সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৪৬+৪৭

0
11178

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৪৬
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য।))
(সংবি’ধিবদ্ধ স’তর্কীকরণঃ ট”ক্সিক পর্ব।)
.
.
রয়েল প্যালেসের ন্যায় লাইট গোল্ডেন থীমে সাজানো হয়েছে পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ। সকাল সকাল ভৃত্যরা কাজে লেগে পরেছে। গেইট থেকে শুরু করে ব্যাক ইয়ার্ড পর্যন্ত এমন কোন যায়গা নেই যেখানে সৌন্দর্যের কৃত্রিম ছোঁয়া পরেনি। চারিদিক গোল্ডেন ফেইরী লাইট আর হ্যাজাকের আলোয় ঝিকমিক করছে।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কোনো ড্রেসকোর্ট থীম না থাকলেও বিয়েতে বর কনের সঙ্গে মিলিয়ে ড্রেসকোর্ট থীম দেওয়া হয়েছে বেবি পিংক কালারের যে কোন দেশীয় পোশাক।

অতিথিদের বহুলাংশই রাতে আসবেন। তবে সন্ধ্যা নাগাদই বাড়িতে মানুষের কলরব শুরু হয়ে গিয়েছে। বিয়ে বাড়ির স্বাদ আস্বাদনে সবাই ব্যস্ত,সেই সাথে হাতে হাতে কোমল পানীয় তো আছেই। সায়র,অর্ণব এলিসা,ক্যাথলিন ওরা একসাথে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে, একই রঙের বিভিন্ন কারুকাজের জাঁকজমক পোশাকে বিয়ে বাড়ির সবার নজর কাড়তে সক্ষম ওরা ক’জন।
সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে তারা ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেবের বিলেত ফেরত বন্ধুবান্ধব। এক কথায় আজকের অতিথিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষন তারাই।

এছাড়াও মামির বাড়ির সবাই এসেছে আজ, এমনকি রেজাও, আজ রেজাকে বেশ হাসি খুশি লাগছে,চোখেমুখে গম্ভীরতা কপটতা কোনো কিছুর লেশমাত্র নেই ওর। রুপা আজ শাড়ি পরেছে, আর মোখলেস চাচা পাঞ্জাবি। বিয়ে উপলক্ষে ওদের জন্য আলাদা ভাবে এই উপহার গুলো পাঠিয়েছিল ক্রীতিক নিজেই।

মোখলেস চাচা কিছুটা হাসিখুশি থাকলেও রুপার চোখ মুখ থমথমে,সমগ্র মুখশ্রীতে মলিনতা বিরাজমান। হয়তো এখনো বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না মেয়েটা।অবশ্য নিতে পারার কথাও নয়।

তবে তাতে যায় আসেনা জাহানারার, তিনি চাবির গোছা কোমড়ে ঝুলিয়ে বেশ খুশিতেই দিব্যি ঘুরে ঘুরে এর ওর সাথে গল্প করে বেড়াচ্ছেন।

সন্ধ্যা নাগাদ তিথিও এসেছে নিজেকে দামি দামি শাড়ি গহনায় মুড়িয়ে পটের বিবি টি সেজে। সাথে তার বিলোভড হাসবেন্ড খন্দকার সাহেব ও আছেন। বড় বড় ভিআইপি গেস্টরা এখনো অনুপস্থিত। হয়তো সময়ের সাথে সাথে তাড়াও চলে আসবেন।

যে সকল টুকটাক ভিআইপি অতিথিরা উপস্থিত হয়েছেন, তাদেরকেই আপাতত সময় দিচ্ছেন আজমেরী শেখ।
বেশ কয়েকজন অফিস ক্লায়েন্টদের সাথে কুশল বিনিময় করায় তিনি যখন বেশ ব্যস্ত, ঠিক সে সময় হুট করেই একজন প্রতিবেশি এসে তাদের কথার মাঝখানে ঢুকে কিছুটা উৎসুক হয়ে আজমেরী শেখকে জিজ্ঞেস করলো ,
—– আচ্ছা আপা, আপনার ছোট মেয়েটাকে তো দেখলাম না, ওকে দেখার খুব ইচ্ছে জানেন? আমাদের ছেলে আছে ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।যদি বিয়ে দিতেন….

মহিলা কথা শেষ করার আগেই আজমেরী শেখ অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের এসিসট্যান্ট কে শুধালেন,
—- ক্রীতিক কোথায়? এখানে নেইতো? আমি চাইনা অনুর বিয়েতে কোনোরূপ ঝামেলা ঝাটি হোক।

আজমেরী শেখের এহেন অগ্রাহ্য ভঙ্গিমায় মহিলাটি হতবাক, অপমান ও বোধ করলেন কিছুটা, মনেমনে ভাবলেন, তিনি কি জিজ্ঞেস করলেন আর আজমেরী শেখ কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া করলো, এ আবার কেমন আতিথেয়তা? আজিব!

নীলিমা সেজেগুজে এসে মাত্রই অরুর রুমে প্রবেশ করলো। দরজা খোলাই ছিল, খাটের উপর বসে লেজ নাড়ছে ডোরা। ওকে একটা সুন্দর বার্বি ড্রেস পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
নীলিমা রুমে এসে প্রথমে ডোরাকে একটু আদর করে অরুর দিকে চাইলো, অরু এখনো কানে টানা ঝুমকো পড়া নিয়ে বেশ কসরত করে যাচ্ছে।

নীলিমা এগিয়ে গিয়ে অরুর হাত থেকে দুলটা নিয়ে ওকে পড়িয়ে দিতে দিতে ওর প্রশংসা করে বললো,
— তোকে মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছেরে অরু। আর এই লম্বা চুল গুলো, ইশ কি সুন্দর! কারও নজর না লাগুক।

তারপর একটু দুষ্টমি করে বললো,
— অবশ্য যার নজর লাগার, সে অলরেডি লাগিয়ে দিয়েছে।

অরু মৃদু হেসে নীলিমাকে অভিবাদন জানিয়ে বললো,
— তোকে বুঝি কম সুন্দর লাগছে? হবু দুলাভাই তোর রূপের আ’গুনে ঝ’লসে গেলো বলে।

—- যাক, ঝ’লসে বারবিকিউ হয়ে যাক হাতে আমার কি?

কথাটা বলে, নীলিমা একফালি মুঁচকি হাসি ফেরত দেয় , পরক্ষণেই ভাবুক হয়ে অরুকে শুধায়,
—- হ্যারে নিচে সবাইকে দেখলাম কিন্তু তোর বর মহাশয়কে তো দেখলাম না। সে কোথায়?

প্রতিউত্তরে অরু ঠোঁট উল্টে কিছুটা অন্য মনস্ক হয়ে বলে,
—- উনিতো সকাল বেলা অফিসে গিয়েছে কি দরকারি কাজ আছে বলে, বলেছিল তো সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে, কি জানি এখনো আসলোনা কেন?

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—- বুঝলাম, কিন্তু অনু আপা কোথায় বলতো?

অরু ঘুরে দাঁড়িয়ে ডোরাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
—- আপাকে তো সেই বিকেল বেলায় মেয়েরা সাজাতে এসেছিল, তারপর তো আর বের হলোনা, চল গিয়ে দেখে আসি। তাছাড়া এমনিতেও আপা সেই সকাল থেকে কা’ন্নাকাটি করছে, আমি সামনে গেলে আমারও কেমন কা’ন্না পেয়ে যাচ্ছে।

নীলিমা অরুর সাথে আর মন খারাপের নদীতে জোয়ার দিলোনা, উল্টো স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—- চল গিয়ে দেখে আসি, আপাকে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে, বর যাত্রী এলো বলে।

*********************************
নীলিমা আর অরু করিডোর পেরিয়ে অনুর রুমে প্রবেশ করতে যাবে ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অনু।

অকস্মাৎ বেরিয়ে আসায় ওরা তিনজন ধাক্কা খেতে খেতেও সামলে নিলো। অনুর পরনে ভারী বিয়ের সাজ, বেবি পিংক ভারী লেহেঙ্গাটা দু’হাতে ধরে উদ্বিগ্ন মুখে দাড়িয়ে আছে অনু। সাজানো গোছানো প্রতিমার মতো মুখটায় ভর করেছে অযাচিত আ’ত’ঙ্ক। তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তালে হাপরের ওঠানামা করছে ওর বুক।

অনুকে এমন বিভ্রান্ত চেহারায় দেখে, ভাঁজ পড়লো অরুর কপালে। নীলিমাও আশ্চর্য বনে গিয়ে শুধালো,
—- কি হয়েছে অনু আপা? তুমি ঠিক আছো?

নীলিমার কথার জবাব দেয় না অনু, উল্টো শুষ্ক ঢোক গিলে অরুকে জিজ্ঞেস করে,
—- অরু মা কোথায়?

অরু ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু জবাব দিতে যাবে, তখনই পেছন থেকে আজমেরী শেখ পেছন থেকে কথা ছো’ড়েন ফের,
—- কি প্রয়োজন? বর যাত্রী এসে পরেছে তোমাকে নিচে যেতে হবে।

অনু ওদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে, এগিয়ে এসে আজমেরী শেখের দু বাহু ধরে গলা খাদে নামিয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
—- ম…মা, আমার মনে হলো আমি ওই লোকটাকে দেখেছি। জানালা দিয়ে দেখেছি, অতিথিদের মাঝে দিব্যি দাঁড়িয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হুট করে দেখে আমার আত্মা কেঁপে উঠেছে। আর..

আজমেরী শেখ মেয়েকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
—- অযথা কথা রাখো অনু, এমন একটা শুভ দিনে একটা শ’য়তা’নের কথা মুখে আনলে কোন আক্কেলে? তাছাড়া পুরো বাড়ি বডিগার্ড দ্বারা সুরক্ষিত, স’ন্দেহভাজন কেউ এলে নিশ্চয়ই আমাকে ইনফর্ম করা হতো। শুধু শুধু এসব ভেবে নিজের স্পেশাল দিনটাকে মাটি করোনা তো। আমি আসছি নিচে অতিথিরা অপেক্ষা করছেন।

আজমেরী শেখ সামনে কয়েক কদম পা বাড়িয়ে ফের ঘুরে তাকিয়ে অরু আর নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—-অনুকে নিয়ে জলদি এসো।

**************************************
প্রত্যয় বসে আছে ফুল সজ্জিত স্টেজে। চারিদিকে বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি আমেজ, অতিথিরা সবাই কনেকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে,অমিত ও হাজির, তাকে কিঞ্চিৎ ক্লান্ত দেখালেও মুখে লেগে আছে এক চিলতে প্রানোচ্ছল হাসি।

কালকে সবাই নাচ গান করলেও আজকে কেমন মনমরা হয়ে বসে আছে ক্রীতিকের বন্ধু মহল। বউ সাজে কনেকে দেখার চেয়েও দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে সামনের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে সায়র, হয়তোবা প্রিয় মানবীকে এক ঝলক দেখার উদ্দেশ্যে, তার রাগীনির চাহনীতে আরও একবার ভ’স্ম হতে হতে প্রানে বেঁচে যেতে।

সায়র নিজেও বুঝতে পারছে না, এইটুকু হাঁটুর বয়সী মেয়েটার সাথে মজার ছলে ঝগড়া করতে করতে কখন যেন তী’রের ফলার মতোই হুট করে মনে গেঁথে গেলো পুরান ঢাকার এই শ্যামলতা রাগীনি। এখন তো আমেরিকা ফিরে গিয়েও শান্তি নেই, বারবার মনে হবে রাগীনিটা থাকলে ভালো হতো একটু ঝগড়া করে সময় কাটানো যেত।

সবার মাঝে থেকেও শুধুমাত্র নীলিমাকেই দেখতে চাইছে সায়রের তৃষ্ণার্থ ব্যাকুল দু’চোখ। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষন ঘনিয়ে এলো, সকল জল্পনা কল্পনা শেষে স্টেজের দিকে পা বাড়ালো, আজকের মোক্ষম চরিত্র। সবার দৃষ্টি যার দিকে নিক্ষিপ্ত, আজকের অনুষ্ঠানের সবচেয়ে সুন্দর রমনীটি,প্রত্যয়ের হবু স্ত্রী, ওর মনের রানী, ওর হৃদয় হরনী মিসেস অনন্যা এহসান।

অরু আর নীলিমা সাথেই ছিল অনুর। সেই সাথে আরও ছিল প্রত্যয়ের বোন আর আত্মীয় স্বজনরাও। অনু ধীর পায়ে লেহেঙ্গা সামলে প্রত্যয়ের নিকট এগিয়ে আসছে, ফিনফিনে দোপাট্টা দিয়ে মাথায় একহাত ঘোমটা টানা,তার আড়াল থেকেই অপার সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ছে মেয়েটার। প্রত্যয় দাঁড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে, অনুর একেকটা পদধ্বনি যেন প্রত্যয়ের বুকে আনন্দ আর উত্তেজনার ঝড় বইয়ে দিতে সক্ষম।

অবশেষে প্রত্যয়ের ঝড়ো হাওয়া মনে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামিয়ে স্টেজে উঠে আসে অনু। প্রত্যয় নিজের একহাত বাড়িয়ে তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। অনু তা গ্রহন করে এগিয়ে গিয়ে প্রত্যয়ের পাশের রাজকীয় ডিভানে বসে পরে। যদিও বা ওদের দুজনার মাঝে ফুলের এক বিস্তার পর্দা ঝুলানো, কেবল তিন কবুলের পরই তা তোলা হবে আর বর তখনই বউয়ের মুখ দেখবে। তার সত্যিকারের বউয়ের মুখ।

******************************************
ক্যাটারিং এর এদিকে সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ম ম করছে চারিপাশ । ওদিকে এই মূহুর্তে কনের মুখ দেখা নিয়ে বরের বাড়ির সবাই ব্যস্ত। আর এদিকে বরের একপায়ের জুতোটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে চোরের মতো চারিপাশে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে নীলিমা।

নীলিমা এককোণে দাড়িয়ে অনবরত দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল, তখন হুট করেই কে যেন নিঃশব্দে কাঁধে হাত রাখলো ওর।অকস্মাৎ ঘটনায় চকিতে লাফিয়ে উঠে পেছনে চোখ ঘোরালো নীলিমা।দেখতে পেলো, ওর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সায়র।

সায়র কে দেখা মাত্রই নীলিমা ঝাঁজিয়ে ওঠে, তৎক্ষনাৎ দাঁত খিঁচিয়ে বলে,
—- এখানে কি চাই?

সায়র নিজ গ্রীবাটা আরেকটু সামনে বাড়িয়ে নীলিমার ডাগর চোখের পাতায় সন্দিহান চোখ দুটো রেখে শুধালো,
— কাউকে খুজঁছো?

নীলিমা ঠোঁট বাকিয়ে জবাব দিলো,
—-জ্বি না, আর খুঁজলেও আপনাকে খুঁজিনি, যান তো, আজাইরা।

নীলিমার কথা গায়ে মাখালো না সায়র, মেয়েরা এমন একটু আধটু ঝাঁজিয়ে কথা বলে ওতে বেশ কিছু অসুবিধা নেই, অর্ণব কত শুনেছে এমন। থা’প্পড় খেতে খেতে ওর গালটাই বোধ হয় বেঁকিয়ে গিয়েছে , তবুও তো শেষমেশ এলিসাকেই পেয়ে গেলো। নীলিমা আর যাই হোক থা’প্পড় মা’রার সাহস নিশ্চয়ই দেখাবে না,উহুম কখনোই না।

যায়গাটা সরু এদিক দিয়ে ক্যাটারিং এর লোকজন আসা যাওয়া করছে হরদম। নীলিমা সেখানেই ঘাপটি মে’রে দাড়িয়ে আছে সেই সাথে সায়র ও। নীলিমা চুপচাপ শান্ত মস্তিষ্কে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সায়র ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে নরম স্বরে শুধালো,
— এ্যাই মেয়ে, আমেরিকা যাবে আমার সাথে?

নীলিমা নিজ ভ্রু জুগল কুঞ্চিত করে বললো,
— কিহ!

সায়র ফের আওড়ালো,
— বলেছি আমার সাথে নিয়ে যাবো তোমায়, নয়তো এতো রাগ কাকে দেখাবে তুমি হ্যা?

তুমিতো রীতিমতো আমাকে মিস করবে, দেখা যাবে আমার উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে তোমার বদ হজম হয়ে গেলো, তারপর ব’মি, আর পর ডি’সি’ন্ট্রি।

কথাটুকু শেষ করে চকিতে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো সায়র, পরক্ষণেই এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে মুখমন্ডলে কৃত্তিম গম্ভীর ভাব টেনে বললো,
— নো ওয়ে, আমার জন্য কারও ডি’সিন্ট্রি হবে?সেটা তো হতে পারে না, পুরো আমেরিকা জানে আমি ভারী সদয় হৃদয়ের মানুষ,তাহলে এই নি’র্দয় কাজটা কি করে করবো আমি? কিছুতেই না, তোমাকে এমন ঘোর ডি’সিন্ট্রি আ’শঙ্কার মধ্যে রেখে আমি তো কখনোই ও দেশে গিয়ে শান্তি পাবো না রাগীনি। তার চেয়ে তুমি বরং আমার সাথে…..

সায়র টেপরেকর্ডারের মতো এক নাগাড়ে কথা বলছে তো বলছেই, থামা থামির নামই নিচ্ছে না, এই পর্যায়ে এসে ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিলো নীলিমা, ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কটমটিয়ে বললো,
—– চুপ করবেন আপনি? তখন থেকে ডি’সিন্ট্র ডিসি’ন্ট্রি বলে আমার পেট খারাপ করে দিলেন, বলি এসব বলতে আপনার কি মুখে বাঁধে না একটু ও?

সায়র বলতে চাইলো,
—- ডি’সিন্ট্রি একটা প্রাকৃতিক সমস্যা, সেটা আবার মুখে বাঁধার কি আছে?

তবে কথা এগোতে পারলো না আর, তার আগেই ক্যাটারিং এর লোকের ধা’ক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে আচমকা পা ফসকে উল্টে পরলো নীলিমার শরীরের উপর। অ সাবধানতায় ওর হাতটা গিয়ে ঠেকলো নীলিমা মেদহীন লতানো উন্মুক্ত কোমড়ের ভাঁজে।

নীলিমা সায়রকে সামলালো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই চরম সাহসীকতা আর জিদের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সায়রের গালে ঠাটিয়ে চ’ড় বসালো ও। আচমকা চ’ড় খেয়ে সায়র অ’গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নীলিমার পানে,কিন্তু তার চেয়েও বেশি অ’ঙ্গার দেখা গেলো নীলিমার চোখে মুখে।

একপর্যায়ে সায়রের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কেঁদে উঠলো নীলিমা।
কিছু মানুষ আছে রাগ দেখাতে গিয়ে কা’ন্না পেয়ে যায়, নীলিমা বোধ হয় ওই ক্যাটাগরিতেই পরে।
নীলিমা কাঁদছে দেখে চোখমুখ কিছুটা স্থীর করলো সায়র, চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নরম কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
—- কাঁদছো কেন, কি হয়েছে? আ’ম সরি এটা ইচ্ছে করে হয়নি,আমি ইচ্ছে করে তোমার ওখানে…

সায়রের কথা না শুনে মাঝপথেই চোখ মুছতে মুছতে গটগট পায়ে ওখান থেকে চলে গেলো নীলিমা। নীলিমা চলে যেতেই কোথা থেকে যেন অরু এসে চারিদিকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বলে ওঠে,
—- আরেহ জুতোটা তো এখানেই পরে আছে তাহলে নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?

সায়র তখনো সেখানেই দাড়িয়ে এক ধ্যানে নীলিমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিল , অরু জুতোটা হাতে নিয়ে সায়রের দিকে তাকিয়ে অসহায় সুরে বললো,
—- আর বলবেন না ভাইয়া, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই মেয়েটা শুধু শুধু কাঁদে। আশ্চর্য!

অরুর কথায় যেন আকাশ থেকে পরলো সায়র, তৎক্ষনাৎ চোখ বড়বড় করে শুধালো,
—- কি বললে তুমি? নীলিমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? কবে, কোথায়, কখন?

অরু ঠোঁট উল্টে ভাবলেশহীন কন্ঠে জানালো,
— এইতো আাপার বিয়ের দুই তিন দিন পরেই আকদ হবে, পরবর্তীতে পড়াশোনা শেষ হলে তুলে দেওয়া হবে।

সায়রের গলাটা ধরে এসেছে,অরুর কথার পাছে ও আর দ্বিতীয় প্রশ্নটা করে উঠতে পারলো না সাহস দেখিয়ে। কেমন যেন পুরো দুনিয়া দুলছে ওর চোখের সামনে।

তাই অরুও আর দাঁড়ালো না জুতোটা নিয়ে হেলেদুলে চলে গেলো অন্দর মহলের দিকে।

************************************
অন্দরমহলের ভেতর প্রবেশ করে, সিঁড়ি ছাপিয়ে দোতলার করিডোরে পা রাখতেই থমকে গেলো অরু। পা দুটো আটকে রইলো সেখানেই, দক্ষিণের বাতাসে দোদুল্যমান জানালার দিকের মোমবাতি গুলো সব নিভে পরে আছে, সেখানেই সটান দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ছে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। লোকটা উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবে অরুর তাকে চিনতে অসুবিধে হলোনা খুব একটা । তাই খুব বেশি না চিন্তা করেই সহসা এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে লোকটাকে ডেকে উঠলো অরু,
—- অমিত ভাই?

অমিতের বন্ধুত্বসুলভ আচরণে বরাবরই বিমোহিত অরু। কখনো এমন কোন ঘটনা কিংবা আচরণ ওর নজরে পরেনি যার কারনে অমিতকে এরিয়ে যেতে হবে কিংবা ঘৃ’ণ্য নজরে দেখতে হবে। তবুও সেদিনের ঘটনার পর থেকে ক্রীতিকের ভয়ে বলা চলে অমিতকে একপ্রকার এরিয়েই চলেছে অরু।

কিন্তু আজ তো সে বাড়ি বয়ে এসেছে, তারউপর বহুদিনের অসু’স্থতা ছাপিয়ে একটুখানি সুস্থ হয়েছে লোকটা, সেই সুবাদেই অমিতের সাথে নিজ থেকে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলো অরু।অমিত ঘুরে তাকালে অরু আন্তরিক হেসে শুধালো,
— অমিত ভাই এখন ঠিক আছেন? পায়ের কি অবস্থা?

অরুর প্রশ্নে একটুকরো হাসি ঠোঁটের আগায় খেলা করে গেলো অমিতেরও, অতঃপর হেসে’ই জবাব দিলো অমিত,
—- এখন ঠিক ঠাক। তোমার কি খবর?
নোবেলটা কতদূর এগোলে?

অমিতের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সুযোগ হলোনা অরুর, তার আগেই ওর চোখ গেলো দমকা হাওয়ায় নিভে যাওয়া মোমবাতি গুলোর দিকে, ও তাড়াহুড়ো করে অন্যপাশ থেকে আরেকটা জ্বলন্ত মোম নিয়ে এসে লম্বা চুল গুলোকে কাঁধের একপাশে রেখে , জানালার কাছে আয়েশ করে বসে নতুন উদ্যমে জ্বালাতে শুরু করলো মোমবাতি গুলো।

কাঁচা হাতে মোম জ্বালাতে জ্বালাতে অরু আর খেয়ালই করেনি অমিত এখনো আছে না চলে গিয়েছে। চুল সরানোর দরুন মোমের নরম আলোটুকু ঠিকরে পড়ছে অরুর ধবধবে কোমল পৃষ্ঠদেশে, নতুন লেহেঙ্গার এই ব্লাউজের গলাটা বেশ বড়, এতোই বড় যে ক্রীতিকের হলুদ লাগানো অংশ স্পষ্ট দৃশ্যমান।

এরকম অপ্রত্যাশিত অথচ আকাঙ্খিত দৃশ্য দেখেই চোখ আটকে গেলো অমিতের। লোভাতুর কামুক চোখ দুটো ঘুরে ফিরে আটকে যাচ্ছে ওই একই যায়গাতে। অরুর প্রতি খারাপ আগ্রহ, লালসিত কিংবা দু’শ্চরিত্র মনোভাব কোনোকালেই ছিলোনা অমিতের।

বরাবরই মনের এক কোনে অরুকে নিজের সহধর্মিণী, নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস করেছে আড়ালে আবডালে। কিন্তু এই মূহুর্তে নিস্তব্ধ রাতে ওর সভ্য পুরুষ সত্তাটা কোথায় যেন যাচ্ছে ক্রমশ, অমিত নি’র্লজ্জের মতো অরুর দিকে তাকিয়ে আছে,আর শুষ্ক ঢোক গিলছে বারে বারে।

শুধু ভাবছে অরুর ওই নরম তুলতুলে শরীর অবধি পৌঁছাতে গেলে কতটা বাঁধা অতিক্রম করতে হতে পারে, ঠিক কতটা? অমিত যখন অরুর দিকে তাকিয়ে আবেশিত ঘোরে বিভোর, সেই ঘোরের মাঝেই হুট করে কপাল কুঁচকে গেলো ওর,অস্ফুটেই অমিত অরুর পিঠের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে ওঠে,
—- কি লেগে আছে হলুদ হলুদ? এখানে হলুদ কে লাগালো?

অমিতের হাতটা অরুর পিঠে ছুঁই ছুঁই হয়তোবা মেগা সেন্টিমিটার দূরত্ব এখনো অবশিষ্ট,আবার তার কমও হতো পারে,ঠিক তখনই, হুট করে, একদম অকস্মাৎ ঝ’ড়ের গতিতে, বাঁজপাখির মতো ছো মে’রে ওর হাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরলো কেউ।

আচমকা ঘটনাতে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো অমিত, সেই সাথে কিছুটা ভয় ও পেলো। ভ্রম কেটে যেতেই অরুর থেকে চোখ সরিয়ে হাতের চাপে ওর কব্জিটা ভা’ঙার জন্য উদ্যত হওয়া লোকটাকে দেখার উদ্দেশ্যে সামনে দৃষ্টিপাত করলো অমিত।

পিঠের উপর অচেনা হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব হতেই ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে তাড়াহুরো করে চুল গুলো পিঠে ছেড়ে দিলো অরু। তারপর হকচকিয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অজানা ভয়ে হৃদয় নেড়ে উঠলো ওর।
তৎক্ষনাৎ শুকনো ঢোক গিলে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো অরু, দেখলো ওরই সামনের অমিতের কব্জিটা চে’পে ধ’রে চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে আছে সয়ং ক্রীতিক।

পুরো বাড়ি ভর্তি সকলে বেবি পিংক থীমের জামা কাপড় পড়ে থাকলেও ক্রীতিকের পড়নে এখনো ব্ল্যাক স্যুট, একহাতে কিছু ফাইল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে সে। আর এই মূহুর্তে আ’গ্নেয়গিরির দা’বানলের মতোই হুর হুর করে আ’গুনের লে’লিহান জ্ব’লে উঠেছে ওর সবগ্র মস্তিষ্কে জুড়ে ।

কিন্তু ক্রীতিক সুকৌশলি,যার ফলসরূপ নিজের মেজাজ টাকে সুকৌশলেই সামলালো ও। কয়েক মূহুর্ত বাদে অমিতের হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে গভীর অথচ মসৃণ আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো অমিতকে,
—- কি করছিলে তুমি এখানে? অতিথিরা তো সব নিচে অপেক্ষা করছে।

ক্রীতিকের কথার পেছনে অমিত আমতা আমতা করে মাথা চুলকে বললো,
— এইতো স্মোক করতে এসেছিলাম, তারপর হুট করেই অরুর সাথে দেখা হয়ে গেলো, তাই না অরু?

অরুর দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসলো অমিত।

পরক্ষণেই ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে পুনরায় অমিত বলে,
—- আমি নিচে গিয়ে দেখছি কাজি সাহেব এলো কিনা, তোমরা ও চলে এসো।কেমন?

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কথাটুকু শেষ করে দ্রুত পদধ্বনিতে দোতলা ত্যাগ করে অমিত। অমিত চলে গিয়েছে কি যায়নি, নিজের ঘাড় ফুটিয়ে অরুর সামনে এসে কোনোরূপ কথা, কিংবা জবাবদিহিতা ছাড়াই ওর গালে নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে চ’ড় বসালো ক্রীতিক। চ’ড়টা এতো জোরেই ছিল যে অরুর চুলের পাঞ্চ ক্লিপটা ছি’টকে পরলো অদূরে। থা’প্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে কাঁপা গলায় কাই কুই করে অরু বলে,
—আ..আম..আমি..

—এই চুউউপ.. শাট ইউর ফা’কিং মাউথ।

ক্রীতিকের র’ক্তিম চোখ আর কঠোর ধমকে আরেক দফা কেঁপে উঠল অরুর ছোট্ট শরীরটা।
এই মূহুর্তে জবাব দেওয়া কিংবা ক’ষ্টে নয়,বরং ভয়ে কাঁপছে অরু। তবে ওর তো কোন দোষ নেই,সেটা ক্রীতিককে বোঝাতে হবেতো।

কিন্তু ক্রীতিক বুঝলো না, উল্টো অরুর চোয়ালটা শক্ত হাতে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— ওই বা’স্টা’র্ড টা তোর শরীরের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস কোথায় পেলো? জবাব দে?

ওই নোং’রা হাতটা আমার জিনিসকে স্পর্শ করেছে, আমিতো তোকে আজ মে’রেই ফেলবো অরু। তুই জানতিস আমি কতোটা খারাপ, তাহলে কলিজায় এতো সাহস কোথা থেকে এলো? হাউ ফা’কিং ডেয়ার ইউ টু টক উইথ সামওয়ান লাইক অমিত?

গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলো ক্রীতিক।

অরু ব্যথায় জর্জরিত সেই সাথে ভয়ে তটস্থ, কথা বলার কোনো পরিস্থিতি অবশিষ্ট রাখেনি ক্রীতিক, তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ফোপাঁতে ফোপাঁতে চোখের জল ফেলছে মেয়েটা।

হৃদয়টা ওর ভে’ঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, শেষ পর্যন্ত কিনা অমিত ও এমন একটা কাজ করে বসলো?

ক্রীতিক দমলো না, একই ভাবে অরুর গালটা চেপে ধরে বললো,
—- আমি জানি তুই কিছু করিসনি, তুই বুঝতেও পারিসনি এমন কিছু হবে, কিন্তু তুই অন্যা’য় করেছিস অরু, ঘোর অ’ন্যায় করেছিস। আমি বারণ করা সত্ত্বেও অমিতের সাথে কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছিস, তোকে আমি কতবার স’তর্ক করেছি আপন ভাই ছাড়া আর কোনো ভাই’ই আদতে ভাই নয়, বলিনি বল?আন্সার মি!

রাগে আক্ষেপে অরুকে ঝাঁকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ক্রীতিক।

অরুর কা’ন্নার আওয়াজ জোড়ালো হলো, ক্রীতিক তীব্র রা’গে অরুকে সামান্য ধা’ক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিয়ে পরনের ব্লেজার আর ফাইল গুলো করিডোরের মেঝেতেই ছু’ড়ে মা’রলো। পুরো অন্দলমহল খাঁ খাঁ করছে, এদিকে একটা কাক পক্ষি ও নেই। বাইরে সবার আনন্দ উল্লাসের শোরগোল শোনা যাচ্ছে, হয়তো বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এটার জন্যই তো এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিল ক্রীতিক। বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরুকে ওর রুমে আটকে রেখে,হাতে একটা হ’কিস্টিক নিয়ে নিজের সফেদ রঙা শার্টের হাতাটা গুটাতে গুটাতে নিচে চলে যায় ক্রীতিক, যাওয়ার আগে অরুকে উদ্দেশ্য করে তীর্যক কন্ঠে বলে,
— আমি ফেরার আগ পর্যন্ত এখান থেকে এক পা ও ন’ড়লে তোর খবর আছে, এই দেহে প্রা’ন থাকবে না।

***************************************
ক্রীতিক হকি’স্টিক সমেত নিচে এসে সরাসরি প্রত্যয়ের মাকে জিজ্ঞেস করলো,
— অমিত কোথায়?

প্রত্যয়ের মা বিয়ে বাড়িতে ব্যস্ত সময় পার করছেন, তাই কোনো কিছু খেয়াল না করেই তিনি বললেন,
— ও তো বাবা মাত্রই বেরিয়ে গেলো, কি জরুরি কাজ আছে বললো।

ক্রীতিক ও আর দাড়ালো না সেখানে, বড় বড় পা ফেলে বাইক নিয়ে সোজা বেড়িয়ে গেলো ক্রীতিক কুঞ্জ থেকে।

আর কেউ খেয়াল না করলেও এই পুরো ঘটনাটা খেয়াল করলো ক্রীতিকের বন্ধুরা। ক্রীতিক বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলিসা তরিঘরি করে বলে উঠলো,
—- অর্ণব, সায়র ওকে আটকা জলদি, নয়তো যাকে মা’রতে যাচ্ছে তাকে আজ মে’রেই ফেলবে।

অর্ণব সায়র আর ঘটনা বোঝার জন্য অপেক্ষা করেনা,কোনোকিছু না ভেবেই ওরাও বাড়ির গাড়িটা নিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে পরে ক্রীতিকের পিছু পিছু।

জোস্ন্যা মাখা রাত, অমিত কে পাওয়ার জন্য খুব বেশিদূর যেতে হলোনা ক্রীতিকের, মহল্লা ছাড়ানোর আগেই অমিতের সাদা টয়োটা গাড়িটা ধরে ফেললো ও।

ক্রীতিকের চোখে গাড়িটা পরার সঙ্গে সঙ্গে কোনোকিছুর আশ’ঙ্কা না করেই একেবারে অমিতের গাড়ির সামনে গিয়ে স্ট্যান্ড করালো বাইক, মাথার হেলমেট টা খুলে বাইকের পেছন থেকে হকি’স্টিক নিয়ে গাড়ির জানালায় কড়া নাড়তেই জানালার কাচ নামালো অমিত, জানালার কাচ নামাতেই ক্রীতিকের থমথমে মুখটা দেখে কিছুটা হতবাক চাহনি নিক্ষেপ করে অমিত বলে ওঠে,
—- ক্রীতিক তুমি এখানে?

— গাড়ি থেকে নামো আগে, বলছি।

অমিত কিছু না ভেবেই ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো অতঃপর ক্রীতিকের হাতের হকি’স্টিকি’কের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললো,
—- কি হয়েছে?

ক্রীতিক জবাব দিলো ,
—- আ’ম সরি অমিত।

এরপর আর কোনো কথা নয় সরাসরি অমিত কে হ’কিস্টিক দিয়ে আ’ক্রম’ন করে বসলো ক্রীতিক। কয়েক ঘাঁ শক্ত প্র’হার শরীরে আঁচড়ে পরতেই কিছুটা টলে পরলো অমিত। কিন্তু ও নিজেও তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়,যথেষ্ট বলবান পুরুষ অমিত।

কিছুদিন আগের এ্যা’ক্সিডে’ন্টের কারনে শক্তির কিছুটা ক্ষয় হলেও এতোটাও দূর্বল নয় যে,ক্রীতিকের হ’কিস্টি’কিকের প্র’হারের বিপরীতে ও চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।

এবং সে-ই শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো অমিত, উঠে গিয়ে শক্ত হাতের ঘু’ষি ছাড়লো ক্রীতিকের নাক বরাবর, তৎক্ষনাৎ নাক ফে’টে র’ক্ত বেরিয়ে এলে ওর।

ক্রীতিক সেটা আলগোছে মুছে নিয়ে, ঠোঁট কামড়ে আঙুলের ইশারায় অমিত কে বললো,
— গুড জব,জাস্ট হিট মি। নাহলে তোমাকে মা’রতে আমার অনুশোচনা হচ্ছে।

—- ইউ ফা’কিং সাই’কো’প্যাথ,

কথা টা আওড়ে ওকে মা’রতে গিয়েও মা’রলো না অমিত, থেমে গিয়ে উল্টো চিল্লিয়ে উঠে বললো,
—- কেন মা’রছো তাহলে? কিসের শ’ত্রু’তা আমার সাথে তোমার?

ক্রীতিক অমিতকে পুনরায় হ’কি’স্টিক দিয়ে মা’র’তে মা’র’তে বললো,
—- আ’ম সরি অমিত, বাট তুমি খুব বড় মিসটেক করে ফেলেছো, জানতে চাও সেটা কি?

অমিতের শরীর ফেটে র’ক্ত বেরোচ্ছে, তবুও চোখে মুখে একরাশ কৌতুহল নিয়ে ক্রীতিকের পানে চাইলো অমিত।

ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
—- আজ যে মেয়েটার দিকে তুমি নোং’রা চোখে চেয়েছিলে, যার শরীরে লালসা করে হাত বাড়িয়ে ছিলে, ওই মেয়েটা আমার বিয়ে করা বউ!!
আমার সম্পত্তি, আমার হার্টবিট, ইভেন সি ইজ মাই এভ্রিথিং, বা’স্টা’র্ড।

ক্রীতিকের কথা শুনে চমকে ওঠে অমিত, এই তাহলে ক্রীতিকের রা’গের কারণ? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? অমিতের জানা মতে অরুর মা ক্রীতিকের ও সৎ মা, তাহলে সৎ বোন কি করে বউ হয়?ও এম জি! ইটস আ হিউজ ব্লা’ন্ডার। কিন্তু এখন? ক্রীতিক নিশ্চয়ই এতো বড় ভুলের জন্য অমিতকে ছে’ড়ে দেবেনা?

অমিত চুপচাপ শুষ্ক ঢোক গিলছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
— আগের বার সতর্ক বার্তা হিসেবে শুধু গাড়ি এ্যা’ক্সি’ডেন্ট করিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম, তারপরেও ক্রমাগত একই ভুল করে গিয়েছো তুমি অমিত।

ক্রীতিকের শেষ কথাটা শোনা মাত্র অমিত হতবিহ্বল হয়ে পরে, মনেমনে ভাবে আগের বারও অরুর ব্যাপারে কথা বলে যাওয়ার সময়ই অনা’ঙ্ক্ষিত দূর্ঘ’টনা’র স্বীকার হতে হয়েছিল ওকে। আর এখনও।

নিজের কথা শেষ করে ক্রীতিক পুনরায় অমিতকে হকি’স্টিক দিয়ে প্রহার করতে যাবে, ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন ছুটে এসে সায়র অর্ণব দুজন মিলে তাড়াহুড়ো করে ধরে ফেললো হকি’স্টি’কটা। সেই সাথে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো উ’গ্র মেজাজী ক্রীতিক কেও।

*************************************

অন্দরমহল এখনো নিস্তব্ধ, কারও কোনো সারাশব্দ নেই, হয়তো এখনো সবাই বাইরে স্টেজের ওখানে বর কনে নিয়ে মেতে আছে, অথচ অরু এখানে একা রুমে বসে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে চোখের জল ফেলছে।

লম্বা পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, থা’প্প’ড়ের আ’ঘা’তে গালটা জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হা করলেও ব্যথায় টনটন করে উঠছে। ক্রীতিকের মুখের আগেই হাত উঠে যায় শরীরে, যা অরু প্রচন্ড ভ’য় পায়, ওই জন্যই তো সবসময় ওইসব কাজ এরিয়ে চলে যেগুলো ক্রীতিকের অপছন্দ, কিন্তু আজ না চাইতেও সেই একই কাজ করলো ও।
আর অমিত? যে মানুষটাকে অরু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলো, ভাইয়ের মতো ভরসা করলো, এমনকি ক্রীতিকের সাথে পর্যন্ত যাকে নিয়ে ত’র্ক করলো, সে কিনা এভাবে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলো ছিহ, ভাবলেই গা গিনগিন করে উঠছে অরুর।

কাঁদতে কাঁদতে মাথাটা ধরে এসেছে ওর,একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, তারউপর নিচে আপা কি করছে কে জানে?

অরুর মস্তিষ্কে প্রবাহমান হাজারো ভাবনার ছেদ ঘটলো ক্রীতিকের আগমনে, ক্রীতিক রুমে প্রবেশ করতেই ঝকঝকে লাইটের আলোয় অরু দেখলো ওর নাকে মুখে র’ক্ত লেগে আছে, নিজের স্বামীর এহেন অবস্থা দেখে অরু উদ্বিগ্ন হলো বটে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না তীব্র অভিমানে। ক্রীতিক কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার ফুরসত ও দিলোনা, এগিয়ে এসে অরুর হাতটা ধরে টা’নতে টা’নতে নিয়ে নিয়ে গেলো রুমের বাইরে অতঃপর কোলে তুলে সিঁড়ি ভেঙে একে বারে নিচে বিয়ের আসরে।

বিয়ে বাড়িতে তখনো ওদের দুজনকে কেউ খুব একটা খেয়াল করেনি , কিন্তু যখন ক্রীতিক অরুকে টেনে এনে সবার মাঝে দাড় করিয়ে ওর সমগ্র মুখ মন্ডলটা চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো, ঠিক তখনই পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল উপস্থিত সকলের।

ছোট বড় সবাই উপস্থিত এখানে, অথচ সবার মাঝখানে দাড়িয়ে দ্য গ্রেট অ’সভ্য খ্যাত জায়ান ক্রীতিক অরুর সমস্ত মুখে টুকরো টুকরো চুমু খেয়ে তবেই থামলো।

ওদিকে আজমেরী শেখের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে, অনু প্রত্যয়কে আয়না দেখানো হচ্ছিলো এতোক্ষন, কিন্তু এই মূহুর্তে আয়না দেখা বাদ দিয়ে ওরা ক্রীতিক অরুকে দেখায় ব্যতিগ্রস্থ হয়ে পরলো।

অরুর অবস্থা ম’রি ম’রি, চারিদিকের জোড়া জোড়া কৌতুহলী আর সন্দিহান চোখ গুলো এড়াতে নিজের চোখ দুটোই খিঁচিয়ে বন্ধ করে মাথাটা নুয়িয়ে রেখেছে অরু।

ক্রীতিক প্রথমে অরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকালো, তারপর শক্ত গলায় বললো,
—- মাথা উঁচু কর অরু, রাইট নাও।

চারিপাশের সকলে এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তা দেখে ক্রীতিক সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ,
—- এভরি ওয়ান এটেনশন প্লিজ, ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন ইটস আ বিগেস্ট মিসটেক কি আমি সবাইকে জানিয়ে শুনিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করতে পারিনি।

বাট আ’ম নট সিঙ্গেল এনি মোর, আই হ্যাভ আ ওয়াইফ।আর এখন, এই মূহুর্তে আমি সবাইকে জানাচ্ছি, আমার পাশে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী, মিসেস জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

হ্যা জানি, এখনো অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে , আমি সেটাও ক্লিয়ার করছি, আমার স্ত্রী আমারই সৎ মায়ের আগের পক্ষের সন্তান। এবং আমি জেনে শুনেই তাকে বিয়ে করেছি, উই আর হ্যাপিলি ম্যারেড নাও।
আশা করছি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কারোর মাঝে আর কোনো সন্দেহ কিংবা জটিলতা নেই এখন আর। যদি থেকে থাকে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা, কারন জেকে কখনো সোসাইটির ধার ধারেনা। নেভার এভার।

এক নাগাড়ে কথা শেষ করে গলা কিছুটা খাদে নামিয়ে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
—- থ্যাংকস ফর ইউর ভ্যালুয়েবল টাইম গাইস, নাও ইউ ক্যান এনজয় দ্য ওয়েডিং পার্টি।

শেষ বাক্যটার ইতি টেনে অরুকে এক প্রকার ফেলে রেখেই হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেলো ক্রীতিক। আজ বোধ হয় আর অরুর উপর থেকে রা’গ কমবে না ওর।
চলবে…..

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৪৭
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)

চন্দ্রদীপ্ত মধ্যরাত, রুপোর থালার মতো চাঁদটা তীর্যক রুপোলী আলোতে ভূবণ ভরিয়ে তুলছে, তারপরেও ঈশান কোনে কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর জ্বলে ওরা বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর চারিদিকের তীব্র হিমেল হাওয়ায় মনে হচ্ছে শেষ রাতে বৈশাখী ঝড়ে লন্ড ভন্ড হবে প্রকৃতি।

প্রত্যয়দের বাড়িটা ক্রীতিক কুঞ্জের তুলনায় কুঁড়েঘর ই বলা চলে। ছোট মতো একটা দু’তলা বাড়ি। নিচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘর, আর অতিথিদের জন্য গেস্টরুম। আর উপর তলায় প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু আর বড় আপুর শোবার ঘর। যদিও বা বড় আপু বেশির ভাগই তার শশুর বাড়িতেই থাকেন।
কালেভদ্রে যখন এ বাড়িতে আসা হয় তখনই কেবল তার রুমে মানুষের আনাগোনা লক্ষ করা যায়।

প্রত্যয় নিজেও আমেরিকা থেকে বছর অন্তর ছাড়া দেশে ফেরেনা, যার ফলরূপ মুরব্বি দুজন ছাড়া পুরো বাড়িটা শূন্যই থাকে বলা চলে।

প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু অমায়িক মানুষ। বিয়ের আগে শশুর শাশুড়ী নিয়ে অনুর মন গহীনে যে অযাচিত আ’তঙ্ক’রা ঘুরে বেড়াতো, চোখ বুজলেই শশুর বাড়ি নামক যায়গাটা কে যেন মহাযজ্ঞ স্থল ঠেকতো, সেই সকল ভুল ধারনাকে এক দর্শনেই বিনা’শ করেছেন প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু।

আজ এই বাড়িতে পা রাখার পরে অরু আর ক্রীতিকের বিষয়টা নিয়ে প্রতিবেশী আত্নীয় স্বজনদের মুখ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি অনুর।

কিন্তু প্রত্যয়ের আব্বুর কান অবধি সে সব কথা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করেছেন, নিজের আত্নীয় স্বজন হোক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী সবার উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় একটাই কথা বলেছেন,
—– বউমা যেহেতু আমার, বউয়ের পরিবারটাও আমারই, আর আমার পরিবার নিয়ে যারা কুৎসিত মন্তব্য করার স্পর্ধা দেখাবে, তারা কখনোই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেনা। তাছাড়া ধর্মীয় আইন কানুন বাদ দিয়ে সমাজের কুসংস্কারে গা ভাসানোর মানুষ আমি নই। ধর্মে যে সম্পর্কের প্রাধান্য আছে, আমার নিকট ও তার যথাযথ সম্মান রয়েছে । দ্বিতীয়বার বউমার বোনকে নিয়ে আর একটাও কথা যাতে না হয় এ বাড়িতে ।

কথা শেষ করে তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে দৃঢ় গলায় আদেশ করে বলেন,
—- প্রত্যয়ের আম্মু, তুমি খেয়াল রেখো। বউমার সম্মানহানী হয় এমন কোন কথা যাতে দ্বিতীয়বার আমার কান অবধি না আসে।

নতুন শশুর শাশুরির কাছ থেকে এতোটা প্রাধান্য, এতোটা আন্তরিকতা পেয়ে সত্যিই তখন গর্বে বুকটা ফুলে ফেঁপে উঠছিল অনুর, বারবার মনে হচ্ছিল প্রত্যয়ের মতো একজন ভদ্র সভ্য, শান্ত ছেলে জন্ম দেওয়া কেবল তাদের মতো অমায়িক আর স্বচ্ছ হৃদয়ের মা বাবার দ্বারাই সম্ভব।

রুমের কোনে অবস্থিত লম্বাটে পুরনো সেগুন কাঠের ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে সন্ধ্যা রাতের সেসব কথা ভেবে আরও একবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অনুর চিত্ত চিড়ে।

প্রত্যয়ের রুমটা একতলা কিংবা দোতলায় নয়। বাড়ির একমাত্র ছেলে হিসেবে সম্পূর্ণ আলাদা ডেকোরেশন করে চিলেকোঠার ঘরটাই প্রত্যয়ের রুম হিসেবে বরাদ্দ করা। প্রত্যয় যখন দেশে ছিল তখন থেকেই এই চিলেকোঠার ঘরটা ওর। আর এখন ওদের বিয়ের প্রথম বাসর রাতের আয়োজন ও এ ঘরেই করা হয়েছে।

পুরো ঘরটাতে ভুর ভুর করে সুঘ্রান ছড়াচ্ছে পুরনো খাটে নতুন করে সাজানো তাজা রজনীগন্ধা আর থোকা থোকা গোলাপের আস্তরণ। সাদা চাদরে মোড়ানো বিছানা জুড়েও গোলাপের ছড়াছড়ি। সেদিকে তাকালেও কেমন অপার স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে মন প্রান।

পুষ্প সজ্জিত স্নিগ্ধ সেই রুমের এক কোনে দাড়িয়ে নির্বিগ্নে চুলে তোয়ালে চালাচ্ছে এই ঘরের নতুন ঘরনি, প্রত্যয়ের সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ। যেন এই ঘরে আগমন তার নতুন কিছু নয়, সেভাবেই বিয়ের ভারী গহনা,পোশাক আশাক ছেড়ে একটা কালো পাড়ের খয়েরী তাঁতের শাড়িতে নিজেকে নতুন বউ রুপে আবিষ্কার করলো অনু।

ঠান্ডা পানি দিয়ে লম্বা শাওয়ার শেষে সারাদিনের ধকল কে ধুয়ে মুছে সাফ করে একেবারে সতেজ হয়ে বেরিয়েছে অনু। আর এখন এই হাল্কা শাড়িটা গায়ে চড়িয়ে আরও বেশি আরাম লাগছে ওর।

শাড়ির ব্লাউজটা ব্যাকলেস, যার দরুন একটু একটু অসস্থি ও হচ্ছে। এমন একটা আটপৌরে শাড়ির সাথে এমন শরীর উন্মুক্ত ব্লাউজ কে কিনলো ভেবে পায়না অনু, ভাবার মতো সময় ও নষ্ট করে না অবশ্য, তার কারণ ওর মাথায় এই মূহুর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য একটা প্রশ্ন, বারংবার মানস্পটে ভেসে উঠছে সেই তীক্ষ্ণ ক্রুর ভ’য়ানক চোখ দুটো।

অনুর মনে আছে ছোট বেলায় এই চোখ দুটোকে ভীষণ ভ’য় পেতো ও, আর এখনো পায়, কিন্তু হঠাৎ করেই এতো গুলো বছর পর কোথা থেকে উদয় হলো সেই মানব? কেনই বা ফিরে এলো ওদের শান্তশিষ্ট নিরিবিলি জীবনে?
ওদের জীবনে তো মানুষটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই, তাহলে আজকের দিনেই কেনো এভাবে দেখা দিলো সে? এটা কি কেবলই অনুর মতিভ্রম নাকি অন্য কিছু?

অনুর ভাবনার জগতের পর্দা টেনে যায় প্রত্যয়ের আগমনে, প্রত্যয় একটু অন্যমনস্ক হয়েই রুমে প্রবেশ করে। আত্নীয় স্বজনদের অধিকাংশই কর্মজীবি হওয়াতে যে যার মতো ফিরে গিয়েছে সবাই, বাড়িতে আপাতত আপু আর তার হাসবেন্ড ছাড়া আর তেমন কেউ রয়ে যায়নি। সবাইকে একেক করে বিদায় দিতে দিতেই রুমে আসতে এতো রাত হয়ে গেলো প্রত্যয়ের।

তারউপর ক্রীতিক কল করেছে কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও কাল অফিস যেতে হবে ওকে, শেয়ার হোল্ডারদের সাথে ইম্পর্টেন্ট মিটিং রয়েছে , তার চেয়েও বেশি চিন্তার বিষয় হলো কাল জামাই শাশুড়ী একই সাথে নিজেদের প্রজেক্ট লঞ্চ করবে, কি জানি কি হবে? কি করেইবা এই দু’জন হট টেম্পার কে একই সাথে সামলাবে ও? চিন্তায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছে প্রত্যয়ের।

প্রত্যয় রুমে ঢুকতেই অসম্ভব মিষ্টি সুঘ্রাণে ওর চোখ দুটো আবেশে বন্ধ হয়ে এলো, ফুল,মোমবাতি, সেই সাথে পরিচিত নারীর গায়ের গন্ধ মিলে মিশে পুরো ঘরটা সৌরভে ম ম করছে। অনু অনু সেই গন্ধটা আরও একবার নাক চিড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাহায্যে ভেতরে পুরে নিলো প্রত্যয়।তবে আজ আর এই সৌরভ ওর নাকে নয় ওর হৃদয় গিয়ে লাগছে।

খানিকক্ষন চোখ বুঁজে রেখে নিজেকে সামলালো প্রত্যয়, তারপর আস্তে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলো ওর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে অনু,হাতে তার সেদিনের সেই ছোট্ট বক্সটা।

প্রত্যয় বক্সটার দিকে ভ্রু কুঞ্চন করে তাকালে অনু শুধায়,
—- আপনার কি ঘুম পেয়েছে প্রত্যয় সাহেব? চশমাটাও দেখি পরেন নি, ঠিকঠাক দেখছেন তো আমায়?

অনুর কথায় এক চিলতে হাসি খেলে গেলো প্রত্যয়ের ঠোঁটের আগায়, ও অনুকে আগাগোড়া পরখ করে বললো,
—- তোমাকে দেখতে আমার চশমার প্রয়োজন নেই অপরিচিতা, চোখ বন্ধ করলে সর্বদাই তুমি আমার দু’চোখের পাতায় রাজত্ব করে বেড়াও, আর এখন চোখ খুললেও তুমি।

প্রত্যয়ের এসব প্রেম প্রেম কথা ভালোই লাগে অনুর, মাঝেমধ্যে লজ্জাও পায় বেশ, কিন্তু এই মূহুর্তে পেলোনা, উল্টো প্রত্যয়ের কথাকে দু আনা প্রশ্রয় না দিয়েই হাত বাড়িয়ে বক্সটা দেখিয়ে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে,
—- বিয়ে হয়েছে গিয়েছে, আজ প্রথম রাত, তাহলে এবার বলুন,কি আছে এতে? আমি আর পারছিনা চুপ হয়ে থাকতে, কৌতুহলে মাথাটা কিলবিল করছে আমার।

প্রত্যয় এবারও অনুকে মসৃণ হাসি ফেরত দিয়ে বলে,
—- প্রথম রাতে স্বামীকে সালাম না করেই উপহার দেখতে চাইছো? ইট’স নট ফেয়ার অনু।

অনু তৎক্ষনাৎ দাঁত দিয়ে জিভ কাটে, মনেমনে বলে,
—- এইরে ভুলেই গিয়েছিলাম।

পরক্ষণেই শাড়ির আঁচলটা পিঠের উপর দিক দিয়ে টেনে এনে সামান্য নিচু হয়ে সালাম করলো প্রত্যয়কে। তারপর আবারও সেই একই বুলি,
—- এবার বলুন এতে কি আছে?

অনুর উন্মুক্ত মসৃণ মোমের মতো পিঠের দিকে চেয়ে প্রত্যয় ঘোর লাগা গলায় বললো,
—- কি পরেছো এটা? সব দেখা যাচ্ছে।

অনু বলে,
—- আগে আমার কথার উত্তর দিন তারপর বলছি।

অনুর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এতে কি আছে না জানা অবধি প্রত্যয়কে এক দন্ড বসতেও দেবেনা ও,আর প্রত্যয় কিনা এইটুকু সময়ে কত কিছুরই না স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। সিল্যি ফিলিংস, হাহ!

প্রত্যয়ের দুচোখে এখন সেই সব অব্যক্ত,নেশাতুর অনুভূতি গুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু অনুকে বোঝানো মুশকিল। তাই এবার আর কোনোরূপ কথা না পেঁচিয়েই বক্সটা খুলে অনুর হাতে ধরিয়ে দিলো প্রত্যয়।

অনু অবাক চাহনিতে বক্সের ভেতর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে, হবে হয়তো কোনো দামি জুয়েলারি, কিংবা কোনো হানিমুন টিকেটস।

অনুর জানা মতে বাসর রাতে তো স্বামীরা এসবই উপহার দেয়। কিন্তু এখানে তেমন কিছুই দেখতে না পেয়ে আশাহত হলো অনু, ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রত্যয়কে শুধালো,
— কই?

প্রত্যয় কাবার্ড থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করতে করতে বললো,
— কি কই?

— কেন উপহার?

অনুর কালো হয়ে যাওয়া চুপসানো মুখটা দেখে প্রত্যয় অনেকটা কাছে এগিয়ে এসে ওর চিবুক তুলে হিসহিসিয়ে বলে,
—- কি বলেছিলাম আমি? এর মাঝে তোমার স্বপ্ন আছে, আর সেটাই আমার তরফ থেকে তোমার জন্য বাসর রাতের বেস্ট গিফট।

অনু ভ্রু কুঁচকে বললো,
— স্বপ্ন মানে? কেমন স্বপ্ন?

প্রত্যয় কিঞ্চিত ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে বক্স থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে অনুর গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো,
—- এই যে আমার বউ সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।

এতোক্ষণে অনুর টনক নড়েছে, চোখ দুটো ছলছল করছে, ও সেই ছলছলে চোখ নিয়েই প্রথমে প্রত্যয়ের দিকে অবিশ্বাসের চাউনি নিক্ষেপ করলো, অতঃপর কাঁপা হাতে আইডি কার্ডটা চোখের সামনে তুলে ধরলো, যেখানে গুটি গুটি ইংরেজি অক্ষরে অনুর নাম আর ছবি বসানো,
অনন্যা শেখ নামের পাশেই ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে পরপর তিনটে অক্ষরে লেখা, L.L.B অনার্স।

এতো ঝড়ঝাপটা, এতো উত্থানপতনে অনু তো ভুলেই গিয়েছিল, নতুন করে পড়াশোনা শুরু করাটা যে ওর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। মায়ের অসুস্থতায়, যা না চাইতেও বিসর্জন দিতে হয়েছিল ওকে, মস্তবড় গেইট পেরিয়ে ভার্সিটিতে প্রবেশ করার স্বপ্ন তো অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল।

মনের টানাপোড়েন তো কম হয়নি এককালে, কিন্তু অনু নিজেকে বুঝিয়েছিল বড় মেয়ে হতে গেলে দ্বায়িত্ব নিতে হয়,বাড়ির বড় সন্তান কে এতো নিজের কথা ভাবলে চলেনা,তাদের পৃথিবীতে পাঠানোই হয়েছে পরিবারের সর্বসকল্যের সুখ নির্ধারন করার জন্যে।

কিন্তু আজ, এই মূহুর্তে প্রত্যয় নিজ হাতে অনুর স্বপ্নকে অনুর হাতে ধরে দিলো, নতুন করে মনে করিয়ে দিলো অনু এখন আর একা নয়, ওরও নির্বিগ্নে মাথা রাখার জন্য একটা কাঁধ রয়েছে, যার নাম “প্রত্যয় এহসান”।

—- তোমার এখনো অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি অনু, এগিয়ে যাও আমি তোমার পাশে আছি। তোমার স্বামী, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী সবসময় তোমার পাশে আছে।

প্রত্যয়ের কথায় এতোক্ষণের ভ্রমটা কেটে গেলো অনুর,মতিভ্রম থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়ের উপর ঝাপিয়ে পরে ওর গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চিৎকার করে কেঁদে উঠলো অনু, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—– এটা কি করেছেন আপনি, কি করেছেন? এতো ভালোবাসা কেন দিচ্ছেন? পা’গল হয়ে যাবো তো আমি। আপনি আমাকে আজকে যা দিয়েছেন তা এই দুনিয়ার কেউ দেয়নি আমাকে, কেউ না।

অনু সরল মনে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বললেও, ওর বলা কথা আর চিৎকারে প্রত্যয়ের চক্ষু চড়কগাছ। প্রত্যয় তৎক্ষনাৎ চোখ মুখ খিঁচিয়ে অনুর মুখটা হালকা চেপে ধরে বললো,
—- আরেহ, কি বলছো এসব? নিচের সবাই শুনলে কি ভাববে? আস্তে বলো জান,আস্তে।

অনু নিজের নাকের পানিটুকু প্রত্যয়ের এক্সক্লুসিভ শেরওয়ানিতে মুছে নতুন উদ্যমে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- আস্তে বলবো মানে? আমিতো সবাইকে জানিয়ে বলবো আপনি আমাকে কি দিয়েছেন এটা, কয়জন স্বামী দিতে পারে এটা? কার এমন আত্মা আছে, শুনি? কয়জন স্বামী পারে বিয়ের প্রথম রাতেই বউকে এতোটা ভালোবাসা দিতে, বলুন?…

তারপর আবারও কান্নার আওয়াজ।

প্রত্যয়দের ঠিক নিচের রুমটাই ওর আপু দুলাভাইয়ের রুম, অনুর এমন কান্নাকাটি আর আহাজারি শুনে প্রত্যয়ের দুলাভাই আপুকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বললেন,
—- তোমার ভাইয়ের একটু সংযত হওয়া উচিৎ ছিল অন্তুর আম্মু। মেয়েটার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে, এতো কান্নাকাটি করছে। বিয়ের প্রথম রাতেই এভাবে পশুর মতো আচরণ কেউ করে?

স্বামীর কথাকে মুখ বাঁকিয়ে অগ্রাহ করে প্রত্যয়ের আপু ঝাঁজিয়ে বলে উঠলো,
—- নিজে কি করেছিলে সে কথা ভুলে গিয়েছো? এখন আবার আমার ভাইকে দোষারোপ করা হচ্ছে, চুপচাপ ঘুমাও, ওদেরটা ওরা বুঝে নিবে।

************************

অনেকক্ষন হলো রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদে
দাঁড়িয়ে আছে অনু। প্রত্যয় গিয়েছে ফ্রেশ হতে, তাই অনু একাই দাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে আপাতত ।ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার ঝাপটা ওর ক্রন্দনরত মুখ মন্ডলে আঁচড়ে পরছে ক্রমশ।

হাওয়ার তালে তালে আধ ভেজা রেসমের মতো চুলগুলোও ইতি উতি উড়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনের আঙিনায় জ্বলতে থাকা মরিচ বাতির রোশনাইএ ছাঁদটাও আলোকিত। আকাশের উজ্জ্বল হাসি হাসি চাঁদখানা এতোক্ষণে মেঘের আড়ালে ঢাকা পরেছে। কালো মেঘের গা থেকে খসে খসে পরছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বাতাসের তোপে সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি খুব একটা গায়ে লাগছে না যদিও।

বৃষ্টি ঝরা ফুটো আকাশের দিকে তাকিয়ে অনু আজ তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে, ভীষণ তৃপ্তিতে অজানা তারকারাজিদের উদ্দেশ্যে মনটা বারবার চিৎকার দিয়ে বলতে চাইছে,
—- শুনছো তোমরা, পৃথিবীটা এতোটাও খারাপ নয়, শুধু বদলে দেওয়ার জন্য একটা মানুষ প্রয়োজন, এই যা।

অনু যখন অদূরে আকাশ পানে চেয়ে মনের খুশিতে মন দিয়েই চিৎকার করছিল, ঠিক সেই মূহুর্তেই নিজের উন্মুক্ত বাঁকানো কোমড়ের খাঁজে শীতল দুটো হাতের স্পর্শে শিরশির করে উঠলো অনুর সর্বাঙ্গ। একটু কেঁপে উঠে অনু পেছনে ঘুরবে, তার ফুরসত দিলোনা প্রত্যয়,বরং আরও শক্ত করে ওর কোমড়টা চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করালো অনুকে,তারপর ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বললো,
—- তোমার ইমোশনের পাল্লায় পরে রাত তো শেষ হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম। এবার একটু ইমোশন টাকে সামলাও, আমি যে বেসামাল।

অনু সাদা মনে বললো,
—- রাত তো শেষ হবেই, রাত না শেষ হলে দিনের আলো ফুটবে কি করে শুনি?

প্রত্যয় অনুর কাঁধে টুকরো চুমু খেয়ে ভারী নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
—- আজকের রাতটা যে আমাদের বহু আকাঙ্খিত রাত জান , থাকনা একটু বেশি সময় ধরে এই আধার টুকু। ক্ষ’তি কি?

অনু নির্বাক, প্রত্যয়ের অবাধ্য স্পর্শে ওর গলা জড়িয়ে আসছে, শরীরের তোরনে তোরনে বয়ে যাচ্ছে শিহরণ জাগানো নাম না জানা এক সাইক্লোন। ও খুব করে চাইছে প্রত্যয়ের হাত দু’টোকে স্থির রাখতে কিন্তু পারছে না, প্রত্যয়ের হাতদুটো অবাধে বিচরণ করছে অনুর সমস্তটা জুড়ে। অনু কোনোমতে ছাঁদের পাঁচিলটা শক্ত করে দু’হাতে খামচে ধরে মাথা নুইয়ে রেখেছে। প্রত্যয় দু’চোখ বুঁজে অনুর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিতেই এক পর্যায়ে তীব্র সংকোচে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রত্যয়ের বুকেই মুখ লুকালো অনু।

প্রত্যয়ের বোধ হয় আজ এসব লজ্জা টজ্জা পছন্দ হচ্ছে না, তাই অনুকে খুব একটা আস্কারা না দিয়ে ওর ঠোঁটের ভাঁজে নিঃসংকোচে নিজের আধিপত্য বিস্তার করলো প্রত্যয়,এরপর সেভাবেই অনুকে কোলে তুলে নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ওদের সাজানো গোছানো চিলে কোঠার ঘরের দিকে। অনু বেশ কসরত করে প্রত্যয়ের ঠোঁট দুটো থেকে ছাড়া পেয়ে অস্ফুটে শুধালো,
—- কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন?

প্রত্যয় দ্রুত গতিতে পুনরায় অনুর অধর জুগলে অধর ডুবিয়ে হিসহিসিয়ে জবাব দিলো,
—- তোমার লজ্জা ভাঙাতে।

*************************************************

শেষ রাতের তীব্র বর্ষনে চারিদিক কর্দমাক্ত। আজকেও আবহাওয়া বেশ শীতল। হয়তোবা এই বর্ষা বর্ষা আবহাওয়াটা এবার বেশ কয়েকদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে।

স্টেট আমেরিকার মতো দেশ থেকে ফিরে পুরান ঢাকার এই ভাঙাচোরা পিচ ঢালা রাস্তা ধরে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সায়রের। স্পঞ্চার শীপ থেকে পাওয়া পায়ের লাল সবুজ ট্যাগ লাগানো গুচ্ছি ব্র্যান্ডের জুতোটাও কাঁদায় মাখামাখি,যা দেখে এই মূহুর্তে এই কাঁদায় বসেই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সায়রের।

চিপাগলি নিবাসী ওই ঝাঁজ ওয়ালা মেয়েটাকে কান ধরে টেনে এনে৷ এসব দেখিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
— দেখ রাগীনির বাচ্চা, দেখ। তোর জন্য আমার লেটেস্ট ব্র্যান্ডের জুতোটার মান ইজ্জত কাঁদায় ডুবে গড়াগড়ি খাচ্ছে , তবুও রাগ দেখাবি? কথায় কথায় মুখ ঝামটি দিবি? কিসের এতো তেজ তোর? এই টুকুনি চুনোপুঁটির মতো শরীর আবার আমাকে তেজ দেখায়।হুহ!

একমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে চিপাগলি নিবাসী সেই রাগীনির বাড়ির সামনে এসেই থামলো, তা টের পায়নি সায়র নিজেও যখন। গন্তব্য যখন এখানেই তাহলে জানা অজানা দিয়ে কিই বা আসে যায়?

সায়রের ও যায় আসলো না। ও আজ আর উঁকি ঝুঁকিও দিলোনা, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে গিয়ে বাইরের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠে গেলো নীলিমাদের শ্যাওলা পরা ছাঁদে।

আজকে আর নীলিমা নাচ করছে না, ঘুঙুর সমেত ছাদে এলেও সেগুলো আপাতত অযত্নে ছাদের এককোনায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, আর নীলিমা ছাদের পাঁচিলে কনুই দিয়ে ভর করে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে, দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক অস্থির ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে মেয়েটা।

নীলিমা কি নিয়ে ভাবছে তা বোধগম্য হলোনা সায়রের, তাই ও পেছন থেকে আচমকা ডেকে উঠে নরম গলায় বললো,
—- নাচবে না আজ আর? আমিতো দেখতে এলাম।

নীলিমা চমকে উঠলো না, তরিঘরি করে পেছনেও চাইলো না, ভাবটা এমন যেন ও সায়রের উপস্থিতি টের পেয়েছে। বাতাসের সাথে ভাসমান সায়র সায়র গন্ধটা নীলিমা বুঝতে পেরেছে। আদতে তেমন কিছু কিনা কে জানে?
তবে নীলিমা আপাতত আস্তে ধীরে ঘুরে তাকিয়ে চোয়ালটা শক্ত করে সায়র কে বলে ওঠে,
—- কি চাই, আবার কেন এসেছেন?

সায়রের গায়ে লাগলো না নীলিমার চরম তিক্ত কথাগুলো, ওর এতোদিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে অর্ণব কেন এতো নি’র্লজ্জ।

সায়র নিজেও এই মূহুর্তে অর্ণবের পন্থাটাই অবলম্বন করলো, নীলিমার কথাতে ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে গিয়ে নীলিমার সামনে দাড়িয়ে বুকের বাম পাশে হাত রাখলো। অতঃপর কোনোরূপ কপটতা না করেই কাতর কন্ঠে বললো,
—- কেন যেন সকাল থেকে বুকটা জ্বলে যাচ্ছিল, অযথাই দম আটকে আসছিল,চোখ দুটোও দারুন তৃষ্ণার্থ, কেন যেন মন বলছিল তোমার দেখা পেলে সব অসুখ এক নিমিষে সেরে যাবে, তাই সবার অগোচরেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি নীলিমা। কেউ জানেনা আমি এখানে।

সায়র নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে এই প্রথম নীলিমার নামটা উচ্চারণ করলো, যা নীলিমাকে অবাক করে দিতে সক্ষম।

নীলিমা অবাক হয়ে চট করে সায়রের চোখ চোখ রাখলে, সায়র আবার বলে,
—- চেয়ে দেখো, এখন আমি পুরোপুরি ফিট, আই থিংক আমার অসুস্থতার মোক্ষম কারন টা ই তুমি, তোমাকে বোধ হয় আমার লাগবে।

সায়রের কথায় নীলিমার কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরলো, ও তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছু’ড়ে শুধালো,
—- লাগবে মানে? আমি কি জড়বস্তু নাকি? আর তাছাড়া আমার….

নীলিমার কথাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে সায়র শান্ত চোখে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
—- আমি বলেছি লাগবে, তার মানে লাগবে, তুমি আমাদের ফ্রেন্ডস জোনটাকে যতটা শান্ত আর নিরিবিলি ভাবো আমরা ততটাও সভ্য প্রজাতির নই। সব কটার ব্যাকরাউন্ড উত্তপ্ত কয়লার মতোই দ’গ্ধ। খুব বেশি নাড়াচাড়া করতে এসোনা পু’ড়ে যাবে তাহলে।

নীলিমা বুঝলোনা সায়রের কথার আগামাথা, তবে সায়র যে বেশ সাবলীল ভাষায় শান্ত স্বরে ওকে হু’মকি দিয়েছে সেটা খুব ভালো মতোই ধরতে পেরেছে ও।

এই মূহুর্তে কারও মুখে রা নেই, দুজনই দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে নিরবতা পালন করছে ওরা, হয়তোবা দু’জন দুজনার চোখের ভাষা পড়ে ফেলার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।

তবে ওদের এই দীর্ঘক্ষনের চোখাচোখির অবসান ঘটিয়ে হুট করেই ছাঁদে চলে আসে নীলিমার আব্বাজান তাইয়েব জামান।

তিনি ভেতরের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে হাঁপানো সুরে বলেন,
—- আম্মাজান,বাজার নিয়া আইছি, রাতের খাওন টা….

তিনি বাক শক্তি হারিয়ে ফেললেন তখন যখন দেখলেন, অচেনা এক সুদর্শন যুবক তার ছাদে দাঁড়িয়ে তার দিকেই হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে এই মূহুর্তে ।

তাইয়েব জামান মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক গলিয়ে সায়রকে আগা গোড়া পরখ করে গম্ভীর গলায় বললেন,
—- ওই মিয়া তুমি ক্যাঠা? এই মহল্লায় তো তোমারে আগে দেখি নাই। মাগার চেনা চেনা লাগতাছে।

সায়র তাইয়েব জামানের কড়া গলার প্রশ্নে জবাব দেওয়ার আগে নীলিমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে শুধালো,
—- এই তোমার আব্বাজান?

নীলিমা হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, সায়র আবার তাকালো তাইয়েব জামানের দিকে,
সবুজ পাঞ্জাবি পরিহিত ছিপছিপে গড়নের লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এক সভ্য পুরুষ, চোখ মুখে কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য আর রাশভারি ভাব থাকলেও, এ মোটেও সায়রের ভাবনার ধারে কাছেও নেই।

সায়র তো ভেবেছিল নীলিমার আব্বাজান নিশ্চয়ই পেট মোটা, গোঁফ ওয়ালা, কুচকুচে কালো দেখতে কোনো পালোয়ান হবে হয়তো। যে সারাদিন সাদা লুঙ্গি ধরে ধরে পান চিবোয়, আর একে ওকে ধরে মে’রে তক্তা বানিয়ে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু এই লোকটাকে তো যথেষ্ট ভদ্রলোক মনে হচ্ছে, নাহ মিললো না। সায়র হতাশ, ভারী হতাশ। সেই হতাশা থেকেই সায়র মলিন মুখে অবিশ্বাসের সুরে ঠোঁট উল্টে আরও একবার প্রশ্ন করলো নীলিমাকে,
—- উনি আসলেই তোমার বাবা তো?

সায়রের কথায় এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো নীলিমা, তেঁতো গলায় বললো,
—- আশ্চর্য! এ আবার কেমন কথা? দেখছেন আমার আব্বাজান, তাও ভুলভাল বকে যাচ্ছেন?

—- ওই মিঁয়া, আমার লগে কথা কও তুমি? আমগো ছাঁদে কি কাম তোমার?

নীলিমার আব্বাজানের প্রশ্নে সায়র একটু গলা খাঁকারী দিয়ে বললো,
—- ইয়ে মানে আঙ্কেল, পানি খেতে আসছিলাম, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তো।

তাইয়েব জামান বুঝতে পারার মতো করে হালকা মাথা নাড়িয়ে বললেন,
—-অহ, এইডা আগে কইবা না? আহো তাইলে নিচে আইসা পানি খায়া যাও।

এরপর নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,
—-আম্মাজান, মেহমানরে পানি দাও।

নীলিমা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, সায়রের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বললো,
— আসুন।

নিচে গিয়ে সায়র সবার আগেই নীলিমার রুমে প্রবেশ করে, পুরো রুমটা গার্লি জিনিস পত্র দিয়ে ভরা। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সায়র বুঝতে পারে নীলিমার এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিস অনেক। তার চেয়েও বেশি গোছানো আর পরিপাটি ওর রুম।

ছবি আঁকার ক্যানভাস ও রয়েছে রুমের এক কোনে, যেখানে সূর্যাস্থের অর্ধেক পেইন্টিং এখনো অসম্পন্ন। অসম্পন্ন ক্যানভাস দেখে সায়রের বোধগম্য হলো, দেওয়াল জোরা পোট্রেড গুলো তাহলে নীলিমার নিজের হাতেই আঁকা। মেয়েটা আসলেই ট্যালেন্টেড, এই পর্যায়ে এসে নীলিমাকে সূর্যের সঙ্গেই তুলনা করে বসলো সায়র, মনে মনে হাজারটা বাহবা দিয়ে বললো,
—- যেমন তেজ, তেমন তার গুণ। কিন্তু নীলিমার আম্মা কোথায়?

সায়রের মাথায় প্রশ্নটা আসতেই রুমে প্রবেশ করে নীলিমা, হাতে ছোট্ট ট্রে, তাতে একবাটি ক্ষীর আর এক গ্লাস পানি।

নীলিমা সামনে এসে দাড়ালে সায়র পানির গ্লাসটা নিতে নিতে বললো,
— ক্ষীর কে বানিয়েছে?

নীলিমা থমথমে মুখে উত্তর দিলো,
— আমিই।

তৎক্ষনাৎ পানির গ্লাস রেখে ক্ষীরের বাটিতে হাত দিলো সায়র, নীলিমা চেয়ে আছে এক ধ্যানে, সায়র গপাগপ করে ক্ষীর খেতে খেতে মৃদু হেসে বলে,
—– উমম!আমার লাইফের বেস্ট ক্ষীর এটা।

এবার নীলিমাও ঠোঁট কামড়ে সামান্য হাসলো, যা সায়রের দৃশ্যগত হওয়ার আগেই আবার উবে গেলো।

সায়র খেতে খেতে আবারও প্রশ্ন করে বললো,
—- আচ্ছা শাশুড়ী আম্মা, না মানে তোমার আম্মা কোথায়?

নীলিমা কোনোরূপ দুঃখ প্রকাশ না করেই স্বাভাবিক ভাবে বললো,
—- আম্মা নেই, আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময়ই আম্মা দুনিয়া ত্যাগ করে, তারপর থেকেই আমি আব্বা আর নয়ন মিলেই আমাদের পরিবার। ওই জন্যই তো আমি দূরে কোথাও…

নীলিমা মাঝপথেই কি ভেবে যেন থেমে গেলো। সায়র ওকে আস্বস্ত করে বললো,
— হ্যা বলো?

নীলিমা পুনরায় বলতে আরম্ভ করে,
—- ওই জন্য আব্বা আর ভাইকে ছেড়ে আমি দূরে কোথাও যেতে পারবো না, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আমার মহল্লারই.. এতো কাছাকাছি দেখেই বিয়ের প্রস্তাবে আর না করিনি।

—- হয়েছে থাক, বিয়ের পরে এতো বাপের বাড়ি নিয়ে ভাবলে হয়না, দরকার পরলে তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী আমেরিকা নিয়ে যাবো।

— কিহ!!

ক্ষীরের বাটিটা ঠাস করে ট্রেতে রেখে, কথাগুলো বললো সায়র, অতঃপর ঢকঢক করে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে উঠে দাড়িয়ে নীলিমাকে শুধালো,
—- তোমার আব্বাজান কোথায়?

নীলিমা আঙুল উঁচিয়ে বসার ঘরের দিকে দেখিয়ে দিলে, সায়র বড়বড় পা ফেলে তাইয়েব জামানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

তাইয়েব জামান তখন পেপার পড়ায় ভীষণ মনোযোগী, সায়র তার হাত থেকে ছো মে”রে পেপারটা টেনে নিয়ে পাশের টি-টেবিলে রেখে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে করতে মনেমনে বললো,

—- খুব শীঘ্রই আপনাকে বড়সড় একটা ঝটকা দিতে যাচ্ছি আব্বাজান, আশা করি আল্লাহ আপনাকে ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করবেন,আমিন।

চলবে……