সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৩১+৩২

0
5

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৩১
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

ইদানীং প্রায়শই শেষ রাতে ঝড় হয়। প্রকট ঝড়ে গাছপালা ভেঙেচুরে শহরতলীর হাইওয়ে রাস্তাঘাট পর্যন্ত ব্লক হয়ে থাকে নিমিষেই ।অতঃপর ভোর হতেই সেই ঝড়বৃষ্টি দমে গিয়ে নতুন করে উদীয়মান হয় সোনালী রঙা সূর্য কীরন। এখন সন্ধ্যারাত চলমান, তবুও শেষ রাতে ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে হুহু করে এলোপাথাড়ি বইতে থাকা মেঘ ভেজা ঘূর্ণি বায়ু। সেই তীব্র ঝড়হওয়ার উল্টো পথে বাতাস কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের ব্ল্যাক মার্সিডিজটা। চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজমান, পুরো রাস্তাটা খালি পরে আছে, এই যায়গাটা বরাবরই এমন, সন্ধ্যে হতে না হতেই মানুষ জনের আনাগোনা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়।

ড্রাইভিং সিটে বসে দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে ক্রীতিক নিজেই। ভার্সিটির কিছু জরুরি কাজ সম্পন্ন করে আজকেই নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিসকো ফিরেছে সে। চোখে তার ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। সব সময় সেট হয়ে থাকা আন্ডারকাটিং স্টাইলিশ চুলগুলোও এখন এলোমেলো ভাবে কপালে পরে আছে। ড্রাইভ করতে করতে প্রায়শই কপালে পরে থাকা অবিন্যস্ত চুলগুলোকে একহাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে পেছনে ঠেলছে ক্রীতিক। তবে এই মূহুর্তে ওর ক্লান্ত মুখ ভঙ্গিমা খুব একটা ঠাওর করা যাচ্ছে না। চোখের ভাষা পড়ার উপায় নেই। দেখলে মনে হবে অনুভূতিহীন নির্জীব এক কাঠের পুতুল। অথচ হাতদুটো চলছে নির্বিগ্নে, ক্রীতিক যখন স্পিডোমিটারের সর্বোচ্চ গতিতে নিজের গাড়িটাকে বাতাসের বিপরীতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই খানিকটা ফুরসত দিয়ে ভাইব্রেট ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে ওর। ক্রীতিক কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে স্পিডোমিটারের গতি সামান্য ধীর করে ফোনটা রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অর্ণব হন্তদন্ত হয়ে বলে ওঠে,
— ভাই খবর শুনেছিস?

ক্রীতিক শুধালো,
— কি খবর।

গলার আওয়াজে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে অর্ণব বললো,
— নিখিল কে সার্চ করার জন্য পুলিশ সহকারে ওর এ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিখিল কোথাও নেই। কোথাও নেই মানে কোথাও না।ভার্সিটি, ক্যাম্পাস, সাইনটিস্ট টীম কেউ ওর খবর জানেনা, কেউ না, এমন কি ওর গার্ল ফ্রেন্ডরাও না। কোথায় পালালো বলতো এই হতচ্ছাড়া?

ক্রীতিক স্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— কোথাও না।

–কিহ!

অর্ণবের কথার প্রতিউত্তরে ক্রীতিক বললো,
— ওকে রাশিয়ান মাফিয়ারা গু’ম করে নিয়ে গেছে, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছিল কিনা,দেখ গিয়ে এতোক্ষণে হয়তো পিস পিস করে ওর লি’ভার কি’ডনি গুলো অন্যদেশে পা’চার করে দিয়েছে তারা।

ক্রীতিক এমন ভাবে নিরুদ্বেগে কথাগুলো বলছিল যেন সামান্য একটা মুরগী কা’টার কথা বলা হচ্ছে এখানে, কি আশ্চর্য!

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব আঁতকে উঠে বললো,
— কি বলছিস? তুই কি করে জানলি এতোসব?

ক্রীতিক ড্রাইভ করতে করতে ঠোঁটের কোনে একটা বিন্যাস্ত কপট হাসি ধরে রেখে বললো,
— আমিইতো ওকে মাফিয়াদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছি,কৌশলে।

অর্ণব তেতে উঠে বললো,
— এটা মোটেও হেলাফেলার কথা নয় জেকে। ছেলেটা ইয়ং, বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভুল করে বসেছে, আমরা ওকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারতাম, হয়তো শুধরে যেতো, নিজের ভুলটা বুঝতে পারতো, তা-না তুই ওকে ডিরেক্ট মৃ’ত্যুর দিকে ঠেলে দিলি? এভাবে কৌশলে আর কত মানুষকে মা’র’বি তুই? সেদিন এ্যা’ক্সিডেন্টের পর জ্যাকসন হসপিটালে ধুঁকে ধুঁকে মা’রা গিয়েছে, আর আজ নিখিল।

অর্ণবের কথায় ক্রীতিকের মোটেও হেলদোল হলোনা, বরঞ্চ নিজের চোয়াল খানা শক্ত করে ও বললো,
— যে যার কর্মফল ভোগ করলে আমার তো কিছু করার নেই।

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ওদের একমাত্র দোষ কি? ওরা অরুর দিকে হাত বাড়িয়েছিল তাইতো?

ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,
—এক্স্যাকলি।

— এতো অবসেশন ভালো নয় জেকে। বাই এনি চান্স তোর এই অতিরিক্ত আসক্তি অরুর উপর চড়াও হলে তখন? মেয়েটাকে তো রেগেমেগে মে’রে ফেলবি তুই।

অর্ণবের কথার পাছে ক্রীতিক বললো,
— কখনো এমন পরিস্থিতি এলে নিজেকেই নিজে আ’ঘাত করবো আমি। তবুও ওকে নয়। আফটার অল,সি ইজ মাই প্রোপার্টি,হার্টবিট, এন্ড মাই এভরিথিং।

অর্ণব ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—বুঝেছি তোকে আবার সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। নয়তো তুই শুধরাবি না।

ক্রীতিক ওর কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,
— জ্ঞানদান পর্ব শেষ হলে বল, কলটা রেখে দেই, আমি ড্রাইভ করছি।

এরপর ওপাশ থেকে কল কাটার পিক পিক আওয়াজ ভেসে এলো কানে। অর্ণব কল রেখে দিলে ক্রীতিক আবারও মন দেয় ড্রাইভিং এ।
সেদিনের পাহাড়ের ঘটনার আজ প্রায় একসপ্তাহ হতে চললো, অথচ গত একসপ্তাহে একবারও অরুর সাথে দেখা কিংবা কথা কোনোটাই হয়ে ওঠেনি ওর।কারন গত একসপ্তাহ ধরেই শহরের বাইরে ছিল ক্রীতিক। আর আজ যখন সানফ্রান্সিসকো ফিরে অরুকে কল দিলো তখন বারবারই ফোনটা বন্ধ বলছে। এতোক্ষণ তো ক্রীতিক ভেবেছে ব্যাপারটা খুবই সাভাবিক ফোন বন্ধ থাকতেই পারে, কিন্তু অর্ণবের সাথে কথা বলার পর থেকেই অরুকে দেখার জন্য হৃদয়টা কেমন আনচান করছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে দেখা না হোক এটলিস্ট অরুর তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দটুকু যদি শোনা যেত তাহলে রাতে অন্তত নিশ্চিন্তে ঘুমানো যেত।

খানিকক্ষন ধরে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মাঝ পথেই ব্রেক কষলো ক্রীতিক। অতঃপর ফোন হাতে নিয়ে দ্রুততার সাথে ডায়াল করলো অরুর নাম্বারে। কিন্তু না অরু কল তুললো না। গত কয়েকবারের মতো এবারও ফোনটা বন্ধ বলছে।এহেন কান্ডে ক্রীতিক বেশ বিরক্ত হলো, উগ্র মেজাজটা হুট করেই চড়াও হলো অরুর উপর। রাগের তোপে মনেমনে দাঁত খিঁচে বললো,
— তোকে একবার চোখের সামনে পেয়ে নেই অরু। তারপর বুঝাবো ফোন বন্ধ করে রাখার শা’স্তি কাকে বলে।

বারবার কল দিয়েও কোনোভাবেই অরুকে কলে না পেয়ে, বিরক্তিতে ফোঁসফাস করতে করতে শেষ মেশ ক্রীতিক কল লাগালো প্রত্যয়ের নাম্বারে।
দুএকবার রিং হওয়ার পরেই কল তুললো প্রত্যয়, তবে ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই ক্রীতিক তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন ছু’ড়লো ওকে,
— অরুর কোনো খবর জানো প্রত্যয়?

ওপাশ থেকে বোধ হয় প্রত্যয়ের শুষ্ক ঢোক গেলার আওয়াজ ভেসে এলো, অগত্যাই আমতাআমতা করতে লাগলো ও।
প্রত্যয় আমতাআমতা করছে দেখে ক্রীতিক হুংকার দিয়ে বললো,
— কি হয়েছে? এরকম মেয়েদের মতো মিনমিন করছো কেন? যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলো, হোএয়ার ইজ অরু?

প্রত্যয় উল্টো প্রশ্ন করে শুধালো,
— ভাই আপনি কি ফিরেছেন?

ক্রীতিক বললো,
— হ্যা একটু আগেই ফিরেছি, এখন বাড়ির দিকে যাচ্ছি, কেন বলোতো?

প্রত্যয় ভয়ার্ত গলায় গাইগুই করে বললো,
— তাহলে বোধ হয় আমাদের একবার অরুদের বাসায় উচিৎ। আমি শুনেছি, না মানে সিওর না, শুনেছি কেবল, অরুর মা,মমানে আজমেরী ম্যাম বোধ হয় অরুকে বববিয়ে দিতে চাইছেন, আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসার কথা।

প্রত্যয়ের কথা শুনে ক্রীতিকের মাথায় ভলভলিয়ে র’ক্ত উঠে গেলো, নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরে ক্রীতিক গর্জে উঠে বললো,
— হোয়াট? এমন একটা কথা তুমি আমাকে এখন বলছো? ব্রেইন কোথায় তোমার?

প্রত্যয় থতমত খেয়ে বললো,
— ইয়ে মানে, আমি নিজেই একটু আগে শুনলাম ভাই।

ক্রীতিক আর অযথা কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না, তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটায় একশোর উপর গতি তুলে হাওয়ার বেগে হুঁশশ করে চলে গেলো উল্টো পথে।
*****************************************
বাইরের ঝড়হাওয়া ক্ষনে ক্ষনে বেড়েই চলেছে। প্রচন্ড বাতাসের তান্ডবে বারবার জানালার ভারী পাল্লা গুলো বারি খাচ্ছে আর বিকট আওয়াজ তৈরি করছে, এই দানবীয় শব্দ সইতে না পেরে অরু এগিয়ে গিয়ে রুমের সবগুলো জানালার গ্লাস টেনে দিলো। গ্লাস টেনে দেওয়াতে গ্লাসের সাথে বাতাস বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে এখন আরও ভ’য়ানক আওয়াজ তৈরি হচ্ছে রুমের মাঝে। সেদিকে অবশ্য খেয়াল নেই অরুর। ওতো সেই কখন থেকে রুমের দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে, চোখের সামনে যে ছোট্ট বেডসাইড টেবিলটা,তারউপর পিচ কালারের জামদানী শাড়ি আর কিছু গহনা রাখা আছে। এগুলো সেই বিকেলে এসে দিয়ে গিয়েছিল অনু। বলেছে সবকিছু পরে রেডি হয়ে থাকতে। সন্ধ্যা নাগাদ রাজের পরিবার আসবে ওকে দেখতে। রাজরা দুইতলায় থাকে, তাই মনে হয়না সন্ধ্যা হওয়ার পর আর দেরি করেছে তারা, বাইরে একাধিক মানুষের কথাবার্তা আর শোরগোল শুনে মনে হচ্ছে সবাই চলে এসেছে এতোক্ষনে অথচ অরু এখনো ক্রীতিকের দেওয়া পাজামা সেট পরেই বসে বসে ঠোঁট উল্টে কাঁদছে। কিভাবে কি ভেস্তে দেওয়া যায় সেটাই ভাবছে তখন থেকে। এতো অল্প বয়সে এরকম সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সেটা বোধ হয় কল্পনাতেও ভাবেনি অরু। অথচ যার জন্য এতো হৃদয়ের হাহাকার, গত একসপ্তাহ ধরে তার কোনো খবরই নেই। ফোন নেই তো কি হয়েছে? একটা বার কি বাসার নিচে আসা যেতো না?

অভিমান হলো অরুর, বেজায় অভিমান। অভিমানের জোয়ারে গলায় আটকে আছে বুক ফাটা কান্নার দল। ক্রীতিকের উপর অভিমানের ঘট যখন পরিপূর্ন ওর হৃদয়ে, তখনই অরুর মনে হলো,
—-না এসেছে ভালোই হয়েছে, ভুলেও যদি এসব কাহিনি জানতে পারতো তাহলে রাজের সাথে সাথে আমাকেও থা’পরিয়ে চান্দে পাঠিয়ে দিতো নিশ্চিত। যা হয়, তা বোধ হয় ভালোর জন্যই হয়, এবার আজকের দিনটা কোনোমতে বিগড়ে দিতে পারলেই হলো, পরে নাহয় রাজকে আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। আর তারপর মাকেও।

অরুর ভাবনার সুতো ছিড়লো বাইরে থেকে অনুর ডাকে, দরজার বাইরে বারবার ক’রাঘাত করতে করতে অনু বললো,
— কিরে অরু, রেডি হয়েছিস? দরজাটা খোল, তোকে যেতে হবেতো।

অনুর উপস্থিতি টের পেয়ে অরু মনেমনে চিন্তা করলো,
— আপাকে একবার বুঝিয়ে বললে কেমন হয়? আপাও তো একজনকে ভালোবাসে, ও নিশ্চয়ই বুঝবে।

— অরু দরজা খোল, সবাই অপেক্ষা করছে তো।
পুনরায় অনুর খাদে নামানো কন্ঠ কানে এলে, অরু এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

ভেতরে প্রবেশ করে অরুর এমন অগোছালো বিমূর্ষ রূপ দেখে অনুর চোখ কপালে উঠে যায়, ও তৎক্ষনাৎ দরজাটা লাগিয়ে অরুর কাছে এগিয়ে এসে ঝাঁজিয়ে বললো,
— রেডি হসনি কেন এখনো?কি চাইছিস? মা আবারও তোর উপর রেগে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরুক? আবারও এতিম হতে মন চাইছে?

অরু এবার কান্না ভেজা গলায় অনুকে অনুরোধ করে বললো,
— আমি এসব দেখাদেখি করতে চাইনা আপা, তুই প্লিজ মাকে একটু বোঝা, তোকে আমি সব বলবো, তার আগে তুই কিছু কর।

অনু অরুর চিকন বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— আমাকে কিচ্ছু বলতে হবেনা, এখানে মায়ের সম্মান জড়িয়ে আছে, মা নিজে ওদেরকে ইনভাইট করেছে তোকে দেখার জন্য, আর এখন তুই বলছিস যেতে পারবি না?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— যদি বলি আমি কাউকে ভালোবাসি?

অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কে সে, শুনি?

অষ্টাদশী অপারগ অরু নিজের মায়ের সৎ ছেলের নামটা উচ্চারণ করার সাহস আর পেলোনা, সব তচনচ হয়ে যাবে সেকথা ভেবে।
অরু চুপ হয়ে আছে দেখে অনু খিটমিটিয়ে উঠে বললো,
— মিথ্যে কথা বলার আর যায়গা পাস না?আমাকে বোকা না বানিয়ে চুপচাপ রেডি হ।

— আপা বিশ্বাস কর আমি মিথ্যা বলছিনা, তুই কিছু একটা কর আপা। আমাকে এভাবে ভরা নদীতে ঠেলে দিস না।

বোনের এরূপ কাকুতি মিনতি দেখে মন গললো অনুর, কিন্তু মায়ের সম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে,তারউপর মা অসুস্থ এসপারওসপার হয়ে গেলে মায়ের যদি শারীরিক কিছু ক্ষতি হয়ে যায়? সেই ভয়ে তটস্থ অনু। তাই ও নিজের কঠিন সুরটা একটু নরম করে অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— দেখ বোন, আগেও বলেছি এখনো বলছি, দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায়না। ওরা শুধু দেখে যাবে এই যা। তাছাড়া আজকের দিনটা কোনোমতে চলে গেলেই দেখবি সব সমস্যার সমাধান, পরে না হয় রাজ কে একান্তে বুঝিয়ে বলিস তোর সমস্যা গুলো। এখন দেরি না করে চল।মা সেই কখন থেকে অতিথিদের সামনে বসে আছে।

আপার কথায় বেশ আস্বস্ত হলো অরু। বুকের ভেতরটা অনেক হালকাও লাগছে এখন। ঠিকই তো আজকের রাতটা মানে-মানে চলে গেলে রাজকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলতে হবে। তাহলে রাজই সব কিছু মিটিয়ে ফেলতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে অরুর কান্নাকাটিতে একটু ভাটি পরলে অনু শাড়ি হাতে নিয়ে বললো,

— আয় পরিয়ে দিই।

*****************************************
অনু অরুকে আনতে রুমে গিয়েছে, এদিকে অনবরত কলিং বেলের আওয়াজ ভেসে আসছে তখন থেকে। কি জানি কে এমন ভাবে কলিং বেলে চাপছে। অনু ধারেকাছে নেই বলে আজমেরী শেখ এবার নিজেই উঠে গেলেন দরজা খুলতে। অতিথিরা সবাই গোল হয়ে কাউচে বসে আছে, রাজ ও আছে, অফ হোয়াইট কালারের প্রিন্স কোর্টে তাকে বেশ সুদর্শনই লাগছে। রাজ ছোট বেলা থেকেই আমেরিকাতে বড় হয়েছে। ওর পুরো চোদ্দগোষ্ঠী আমেরিকান নাগরিক , সবাইই এখানকার বড়বড় ব্যাবসায়ী কিংবা চাকুরীজীবি। সেই হিসেবে পাত্রী দেখতে আসায় কোনোরূপ ত্রুটি রাখেননি তারা ভরপুর এনেছেন, তারউপর এসেছেও অনেকজন। পুরো বসার ঘর মানুষে গিজগিজ করছে এই মূহুর্তে ।

ঠিক সেই সময়ই আগমন ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত একজনার, সে আর কেউ না, মিসেস অরোরা জায়ানের লিগ্যাল গার্ডিয়ান,মি. জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

আজমেরী শেখ দরজা খুলতেই চোখের সামনে প্রত্যয়কে দেখতে পায়, প্রত্যয়কে দেখে তিনি ভেবেছেন হয়তো কোনোরূপ অফিসিয়াল কাজেই তার আগমন, কিন্তু তারপর পরই প্রত্যয়ের পেছন থেকে বেড়িয়ে আসে আরেকজন। যদিও এটাই প্রথম সাক্ষাৎ, তবুও এই লম্বা সুদর্শন ছেলেটাকে চিনতে খুব একটা সমস্যা হলোনা আজমেরী শেখের, তিনি ক্রীতিককে দেখা মাত্রই তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
— জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, এইখানে? অহংকার ভাঙলো তবে? তা আগমনের কারনটা জানতে পারি?

ক্রীতিক আজমেরী শেখের একটা কথারও জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো, ওর পেছন পেছন প্রত্যয়ও। ভেতরের সবাই ক্রীতিককে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো বটে, সবার মনে একটাই প্রশ্ন,
— এ আবার কে? আদৌও বাঙালি, নাকি বিদেশি? চেহারা দেখেতো মনে হচ্ছে দুটোর মিক্সড।

ক্রীতিক জিভ দিয়ে গাল ঠেলে এগিয়ে গিয়ে আজমেরী শেখের ব্যক্তিগত ডিভানের উপর পায়ে পা তুলে বসে পরলো। ক্রীতিকের বে’য়াদবি দেখে আজমেরী শেখ এগিয়ে এসে অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড়িয়ে ক্রীতিকের উদ্দেশ্যে বললেন,
— এটা আমার বসার যায়গা, গেট আপ।

ক্রীতিক পা দুলাতে দুলাতে বললো,
—আমার কোম্পানির টাকায় কেনা। ইনভেস্ট ফ্রম জেকে গ্রুপ? এম আই রাইট?

— কোম্পানির ধারে কাছেও তো আসোনা, আমার নিজের কোম্পানি দাবি করছো?

ক্রীতিক রহস্যের হাসি হেসে বললো,
— আমি যদি সারাজীবনও কোম্পানির ধারে কাছে না যাই, তাও জেকে গ্রুপ আমারই থাকবে।

আজমেরী শেখ নিজের রাগ টুকু সংবরণ করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
— কি চাইছো কি তুমি ক্রীতিক, কেন আমার বাসায় অহেতুক এসে ঝামেলা পাকাচ্ছো?

জবাবে ক্রীতিক বললো,
— ঝামেলা পাকাবো কেন আশ্চর্য ? কি প্রোগ্রাম হচ্ছিল এখানে? প্রোগ্রাম করুন না, আমার কোনো অসুবিধা নেই আমিও দেখছি।

ক্রীতিকের কথায় আজমেরী শেখ ওর দিকে বিরক্তির দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,

—কেন, আমি ইনভাইটেড না? তাছাড়া ইনভাইট দিয়ে করবো টা কি?আফটার অল উই আর ফ্যামিলি। রাইট মামুনি?

আজমেরী ঠিকই বুঝলেন, যেই ছেলে সারাজীবন উনি উনি করে কথা বলেছে। জীবনে এইটুকু সম্মান পর্যন্ত দেয়নি, তার হটাৎ করে মামুনি ডাকে নিশ্চয়ই কোনো ঘাবলা আছে। তবুও চোখের সামনে এতোগুলা মেহমান দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন তিনি। ঠিক তখনই সবার কৌতুহল, অযাচিত প্রশ্ন সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে অরুকে নিয়ে অনু প্রবেশ করে বসার ঘরে। অরুর পরনে পিচ কালারের জামদানী শাড়ি, হাতে স্বর্ণের বালা। মাথায় ছোট্ট করে ঘোমটা টানা, দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।

কিন্তু অরুর এই সৌন্দর্য দেখে ক্রীতিকের র’ক্ত গরম হয়ে উঠেছে মূহুর্তেই। শরীরের শিরা উপশিরায় সেই টগবগে র’ক্তের উত্তাল ক্রোধ কোনোমতে ধামাচাপা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে অনবরত পা দোলাচ্ছে সে।

অনু এগিয়ে এসে অরুকে রাজের মুখোমুখি কাউচে বসিয়ে দেয়। এতোক্ষণ মাথা নুয়িয়ে রাখার জন্য ক্রীতিককে খেয়াল না করলেও কাউচে বসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিককে দেখে অরুর মুখ যেনো থেকে র’ক্ত সরে গেলো। প্রকট আতঙ্কে অজান্তেই নিজেই খামচে ধরলো নিজের শাড়ি। ক্রীতিক এই মূহুর্তে দু আঙুলে কপাল ঘষতে ঘষতে অরুর দিকেই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরনে তার সিলভার কালারের ব্র্যান্ডেট শার্ট। শার্ট গলিয়ে শক্ত হয়ে থাকা হাতের জিম করা পুরুষালী পেশিগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। ক্রীতিককে এভাবে হুট করে এই সময় দেখতে পেয়ে, ক্রীতিকের আ’গুন চোখে চোখ রেখেই তিরতিরিয়ে কাপছে অরু।

ওকে এভাবে কাঁপতে দেখে রাজের মা অরুর পাশে এসে বসে ওকে আসস্থ করে বললেন,
— কাঁপছো কেন মা? আমরা আমরাইতো। এক সময় এরাই তোমার আসল পরিবার হবে এতো ভয়’ পাওয়ার তো কিছু নেই।

কে শোনে কার কথা? এই মূহুর্তে কারোর কথায় কোনোরূপ খেয়াল নেই অরুর, ওতো এখনো ক্রীতিকের দিকেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্রীতিক কি থেকে কি করবে সেই ভয়েই তটস্থ অরু।

ক্রীতিক প্রথমে অরুর থেকে চোখ সরিয়ে চারিদিকে একবার চোখ বোলালো, অতঃপর চট করে উঠে দাড়িয়ে অরুর হাতটা শ’ক্ত করে চেপে ধরে, ওকে টা’নতে টান’তে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। ক্রীতিকের হঠাৎ এমন বি’স্ফোরিত কান্ডে সবাই হতভম্ব। কারও মুখে কোনো বাক্য নেই, কি করছে এই ছেলে। ক্রীতিক যখন অরুকে নিয়ে রুমে যাচ্ছিল ঠিক তখনই অরুর অন্য হাত টেনে ধরে রাজ। ক্রীতিক রাজের দিক অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তীর্যক স্বরে বললো,
— হাউ ডেয়ার ইউ।

রাজ একটু সাহস দেখিয়ে বললো,
— সি ইজ নট ইওর প্রোপার্টি।

ক্রীতিক শক্ত গলায় জবাব দিল,
— ইয়েস সি ইজ।

কথাটা বলে ক্রীতিক রাজকে মা’রতে উদ্যত হবে, তার আগেই প্রত্যয় অরুর থেকে রাজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— জানে বাঁচতে চাইলে ছাড়ো রাজ। অরু বিবাহিত। ক্রীতিক ভাই অরুর হাসবেন্ড।

প্রত্যয়ের শেষ কথাতে রুমের প্রত্যেকটা মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভে’ঙে পরলো। কি বললো প্রত্যয় মাত্র এটা? আদৌও ঠিক শুনেছে তো সবাই? আজমেরী শেখ আর অনুতো বাকরুদ্ধ পুরোপুরি। ক্রীতিক সেসবের দু পয়সা তোয়াক্কা না করে প্রত্যয়কে বললো,
— আবর্জনা গুলো পরিষ্কার করো, এস সুন এস পসিবল। আর যেন এদের চোখের সামনে না দেখি আমি।

প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক অরুকে নিয়ে রুমে গিয়ে ঠাস করে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। অরু জানে ওর কপালে শনি নৃত্য করছে, তাই ভয়ের চোটে কুকরে আছে মেয়েটা।

ভেতরে এসে অরুকে সোজা দাঁড় করিয়ে শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ওর গালে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চপেটাঘা’ত করলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ছি’টকে মেঝেতে গিয়ে পরলো অরু। ঢিলে খোপা করা লম্বা চুলগুলো বাধন হারা হয়ে পরলো মূহুর্তেই। মেঝেতে বসে নিজের মুখটা দু-হাতে চেপে ধরে তীব্র কা’ন্না সংবরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে অরু। ক্রীতিককে দেখতে কি ভ’য়ান’কই না লাগছে। আগুনের শিখার মতো চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে আজ ওর খবর করে ছাড়বে ক্রীতিক। ক্রীতিক নিজের অন্য হাতাটা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে এসে অরুকে বললো,
— এটা কেন দিলাম জানিস? আমার বউ হয়েও অন্যকারও সামনে বউ সেজে বসার স্পর্ধা দেখানোর জন্য।

অরুকে শক্ত হাতে টেনে তুলে ক্রীতিক ওর অন্যগালে থা’প্পড় দিতে উদ্যত হলে, অরু চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— ব্যাথা পাচ্ছি, কষ্ট হচ্ছে আমার, আর মা’রবেন না, আআমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, আপা বলেছিল দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায়না। তাছাড়া আপনিও তো আসেননি এই কদিন কি করতাম আমি?

ক্রীতিক আর মা’রলো না ওকে, হাত নামিয়ে রেগেমেগে ওর গলাটা চেঁ’পে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
— একবার ফোন করতে পারতি না? আমি আদৌও বেঁচে আছি কি ম’রে গিয়েছি সেটা অন্তত খোঁজ নিতে পারতি। বিধবা হওয়ার এতো শখ?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— কি বলছেন এসব, ফোন তো আমার কাছে ছিলোই না মা নিয়ে গেছে সেই কবে।

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুর গলা ছেড়ে দেয়। ফর্সা গলাটা আঙুলের চাপে র’ক্তিম হয়ে উঠেছে। ক্রীতিক তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে একবার নজর দিলো, তারপর অরুর বাহু ধরে ওকে কাছে নিয়ে এসে ওর সুন্দর কারুকাজ করা ব্লাউজের দুটো হাতাই একটানে ছি’ড়ে ফেললো ক্রীতিক। ওকে রেখে হঠাৎ ওর জামাকাপড় টেনে ছিঁ’ড়ছে দেখে অরু আঁতকে উঠে বললো,
— কি করছেন এটা?

ক্রীতিক অরুর চুলের গার্ডার, ঠোঁটের লিপস্টিক, চোখের কাজল সব কিছু নিজ হাত দিয়ে একেএকে লেপ্টে দিতে দিতে চোয়াল শক্ত করে বললো,
— অন্যকারোর সামনে নিজের সৌন্দর্য বিলাতে কেন গেলি অরু? আমার রা’গ কমছে না কিছুতেই, তোকে মার’তেও পারছি না, কলিজায় লাগছে। উল্টে আমিই ব্যাথা পাচ্ছি, ইচ্ছেতো করছে নিজেকে নিজেই…

ক্রীতিক কথা শেষ করার আগেই নিজের নরম তুলতুলে হাত দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরলো অরু, অতঃপর ক্রীতিকের চোখে চেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ালো।

অরুর এমন প্রতিক্রিয়ায় ক্রীতিকের কি না কি হলো কে জানে? ও হুট করেই অরুকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে ওর লালচে হয়ে যাওয়া র’ক্তাক্ত গলায় স্ব-গতিতে মুখ ডুবিয়ে দিলো। ক্রীতিক জিদের বশবর্তী হয়ে ক্রো’ধটা একটু বেশিই ঢালছিল অরুর উপর, তবুও চোখ মুখ খিঁচে পুরোটাই সহ্য করে নিলো অরু। এই মিষ্টি যন্ত্রনাটুকু বোধ হয় ওর পাওনা ছিল।

ওদিকে বাইরে থেকে দরজা ধা’ক্কাতে ধা’ক্কাতে হয়রান হয়ে উঠেছেন আজমেরী শেখ। প্রচন্ড মানসিক চাপ আর হঠাৎ রেগে যাওয়ার ফলপ্রসূ শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে গিয়েছে তার। মাকে এভাবে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে অনু তরিঘরি হয়ে মাকে বসার ঘরে নিয়ে এসে বললো,
— তুমি একটু বসো মা, আমি ডাকছি ওদের।

প্রত্যয়ও বাইরেই দাড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ, মাত্র অনুকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ও নিজেও এগিয়ে গেলো অনুর পিছু পিছু । যেতে যেতে পেছন থেকে প্রত্যয় বললো,
— এখন না ডাকলেই ভালো হবে ভাই খুব রেগে আছে।

প্রত্যয়ের কথায় অনু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— খবরদার আর একটাও কথা যদি বলেছেন, আপনি সব জানতেন, অথচ আমাকে বোকা ভেবে দিনের পর দিন ভালোবাসা দেখিয়ে আমার পিঠেই ছু’রি মে’রেছেন।

প্রত্যয় আশ্চর্য হয়ে বললো,
— আমি কি করলাম আজিব?

— আপনি আমাকে বলেননি কেন যে অরু এতোবড় একটা অন্যায় কাজ করেছে।

প্রত্যয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কি অন্যায় করেছে অরু?

অনু এবার হাটার গতি থামিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,
— সৎ ভাইকে বিয়ে করা অন্যায় নয়? অরু নাহয় ছোট মানুষ, কিন্তু ক্রীতিক ভাইয়া? সে তো ছোট নয়, তাহলে তিনি এটা কিভাবে করলেন? কিসের প্র’তিশোধ নিতে উনি আমাদের মুখে এভাবে চুনকালি মাখালেন? আমার বোনের জীবনটা ন’ষ্ট করলেন?

প্রত্যয় এবার একটু রেগে গিয়ে বললো,
— ধর্মে, কিংবা আইনে ওদের বিয়ের সম্পূর্ণ বৈধতা আছে, তাহলে চুনকালির কথা কোথা থেকে আসছে অনু?

অনু তেতে উঠে বললো,
— আপনি সমাজ বোঝেন? সারাজীবন তো থেকেছেন অসামাজিক জায়ান ক্রীতিকের সাথে সাথে , তাহলে কি করে বুঝবেন সমাজের মর্ম? আজ বাদে কাল যখন পুরো সমাজ আমাদের পেছনে কথা বলবে,ছি ছি বুলি আওড়াবে, সবাই কানাঘুষা করবে, যে আজমেরী শেখ টাকার জন্য নিজের সৎ ছেলের গলায় নিজেরই মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছেন। তখন আপনাদের মতো মানুষের গায়ে না লাগলেও সমাজের অ’পমান আর বিদ্রুপে আমাদের তিন মা মেয়ের ম’রে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কারণ সমাজে এক ঘরেদের কোনো স্থান নেই।

অনুর একনাগাড়ে বলা হাজারটা যুক্তির পাছে প্রত্যয় আর কোনো যুক্তিই খুঁজে পেলোনা অনুকে ঘায়েল করার জন্য, তাই ও সহসা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। আর অনু গটগটিয়ে এগিয়ে গেলো অরুর রুমের দিকে।
*****************************************

দুইপাশে দুটো ডিভানের উপর পায়ে পা তুলে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে আজমেরী শেখ আর জায়ান ক্রীতিক। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের মাঝে পুরোদস্তুর নিরবতা বিরাজমান। ওদের থেকে একটু খানি দূরে দাড়িয়ে আছে অনু, প্রত্যয়, আর অরু। জামা কাপড় পাল্টে, ওড়না দিয়ে গলার কলার বোনগুলো খুব সাবধানে ঢেকে তবেই বেরিয়েছে অরু , নয়তো খানিকক্ষণ আগে পুরো গলায় ক্রীতিকের জিদের তোপে করা দাগগুলো সবার সামনে উন্মুক্ত বই হয়ে যাবে অনায়াসে । এই মূহুর্তে অরু সবার আড়ালে মাথা নুয়িয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওই মস্ত বড় অ’পরাধী, আর এখানে ওর বিচার সভা বসেছে।

চারিদিকের থমথমে পরিবেশটাকে আরও খানিকটা গুমোট করে দিয়ে আজমেরী শেখ বললেন,
— আমার মেয়েটাকে বলির পাঁঠা কেন বানালে ক্রীতিক?

ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,
— ফার্স্ট অফ অল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি, বলির পাঁঠা বানায়নি, আর সেকেন্ডলি আই থিংক সি ইজ মাই হার্টবিট।

ক্রীতিকের কথায় চটে গেলেন আজমেরী শেখ, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— মজা করছো আমার সাথে? নিজের সৎ বোনকে বিয়ে করতে লজ্জা করলো না তোমার?

ক্রীতিক বাঁকা হেসে নিজের ঠোঁট কামড়ে বললো,
— শুধু বিয়ে নয়, আরও অনেক কিছু করেছি , এই যে একটু আগেও করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন একটুও লজ্জা লাগেনি, কেনইবা লজ্জা লাগবে বলুন? বউ হয় তো। যেই পুরুষ বউয়ের সামনে লজ্জা পায় সে আবার কেমন পুরুষ?

ক্রীতিকের কথায়, অনু আর আজমেরী শেখ দুজনই অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকালো অরুর পানে, যে এই মূহুর্তে মাথা নিচু করে ফোপাঁচ্ছে।

— ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, আমার বউকে আমি যেটা বলবো ও সেটাই করবে।

ক্রীতিকের কথায় আজমেরী শেখ চোখ ঘুরিয়ে বললেন,
— তুমি একা একা থেকে, আমেরিকান কালচারে বড় হয়ে একটা বেহায়া তৈরি হয়েছো। আর তুমি যেটাকে বিয়ে, ভালোবাসা বলছো না? এটা আসলে ভালোবাসাই নয়, ইটস ইওর অবসেশন, আনহেলদি অবসেশন, যার স্বীকার হয়েছে আমার মেয়েটা। নয়তো নিজের হাটুর বয়সী একটা মেয়েকে কে ভালোবাসে?

আজমেরী শেখের কথায় ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে বাহবা দিয়ে বললো,
— আপনি সত্যিই জিনিয়াস, না হলে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে বুঝে গেলেন জিনিসটা? আর আমি কখন বললাম যে আমি অরুকে ভালোবাসি? আমি ওর প্রতি অবসেশট আনহেলদি রকম অবসেশন। আর এটাই সত্যি।

এখন আপনি সেটা ভালোয় ভালোয় নেবেন, নাকি নেবেন না, সেটা একান্ত আপনার ব্যাপার, বাট আমার বউকে আমি চাই, ব্যাস।

কথাটা শেষ করে তরাগ করে দাঁড়িয়ে পরে ক্রীতিক।
অতঃপর অরুর দিকে একপলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিক বলে,
— কিছুদিন সময় নিন, মন দিয়ে ভাবুন, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গিয়েছে তারমানে, সি বিলোংস টু মি। তাই আপনাকে জোরজবর’দস্তি করে অরুকে কষ্ট দিতে চাইছি না।

তবে হ্যা আমার বউকে অন্যকারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এন্ড আই মিন ইট। কথাটুকু শেষ করে গটগটিয়ে যায়গা ত্যাগ করে ক্রীতিক।

অরুর বিয়ে হয়ে গেছে, আজমেরী শেখ চাইলেও আর মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকাতে পারবেননা,কোথাও বিয়ে দিতে পারবেন না, ক্রীতিক যা চাইবে তাই করতে হবে, ব্যাপারটা বুঝে আসতেই অকস্মাৎ ক্ষে’পে গেলেন তিনি, তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়িয়ে টেনে এনে এলোপাথারি চ’ড় বসাতে লাগলেন মেয়ের দুইগালে। হঠাৎ এভাবে এলোপাথাড়ি থা’প্পড়ে অরুর মাথায় চ’ক্কর দিচ্ছে বারবার, ও কাঁদতে কাঁদতে মাকে আকুতি করে থামতে বলছে, তবুও আজমেরী শেখের হাত থামছে না, ওকে মা’রতে মা’রতে তিনি কাঠিন্য সুরে বললেন,
— একটা নোংরা কীট জন্ম দিয়েছি আমি, বেহায়া, নির্লজ্জ,নষ্টা, নিজের থেকে বারো বছরের বড় সৎ ভাইয়ের সাথে শুতে একটুও লজ্জা করলো না তোর?

মায়ের কথায় অরু যেন আকাশ থেকে পরলো, কি বলছে মা এসব? তার আর জায়ান ক্রীতিকের সম্পর্ক তো এতোটাও গভীরে যায়নি, আর মা কিনা এতো নোংরা চিন্তা করে ফেলেছে?ছিহ!
কথাটা ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো অরু। ওদিকে অরুর কান্নার আওয়াজ কানে পৌঁছতেই দরজার কাছে থেকে পুনরায় তরিৎ বেগে ফিরে এলো ক্রীতিক, হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রেগেমেগে এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রীতিক, তা দেখে মায়ের হাত চালানোকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দৌড়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে ক্রীতিকের পায়ের সামনে বসে পরলো অরু, ওর সামনে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— হাত জোর করছি, আর অশান্তি করবেন না, মা এমনিতেই অসুস্থ।এতো চাপ নিতে পারবেন না তিনি। আমি কথা দিচ্ছি আপনি ছাড়া এই জীবনে অন্য কোনো পুরুষের সামনে আর নিজেকে উপস্থাপন করবো না আমি।কোনোদিনও না।তাও আপনি ফিরে যান দয়া করে।

ক্রীতিক অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে সকলের সামনে অরুর ঠোঁটে আর কপালে আলতো চুমু খেলো, তারপর ওর গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— তুই কেন পায়ে পরছিস জান? তোর জায়গাতো আমার বুকে।

ক্রীতিকের আদুরে আওয়াজে আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো অরু, ক্রীতিক নিজের অন্য হাতটা অরুর আরেকগালে ছুয়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
— বিশ্বাস কর অরু, তোর কষ্ট দেখে আমার হৃদয় ছি’ড়ে যাচ্ছে, একবার শুধু বল, তুই আমার সাথে যাবি, বাকিটা আমি বুঝে নেবো।প্লিজ বল।

অরু নিজের হাত দিয়ে ক্রীতিকের হাত ধরে বললো,
— একটু সময় দিন আমাকে, আমি আপা আর মাকে ঠিক বোঝাতে পারবো।

অরুর কথায় ক্রীতিকের সাভাবিক মুখশ্রীটা মূহুর্তেই কঠিন হয়ে উঠলো, ও অরুর দিকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছু’ড়ে বললো,
— মা আর আপা যদি তোর কাছে এতোটাই প্রয়োজনীয় হয়, আমার কথা যদি তোর কাছে এতোটাই অগ্রাহ্য মনে হয়, তাহলে আমিও তোকে আর জোর করবো না।আমার কাছে যেতে হবেনা তোকে, থাকতে হবে না আমার সাথে। তবে হ্যা, আমাকে খুজে না পেলে আবার কান্না করিস না যেন। বিকজ আই হেইটস ইউর টিয়ারস বেইবি।

নিজের কথা শেষ করে এক মূহুর্তও ফুরসত না দিয়ে বাসা থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্রীতিক।

অরু এখনো অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে, ক্রীতিকের শরীরের মাতাল করা স্যান্ডাল উডের গন্ধটা এখনো চারিপাশে ম ম করছে। এইতো একটু আগেও দু’হাত দিয়ে অরুকে ছুঁয়েছিল সে, আর এখন কোথাও নেই সবকিছু কেমন শূন্য। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে আছে অজস্র কান্নারা,যার দরুন নাকের ডগাটা বারবার ফুলে উঠছে অরুর । ওর ছোট্ট মস্তিষ্কটা এখনো ঠিক ধরতে পারছে না, একটু আগে কি বলে গেলো ক্রীতিক? কিইবা বোঝালো ওই কঠিন কথাগুলো দ্বারা?
চলবে……..

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৩২
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

[সংবেদনশীল পর্ব, যারা দূর্বল চিত্তের তারা এড়িয়ে যেতে পারো।]

রাতের শেষ ভাগ চলমান, চারিদিক ছেয়ে আছে শুনশান নিস্তব্ধতায়। বিশাল আকাশ ছুঁই ছুঁই কংক্রিটের ভবনটার বেশির ভাগ এ্যাপার্টমেন্টেরই আলো নিভানো। ভবনের পেছনে অবস্থিত মানুষ যাতায়াতের সরু রাস্তায় গাড়ি তো দূরে থাক একটা সাইকেল চলারও টুংটাং আওয়াজ নেই পর্যন্ত,কি করেইবা থাকবে? এখনতো সবার ঘুমের সময়। রাতের এই শেষ প্রহরে মানুষ তো দূরে থাক রাত জাগা পাখিরাও বোধ হয় ঘুমিয়ে পরে ক্লান্তিতে ।

আমেরিকার এই স্টেটে ভালোই বাঙালি চোখে পরে, তাই হয়তো এখানে নাইট ক্লাব, কিংবা বার এসব বিদেশি আমোদ ফূর্তির জোয়ার অতো বেশি নেই,তারউপর পাশেই হাসপাতাল। তাইতো চারিদিকে এমন শান্তি শান্তি পরিবেশ বিরাজমান।

এই শুনশান নিস্তব্ধতা, মৃদু হিমেল হাওয়া,কিংবা শান্তিদায়ক পরিবেশ কোনোটাই উপভোগ করার লেশমাত্র আগ্রহ নেই অরুর মাঝে, আর না আছে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত নিভু নিভু চোখ দুটোর পাতায় একরত্তি ঘুম। সেই সন্ধ্যা বেলাতে টানা বারান্দায় এসে বসেছিল, আর এখন রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে চললো, তাও একই ভাবে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বারান্দায় বসে আছে অরু। আজকাল এটা ওর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গত কয়েকদিন যাবত নামমাত্র খাবার আর পানি খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে মেয়েটা। কি করেই বা খাবার মুখে তুলবে ও? মা, আপা কেউ ওর সাথে কথা বলাতো দূরে থাক ওর দিকে ভালো করে ফিরেও তাকায় না, চোখের সামনে দেখলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কেমন যেন সবার মাঝে উপস্থিত থেকেও নেই অরু। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে, হঠাৎ করেই ওর সুন্দর সাজানো গোছানো জীবনটা হয়ে উঠেছে দূর্বিষহ আর অসাভাবিক।

এতোকিছুর পরেও যার জন্য এতোটা কষ্টসাধ্য করা, যার জন্য এতো ধৈর্য ধারণ করা, যার কথা ভেবে ভেবে এই নির্ঘুম রাত কাটানো, সে যদি অন্তত মনের খবরটা বুঝতো। কিন্তু না ক্রীতিক সেই যে রেগেমেগে চলে গেলো আজ প্রায় একসপ্তাহ হতে চললো, আর আসেনি সে।

ওদিকে মা আর আপার খুশির জন্য ঘরের বাইরে পা মারায়না অরু, কারণ ও জানে ঘরের চৌকাঠ মারালেই সবাই ভাববে অরু ক্রীতিকের কাছে গিয়েছে, তারপর শুরু হবে আরেক অশান্তি। অরু আর অশান্তি চায়না। ওর এইটুকু জীবন দিয়ে কম তো আর ধকল গেলোনা। গত একসপ্তাহের অনাহার আর অবহেলায় সুন্দর লাবন্যময় মুখটা হুট করেই কেমন ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে , না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখের কোটরে কালি জমেছে, লম্বা চুলগুলোতে চিরুনি চলেনি বেশ কয়েকদিন, শরীরের সাথে ফিটিং হয়ে থাকা জামাটাও গলা থেকে নেমে যাচ্ছে নিঃসংকোচে। আর কিছুদিন এভাবে থাকলে অরুকে অ’সুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে নিশ্চিত।

জীবনে প্রথমবার প্রেমে পরলে বুঝি এমনটাই হয়? তার দহনে হৃদয় ছি’ড়ে যায়। কিন্তু ওর এই বিভীষিকা ময় অবস্থা করে দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো ক্রীতিক?

ভেবে পায়না অরু। দিনে অন্তত একশোবার এসে টানা বারান্দায় উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে কেউ আসলো কিনা দেখার উদ্দেশ্যে, কিন্ত না অরুর জন্য এখন আর কেউ আসেনা, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েও থাকেনা কেউ। অরু কষ্ট পায়, ওর হৃদয়টা ব্যাথায় টনটন করে ওঠে, অভিমানি কা’ন্নায় ভিজে ওঠে চোখের পাতা। ক্রীতিকের উপর একরাশ অভিমান করে, অরু নিজেকেই নিজে কঠিন শর্ত এঁটে দিয়ে বলে,
—- আর কখনো আপনার জন্য অপেক্ষা করবোনা আমি, আপনি একটা নিষ্ঠুর মানব, হৃদয়ে মায়া দয়া বলে কিছুই নেই আপনার। নয়তো কিভাবে পারছেন আমাকে না দেখে থাকতে? আপনার কি একটুও খারাপ লাগে না? আমাকে একটুও দেখতে ইচ্ছা করেনা? যদি দেখতে না-ই ইচ্ছে করে তাহলে আপনি কেন আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক করেন সারাক্ষণ? আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি, সাভাবিক হতে পারছি না, আপা- মাকে বুঝাতেও পারছি না, অথচ ভেতরটা আপনার দহনে পু’রে যাচ্ছে সারাক্ষণ । কেন এই দহন? উত্তরটা অন্তত দিয়ে যান।

অরুর অযাচিত অভিমানী মনের উত্তর দিয়ে যায়না কেউই, তাই পরক্ষণেই আবার রেগেমেগে অরু নিজেই বলে,
—যেহেতু আপনি আমার কথা ভাবেননা, তাই এবার থেকে আমিও আর আপনার কথা ভাববো না, একটুও ভাববো না।

ঠিকই তো সে যদি অরুকে না দেখে ভালো থাকতে পারে,এতোগুলা দিন চলে গেলো তাও যদি অরুকে একটাবার মনে না পরে, তবে অরুও থাকতে পারবে। কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু হায় প্রেমে পড়লে কি আর এতো শর্ত মনে থাকে? অষ্টাদশী যে ভীষণ ভাবে প্রেমে পড়েছে ওই উগ্র, বেপরোয়া লোকটার। তাইতো ফেটে পরা অভিমানের কয়েকমূহু পরেই নিজেকে নিজে দেওয়া শর্তফর্ত জলাঞ্জলি দিয়ে পুনরায় ছুটে যায় টানা বারান্দায়, অতঃপর সেই চেনা মুখ, চেনা কামুক চোখ, চেনা বাইক কিছুই দেখতে না পেয়ে তীব্র কা’ন্নার জোয়ারে সেখানেই বসে পরে অরু। প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়, অরুর অপেক্ষা শেষ হয়না, তাকে একটাবার দেখার জন্য আনচান করতে থাকা হৃদয়টা অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ঝিমিয়ে পরে তবুও আশা হারায়না অরু। ওর মনে হচ্ছে ক্রীতিক সেদিনের ঘটনায় একটু রেগে আছে, তাই হয়তো আসছে না, রাগ পরে গেলে ঠিক চলে আসবে। কিন্তু আর কত? ক্রীতিকের বি’ষের মতো জ্বালাময় প্রেম যে অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথমবার কারও সত্যিকারে প্রেমে পরে শেষ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, সবার অজান্তে একটু একটু করে নিজেই খু’ন করছে নিজেকে, শুধু মাত্র জায়ান ক্রীতিকের জন্য।
***********************************************

সময় চলমান, দিনের আলো আর রাতের মাঝেই তার প্রবাহ বিদ্যমান । এই আসে তো এই যায়, দেখতে দেখতে চোখের পলকেই কেমন দশদিন পার হয়ে গেলো, তবুও দেখা মেলেনি ক্রীতিকের। এখন আর অভিমান হয়না অরুর বরং কষ্ট হয়, ভীষন কষ্ট।যেই কষ্টে ওর হৃদয়টা ক্রমাগত দুমরে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। অনু আর আজমেরী শেখ ভেবেই নিয়েছে যেহেতু দেখা সাক্ষাৎ, যোগাযোগ কিছুই নেই সেহেতু ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসবে অরু, একবার শুধু মনটা ঘুরে গেলেই কেল্লাফতে, তারপর সোজা ডি’ভোর্স। কিন্তু তারা তো আর জানেনা,ক্রীতিকের এই অনুপস্তিতি ছিল অরুর হৃদয়ে এক নিদারুণ প্রেমের জোয়ার। অষ্টাদশীর মনে দা’গ কেটে গিয়েছে এই দূরত্ব। জায়ান ক্রীতিক আর নিখিল দু’জনকে ভালোবাসার পার্থক্যটা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে সে। নিখিলের মাসের পর মাস অনুপস্থিতি কিংবা দূরত্ব কোনো কিছুই এভাবে পো’ড়ায় নি অরুকে। অথচ ক্রীতিকের এই দশদিনের দূরত্ব অরুকে বুঝিয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা কি?

ক্রীতিকের হাস্কি কন্ঠস্বর, ক্রীতিকের রাগ,ক্রীতিকের হাসি, ক্রীতিকের ছোঁয়া, ক্রীতিকের শরীরের মাতাল করা সুবাস কিইনা মিস করে অরু? এখন আর ভাবতে ইচ্ছে হয়না ক্রীতিক কেন আসেনা, এখন তো অরুর নিজেরই সবকিছু ভে’ঙেচুরে ক্রীতিকের বুকে গিয়ে ঝাপিয়ে পরতে মন চায় অনায়েসে । হৃদয়টা যে এই দহন আর সহ্য করতে পারছে না। ক্রীতিকের ও কি ঠিক এই রকমই য’ন্ত্রনা হতো অরুর অনুপস্থিতিতে? ভাবছে অরু। মনেমনে বলছে,
—– আপনি তো এই দহন, এই য’ন্ত্রণা বোঝেন, তাহলে জেনেশুনে কেন আমাকে এই দহনে পো’ড়াচ্ছেন? কি দোষ করেছি আমি? আমার কষ্টে নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হচ্ছে আপনার? হাসি পাচ্ছে খুব নিশ্চয়ই?

হাহ, অষ্টাদশীর অবুঝ অভিমান…..

অলস দুপুরে খাওয়া নাওয়া ছেড়ে অরু যখন শুয়ে শুয়ে ক্রীতিকের কথায়ই ভাবছিল তখনই রুমে প্রবেশ করে অনু। আজকাল অনু আর অরুর মাঝে খুব একটা ভাব নেই, যতটুকু প্রয়োজন পরে কেবল ততটুকুই কথা বলে ওরা। এর বাইরে চোখাচোখি হলেও কোনো এক অজানা অপরাধ বোধ ঘীরে ধরে দুজনকে।

অনু রুমে এসে দেখতে পায় অরু বিছানায় উপুর হয়ে ম’রার মতো পরে আছে, লম্বা সিল্কি বাঁধন হারা চুলো গুলো পুরো খাটে ছড়িয়ে, শরীরটা শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে মেয়েটার। কিসের এতো কষ্ট এই একরত্তি মেয়ের বুঝে পায়না অনু। হয়তো বুঝতে চায়ও না, তাই ও আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেকে উঠলো অরুকে,
— অরু খেতে আয়।

অনুর ডাকে শুয়ে শুয়েই জবাব দিল অরু,
— রেখে দে, পরে খাবো।

অনু বলে,
— রেখে দিলে ঠান্ডা হয়ে যাবে, এখনই খেয়ে যা, তাছাড়া মা বাসায় নেই, কেউ কিছু বলবে না তোকে।

মা বাসায় নেই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো অরু। অতঃপর অনুর কাছে এগিয়ে এসে জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে একটু সাহস করে বললো,
— আপা আমার ফোনটা একটু দিবি? খুব বেশি না মাত্র পাঁচ মিনিট, তারপর আবার নিয়ে নিস, দে না আপা।

অনু গম্ভীর গলায় বললো,
— তোর ফোন মা লকারে ঢুকিয়ে তালা মে’রে রেখেছে, আমি কিভাবে দেবো?

অরু একটু ভেবে বললো,
— তাহলে তোর টা দে।

অনু স্ব ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধালো,
— কি করবি ফোন দিয়ে তুই?

অরু স্পষ্ট গলায় জবাব দিল,
— জায়ান ক্রীতিক কে কল করবো।

অরুর কথায় ঝাঁজিয়ে উঠলো অনু, ও তৎক্ষনাৎ অরুর দিকে ক্ষী’প্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তেঁতো গলায় বললো,
—- জায়ান ক্রীতিক, জায়ান ক্রীতিক বলা বন্ধ কর অরু, কানে লাগছে আমার। উনি আমাদের ভাই হয়।

অরু শক্ত গলায় বললো,
— উনি আমার স্বামী, ওনাকে আমি শুধু ক্রীতিক ও বলতে পারি, স্বামীকে ভাইয়া কেন বলতে যাবো?

— এরকম একটা সম্পর্কের কথা মুখে আনতে লজ্জা করেনা তোর? যেখানে মানুষটার বাবা আমাদের মায়ের প্রয়াত স্বামী।

অনুর ধা’রালো কথায় অরু ঘাবড়ালো না, বরঞ্চ সোজাসাপটা ভাবে বললো,
— আমাদের বিয়ের সম্পূর্ণ বৈধতা আছে আপা, সমাজ যা বলে বলুক আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি, আমি আর পেছাতে পারবো না, তাহলে ম’রে যাবো।

অনু দাঁত কটমটিয়ে বললো,
— তাই বলে জায়ান ক্রীতিককে? মানুষটা একটা উগ্র মেজাজী লোক, ছেলে বুড়ো কাউকে এইটুকুনি রেসপেক্ট দেয়না, আমাদের মাকে তো দেয়ই না। তাকেই ভালোবাসতে হলো তোকে? আমি যতটুকু দেখেছি তোর সাথে তো ভালো ভাবে কথাও বলেনা সে, তাহলে ভালোবাসাটা এলো কোথা থেকে?

অনুর কথায় অরু মনেমনে হাসে, অতঃপর মনেমনেই বলে,
— জায়ান ক্রীতিক রহস্যময় মানব আপা, উনি সামনে যা দেখায় ভেতরে পুরোপুরি তার বিপরীত। একদিন সেটা তোরাও বুঝবি।

অরু চুপ হয়ে আছে দেখে, অনু বিরক্তি জড়ানো গলায় বললো,
— শোন অরু ভালোবাসিস আর যাই করিস, তবে তোর এসব অ’স্বাস্থ্যকর ভালোবাসা আর পা’গলামিতে মায়ের শরীরের যদি এইটুকুনি ত্রুটি হয়েছে, কিংবা মা আবার অসুস্থ হয়েছে তাহলে তোর খবর আছে।

অরু সঙ্গে সঙ্গে বললো,
— তাহলে সম্পর্কটা মেনে নিলেই তো পারিস।

অরুর কথায় অনু তেতে উঠে বললো,
— জায়ান ক্রীতিককে বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে বে’য়াদবের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছিস দেখছি। আর কি মেনে নেব? মেনে নেওয়ার মতো সম্পর্কে জড়িয়েছিস তুই?

—- তাহলে সেধে সেধে দরদ দেখাতে আসিস না, আমাকে একা ছেড়ে দে।

অনু দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,
— আমাকে আর মাকে না জানিয়ে বিয়ে করতে তোর একটুও বাঁধলো না অরু? আরও কি কি করেছিস কে জানে? নয়তো দামি ফোন, এতো বড় এ্যামাউন্টের চেক, এতোসব কোত্থেকে আসছে?

অনুর শেষ কথায় র’ক্ত চড়ে গেলো অরুর মস্তিষ্কে, সেদিন মা-ও একই কথা বলেছে, আর আজ আপাও আকারে ইঙ্গিতে বোঝালো, কি ভাবে ওকে এরা? আজ আর চুপ থাকলো না অরু, তেঁতো গলায় বললো,
— যদি করেও থাকি স্বামীর সাথে করেছি,পাপ তো আর করিনি। তাহলে কেন শুধু শুধু কথার আ’ঘাত করছিস আপা?

অরু মিথ্যে কিছু বলেনি, কথাটা ভেবেই দমে গেলো অনু। নিজেকে বারবার বসালো অরুর যায়গাতে, আজ প্রত্যয় যদি বৈধ ভাবে কিছুর দাবি করতো, তাহলে কি অনু ফিরিয়ে দিতো? কখনোই না। অরুর বেলায় কেন সবাই বিমাতাসূলভ আচরণ করছে তাহলে?ওর দো’ষটা কোথায়? ভালোইতো বেসেছে অপ’রাধ তো আর করেনি, তাহলে ওকে বারবার অপরা’ধীর মতো কেন জাজ করা হচ্ছে?

অনু চুপচাপ মলিন মুখে কিছু ভাবছে দেখে, অরু কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুতে শুতে বললো,
— তোর কিছু বলার না থাকলে যেতে পারিস, আমি ঘুমাবো।

অনু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিরব পদধ্বনিতে বেরিয়ে যেতে যেতে ছোট্ট করে বললো,
— খেয়ে নিস।

*****************************************
আজ বহুদিন বাদে আবারও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছে অরু। লম্বা চুলে চিরুনি টেনে টেনে চুলগুলো পরিপাটি করে নিচ্ছে সযত্নে। গায়ে পরেছে ডার্ক কফি কালারের ফতুয়া আর লংস্কাট। নিজেকে এতোটা গোছানোর পরেও চোখেমুখে কি বি’ষন্নতা মেয়েটার। ফর্সা উজ্জল চেহারাটা গত পনেরোটা দিনে কয়েক শেড ফর্সা হয়ে গিয়েছে, ফ্যাকাসে মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে র’ক্তশূণ্যতায় ভুগছে বহুদিন। নিজের মলিন চেহারাটার দিকে খানিকক্ষণ একই ভাবে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো অরু, তারপর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার হাতরে একটা লিপ বাম বের করে আলতো করে লাগিয়ে নিলো দু ঠোঁটে। এখন একটু ভালো লাগছে দেখতে। নিজেকে আরও একবার আয়নায় দেখে নিয়ে পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো অরু।

আজ পনেরোটা দিন হলো ক্রীতিকের দেখা নেই, কোনো খোঁজ নেই।এখনতো অরুর অভিমানের চেয়ে চিন্তা বেশি হচ্ছে, কোথায় গেলো লোকটা? কেনইবা অরুর থেকে নিজেকে এতোটা আড়াল করে রেখেছে? তাহলে কি সে আর অরুকে চায়না? কিন্তু ক্রীতিক যে বলেছিল,
— তুই শুধু বিয়েটা কর,বাকিটা জীবন আমি সামলে নেবো।

এই তার সামলানো? এসব কথা ভেবেই গত রাতে অরু ঠিক করেছে ও ভার্সিটিতে যাবে। তাতে মা যা বলার বলুক, আর যা করার করে নিক। এভাবে চার দেওয়ালের মাঝে বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলে নির্ঘাত দম আটকে ম’রে যাবে ও। তার চেয়ে একটা রি’স্ক নিয়ে ক্রীতিকের সামনা সামনি হওয়াটা বেশি জরুরি। এভাবে ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে কষ্ট দেওয়ার মানে কি? জানতে চায় অরু। সেই উদ্দেশ্যেই সকাল সকাল আজ বেরিয়েছে ও। মা অফিসে, আপা বোধ হয় নিজের রুমে সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পা টিপেটিপে এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে অরু।

.
ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পা রাখতেই, সবার আগে আজও দেখা হয়ে গেল সায়নীর সাথে। অরু সায়নীকে দেখে ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে আসতেই, সায়নী অরুকে দেখা মাত্রই মুখ ঘুরিয়ে সোজা হাটা দিলো বিপরীত দিকে। সায়নীর এমন বিরূপ আচরণে ঘাবড়ালো না অরু, কারন সেদিন অরুও সায়নীর সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেনি, তারউপর সায়নী জেনে গিয়েছে ওর পছন্দের জেকে স্যার আর কেউ নয় সয়ং অরুর হাসবেন্ড। এতোকিছু একসাথে জানার পর একটু আধটু রাগ হওয়ারই কথা, তাই সায়নীর পেছন পেছন এগিয়ে আসতে আসতে অরু বললো,
— সায়নী দাঁড়াও, একটাবার আমার কথা শোনো প্লিইইজ। খুব বিপ’দে পরেছি আমি।

অরুর শেষ কথায় পা থেমে গেলো সায়নীর, ও চোখ মুখ শক্ত করে বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাড়াতেই আশ্চর্য হয়ে গেলো। আপনাআপনি হাত চলে গেলো মুখের উপর, মনেমনে বললো,
—এ কি হাল হয়েছে গুলুমুলু মেয়েটার? এতোটা শুকিয়ে গিয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে বাতাসের ধা’ক্কায় উড়ে যাবে এক্ষুনি ।

সায়নী দাড়িয়ে পরতেই অরু ছুটে এসে বললো,
— রাগ করে আছো এখনো?

সায়নী বেশ ম্যাচিউরড, অরুর থেকে বয়সেও কয়েক বছরের সিনিয়রই হবে, স্কলারশীপ নিয়ে এসেছে কিইনা। তাই রাগ হলেও প্রকাশ করার প্রশ্নই ওঠে না, অগত্যাই সায়নী বললো,
— রাগ করিনি, কিন্তু এ কি হাল হয়েছে তোমার, এতোটা শুকিয়ে গেলে কি করে?

অরু সায়নীর কথাটা পুরোপুরি এরিয়ে গিয়ে বললো,
— বলবো, সব বলবো, তার আগে তুমি প্লিজ আমাকে বলো তোমার জেকে স্যার কোথায়?

অরুর কথায় সায়নী তাচ্ছিল্যের হাসি
হেঁসে বললো,
— নাইস জোক অরু, তোমার হাসবেন্ড অথচ খোজ জিজ্ঞেস করছো আমার কাছে? ইজন্ট ইট ফানি?

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে অনুনয় করে বললো,
— আমি মজা করার অবস্থায় নেই সায়নী, প্লিজ বলো, আচ্ছা থাক তোমার বলতে হবেনা, আরেকটু পরেই তো ওনার ক্লাস আমই বরং খুজে নেবো।

অরুকে হয়রান আর ব্যতিগ্রস্থ দেখাচ্ছে, চোখে মুখে দারুণ কষ্টের ছাপ, ওর এমন অবস্থা দেখে মন টললো সায়নীর, ও আস্তে করে বললো,
— কি হয়েছে বলোতো তোমাদের? জেকে স্যার তো প্রায় পনেরো দিন ধরে ভার্সিটিতে আসেন না, আর তুমিতো তারও আগে থেকে।

সায়নীর কথায় অরুর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো, ও মনেমনে বললো,
— কি বলছে সায়নী এটা? ক্রীতিক পনেরো দিন ধরে ভার্সিটিতে আসেন না? কিন্তু উনিতো কাজে ফাঁকি দেওয়ার লোক নন, আমিতো অন্তত দেখিনি। তাহলে হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলেন উনি?

অরু ভাবছে দেখে সায়নী বললো,
— তোমার সাথে কথা হয় নি স্যারের? এখন আবার বলোনা যে নিজের হাসবেন্ডের কোনো খোঁজই জানোনা তুমি।

অরু একটা শুষ্ক ঢোক গিলে অপ’রাধীর সুরে বললো,
— ঠিকই বলেছো তুমি সায়নী, আমি ওনার কোনো খোঁজই জানিনা।
পরক্ষণেই কিছু একটা মাথায় আসতেই চট করে অরু বলে ওঠে,
—তোমার ফোনটা একটু দাওনা সায়নী।

সায়নী হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ফোন বাড়িয়ে দেয় অরুর হাতে, ফোন পেয়ে অরু কাঁপা হাতে মুখস্ত নাম্বারটা ফোনে তুলে ডায়াল করলো তাতে। কিন্তু এবারও অরুকে নিরাশ করে দিয়ে কলটা কেটে গেলো। কেটে গেলো বললে ভুল হবে, ফোনটা পুরো পুরি বন্ধ। নিভু নিভু শেষ আশা টুকুও হাত ছাড়া হয়ে যাওয়াতে অরুর বুক কাঁপছে, কা’ন্নারা দলা পাকিয়ে আটঁকে আছে গলায়। বাকশক্তি ক্ষীণ, জিহ্বাটা অযথাই তেঁতো হয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পরেছে, অরু একবার দুবার করে উদভ্রান্তের মতো অসংখ্য বার ডায়াল করলো ক্রীতিকের নাম্বারে, কিন্তু প্রতেয়কবার সেই একই বিরক্তিকর কথা,
— দা নাম্বার ইজ ক্লোজড।

অরুকে এমন দিশেহারা হতে দেখে সায়নী শুধালো,
— আর ইউ ওকে?

অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,
—ঠিক নেই, কিচ্ছু ঠিক নেই, আমি আমার মন, মস্তিষ্ক, হৃদয় কিচ্ছু ঠিক নেই ।
****************************************
ভার্সিটি ক্লাস সব কিছু সিকোয় তুলে শেষমেশ অরু গিয়েছিল ক্রীতিকের বাড়িতে, কিন্তু না বাড়িটাও ফাঁকা পরে আছে, কোথাও নেই ক্রীতিক। অগত্যাই একবুক ব্যাথা আর অভিমান নিয়ে ঘরে ফিরেছে অরু। ক্রীতিকের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে পুরোদস্তুর।

প্রায় দু’ঘন্টার রাস্তা জার্নি করে এসে বড্ড ক্লান্ত লাগছে অরুর, তারউপর সারাদিন না খেয়ে আছে। কিন্তু এখন খাওয়া যাবেনা, চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে হবে, নয়তো মা দেখলে হাজারটা প্রশ্ন তুলবে, কড়া কথা শোনাবে।সেই ভেবে সদর দরজা খুলে চুপচাপ মাথা নুয়িয়ে নিজের রুমে পা বাড়ালো অরু।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলোনা, রুমে প্রবেশের আগেই বাধ সাধলেন আজমেরী শেখ, গলা উঁচিয়ে বললেন,
— ন’ষ্টামো করতে গিয়েছিলে বুঝি?

অরু হকচকিয়ে উঠে পেছনে তাকিয়ে বললো,
— কি বলছো মা?

আজমেরী শেখ দুহাত বুকের উপর ভাজ করে সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন,
— আমার কাছে খবর আছে তুমি জায়ান ক্রীতিকের বাড়িতে গিয়েছিলে।

মায়ের কথায় অরু চো’রের মতো মাথাটা নিচু করে ফেললো, অতঃপর বললো,
—- আসলে মা, তুমি যা ভাবছো তা নয়।

— একদম চুপ করো। তোমার নোংরা মুখে মা ডাকবে না আমাকে।

অরু কান্না জড়িত কন্ঠে চেচিয়ে উঠে বললো,
— বারবার নোংরা নোংরা কেন বলছো? কি নোংরামো করেছি আমি?

আজমেরী শেখ কাঠকাঠ গলায় বললেন,
— সেটা মুখে বলতে হবে?

ওদিকে মা মেয়ের তর্ক শুনে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো অনু। অরুকে এভাবে মায়ের সাথে ঝাঁজিয়ে কথা বলতে দেখে চটে গেলো সে, অগত্যাই অরুর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
— আবার শুরু করেছিস অশান্তি? তুই চাইছিস টা কি অরু? আমাদের মা ম’রে যাক?

অনুর কথায় অরু আহত সুরে বললো,
— কি বলছিস আপা?

— তাহলে সকালে উঠে কোথায় গিয়েছিলি, আর সন্ধ্যা বেলাতেই বা কেন ফিরলি?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— তোরা আমার সাথে কেন এমন করছিস? কেন এতো মানসিক য’ন্ত্রনা দিচ্ছিস? আমি ঠিক নেই আপা ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছি, প্লিজ আমাকে একটু সস্থি দে।আমাকে একটু বাঁচতে দে।

অনু চোয়াল শক্ত করে বললো,
— তুই আগে আমাদের বাঁচতে দে, মাকে সুস্থ থাকতে দে।

অরু বললো,
— কি করতে বলছিস আমাকে?

অনু স্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— ক্রীতিক ভাইয়াকে নিজের স্বামী দাবি করা বন্ধ কর। ভুলে যা তাকে।

অরু কিছুক্ষন নিরব চোখে মা আর আপার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর কাঠকাঠ আওয়াজে বললো,
— পারবোনা।

সঙ্গে সঙ্গে ওর নরম তুলতুলে গালে এসে হা’মলে পরলো আরও একখানা চ’ড়ের আ’ঘাত। অরু এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল, এটা খাওয়া হয়ে গেলে রুমে চলে যাবে সে। তাইই করলো, গালে হাত দিয়ে টলমলে চোখের পানিটুকু আড়ালে মুছে রুমে গিয়ে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো।

অরু চলে গেলে অনুও নিজের রুমে গিয়ে দরজায় কপাট আটে,ওর মনটা যে খুব ভালো তাতো নয়, বরং অতিরিক্ত খারাপ, গত পনেরোটা দিন ধরে প্রত্যয়ের সাথে কথা নেই। অনু না হয় রাগ করেছে, তাই বলে প্রত্যয় কি একটাবার কল দিয়ে ওর খোজ নেবেনা? এ কেমন ভালোবাসা তার?

প্রত্যয়ের উপর গভীর রাগটা যখন গভীরতর হয়েছিল, তখনই ঘটে গিয়েছে এই ঘটনা, অনু নিজের একরাশ রাগ আর বিরক্তি অজান্তেই ঝেড়ে ফেলেছে ছোট্ট বোনটার উপর। এটা অবশ্য নতুন নয়, অনু বরাবরই রগচটা স্বভাবের, হুটহাট রাগ উঠে যায় ওর, আর তার বহিঃপ্রকাশটাও হয় ভুল ভাবে। সেই ভুল বহিঃপ্রকাশের বেশির ভাগ স্বীকারই হয় অরু।

কিন্তু আজ একটু বেশি বেশি হয়ে গিয়েছে। অনু নিজেই সেটা এখন বুঝতে পারছে, অনুশোচনা, অপরাধ বোধে গলা ধরে আসছে ওর। ও পরেছে মহা দোটানায় একদিকে বোনের অসহায়ত্ব আর অন্যদিকে মায়ের স্বাস্থ্য। কোন দিকে যাবে অনু?

তাও মা কিংবা জায়ান ক্রীতিক কেউ যদি একটু নরম মনের হতো, দুইজনই হচ্ছে টিট ফর ট্যাট। কেউ কাউকে এক বিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়, ওদিকে এসবের মাঝে পিষে যাচ্ছে, ছোট্ট অরুটা। অরুর জন্য এবার সত্যি সত্যি ভেতরটা পু’ড়তে লাগলো অনুর। অনু যখন অরুকে নিয়ে একরাশ অনুশোচনায় ডুবে আছে, ঠিক তখনই অযত্নে পরে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে তারস্বরে।
অনু স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখতে পায় প্রত্যয়ের নাম্বার। এতোগুলা দিন বাদে আজ হঠাৎ প্রত্যয়ের কল পেয়ে ভেতরে ভেতরে খুশির হিড়িক পরে গেলো অনুর, ও তৎক্ষনাৎ ফোনটা রিসিভ করে, কানে ধরে চুপ হয়ে রইল। এপাশ থেকে সারাশব্দ না পেয়ে ওপাশ থেকে প্রত্যয় ডাকলো,
— হ্যালো, অনু শুনতে পাচ্ছো?

— হুম বলুন।

অনুর নরমসরম আওয়াজ পেয়ে প্রত্যয়ের ও বোধ হয় ভালো লাগলো, ও খানিকটা আদুরে গলায় বললো,
— কেমন আছো সোনা?

অনু অভিমানী সুরে বললো,
— কে খোঁজ নেয়?

প্রত্যয় নিজের অপরাধ টুকু স্বীকার করে বললো,
— খুব বেশি ঝামেলায় ছিলাম, সব বলবো তোমায়, তার আগে ফোনটা অরুকে দাও।

অনু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— অরুর সাথে কি কাজ আপনার?

প্রত্যয় শাসন করার সুরে বললো,
— দিতে বলেছি দাও। ওর সাথে জরুরি কথা আছে।

অনু নাক ফুলিয়ে বললো,
— আপনি এতোদিন পরে বকা দেওয়ার জন্য কল দিয়েছেন তাইনা?

প্রত্যয় বুঝলো অনুর অভিমানের ঘট পূর্ণ। প্রেমিক হিসেবে প্রত্যয়ের ও তো একটা দায়িত্ব আছে প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর, কিন্তু এখন তো হাতে সময় নেই। তাই ও খুব বেশি আদর দেখিয়ে বললো,
— আমার জান, আমার প্রান, আমার অনু, প্লিজ কথা শোনো,ফোনটা অরুকে দাও, তারপর আমি তোমার সাথেই সারারাত কথা বলবো প্রমিস, আজ আর ঘুমাতে দেবোনা তোমায়।

প্রত্যয়ের এমন আহ্লাদী কথায় গদোগদো হয়ে উঠলো অনু, এতোক্ষণের রাগ ঢাগ সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো মূহুর্তেই, ও লাজুক সুরে বললো,
— ঠিক আছে এটাই কিন্তু শেষ বার, তারপর আর এরকম রিকোয়েস্ট করবেন না, মা জানলে খুব চটে যাবে আমার উপর।

প্রত্যয় সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আচ্ছা করবো না এবার দাও।

— একটু ধরুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।

*****************************************
সেই সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত অবধি একনাগাড়ে শাওয়ার ছেড়ে ভিজেছে অরু। নিজের সাথে নিজে না পেরে চিৎকার করে কেঁদেছে, শরীরের ব্যাথা, মনের ব্যাথা, সব কিছুতে জর্জরিত হয়ে আছে ও। হাত পা গুলো পানিতে ভিজে আরও ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত ভেজার ফলসরূপ, ঠান্ডায় তিরতিরিয়ে কাপছে ছোট্ট শরীরটা। একপর্যায়ে নিজের ভ্রম ছুটে গেলে জামাকাপড় পাল্টে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে নিজেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে অরু।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় টানা বারান্দায়, আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন, দূর আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে, হয়তো আজ রাতেও ঝড় আসবে। প্রচন্ড ঝড়ে ভে’ঙে যাবে গাছপালা। সেই তীব্র ঝ’ড়ের তান্ডব ও হয়তোবা অরুর মনের ঝ’ড়ের কাছে সামান্য মাত্র। তখনও কংক্রিটের ভবনের কোনো একতলা থেকে ভেসে আসছে বেসুরো গানের লাইন,
” রাত চান্দের আলো ঝড়ে বন্ধু তোমারও ঘরে
হায়, আলো যে জ্বলে না আমি একলা আন্ধারে
বন্ধু বিব্রতি যে না আমি খুঁজি তোমারে….
তুমি কোথায় আছো, কোথায়
দেইখা যাও আমারে……”

গানের লাইন গুলো খুব মন দিয়ে শুনতে শুনতেই, অস্ফুটে অরু বললো,
আমার থেকে লুকিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি জায়ান ক্রীতিক? তুমিহীন আমিটা যে বিদ্ধস্ত, বিমূর্ষ, আর পা’গলপারা সেটা তোমার অদেখাই রয়ে গেলো। সেদিন তোমার বলে যাওয়া প্রতিটি কথার মর্ম আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি আমি। নিজের অজান্তেই তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে পরেছি আজ, এখন তোমাকে যে আমার চাইই চাই, কিন্তু তুমিতো নেই, কোথাও নেই।
আর কত পো’ড়াবে আমায় বলো? কত বোঝাবে তোমার মর্ম? পারছিনা তো আর, এবার তো ফিরে এসো??

অরুর নিদারুণ ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রুমে প্রবেশ করে অনু। রুমের মাঝে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অরু এগিয়ে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
— খাবোনা আমি, যেতে পারিস।

অনু বললো,
— খেতে ডাকার জন্য আসিনি, প্রত্যয় সাহেব কথা বলতে চাইছে।

অরু একদিকের চুল অন্যদিকে এনে পুনরায় তোয়ালে চালাতে চালাতে বললো,
— এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

— বলেছে ইম্পর্টেন্ট কিছু, হয়তোবা ক্রীতিক ভাইয়া….

অনু কথাটুকু শেষ করার আগেই ওর হাত থেকে ছো মে’রে ফোনটা নিয়ে কানে ধরলো অরু, এই মূহুর্তে খুব ভয় করছে ওর, শরীরটা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে, কোনোমতে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, কাঁপা গলায় অরু বললো,
— হ্যালো!

অরুর প্রতিউত্তরে ওপাশ থেকে প্রত্যয় আস্তে করে বললো,
— ভাই নিচে অপেক্ষা করছে।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে, ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো অরু। দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের ক্রন্ধনরত মুখ। কাঁদতে কাঁদতে ক্রমাগত পা দুটোকে বাচ্চাদের মতো মেঝেতে ছুড়তে লাগলো ও। হুট করেই হৃদয়ের ব্যথাটা তরতর করে বেড়ে গিয়েছে । অভিমানের ঝড়ে মস্তিষ্কটা ব্লক হয়ে আছে। আজ আবারও কতগুলো দিনপর পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়ছে ।ইচ্ছেতো করছে চিৎকার করে কাঁ’দতে। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়। তাই মেঝেতে বসেই দু’হাতে মুখ চেপে ধরে চোখের পানি ফেলছে অরু। অরুকে এভাবে কাঁদতে দেখে অনু আর কথা বাড়ায়না ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ রুম ত্যাগ করে।

অরু যখন নিচে আসে তখন রাত বারোটা কি একটা। চারিদিকের তীব্র ঝড়োহাওয়া আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ভবন থেকে বেড়িয়ে আসে অরু। ওর পরনে ফ্রক আর লেগিংস, ভেজা চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনোমতে আটকানো। মাথার উপর বড় করে ঘোমটা টানা। নিচে এসে ক্রীতিক কিংবা তার বাইক কোনোটাই দেখতে পেলোনা অরু, শুনশান নিরব রাস্তায় শুধু মাত্র চোখে পরলো একটা ব্ল্যাক মার্সিডিজ। অরু জানে এটা কার গাড়ি তাই ও আর দেরি করলো না, ছুটে চলে গেলো গাড়ির সামনে।

এতোগুলা দিন পর ক্রীতিককে দেখার উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে ওর, সেই সাথে হৃদয় ভার হওয়া অভিমান তো আছেই। অরু গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই একটানে দরজা খুলে দিলো ক্রীতিক।

ক্রীতিককে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে অরু, পরনের অফ হোয়াইট ব্র্যান্ডেট শার্ট আর ওভার সাইজ ব্ল্যাক ডেনিম দুটোই অগোছালো। কপাল জুড়ে আঁটোসাটো ব্যান্ডেজ, লম্বা ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো আরও খানিকটা লম্বা হয়ে কপালে পরে আছে। বাম হাতের পিঠে এখনো ক্যানোলা লাগানো।

অরু জানেনা ক্রীতিকের কেন এই হাল, তবে কিছুটা আঁচ করতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠে অরু বললো,
— এখনো বলবেন মাইনর বাইক এ’ক্সি’ডেন্ট তাইতো?

ক্রীতিক মৃদু হেসে বললো,
— বেশি না মাত্র তিনদিন সে’ন্সলেস ছিলাম। পায়ের ফ্যাকচা্রের কারনে হাটতে পারিনি, আজই ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে, আর আমি হসপিটাল থেকে সোজা তোর কাছে চলে এসেছি।

ক্রীতিকের কথা শুনে অরুর অপ’রাধবোধ তুঙ্গে উঠে যায়, ও কত কিই না ভেবেছিল এই কদিন। অথচ ক্রীতিক কিনা হসপিটালে শুয়ে শুয়ে মৃ’ত্যুর সাথে পাঞ্জা লরছিল?নিজের উপর বড্ড রাগ হলো অরুর। অরুকে কাঁদতে দেখে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে বললো,
— ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি নাতো একদম, তোর কান্না বিশ্রী লাগে।আমি কি ম’রে গেছি?আশ্চর্য!

অরু নাক টেনে বললো,
— লাগলে লাগুক।

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম সুরে বললো,
— বুকে আয়।

ক্রীতিক কি বললো সেটা শোনার জন্য অরু এবার চোখ তুলে তাকালো,
অরু এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
— বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে? তাহলে ভিজতে থাক আমি গেলাম।

অরুর তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,
— আমায় রেখে কোথায় যাবেন আপনি?
অরুর কথায় ক্রীতিক গভীর চোখে তাকালে, অরু পুনরায় মিনমিনিয়ে বললো,
— না মানে বৃষ্টি নেমেছে তাই।

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বললো,
— কতক্ষণ ধরে বলছি বুকে আয় কথা শুনিস আমার?

— হ্যা??

ক্রীতিক আর কথা বাড়ালো না অরুর হাতে হ্যাচঁকা টান দিয়ে ওকে গাড়ি মধ্যে নিয়ে শব্দ করে গাড়ির ডোর লক করে দিলো। সেই সাথে নিভিয়ে দিলো অবশিষ্ট আলোটুকুও। তবুও সোডিয়ামের টিমটিমে আলোয় ক্রীতিকের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাঁচ্ছে অরু। যে এই মূহুর্তে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ওর দিকেই মাতাল চাহনীতে চেয়ে আছে।ক্রীতিক কে হুট করে এতোদিন পর এতোটা কাছে দেখতে পেয়ে কেন যেন এই মূহুর্তে প্রচন্ড কা’ন্না পাচ্ছে অরুর। খুশির কান্না। ও কাঁপা হাতে ক্রীতিকের গালে হাত ছুয়িয়ে মনে মনে বললো,
—- আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় বুক ফেটে ম’রেই যাচ্ছিলাম, তারপর হুট করেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে আবারও ফিরে এলেন আপনি,ধরা দিলেন হৃদয়ে, পুনর্জীবিত করে দিলেন আমার আত্মাটাকে। এ কোন মায়ায় বাঁধা পরেছি আমি?

অরু চুপচাপ ক্রীতিকের গালে হাত রেখে চোখের জল ফেলছে দেখে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বললো,
— আই মিসড ইউ বেইবি। তোর কি একবারও মনে পরেনি আমাকে?

অরু কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না, তাই উল্টো প্রশ্ন করে বললো,
— আপনি ঠিক আছেন? হাতে এখনে ক্যানোলা লাগানো কেন?

ক্রীতিক নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ডিসচার্জ করার আগেই বেরিয়ে এসেছি তো তাই খোলা হয়নি।

অরু পটু গিন্নির মতো করে ওকে শা’সিয়ে বললো,
— এটা কি ঠিক হলো? আপনি এখনো ইনজুরড।

ক্রীতিক অরুর গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
— তোর কাছে ফিরে এসেছি, এবার ঠিক হয়ে যাবো।

অরু চোখ দুটো বুজে কাঁপা গলায় বললো,
— আমি ভেবেছিলাম আপনি আর আসবেননা।

ক্রীতিক অরুর ওড়নাটা সরিয়ে ওর লম্বা চুলগুলো একটানে খুলে দিয়ে, চুলের সুঘ্রাণে মুখ ডোবাতে ডোবাতে বললো,
— তোকে ছাড়া বাঁচতে পারলে তো।

ক্রীতিকের কথায় অরু মৃদু হাসে, তীব্র ঝরের শেষে প্রকৃতি যেমন পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায় ওর হৃদয়টাও এই মূহুর্তে পুরোপুরি শান্ত।
বাইরে বৃষ্টি ছাপিয়ে ঝড় শুরু হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে আকাশ। এমন ঝড়োহাওয়ার মধ্যে গাড়িতে বসে থাকতে ভ’য় করছে অরুর। অথচ ক্রীতিক সেই যে গলায় মুখ ডুবিয়েছে এখনো ছাড়েনি। অরু এখন ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে চোখ বুজে সহ্য করছে সবকিছু। এক পর্যায়ে গগন কাঁপানো আওয়াজে হুট করেই বাজ পড়লো ধরনীতে, সঙ্গে সঙ্গে অরু ঘুরে এসে ক্রীতিককে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।

অরু জড়িয়ে ধরাতে এতোক্ষণে ক্রীতিক পার্থক্যটা বুঝতে পারলো, অরু শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা। শরীরটা এইটুকুনি হয়ে গিয়েছে। ক্রীতিক এবার ভ্রু কুঞ্চিত করে অরুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,
— এভাবে শুকিয়ে গিয়েছিস কেন? কি হয়েছে এই কদিনে তোর সাথে?

ক্রীতিকের কথায় অরু মাথা নিচু করে ঠোঁট উল্টে ফুপিয়ে উঠলো, অভিমানী কা’ন্নায় ভে’ঙে পড়ে অস্পষ্ট সুরে বললো,
— কি হয়েছে সেটাতো আপনি ভালো বলতে পারবেন। সেদিন কি কি সব কঠিন কথা বলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, আর এলেন না, দিন যায়, রাত যায় আপনি আর আসেন না। আমিতো ভেবেছি আপনি আমাকে শা’স্তি দেওয়ার জন্য লুকিয়ে আছেন কোথাও।আমার বুঝি কষ্ট হয়নি?

অরুর কথায় ক্রীতিক যেন আকাশ থেকে পরলো, ও অরুর গাল দুটো হাতে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো,
— মাত্র কয়েকটা দিন আমি আসি নি বলে তুই খাওয়া বন্ধ করে দিবি?এটা কেমন কথা? আমাকে কি তোর এতোটাই লেইম মনে হয়? যাকে না দেখে একমূহুর্ত থাকতে পারিনা, তাকে শা’স্তি দেওয়ার জন্য নিজেই লুকিয়ে থাকবো?এই তোর বুদ্ধি? নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার সাহস কোথায় পেলি তুই? মাত্র পনেরো দিনে ভুলে গেলি, শরীরটা তোর হলেও আত্মাটা যে আমার?

অরু কাঁদতে কাঁদতে অভিমানের পসরা সাজিয়ে বসেছে, একেএকে উগরে দিচ্ছে সব, ক্রীতিকের শার্টের বোতাম খুঁটতে খুঁটতে হেঁচকি তুলে অরু বললো,
—- শুধু আসেন নি তাতো নয়, একটা খোজ নেই, খবর নেই, আপনার ফোনটাও বন্ধ। আপনি জানেন আমি আপনার বাড়িতে পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে এসেছি কিন্তু আপনাকে পাইনি।

অরুর কথায় ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
— খুজেছিস ভালো কথা, তাই বলে নাওয়া,খাওয়া বন্ধ করে এভাবে শুকিয়ে যেতে হবে?এখন আমি আদর করবো কোথায়? পিচ্চি মেয়েদের বিয়ে করলে এই হয়, পরিস্থিতি বোঝে না, কিছুনা, সারাক্ষণ ইমোশনাল হয়ে থাকে।

অরু কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— ইমোশন যদি বুঝবেনই না, তাহলে করেছেন কেন পিচ্চি মেয়েদের বিয়ে? আমিকি বিয়ে করার জন্য নাচছিলাম?

অরুর এতোএতো কান্নাকাটি সহ্য হলোনা ক্রীতিকের, ও অরুকে এক ঝটকায় টেনে এনে নিজের বাহুতে আগলে ধরে এবার নরম সুরে বললো,
— আমি কল্পনাও করিনি যে তুই আমার জন্য এতোটা ডেস্পারেট হয়ে যাবি, তাহলে জ্ঞান ফেরার পরে অন্তত অর্ণব কে দিয়ে খবর পাঠাতাম। কিন্তু তাই বলে তুই এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবি?

অরুর উত্তর নেই, ওতো ফোপাঁতে ফোপাঁতে নাকের পানি চোখের পানি দিয়ে ক্রীতিকের শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। ক্রীতিক সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে পুনরায় বললো,
— এখানে আর থাকতে হবেনা, চল আমার সাথে।

অরু এবার মাথা তুলে শুধালো,
—কোথায় যাবো?

— তোর হাসবেন্ডের বাড়ি আছে, সেখানেই।

অরু আঁতকে উঠে বললো,
—কি বলছেন, এই ঝড়ের মাঝে এতো রাতে?

— যাবি কি না?

অরু কিছু বলছে না দেখে ক্রীতিক গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
— আমিওবা তোকে কেন জিজ্ঞেস করছি অযথা? তোকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারবো না, সো না এর কোনো অপশন নেই।

ক্রীতিকের কান্ডে অরু হতভম্ব। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর, তাই একবার সবটা বোঝার জন্য নিজের দিকে তাকালো অরু,
পায়ে স্যান্ডেল, গায়ের ওড়নাটা ব্যাকসিটে পরে আছে, পরনে ফ্রক। বাইরে তুমুল বর্ষন। পেছনে ফেলে এসেছে মা আর আপাকে। পাশে বসে দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে সব চেয়ে কাছের মানুষটা আর অরু এভাবেই তার সাথে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে। অবশ্য জায়ান ক্রীতিকের দ্বারা সবই সম্ভব।

সানফ্রান্সিসকো ছাড়িয়ে শহরতলীর সেই নির্জন শুনশান রাস্তায় আসতেই ঘটলো বিপত্তি, গাছপালা ভে’ঙে পরে পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে আছে। সামনে যাওয়ার কোনোরূপ উপায়ান্তর নেই। অগত্যাই ক্রীতিক ব্রেক কষলো সেখানেই। পুরো রাস্তা জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার,বিদ্যুতের লাইনচ্যুত হওয়ায় রোড লাইট গুলোও নিভে আছে। চারিদিকে মানুষতো দূরে থাক একটা মশা-মাছিরও আনাগোনা নেই। অথচ বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এমন একটা পরিবেশে আটকে পরে অরুর গা ছমছম করছে। তাই ও মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
— এবার কি হবে?

ক্রীতিক একবার অরুর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো, অতঃপর গমগমে আওয়াজে বললো,
— অরু ব্যাকসিটে চল।

অরু অবাক সুরে শুধালো,
— কেন?

— আমি বলেছি তাই।

অরু উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— এভাবে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস কেন ফেলছেন?আপনার কি শরীর খারাপ করছে?

ক্রীতিক বললো,
— হ্যা, চল এবার।

অরু আর কিইবা করবে, ক্রীতিকের শরীর খারাপ লাগছে দেখে তারাহুরো করে বেরিয়ে গেইট খুলে ব্যাক সিটে গিয়ে বসলো। ক্রীতিক ও অন্য সাইড থেকে এসে গেইট লাগিয়ে দিলো।
ক্রীতিক এসেছে দেখে অরু নিজের জামা কাপড় থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়া বাদ দিয়ে ওর ব্যান্ডেজ করা কপালে হাত ছুয়িয়ে বললো,
— কোথায় খারাপ লাগছে দেখি?

ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ কোনোকিছুর পূর্বাভাস না দিয়েই, অরুর হাতটা পিছনে চেপে ধরে নিজের ঠোঁট দিয়ে ওর ওষ্ঠাধর দখল করে। ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরু বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ও নড়তে পারছে না, ক্রীতিককে ছাড়াতেও পারছে না, ওদিকে দম আটকে আসছে।

একটা দীর্ঘ আর গভীর চুম্বন শেষে ক্রীতিক অরুর ঘাড়টা চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে হিসহিসিয়ে বললো,
— হার্টবিট, একবার তুমি বলে আপন সুরে ডাক, তোর মুখে তুমি শোনার ইচ্ছে আমার বহু বছরের।

অরুর চোখ বন্ধ, কোনোমতে জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— আপনিতো আমার অনেক বড়।

ক্রীতিক হাস্কিস্বরে বললো,
— সো হোয়াট? আমি তোর সব থেকে আপন, আরেকটু পরে আমাদের মধ্যে কোন দূরত্ব থাকবে না, তাহলে আমাকে ডাকবি নাতো কাকে ডাকবি?

অরু এই মূহুর্তে পুরোপুরি ক্রীতিকের বশবর্তী, কোন এক অদৃশ্য জা’দুবলে ক্রীতিক ওকে পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে, তাই অরুও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
— আপনাকেই বলবো।

— তাহলে বল।

অরু পরাজিত সৈনিকের মতো ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো,
—ততুমি!

ক্রীতিক পুনরায় বললো,
— চোখ খুলে, আমার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বল।

অরু এবার তাই করলো,শুষ্ক ঢোক গিলে ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে রিনরিনিয়ে বললো,
— তুমি।

অরুর লজ্জারাঙা মুখ দেখে ক্রীতিক নিঃশব্দে হাসলো, অতঃপর একটানে অরুকে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— আই নিড ইউ অরু, আই ডেস্পারেটলি নিড ইউ রাইট নাও। হবি না আমার?

ক্রীতিকের কথা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরে ভ্রম ছুটে গেলো অরুর,মূহুর্তেই ভ’য়ের চোটে আ’ত্মাটা শুকিয়ে গেলো ওর। ক্রমাগত ছটফট করতে লাগলো ক্রীতিকের কোল থেকে নামার জন্য। ক্রীতিক একহাতে অরুকে চেপে ধরে অন্যহাত দিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিরক্ত হয়ে বললো,
— কি হয়েছে? ছটফট করছিস কেন?মা’রছি তোকে? আদরই তো করবো।

অরু আতঙ্কিত সুরে বললো,
— আমার ভ’য় করছে।

অরু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক নিজের হাতে লাগানো ক্যানোলাটা একটানে বের করে ফেললো, তৎক্ষনাৎ ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেরোলো ওর হাত থেকে। অরু সেখানটায় চেপে ধরে বললো,
— কি করছেন?

— এটা ডিস্টার্ব করছে।

অরু এবার কম্পিত কন্ঠে বললো,
— আপনি কি চাইছেন?

ক্রীতিক পুনরায় নিজের শার্টের বোতামে হাত চালাতে চালাতে অরুর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— তোকে।

ক্রীতিকের নেশালো আওয়াজে কেঁপে উঠলো অরু, তবুও অনেকটা সাহস সঞ্চার করে মিনমিনিয়ে বললো,
— আমার ভ’য় করে আপনাকে।

ক্রীতিক একটানে অরুকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিয়ে বললো,
— ভয় কেন?

অরু কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,
— আপনি ডার্ক রোম্যান্স শোনেন সবসময়।

ক্রীতিক অরুর লম্বা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে ধীরে ধীরে ওর জামার চেইনটা খুলতে খুলতে বললো,
— দিস ইজ ইউর ফার্স্ট টাইম, সো আ’ল বি জেন্টাল বেইবি…..

অরুর মাঝে ডুবে যেতে যেতে ক্রীতিকের মন বলছে,
“ঝলসানো রাতে,এ পো’ড়া বরাতে
তুমি আমার অন্ধকার..
আর রোশনাই……. ”

মধ্যরাতে আকাশ বাতাস ছাপিয়ে বর্ষনে মুখরিত ধরনী,সেই সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তাল ঝড়ো হাওয়ায় চারিদিক কনকনে ঠান্ডা। ঝড়ের তান্ডব কমে এসেছে একটু একটু, অথচ অন্ধকারের মাঝে আটকে পড়া ব্ল্যাক মার্সিডিজটা এখনো সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে। ধরনীতে বহমান ঝড়ের গতিবেগ কমে এলেও দুটো হৃদয়ে এলোপাথারি বইতে থাকে উত্তাল জলো’চ্ছ্বাসের তান্ডব আজ রাতে বোধ হয় কমবে না আর। ক্রীতিকের অবাধ্য আচরণে ইতিমধ্যে অরু বুঝতে পেরেছে,আজ রাতটা ওর জন্য দীর্ঘতম হতে চলেছে, সেই সাথে নিদ্রাহীন।
চলবে…….