#সংসার_সমরাঙ্গন (১০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তনয়ার। মাত্রই চোখ লেগেছিল, আবার শব্দ আসে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে—রাত দুইটা হতে তিন মিনিট বাকি। পাশে ঘুমন্ত মাহমুদ নড়েচড়ে আবারও তলিয়ে যায় নিদ্রায়।
‘কে?’—গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করে তনয়া।
দরজার ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘তনয়া, আমি বলছি।’
—’আব্বা?’
দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে করতে দরজা খুলে দেয় সে।
—’আব্বা, আপনি এত রাতে? সব ঠিক আছে?’
খালেকুজ্জামান একপাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘জ্বর কমেছে মা?’
তনয়া মাথা নাড়তেই আবার প্রশ্ন আসে, ‘ তোমার খিদে পেয়েছে বুঝি?’
তার মুখটা মলিন হয়ে যায়। আস্তে বলে, ‘না তো।’
‘মিথ্যে বলছো কেন? আমি দেখেছি সব। তোমার কি ভাত খেতে ইচ্ছে করছে?’
তনয়া মাথা নিচু করে মেঝে খুঁটতে থাকে নখ দিয়ে।
‘খাবে এখন? দিবো?’
তনয়ার মনে পড়ে যায় রান্নাঘরে ভাতের পাতিল উল্টো করে রাখা। খাওয়ার মতো কিছুই নেই। এখন খেতে চাওয়া মানে নতুন করে রান্না চড়াতে হবে চুলোতে। হাসার চেষ্টা করে সে জবাব দেয়,
‘এখন ঝামেলা করার কোনো দরকার নেই আব্বা। অনেক রাত হয়েছে। গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ঘুম না হলে আবার প্রেশার বেড়ে যাবে আপনার।’
‘আমি ভাত রেঁধেছি। তুমি খাবে বলে।’
পিলে চমকে উঠে তনয়ার। বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় খালেকুজ্জামানের দিকে। অবিশ্বাস্য চাহনি তার। তোতলাতে তোতলাতে বলে,
‘আ,,,,,য়াপনি এখন ভাত রেঁধেছেন?’
খালেকুজ্জামান মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
‘ঘুম আসছিলো না আমার। এপাশ-ওপাশ করছিলাম। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম ডাইনিং এর আলো জ্বলছে। তোমার জ্বর বেড়েছে ভেবে উঠে এসে দেখলাম,, এতটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
তখনকার বলা কথাগুলো সব তিনি শুনে ফেলেছেন বুঝতে পেরে আড়ষ্ট হয় সে।
‘আব্বা আমি আসলে ওভাবে কিছু,,,
তনয়াকে থামিয়ে দিলেন তিনি।
‘মেয়ে করে রাখবো বলে কথা দিয়েছি। সেই অসুস্থ মেয়েকে অভুক্ত রেখে কি করে ঘুমোতে দেই? আমারও তো দুইটা মেয়ে আছে। সবাই বিবেক বিকিয়ে দিলেও আমি তা পারবো না।’
দুইজনের কথোপকথনে নিদ্রা হালকা হয়ে আসে মাহমুদের। প্রতিটা কথাই তার কর্ণগোচর হয়েছে। কথাগুলোর ভার এতই প্রকট ছিলো বিবেকের কাঠগড়ায় তার অপরাধবোধের মাত্রা হয় আরও তীব্র।
________________
ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত, একটা ডিম ভাজি আর শুকনো মরিচ আর পেঁয়াজ হাতে চটকে বানানো ঝাল ঝাল ভর্তা।
ডিম ভাজি আর গরম ভাতের ঘ্রাণ নাকে যেতেই চেপে রাখা খিদেটা যেন মাথা চারা দিয়ে ওঠে তনয়ার।
‘অল্প সময়ের মধ্যে এর থেকে বেশি কিছু করতে পারিনি। এগুলোই খেয়ে নাও।’
‘এগুলোরই যেন ভীষণ প্রয়োজন ছিলো।’
‘অবশ্য জ্বরের মুখে ভর্তাটাই ভালো লাগবে।’ বলতে বলতে তনয়ার পাতে ভাত তুলে দেন খালেকুজ্জামান। ভাজা ডিম আর ছোট চামচের এক চামচ ভর্তা। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিলেন তনয়ার সামনে।
ভাত, ডিম, ভর্তা—সাদামাটা আয়োজন, তবে তাতে ছিল পরম যত্নের স্পর্শ। তনয়ার মনে হলো, যেন রাজকীয়ভাবে আপ্যায়ন করা হচ্ছে তাকে।
ভাতের লোকমাটা মুখ পর্যন্ত তুলে এনে থমকে যায় তনয়া। এক অজানা বেদনায় বুকটা যেন ভারী হয়ে আসে। কান্না দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যায়, শব্দহীন আর্তনাদে থরথর করে ওঠে সারা শরীর। ক্রমশ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, যেন চোখের সামনে স্মৃতির এক আবছা পর্দা নেমে আসছে।
‘থেমে গেলে কেন? খাও।’
ভাতের লোকমা টা মুখে দিয়েই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তনয়া। কান্না প্রকোপে কাঁপতে থাকে শরীর।
খালেকুজ্জামান হকচকিয়ে গেলেন। শঙ্কিত কন্ঠে শুধালেন,
‘কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? ভর্তা কি বেশি ঝাল?’
মুখের খাবার বহুকষ্টে গিলে নেয় তনয়া। চিবুকে জমা অশ্রু মুছে নিলো হাতের উল্টো পিঠে। টলমলে চোখজোড়া পলক ফেলতেই আবারও চিবুকে জমা হয় বেদনার নোনা জল। সে ফুঁপিয়ে উঠলো। কাঁপা স্বরে অস্পষ্ট বলল,
‘আমার বাবা বেঁচে থাকলেও কি আমার অসুস্থতায় এমন যত্ন করতো?’
খালেকুজ্জামান হঠাৎ থমকে গেলেন। এক প্রশ্নে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি—জানা উত্তরও যেন অজানা হয়ে গেল। মুহূর্তেই কথার খেই হারিয়ে ফেললেন।
__________________
খাওয়া শেষ হতেই হাত ধুয়ার জন্য ওঠে চলে যায় তনয়া। খালেকুজ্জামান আনমনে বসে ছিলেন চেয়ারে। সহসাই দৃষ্টি যায় দরজার দিকে। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদ। ফোলা ফোলা চোখ জোড়ায় ঘুম জড়ানো। তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন মাহমুদের সামনে। মাহমুদ নড়েচড়ে ওঠলো।
মাহমুদের কাঁধে হাত রাখেন খালেকুজ্জামান। কিঞ্চিৎ হাসলেন তিনি।
“পিতৃশোক কখনো ভুলা যায় না, তবে কিঞ্চিৎ লাঘব হয়। কখন জানো? যখন কোনো মেয়ে তার বাবার ছায়া স্বামীর মাঝে খুঁজে পায়। যখন স্বামী নামক মানুষটি বাবার মতো আগলে রাখে, যত্ন করে। যে মেয়েটি রাজকন্যার মতো বেড়ে উঠেছে, সে যদি শ্বশুরবাড়িতে রাজরানীর মতো ভালোবাসা পায়। কিন্তু আফসোস! তুমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ। কেবল স্ত্রীর পাশে শুয়ে ঘুমালেই স্বামী হওয়া যায় না।’
অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে ফেলে মাহমুদ। তার বলার মতো কিছুই নেই। না পেরেছে মায়ের রোষানল থেকে নিজের স্ত্রীকে বাঁচাতে। আর না পেরেছে স্ত্রীর অসুস্থতায় তার খেয়াল রাখতে।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, তবু সে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল। তনয়া হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলে দু’জনের চোখাচোখি হয়। তনয়ার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। আত্মগ্লানির ভার সইতে না পেরে মাহমুদ তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।
বুক অব্দি কম্বল টেনে চুপচাপ শুয়ে আছে তনয়া। খানিক বাদেই মাহমুদ এলো। চুপচাপ সেও শুয়ে পড়ে। দুজনের মধ্যিখানে একহাত সমান দূরত্ব। ঘেঁষতে ঘেঁষতে দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচায় মাহমুদ। কিছু বলার সাহস সে পাচ্ছে না। ফাঁকা ঢোক গিলে হাত ছোঁয়ায় তনয়ার কপালে। তনয়া প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ওভাবেই রইলো। তনয়ার নীরবতায় সাহস পায় সে। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
‘জ্বর টা কমেছে তাহলে!’
‘শুধু যে জ্বর কমেছে তা না, এই জ্বর আমাকে আপনজনও চিনিয়েছে।’
__________________
সাতসকালে বাকবিতন্ডায় ঘুম উবে যায় তনয়ার। শোরগোল বসার ঘর থেকে আসছে। উঠে বসার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু পারলোনা। শরীর তুলনামূলক দূর্বল। শুয়ে থেকেই শোনার চেষ্টা করলো সে। তখনই কানে আসে খালেকুজ্জামানের হুঙ্কার।
‘বাসায় চাল কম ছিলো নাকি এইমাসে মাসকাবারি বাজার কম এসেছে? চাল গুনে গুনে ভাত বসিয়েছিলে?’
মেহেরুন্নেসার কন্ঠ যেন আরো ঝাঁঝালো।
‘হ্যা গুনে গুনে বসিয়েছি। আমি কি করে জানবো তোমার আদরের বউমার রাত-বিরেতে খিদে পাবে।’
‘বিবেকবুদ্ধি কি তোমার লোপ পেয়েছে মাহমুদের মা? জ্বর হলে তোমার রাতে খিদে পেতো না? সেই দুপুরে মেয়েটা খেয়েছিলো। ভুলে যেও না মেয়ে তোমারও আছে।’
এরপর আর কিছু শোনা গেলো না। নীরব হয়ে গেলো পরিবেশ। তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তখনই কানে আসে মাহমুদের গলার স্বর।
‘তুমি এটা ইচ্ছে করে করেছো তাই না আম্মা? এমনটা না করলেও পারতে। এমন না হয় তোমার আজকের কর্ম ভবিষ্যতে আবার তোমার উপরই না বর্তায়।’
তনয়া উদ্বর্তিত হাসে। আপনমনে বিড়বিড় করে আওড়ায়, ‘ন্যায় অন্যায় বোধ উদয় হচ্ছে শেষে।’
মাহমুদ রুমে চলে এলেও থেমে থাকলেন না মেহেরুন্নেসা। এটা ওটা বলে বিলাপ করছেন তিনি। তনয়ার সেগুলো শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না।
তনয়া কে জাগ্রত দেখে কাছে এসে বসে মাহমুদ। কপালে হাত ছুঁয়ে শরীরের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করলো। আগের মতোই স্বাভাবিক আছে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
‘যাক বাবা জ্বর আসেনি। আর বোধ হয় আসবেও না। তারপরও ঔষধগুলো খেয়ে নিও।’
হালকা ঝুঁকে তনয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় মাহমুদ।
‘একা একা ওঠতে পারবে? নাকি মুনিরাকে ডেকে দিবো?’
‘আমার কাউকে লাগবেনা। নট ইভেন ইউ।’
মাহমুদ হাসলো।
‘আমাকে তোমার না লাগলেও তোমাকে আমার প্রয়োজন।’
তনয়া মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
‘ওঠে কিছু একটা খেয়ে নাও। ঔষধ খেতে হবে।’
বলেই কালো রঙের কোটটা গায়ে জড়িয়ে নিলো।
‘কোথায় যাচ্ছো তুমি? তুমি না ছুটি নিয়েছো তিনদিনের?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে তনয়া।
‘জরুরি মিটিং পড়েছে। ইউকে থেকে বায়ার আসবে। বেশি জরুরি না হলে এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে কখনো যেতাম না।’
‘যে মানুষ পাশে শুয়ে থেকেও বউয়ের খবর রাখে না। সে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি।’
মাহমুদ আবারও তনয়ার কাছে এসে বসে। তনয়ার একটা হাত মুঠোবন্দি করে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দেয়।
‘হয়তো আমি খামখেয়ালি কিংবা বুঝে উঠতে পারি না কিছু। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সে ভালোবাসা মিথ্যে নয়।’
________________
অফিস থেকে ফেরার পথে সবার জন্য টুকটাক শপিং করে নিয়ে এসেছে মাহমুদ। ডেকে ডেকে যার যার টা তার তার হাতে দিলো।
মুনিরা নিজের জন্য আনা থ্রি-পিসটা খুলে উল্টেপাল্টে দেখলো। ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে দেখলো তাকে কেমন লাগছে। আচমকাই তার নজর গেলো টি-টেবিলের ওপর পড়ে থাকা শাড়িটার দিকে। ছোঁ-মে*রে সে সেটা নিয়ে নিলো। ভাঁজ খোলে শাড়িটা দেখেই তার চোখজোড়া চকচক করে ওঠে।
‘ওয়াও! শাড়িটা কি সুন্দর! ভালোই হলো। নেক্সট ইভেন্টে শাড়িটা পড়ে কলেজে যেতে পারবো।’
‘ওটা তনয়ার জন্য এনেছি।’
‘তনয়ার জন্য এনেছিস তো কি হয়েছে? মুনিরার তো এটা ভালো লেগেছে। এটা ও নিয়ে নিক।’ বললেন মেহেরুন্নেসা।
‘তাহলে এক কাজ কর মুনিরা, তোর থ্রি-পিস টা তনয়াকে দিয়ে দে।’
‘ওমা এতে আবার বদলাবদলির কি আছে? থ্রিপিসটা তো তুই তোর বোনের জন্যই এনেছিস তাই না? দুইটাই মুনিরা রাখুক। পরে তনয়াকে হাজার বারোশোর মধ্যে একটা কিনে দিস।’
মেহেরুন্নেসার কথাকে গায়ে মাখলো না তনয়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মুনিরার দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘পছন্দ হলে শাড়ি তুমি নিয়ে নাও। কিন্তু আজকের ঘটনা যদি তোমার সাথে পুনরাবৃত্তি হয়? তোমার জন্য আনা শাড়িটা যদি তোমার ননদ নিয়ে যায় সেদিন তুমি হাসিমুখে তাকে দিতে পারবে তো?’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য চাই আজ।