সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-০১

0
17

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#সূচনা পর্ব।
#লেখনীতেঃsuraiya rafa

শুধুমাত্র প্রাপ্ত মনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য।

[“যাদের ডেস্পারেট কিংবা রাগী হিরো পছন্দ গল্পটা শুধু মাত্র তাদের জন্য। যাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয় তাদের জন্য নয়।”]
[গল্পের স্থান, কাল এবং সকল দৃশ্যপট কাল্পনিক। ]
🚫 বিঃদ্রঃ এই গল্পে ডার্ক রোমান্সের অস্তিত্ব নেই।

ভালোবাসা একটি চার অক্ষরের বিশাল অর্থবহ তাজা অনুভূতির রাজ্য। এ অনূভুতি কে কখনো কখনো বিশ্লেষণ করে হাজারটা রূপ দান করা যায়।প্রেম, প্রনয়, মোহ,ঘোর,আসক্তি আরও কত কিই,আবার কারও কারও কাছে এটি “সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি” বা(unhealthy obsession)।
ভালোবাসার বিশ্লেষণ যেমন সবার কাছে এক’নয়, তেমনই সবার ভালোবাসার ধরনটাও ঠিক এক’রকম নয়।কিছু মানুষের ভালোবাসা সদ্য ফোটা ভৃঙ্গরাজ পুষ্পের ন্যায় আকর্ষনীয় আর সুরভীত।তাদের হৃদয়ের আদ্যপান্ত মিলনে ইষার্ন্বিত হয়ে কত প্রশংসাই না করে মানুষ। অলিতে-গলিতে বন্ধু মহল থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের আড্ডা পর্যন্ত তাদের নিয়ে চলে দিনভর আলোচনার বহর, কি করে তৈরি হলো এমন যুগল?? এতো রাজযোটক।কোনো দিন ভাঙবে না।আরও কত কিই!!!!
অন্যদিকে এই পুষ্পরেণুর মতো ভালোবাসার বিপরীতে যে শুধুই ঘৃনার বসবাস তেমনটা নয়, ওই যে বললাম ভালোবাসারও ধরন হয়। কেউ কেউ এসব গঁদবাধা ভালোবাসার নিয়মে গা ভাসাতে পারেনা কোনো কালেই, খালি মুখে ভালোবাসি কথাটা উচ্চারন করাটাও যেন হিমালয় জয় করার মতো এডভেঞ্চারাস আর থ্রিলিং তাদের কাছে, তাই সেসব কিন্তু ওয়ালা মানুষগুলোর ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটাও হয় কিছুটা ভিন্নরকম, সেখানে অনুভূতি প্রকাশের থেকে আদায়করার স্পৃহাটাই বেশি কাজ করে।সেই আদায় করার ধরনটা যেমনই হোক,জোর করে কিংবা তার থেকেও কোন কুৎসিত পন্থায় (এট এ্যনি কষ্ট)।

কারও কাছে সে ভালোবাসা বিষাক্ত তো কারও কাছে অসুস্থ।
কারও মতে এ আবার কেমন ভালোবাসা, এটা কোনো কালেই ভালোবাসা নয়,নিছকই আসক্তি, ভয়ানক আসক্তি। আবার ইঁচড়েপাকা, ডার্ক রোম্যান্স দেখে দেখে ফরেইন কালচারে বেড়ে ওঠা অষ্টাদশীদের কাছে ইটস কল্ড ডেঞ্জারাস লাভ।

এতো এতো বিশ্লেষণ আর চর্চার বাইরে গিয়ে আরও একধরণের অনুভূতি রয়েছে, এটা অনেকটা একপাক্ষিক ভালোবাসা বা অনসাইড লাভ। হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতির কথা তাকে না জানিয়েও কি সুন্দর দিনরাত অতিবাহিত করে দেওয়া যায় তাকে কল্পনায় ভালোবেসে। একটিবার চোখের দেখা দেখেও নরম হৃদয়টা পুলকিত হয়ে ওঠে মূহুর্তেই। ভালোবাসা টইটুম্বুর হয়, ভরে ওঠে হৃদয়ের কানায় কানায়,ভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে বই আস্তরিত ফাঁকা লাইব্রেরীর এককোনের ছোট্ট টেবিলটায় সেই শ্যাম পুরুষকে দেখার জন্য কত যায়গাতেই না ছুটে বেড়ায় বেপরোয়া সর্বনাশা মনটা, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে মনের অধিকারী র’ক্তমাংসের মানুষটাও।আপন মনকে অন্যজনের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিলে এই হয়। ক্যাম্পাসে এসে তাকে এক নজর না দেখা অবধি অশান্ত মনটা দমার নামই নেয়না। এই যেমন এই মূহুর্তটা মনটা কেমন ঝিমিয়ে যাওয়া ম’রা বিকেলের ন্যায় শান্ত হয়ে আছে। উচ্ছ্বাস আকাংঙ্খা সবকিছু দমে গিয়ে তৃষ্ণার্থ চোখ জোড়া সবচেয়ে পছন্দের শ্যাম পুরুষটিকে দেখতে ব্যাস্ত। সেকেন্ড, মিনিট,ঘন্টা অতিবাহিত হয়,তবুও তাকে দেখে দেখে চোখ দুটো ক্লান্ত হয়না, কি আছে এই শ্যাম পুরুষের মাঝে?? আহামরি তো কিছু নয়, হলিউড কিংবা বলিউড হিরোদের মতো পেশীবহুল গৌড় বর্ন ও নয়।ছিমছাম গড়নের শ্যাম পুরুষ সে, বেশ লম্বা চওড়া মানুষটা আর সবচেয়ে সুন্দর তার হাসি, হাসির সাথে সাথে কি সুন্দর ঠেউ খেলে যায় টোল পরা গাল দুটোতে।

ফাঁকা লাইব্রেরীতে সবচেয়ে কর্নারের টেবিলটায় ঠিক মুখো মুখি হয়ে বসে আছে নিখিল ভাই। এটা বোধ হয় নিখিল ভাইয়ের পছন্দের যায়গা ওই জন্যই তো প্রতিদিন এসে এখানটায় বসে বই পড়ে। পড়বে নাই’বা কেন ভার্সিটির তুখোর ছাত্র নিখিল ভাই,ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে সমাবেশ কিংবা নির্বাচন সব কিছুতেই নিখিল ভাইয়ের অগ্রাধিকার, সেই যের ধরে ভার্সিটির ভিপিও তিনিই।এক নামে সবাই চেনে,তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে একটুও কম্প্রোমাইজ করেননা তিনি, এই যে এখনো বই পড়ছে, কানে হেডফোন গুঁজে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে , এই সিনটা দেখতেও মারাত্মক লাগছে, লাগবেই তো এতো কাছ থেকে নিখিল ভাইকে দেখার সুযোগ হয়নি কোনো কালেই। মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই আটকে যাক।আজ লাইব্রেরিটাও বেশ ফাঁকা, সিনিয়র রা তেমন কেউই নেই।এই সুযোগে নিখিল ভাইয়ের সাথে দু’একটা কনভারসেশন এগোলে ক্ষতি কি??

–নিখিল ভাই,এই যে নিখিল ভাই…….লাজুক হেসে টেবিলে টক টক করে সামান্য টোকা দিয়ে ডাকছে অরু, তবুও নিখিল ভাইয়ের হেলদোল নেই কোনো। একবার তাকালো না পর্যন্ত আশ্চর্য এভাবে উপেক্ষা করার কি হলো?অরুর বুঝি খারাপ লাগেনা? লজ্জা আর আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে অরু আবারও ডাকলো তাকে,কিন্তু এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, নিখিল ভাই কোনোরূপ সারা দিলোনা বরং ওর দিকে না তাকিয়েই বাম হাত দিয়ে একটা ছোট্ট সাইজের এলার্ম ঘড়ি এগিয়ে দিলো ওকে, যেটা এই মূহুর্তে বাজখাঁই আওয়াজ তুলে কানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
–ইশ কি বিরক্তি কর, এটা কেন দিলেন নিখিল ভাই??

এবারও নিখিল ভাই নিশ্চুপ, বরং এলার্মের বিরক্তিকর শব্দটা আরও দিগুণ জোরে বাজিয়ে দিলেন তিনি, এলার্মটা বিরক্তির আওয়াজ তুলে কর্নকূহর ছাপিয়ে মস্তিষ্কে এসে লাগছে এবার, কানের পর্দা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম। নাহ আর নিতে পারলো না অরু,বিরক্তির চড়ম পর্যায়ে গিয়ে শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠলো,

— এটা বন্ধ করুন নিখিল ভাই উফফ আর সহ্য হচ্ছে নাআআআ.. একপর্যায়ে গায়ের কম্ফোর্টারটা ছুড়ে ফেলে হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলো অরু।

ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি.. চারিদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উঠতে একটু সময় লেগে গেলো ওর,যখন বুঝে উঠলো তখন প্রতিদিনের মতো প্যালেসের ন্যায় মাস্টার বেডরুমের কিং সাইজ বিছানায় নিজেকে আবিস্কার করলো অরু। ঠোঁট কামড়ে একটা চাঁপা নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে নিজের হাটু অবধি লম্বা সিল্কি চুল গুলোকে মেসি বান করে বিছানা ছাড়লো ও, তারপর সবার আগে বন্ধ করলো বিরক্তিকর অ্যালার্মটাকে।

একে একে পুরাতন জানালার ভারী পর্দা গুলো সরিয়ে রুমটাকে আলোকিত করে বসে পরলো ল্যাপটপ নিয়ে ,,তারপর সেই বিরক্তিকর কাজ মেইল পাঠানো।

গত একবছর ধরে এটা ওর রুটিনে রূপান্তরিত হয়েছে, আপা যে কেন বুঝতে চায়না কে জানে?আবারও ভেতরের আহত বাতাসকে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নিংড়ে বের করলো অরু।

মেইল পাঠানো শেষ হলে,শক্ত কাঠের চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে উদাসীন চোখে বাইরে চাইলো অরু,ওর
পড়নে কোন দামি পাজামা সেট নয়, বরং সিম্পল প্লাজো আর একটা ওভারসাইজ টিশার্ট, সাধারন বাঙালি মেয়েরা যা পরে ঘুমায় আর কি, এই রুমের বিশাল জানালার কারুকাজ করা লৌহ গাট গলিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু বাগানবিলাশের ছড়াছড়ি, এখন বসন্ত চলছে তাই একটু বেশিই সুন্দর লাগছে বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ডটা।

পুরান ঢাকায় যতগুলো প্রাচীন আর নাম করা বাড়ি আছে তার মধ্যে এই বাড়িটা অন্যতম। লোকমুখে শোনা যায় এ বাড়ির পূর্ব পুরুষরা নায়েব -গোমস্তা ছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এদের বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব আর আভিজাত্য ভাবটা রয়েই যায়, তাইতো যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সবাই রাজনৈতিক কর্নধার হয়ে নাম লিখিয়ে এসেছেন। এই বাড়িটা ঠিক কোন প্রজন্মের জানা নেই অরুর তবে বাড়িটা বেশ পুরোনো। প্রায় দশ বিঘা জমি নিয়ে তৈরি এ বাড়িটাকে ছোট খাটো ড্রিম হলিডে বললে মন্দ কিছু হবেনা।
মহলের সদর দরজা থেকে গেইট অবধি যেতে মিনিট দশেক টাইম লেগে যায়, ধীরে সুস্থে হাটলে তার চেয়েও বেশি। তারপর চোখে পরে অযত্নে ইতি-উতি বেড়ে ওঠা বাগান বিলাসে ঘেড়া দানবাকৃতির বিশাল গেইট। তাতে মার্বেল পাথর দিয়ে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা
” ক্রীতিক কুঞ্জ “।

বছর ত্রিশেক আগেও বাড়ির নাম কিংবা গেইটের চেহারায় ভিন্নতা ছিল, কিন্তু ত্রিশ বছর আগে এ বাড়ির ছোট কর্তার জন্মের পরই তার দাদাসাহেব এক মাত্র আদরের নাতির নামে বাড়ির নাম পরিবর্তন করেন। ইট পাথর আর লোহায় ঘেরা গেইটকে সর্বেসর্বা বিদায় জানিয়ে মার্বেল পাথরের গেইট নির্মান করেন সে’ই, বাড়ির নাম পরিবর্তন করে রাখেন “ক্রীতিক কুঞ্জ”।

সময় পাল্টেছে, সময়ের তালে তালে বদলে গেছে কতৃত্ব আর আভিজাত্যে মোড়ানো মানুষ গুলোওও। একে একে খালি হয়েছে ক্রীতিক কুঞ্জ। তাদের দাম্ভিকতা কিংবা রাজনৈতিক অবদান এখন কেবলই লোক মুখের বুলি মাত্র। এতো কিছু বাদ দিলেও রিয়েলস্টেড বিজনেস নিয়ে এ পরিবার এগিয়েছে অনেক দূরে….. দেশ ছাপিয়ে বিদেশে সগৌরবে দাপিয়ে বেড়ায় এদের পারিবারিক বিজনেস। সবাই এক নামে চেনে, দেশিয় পন্যের থার্টি পাসেন্ট জোগান এদের পারিবারিক ব্যাবসা থেকেই আসে,শুধু উচ্চ পদস্থ না,সয়ং সরকারওও আজকাল মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলে এদের সাথে।
–আনফরচুনেটলি এই পরিবারের শুধু টাকাই আছে পরিবার বলে কিছু নেই, আপসোসের সুরে বলে ওঠে অরু। তখনই নিচ তলা থেকে অনুর রাশভারী কন্ঠস্বর শোনা গেলো,

–অরু এই অরুর বাচ্চা খেতে নাম, আমি কি এখন পালকি নিয়ে আসবো? হসপিটালে যেতে দেরি হলে তোর খবর আছে।
শুনেই বোঝা যাচ্ছে বেজায় চটে আছে সে।

অরু দ্রুত চেয়ার ছেড়ে দেওয়াল ঘড়িতে চোখ রাখলো, নয়টা বেজে পয়ত্রিশ,
— এই রে..হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে সময় শেষ করে ফেলেছি, তারউপর আজ আবার ভার্সিটিতে যাওয়ার প্লান আছে, নিচে গেলে আপা নির্ঘাত কথা শুনিয়ে পেট ভরিয়ে ফেলবে… এখন কি করি?

********************************

বিশাল হলরুমের এক কোনে রান্নাঘর, তার পাশেই ছোট একটা ডাইনিং, চারজন মতো বসার যায়গা হবে।সেখানেই খাবার সাজাচ্ছে অরুর বড় আপা অনু। এ বাড়ির কোনো কিছুই না পারতে ব্যাবহার করেনা অরুরা। যতটুকু না করলেই নয়,ঠিক ততটুকুতেই ওরা অধিকার খাটায়।

অনু খাবার সার্ভ করতে করতেই রেডি হয়ে নিচে নামে অরু, পরনে সেটে আছে টপস আর স্কার্ট, হাতে পুঁথি দিয়ে তৈরি বানজারা ব্যাগ।

অরু কে দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো অনুর। অরুর পরিপাঠি রূপ দেখে তেতিয়ে উঠলো মস্তিষ্কটা, রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো অরু চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে।
— এতোক্ষণে আসার সময় হলো তোর? রুমে দরজা আটকে কি করিস এতো? তোর জন্য আমার হসপিটালে যেতে কতটা দেরি হয়ে গেলো দেখলি??

— অরু রুটি আর ডিমের রোলে কামড় বসাতে বসাতে বললো, রেডি হচ্ছিলাম আপা।

— প্রতিদিনই তোর রেডি হতে লেট হয়? আর রেডি কেন হয়েছিস? কতবার বলেছি ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই, আমি একা এতো কিছু সামলাতে পারছি না হাঁপিয়ে উঠেছি আমি।নিঃশ্বাসের পাল্লা ভারী হয় অনুর।
অনুর হাজারটা অভিযোগেও অরু নিশ্চুপ। শুধু ছোট্ট করে প্রশ্ন করে, মা এখন কেমন আছে আপা?

অনু আবারও ঝাঁঝ নিয়ে বলে,
— সেটা নিজে গিয়েই বরং দেখে আয়।

— আমার দেখতে ভালো লাগেনা আপা, বড্ড কষ্ট হয় মাকে এভাবে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখতে, হসপিটালের ডেটল আর হেক্সাসল এর গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।শ্বাস নিতে পারিনা আমি।

অরুর কথায় অনু আড়ালে নিঃশ্বাস ছাড়ে, মায়ের অসুখের পর থেকে ওর ডান পিঠে দুরন্ত বোনটা নিজেকে অনেক সামলেছে,যে মেয়ে সারাদিন হুরোহুরি আর বান্ধবীদের নিয়ে মেতে থাকতো সেই মেয়ে ঘরকুনো হয়েছে, হাজারটা অহেতুক বায়না ধরা মেয়েটা প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে এখন আর একটা কথাও বলেনা। অরুর মতো মুক্ত বাতাসে ডানাঝাপটানো মেয়ের জন্য এই পরিবর্তন অনেক কিছু, এতো অল্প বয়সে আর কতইবা সামলাবে নিজেকে ও?

অরুর বয়স কম সবে উনিশে পা দিয়েছে, তাইতো অনু নিজেই ওকে এসব হসপিটালের ঝুটঝামেলা থেকে দুরে সরিয়ে রাখে, আবার নিয়তির সাথে পেরে না উঠে নিজেই বিরক্ত হয়ে যায় বারংবার, সে বিরক্তি নিজের মধ্যে আটকে রাখা কষ্টকর হয়ে ওঠে ওর জন্য,গুমরে মরা অশান্ত হৃদয়টাকে একটু হালকা করার দায়ে মাঝেমধ্যেই বহিঃপ্রকাশ ঘটে চড়াও মেজাজের, যার ভুক্তভোগী হয় ওর ছোট্ট বোনটা।
অনু নিজেকে বহুবার বুঝিয়েছে আর যাই হোক ছোট বোনের ওপর রাগ ঝাড়বে না, কিন্তু দিন শেষে, মায়ের অসুখ, বাড়ি হসপিটাল-হসপিটাল বাড়ি এই করতে করতে নিজের খেইর নিজেই হারিয়েছে।

–আপা আমি গেলাম, আগামী একসপ্তাহ কোথাও যাবোনা, রান্না বান্না সব আমি করবো তবুও প্লিজ রাগ করিস না তুই।

— এই শোন, অনুর অযাচিত ডাকে পেছনে ঘুরলো অরু।

— ইমেইল…

অনু কি বলবে সেটা বোধ হয় অরু জানতো, তাই এগিয়ে এসে বললো, ইমেইল পাঠিয়ে দিয়েছি।

— কোন রিপ্লে এসেছে??

অরু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— আপা তুইও না, গত এক বছর ধরে একটানা ইমেইল পাঠানোর পরেও যেখান থেকে একটা রিপ্লে আসেনি,হুট করেই সেখান থেকে রিপ্লে চলে আসবে? এতোটাও বেশি আসা করিস না।

কথা শেষ করে গট গট পা ফেলে প্যালেসের মতো বিশাল মহল ছেড়ে বেরিয়ে যায় অরু।

অরু চলে যাওয়ার পরে.. অনু আনমনে বলে, আমার বিশ্বাস অরু কোনো একদিন ঠিক রিপ্লে আসবে, আর আমরা মাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশেও নিয়ে যাবো। যেদিন মা আবারও সুস্থ হয়ে ফিরবে, তোর আর আমার দুঃখ সেদিনই ঘুচবে।

******************************
জটলা পাঁকানো চুলের মতো পুরান ঢাকার রাস্তা গুলোতে ইলেকট্রনিক তারের ছড়াছড়ি, রাস্তার দু ধারে লোহালক্কড়,হলুদ,মরিচ,শাড়ী, বিরিয়ানি আর গুড়ের পাইকারি দোকানের মরচে পড়া গন্ধ। কখনো কখনো সেই গন্ধটা নাকে উৎকট লাগে,আবার কখনো বেশ ভালো। মাথার উপর সূয্যি মামা তীর্যক আলো ছড়াচ্ছে, আজ বোধ হয় ভালোই গড়ম পরবে, দু’ধারে দোকান পাঠ ছাপিয়ে টিংটিং আওয়াজ করে জগন্নাথবিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অটোচালিত রিকশা, তাতে চেপে বসে আছে অরু।

পুরো নাম,মেহরীন শেখ অরোরা। এই বছরই ভার্সিটিতে এডমিশন হয়েছে ওর। তবে নতুন নতুন বড় হয়ে যাওয়া, ভার্সিটির আনন্দ, কিংবা বন্ধুমহল কোনো কিছুই ছুতে পারেনি ওকে, কারন একটাই মায়ের হার্টের অসুখ। আগে তাও হেটে চলে আসতে পারতো কিন্তু গত একবছর ধরে হসপিটালের এক কামরার বেডে শুয়ে দিনাতিপাত করে ওর মা আজমেরী শেখ। মায়ের দিনরাত দেখভাল করতে হয় বলে বড় বোন মেহবীন শেখ অনন্যা ইন্টারমিডিয়েটের পরেই পড়াশোনার ইতি টেনেছে।
অরু জানে ওর বড় আপা এতো রগচটা কোনোকালেই ছিলনা, গত একবছর ধরেই এমন হুটহাট রেগে যায় আপা, আর এও জানে পরিবারের জন্য আপার কত বিষর্জন, এমনটা নয় যে অনু বয়সে অরুর থেকে খুব বড়, পিঠেপিঠি বোন ওরা দুজন,তবুও অনুর কত ত্যাগ।

তাইতো আপার রাগের মাথায় বলা সবচেয়ে তিক্ত কথাগুলোকেও গায়ে মাখেনা অরু।
অরুর উদাসীন ভাবনার ইতি টেনে রিকশা এসো পৌঁছালো গন্তব্যে।

ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে লম্বা করে শ্বাস নেয় অরু, এই একমাত্র যায়গা যেখানে এসে একটু প্রানভরে সস্থির নিঃশ্বাস নিতে পারে অরু। সেই সাথে সস্থিদায়ক মানুষটার একটিবার দেখা মিললে তো আর কথায়ই নেই।
যাকে নিয়ে ও রোজ স্বপ্ন দেখে, সুন্দর সপ্ন। অরু জানে নিখিল ভাইয়ের সাথে কমিটমেন্ট কিংবা মুখ ফুটে দুটো কথাবলার সাহস ওও ওর নেই।তারউপর নিখিল ভাই ভার্সিটির সিনিয়র, গ্রাজুয়েশন ও এবছর শেষ তার।তবুও বেহায়া মনটা মানেনা। প্রিয় মানুষের স্কেচ বোর্ডে তার মুখটাই এঁকে ফেলে বারবার।

–কবে যে নিখিল ভাই নিজে এসে বলবে, অরু শোনো, আমি ও তোমাকে পছন্দ করি,মনের রঙ তুলির ক্যানভাসে আমিও তোমাকে আঁকি।

–সেই আশায় সেগুড়ে বালি।

পেছনে নীলিমার কাঠকাঠ প্রতিউত্তর শুনে অরুর হাসিহাসি দাঁত কপাটি বন্ধ হয়ে গেলো।মুখটা এইটুকুনি করে বললো,
— তুই আমার মনের কথা শুনলি কি করে?

— যেই টোনে বলছিলি,আমি কেন রিকশা ওয়ালা মামারাও শুনেছে আমি শিওর।

— আপসোস শুধু নিখিল ভাইই শুনলো না।

— কি করে শুনবে? তুইতো তাকে দেখলেই চোরের মতো যথাতথা লুকিয়ে পরিস।

— তা ঠিক চল ভেতরে যাই।
গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে যেতে নীলিমা বলে,
— আন্টির কি খবর??এখন কেমন আছেন?

— একই রকম।আজকেও আপার বকুনি খেয়ে এসেছি।
নিলীমার শান্তনার বাণী বহু আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে,ঘটে যা ছিল সব কিছু দিয়েই অরুকে বুঝিয়েছে ও তাই এখন আর বলার কিছু নেই। শান্তনা না দিয়ে হয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো নীলিমা।
— তোর ভাইয়ার কোম্পানি থেকে ইমেইল এসেছিল??

কথাটা বলতে একটু অসস্থি হলো নীলিমার, কারন সব ব্যাপারে মুখ খুললেও এই ব্যাপারটা সবসময়ই এরিয়ে যায় অরু, খুব বেশি হলে হুম হা করে উত্তর দেয়।
এবারও তাই হলো, এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে না জবাব দিলো অরু।

নীলিমার রাগ হলো কেন যেন, যদিও ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অরুর ব্যাক্তিগত তবুও এ কেমন ছেলে?? মায়ের খোজ নেয়না, ইভেন কোনোরকম যোগাযোগ নেই পর্যন্ত। আজকালকার যুগে ইমেইলে কেউ যোগাযোগ করে?

নীলিমা রাগ সংবরণ করতে না পেরে বলেই ফেললো, কেমন ভাই তোর মাকে এভাবে দেশে ফেলে রেখে নিজে বিদেশে পরে আছে??

অরু মেকি হাসলো, হুট করেই নীলিমার রাগের কারন ধরতে পারলো না, তবুও নরম সুরে বললো,
–হি ইজ নট মাই সিবলিং।

— তাহলে?? স্টেপ ব্রাদার, মানে আঙ্কেলের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে তাইতো??

অরু আবারও হাসে এই মেয়ের এতো কৌতূহল কেন?

—- নাহ তেমন কিছুও নয়।

— তাহলে কেমন ভাই তোর??
নীলিমার কথার পেছনে অরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওদের মাঝে তিথি চলে আসে।
আর মি. জায়ান ক্রীতিককে নিয়ে চলমান রহস্যময় কনভারসেশনের ওখানেই ইতি ঘটে।
চলবে………
প্রথমবার উপন্যাস টাইপ কিছু লেখার চেষ্টা করেছি ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা প্রার্থী।

এতো এতো শব্দ ভান্ডার লিখতে গিয়ে টাইপিং মিস্টেক হওয়াটা কোনো বিরাট বড় অ’পরাধ নয়, আমার মতে।নজরে এলে অবশ্যই জানাবেন, আমি শুধরে নেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করবো।