মায়ের তো দাম নেই নেই। সাথে আমারও নেই। আমাদের তোর সাথে নিয়ে চল।’
মুনিরার কান্না আগুনে ঘি ঢেলে যেন আগুনের উত্তাপ আরো বাড়িয়ে দিলো।
‘তুমি আমার বোনকে অভদ্র বলেছো?’
‘আমি বলেছি।’ পাশ থেকে বলে উঠে মাহমুদ।
সুমনা ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কেন?’
‘কারণ তোর বোন অভদ্রের মতো কাজ করেছে।’
‘তোর বউ তোকে বড্ড ভদ্রতা শিখাচ্ছে? কই আগে তো মনে হয় নি আমার বোন অভদ্র। বড্ড সভ্য হয়েছো না? চড়াতে চড়াতে সভ্যতা একদম ঘুচিয়ে দিবো তোমার।’
এতক্ষণ যাবৎ চুপ থাকলে ধমকে উঠলেন খালেকুজ্জামান,
‘সকাল সকাল কি শুরু করলি সুমনা? ছেলেটা অফিস যাবে তো।’
‘এই আপনি।’
খালেকুজ্জামানের দিকে আঙুল তাক করে সুমনা।
‘আপনি কোনো কথা বলবেন না। যখন এই ফাজিল মেয়েটা খাবারে পানি ঢেলেছিল তখন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। আপনার স্ত্রী কন্যা অভুক্ত আর আপনার লজ্জা করেনি গোগ্রাসে গিলতে?’
খালেকুজ্জামান চমকে উঠে মেয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। এই বয়সে মেয়ের এতোটা অধঃপতন? ঠিক ভুল যাচাই না করে এখনই মেয়ে তাকে শাসাচ্ছে? তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন একেবারে।
নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও শেষের কথাটায় আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না তনয়া। রাগে উত্তাল হয়ে উঠে সে,
‘এটা ভদ্রলোকের বাসা। অসামাজিক, অভদ্র মানুষের মতো সাতসকালে চেঁচামেচি করবেন না।’
‘আমাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছো তুমি। আমাকে?’
‘আপনি অভদ্র হলে অবশ্যই আপনাকে ভদ্রতা শিখাবো। মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসবেন। আদর আপ্যায়ন করবো। মাথায় তুলে রাখবো। সম্মান দিচ্ছি সম্মানের জায়গায় থাকুন। সত্য মিথ্যা যাচাই না করে এমন উগ্র আচরণ করলে ফল ভালো হবে না। আপনার নিজের একটা সংসার হয়েছে মানেই আপনি আমার সংসারের তৃতীয় ব্যক্তি।’
#চলবে।