সংসার সমরাঙ্গন পর্ব-০৪

0
2

#সংসার_সমরাঙ্গন (০৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘মাহমুদ তোর বউ এটা আমাকে কি বললো? আমি এই সংসারের তৃতীয় ব্যক্তি? তোকে কোলেপিঠে মানুষ করার ফল বুঝি এইটা? উত্তর দিচ্ছিস না কেন তুই?’ শেষের কথায় চিৎকার করে উঠে সুমনা।

ছুটে গেলো সে খালেকুজ্জামানের কাছে।

‘আব্বা আপনার সামনে আপনার ছেলের বউ আমাকে এতোগুলো কথা শুনালো। আপনি কিছু বলবেন না? আমি এতোটাই পর হয়ে গেলাম আপনাদের?’

খালেকুজ্জামান কাতর চোখে তাকালেন। ম্লান হেসে জবাব দেন,

‘আমার সন্তান যে কিছু যাচাই না করে আমায় কথা শুনালো এর বিচার আমি কার কাছে চাইবো মা?’

সুমনার মাথা আপনা-আপনি নিচু হয়ে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন খালেকুজ্জামান। এখানে আর দাঁড়ালেন না। পা বাড়ান নিজের কক্ষের দিকে।

‘আপা দেখলি তো সব। এবার বুঝলি তো আমরা দুইজন এই বাসায় কিভাবে আছি?’

‘কিভাবে আছো মুনিরা।’ কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়লো তনয়া। রক্তচক্ষু তার।

তীব্র গতিতে এগিয়ে এলেন মেহেরুন্নেসা। দাঁত চেপে ক্ষোভ দমন করেন তিনি।

‘তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমি। আজই তোমার মাকে খবর পাঠাবো। মেয়ে কি বিয়ে দিয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে এসে অশান্তি করার জন্য? দেখি, তিনি কী জবাব দেন।’

‘এইসবের সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক কী? আমার মাকে টেনে আনছেন কেন?’

মাহমুদ সজোরে সোফার পায়ায় লাথি মা*রে। গায়ের কোটটা খুলে ছুঁড়ে মা*রে মেঝেতে।

‘উত্তরটা পেয়েছো তনয়া, কেন আমি ভালো মন্দ কিছু বলি না? তোমার হয়ে যদি আমি দুই কথা বলি এমন অশান্তি প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় হবে। অশান্তির ভয়ে খারাপ লাগা সত্বেও আমি চুপ করে থাকি।’

________________

বিষন্ন মুখে জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তনয়া। খোলে রাখা চুলগুলো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। গ্রিল ভেদ করে আসা সোনালী আভা উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার দেহে। আচমকা তনয়ার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। হাহাকার করে উঠে হৃদয়ের গভীরে। চোখের পাতা গলগল করে। মানসিক টানাপোড়েন এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে হয়তো মায়ের কোলে মাথা রাখলে শান্তি পেতো। মানিয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সমস্ত যন্ত্রণা চেপে রাখলো মনে। বুক বেয়ে নির্গত হয় দীর্ঘশ্বাস।

‘অফিসে গেলেই পারতে। শুধু শুধু বাসায় রয়ে গেলে।’

কপাল থেকে হাত সরায় মাহমুদ। জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলো তনয়ার বিধ্বস্ত মুখে দিকে। তনয়ায় বিমর্ষতায় বুকটা জ্বলে উঠে তার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। দরজা চাপিয়ে তনয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়।

তনয়া মাথা রাখে মাহমুদের বুকে। যেন তার সমস্ত অস্তিত্ব মিশে গেলো মাহমুদের উষ্ণতায়। আগলে নিলো মাহমুদ। আদরে স্পর্শে নেতিয়ে পড়লো তনয়া। ফুঁপিয়ে উঠলো সে।

‘মায়ের কানে এসব কোনোভাবেই না যায়। মা এমনিতেই অসুস্থ। অশান্তির কথা জানলে তার অসুস্থতা আরও বেড়ে যাবে। আমার একটু কিছু হলে মা এমনিই পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন।’

তনয়ার মাথায় হাত রেখে ভারী নিঃশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ।

‘প্রত্যেকটা বিবাহিত পুরুষের স্বপ্ন কি জানো?’

তনয়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায় নীরবে। মাহমুদ হাতের আঁজলে তুলে নেয় তনয়ার মুখের আদল, যেন তাকে পুরোপুরি ধারণ করতে চায়। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া আলতো করে ছুঁয়ে যায় তনয়ার কপাল।

‘এটা বিবাহিত পুরুষদের স্বপ্ন?’

মৃদু হেসে অসম্মতি জানায় সে।

‘প্রত্যেকটা বিবাহিত পুরুষের স্বপ্ন হলো, মা আর বউকে একসাথে হাসতে দেখা।’

‘আদৌও সম্ভব এটা?’

‘হয়তো। হয়তো আবার না।’

মাহমুদ পুনরায় বলে,

‘আমার উপর তোমার অনেক অভিমান তাই না?’

তনয়া মাথা নুইয়ে ফেলে। মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে হতাশা আর আফসোস যেন ছুটে পালিয়ে গেলো কোথাও। নিষ্প্রভ হাসলো সে।

‘খাবার টেবিলে ভুল ধরার বদলে খুনসুটি হবে। আম্মার প্লেটে তুমি মাছের বড় টুকরোটা তুলে দিলে উল্টো আম্মা তোমার প্লেটে দিয়ে বলবে, “আমি তো অনেক খেলাম এখন তুমি খাও।” তোমার আর আমার মধ্যে টুকটাক ঝামেলা হলে আম্মা আমাকে শাসন করবে। তেড়ে আসবে মা*রার জন্য।’

চুপ হয়ে যায় মাহমুদ। তনয়াকে পাশ কাটিয়ে জানালা ঘেঁষে দাঁড়ায়।

‘এমন দৃশ্যের অপেক্ষায় আমি চুপ থাকি। ভেবেছিলাম আমাদের নিরবতা আমার চাওয়ার পথটাকে সুগম করবে। কিছু যদি বলি তাহলে তোমার প্রতি আম্মার তিক্ততা বাড়বে। তারা ভাববে তুমি আমাকে বশ করে নিয়েছো। তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ো নিচ্ছো। অশান্তি হবে। আজকের সকাল টা এর উদাহরণ।’

‘তিক্ততা কি কমেছে?’

মাহমুদ জবাব দিতে পারে না। নিরবতার চাদরে আড়াল করে নিলো নিজেকে।

‘নরম হয়ে তো দেখলে। এখন একটু প্রতিবাদ করে দেখো। যখনই ভুল করবে তখনই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে। দেখো ভুল বুঝতে পারে কিনা।’

‘কাল অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে তোমার সাথে বাজি ধরে ছিলাম। বাজিতে কেবল আমি তোমার কাছেই হারিনি। হেরেছি নিজের কাছেও।’

‘আমি সবাইকে নিয়ে আমার সংসার সাজাতে চাই মাহমুদ। এটাও চাই আম্মা উপলব্ধি করুক এতোদিন যা করেছে সব ভুল।’

খানিক চুপ থাকে তনয়া। এরপর,

‘মাহমুদ?’ বলে করুণ স্বরে ডাকে।

‘হুম।’

‘আমি বড় আপার সাথে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি তাই না? আমার ওমন করে বলা একদম উচিত হয়নি।’

‘জানি না।’

‘চলো আপার কাছে ক্ষমা চাইবো।’

চোখ বড় বড় তাকায় মাহমুদ। কান চুলকে বলে,

‘আমি কি ভুল শুনলাম?’

‘ভুল শুনোনি। আমি আপার কাছে মাফ চাইবো। তবে একটা শর্তে।’

_____________

মেহেরুন্নেসার বুকে মাথা রেখে অনবরত কেঁদে চলেছে সুমনা। মেয়ের পিঠে মাথায় সমানে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তিনি।

‘পরের মেয়ে আমার আব্বার এতো আপন হয়ে গেলো আম্মা?’

‘আম্মা তোকে কি বলবে রে আপা। আব্বা তো আম্মার হয়েই কিছু বলে না।’

মেহেরুন্নেসা চুপ করে কেবল শুনেই গেলেন। নিজের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলো না। কিন্তু তার মনের ভেতর যেন এক তীব্র ঝড় বয়ে চলেছে। বুকের গভীরে জমে থাকা পুরনো ক্ষোভ হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার মনের অলিগলি রাগে-ক্ষোভে থরথর করে কাঁপছে। এই নীরবতা যেন তার ভেতরের অগ্নি ঠিকরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ, বাইরে থেকে তাকালে মনে হয়, তিনি স্থির—একদম চুপ। তার চোখে ক্ষণিকের জন্য আগুন জ্বলে উঠলেও, তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। তবু তার থমথমে মুখ বলছে, এই নীরবতা আসলে ঝড়ের আগে যে ভয়াল শান্তি, সেই রকম কিছু।

‘আম্মা ভেতরে আসবো?’

মাহমুদের ডাকে নড়েচড়ে বসলো সকলে। মুনিরা মুখ ভেঙচি দিয়ে খাটের কোণায় গিয়ে বসে। আবারও ডাকলো মাহমুদ,

‘আম্মা?’

মেহেরুন্নেসা থমথমে গলায় জবাব দিলেন,

‘আয়।’

তনয়াকে সাথে নিয়ে রুমে ঢুকে মাহমুদ। চোখের পানি মুছে ঝট করে মাথা তুলে তাকায় সুমনা। রুক্ষ স্বরে বলে,

‘আবারও এসেছিস কথা শুনাতে? তখন তোর বউ কিছু বলতে ভুলে গিয়েছিলো?’

‘তনয়া ক্ষমা চাইতে এসেছে।’

‘তোর বউ আর ক্ষমা? আম্মার সাথে যে বেয়াদবি করেছে সেটার জন্য ক্ষমা চেয়েছে? নাকি তুই জোর করে নিয়ে আসলি।’

‘জোর করে আনিনি। নিজে থেকেই এসেছে।’

‘কে তোমার বউ?’ তিরস্কার করে মুনিরা।

‘আপার কাছে ক্ষমা চাও।’

তনয়া একচুলও নড়লো না হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়।

‘কি হলো যাচ্ছো না কেন?’ ধমকে উঠল মাহমুদ।

‘তোর বউ না নিজে থেকে এসেছে। এই তার নমুনা।’

‘ক্ষমা আমি চাইবো। তবে শর্ত আছে আমার।’

‘আজকাল মাফ চাইতে আসলে শর্তও লাগে নাকি? জানতাম না তো।’ কটাক্ষ করলো সুমনা।

‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাগে।’

‘কি বলতে চাইছো তুমি।’

‘আমি যেমন আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি তেমনি আপনাকে বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আফটার অল দুজনেই ভুল করেছি।’

তেতে উঠে সুমনা। দাঁত কিড়মিড় করে বলে।

‘ওটা আমার আর বাবার ব্যাপার। নাক গলানোর তুমি কে?’ এই সাহস তোমায় কে,,,,

আরো কিছু বলতে চাইলে সুমনার হাত চেপে ধরেন মেহেরুন্নেসা। চোখের ইশারায় আশস্ত করলেন। এবং বললেন চুপ থাকতে। শীতল কন্ঠে বলেন,

‘তোমার যদি শর্ত থাকে তো শর্ত আমাদেরও আছে।’

‘কী শর্ত?’

‘ক্ষমা তোমাকে চাইতে হবে সুমনার পায়ে পড়ে।’

#চলবে