#সংসার_সমরাঙ্গন (২৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে মুনিরা! পাত্রপক্ষ আসার ঠিক আগের রাতেই নিঃশব্দে ঘর ছেড়েছে সে—তার প্রেমিকের হাত ধরে। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে বিয়ের জন্য গড়িয়ে রাখা গয়না আর কাপড়ের নিচে রাখা বিশ হাজার টাকা।
সকালে ঘুম ভাঙতেই যেন এক ভয়াল ঝড় বয়ে গেল বাড়ির ভেতর। মেহেরুন্নেসার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির সামনে তখনো বিশ্বাস আসছে না তার চোখের দেখা। কেবল উদ্ভ্রান্তের মতো বিড়বিড় করতে থাকে,
‘আমার মুনিরা এটা কি করল? আমার মুনিরা এটা কি করল?
ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন তিনি। মাথা ধরে কাঁপতে লাগলেন পুরো শরীর।
খালেকুজ্জামান স্তব্ধ। হাতে মুনিরার রেখে যাওয়া চিরকুট। কাঁপা কাঁপা আঙুলে কাগজটা মেলে ধরে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন সেই পরিচিত হস্তাক্ষরের দিকে।
“বিয়ের জন্য গুছিয়ে রাখা গয়না বিয়ের কাজেই লাগবে। তবে বিয়েটা হবে আমার পছন্দের মানুষের সঙ্গে, তোমাদের ঠিক করা ছেলেকে নয়।”
সেই কয়েকটা লাইন যেন বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিল পুরো ঘরে।
ডাইনিং টেবিলের এক পাশে চুপচাপ বসে আছে মাহমুদ। বাকিদের মতো তার মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য নেই, নেই কোনো বিস্ময়ের ছাপ। যেন এ কাণ্ডের জন্য সে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল।
ফ্ল্যাটের চার দেয়ালের মাঝে বাতাসটা ভারী হয়ে আছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে সব যেন বদলে গেল। এই ঘর, এই মানুষগুলো, এই সাজানো সংসার—সবকিছুর মাঝেই যেন পড়ে রইল এক ফাঁকা শূন্যতা।
অচিরেই মেহেরুন্নেসার বুকচেরা আহাজারি ছড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দ ঘরজুড়ে।
‘আল্লাহরে আমার সব শেষ রে!’
এটা যেন কোনো স্রেফ চিৎকার নয়—এ যেন হৃদয়ের গহিন থেকে ছিঁড়ে আসা এক প্রবল হাহাকার
সেই শব্দে মিশে আছে এক মায়ের ভেঙে পড়া আত্মা, বিশ্বাসভঙ্গের জ্বালা, আর লজ্জার তীব্র আঘাত। মুহূর্তেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে—চার দেয়ালে ধাক্কা খায় সেই শব্দ, কিন্তু প্রতিধ্বনি হয় না।
মায়ের আচমকা আর্তনাদ যেন বজ্রাঘাতের মতো আছড়ে পড়ে মাহমুদের বুকের ওপর। মুহূর্তেই দিকবিদিকশূন্য হয়ে যায় সে—চোখে বিস্ময়, মুখে আতঙ্ক, চলনে অস্থিরতা। এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে মায়ের সামনে উবু হয়ে পড়ে।
মেহেরুন্নেসা কাতর চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠে মেহেরুন্নেসার। কম্পিত গলায় থেমে থেমে বলল,
‘সব আমার কর্মফল বাবা। সব আমার কর্মফল।’ কন্ঠে তার তীব্র অপরাধবোধ। তিনি পুনরায় বলেন,
‘আমার প্রতিটা কর্মের ফল আমি এখন পাচ্ছি বাবা। আমার কারণে তোর জীবন টা শেষ। এতো সুন্দর সংসারটা ধ্বংসের দারপ্রান্তে।’
তিনি কপাল চাপড়ানো শুরু করে। চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন,
‘আমি কেন সেদিন তনয়ার কথা বিশ্বাস করলাম না। তনয়াকে অবিশ্বাসের ফল দিয়ে গেল আমায় মেয়েটা।,
তিনি বিড়বিড় করে আরো কিছু বলছিলেন। খালেকুজ্জামান এতোক্ষণ চুপচাপ আর থমথমে থাকলেও এবার মুখ খুলেন। আফসোসের সুরে বলেন,
‘তুমি না হয় অন্ধ ছিলে অতিরিক্ত মায়ায়। কিন্তু আমি? আমিও কম কিসে? মেয়েটাকে কম কিছু বলেছি? আমাদের সেদিন তনয়ার কথাকে বিশ্বাস করা প্রয়োজন ছিল।’
মুখের ভাষা থমকে গেছে মেহেরুন্নেসার। শুধু ঠোঁটদুটো কাঁপছে নিস্তব্ধ বিড়বিড়ে স্বরে। ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। সময় থমকে আছে।
হঠাৎ তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। বুকের মাঝখানে এক অদৃশ্য মুঠো চেপে ধরেছে যেন—একটা অস্বস্তিকর চাপ, একরাশ যন্ত্রণার ওজনে থমকে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। প্রাণপাখিটা ছটফট করছে খাঁচার ভেতরে। চোখের পাতা কাঁপে, ঠোঁট থেকে শব্দ আর বেরোয় না।
তিনি হাত বাড়ান, যেন কিছু বলতে চান, কিন্তু শব্দ আটকে যায় গলার গভীরে। চোখে ছায়া নামে, ঠোঁট থরথর করে ওঠে। এক ঝটকায় শরীরটা দুলে ওঠে, তারপর নিথরভাবে ঢলে পড়েন মাহমুদের গায়ে। তার চোখদুটি অর্ধ-নিমীলিত। মুখে তখনো লেগে থাকে অসমাপ্ত এক আর্তনাদের ছায়া।
_____________
হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ইউনিটের দরজার সামনে অস্থির পায়চারি করছে মাহমুদ। ভেতরে কী হচ্ছে, কিছুই জানতে পারছে না—শুধু কখন দরজাটা খুলবে, কখন কেউ একটা কথা বলবে, সেই প্রতীক্ষা। তার চোখে লেগে আছে ভয়, আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব।
পাশে দাঁড়িয়ে খালেকুজ্জামান। এতক্ষণ দৃঢ় থাকার চেষ্টা করলেও এবার তিনিও যেন ভেঙে পড়ছেন ভিতরে ভিতরে। ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন কোনোভাবেই অনুভূতি ফুঁটে না বেরোয়।
ভেতরে দেখা যাচ্ছে—মেহেরুন্নেসাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নেওয়া হচ্ছে ভেতর দিকে। ডাক্তারের মুখ গম্ভীর, নার্সরা ব্যস্ত।
ঠিক সেই সময় করিডোরের একপ্রান্তে উন্মাত্তের মতো ছুটে আসে সুমনা। সাথে করে নিয়ে এসেছে ত ছেলে-মেয়েকে। চোখে তার ভয়, মুখে স্তব্ধতা। সুমনার চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে কান্নায়। সে ছুটে এসে মাহমুদের সামনে দাঁড়ায়। ঠোঁট উল্টে বলে,
‘আম্মা,,,
বলেই সুমনা নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ে মাহমুদের বুকের ওপর। তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণা যেন জমে গেছে—শুধু ফোঁপাতে থাকে। তার পিঠ থেমে থেমে কাঁপতে থাকে। এক অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনিতে তার সমস্ত ভার ছেড়ে দেয় মাহমুদের উপর।
মাহমুদ চোখের কোণে জমে ওঠা জল সামলানোর চেষ্টা করে। হাত রাখে সুমনার মাথায়। যেন বোনের ঢাল সে। সমস্ত ভরসা তার হাতের নরম তালুর স্পর্শে।
‘কাঁদিস না, আপা। আম্মার কিচ্ছু হবে না। আমরা কিছু হতে দেবো না।’
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, এক অদৃশ্য দৃঢ় বিশ্বাস যা অন্যদের ভেঙে পড়া মনকে শক্ত করে তোলে। একটুখানি ভরসা পেতেই সুমনা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভাইয়ের বুক।
মাহমুদয়ের বুকের উষ্ণতা, তার কথার শক্তি—যেন দুটি অস্তিত্বের মাঝে এক অটুট সেতু।
ঠিক সেই মুহূর্তে ইমার্জেন্সি রুমের দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে। সুমনা আর মাহমুদ। এক সঙ্গে দৌড়ে যায় ডাক্তারর দিকে। তাদের পেছনে অস্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন খালেকুজ্জামানও।
মাহমুদ কাঁপা কাঁপা স্বরে মেহেরুন্নেসার কথা জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার গম্ভীর গলায় জবাব দেন,
‘উনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন। অবস্থা এখনও ক্রিটিক্যাল। আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা আল্লাহকে ডাকুন।’
সেই কথাটা যেন হাতুড়ি হয়ে আছড়ে পড়ে সবার বুকে। খালেকুজ্জামান এক ধাক্কায় দেয়ালে হেলে পড়েন। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।
সুমনা ধপ করে বসে পড়ে হাসপাতালের মেঝেতে। বুকচেরা আর্তনাদে ভেঙে পড়ে সে—মুখে হাত চেপেও কান্না থামাতে পারে না। দমবন্ধ করা হাহাকার গলার গভীর থেকে উঠে আসে। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
মাহমুদ কিছু বলে না। তার চেহারা পাথরের মতো—চোখে জল নেই, তবু সেই শূন্য দৃষ্টিতে ভর করে আছে এক চাপা বিষাদ। মনে হচ্ছে, সে যেন পুরো সংসারের ভেঙে পড়া ভার এখন একা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—নীরবে, নিঃশব্দে।
নিশির ছোট্ট মস্তিষ্ক এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তার নানুর কি হয়েছে। শব্দগুলো আগে শুনলেও তা কতটা ভয়াবহ সে বুঝে না। এতটুকু বুঝতে পারছে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। তাই পরিবেশটা যে ভয়ের। তার ওপর সুমনার অপ্রতিরোধ্য কান্না—সব মিলিয়ে নিশি যেন সিটিয়ে গেছে।
সে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাহমুদের গা ঘেঁষে। তার ছোট্ট হাতটা আঁকড়ে ধরে থাকে মাহমুদের জামার প্রান্ত, চোখে টলমল করে জল। সে চায় না তার নানুর কিছু হয়ে যাক।
ইফাদ এক ছুটে তার মাকে গিয়ে ধরে। সুমনা কাত হয়ে তার ছেলের দিকে তাকাল। করুণ স্বরে বলে,
‘বাবা তোর নানু!
____________________
কারো নাওয়া খাওয়া নেই। চোখেমুখে ভাঙা ভোরের ক্লান্তি, আর অন্তরে চেপে বসা এক গভীর শঙ্কা। হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের স্বচ্ছ কাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে পরিবারের সদস্যরা—চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে মেহেরুন্নেসার দিকে।
ভেতরে নিঃশব্দে শুয়ে আছেন তিনি। সাদা বিছানায় সাদা চাদরের ভাঁজে ঢাকা তার শরীর। মাথার পাশে মনিটরের পর্দায় উঠানামা করছে হৃদস্পন্দনের রেখাচিত্র। কখনো ধীর, কখনো খানিকটা তড়িত—ঠিক যেমন করে টালমাটাল হয় জীবন।
মুখে অক্সিজেন মাস্ক। নাকের পাশে নল, হাতে স্যালাইন, আর বুকে যন্ত্রপাতির তার। যেন এক নিঃসীম নির্ভরতায় এখন শরীরটা যন্ত্রের ওপর ঝুলে আছে। তার নিথর মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, সমস্ত ক্লান্তি যেন জমাট বেঁধে আছে চোখের কোলে। চোখদুটো অর্ধ-নিমীলিত, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, তবু মনে হয় কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারেননি।
সেই অজানা আকুতি ছড়িয়ে আছে তার নিস্পন্দ মুখে।
আইসিইউ ইউনিটের বাতাসটা শীতল, কিন্তু সেই শীতলতায় যেন একটা চাপা অস্থিরতা। ঘণ্টা বাজে, নার্সের পা টিপে টিপে হাঁটার শব্দ শোনা যায়, মাঝে মাঝে দূর থেকে শোনা যায় মনিটরের সতর্ক শব্দ—সবকিছুই এক অপার নিরবতায় ডুবে আছে।
বাইরে অপেক্ষারত পরিবারের মুখে কোনো রঙ নেই—কেবল চোখে অনিশ্চয়তা, একরাশ প্রার্থনা আর বুকচেরা উদ্বেগ। যেন তাদের হৃদয় ছিঁড়ে পড়ে আছে ঐ কাঁচের ওপারে, ঐ শুয়ে থাকা প্রিয় মুখটার ভেতরে।
ডাক্তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানায়,
সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট এসেছে। ব্রেনের বাম দিকে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটেছে—হৃদযন্ত্র থেমে যাওয়ার কিছু সময় পরপরই মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। এতে করে ব্রেনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ডাক্তারদের মতে, এই ধাক্কাটা মিনি স্ট্রোক বা ইস্কেমিক অ্যাটাক—তবে তার প্রভাব যথেষ্ট গুরুতর। এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও, শরীরের ডান পাশের প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝা যাচ্ছে—আংশিক পক্ষাঘাতের সম্ভাবনা প্রবল।
তার ডান হাত-পা এখনো সম্পূর্ণ নিস্তেজ। চেষ্টাতেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা আরো জানান, এমন অবস্থা থেকে কে কতটুকু ফিরে আসবে, সেটা সময়ই বলে দেয়। এখনো তিনি সংকটাপন্ন।
এই কথা শেষ হতেই কাঁচের ওপাশে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখে ছায়া নামে। যেন কাঁচ নয়, সে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল, যার ভেতরে তাদের সবচেয়ে আপনজন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এক অনিশ্চয়তার আড়ালে।
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মাহমুদ। ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় দেয়াল ঘেঁষে। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে সুমনার। জিভে দাঁত চেপে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকে রাখে। চারপাশে নিঃশব্দ, অথচ প্রত্যেক হৃদয়ে একেকটা বজ্রপাত ঘটে চলেছে নীরবে।
থম মে’রে দাঁড়িয়ে থাকেন খালেকুজ্জামান। তাকিয়ে থাকেন স্ত্রীর মুখপানে। দুজনের মাঝখানে কাঁচের স্বচ্ছ দেয়াল। ভেতরটা হু হু করে উঠে তার।
এই একরাতেই সব বদলে গেছে। শুধু সময় নয়, বদলে গেছে মানুষের ভেতরের আশার রঙ, বিশ্বাসের ভার, আর ভবিষ্যতের ছবিটাও।
#চলবে
#সংসার_সমরাঙ্গন (২৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
দুইটা দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মেহেরুন্নেসার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আইসিইউর বাইরে বিরাজ করছে এক অপ্রতিরোধ্য স্তব্ধতা, যেন সময় থেমে গেছে। সাদা চাদরের নিচে শুয়ে থাকা প্রিয়জনের অবস্থা দেখে চলছে কেবল নিঃশব্দ প্রার্থনা।
সুমনা, মাহমুদ আর খালেকুজ্জামান—তিনজনেরই পাগল প্রায় অবস্থা। সুমনার চোখে নির্লিপ্ততা। নিষ্প্রাণ চোখ জোড়া থেকে থেকে কেঁদে ওঠে। মাহমুদ যেন অনেক দূরে কোথাও, চোখে অস্বাভাবিক শূন্যতা, অথচ তার মধ্যে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। খালেকুজ্জামান চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন, চোখে একটু একটু করে ভেসে ওঠে অসহায়ত্ব, যেন তিনি নিজেও জানেন না কী করতে হবে, কীভাবে এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবেন। মাঝে মাঝে তিনজনের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসে এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।
‘বলছিলাম দু’টো দিন হয়ে গেল তোমরা কেউ মুনিরার খোঁজ নিয়েছো? কোথায় গেল সে? কেমন আছে এখন?”
তার প্রশ্নটা যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। এর উত্তর দিতে সময় নেয় না সুমনা। মুখের কোমলতা উবে গিয়ে রূপ নেয় কঠোরতায়। আগুনে জ্বালা নিয়ে ছুড়ে দেয় প্রতিক্রিয়া—
‘ওই জানোয়ারটার নাম মুখে আনবে না তুমি, সোহেল। ওর জন্যই আজ আম্মার এই দুর্দশা। মরে যাক ও কোথাও!’
সোহেল স্থির গলায় বলে, ‘পাগলামি করো না সুমনা। মুনিরা ছোট। হয়তো সবকিছু বুঝে ওঠেনি। যদি বুঝতো, কখনোই এমন কাজ করতো না।’
সুমনার চোখে এবার তীব্র ক্ষোভ। ঠোঁট কাঁপে—
অনার্সে পড়ুয়া মেয়েটা ছোট?
সোহেল সহজ গলায় বলে,
‘তোমাদের দৃষ্টিতে তো সে সবসময়ই ছোট ছিল, তাই না?’
সোহেলের কথায় মুহূর্তেই থমকে যায় সুমনা। শব্দগুলো যেন তিরের মতো বিদ্ধ করে তাকে। চোখ নামিয়ে নেয় সে। চুপচাপ বসে থাকে, গলার কাছটায় দলা পাকানো কিছু শব্দ আটকে যায়।
ঘরের ভেতরে নেমে আসে আরেক স্তর নীরবতা। সে নীরবতা শুধু শব্দহীন নয়, বেদনাবোধে ভারাক্রান্ত।
সুমনা প্রসঙ্গ বদলানোর প্রয়াসে মাহমুদকে জিজ্ঞেস করে,
‘দুইটা দিন হয়ে গেল তনয়া যে এলো না একবার? আম্মার কথা জানাসনি তনয়াকে?’
মাহমুদ উত্তর দেওয়ার আগে সেই প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নের মাধ্যমেই দিলেন খালেকুজ্জামান,
‘তনয়ার এখানে কি কাজ সুমনা?’
‘আপনি এসব কি বলছেন আব্বা? আম্মার এই অবস্থায় তনয়া আসবে না?’
‘এমন অবস্থায় আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি সেই জায়গাটায় তোমার আম্মা নেই।’
‘এমন খুটিনাটি ঝামেলা তো সব সংসারেই হয় আব্বা। তাই বলে বাড়ির বউ হয়ে শ্বাশুড়ির অসুস্থতায় আসবে না?’
‘খুটিনাটি ঠিক কতটা ঝামেলা হয় একটা সংসারে? উত্তর দিতে পারবে ঠিক কতটা ঝামেলা হয়? তোমার শ্বাশুড়ি অশান্তি করে বলে নিজের সংসার আলাদা করলে। তোমার আম্মাও তো কম অশান্তি করেনি। তখন তো সংসার আলাদা করার কথা বলোনি? উল্টো তার সংসার জীবনটা তিক্ত করেছো। এখন তার কাছে সেবা আশা করো কোন আক্কেলে?’
‘আব্বা আপনি আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা করুন।’
‘কি বুঝবো মা? আমার বুঝার কিছুই নেই। তোমার মায়ের সেবা করার দায়িত্ব তোমাদের ভাইবোনদের। তনয়ার না। তনয়ার সেবার যদি প্রয়োজন হতোই তোমরা প্রত্যেকে মেয়েটার সাথে এমন আচরণ করতে না। মুনিরার ব্যাপারে আগেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। আমরাই শুনিনি। কথা শুনিয়েছি। তুমি তো ছিলে এক কাঠি উপরে। বাড়ি বয়ে এসে কথা শুনিয়েছো।’
সুমনা মাথা নুইয়ে ফেলে। তার বলার আর কিছুই নেই। খালেকুজ্জামান আফসোসের সুরে পুনরায় বলেন,
‘মেয়েটার উপর এতোটা মানসিক অ*ত্যা*চার করেছো শ্বশুর হয়ে তার চোখে চোখ রাখার সাহস নেই। এতোদিন হয়েছে একটা খবর নাওনি। আজ তোমার আম্মা অসুস্থ বলে তার কথা মনে পড়েছে? ওই মেয়েটার ঠেকা পড়েনি। তোমরা কেবল মেয়েটাকে খাটাতেই পারো।’
কথার মাঝেই নার্স এসে উপস্থিত হয়। চোখেমুখে তার বিরক্তির ছাপ।
‘আপনারা এখানে এতো কথা বলছেন কেন? কথা বলার হলে দয়া করে বাইরে গিয়ে কথা বলুন।’
মাহমুদ হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে।
‘আম্মার কন্ডিশন কি এখন?’
‘এখনই ডক্টর বের হবেন। ডক্টর বলবেন পেশেন্টের কন্ডিশন।’
কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আইসিইউর দরজা ঠেলে বের হন ডাক্তার। নার্সকে ফেলে মাহমুদ ডাক্তারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘ডক্টর আমার আম্মা?’
‘আগের মতোই আছে।’
সুমনা টলমলে চোখে মাহমুদের দিকে তাকায়। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে,
‘আম্মা ফিরবে তো মাহমুদ?’
‘ফিরবে আপা ফিরবে।’
_____________
নিরবিচারে কেটে যাওয়া দু’টি রাত, এক ফোঁটা ঘুম চোখে আসেনি কারো। ক্লান্তি যেন জমে বসেছে চোখের কোলে। মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে নিঃশেষ হবার ছাপ। শোক আর উদ্বেগ মিলেমিশে তাদের করে তুলেছে নিঃস্ব, নিঃশ্বাসটাও যেন ভারী মনে হয় এখন।
এই অবর্ণনীয় ক্লান্তির ভেতরেও মাহমুদ নিজেকে সামলে নিয়ে অনেকটা জোর করেই সুমনা আর খালেকুজ্জামানকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাসায়। অন্তত কিছুটা বিশ্রাম যেন তারা নিতে পারে। কারণ, যদি এমন চলে, তাহলে ভয় হয়—এক মেহেরুন্নেসার অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকেই হারিয়ে ফেলবে এই পরিবার।
বুকে জমে থাকা শোকের ভার বহন করতে হলে শরীরেরও বিশ্রাম প্রয়োজন।
মাহমুদ কখনো ধীর পায়ে এদিক-ওদিক হাঁটে, কখনো থেমে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে মেহেরুন্নেসার নিস্তেজ, নেতিয়ে পড়া শরীরটার দিকে—যেন দৃষ্টি দিয়েই তাকে স্পর্শ করার ব্যর্থ চেষ্টা। তার চোখে ভেসে ওঠে সীমাহীন অসহায়ত্ব। যেন এক আকাশজোড়া হাহাকার জমে আছে দৃষ্টির গভীরে।
কণ্ঠ চেপে ধরা এক দীর্ঘশ্বাস ধীরে ধীরে বুক গলে বেরিয়ে আসে—নিরব, কিন্তু ভারী। শব্দহীন, তবুও গমগমে।
মাহমুদ নিজের ভেতর জমে থাকা দগদগে অসহায়ত্ব আর অনুচ্চারিত যন্ত্রণাকে আর সংবরণ করতে পারে না। অবশেষে থমকে থাকা আঙুল ছুঁয়ে যায় ফোনের পর্দা, নম্বরটি তুলে নেয় তনয়ার। রিং হয় তবে রিসিভ হয় না। পর পর দুই বার ফোন করার পরও তনয়ার সাড়া পাওয়া গেল না। হাল ছেড়ে দেয় সে। গিয়ে বসল দেয়াল লাগোয়া চেয়ারটায়। গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নেয় সে।
‘তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন তনয়া। আমি ক্লান্ত, আমি অবিশ্রান্ত। আমার ক্লান্তি মেটানোর একমাত্র জায়গা যে তুমি।’
________________
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তনয়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার শরীরে হালকা গরম অনুভূত হওয়ায় তাকায় মাথার উপর স্থির হয়ে থাকা পাখার উপর। বিরক্ত হয় সে। কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে,
‘হঠাৎ করে এতো গরম পড়ল। এক মিনিট পাখা ছাড়া টেকা দায়।’
বলে খানিক ঝুঁকে উঠে ফ্যানের সুইচ টিপে দেয়। ঠিক তখনই মোবাইলের রিংটোনে কক্ষের নীরবতা ভেঙে উঠে। আঁড়চোখে দেখল সে। ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে ‘আপা’ লেখাটা মোবাইল স্ক্রিনে ভাসছে। আচমকা সুমনার ফোন পেয়ে বেশ অবাক হয় তনয়া। মোবাইল হাতে নেওয়ার আগেই রিং হওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
তনয়া সোজা হয়ে বসে মোবাইলটি হাতে নেয়। তিনটি মিসড কল দেখে, আঙুল চালিয়ে কন্টাক্টে ঢুকে। দুটো মিসড কল মাহমুদ এবং একটি সুমনার নম্বর থেকে। বিশেষ করে সুমনার আকস্মিক ফোনে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায় তার। অজানা আতঙ্ক ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে, আর ভাবনার ফুরসতও সে পায় না। ঠিক তখনই সুমনার নম্বর থেকে আবার ফোন আসে। রিংটোনের উচ্চ শব্দ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটের কোণটা ভিজিয়ে, একটানা ফাঁকা গিলে নেয় সে। রিসিভ করে মোবাইল কানে ঠেকায়। তখনই কর্ণগোচর হয় সুমনার ফুঁপানোর শব্দ।
তনয়া কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। মোবাইল কানে ঠেকানো অবস্থাতেই সুমনার ফুঁপানোর শব্দ তার মনকে অস্থির করে তোলে। ভাবনার সেই আতঙ্ক স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তার চোখে । গলা শুকিয়ে আসে। বুকের ভেতরটা একটানে চাপা পড়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্য জমে যায় সে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে। কপালের ভাঁজ আরও গভীর হয়ে ওঠে। উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো,
‘আপা কাঁদছেন কেন? কিছু হয়েছে কি?’
সুমনা কান্নার জন্য কথা বলতে পারে। সে বলতে চাইলো সব কিন্তু কান্না যেন গলা চে পে ধরেছে। তনয়া আরো উতলা হয়ে পড়ে। উৎকন্ঠা বাড়ে।
‘আপা বলুন না কিছু।’
মাহমুদ কে ঘিরে একটা ভয় তার মনে বাসা বাঁধে। উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলেনি তো? উৎকন্ঠিত গলায় পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার ভাই ঠিক আছে তো আপা?’
‘মাহমুদ ঠিক আছে। আমার আম্মা ঠিক নাই তনয়া। আমার আম্মা ঠিক নাই। আইসিইউ নামক কাঁচের ঘরটার ভেতর জীবন আর মৃ*ত্যুর সাথে লড়াই করছে। আজ দুইটা দিন আমার মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কথা বলে না। হাসে না। বকে না। খায় না।’
‘কি হয়েছে আম্মার? বলবেন তো নাকি?’ তনয়া রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
‘মুনিরা গয়নাগাটি নিয়ে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে। আম্মা এই ধাক্কা সামলাতে পারেনি। হার্ট এট্যাক করেছে। সাথে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হওয়াতে এক পাশ প্যারালাইজ। দুইটা দিন গত হওয়ার পরও আম্মার অবস্থার কোনো উন্নতি নাই। কেবল নিঃশ্বাস টুকু নিচ্ছে।’
‘দুইদিন হয়ে গেল আর আপনারা আমাকে আজ বলছেন?’
‘তোমায় বলার মুখ আমাদের নেই। আম্মা তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে। তার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। শুধু বলবো আম্মার জন্য একটু দোআ করো। আল্লাহ যেন আমাদের মা হারা না করেন।’
#চলবে