#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৩৭
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]
অনুজা ছোট্ট বোনটার উদভ্রান্ত ভগ্নহৃদয়ের কা’ন্না আর কষ্ট দেখে অবশেষে কিছুটা হলেও হৃদয় টললো অনুর। মনের মনিকোঠায় কোথায় যেন চিনচিনিয়ে নাড়া দিয়ে উঠলো ওর।
যেখানে মানুষ দুইটা একজন আরেকজনকে ছাড়া ম’রে যাচ্ছে, সেখানে এতো সমাজ বিবেচনা করে কি লাভ? বুঝে আসেনা অনুর।তাছাড়া ধর্মে যেই সম্পর্কের পুরোপুরি বৈধতা আছে, সেখানে সামান্য সমাজ আর সমাজের কটুক্তির দোহাই দেওয়াটা নিছকই ছেলে মানুষি নয় কি?
জায়ান ক্রীতিক কবেই বা মেনেছে এই সমাজের নিয়ম কানুন? তার মতো মানুষকে সমাজের শেকলে ব’দ্ধ করা কেবলই কল্পনা মাত্র। অথচ এসবের মাঝে পরে শুধু শুধু পাহাড় সমান ক’ষ্টে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওইটুকুনি মেয়েটা।
এতোদিন যেমন তেমন ছিল, দেশে ফেরার পরে এখন আবার শুরু হয়েছে মামি আর রেজা ভাইয়ের উপদ্রপ। সবমিলিয়ে নিজের ছোট্ট বোনের এমন হৃদয় নিংড়ানো কা’ন্নার জোয়ার চোখের সামনে আর দেখতে পারলো না অনু। করিডোরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কিছু ক্ষী’প্র সিদ্ধান্ত সমেত, নিজের সকল সংশয় ভুলে ছুটে যেতে লাগলো মায়ের কক্ষের দিকে।
চৈত্র মাসের ভ্যাপসা গরম, মাথার উপর অনবরত ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটার জীবন ফুরিয়ে এসেছে বোধহয়,তবুও কর্মক্ষেত্রে অটল সে। পুরাতন আমলের পাখা মজবুত তো হবেই।
রাতের বেলাতেও এইটুকুনি ঠান্ডা হাওয়া নেই, তাই রুমের মাঝে এয়ারকুলার মেশিন চালিয়ে ইজি চেয়ারে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন আজমেরী শেখ। সেই প্রথম জীবন থেকেই সাহিত্যে তার ভীষণ আগ্রহ, জামশেদ জায়ানের সাথে বিয়ে হওয়ার পরে তিনিই মহলের এককোনে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরী উপহার দিয়েছিলেন আজমেরী শেখকে। ভালোবাসা প্রকাশের ফলস্বরূপ লাইব্রেরীর নাম দিয়েছিলেন “মেরীর রংমহল”।
কিছু বছর আগেও ব্যবসায়ী কাজে স্বামীকে সাহায্য করার পরে যেই ফুরসত টুকু মিলতো সেই সময়টা লাইব্রেরিতেই কাটাতেন আজমেরী শেখ। খুব মনদিয়ে নাড়াচাড়া করতেন পছন্দের বইগুলো, একে একে পাতা উল্টে বুক ফুলিয়ে নিতেন নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ ।
মাঝখানে অবশ্য অসুস্থতায় কেটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর,এখন আর আগের মতো চোখের তীক্ষ্ণ পাওয়ারটা অবশিষ্ট নেই, তাই চোখের উপর মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়েই বহুবছরের অভ্যেসে কিছুটা শান দিতে বসেছেন তিনি আজ।
আজমেরী শেখ যখন বইয়ের পাথায় বুদ হয়ে আছেন, তখনই হুড়মুড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করে অনু। অনুর এমন অকস্মাৎ আগমনে ভ্রুকুটি করে আজমেরী শেখ বলেন,
—-এটা কি ধরনের আচরণ অনু? কারও রুমে ঢুকতে হলে আগে নক করতে হয়, এখনো শিখাতে পারিনি কেন?
মায়ের কথায় কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে, অনু হাতের মাঝে হাত দিয়ে কচলাতে কচলাতে বললো,
—- মামি কেন অরুর রুমের দরজায় তালা লাগিয়েছে মা? তুমি কিছু বলোনি?
আজমেরী শেখ কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
—- তালা লাগিয়েছে মানে?
মায়ের কথার পাছে অনু কিছু বলবে তার আগেই রুমের মাঝে আগমন ঘটে অনুর মামি জাহানারার। অনু রা আমেরিকা থেকে ফেরার পরেই পুরো পরিবার শুদ্ধ এসে ক্রীতিক কুঞ্জে হাজির হয়েছে তারা। উদ্দেশ্য আজমেরী শেখের দেখভাল করা। অনুর মামা ভূমি অফিসের ছোটখাটো কর্মকর্তা, তিনি মেয়েলী ঝুট-ঝামেলায় খুব কমই থাকেন।
তবে ক্রীতিক কুঞ্জের মতো আলিশান বাড়িতে একমাস কেন একবছর বেড়াতেও তার কোনো অসুবিধা নেই। তারউপর এখন তার বোনও সুস্থ সবল হয়ে ফিরেছে,আগেতো ধিঙ্গি মেয়ে দু’টোর সাথে জাহানারার সারাদিন কথা কাটাকাটি লেগেই থাকতো, এখন আর সেই সুযোগ নেই। কারন মামির সাথে বে’য়াদবি করলে কিভাবে মেয়েদের সু-শিক্ষা দিতে হয় সেটা তার বোন ভালো করেই জানে।
ওই জন্যই তো, বউয়ের এক কথাতেই এখানে বেড়াতে চলে আসা। জাহানারার অবশ্য অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটা ফলিয়ে তবেই এ বাড়ি থেকে বিদেয় হবে সে, তার আগে নয়।
অনুর কথায় আশ্চর্য হয়ে আজমেরী শেখ কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবেন তার আগেই জাহানারা এগিয়ে এসে বলেন,
—- কি করবো বলো আজমেরী, তোমার ছোট মেয়েটা অসহ্য রকম চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছিল, তারউপর অন্দরমহলের সব দামিদামি জিনিস গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছে।বিশ্বাস না হলে নিচে গিয়ে দেখো একবার।
মামির কথায় তেতে উঠে অনু বললো,
—– ভাঙলে ওর স্বামীর টাকায় কেনা জিনিস ভেঙেছে, তাতে তোমার কি মামি?
অনুর মুখে ক্রীতিকের গুনগান শুনেই গর্জে উঠলেন আজমেরী শেখ,মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,
—— চুপ করো, কে কার স্বামী? কোথাকার কোন থাইল্যান্ড বসে বিয়ে পরিয়েছে, রেজিষ্ট্রি করেছে ওসব আমি মানিনা।
—- কেন মানোনা মা? অস্বীকার করতে পারবে অরু যে ক্রীতিক ভাইয়ার বিবাহিতা স্ত্রী? তাছাড়া অরু চারদিন যাবৎ ক্রীতিক ভাইয়ার সাথে ছিল, একসাথে একই ছাদের নিচে, আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা একজন আরেকজন কে ভালোবাসে।তাহলে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?
অনুর কথার পাছে, আজমেরী শেখ কিছু বলার আগেই জাহানারা মুখ দিয়ে বিরক্তিকর ছ্যাহ ছ্যাহ উচ্চারণ করে বলে ওঠে ,
—– কতটা লজ্জা শরমের মাথা খেলে মানুষ এই কাজ করতে পারে বাপু? শেষ পর্যন্ত কিনা নিজের মায়ের সৎ ছেলের গলায় ঝুলে পরলো ছ্যাহ। আমার তো মনে হয় ওই ছেলে ফূর্তি করার জন্যই এতো নাটক করেছে, ফূর্তি করা শেষ এখন আর এদিকে ফিরেও তাকাবে না।
মামির কথায় শক্ত হয়ে এলো অনুর চোয়াল, এরা ভাবেটা কি নিজেকে যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে। ওদিকে আজমেরী শেখের ও কানে লেগেছে কথাগুলো, নিজের সন্তানকে নিয়ে কেউ এসব বললে কানে লাগারই কথা। আজ নিজের ভাইয়ের বউ বলছে, দুদিন পর মহল্লার লোকেরাও বলবে,তারপর ধীরে ধীরে পার্টি অফিসের সবাই পিঠ পিছে খিল্লি ওড়াবে।তার মেয়েকে নিয়ে বাজে কু’রুচিকর মন্তব্য করবে,খুব গভীর আর অন্তরঙ্গ ব্যাপার গুলো নিয়ে হাসাহাসি করবে।এখনই সেসব কথা ভাবতে গেলে মেজাজ সপ্তম আসমানে চড়ে যায় আজমেরী শেখের।
তিনি ক্ষ্যা’পাটে অনুকে তৎক্ষনাৎ ধমকের সুরে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
—- অরু যদি একটা রাস্তার ছেলেকেও ভালোবাসতো তবুও তার অন্যান্য যোগ্যতা বিচার করে মেনে নিতাম আমি,কিন্তু জায়ান ক্রীতিক কে মানা যায়না। তাই এসব বিষয় নিয়ে আর একটাও কথা বাড়াবে না অনু, চুপচাপ থাকবে,সবার সব কিছু জানাজানি হয়ে যাওয়ার আগেই অরুর জন্য উপযুক্ত একটা ব্যাবস্থা করবো আমি।
অনু বিচলিত হয়ে তেঁতো গলায় বললো,
—- জায়ান ক্রীতিকের দোষটা কোথায় মা?
তখন থেকে অনু ক্রমাগত মুখেমুখে তর্ক করছে তাও এরকম একটা জটিল বিষয় নিয়ে, ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগছে না আজমেরী শেখের।তাই তিনি এবার মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
—– আমি বলেছি মেনে নেওয়া যায়না,তারমানে যায়না। আর কোনো প্রশ্ন করবে না এক্ষুনি নিজের রুমে যাও।
অনু থমথমে গলায় বললো,
— যা ইচ্ছে করো মা, তবে নিজের জিদ আর অহমিকাকে এতোটাও বড় করে দেখতে যেও না যার ফলসরূপ তোমার মেয়ের না আবার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়।
কথাটুকু বলে মামির কোমরের গোছা থেকে টান মে’রে অরুর রুমের চাবিটা নিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় অনু।
অনু চলে যেতেই শুরু হয়ে যায় জাহানারার ব্রে’নওয়াশ। তিনি এগিয়ে গিয়ে আজমেরী শেখের উদ্দেশ্যে বলেন,
—- সেই কবে থেকে বলছি তোমায় আজমেরী, অনু বড় হয়েছে,আমার রেজাও মাসআল্লাহ নামদাম কামিয়েছে অনেক, পুরো ঢাকা দক্ষিণের ছাত্রলীগের সহসভাপতি হয়েছে এবছর। রেজার কথায় বড়বড় মাথা ওয়ালা লোকেরাও এখন ওঠে বসে।
তাছাড়া আমার ছেলের ক্ষমতা তো তোমরা নিজের চোখেই দেখলে, তোমাদের সকল বন্দোবস্ত সেরে হুট করেই কেমন আমেরিকা থেকে নিয়ে এলো। ক্ষমতা না থাকলে কি এসব হয়? তাই এখনো সময় আছে অরুর মতো উচ্ছনে গিয়ে ভুলভাল কাহিনী ঘটানোর আগেই অনু আর রেজার গাঁটছড়াটা বেধে দাও। তাহলে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকলো,মাঝখান থেকে তোমার একটা ছেলেও জুটলো।
একসাথে অনেকগুলো কথা শেষ করে,রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে জাহানারা পুনরায় বললেন,
—-আমি যা বলি তোমার ভালোর জন্যই বলি বোন।
অন্যের কথায় প্রভাবিত হওয়ার মতো মানুষ আজমেরী শেখ নয়। কিন্তু অরু এবার ইউ এস এ তে গিয়ে যা যা ঘটালো তাতে অনুর প্রতি সন্দেহ আর শঙ্কা দুটোই তার মনেও দানা বেঁধেছে কিছুটা।
এক মেয়ের জন্য মান সম্মান খোয়া যাচ্ছে, এই সময়ে অন্য মেয়েকে সম্মানের সাথে উপযুক্ত গুনাগুন সম্পন্ন পাত্রস্থ করা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতোই। তাই আপাতত আজমেরী শেখের মাথায় জাহানারার কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঠিকই তো এভাবে শর্ট নোটিশে কত সহজে দ্বায়িত্ব নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছে রেজা। তাছারা আরেকটা কথাও তো ঠিক, এখন আর সেই এলাকার নেতাদের লেজ ধরে ঘুরে বেড়ানো পাতি নেতা নেই রেজা। নিজের যোগ্যতায় বেশ ভালোই নামদাম কামিয়েছে সে। দেখতে শুনতেও খারাপ না। এককথায় পাত্র হিসেবে ভালো, শুধু ভালো নয় বরং বেশ ভালো।
***********************************************
মামির কাছ থেকে চাবিটা ছিনিয়ে নিয়ে অনু যখন দ্রুত পা ফেলে অরুর রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই হুট করে সামনে চলে আসে রেজা আর ওর ছোট বোন রুপা।
না, রেজা অনুর পথ আটকে দাঁড়ায়নি, বরং দু’জন দুদিক থেকে আসছিল বলেই পথিমধ্যে দেখা। আমেরিকা থেকে আসার পর এটাই বোধ হয় প্রথম সাক্ষাৎ ওদের। যার ফলস্বরূপ অনুকে দেখা মাত্রই পা দুটো থমকে যায় রেজার। রেজার পেছনে ওর ছোট বোন রুপাও ছিল, মাত্রই সন্ধ্যার টিউশন থেকে ফিরেছে সে, এখন রুমেই যেতো।কিন্তু পথিমধ্যে ভাইকে এভাবে আচমকা দাঁড়িয়ে পরতে দেখে,তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের আগন্তুক কে দেখার জন্য একটু খানি উঁকি দেয় রুপা।
উঁকি দিতেই চোখের সামনে অনুকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে রুপা বললো,
—- আরে ভাবি যে, কতদিন পর দেখা হলো তোমার সাথে।
এমনিতেই মেজাজ চড়াও হয়ে আছে,মাথাটা য’ন্ত্রণায় ধিরিম ধিরিম আওয়াজ করছে,তারউপর রুপার এমন অহেতুক ভাবি সম্মোধনে বেশ বিরক্ত হলো অনু, তৎক্ষনাৎ রুপাকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
—- কে তোর ভাবি? আপু বল।
অনুর ধমকে রুপা মুখ কালো করে চলে যেতেই রেজা খানিকটা এগিয়ে এসে শুধালো,
—– কেমন আছো অনু?
অনু বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠে বললো,
—- ভালো নেই।
—কেন?
অনু এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া পরখ করলো রেজাকে,আগের চেয়ে বেশভূষায় বেশ পরিবর্তন হয়েছে তার । চেহারায় এখন আগের মতো মদন মদন ভাবটা আর নেই, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর মুখভর্তি খড় দাড়িতে ভালোই লাগছে দেখতে,কোথাও যেন একটা গু’ন্ডা মা’স্তান ভাইব আছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনুর চোখে রেজাকে সেই আগের মতোই মদন মদন লাগছে। রেজা এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে দেখে অনু নিজের ভ্রম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বললো,
—- আপনার মা ভালো থাকতে দিলেতো?
অনুর কথার পাছে রেজা স্নেহের স্বর বুলিয়ে বললো,
——এভাবে কেন বলছো অনু? এখন একটু সহ্য করো বিয়ের পর মাকে সামলানোর দ্বায়িত্ব আমার।
অনু অবাকের চরম শিখরে পৌঁছে বলে,
—- কিসের বিয়ে, কার বিয়ে? কি বলছেন যা-তা?
রেজা ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বললো,
—- এবার আমাদের বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে “প্রিয়া আমার”। একটু আগে শুনে এলাম মা আর ফুপি বিয়ে নিয়ে আলাপ করছে। আরেকটু সবুর করো তোমাকে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে বউ করে নিয়ে যাবো আমি।
রেজার পকর পকর অনু এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে অরুর ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বজ্র কন্ঠে বললো,
—- রিডিকিউলাস।
রেজা লাজুক হেঁসে হালকা মাথা চুলকে বলে ওঠে,
—– হ্যা ওইটাই।
রেজার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখ ভঙ্গিমা পাল্টে গেলো অনুর, রাগি রাগি চেহারাটা মূহুর্তেই ধারণ করলো অসহায় রূপ। মুখশ্রী জুড়ে জমা হলো একরাশ ঘন কালো আত’ঙ্কের মেঘ, দেখে মনে হচ্ছে টলটলে চোখ দুটো থেকে এখনই নেমে আসবে অসহায় অপারগ বারিধারা। তপ্ত রাশভারি ব্যথাতুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড়ালো অনু,
—– শুনেছি বাড়ির বড় মেয়েরা সবসময় স্যাক্রিফাইস করে, আমি যদি নিজের ভালোবাসার বেলায় একটু খানি স্বার্থপর হই তাহলে কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? আমিও কি অরুর মতো খারাপ আর অবাধ্য মেয়ে হয়ে যাবো?
***********************************************
ক্রীতিক কুঞ্জের হলরুমে টাঙানো দেয়াল জোড়া বিশাল ঘড়িটায় ঢংঢং আওয়াজ করে সকাল আটটার জানান দিচ্ছে।
তবে এখনো পর্যন্ত বিছানা ছাড়েনি কেউ। নিচে ডাইনিং এর যায়গাটাও পুরোপুরি ফাঁকা, সেই সুযোগে সবার আড়ালে অরুকে একটু খানি মাংস ভাত মাখিয়ে খায়িয়ে দিচ্ছে অনু।
খাবারের লোকমা মুখে নিয়েই বসে বসে ফোপাঁচ্ছে অরু, কিছুতেই মুখ থেকে গলায় নামাচ্ছে না। সেই তখন থেকে একই ভাবে বসে আছে দেখে অনু এবার ধমকে উঠে বললো,
—- কি ব্যাপার খাচ্ছিস না কেন?
অরু হেঁচকি তুলে বলে,
—- খাবার গলা দিয়ে নামছে না আপা,আমি ওনার কাছে যাবো।বিশ্বাস কর ওনার থেকে এতোটা দূরে চলে এসেছি, সেটা ভাবলেও আমার কলিজা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে, গ’লা কাঁ’টা মুরগীর মতো ছটফট করে উঠছে হৃদয়টা।
আমাদের কি আর কখনো দেখা হবেনা আপা? উনিতো আমাকে না দেখে থাকতে পারেনা,প্রচুর রেগে যায়। আচ্ছা, অতিরিক্ত টেনশনে ওনার যদি আবারও প্যানিক এ্যা’টাক হয়, আবারও যদি নাক দিয়ে র’ক্ত পরে, তাহলে? উনিতো তখন পুরোপুরি সেন্সলেস হয়ে যায়, ওনার অনেক কষ্ট হয় আপা।
খাবার মুখে নিয়ে একত্রিশ বছরের ক্রীতিকের জন্য মাত্র উনিশে পা দেওয়া অরুর এমন দুশ্চিন্তা দেখে অনু হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর ছোট বোনের দিকে, ঠিক কতোটা ভালোবাসলে সামান্য ভৌগোলিক দূরত্বে মানুষ এতোটা ছটফট আর আহাজারি করে জানা নেই অনুর,তাই বলার আর কিছু ভেবে না পেয়ে অরুকে স্বান্তনা দিয়ে অনু বলে,
—- সব ঠিক হয়ে যাবে বোন আমার, ক্রীতিক ভাইয়া ঠিক কোনো একদিন চলে আসবে,এখন খেয়ে নে।
অনু কথাটা বলেছে কি বলেনি,তখনই ওর মুখের কথা ছো মে’রে নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে এসে জাহানারা বললেন,
—– খাওয়া খাওয়া, বেশি করে খাওয়া, শরীর ভে’ঙে চুড়ে যা হাল হয়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ বাড়ির ছোট সাহেব সর্বনাশের আর কিচ্ছুটি আর বাদ রাখেনি।
মামির আকারে ইঙ্গিতে করা নোং’রা তি’রস্কারে থমথমে হয়ে ওঠে অনুর মুখ। এসবের কারনেই তো অরুকে মামির সামনে খুব একটা পরতে দেয়না ও।
অনুর এসব রাগ ঢাকের দু’পয়সা তোয়াক্কা না করে জাহানারা এগিয়ে এসে,আঙুল উঁচিয়ে অরুর ঢিলে হয়ে যাওয়া জামাটা দেখিয়ে বললো,
—- দেখ দেখ জামাটা পর্যন্ত কাঁধ থেকে খুলে পরছে, কি ধকলটাই না গিয়েছে মেয়ের উপর দিয়ে, আগে তো এমন ছিলিস না। অথচ এবাড়ির ছেলের সাথে কদিন থেকেই এই হাল?
হ্যারে অরু হাঁটুর বয়সী মেয়ে হয়ে বয়সে ওমন বড় সৎ ভাইয়ের সাথে থাকতে তোর একটুও ভয় করলো না?
মামি এখন ইচ্ছে করে লাগাম ছাড়া কথা বলে ঝামেলা পাকাতে চাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝে আসতেই চেঁচিয়ে উঠলো অনু,
—-মামি চুপ করবে তুমি?
মামির বলা নোংরা কথার মাথায় এতোক্ষণে নিজের শরীরের দিকে চাইলো অরু, আসলেই ও আগের চেয়ে অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে, তবে এটা আজ বা কাল নয়, প্রায় মাস খানিক আগে ক্রীতিক যখন হুট করেই ওর সাথে দেখা করতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল তখনকার ঘটনা।
ঘুরিয়ে পেচিয়ে হলেও কথাটা সত্যি, ক্রীতিকের জন্যই শারীরিক এই অধপতন অরুর। তাই অরু নিজের জামাটা ঠিকঠাক করে খাবার চিবুতে চিবুতে মামির উদ্দেশ্যে বললো,
—- স্বামীর সাথে থাকতে ভ’য় কিসের মামি?বিয়ের পরে মামার সাথে থাকতে তোমার বুঝি খুব ভ’য় হতো? শুনেছি তোমার আর মামার বয়সের পার্থক্য প্রায় পনেরো বছর, সেখানে আমিতো আমার স্বামীর চেয়ে বারো বছরের ছোট মাত্র।
এইটুকুনি মেয়ের মুখে এতো বড় অপ’মান জনক কথা শুনে ঝাঁজিয়ে উঠলেন জাহানারা, আশেপাশের কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই খিটমিটিয়ে বললেন,
—– বিদেশে গিয়ে ন’ষ্টা হয়ে ফিরেছিস আবার বড়বড় কথা বলা হচ্ছে? মহল্লার মানুষকে বলে দিলে তখন বুঝবি অপ’মান কাকে বলে।
— মামি, কি সমস্যা তোমার? কেন গায়ে পরে শুধু শুধু ঝ’গড়া করছো, আর কাকে কি বলছো তুমি? যে গদিতে বসে পায়ে পা দোলাচ্ছো সেটা ওর স্বামীর টাকায় কেনা, তাই ভালোয় ভালোয় বলছি মুখ সামলাও। পরিনাম খারাপ হতে পারে।জায়ান ক্রীতিক কে চেনোনা তুমি।
অনুর কথা শেষ হতেই,জাহানারার তীরের ফলার মতো দৃষ্টি ভস্ম করলো অনুকে, তিনি সেভাবেই তাকিয়ে বললেন,
—- ক’দিন পর ছেলের বউ হবি বলে তোক কিছু বলছি না অনু, তাই বলে এইনা যে মুখেমুখে তর্ক করলে তোকে ছে’ড়ে দেবো আমি।
অনু আশ্চর্য হয়ে শুধালো,
—- কি বলছো, কার ছেলের বউ?
—- তোমার আর রেজার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।
মায়ের মুখ থেকে ভেসে আসা অকস্মাৎ কথাটা ধূমকেতুর হলকার মতো ছুটে এসে কর্ণকূহরে ঝঙ্কার তুললো অনুর, ও তৎক্ষনাৎ পাশ ঘুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে আহত সুরে ডাকলো,
—- মা!
আজমেরী সিঁড়ির রেলিং ধরে নামতে নামতে বললেন,
—- আশা করি তোমার কোনো আপত্তি নেই।
অনু কাতরে উঠে বললো,
—- এতো তাড়াহুড়ো কেন মা? মাত্র কদিনই তো হলো আমরা দেশে ফিরলাম, তুমি এখনো সুস্থ হওনি পুরোপুরি, তোমাকে এখনো মাসে মাসে চেকআপের জন্য ইউ এস এ যেতে হবে।আর এখনই কিনা….
—- ওই জন্যই তো তাড়াহুড়ো, তোমাদের জন্য করনীয় দ্বায়িত্বটুকু ভালোয় ভালোয় পালন করতে পারলে তবেই আমার শান্তি। তাছাড়া তোমার বিয়ে না হলে অরুকে বিয়ে দেওয়া যাবেনা,এই মূহুর্তে অরুর বিয়ে হওয়াটা জরুরি, কিন্তু বড় বোনের আগে ছোট বোনকে বিয়ে দিতে গেলেই মানুষ পেছনের কাহিনি খোঁচাতে শুরু করবে,এটাতো আর আমেরিকা নয়। তাই আপাতত অরুর নয়, তোমার বিয়েটাই মোক্ষম আমার কাছে, আশা করি এবার আর কোনো আপত্তি নেই?
মায়ের কথা শেষ হতেই চেঁচিয়ে উঠলো অনু, জড়ানো কন্ঠে বললো,
—- হ্যা,হ্যা অনেক আপত্তি আছে, আমি এই বিয়েটা কিছুতেই করতে পারবো না মা।
অনুর প্রতিক্রিয়া শুনে আজমেরী শেখ মুখে কিছুই বললেন না, চুপ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মেয়ের মুখের দিকে অতঃপর আহত সুরে বলে উঠলেন,
—– ইদানীং আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে অনু, যখন তখন আবারও পরে যেতে পারি, তবে মনে হয়না এইবার পরে গেলে আর কোনোদিন উঠতে পারবো। সুস্থ থাকতে কথা শোনো মায়ের, নয়তো পরে আপসোস করবে।
মায়ের কথায় অনু, অরু দু’বোনেরই মুখ থেকেই র’ক্ত সরে গেলো, ওরা কি মায়ের সাথে বেশি বেশি করে ফেললো? সেটাই ভাবছে আপাতত।
অনুর হাত পা কাঁপছে, মনে হয়না আর শেষ রক্ষা হবে।অরুতো তাও কয়েকটা দিনের জন্য হলেও ক্রীতিকের হতে পেরেছিল, ওদের ভালোবাসা পূর্নতা পেয়েছিল, কিন্তু অনুদের অপূর্ণ ভালোবাসার কি হবে?
এই “কি হবে”,ভাবতেই গিয়েই বুকের ভেতরে এলোপাথারি ঝড় উঠেছে অনুর,সেই ঝড়ে একে একে ভে’ঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে আশা, ভরসা,প্রতিশ্রুতি সব। প্রত্যয়ের সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত মানস্পটে খচিত প্রতিটা সুন্দর মূহুর্তে যেন হুট করেই দা’উদাউ করে অ’গ্নি শিখা জ্বা’লিয়ে দিয়েছে কেউ।
অনু আর এভাবে ভেজা চোখ নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না সবার সামনে, এঁটো হাত সহ’ই ছুটে চলে গেলো নিজের রুমে। অতঃপর দরজা লাগানোর কর্কষ আওয়াজ ভেসে এলো দোতলার কোনো একটা ঘর থেকে।
***********************************************
সন্ধ্যে হতেই ল্যানটার্ন আর স্ফটিকের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে হিরিকো খচিত বারের চারিপাশ। ভেতরে সফ্ট গানের তালে তালে শরীর দোলাচ্ছে তরুণ তরুণীর দল।হাতে থাকা হুইস্কি আর রেড ও’য়াইনের প্রভাবে কেউ মাতাল আবার কেউ বা অর্ধ মাতাল। তবুও মিউজিকের তালে তালে পায়ে পা মিলিয়ে কোমর দোলাতে মোটেও অপারগ নয় তারা।
বিশাল বারের এককোনে যে বার কাউন্টার রয়েছে, সেখানেই বারস্টুল পেতে ডোরাকে কোলে নিয়ে বসে বসে রেড ও’য়াইনে চুমুক দিচ্ছে ক্রীতিক, পরনে এখনো পুরোপুরি ফর্মাল ড্রেস। দেখে মনে হচ্ছে ভার্সিটি থেকেই এখানে এসেছে সে। ক্রীতিকের মোটেই ডিস্কোবার কিংবা হইহট্টগোল পছন্দ নয়। তাই নিজের মতো করে একটু খানি সময় কাটাতে হলে এখানেই চলে আসে ও।
ছোট্ট ডোরা নিজের নরম তুলতুলে গা টা পুরোপুরি ক্রীতিকের হাতে ছেড়ে দিয়ে আধো আধো চোখ খুলে ঝিমাচ্ছে, মনে হয় অ্যা’লকোহলের গন্ধে ওরও নেশা ধরে এসেছে। ক্রীতিক ডোরার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
—– তোর মালিকের মতো ঢং করা বন্ধ কর, নয়তো মাথায় তুলে একটা আ’ছাড় দেবো।
ডোরা বেচারী হয়তো জানেই না আসলে ওর দোষটা কোথায়,তাই সহসা চুপচাপ বসে রইলো ও।
ডোরাকে ধমক দিয়ে ক্রীতিক যখন আবারও ওয়াইনে মন দেয়, তখনই বারের মধ্যে একে একে আগমন ঘটে অর্ণব, এলিসা, আর সায়রের।
ওরা আজকাল ক্রীতিককে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকে, ওই জন্যই নিজেদের অবসর হলেই, হুটহাট লোকেশন ট্র্যাক করে চলে আসে ক্রীতিকের কাছে,ওকে একটু সময় দেওয়ার জন্য, ঠিক আগের মতো।
ওদেরকে দেখে ক্রীতিক ভালোমন্দ কিছুই বললো না,বরং ভাবলেশহীন হয়ে বসে রইলো আগের ন্যায়।
অর্ণব এগিয়ে এসে বারস্টুল টেনে বসতে বসতে অবাক হয়ে শুধালো,
—- দেখে তো মনে হচ্ছে ভার্সিটি থেকে ফিরেছিস, তাহলে বিড়ালের বাচ্চা কোলে নিয়ে বারে কি করিস তুই?
ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— জানিনা।
সায়র একটু ভালো করে নজর বুলিয়ে বললো,
—– আরে এটাতো অরুর বিড়াল।
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
—- তোকে জিজ্ঞেস করেছি? কতবার বলেছি ওর নাম মুখে নিবিনা তুই।
এলিসা ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো,
—– থামনা তোরা, জেকে তুই তো বিড়াল দেখলেই এ’লার্জি এ’লার্জি বলে নাক সিটকাস, এখন তাহলে বিড়াল নিয়ে বারে কি করিস তুই? আর কতক্ষণ ধরেই বা এখানে বসে আছিস? আদৌও ভার্সিটিতে গিয়েছিলি?
ক্রীতিক কোনোরূপ জবাব না দিয়ে নির্লিপ্ত মুখে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলের উপর রেখে পুনরায় চুমুক দিলো ওয়াইনের গ্লাসে।
কাগজে কি আছে দেখার জন্য অর্ণব তাড়াহুড়ো করে কাগজটা লুফে নিয়ে সেটাতে চোখ বুলিয়ে আশ্চর্য কন্ঠে বলে ওঠে,
—— তুই রিজাইন দিয়েছিস মানে? এটা তোর শখের জব ছিল।
ক্রীতিক সামান্য হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,
—– আই নো।
এলিসা রেগেমেগে বললো,
—- তাহলে হুট করে রিজাইন দিয়েছিস কেন? অরুর জন্য? সবকিছুর একটা লিমিট থাকতে হয় জেকে, এভাবে লিমিটক্রস করে কেউ লাইফ লিড করতে পারেনা, তুই আজকাল যা শুরু করেছিস, তাতে খুব শীঘ্রই ম’রে যাবি তুই।
সায়র নাক চোখ সিকোয় তুলে বললো,
—- গাইস ওর সাথে থাকতে থাকতে বিড়ালটাও অসভ্য আর উগ্র হয়ে যাচ্ছে, আমাদের উচিৎ বিড়ালটাকে হেফাজতে নিয়ে নেওয়া। নয়তো কোন দিন দেখবো বিড়ালটারও অতিরিক্ত ডি’প্রেশনে নোজ ব্লে’ডিং হচ্ছে ।
ওদের একেক জনার যুক্তি শুনে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে কর্কষ আওয়াজে বলে উঠলো ,
—– আহ,চুপ করবি তোরা, আমি ডিপ্রেশড হয়ে ঘরে বসে থাকার জন্য মোটেই জব ছাড়িনি, বিডি তে যাওয়ার জন্য ছেড়েছি।
এবার অর্ণব,এলিসা, সায়র একযোগে বললো,
—- কিহ, তুই অবশেষে বিডি তে ফিরছিস?
ক্রীতিক ওয়াইনের গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে বললো,
—- একেবারের জন্য যাচ্ছি না, বেশকিছু হিসেব নিকেশ বাকি পরে আছে,সেগুলো শুধে আসলে মিলাতে যাচ্ছি। তাছাড়া আরও একজনকে খুব কাছ থেকে শা’স্তি দেওয়াটাও বাকি পরে আছে। আমি আবার বাকির খাতা খুব বেশিদিন ফেলে রাখিনা।
তীর্যক ছু’ড়ির ফলার মতো কথাগুলো উগরে দিয়ে ডোরাকে নিয়ে উঠে যায় ক্রীতিক, যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
—- বাই দা ওয়ে, সি ইজ নট বিড়ালের বাচ্চা, হার নেইম ইজ” ডোরা”।
ক্রীতিক চলে গেলে সায়র, অর্ণব আর এলিসার কাঁধ হাত দিয়ে অস্ফুটেই বলে ওঠে,
—- দোস্ত এবারের ভ্যাকেসনটা বাংলাদেশে কাটালে কেমন হয়?
অর্ণব দাঁত কটমটিয়ে সায়রের একহাত ঝাড়া মে’রে এলিসার কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
—- কেমন হয় সেটা পরে বলছি, তার আগে তুই আমার বউয়ের কাঁধ থেকে হাত সরা গর্ধব।
সায়র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গালে হাতদিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
—- আজ একটা বউ নেই বলে বন্ধুরাও মীরজাফরের মতো আচরন করে, হাহ!!
চলবে……
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৩৮
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]
দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পাচ্ছি না, ভুলতে পারছি না,তবুও তুমি আছো, এ তোমার কেমন থাকা জায়ান ক্রীতিক??
ল্যাপটপের কিবোর্ডে এতটুকু টাইপ করে থামলো অরু, অতঃপর “জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী” খচিত যে ইমেইল একাউন্ট টা এখনো সেভ করা রয়েছে, সেটার সেন্ড অপশনে ক্লিক করে চোখ বোলালো মেইল একাউন্টের পাশে এটে থাকা ছোট্ট ডিপিতে।
ডিপিতে দেখা যাচ্ছে রোদচশমা আর ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট পরিহিত ক্রীতিক কে, যে বাইকে হেলান দিয়ে উরুর উপর হেলমেট নিয়ে নির্বিগ্নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর মুখ খানাও কি স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।
এই ছবিটা বেশ কিছু বছর আগের হবে হয়তো, অন্তত হেয়ার স্টাইল তো তাই বলছে। দেশে ফেরার পর আজ প্রায় সাত দিন যাবত এই একই কাজ ক্রমাগত করে যাচ্ছে অরু। ও জানেনা এই মেইল একাউন্ট আদৌও ক্রীতিক ব্যবহার করে কিনা।কিন্তু ওই যে আশায় বাঁচে চাষা। সেরকমই বুকের মাঝে জমে থাকা তীব্র দহন আর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আশাকে সামনে রেখে প্রতিদিন ক্রীতিকের একাউন্টে মেইল পাঠায় অরু।
কি জানি হুট করে ক্রীতিকের চোখে পরলেও তো পরতে পারে। কারণ একটাই ক্রীতিক নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে এ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো উপায় জানা নেই অরুর ।
মেইল পাঠানো শেষ হলেও সেই কখন থেকে এক ধ্যানে ক্রীতিকের ছবির দিকে তৃষ্ণার্থ চাতকের ন্যায় তাকিয়ে আছে অরু, মনেমনে ভাবছে,
—– কতদিন আপনাকে দেখিনা, আপনি কত দূরেএএ।আপনার ছবির দিকে তাকালে হৃদয় কেঁপে ওঠে আমার,বারবার মনে হয় হাজার মাইল দূরত্বে নিজের অতি মূল্যবান কি যেন ফেলে এসেছি আমি, যখন মস্তিষ্কটা গভীর ভাবে ভাবতে থাকে কি সেই জিনিস? তখনই মনে পরে যায়, আমার আত্মাটাকেই তো আপনার মাঝে ফেলে রেখে এসেছি আমি। এখন আপনি হীন আমার আমিটার অস্তিত্ব যে পৃথিবীর বুকে থেকেও নেই। ছয়মাস আগে যখন আমেরিকাতে প্রথম পা রেখেছিলাম তখনও কি জানতাম? কেউ একজন আমার জন্য বুকের ভেতর ভালোবাসার পাহাড় জমিয়ে দিন রাত নিদারুণ কষ্টে অতিবাহিত করছে। আর এখন সেই কষ্টটা শুধে আসলে ফেরত দিচ্ছেন আপনি আমাকে। আপনি সত্যিই পা’ষাণ, আর নি’র্দয়। আপনি আমাকে না দেখে বেশ ভালোই থাকতে পারেন। শুধু শুধু সামনে এলে আমাকে ব্যথা দেওয়ার জন্যই পা’গলামি আর রা’গ দেখানোর নাটক করেন।এখন সব বুঝতে পারছি আমি।
প্রথমে ভালোবাসা, তারপর অভিমান অতঃপর সবশেষে বুকভা’ঙা কাতর কা’ন্না, এভাবেই যাচ্ছে অরুণ দিন। অরু ভালো নেই, ভালো থাকার কথাও নয়।এক অষ্টাদশীকে নিজের প্রেমে পা’গল করে দিয়ে ক্রীতিকের আর খোঁজ নেই।
যে ক্রীতিক জিদের তোপে গত আট বছর ধরে বাংলাদেশে আসেনি সে কখনোই হুট করে শুধুমাত্র অরুর টানে বাংলাদেশ চলে আসবে না নিশ্চয়ই?অরু হলফ করে বলতে পারে, ক্রীতিক আসবে না, আর এখানেই হয়তো অরুর অপারগতা,অসহায়ত্ব আর দুঃখের দিনের সূচনা।
অরু তখনও টেবিলের উপর মাথা এলিয়ে রেখে ল্যাপটপে ক্রীতিকের ছবির দিকে তাকিয়ে অযাচিত চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল। চোখের কার্নিশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল অশ্রুসিক্ত নোনাজল। ঠিক সে সময় হুট করেই রুমে প্রবেশ করে অনু। রুমের মাঝে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে তরিঘরি করে ল্যাপটপ বন্ধ করে চোখ মুছে পেছনে চাইলো অরু। দেখলো দরজার কাছে অনু দাড়িয়ে।
আজকাল অনুর মুখের দিকে তাকানো যায়না আর, সবসময় এইটুকুনি হয়ে থাকে শুকিয়ে । অনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে গলা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো অরু,
—- কিছু বলবি আপা?
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, ছাদে গিয়ে দেখ অপেক্ষা করছে বোধ হয়।
প্রেমিক পুরুষের হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে নেতিয়ে যাওয়া মনটা হুট করেই লাফিয়ে উঠলো অরুর, হৃদ গহীনের কোথাও যেন প্রদীপ শিখার ন্যায় দপ করেই জ্বলে উঠলো একফালি আশার আলো। অনুর সাথে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করায় সায় দিলোনা অরুর মন, ও তৎক্ষনাৎ গায়ে কোনোরকম ওড়নাটা জড়িয়ে ছুট লাগালো মহলের ছাদের দিকে।
ক্রীতিক কুঞ্জের তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল মহলের লম্বা করিডোর পেরিয়ে চিলেকোঠার কাছে আসতেই হাঁপিয়ে উঠলো অরু।
দিনের দ্বিপ্রহর চলমান। তবুও চারিদিকে চৈত্র মাসের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে চোখ জ্বলে যাচ্ছে। এই সময়ে ছাদের দিকে তাকালেও কেমন গলা শুকিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পু’ড়ে ফো’সকা পরে চামড়া উঠে আসবে।বুড়িগঙ্গা ছাপিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে যা ও একটু শীতল হাওয়া দিচ্ছে তাও রোদ পেরিয়ে এদিকে আসতে আসতেই হিটারের উত্তাপে পরিনত হচ্ছে।
অনেক গুলো দিন আমেরিকার বরফশীতল ঠান্ডা আবহাওয়ায় থেকে এসে এই রোদকে অরুর চোখে ঝ’লসানো অ’গ্নিদাহের মতোই ভ’য়ানক লাগছে। তাই কিছুক্ষণ চিলেকোঠার ঘরের সামনে দাড়িয়ে থেকে সেখান থেকেই গলা ছেড়ে ডাকলো অরু,
—– শুনছেন এদিকে আমি।
ওর প্রিয় আগন্তুক কোন দিকে দিয়ে আসবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না, তাই সহসা এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অরু। কিছু সময় যেতেই ওর চোখের সামনে দৃশ্যগত হলো সেই আগন্তুক। কিন্তু এতো জায়ান ক্রীতিক নয়, জায়ান ক্রীতিকের ধারে কাছের কেউ ও নয়। অকস্মাৎ ঝটকা টাকে সামাল দিতে না পেরে হতবিহ্বল হয়ে সামনের মানুষটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে অরু।
—– কেমন আছিস অরু?
চঞ্চলা হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে প্রশ্ন ছুড়লো নীলিমা।
অনেকদিন বাদে দেখা, তাও অবাক না হয়েই মেকি হেসে অরু বলে,
—- হ্যা ভালো আছি।
চিরাচরিত মিথ্যে কথা, যা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে, তাও বলতে হয় তাই বলা।
—-কিন্তু তুই হঠাৎ ক্রীতিক কুঞ্জে?
অরুর করা দ্বিতীয় প্রশ্নে নীলিমা সহসা হেসে উত্তর দিলো,
—- তোর সাথেই দেখা করতে এলাম, অনু আপা ডেকে পাঠিয়েছে তোর নাকি মন মেজাজ ভালো নেই।
অরু মৃদু হেসে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো,
—- তেমন কিছুনা আমি ঠিক আছি।
অরুর কথার পাছে নীলিমা কিছুই বললো না, শুধু নির্লিপ্ত চাহনীতে আগাগোড়া পরখ করলো ওর, মনেমনে ভাবলো,
—– এক নিখিল ভাইয়ের জন্য কি হাল হয়েছে মেয়েটার। নাদুস নুদুস মাখনের মতো শরীরটা শুকিয়ে চোদ্দ বছরের না বালিকাদের মতো লাগছে। গলার হাড় হাড্ডি সব বোঝা যাচ্ছে। তাও বলছে ও নাকি ঠিক আছে। নিখিল ভাই যে কেন অরুর একতরফা ভালোবাসা বুঝলো না, কে জানে?
নীলিমা সেই তখন থেকে চুপ হয়ে আছে দেখে অরু বললো,
—- দাঁড়িয়ে থাকবি চল নিচে যাই, এ বাড়িতে প্রথম এলি, তোকে ক্রীতিক কুঞ্জ ঘুরিয়ে দেখাই।
নীলিমা না সূচক মাথা নাড়িয়ে, অরুর হাতে হাত রেখে বললো,
—- তোকে আমার সামনে খুশি থাকার ভান করতে হবে না অরু, আমি জানি তুই পু’ড়ছিস।তবে আমি জিজ্ঞেস করবো না কেন এই দহন, সেটা না হয় তোর ভেতরেই থাকুক। আমি শুধু বলতে এসেছি, এভাবে মনমরা হয়ে ঘরে বসে আর কতদিন থাকবি বল? যে যাওয়ার সে তো গিয়েছে, তাই বলে তো আর জীবন থেমে থাকবে না,তাই না? আমি বলি কি তুই আবার পড়াশোনায় মন দে।
অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—– এই মূহুর্তে একাডেমিক পড়াশোনায় মন বসানোর মতো মন কিংবা মস্তিষ্কের অবস্থা নেই আমার নীলিমা। আমার একটু সময় লাগবে। তাছাড়া ইউ এস এ তে আমি ইকোনমিকস এ পড়তাম। এখন আবার হুট করে এখানে কি নিয়ে শুরু করবো তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
অরুর কথাগুলো শুনে নীলিমা মাথা নাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, পরক্ষণেই চট করে বলে উঠলো,
—– অরু, তোর তো সাহিত্যে বেশ আগ্রহ, তুই নোবেল পড়তে ভালোবাসিস।তুই একটা কাজ করতে পারিস, তুই বাংলা একাডেমির সাহিত্যকলায় ভর্তি হয়ে যা না। ওখানে প্রতিদিন সাহিত্যের আসর বসে, বিভিন্ন বয়সের কবি,সাহিত্যিক, গল্পকার রা ওখানে এসে নিজের লেখা কবিতা, গদ্য,উপন্যাস এসব পাঠ করে অন্যদের উৎসাহিত করেন।
ভেতরে পাবলিক লাইব্রেরীও আছে,একেবারে মনোরম শান্তি শান্তি পরিবেশ। যারা একটু নিরিবিলিতে সাহিত্য চর্চা কিংবা উপন্যাস লেখায় মনদিতে চায়,তারাই সকল ডিপ্রেশন ভুলে একাডেমিতে গিয়ে বইয়ের মাঝে কিংবা সাহিত্য আড্ডায় ডুব দেয় ।
তাছাড়া পাশের চারুকলা একাডেমিতে আমি প্রতিদিন আঁকাআঁকি আর স্কাল্পচারের কাজ শিখতে যাই, তুই যদি সাহিত্যকলায় ভর্তি হোস তাহলে দুজন মিলে প্রতিদিন একসাথে যাওয়া যাবে।
নীলিমার কথাটা একেবারেই ফেলনা নয়, বরং অরুর ভা’ঙাচোরা মনটা ভালোই আগ্রহ পেলো ওর প্রস্তাবে। সেইসাথে অরুর মস্তিষ্কে খেলে গেলো আরও একটা কৌশলী পরিকল্পনা, মনেমনে ভাবলো,
—– এটাই সুযোগ মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পড়াশোনার নাম করে বিয়ে দেখা থেকে আটকানো যাবে। তাছাড়া সাহিত্যে মায়ের বেশ আগ্রহ আমি একাডেমিতে ভর্তি হতে চাই শুনলে না করবে না নিশ্চয়ই?
অরু কিছু একটা ভাবছে থেকে নীলিমা ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,
—- একটু সময় নে, তারপর না হয় সিন্ধান্ত নিস। আর হ্যা ওসব পেছনের কথা ভুলে যা, দেখবি তোর জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোর চোখের দিকে তাকালেও ভালোবাসার গভীরতা মাপতে পারবে, হাত বাড়িয়ে নয় বরং হৃদয় বাড়িয়ে স্পর্শ করবে তোর সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে।
নীলিমার কথায় অরু আশ্চর্য হয়ে বললো,
—– কি বলছিস এসব নীলিমা? আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছু উনিই।সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়িয়েছে,এখন আর ওনাকে ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষকে আমি আমার জীবনে কল্পনাও করতে পারিনা। উনি ছাড়া অন্যকেউ ভালোবেসে স্পর্শ করার আগে ম’রণ হোক আমার।
নীলিমা বুঝতে পারে মেয়েটা নিখিল ভাইয়ের প্রতি খুবই সিরিয়াস।তাই এসব ভুলে যাওয়া টাওয়ার কথা বাড়িয়ে আর মন খারাপ করলো না অরুর, সহসা কথা ঘুরিয়ে শুধালো,
—- রাখ এসব মন খারাপের কথা, আমেরিকাতে কি কি করলি তাই বল?
গোধূলী বেলায় বিকেলের অসহিষ্ণু তীব্র রোদ, এখন অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে, অদূরে কান ফাটানো হুইসেল বাজিয়ে একে একে সদরঘাট ছাড়ছে লঞ্চ গুলো। বুড়িগঙ্গা পারের নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ার বেগ বেড়েছে, সেই সাথে বড় আমগাছটার ছায়ায় ঢাকা পরেছে শেষ বিকেলের ম’রা রোদ। অরু এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা কাঁচা আম ছিড়ে, ছাঁদের পাঁচিলে পা দুলিয়ে বসতে বসতে বললো,
—– আয় বলছি।
***********************************************
নিকোশ আধারে ছেয়ে গেছে সন্ধ্যার আকাশ। সূর্যের শেষ লালিমা টুকুও অবশিষ্ট নেই আর। চারদিকে ভ্যাপসা গরম, শেষ রাতে কালবৈশাখী ঝড় হলেও হতে পারে,পশ্চিম আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর গতিবেগ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। অরু মাত্রই নীলিমাকে গেইট থেকে রিকশায় তুলে দিয়ে ফিরে এলো।
ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ট, তারউপর হাঁটু সমান লম্বা চুল। অনেকটা শুকিয়ে যাওয়াতে এতো লম্বা চুলের ভার বইতেও আজকাল কষ্ট হয়ে যায় অরুর। ও কোনো রকম চুলগুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাধতে বাঁধতে অন্দরমহলের দিকেই যাচ্ছিল। তখনই ওপাশের বাগান বিলাশের ঝোপের আড়াল থেকে ওর কানে ভেসে আসে ক্রন্দনরত অনুর অস্পষ্ট কিছু কথা। অনুর কথাগুলো ভালো মতো ঠাওর করার জন্য এগিয়ে গিয়ে বাগানবিলাশের অন্যপাশে দাঁড়াতেই অরু শুনতে পেলো কা’ন্নারত অনুর শেষ কথা,
—– আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে প্রত্যয় সাহেব। আমি আপনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি, আমার জন্য দ্বিতীয়বার আপনাকে কষ্ট পেতে হলো, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মোটেই ভালো মেয়ে নই,খুব খারাপ, সব ছেলের সাথেই এমন ভালোবাসার নাটক করি, আমি আপনার এক্স তিন্নির থেকেও খারাপ। আমাকে বিয়ে করে আপনি একটুও ভালো থাকতেন না, তাই যা হয় ভালোর জন্যই হয়। ভবিতব্য মেনে নিন।আর আমাকে ভুলে যান।
ওপাশ থেকে প্রত্যয় কি বললো না বললো কিছুই শোনা গেলো না, উল্টো অনু তাড়া দিয়ে বললো,
—- আমার স্বামী ডাকছে প্রত্যয় সাহেব, আমাকে যেতে হবে। কাল বাসর রাত ছিলো কিনা, ডাকবেই তো। এখন রাখছি, আর কখনো কথা হবেনা আমাদের।দোয়া করি, আপনি আমেরিকাতে সত্যিকারের সোলমেট কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবেন।তখন আমাকে কিংবা আমার দেওয়া পাথরের মতো আ’ঘাত গুলোকে মনে পরবে না আর।আপনি খুব সুখি হবেন।
এরপর কল কাটার পিক পিক আওয়াজ হলো, বোধ প্রত্যয়ই লাইনটা কেঁটে দিলো।
—-আর আমি এও জানি আপনার মতো পিওর হার্ট কে কষ্ট দিয়ে আমি কোনোদিনও সুখের মুখ দেখতে পাবো না, আর না আপনাকে কখনো ভুলতে পারবো।
অস্ফুটে কথাটা বলেই শুকনো মর্মরে পাতার উপর ধপ করে বসে পরে বোবা কা’ন্নায় ভেঙে পরলো অনু।
অনুর এহেন হাল না হলে অরু হয়তো ছুটে গিয়ে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলতে চাইতো,প্রত্যয়ের মাধ্যমে ক্রীতিকের খোজ নিতো। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। আপাতত সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে রাগে ফুঁসছে অরু। বোনের উপর রাগটা যেন পাহাড় সমান উঠে এসেছে, আ’গ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভার মতোই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কটা।
অরু নিজের রাগ দমাতে না পেরে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অনুর সামনে দাড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,
—–এভাবে শুধু শুধু মিথ্যে বলে একজনকে কষ্টের সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার কি মানে ছিল আপা?
অনু দু’হাতে মুখ চেপে কা’ন্নার আওয়াজ সংবরণ করছে ঠিকই কিন্তু ওদিকে হৃদয়টা ছি’ন্নভি’ন্ন হয়ে যাচ্ছে অপারগ কা’ন্নার তালে।
বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে মন টললো না অরুর, ও দিগুন আওয়াজে বললো,
—- কি হলো বল আপা? কেন করলি এটা? যে মানুষটা হাজার মাইল দূরে থেকেও নাম্বার সংগ্রহ করে তোকে কল দিয়ে তোর খোঁজ নিতে ভুললো না, তাকে তুই এভাবে ফিরিয়ে দিলি?
অথচ আমাকে দেখ চাতক পাখির মতো ছটফট করছি জায়ান ক্রীতিকের একটুখানি খবর পাবো বলে, কিন্তু জায়ান ক্রীতিক তো প্রত্যয় ভাইয়ার মতো এতোটা সদয় নয়। তাহলে কেন করলি এটা?
অরুর কথার পাছে অনু এবার হেঁচকি তুলে বললো,
—- যা করেছি চিন্তা ভাবনা করে, বুঝে শুনে করেছি,তোর টেনশনে এমনিতেই মায়ের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। বাড়িতে প্রতিনিয়ত একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। এখন যদি আমিও এসব বলে মা’কে নিরাশ করি তাহলে মা’কে আর বাঁচাতে পারবো না অরু। পরিবারের বড় সন্তানের জন্মই হয় স্যাক্রিফাইস করার জন্য, আমিও নাহয় মায়ের কথা ভেবে নিজের ভালোবাসাকে স্যাক্রিফাইস করলাম। এ আর এমন কি?
কথা শেষ করে পুনরায় কা’ন্নায় ভে’ঙে পরলো অনু।
অনুর কথার যুক্তি আছে,কিন্তু অনুর ভালোবাসা না মানার মতো তো কোনো কারন নেই? অনু তো আর নিজের সৎ ভাইয়ের প্রেমে পরেনি। আর না ক্রীতিকের মতো প্রত্যয়ের সাথে মায়ের কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা আছে, তাহলে মাকে একবার খুলে বলতে সমস্যা কি?
অনুর কান্নাকা’টি দেখে অরু তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলো ও গিয়ে মাকে সত্যিটা বলবে, নরম সুরেই বলবে বোঝানোর চেষ্টা করবে তারপর যা হওয়ার হোক। নিজের সিদ্ধান্তকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে অনুকে রেখেই দ্রুত যায়গা ত্যাগ করলো অরু। দ্রুত পদধ্বনিতে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনেমনে ভাবলো,
—— আমি না হয় জায়ান ক্রীতিকের প্রেমে পরে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি,কিন্তু আপা তো আর তেমন কিছু করেনি, তাহলে আপা কেন নিজের ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাবেনা?
***********************************************
ভর সন্ধ্যা বেলা এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আজমেরী শেখ।
বাংলাদেশে ফিরে আজকেই প্রথম অফিসে গিয়েছিলেন তিনি, অফিস থেকে ফিরে সব ফাইল পত্র গুছিয়ে কেবলই শুতে যাবেন তখনই হুরমুরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো অরু।
অরুর সাথে আজকাল খুব একটা কথা বলেন না আজমেরী শেখ, অরুর চোখের দিকে চাইলেই ক্রীতিকের জন্য এক অদম্য ব্যথাতুর ভালোবাসার জোয়ার দেখতে পান তিনি। যা আজমেরী শেখের মোটেই পছন্দ নয়।নিজের সৎ ছেলের সঙ্গে কিভাবে তার মেয়ে ছি ছি। ভাবলেও বিরক্ত লাগে তার, অগত্যাই সেসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে, হেড বোর্ডে গা এলিয়ে দিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ দুটো নিবদ্ধ রেখে মেয়েকে শুধালেন,
—- কি প্রয়োজন?
অরু প্রথমে কিছুক্ষন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই পুনরায় আওয়াজ ভেসে এলো ওদিক থেকে,
—-কিছু বলার না থাকলে যেতে পারো, আমি একটু রেস্ট করবো।
মনের মাঝের সকল শঙ্কাকে হটিয়ে অরু এবার চট করে বলেই ফেললো,
—– মা আপা একজন ভালোবাসে, তুমি রেজা ভাইয়ের সাথে আপার বিয়েটা দিওনা,আপা মুখ ফুটে কিছু বলবে না তোমাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক’ষ্টের বোঝা বইতে বইতে আপা হয়তো ম’রেই যাবে।
অরুর কথায় তৎক্ষনাৎ হাতের বইটা ডিভানে ছু’ড়ে মে’রে গভীর গলায় প্রশ্ন করলেন আজমেরী শেখ,
—- সে আবার কার সাথে ন’ষ্টামো করে বেরিয়েছে?
নোংরা কথাটা যে আকারে ইঙ্গিতে অরুকে বলা হয়েছে, সেটা অরু ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে,তবুও মায়ের কথা গায়ে না মেখে নরম গলায় বললো,
—– পপপ্রত্যয় ভাইয়া।
—- সি এফ ও অফ জেকে গ্রুপ?
মায়ের কথায় অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই কোথা থেকে যেন শ’ক্ত চ’পেটাঘা’ত এসে আঁচড়ে পরলো অরুর গালে। শরীরটা বেশ দূর্বল, তারউপর এতো শক্ত চ’ড় খেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো অরু।তীব্র ব্যথায় চ’ড় খাওয়া গালে হাতদিয়ে চোখদুটো খানিকক্ষণ খিঁচে রাখলো ও। অরুর দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অনু বললো,
—- তোকে আমি এসব বলতে বলেছি? সত্যি করে বল অরু? আমিকি একবারও বলেছি মাকে গিয়ে এসব বল, তাহলে কেন বললি?
অরু ফুপিয়ে উঠে বললো,
—— আমিতো মিথ্যে কিছু বলিনি আপা, তাছাড়া যা বলেছি তোর ভালোর জন্যই…
অরু কথা শেষ করার আগেই অনু তেতে উঠে বললো,
—–কে বলেছিল তোকে আমার ভালো করতে? আমি বলেছি?আমার ভালো করতে গিয়ে এখন যদি মায়ের কিছু হয়ে যায় তখন কি করবি তুই? এমনিতেই সারা ঘরে একাই অশান্তি বাধিয়ে রেখেছিস, আর কত অশান্তি হলে থামবি তুই? বল আমায়?
অনুর প্রতিটি ঝাঁঝালো কথায় ডুকরে কেঁদে ওঠে অরু। ওর শরীরটাও যে আর নিতে পারছে এই অশান্তি। অথচ যার কারণে এই ন’রক জীবন যাপন, তারই তো হদিস নেই। সে আদৌও বাংলাদেশে ফিরবে কিনা তাও জানা নেই অরুর। অথচ সব অপবাদ, সব তিরস্কার এসে জুটলো অরুর কপালে। বিয়ের পরে তো এইসব অশান্তিরই ভ’য় পেয়েছিল অরু।
নিজের আকাশচুম্বি রা’গকে দমাতে না পেরে অনু আরও কিছু বলবে, তার আগেই আজমেরী শেখ বলে ওঠেন,
—– তোমরা দুজনই এক্ষুনি বাইরে যাও, শরীরটা ভালো লাগছে না আমার। একটু একা থাকতে চাই।
অনু এগিয়ে এসে বললো,
—- মা কোথায় খারাপ লাগছে তোমার? বলো আমায়, মাথা টিপে দেবো একটু।
—– চুপচাপ বাইরে যাও।
আজমেরী শেখের রাশভারি আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল অনুর, ও তৎক্ষনাৎ অরুর হাত ধরে গম্ভীর গলায় বললো,
—– চল।
***********************************************
চোখের পলকে খসখস করে উল্টে গিয়েছে ক্যালন্ডারের পাতা। বাংলা ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাকে বিদায় জানিয়ে বৈশাখ এসেছে ধরনীতে।
অরুরা বাংলাদেশ ফিরেছে প্রায় একমাস হতে চললো। বৈশাখে পা দিতে না দিতেই প্রায় প্রতিটি বিকেলেই আকাশ কালো করে তীব্র ঝড়ে ফেটে পরে প্রকৃতি। আজকেও তেমন এক বিকেল, মেঘ তো নয় যেন আকাশ জুড়ে বুনো মহিষের পাল। সেথা থেকে গুড়গুড়িয়ে ভেসে আসছে কাল বৈশাখী সংকেত। চারিদিকে ঘূর্নি হাওয়া বইছে।
একাডেমী গেইট দিয়ে বেরিয়ে অরু দ্রুত পা চালাচ্ছে বাড়ির দিকে। আজ পুরো রাস্তায় একটাও রিকশার দেখা নেই।যার ফলসরূপ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে অরুকে। তবে মেইন রাস্তা ছেড়ে গলির মোড়ে ঢুকতেই দেখা মিললো চেনা পরিচিত একটা সাদা গাড়ির। অরু ফুটপাত ধরে এগিয়ে আসতেই সহসা গাড়ির কাঁচ নামিয়ে কিছুটা ঘাড় বাকিয়ে উঁকি দিলো ধূসররঙের সিকোয়েন্স পাঞ্জাবি পরিচিত এক সুদর্শন। চোখে তার রোদ চশমা। অরু কাছাকাছি আসতেই লোকটা আগ বাড়িয়ে বললো,
—- আরে অরোরা যে,
অরু সম্মোহনী হেসে জবাব দিলো,
—- জ্বি অমিত ভাই।
অমিত আরিয়ান, বাংলা একাডেমিতে যার যাতায়াত অহরহ। থাকবে নাইবা কেন, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা নামকরা উপন্যাস আর ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে তার। বছরের বেস্ট সেলের তালিকায় তার বইয়ের নামই সর্বাগ্রে। সাহিত্য কলার সদস্যদের কাছে অমিত আরিয়ান অনেকটা সেলিব্রিটিদের মতোই, যে একাডেমিতে আসলে হইচই লেগে যায় পুরো একাডেমি জুড়ে, কেউ নিজের পছন্দের বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ নেয়, তো কেউ পাশে দাড়িয়ে সেলফি।
মূলত গত বছর অমিতের যে রোমান্টিক জনরার উপন্যাসটি বের হয়েছে সেটার পর থেকেই অমিতের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অরুও সভাব সুলভ সেই উপন্যাসটা পরেছিল। পড়ার পরেই বুঝেছিল অমিত আদতে কতটা জ্ঞানের অধিকারী।একাডেমিতে নবীনদের বেশ ভালো উৎসাহ দেয় অমিত,সেইসাথে ছোটখাটো টিপস।
সেখান থেকেই মূলত অরুর সাথে মুখ চেনা চিনির পরিচয়। দেখা হলে নিজের ছোট বোনের মতোই লিখালিখি তে দু এক লাইন উৎসাহ দিয়ে যান অরুকে।অরুও বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধার নজরে দেখে অমিতকে, মাঝে মধ্যে নিজে থেকে দুএকটা প্রশ্নও করে বটে। যদি তার বিশাল জ্ঞান ভান্ডার থেকে এক আধটু আহরণ করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। তাছাড়া অমিতকে শ্রদ্ধা না করার তো কোনো কারণ নেই, আজ অবধি কখনো কোনো মেয়ে ঘটিত কিংবা অন্য কোনো খারাপ স্ক্যান্ডালে নাম জড়ায়নি অমিতের। অরু অন্তত শোনেনি কখনো।
—-এই গলিতে কি করো হুম?
অমিতের প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো অরুর, মৃদু হেসে জবাব দিলো,
—- এই গলিতেই থাকি আমি।
—- ও এম জি, কোথায় থাকো?
অরু ইতস্তত কন্ঠে বললো,
—- জ্বি, ক্রীতিক কুঞ্জে।
আজকাল বাড়ির নামটা মুখে নিতেও কেমন যেন দম আটকে আসে অরুর। বাড়ির নামেও যে তার স্মৃতি জড়িয়ে।
অমিত আশ্চর্য হয়ে গেলো অরুর কথায়, চোখ দুটো বড়বড় করে বললো,
—– তুমি চৌধুরী বাড়ির মেয়ে?
জামশেদ জায়ান কি হয় তোমার?
এতো ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না অরুর, তাই গতানুগতিক কথা এড়িয়ে অরু বললো,
—- আকাশ কালো করেছে, মনে হয় ঝড় আসবে আমি আসি অমিত ভাই।
—– আরে কোথায় যাচ্ছো, গাড়িতে এসো আমি এগিয়ে দিচ্ছি ঝড়ে পরবে তো।
অরু দ্রুত পা চালাতে চালাতে বললো,
—– দরকার নেই চলে যেতে পারবো।
অরু চলে গিয়েছে অনেকক্ষন, অমিত এখনো সেদিকে তাকিয়ে, থাকতে থাকতে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
—– এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা সবসময় মুখ কালো করে থাকে কিসের এতো দুঃখ ওর?
অরু ঘরে ঢুকে ব্যাগটা ছোফার উপর ছু’ড়ে ফেলে ডাইনিং এ গিয়ে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি পান করলো।
পানিটা শেষ হতেই কানে ভেসে এলো মামির গা জ্বালানো কথা,
—- বিদেশ থেকে এক কাহিনী করে এসেছে, এখন আবার সন্ধ্যে পর্যন্ত বাইরে বাইরে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে বেড়ায়।
আমিও দেখবো আজমেরী কিভাবে বিয়ে দেয় এই ধিঙ্গি মেয়ে গুলোর। একজনকে তো এ বাড়ির ছেলেই ফূর্তি করে ছেড়ে দিলো,কই আর তো এলোনা, জানি জানি আর আসবেও না। যা নেওয়ার ছিল সে তা নিয়ে নিয়েছে। এখন আর কি করবে এই হাড় হাড্ডি ওয়ালা মেয়েকে দিয়ে?
অরু জানে মামি চটে আছে,চটে থাকারই কথা সেদিন অনুর ব্যাপারে সত্যি কথা গুলো বলে দেওয়ার পর আজমেরী শেখ আর বিয়েটা নিয়ে কথা বাড়ায়নি। সেই তেজে মামিও আর ক্রীতিক কুঞ্জ ছাড়েনি। সেও দেখতে চায় ঠিক কতদিন আর মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে থাকতে পারে আজমেরী। তার সোনার টুকরো ছেলেকে অনুর সাথে বিয়ে দিয়ে তবেই এ বাড়ি থেকে যাবে সে।
অন্যান্য দিন চুপচাপ থাকলেও আজ একটু বেশিই বেড়েছে মামি,তার কারন আজ বাড়িতে অনু আর মা নেই। ব্যবসায়ী কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে আজমেরী শেখ। শরীরটা ভালো না থাকার কারনে সাথে করে অনুকেও নিয়ে গিয়েছে। সেই সুযোগে অরুকে আজ ইচ্ছে মতো কথা শোনাচ্ছেন জাহানারা।
জাহানারা যখন এ বাড়ির ছোট সাহেব কে জড়িয়ে অরুকে হাজারটা নোংরা কটাক্ষ করায় ব্যস্ত, তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাইরে থেকে ছুটে আসে রুপা, কোনমনে হাঁপাতে হাঁপাতে গলা ছেড়ে ডেকে বলে,
—- মা, লম্বা মতো একটা ভাইয়া, রেজা ভাইয়াকে ইচ্ছে মতো পে’টাচ্ছে।
অরুর দুই পয়সার ইন্টারেস্ট নেই ওদের মা’রামা’রিতে, রেজা গোল্লায় যাক তাতে ওর কি? সেই হিসেব মতে ব্যাগটা নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা দিলো অরু।
জাহানারা হকচকিয়ে উঠে বললো,
—- কে মা’রে আমার ছেলেকে, এতো বড় সাহস কার?
রুপা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
—- জানিনা, কখনো দেখিও নি এই মহল্লায়। দেখতে বিদেশিদের মতো কিন্তু বিদেশি না, ভাইয়াকে বাংলায় গা’লি দিচ্ছিলো।
রুপার শেষ কয়েকটা কথা ছক্কা লাগার মতোই অরুর মস্তিষ্কে গিয়ে লাগলো, অজানা শিহরণে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল ওর পুরো শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। টলমলে চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছে এখনই চেতনা হারাবে ও। কিন্তু হারালো না। হাতদুটো শক্ত করে নিজেকে স্থির রেখে কাঁপা কন্ঠে বললো,
—– রুপা,যে এসেছে তার চুল গুলো কি ঘাড় অবধি লম্বা? আর চোখ গুলো কি ভাসা ভাসা?
রুপা ঠোঁট উল্টে হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই কাঁধ থেকে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে বাইরের দিকে ছুট লাগালো অরু।
ওর পরনে সুতির স্কার্ট আর টপস, লম্বা চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনমতে আটকানো। দুই পায়ে ক্রীতিকের পরিয়ে দেওয়া দুটো সোনার নুপুর। সেভাবেই ছুটছে অরু।
তবে অন্দরমহল থেকে বেরোনোর আগেই খপ করে ওর হাত টেনে ধরলো জাহানারা, চোখ রাঙিয়ে শুধালো,
—- কে এসেছে সত্যি করে বল?
অরু জবাব দিলো না, এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে ছুটে চলে গেলো সদর দরজার বাইরে, তবে ক্রীতিকের দিকে আর এক পা ও এগোতে না দিয়ে ওকে আবারও শক্ত করে চেপে ধরলো জাহানারা। হুট করে এভাবে টেনে ধরায় সদর দরজায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো অরু। ঠিক তখনই একজোড়া মোহাবিষ্ট ভাসা ভাসা চোখ স্থির হলো অরুর চোখে।
চোখের সামনে অরুকে দেখা মাত্রই হাতের হ’কিস্টিকটা দূরে ছু’ড়ে মা’রলো ক্রীতিক।
তারপর দাড়িয়ে রইলো রেজার পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়।
ক্রীতিককে এভাবে দাড়িয়ে পরতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো অরু, এক্ষুনি তো রেজার চ্যালাপ্যালারা ক্রীতিকের উপর নিজেদের রা’গ ঝা’ড়তে উদ্যত হবে, তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে পরার কি মানে?
অরু সেদিকে তাকিয়ে দু’হাতে ভর করে উঠতে যাবে তখনই ক্রীতিককে একেরপর এক তীব্র ক’ষাঘা’ত করতে লাগলো রেজার লোকেরা।
সঙ্গে সঙ্গে আবারও মুখ থুবড়ে পরলো অরু, চোখের সামনে নিজের স্বামীকে এভাবে মা’র খেতে দেখে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে ছি’ড়ে যাচ্ছে ওর।অথচ ক্রীতিক এক ধ্যানে অরুর দিকে তাকিয়ে মা’র খেয়ে যাচ্ছে।
মা’র খেতে খেতে এক পর্যায়ে ঠোঁট কে’টে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে এলো ক্রীতিকের। ও হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটের র’ক্তটুকু মুছতে মুছতে ক্রুর হাসি হাসলো অরুর পানে চেয়ে।
ক্রীতিক কুঞ্জে দাড়িয়ে, ক্রীতিক কুঞ্জের মালিকই কিনা মা’র খাচ্ছে, তাও বাইরের লোকের হাতে। শুধু মাত্র অরুকে কাঁদানোর জন্য।
এবং সেই উদ্দেশ্য সফল ও হয়েছে, অরু বেশ ক’ষ্ট পাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে পৈচাশিক হাসিতে প্রসারিত হলো ক্রীতিকের দু’ঠোঁট। তবে এই অসহনীয় দৃশ্য আর সহ্য করতে পারলো না অরু,গলা ছে’ড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- ওনাকে মা’রছো কেন?ছাড়ো, উনি এই বাড়ির ছোট সাহেব।
অরুর শেষ কথাতে চমকে উঠে ভ’য়ে তটস্থ হয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো সকলে।তবে শেষ রক্ষা হলো না আর।
ক্রীতিক কিছু না বললেও, এলিসা, অর্ণব আর সায়র গাড়ি থেকে নেমে এই দৃশ্য দেখেই দৌড়ে এসে একেক টাকে ইচ্ছে মতো রা’ম ধো’লাই দিয়ে মুখ বেঁকিয়ে দিলো।
আর ক্রীতিক ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অরুর দিকে। অরুও কোনো মতে হাতের তালুতে ভর করে উঠে দাড়ালো, এই আশায় হয়তো এখনই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ওকে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরবে ক্রীতিক। কিন্তু আদতে তেমন কিছুই হলোনা ক্রীতিক এগিয়ে এসে অরুকে ধরা তো দুরে থাক ওর ধারে কাছেও এলোনা, উল্টো অরু এগিয়ে এসে ওর ক্ষ’তস্থানে হাত ছোঁয়াতে গেলে বিদ্যুৎ বেগে দূরে সরে যায় ক্রীতিক।
চলবে……..