#সংসার_সমরাঙ্গন (২৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
সবাই যখন রুম থেকে বেরিয়ে যায় তনয়া হঠাৎই মাহমুদের হাতটা খপ করে চেপে ধরে। চোখ মুছে একটু সময় নেয়। তারপর নীরব কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
‘মুনিরা? মেয়েটাকে একটা খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করো না দয়া করে।’
মাহমুদ এক মুহূর্ত নীরব থাকে। তারপর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘তোমার কি মনে হয় আমি চেষ্টা করিনি? যে নিজেই হারিয়ে যেতে চায় তাকে কেউ কিভাবে খুঁজে পাবে? খুঁজে পাওয়ার কোনো রাস্তাই তো খোলা রাখেনি।’
তনয়া থেমে থাকে না। তার কণ্ঠে চাপা তাগিদ।
‘তবুও তুমি দেখো না একটু? এমন সময়ে ও থাকবে না? যতই ভুলই করুক মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানার অধিকার তো তারও আছে। এখন না জানলে পরে যখন জানতে পারবে, তখন তো…’
কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে তার।
মাহমুদ তাকায় তনয়ার দিকে। দৃষ্টিতে ক্লান্তি, কণ্ঠে ম্লান স্বর,
‘বস্তির মুখের গলিটায় যে কতগুলো ছোট ছোট বিল্ডিং আছে ছেলেটা সেখানে একটা রুমে ভাড়ায় থাকতো। যতদূর খবর নিয়ে জানতে পেরেছি উত্তরাঞ্চলের কোথাও একটা ছেলের গ্রামের বাড়ি। খুব সম্ভবত কুড়িগ্রাম। এটা তো খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো। এই অবস্থায় আমি কোথায় খুঁজবো বলতে পারো? তাই আশা ছেড়ে দিয়েছি।’
তনয়া আর কিছু বলে না।
শোকের আবরণে মোড়া সেই ঘরে আবার ঘন হয়ে নামে নীরবতা।
‘কথায় আছে সময় গেলে সাধন হবে না। সেদিন তোমার কথা যাচাই করার দরকার ছিল। যার মাশুল আজকের দিন। মুনিরা টা যদি জানতো ওর একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ আমরা মা হারা। যাইহোক আম্মার জীবনের বিনিময়ে হলেও মুনিরা ভালো থাকুক।’
____________________________
খাটিয়ার ওপর নিথর পড়ে আছে মেহেরুন্নেসার দেহ। সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো, শেষ বিদায়ের প্রতীক্ষায়। সময় যেন থমকে গেছে চারপাশে। শিয়রের পাশে নিঃশব্দে বসে আছে সুমনা। বুকের ভেতর এক অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে। কিন্তু চোখে একফোঁটাও জল নেই। ম্লান দু’চোখে সে অপলক তাকিয়ে আছে কাফনে ঢাকা প্রিয় মুখের দিকে। এইতো আজই শেষ দিন। আর কাউকে মা বলে ডাকা হবে না। মায়ের গায়ের গন্ধ নেওয়া হবে না। মানুষটা থাকবে না। থাকবে কেবল নামের অস্তিত্ব।
সুমনার কাঁধে আলতো হাত রেখে পাশে বসে আছে তনয়া। তার মুখেও অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। যেন সমস্ত শব্দ হারিয়ে গেছে এই শোকের ভারে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে মাহমুদের গলা শোনা যায়।
‘আপনারা জানেন, আমার আম্মা আজ এই পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। জীবদ্দশায় তিনি আপনাদের অনেকের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। কখনো আত্মীয়তায়, কখনো সৌজন্যে, আবার কখনো সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমে। তার জীবনের কোনো পর্যায়ে যদি কারো সঙ্গে কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন থেকে থাকে, কেউ যদি তার কাছে কিছু পাওনা রাখেন। দয়া করে আমাকে জানাবেন। আমি যথাসম্ভব পরিশোধ করার চেষ্টা করবো।
তেমনি, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, যদি কথায় বা ব্যবহারে তিনি কখনো কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন আমি বিনীতভাবে সবার কাছে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনারা সবাই আমার আম্মার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেন। তার কবরকে প্রশান্তিময় করে তুলেন। আর তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন। আমিন।’
মাহমুদের কথা শেষ হওয়া মাত্রই মাথায় কারো হাতের অস্তিত্ব টের পায় তনয়া। মাথা উঁচিয়ে তাকাতেই দেখতে পায় খালেকুজ্জামান ম্লান আর কাতর চোখে চেয়ে আছেন। এই চাহনির মানে তনয়া জানে। তনয়া ফোলা ফোলা চোখে পলক ফেলে। চোখের পানি স্পর্শ করে চিবুক। যার অর্থ আমার কোনো অভিযোগ নেই।
একজন পুরুষ বলে উঠে, ‘তুমিও ভাবিকে মাফ দাও ভাই।’
‘তার প্রতি তো আমার কোনো অভিযোগ নেই। মাফ কিসের জন্য।’
‘শেষ বিদায়ে সুন্দর করে বলো না। একটু পরেই সারাজীবনের জন্য সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসবে।’
খালেকুজ্জামান একমুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যেন মাথাতেই ছিলো না মেহেরুন্নেসাকে গোরস্তানের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হবে।
‘আপা? আমরা একটু দূরে যাই? আব্বা এখানে আসুক।’
সুমনা নিঃশব্দে সরে যায়। ঠিক সুমনার জায়গায় হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন তিনি। আলতো করে ডাকলেন তিনি। যেন মেহেরুন্নেসা ঘুমোচ্ছে।
‘মেহের? মেহের?’
খানিক চুপ থেকে আবারও ডাকে।
‘মেহের? তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?’
গাল ভিজে ওঠে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটার। শিশুর মতো ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।
বাবার কান্না দেখে মাহমুদ কেঁদে উঠে। হেঁচকি তুলে কাঁদে সে। সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদের কাঁধে হাত রাখে নোমান। এ যেন নীরব সান্ত্বনা।
‘পুরুষ হয়ে ভেঙে পড়লে নারীদের কি হবে? ওরা যে আরো ভঙ্গুর প্রকৃতির।’
সোহেলের কথায় সে বোনের দিকে চাইলো। তার অবস্থা আরো নাজেহাল। তনয়াকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে সে।
‘তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই মেহের। ভুলত্রুটি নিয়েই মানুষ। আল্লাহ যেন তোমাকে ক্ষমা করে।’
খাটিয়ায় মাথা ঠেকালেন তিনি। কান্নার বেগ বাড়ছে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন এরচেয়ে নিদারুণ করুণ চিত্র বোধহয় দুনিয়ায় আর হয় না।
____________
শেষ বিদায়ের ভারী মুহূর্ত। নিস্তব্ধতা ভেদ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে চারজন, কাঁধে তুলে নেয় খাটিয়া। চারদিক জুড়ে ভেসে ওঠে একটাই চিরচেনা, শিহরণ জাগানো ধ্বনি,
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’
সেই মহাপবিত্র উচ্চারণে ঘনীভূত হয় আবেগ, বেদনা আর আখিরাতের অনন্ত প্রত্যাশা।
গুনগুন কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে প্রবল হয়। একে একে সব পুরুষ মানুষ এগিয়ে চলে জানাজায়। কেউ কেউ চোখ মুছতে মুছতে মিলিয়ে যায় ধুলোমাখা প্রান্তে। সুমনাকে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। তনয়া একা সামলাতে পারে না।
‘মা গো আমাদের কোথায় রেখে গেলা গো মা। আর ক’টা দিনের আয়ু নিয়ে কেন এলে না। মা ডেকে যে মন তৃপ্ত না। তনয়া ওরা আম্মাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের আটকাও ওদের আটকাও।’
সুমনার কণ্ঠ বুজে আসে। দেহটা নেতিয়ে পড়ে। গলা দিয়ে আর কোনো শব্দ বেরোয় না। শুধু কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস।
আবারও চাপা গুঞ্জন শোনা যায়, ‘সবাইকে দেখা গেল। মুনিরাকে দেখা গেল না। কিছু একটা হয়েছে। না হলে এই মেয়ে কোথায়?’
সুমনা মাথা তুলে তাকায়। নিভু নিভু চোখজোড়া হঠাৎই যেন জ্বলে ওঠে জ্বলন্ত ক্ষোভে।
‘ওই জানোয়ারের নাম মুখে নিবেন না। ওই অমানুষটা আমার আম্মারে খাইছে।’
তনয়া কাঁপতে কাঁপতে সুমনার হাত খামচে ধরে। চায় তাকে থামাতে। চুপ করাতে।
‘আমাদের মানসম্মানের কথা ভাবলো না। ওর সিদ্ধান্তের জন্য আম্মা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলো। নিজে মা হারা হলো। আমাদেরও মা হারা করলো। কি হবে এসব লুকিয়ে? মা মা*রা গেছে অথচ ছোট মেয়েকে কেউ একটা বারের জন্য দেখেনি তোমার কি মনে হয় এরা অবুঝ? এরা কেউ বুঝবে না? সবাই ঘটনা জানবে না?’
‘আপা থামুন না এবার।’
সুমনা থেমে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘থেমেছি তনয়া থেমেছি। তবে যেদিন ওকে পাবো সেদিন থামবো না।’
___________________
রাত বাড়তেই একে একে আত্মীয়রা বিদায় নিতে শুরু করলো। বাইরে নীরবতার এক অদৃশ্য চাদর ছড়িয়ে পড়েছে। আর ঘরের ভেতর ছিল চাপা একটা অস্বস্তি। তারা যাওয়ার আগপর্যন্ত ফিসফিসানির শব্দ ছিল চারপাশে। ঘটনা আচঁ করতে পেরে কারও চোখে ছিল অবিশ্বাস। কারও মুখে চাপা উত্তেজনা।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে বিস্তারিত জানার জন্য কেউই মুখ ফুটে প্রশ্ন করার সাহস করেনি। যেন এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ঘিরে রেখেছিল চারদিকে।
খালেকুজ্জামানের বুকে মাথা রেখে বসে আছে সুমনা। আজ যেন পৃথিবীর সমস্ত শান্তি এখানে নেমে এসেছে।
সুমনার মেয়েকে সাথে নিয়ে এগিয়ে আসেন নাজমা বেগম। বাচ্চা মেয়েটির চোখমুখ শুকিয়ে একেবারে পাংশু হয়ে গিয়েছে। চোখে চাপা আতংক।
‘এভাবে থাকলে তোমার মা ফিরে আসবে?’
সুমনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘সকাল থেকে কিছুই খাওনি তোমরা। তোমরা না খেয়ে থাকলে তো বেয়ান ফিরে আসবে না।’
‘খিদে নেই আন্টি।’
‘পাগলামি করে না মা। খাবে চলো।’
‘বাকিদের খেতে দিন। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘তোমার মেয়েটার দিকে তাকাও। সারাদিন মেয়েটা কিছু খায়নি। রূপা খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করলো। তুমি খাওনি তাই সেও খাবে না। মেয়েটার জন্য অন্তত,,,,
সুমনা মাথা তুলে তাকায়। হাত বাড়িয়ে ডাকতেই মায়ের পাশে বসে নিশি। মেয়ের মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে আবারও কান্নার ঝড় তোলে।
‘তোমার নানু তো আর নেই মা। আর কাকে নানু বলে ডাকবে?’
তখনই তার মাথায় হাত রাখেন নাজমা বেগম।
‘আর কত কাঁদবে মা? আর কেঁদো না। বরং বেয়ানের জন্য দোয়া করো।’
‘মন যে মানে না আন্টি। আজ সবাই আছে কিন্তু আমার আম্মা নেই। আমার বুকটা যে ফেটে যায়।’
নাজমা বেগম আর কিছু বলতে পারেন না। এই শোকের কোনো সান্ত্বনা হয় না। শূন্যস্থান কখনো পূর্ণ হবে না।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তনয়া। সুমনা হাতের ইশারায় ডাকতেই এগিয়ে এলো। পাশ থেকে খালেকুজ্জামান উঠে যেতেই তনয়া সেখানে বসে।
তনয়ার দুটো হাত মুঠোবন্দি করে সুমনা। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
‘আম্মার সাথে কথা বলে যখন ওঠে দাঁড়ালাম আম্মা আমাকে বলে, তনয়াটার সাথে অনেক অবিচার করেছি। কারনে অকারণে বকেছি। ভুল ধরেছি। কথা শোনানোর সুযোগ খুঁজেছি। একবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি আর মেয়েটাকে বকবো না। আগলে রাখবো যেভাবে তোদের আগলে রেখেছি। এই যে আমাকে দেখতে এসেছে। তোরা কিন্তু ওকে আর বাপের যেতে দিস না। বলে দিস কোনো রাগ যেন পুষে না রাখে। মা মনে করে যেন আমায় ক্ষমা করে দেয়।’
সুমনা কপাল ঠেকায় সেই মুঠোবন্দি হাতে।
‘এর আগে যখন আম্মা কথা বলছিল বুঝা যাচ্ছিল না। কোনো কথাই স্পষ্ট করে বলতে পারছিলেন না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তোমার কথা যখন বলছিল আম্মার গলার স্বর একদম স্পষ্ট ছিল। টানা কথার কোথাও আটকায়নি। আমি যদি জানতাম তনয়া ওটাই আমার মায়ের শেষ কথা হবে আমি কখনো সেখান থেকে আসতাম না। আচ্ছা আম্মা কী বুঝতে পেরেছিল আর বাঁচবে না? তবে বলল না কেন আমায়।’
সুমনা মাথা তুলে তাকায়। চোখের জলে নাকের একাকার তার।
‘মা ভেবে আমার মাকে ক্ষমা করে দিও। কোনো রাগ পুষে রেখো না। সংসারটা ফেলে যেও না কোথাও।’
#চলবে