#সংসার_সমরাঙ্গন (১২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
পিলে চমকে উঠে মুনিরার। খাবারের গ্রাসটি ঠিকমতো গিলতে গিয়ে আটকে যায় তার গলায়। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। খকখক করে কাশতে শুরু করে সে, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হাতের কাছে থাকা গ্লাসটি টেবিল থেকে তুলে মুখে দিতে গিয়েও হাত কাঁপতে থাকে তার।
‘ওই ওয়ার্কশপের ছেলেটার সাথে তোর কি চলছে?’
‘কি বলছো তুমি উল্টো পাল্টা? কোন ছেলে? কিসের ছেলে?’
‘আমি উল্টোপাল্টা বলছি?’
‘তা নয়তো কি?’- গলা শুকিয়ে আসে মুনিরার। একটু একটু লোপ পাচ্ছে কথা বলার শক্তি। এই বুঝি সে ধরা পড়ে গেলো!
‘তাহল কি তোর ভাব,,,,
এইটুকু বলে থেমে যায় মাহমুদ। আড়চোখে তাকায় তনয়ার দিকে। তনয়া মাত্রই তার দিকে তাকিয়েছিলো। কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই শুনতে পেলো,
‘ওহ! তাহলে এসব বানোয়াট কথা বলে ভাবি তোমার কান ভাঙিয়েছে?’ -এইটুকু বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। ধরা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য একটা খুঁটি সে পেয়েছে।
‘প্রেম করতে পারবি আর তোর ভাবি বললে দোষ? সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে?’
আচমকাই কেঁদে দেয় মুনিরা। ভাতের প্লেট দূরে সরিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। তনয়ার দিকে নেত্রপাত করলো।
‘আমার সাথে কিসের এতো শ*ত্রু*তা তোমার?’
তনয়া যেন আকাশ থেকে পড়লো।
‘মানে?’
‘আমার নামে যা-তা বলে এখন মানে খুঁজে পাচ্ছো না?’
‘তুমি অস্বীকার করতে পারবে ওই লম্বা করে ফর্সা ছেলেটার সাথে কিছু নেই।’
‘ওই ছেলেটার সাথে যে আমার কিছু চলছে তার প্রমাণ আছে? নাকি হিংসা করেই আমার চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করছো?’
‘প্রমাণ তোমার হাতের ওই মোবাইলটাই যথেষ্ট। মেসেঞ্জারে ঢুকলেই তোমাদের সকল কনভারসেশন পাওয়া যাবে।’
‘আমার মোবাইল এখনি তোমার হাতে দিবো। যদি কিছু না পাওয়া যায় এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।’ -বুকের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর সরেছে মুনিরার। মোবাইলের প্রতিটা পার্ট উল্টেপাল্টে ফেললেও কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তনয়া চুপ হয়ে যায় একদম। প্রতিক্রিয়া জানানোর ইচ্ছে হলোনা বিন্দুমাত্র। ঠিক তখনই কানে আসে মেহেরুন্নেসার হুঙ্কার। চেঁচিয়ে উঠেন তিনি।
‘শেষ স্বামী স্ত্রীর নাটক? তনয়া তুমি কি চাইছো? আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?’
তনয়ার ঠোঁটের কোণে নিঃশব্দে ঝরে পড়লো নিঃশ্বাসের করুণ সুর। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কোমল গলায় জবাব দেয়।
‘আমি এমনটা কখনো চাইনি আম্মা। আর না কখনো চাইবো।’
‘এমনটা যদি না চাও তবে আমার মেয়েটার পিছনে পড়েছো কেন? তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে সে? শেষমেশ আমার মেয়ের চরিত্রের উপর আঙুল তুলছো।’
‘তনয়া মিথ্যে বলছে না আম্মা।’
‘তনয়া মিথ্যে বলছে না তুই কি করে জানলি? প্রমাণ আছে তোর কাছে?’
‘প্রমাণ না থাকলেও জানি। ও মিথ্যে কথা বলে না।’
‘বউ মিথ্যে বলে না। আর তোর মায়ের পেটের আপন বোন মিথ্যে বলে?’ -তেতে উঠলেন মেহেরুন্নেসা।
‘তখন শাড়ি টা নিতে চেয়েছি বলে এভাবে শোধ নিচ্ছো ভাবি? শাড়িটা তো তুমি নিয়েই নিয়েছো। তবে?’
চকিত চোখে তাকায় তনয়া। শাড়ির কথা আসতেই অবাক না হয়ে পারলো না সে। এটার সাথে তো শাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই! অথচ মুনিরা কী নিপুণ দক্ষতায় বিষয়টাকে শাড়ির প্রসঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিলো গা বাঁচানোর জন্য
এক মুহূর্তে বিতৃষ্ণা এসে ভর করল তার মনে। কথা বাড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে জাগল না তার। যুক্তি-তর্কের এই বৃথা খেলায় অংশ নেওয়ার মানে হয় না।
তাই সে নিজেকে আড়াল করল নীরবতার চাদরে। কথা না বলাই হয়তো সবচেয়ে বড় জবাব।
খাওয়া থেমে গেছে সকলেরই। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। তনয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহমুদের মুখে রাঁ নেই। গুনগুনিয়ে কেঁদে উঠে মুনিরা। আচমকাই মেহেরুন্নেসা খাবারের প্লেটটা ছুঁড়ে মা*রলেন মেঝেতে। পলকেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় সেটা। খাবারগুলো ছড়িয়ে যায় এদিক সেদিক।
‘কেমন বাপ তুমি? আমি জানতে চাই তুমি কেমন বাপ। একজন তোমার মেয়ের নামে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে। তুমি চুপ করে আছো। ও তো তোমার ঔরসজাত সন্তান। ছেলের বউ তোমার কাছে এতটা আপন হয়ে গেলো? নিজের সন্তানকে পর্যন্ত চোখে লাগছে না?’
রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি।
‘তনয়া তুমি যা বলছো সত্যি বলছো তো? ব্যাপারটা সেনসিটিভ। মুনিরা যেমনই হউক আমার মেয়ে। ওর নামে মিথ্যে বললে কিন্তু আমি বরদাস্ত করবো না মা।’
তনয়া করুণ চোখে তাকালো। পৃথিবীর সমস্ত বেদনা যেন উপচে পড়ছে তার চোখে। তার শ্বশুরের সন্দেহমিশ্রিত দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে বারবার। তবে কি তিনি ভুল বুঝছেন তাকে?
বুকের গভীরে একরাশ হতাশা চেপে ধরে সে নিঃশব্দে মাথা নিচু করল। অভিযোগহীন, অথচ বিধ্বস্ত। মিনমিন করে আওড়ায়,
‘আব্বা আপনি ভালো করেই জানেন আমি মিথ্যে কথা বলি না। আর যাচাই-বাছাই ছাড়া কারো দিকে আঙুল তো কখনোই তুলবো না।’
‘এবার তুমি বলো মুনিরা, কিসের ভিত্তিতে তোমার ভাবি তোমায় সন্দেহ করছে।’
নিজের উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগায় মুনিরা। কান্না থামিয়ে বলে,
‘ছেলেটা একবার আমাকে কলেজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলো। কোন কলেজে পড়াশোনার মান ভালো। বোনকে ভর্তি করাবে। নিজে পড়তে পারেনি তাই বোনকে উচ্চ শিক্ষিত করার শখ তার।’
‘একটা অপরিচিত ছেলে হুট করে তোকে এসব জিজ্ঞেস করবে?’
মাহমুদকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দেয় তনয়া। তর্কবিতর্ক বাড়ুক সে আর চাইছে না।
‘তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে তনয়া। তোমার কাছে অন্তত এটা আশা করিনি। হুট করে কারো নামে কিছু বলা অনুচিত কাজ।’
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে তনয়া। সকলের কাছে কেমন ছোটো হলো সে। হয়তো বা সকলে ভাবছে ননদকে সে সহ্য করতে পারে না। তাই মিথ্যে কথা রটাচ্ছে। এই ভাবনাটার জন্যই সমস্তটা চেপে রেখেছিলো মনে। খালেকুজ্জামানের কথায় স্পষ্ট তিনিও এটাই ভাবছেন। নীরব কান্নার ঢেউ যেন ধীরে ধীরে প্রবল হয়ে ওঠে। অথচ সে বোবা হয়ে গেলো মুহুর্তেই।
খালেকুজ্জামান উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়ালেন রুমের দিকে। তার চলে যাওয়া দেখে তনয়া আস্তে করে বলে,
‘কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে তুমি তা ভালো করে জানো মুনিরা। আজকের দিনটার আফসোস তোমায় আবার সারাজীবন না বয়ে বেড়াতে হয়।’
স্তব্ধতায় কথাগুলো খালেকুজ্জামানের কানে ঠিকই পৌঁছে গেলো। থমকে দাঁড়ালেন তিনি। আবারও শুনতে পেলেন,
‘ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো ব্যক্তিগত ভাবেই জিজ্ঞেস করতে হয়। পাবলিকলি নয়। হয়তো বা বোঝাতে পারতে। ভালো চেয়েছিলাম। উল্টো ভুল বুঝলো সবাই।’
‘তনয়া আমি তো,,,,
হাতের ইশারায় মাহমুদ কে।
‘ব্যাপারটার সমাপ্তি এখানেই ঘটুক। খুব করে চাই আমি যেন মিথ্যে হই। কারন আমি সত্য হলেই আমার সত্যের মাশুল পুরো পরিবারকে সারাজীবন দিয়ে যেতে হবে।’
__________________
‘আম্মা বললো তুমি নাকি বলেছো মুনিরা কোন এক ছেলের সাথে প্রেম করে।’
চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখে তনয়া। নির্জীব চোখে তাকালো সুমনার দিকে।
‘এই কথা বলেছো তুমি?’
দৃষ্টি নামিয়ে সে চাপা শ্বাস ফেলে। নত স্বরে বলে,
‘আমারই ভুল আপা। এসব বলা আমার একদম হয়নি।’
তনয়ার এমন দমে যাওয়া খটকা লাগে সুমনার কাছে। সত্য মিথ্যা নির্ণয়ে পড়ে যায় দ্বিধায়। তনয়ার চোখ অন্য কথা বলছে।
‘আপারে তুই এসেছিস? আমাকে তোর সাথে নিয়ে চল। কাল বলেছে আমি প্রেম করি। আরেকদিন বলবে আমি ছেলে আনি বাসায়। আমি এই অপবাদ নিতে পারবোনা।’
চকিত চোখে মুনিরার দিকে তাকায় তনয়া। চোখের তারায় বিস্ময়ের ছায়া। ভালো চাইতে গিয়ে কেমন কাঁটা হয়ে গেলো সকলের কাছে।
এক বিষয়ে বার বার বাকচিত মোটেও ভালো লাগছে না তার।
‘আমার বোঝার ভুল ছিলো মুনিরা। ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। বেঁচে থাকতে এমন ভুল আর হবে না।’
তনয়াকে নত হতে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পায় মুনিরা। তার পিছে লাগার শোধ এতো তাড়াতাড়ি নিতে পারবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। তবে সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না মাহমুদের কথায়।
‘তাহলে ভালোই হলো। আমার কলিগের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিন্তে এগোনো যাবে।’
#চলবে