#সংসার_সমরাঙ্গন (০৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
খালেকুজ্জামান গভীর বিষণ্নতায় নুয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, তার হাত-পা যেন ব্যর্থতার অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা। মেয়ের আচরণ আজ তার মনে চরমভাবে আঘাত হেনেছে। বাবার মমতা, যত্ন আর আত্মত্যাগের মূল্য এভাবে ফিকে হয়ে যাবে , তা তিনি কল্পনাও করেননি। বার বার বাজছে কথাগুলো। মনের ভেতরটা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে, ক্ষতচিহ্ন রেখে যাচ্ছে প্রতিটি শ্বাসে। তপ্ত অঙ্গারে রূপ নিচ্ছে পিতৃ অনুভূতি। তিনি চোখ বুঁজে নিলেন। পয়ত্রিশ বছর আগে সৈনিকের পোশাক পড়া সেই তাগড়া খালেকুজ্জামানের প্রতিচ্ছবিই যেন ভেসে উঠলো চোখেমুখে।
নব্বই এর কথা মনে পড়তেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে খালেকুজ্জামান এর। সেইবার স*ন্ত্রা*সী দমন অভিযান পরিচালনার জন্য অস্থায়ী ফিল্ড ক্যাম্প স্থাপন করেছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামে। সুমনা সবে আধো আধো বুলিতে বাবা বলতে শিখেছে। ক্যাম্পে আসার দিন পনেরো আগেই ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছেন তিনি। ছুটি শেষে মেয়েকে মায়ের কোলে দিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যখন পা বাড়িয়ে ছিলেন কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো তার। বার বার চোখ ভিজে উঠছিলো। পিছু ফিরে তাকিয়েছে বারংবার। যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো ততক্ষণ কেবল মেয়েকেই দেখে গিয়েছেব। ক্যাম্পে আসার পরও মন পড়ে থাকতো মেয়ের কাছে। এখানকার মতো তখন যোগাযোগের এতো উন্নত মাধ্যম ছিলো না। যেদিন স*ন্ত্রা*সীদের সাথে তাদের ব*ন্দু*ক যু*দ্ধ হয় সেদিন সহকর্মীকে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি যদি ম*রে গেলে আমার লা*শের সাথে তুমিও যেয়ো। আমার মেয়েটাকে বলো তার বাবা তাকে ভীষণ ভালোবাসে।’
‘আব্বা?’
সেই আধো বুলি যেন কানে এসে ঠেকলো আবারও। বুকটা ধক করে উঠে তার। তিনি চট করে চোখ মেলে তাকালেন। করুণ স্বরে বলেন,
‘কে? আমার সুমু?’
পরক্ষণেই তিনি নড়েচড়ে বসেন। নিরেট গলায় বলেন,
‘বলো।’
সুমনা সামনে এলো। ভনিতা না করে বলে,
‘তখন আমার ওভাবে আপনাকে বলা ঠিক হয়নি। আমাকে ক্ষমা করবেন।’ বলেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত সুমনাকে পর্যবেক্ষণ করেন খালেকুজ্জামান। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন,
‘তুমি আসলেই অনুতপ্ত? চোখ তো তা বলছে না।’
তৎক্ষনাৎ মাথা নুইয়ে ফেলে সুমনা। রইলো নিশ্চুপ। খালেকুজ্জামান ফের বলেন,
‘তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। বাবা মা কখনো সন্তানের উপর রেগে থাকে না।’
সুমনা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো নিরবে।
‘আর কিছু বলবে?’
সে এপাশ ওপাশ মাথা দুলায়।
‘তবে তুমি যেতে পারো। আমি একটু ঘুমাবো।’
___________________
সুমনা ডয়িং রুমে পা রাখতেই মেহেরুন্নেসা বলে উঠেন,
‘সুমনা তার বাবার কাছে মাফ চেয়েছে। এবার তোমার পালা। আমার মেয়ের পা ধরে মাফ চাও।’
পায়ে ধরার প্রস্তুতি নিতেই তনয়ার হাতটা ধরে ফেলে মাহমুদ। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করতেই মাহমুদ মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়।
‘এটা শর্তে ছিলো মাহমুদ।’
‘তো?’
‘তো মানে? শর্ত পূরণ করতে দাও।’
তনয়া আবারও সুমনার পায়ে ধরতে নিলে মাহমুদ দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
‘তুমি শর্ত পূরণ করতে চাও আর আমি তোমাকে আদেশ দিলাম তুমি আপার পায়ে হাত দিবে না।’
তনয়া অবাক চোখে তাকাতেই মাহমুদ পুনরায় বলে,
‘প্রতিবাদ না করতে পারি তবে এতোটাও অপদার্থ হয়ে যাইনি আমার সামনে আমার স্ত্রী একজনের পা ধরে ক্ষমা চাইবে আর আমি সং এর মতো দাঁড়িয়ে থাকবো।’
‘দেখ দেখ আমার ছেলেরে কেমনে বশ করছে। তাবিজ করছে আর কিছু না। আমার সন্তান আর আমার নাই।’
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আহাজারি শুরু করলেন মেহেরুন্নেসা। মাহমুদ গায়ে মাখলো না। পুনরায় বলল,
‘আমার অগোচরেও যদি তুমি আপার পায়ে পড়ো তাহলে মনে করবে জনসম্মুখে তুমি আমায় জুতো পে*টা করেছো।’
___________________
স্কুলের বারান্দায় রাখা বেঞ্চে বসে ইফাদ আর নিশি। এগারো বছর বয়সী নিশির চোখে মামা বাসায় যাওয়ার উপচে পড়া আনন্দ দেখা গেলেও ষোড়শবর্ষীয় কিশোর ইফাদের চোখে যাচ্ছে ভয় আর আতঙ্ক। হঠাৎই তার মামার স্কুলে তাদের নিতে আসা মানে হয়তো কোনো বিপদের পূর্বাভাস। শীতোষ্ণ আবহাওয়ায় তার কপালে চিক চিক করছে ঘাম। মনে মনে বার বার আওড়াচ্ছে, ‘সবাই ভালো আছে তো?’
সামনে দিয়ে রসায়নের নোমান স্যার যাওয়ার সময় ডাকলো ইফাদ,
‘স্যার?’
‘কিছু বলবে ইফাদ?’
‘স্যার, মামা আপনার কাছে কিছু বলেনি কেন আসবে?’
‘তেমন কিছুই তো বলেনি। শুধু বলেছে তোমাদের নিতে আসবে। হেড মিস্ট্রেস কে বলে যেন ছুটি ম্যানেজ করে রাখি।’
‘ওহ।’ বলেই হাত কচলাতে থাকে ইফাদ।
‘কেমন আছিস দুস্ত?’
নোমান পিছু ফিরেই একহাতে জড়িয়ে ধরে মাহমুদ কে।
‘আমি তো বেশ আছি। তোর কী হাল অবস্থা বল?’
‘এই তো চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ী।’
নোমান তপ্ত শ্বাস ফেলে।
‘সার্কেলের কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। ভাগ্নে আর ভাগ্নীর বদৌলতে তোর সাথে একটু যোগাযোগ আছে। নয়তো তুইও,,,
‘তুই খবর নিয়ে উল্টাস? এখন বল তাদের পড়াশোনার খবর কী? তুই এই স্কুলে জয়েন করবি শুনে আমি কিন্তু আপার সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে ওদের এই স্কুলে এনেছি।’
‘সব ঠিক নিশি ইংরেজিতে দূর্বল। ওর মিস বললো। ইফাদ গনিতে গরমিল করে ফেলে।’
‘ইফাদ? স্যার এসব কি বলছে?’
মাথা নুইয়ে ফেলে ইফাদ। মিনমিন করে বলে,
‘আমি ঠিকঠাকই ম্যাথ করি। পরে ভুল হয় কি করে জানি না।’
নোমান হাতের ঘড়ি দেখলো।
‘দুস্ত আমার ক্লাস আওয়ার চলে যাচ্ছে। আমি আসি তবে।’
হেন্ডশেইক করে দুই বন্ধু বিদায় নিলো।
‘মামা?’
‘হুম।’
ইফাদের বুক দুরুদুরু করছে ভয়ে।
‘সবাই ভালো আছে তো?’
মাহমুদের পা থেমে যায়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ইফাদের দিকে। চোখমুখের আতঙ্ক, কপালের ঘাম কিছুই নজর এড়ায় না তার।
‘কিছু হয়েছে ইফাদ?’
ইফাদ ফাঁকা ঢোক গিলে।
‘আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় আছে না? গত রোববার ওর চাচা আসে আমাদের থার্ড পিরিয়ডে৷ পরে জানতে পারি ওর বাবা মা*রা গিয়েছে।’
মাহমুদ মৃদু হাসে।
‘তাই এই সময় আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিস?’
ইফাদ মাথা নাড়াতেই মাহমুদ পুনরায় বলে,
‘আরে বোকা তেমন কিছু না। তোর সকালে আমাদের বাসায় এসেছে। তাই মামি বলল তোদের স্কুল থেকে নিয়ে যেতে। অনেকদিন হয় তোরা বেড়াতে আসিস না। তোর বাবাকেও বলেছে। সন্ধ্যায় সোজা আমাদের বাসায় আসবে।’
ইফাদ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এতোক্ষণ বাদে হাসি ফুটলো তার মুখে।
‘তাড়াতাড়ি চল। বাইরে রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।’
নিশিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ম্যাম কোলে বসতে পারবেন তো? নাকি আপনার জন্য আলাদা রিক্সা নিতে হবে?’
নিশি কিছু না বললেও স্কুল ব্যাগটা তার মামার কাছে দিয়ে তিড়িংবিড়িং করে চলল মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেন নিজের সমস্ত দায়িত্ব সে মামাকে গছিয়ে দিয়েছে।
_______________
কলিংবেলের আওয়াজ হতেই মেহেরুন্নেসা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তনয়া দরজা খোলে দেয়। গায়ে তার বোরকা। কপাল কুঁচকে তাকালেন তিনি। ওমনি ছোটো ছোটো দুইটা হাত তনয়ার কোমর পেঁচিয়ে ধরে।
‘মামিমনিইই!’
তনয়াও আগলে নেয় হাতের মালিককে। ইফাদ ভেতরে ঢুকে।
‘কেমন আছেন মামি?’
‘এইতো ভালো। তুমি?’
‘আমিও ভালো।’
ইফাদ তার নানির কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
‘তুমি কেমন আছো নানু?’
‘ভালো। কিন্তু তোরা এই সময়? তোর মা তো এখনই রেডি হচ্ছিলো চলে যাবে বলে।’
‘আপাকে যেতে না করেন আম্মা। দুলাভাইও এখানে আসবে সন্ধ্যায়। আপারা সবাই আজ এইখানে থাকবে। আমি আর আপনার ছেলে এখন যাবো বাজার করতে।’
‘এইসব করার আগে আমায় একটা বার জিজ্ঞেস করেছো? ভালো সাজতে চাইছো সবার কাছে?’
‘জিজ্ঞেস টা করবো কখন? দরজা আটকে তিনজন সেই কখন থেকে বসে আছেন? তাছাড়া অনেকদিন পরে আপা এসেছে। তাই ভাবলাম সবাইকেই আসতে বলি। এমনি আসার কথা বললে তো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অজুহাত দেয়। তাই,,
‘ভালো সেজে সংসারের কর্তী হতে এসেছো? খবরদার বলে দিচ্ছি। আমি এখনো জীবিত আছি। এই সংসার আমার।’
‘আপনার সমস্যা টা কি বলবেন? আপ্যায়ন না করলে দোষ হবে। বলবেন দেখতে পারি না। আপ্যায়ন করতে চাইছি এখন বলছেন কর্তী হতে চাই। এই সংসার আপনার হলে আমি কে? সকাল ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করা বিনা বেতনের কর্মচারী? কই কাজের সময় তো কেউ বলেন না এই সংসার আমার কাজটাও আমার। হুকুম দেওয়ার সময় মনে হয় এসব? একা হাতে সব কাজ সামলাতে পারবো আর সংসারের কর্তী হতে পারবোনা? নাতি নাতনি এসেছে। আপনি খুশি হবেন। কিন্তু না আপনি যা করছেন মনে হচ্ছে আপনি ওদের দেখতে পারেন না।’
‘নানু আমরা আসাতে খুশি হওনি তুমি?’
হাসার চেষ্টা করেন মেহেরুন্নেসা।
‘না নানু ভাই। খুশি হবো না কেন। কাছে আসো।’
তনয়া চলে যায় রুমে। মাহমুদ ঠান্ডা গলায় বলল,
‘যখন তখন কথা শুনানোর অভ্যাসটা ত্যাগ করো। নয়তো যে আপন মানুষগুলোকে আগলে দাঁড়িয়ে আছো তারাই তোমাকে ভুল বুঝবে।’
মাহমুদ চলে যেতেই মেহেরুন্নেসা কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে ফিরে তাকালেন। সুমনাকে দেখে চমকে উঠেন তিনি।
‘কিছু বলবি?’
শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে সুমনা কেবল মাথা নাড়ালো।
__________________
সন্ধ্যার পরপরই বাসার পরিবেশ রমরমা হয়ে উঠলো। আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে পড়লো প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে। খালেকুজ্জামানের সারাদিনের বিষন্নতা যেন উধাও হয়ে গেলো নিমিষেই। রান্নাঘরে একা হাতে সবকিছু সামলাচ্ছে তনয়া। একটু জিরোবার ফুরসত পাচ্ছে না সে। সকলে ড্রয়িংরুমে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তনয়া বার বার সেদিকে তাকাচ্ছে আবার কাজ করছে। খুব করে চাইলো কেউ একজন এসে হাতে হাতে কাজ করে দিক। কেউ যে আসবে না তা তার ভালো করেই জানা। গরুর গোশত টা চুলোয় চাপিয়ে পোলাওয়ের চালগুলো ধুয়ে নিলো সে। পিছন ফিরতেই চমকে উঠে। মাহমুদ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তনয়া বুকে থুথু দেয়।
‘গলা ঝারি দিয়ে আসবে না তুমি।’
‘ভয় পেয়েছো?’
‘মুখ দেখে বুঝতে পারছো না?’
‘মুখ দেখে তো অনেক কিছুই বুঝতে পারছি। আমি সাহায্য করি?’
‘দরকার নেই জনাব। আমি সামলাতে পারবো।’
তনয়ার নাক টানে মাহমুদ।
‘ম্যাম আপনি জানেন না বউয়ের কাজে সাহায্য করা সুন্নাত?’
গোশত তরকারি টা নেড়ে দেয় তনয়া। চুলোর আঁচ কমিয়ে অন্য পাশের চুলোয় কড়াই বসালো।
‘আর আপনি জানেন না আপনাকে আমার সাথে কাজ করতে দেখলে আপনার মা দক্ষযজ্ঞ বাঁধাবে?’
‘তো?’
‘তো আবার কী? দেখো বাসায় দুলাভাই আছে। আর আম্মা কথা শুনানোর সুযোগ পেলে বাসায় কে আছে না আছে জীবনেও তোয়াক্কা করবে না। এখন অশান্তি হউক আমি চাই না।’
‘তাহলে কাউকে গিয়ে বলি সাহায্য করতে?’
তনয়া পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মাহমুদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
‘কারো যদি সাহায্য করার হতোই তবে তোমাকে গিয়ে বলার প্রয়োজন হতো না। সাহায্য করার জন্য নিজে থেকেই চলে আসতো।’
#চলবে