#সংস্পর্শে_তুমি
#পর্ব_২০(অন্তিম পর্ব)
#নাহিদা_ইসলাম
সকাল সকাল অহনা হসপিটাল এসেছে। আজকে তার টেস্টগুলোর রিপোর্ট দিবে। অহনা শুভ্রকে না বলে এসেছে। শুভ্রকে বললে ই একা আসতে দিতো না,তাই আর বলেনি। রিপোর্ট ডেলিভারি কাউন্টার থেকে রিপোর্ট গুলো নেওয়ার পর অহনা রিপোর্টগুলো দেখে কান্না করে দেয়। প্রেগ্ন্যাসির টেস্ট দিয়েছিলো ডক্টর এবং রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে।
অহনা নিজেকে স্বাভাবিক করে বাসায় যায়। বাসায় গিয়ে রিপোর্টগুলো লুকিয়ে রাখে। শুভ্র রুমে ছিল না তাই কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি।
শুভ্র তার বাবা আরাফাত রহমানকে বাসায় নিয়ে এসেছে। অনেকবছর পর নিজের সন্তানদের কাছে ফিরলো আরাফাত রহমান। এতোদিন একা থেকেছে ইচ্ছে হলেও কারো সাথে গল্প করতে পারেনি। শুভ্র অহনাকে চিৎকার করে ডাকছে,
–অহনা এসে দেখো বাবা এসেছে।
অহনার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শুভ্র উপরে গিয়ে দেখে অহনা বেলকনিতে বসে আছে। শুভ্রকে দেখে চোখের পানি মুছে উঠে দাড়ালো। শুভ্র অহনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অহনা শুভ্রের সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। শুভ্র জড়িয়ে ধরে বললো,
–কি লুকাচ্ছো আমার কাছে?
অহনা নিশ্চুপ। কয়েকবার জিজ্ঞেস করার ওর ও কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুভ্র কাঁপলে চুমু দিয়ে বললো,
–বাবার সাথে দেখা করে রেস্ট নেও তুমি। একটু স্বভাবিক হও তারপর না হয় সব কথা শোনবো।
অহনা নিচে গিয়ে আরাফাত রহমানকে সালাম দেয়,
–আসসালামু আলাইকুম বাবা
–ওয়ালাইকুম আসসালাম মা। কেমন আছো মা। তোমার মুখখানা এমন লাগছে কেনো?
অহনা মুখে হাসি টেনে বললো,
–কিছু না বাবা মাথাটা একটু ব্যথা করছে আরকি।
–তাহলে উপরে গিয়ে তুমি রেস্ট নাও পরে কথা বলবো।
–না বাবা আমি এখন ঠিক আছি।
অহনা আরো বেশকিছুক্ষন আরাফাত রহমানের সাথে কথা বলে। কথা বলে উপরে চলে যায়।
অহনার বড্ড বেশি ভয় হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে অবন্তীকে কি শুভ্র এখনও ভালোবাসে। মনে মনে কি অবন্তীকে শুভ্র চায়। ভয় পেয়ে কি শুভ্র এ কথা প্রকাশ করছে না। এসব প্রশ্ন বার বার ঘুপাকখাচ্ছে মাথায়। সে তার প্রেগ্ন্যাসির কথা এখন জানাবে না। ভয় কাটুক যদি বুঝতে পারে সত্যি শুভ্র তাকে ভালোবাসে তাহলে ই কেবল প্রেগ্ন্যাসির কথা জানাবে।
___________________________
সকাল আটটা নয় বাজে অহনা দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা মায়ের কবরের সামনে। বাবা মা নেই ছোটবেলা থেকে যদি থাকতো তাহলে জীবনট হয়তো অন্যরকম হতো। এতো কষ্ট হয়তো সহ্য করা লাগতে না। বাবা মায়ের করব একসাথে ই আছে। এখানে আসলে মনে ভেতর অন্যরকম শান্তি অনুভব করে অহনা। মনে হয় বাবা মা দু’জনই তার পাশে আছে।
শুভ্র ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে শার্ট পড়তে পড়তে তার চোখ যায় ওয়ারড্রবের লাস্ট ড্রয়ারে। ড্রয়ারটা ভালোভাবে লাগেনি। কিছু একটা জন্য আটকে আছে। শুভ্র বসে ড্রয়ারটা লাগানোর চেষ্টা করলে ও লাগছে না।কাপড় আটকে আছে কোণায়। শুভ্র ড্রয়ারটা পুরোপুরি খুলে কাপড়টা ভেতরে রাখতে যাবে ঠিক তখনই প্রেসক্রিপশন দেখতে পেলে। গাইনোকোলজিস্টের নামটা দেখে চিনতে পারলো গতকাল এই ডক্টর অহনাকে দেখেছিলো। ভেতরে খুলতে ই প্রথমে ঔষুধের নাম দ্বিতীয় আরেকটা কাগজ উপড়ে তুলতে ই দেখে প্রেগ্ন্যাসি রিপোর্ট পজিটিভ। বাকি রিপোর্টগুলো ও ভালোভাবে দেখলো। প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে অহনাকে ডাকছো শুভ্র। অহনার কোনো সাড়া না পেয়ে দৌড়ে নিচে গেলো।নিচে ও নাই। সবাইকে জিজ্ঞেস করলো অহনা কোথায় কেউ অহনার কথা জানে না।
ঘুম থেকে উঠে শুভ্র অহনাকে দেখতে পায়নি। ভেবেছিলো নিচে আছে।
রাসু বেগম অহনার পাশে দাড়িয়ে আছে। অহনার কান্না দেখে রাসু বেগম ও কান্না করছে। রাসু বেগম এই পথ ধরে সকাল বেলা হাটছিলো। হঠাৎ অহনাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে দেখলো দাড়িয়ে কান্না করছে। রাসু বেগম আধঘন্টা হবে অহনার সাথে দাড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকবার নানান প্রশ্ন করলে ও একবারের জন্য ও উত্তর দেয়নি অহনা। এবার রাসু বেগমের ফোন বেজে উঠলো,
হ্যালো বলতে ই ঐপাশ থেকে শুভ্র জিজ্ঞেস করলো,
–চাচি অহনা কি আপনাদের বাসায়?
রাসু বেগম বললো,
–হ্যাঁ বাবা এসেছে।
শুভ্র কল কেটে দিলো। ভয় পাচ্ছিলো শুভ্র। অহনা তাদের বাসায় আছে শুনে মনে হচ্ছে প্রাণ ফিরে পেলো। শুভ্র দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দেয়।
রাসু বেগম অহনার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,
–মারে আর কত কান্না করবি এবার বাড়ি চল।
–চাচি আমি তো অনাথ আমার আবার বাড়ি আছে নাকি।
–এভাবে বলিস না মা আমার অপরাধবোধ আমাকে কুড়কুড়ে খাচ্ছে। এই বুড়ো মাটাকে ক্ষমা করিস মা।
–চাচি এভাবে বলো না আমি তো তোমাদের সংসারের উটকো ঝামেলা ছিলাম। আমার জন্য তোমার সংসারে বেশি খরচ হতো। আমি অনাথ তুমি তো আমাকে লালান পালান করে বড় করেছো এই আমার অনেক।
–ক্ষমা করিস মা আমাকে তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার ও মুখ আমার নেই তাও তোর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। চল বাড়ি চল।
–অনেক তো করেছো চাচি আর বাড়ি গিয়ে তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার আসল বাড়ি তো এটা ই যেখানে আমার মা বাবা আছে।
কথাটা বলে ই অহনা চলে যেতে নিবে ঠিক তখনই রাসু বেগম হাত ধরে বললো,
–আজ যদি চলে যাস বুঝবো আমাকে ক্ষমা করতে পারিসনি। আজ আমি তোর চাচি হিসেবে নয় তোর পালিত মা হিসাবে বলছি তুই যাবি না।
অহনা আটকে গেলো রাসু বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
–মা হিসেবে বলেছো নয়তো চলে যেতাম। এটা শিকার করতে ই হয় তুমি আমাকে লালন পালন করে বড় করেছো। তুমি মায়ের মতো কিন্তু মা নয়। মা হলে কি আর আমার সাথো এমন করতে।
রাসু বেগম অহনার কাছে গিয়ে বলে,
–মা আমি যদি তোর পা ধরে মাফ চাই তাহলে কি মাফ করে দিবি?
অহনা রাসু বেগমকে হাতে ধরে বললো,
–চলো বাড়িতে যাই।
শুভ্র অহনাদের বাসায় এসে দৌড়ে অহনার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। রাসু বেগম জিনিয়া পিয়াস সবাই সামনে জড়িয়ে ধরায় অহনা বললো,
–ছাড়ুন আমাকে সবাই দেখছে।
শুভ্র অহনাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
–প্রেগ্ন্যাসির কথা আমার থেকে লুকিয়েছো কেনো অহনা?
শুভ্রের এমন প্রশ্ন শুনে অহনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–আপনি কিভাবে জানতে পারলে?
–কি ভেবেছিলে আমি জানবো না? এমনটা কেনো করলে।
রাসু বেগম হেসে বললো,
–কি বলছো বাবা তাহলে তো সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে হয়।
শুভ্র হেসে বললো,
–হে চাচি আপনার যা ইচ্ছে করুন আমি আপাতত অহনাকে নিয়ে যাচ্ছি। অহনার হাত ধরে টান দিতে ই অহনা বললো,
–আমি এখন যাবো না।
শুভ্র অহনার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–যদি না যেতে চাও তবে কোলে করে নিবো। তুমি কি চাও সবার সামনে আমি কোলে নেই।
অহনা কথা বাড়ালো না শুভ্রের সাথে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ঘন্টাখানের মধ্যে একটা বাসায় গিয়ে পৌঁছালো। ভেতরে ডুকতে ই সোফায় অবন্তীকে বসা দেখে অহনা শুভ্রের হাত ছেড়ে দিল। শুভ্র অহনার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
–অহনা পাঁচ মিনিট ওয়েট করো বুঝতে পারবে আমরা এখানে কেনো এসেছি।
কয়েকমিনিটের মধ্যে অবন্তীর বাবা মা আসে। শুভ্র তার ফোন বের করে বললো,
–আন্টি প্লিজ আপনি আমার ফোনটা দেখুন অবন্তী আমাকে প্রতিদিন কল দিয়ে ডিস্টার্ব করে এবং আমাকে বলে তার ফোন রিসিভ না করলে তার সাথে দেখা না করলে সে সুই-সাইড করবে।
অবন্তী মা বাবা মেসেজগুলো দেখে অবন্তীকে জোরে থাপ্পড় মারো। অবন্তী বাবা শুভ্রকে বলো,
–বাবা হাত জোর করে ক্ষমা চাই। এমন আর হবে না কথা দিচ্ছি। এখন তোমরা আসতে পারো।
শুভ্র অহনাকে নিজের বাসার উদ্দেশ্য বের হয়ে যায়। গাড়িতে কেউ একটা কথাও বলেনি। বাসায় আসতে ই অহনা কাউকে নিচে পায়নি। নিজের রুমে যেতে ই দেখলো সবাই তার রুমে বসে আছে। আর রুমটা বাচ্চাদের ছবি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। সবাই অহনাকে নতুন মা হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। সবাই রুম থেকে চলে যাওয়ার পর শুভ্র অহনার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
–অবন্তী বাবা মাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। অবশেষ গতকাল তাদের সাথে কথা হলো। পুরো ব্যাপারটা জানার পর উনারা আজকে আসলো বাকিটা তো তোমার সামনে ই ঘটলো। এবার তোমার মনের সন্দেহ দূর হয়েছে তো অহনা। আমাকে আর ভুল বুঝিয়ো না প্লিজ। তোমাকে কষ্ট পেতে দেখলে আমার ভালো লাগে না।
অহনা শুভ্রেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–সরি আমি ভয় পেয়েছিলাম ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমাকে ছেড়ে যাবেন।ভয় কাজ করতো। এখন আর কোনো ভয় নেই।
★★★
দুইবছর পর,
তিনটা বাচ্চা অহনাকে নাজেহাল করে ফেলেছে। দুপুরে তাদের খাওয়ানো যেনো একযুদ্ধ জয় করার সমান। দুই ছেলে পুরো অহনার মতো হয়েছে আর মেয়েটা শুভ্রের মতো।তিয়াস তমার ছেলে বাবু হয়েছে। মৌয়ের সবেমাত্র বিয়ে হলো। শায়লা, হামিদা, লামিয়া এখনও জেলে আছে।
অহনার অবস্থা দেখে শুভ্র হাসছে। বাচ্চাদের খাওয়ানোর স্টাইল দেখে মূলত শুভ্র হাসছে। বাচ্চাদের সব কাজ অহনা নিজ হাতে করে।কাউকে করতে দেয় না। শুভ্র একে একে বাচ্চাদের কপালে চুমু খায়। অহনার কপালে চুমু খেয়ে বললো, এভাবে ই সবাই একসাথে সারাজীবন থাকতে চাই।
সমাপ্ত