#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫০
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
( কঠোর এবং কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)
(আজকের পার্ট দূর্বল চিত্তদের জন্য নয়)
দুদিন ধরে ভারী বর্ষন, দার্জিলিং এর সবুজ স্নিগ্ধ আবহাওয়া ভারী বর্ষনে ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে। আকাশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বুনো মহিষের পাল। কখন দিন আর কখন রাত তা ঠাওর করা দায়।
দু’দিন বৃষ্টিতে হোম’স্টে এর কটেজ থেকে বেরোতে না পারলেও,পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেদের ভেলার সাথে খুনসুটি জমিয়ে বৃষ্টি মূখর দিনগুলো খুব একটা খারাপ কাটেনি অরুদের।
ওরা কখনো একসাথে বসে মনোপলি খেলায় মেতেছে, আবার কখনো গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে নিঃসংকোচে গান ধরেছে একই সুরে, মুশল ধারার বর্ষন কিছুটা কমে এলে ছেলেরা তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে শহরের দিক থেকে খাবার কিনে এনেছে ,আর মেয়েরা খুব যত্ন করে সেগুলো রান্না করে সবাইকে পরিবেশ করেছে। একেক দেশের একেক জন মিলেমিশেই যেন আস্ত একটা পরিবার ওরা।
নিজেদের বউকে কিছুটা ফুরসত দিতে কখনো বা পার্সেলও নিয়ে এসেছে ছেলেরা।
একসাথে মিলেমিশে গল্প, আড্ডা, খুনসুটি, দুষ্টমি অতঃপর দিন শেষে যে যার মতো জোড়ায় জোড়ায় ফিরেছে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত কটেজে। হয়তোবা ভালোবাসার মানুষের সাথে মধু রাত্রি যাপন করতে, নয়তো মনের মাঝে দমিয়ে রাখা একরাশ কাতরতা আর হতাশা নিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমাতে ।
আর এভাবেই পার হয়েছে ওদের দার্জিলিং এর ঘরবন্দী দুটো দিন।
আজ সারাদিন বৃষ্টি নেই,তবে আকাশ গুমোট হয়ে ধূসর রঙ ধারণ করে আছে। এইতো কিছুক্ষণ হলো দিনের সুক্ষ্ম নিয়ন আলোতে আঁধারের পর্দা টেনে দিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ধরনী জুড়ে। বাইরে মেঘ ডাকার গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে, এক পশলা ঝুম বৃষ্টি এক্ষুনি নেমে এলো বলে।
আর ভেতরে আঙুলের ভাঁজে শাড়ির কুঁচি ধরে কোমড়ে গুঁজতে ব্যস্ত লতানো মোহনীয় শরীরের অধিকারীনি সদ্য যৌবনে পা রাখা মারাত্মক এক রূপসী যুবতী।
টকটকে লাল শীফনের শাড়িটা কোনমতে পড়া হয়ে গেলে, অরু ব্যস্ত হাতে আঁচল ঠিক করতে শুরু করে, প্রথমে সবসময়ের মতো আঁচলটা বাহু থেকে ছেড়ে দিলেও আজ কি ভেবে যেন আঁচল গুটিয়ে রাখলো কাঁধের উপরিভাগে। যার দরুন এক ফালি নির্মেদ কোমড়ের রহস্য উন্মুক্তই রয়ে গেলো।
হাতের কাজ শেষ করে অরু ঘুরে দাড়ালো কটেজের দেওয়ালে লাগোয়া অত্যধুনিক গোলাকার আয়নাটার দিকে, যেখানে ভেসে উঠেছে এক লাস্যময়ী সুন্দরী রমনীর নিদারুণ প্রতিবিম্ব। আয়নার প্রতিবিম্বতে নিজেকে সুন্দরী আবিষ্কার করে নিজেই লাজুক হাসলো অরু, তারপর কাঠের স্টুল টেনে বসে পরলো মাথা ভর্তি রেশমের মতো চুলগুলো আঁচড়াতে। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতেই অরু ভাবতে লাগলো আজ সারাদিনের কথা,
আজ বৃষ্টি ছিলোনা বলেই দু’দিন বাদে সবাই মিলে বেরিয়েছিল ওরা। স্যাতস্যাতে আবহাওয়ার মাঝেই রকগার্ডেন, রেইনবো ফলস, পাম ফরেস্ট সবখানেই একটু করে ঢু মেরে, আবারও শহরের দিকে ফিরে এসেছে ওরা সবাই মিলে।
যেহেতু শহরটা সায়রের, তাই আজকের ট্যুর গাইড ও সায়র। ও সবাইকে এটা ওটা দেখাতে ব্যস্ত।
ওদিকে সারাদিন অরু নীলিমা আর এলিসারা এক সাথেই ছিল, আগমন টা যেভাবেই হোকনা কেন, হুট করে নিজেদের স্বপ্নের শহরে পা রেখে দু’বান্ধবীই পুলকিত ওরা, যার ফলরূপ উচ্ছ্বাসের কোন ঠিক ঠিকানা নেই ওদের।দুজন হাতে হাত ধরে হাটছে তো কখনো আবার দাঁড়িয়ে পরে একজন আরেকজনের ক্যামেরা ম্যান হয়ে ছবি তুলে দেওয়ার মোক্ষম দায়িত্ব পালন করছে।
এতো উচ্ছ্বাস, এতো উদ্দীপনার মাঝেও ক্রীতিকের চোখ মুখ ছিল বিষন্নতায় ঘেরা,চাহনীতে ছিল অমাবস্যার মতোই কালো মেঘের ঘনঘটা। সবার মাঝে উপস্থিত থেকেও যেন কিছু একটা নিয়ে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল ওকে। গতানুগতিক বেপরোয়া চলন বলনের মাঝেও ওর চোখের সেই অপারগ দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপটুকু স্পষ্ট খেয়াল করেছে অরু।
ক্রীতিক কখনো ফোন স্ক্রল করেছে তো কখনো সবার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্মোক করেছে, এমনকি পরনের কালো রঙা হুডিটার চেইনটা যে বক্ষস্থল পর্যন্ত খুলে ভেতরের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটা দৃশ্যমান সে খেয়াল অবধি নেই ওর।
এতো আনন্দের মাঝেও এই সবকিছু চোখ এড়ায়নি অরুর। ক্রীতিককে এভাবে বিষন্ন মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অরু যতবারই ওর শুকনো মুখশ্রীর পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে,ঠিক ততবারই ক্রীতিকের চাহনিতে বুক কেঁপে উঠেছে অরুর। টলটলে দীঘির জলের মতো চোখ দুটোতে কি ভীষণ কাতরতা আর অপরাগতা তা কেবল অরুই টের পেয়েছে। ক্রীতিকের এমন ভগ্ন চাহনি দেখলে হৃদয়ে ভীষণ তোলপাড় হয় অরুর, বারবার মনে হয় সবার সামনেই ছুটে গিয়ে ক্রীতিকের বুকে ঝাপিয়ে পরতে,ওর ভাসা ভাসা চোখের পাতায় আবেশিত চুমু এঁকে দিয়ে দৃঢ় গলায় বলতে,
— এই তো আমি। তোমার বুকেই আছি,তাহলে কেন এই কাতরতা বলো?
কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়,কারণ ক্রীতিকের মতো ছন্নছাড়া, বেপরোয়া অরু নয়, যথেষ্ট লজ্জা আর সংকোচ রয়েছে ওর মধ্যে। তাই এবার নীলিমাকে রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরু দাঁড়ালো ক্রীতিকের পাশ ঘেষে, অরু পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখ নামিয়ে এক ঝলক ওকে দেখে নিয়ে পুনরায় চোখ সরিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়ার কুন্ডলীতে মন দেয় ক্রীতিক।
ক্রীতিকের এহেন মুড অফ হওয়ার কারনটা যে ও নিজেই তা ভালোমতোই আঁচ করতে পারছে অরু। তবুও কিছুটা সংশয় নিয়ে কাঁপা কন্ঠে ক্রীতিককে শুধালো,
— কি হয়েছে, ঠিক আছেন আপনি।
অরুর কথায় ক্রীতিক আবারও সেই ব্যথাতুর চাহনি নিক্ষেপ করে, নরম গলায় জবাব দিলো,
— উমম, ঠিক আছি।
তারপর আর কোনো কথা নয়, অর্ণব আর সায়রকে ডাকতে ডাকতে অরুকে একপ্রকার এড়িয়েই ওখান থেকে চলে গিয়েছে ক্রীতিক।
এরপর সারাটাদিন অতিবাহিত হলো, অথচ দুজনার একটা বাক্য ও কথা আদান-প্রদান হয়নি, বেখেয়ালে দুজনার চোখচোখি হয়ে গেলে ক্রীতিকের ব্যাকুল দু’চোখ অরুকে ব্যথা দিয়েছে বারবার, এতো আনন্দের সবটাই কেমন ফিকে লেগেছে অরুর নিকট।
অবশেষে সন্ধ্যা নামতেই হৃদয়ের মাঝে একরাশ ব্যথাতুর অনুভূতি নিয়ে কটেজে ফিরেছে অরু। কটেজে ফিরে বেডরুমে প্রবেশ করে আর একমুহূর্ত ও অপেক্ষা করেনি ও, দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পরেছে ক্রীতিকের জন্য নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করার কাজে।
*************************************************
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে,বৃষ্টির ফোঁটার ঘনত্ব কম,তাই গায়ে লাগছে না মোটে,ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই পাহাড়ের চূড়ায় হোম স্টে এর ফ্রন্ট ইয়ার্ডের কাঠের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব, সায়র,আর ক্রীতিক। তিনজনের হাতেই একটা করে সিগারেটের শলাকা।ওদের নিঃশ্বাসের তালে তালে অন্ধকারের মাঝেই সেই শলাকা গুলো জ্বলছে আবার নিভছে।
নিকোশ আধারে পাহাড়ের ঢালে এক আধটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে অর্ণব দৃষ্টি নিক্ষেপন করে সায়রের দিকে, সায়র তখনো নির্লিপ্ত চোখে কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ পানে চেয়ে আছে, সে’সময় অর্ণব হাত বাড়িয়ে ওর পিঠ চাপড়ে বলে ওঠে,
—- নীলিমাকে উঠিয়ে নিয়ে এলি ভালো কথা, এবার কি করবি? কিছু ঠিক করেছিস?
সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— ভিসা পাসপোর্টের প্রসেস চলছে,কাজ হলেই ওকে নিয়ে ফিরে যাবো।
— আর তোর পুরান ঢাকাইয়া শশুর?
অর্ণবের কথায় সায়র কিছু একটা ভেবে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বললো,
—- আমার মনে হয়না নীলিমা যতটা ভ’য় দেখিয়েছে শশুর আব্বা অতোটাও ডে’ঞ্জা’রাস। কিছুদিন হয়তো রেগেমেগে বাঁশ হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে,চিল ব্রো।
অর্ণব ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— তুইতো অলওয়েজই চিল, শশুরের ব’ন্দু’কের সামনে দাড়িয়েও বলিস চিল আব্বাজান। এতো চিল কই পাস?
অর্নবের কথায় সায়র মলিন হেসে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমরা তো ফিরে যাচ্ছি, তুই কি করবি?
সায়রের কথায় একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ক্রীতিকের বুক চিড়ে,কিছু্ক্ষন থম মে’রে থেকে ও বললো,
—- আপাতত যাচ্ছিনা, কোম্পানির অনেক কিছু এখনো আয়ত্তে আসেনি, সবকিছু বুঝে উঠতে আরও বছর খানিক সময় লেগে যাবে, তারপর না হয় ফিরে যাবো।
ক্রীতিকের কথার পাছে অর্ণব স্ব-ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে উঠলো,
—- কোম্পানি তো তুই হেড অফিস থেকেও সামলাতে পারবি, এখানে থাকতে হবে কেন?
ক্রীতিক বললো,
— অরুকে নিয়ে ভাবছি, আমাদের সম্পর্কটা আরেকটু স্বাভাবিক হোক, আমি ওর অভ্যেসে পরিনত না হলে কোনোকিছুই সম্ভব নয়। নয়তো দেখা যাবে ইউ এস এ তে ফিরে মা আর আপার জন্য কা’ন্নাকা’টি লাগিয়ে দিয়েছে।
ক্রীতিকের কথায় অর্ণব হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেও সায়র বাম হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
— কিন্তু অরুতো…. এ্যা,এ্যা,এ্যাহ…
সায়রের কথা জিহ্বা অবধি এসেই থেমে গেলো, কারণ এই মূহুর্তে নিজের বাহু দিয়ে ওর গলাটা চে’পে ধরে আছে ক্রীতিক, ওর হাতের বাঁধনটা ছাড়ানোর জন্য সায়র কাইকুই করছে খুব, অর্ণবের কাছেও সাহায্য চাইছে,অথচ অর্ণব মিনমিনিয়ে হাসছে আর স্মো’কিং করছে।
সায়রকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ক্রীতিক দাঁত কটমটিয়ে বললো,
— কতবার বলেছি আমার বউয়ের নাম মুখে নিবিনা তুই, কথা কানে যায় না?
সায়র খ্যাক খ্যাক কেশে উঠে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
—- আরে ভাই আমি বিবাহিত এখন, ছাআআড়!
—- বিবাহিত কেন? তিন বাচ্চার বাপ হলেও তুই আমার বউয়ের নাম মুখে আনবি না,ব্যাস।
ক্রীতিকের কথায় সায়র এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
— এমন ভাব করছিস যেন আমার মুখে জীবানু লেগে আছে, আমি তোর বউয়ের নাম মুখে নিলেই ফোস্কা পরবে।
— হ্যা পরবে,একশো বার পরবে, কারণ তুই পুরোটাই একটা ম’হামারী, আজ থেকে তোর নাম রাখা হলো সায়র ভাইরাস। আর আমি একদমই চাইনা আমার ওইটুকুনি বউটা তোর ভাইরাসে আ’ক্রান্ত হোক, দূর হ শালা।
কথাশেষ করে সায়রকে ধা’ক্কা মে’রে কাঁদার মধ্যে ফেলে দিলো ক্রীতিক। তা দেখে অর্ণব না চাইতেও মুখ ফসকে হো হো করে হেসে দিলো। ক্রীতিক ও নতুন উদ্যমে সিগারেট ধরিয়ে মিটমিট করে হাসি সংবরণ করছে, যথাসাধ্য চেষ্টা করেও মুখের আদলে গম্ভীর ভাবটা ধরে রাখা যাচ্ছেনা কিছুতেই। ওদের দু’জনার এহেন কপটতা আর ষ’ড়যন্ত্র:কারীর ন্যায় আচরণ দেখে সায়র কাঁদা ছাড়িয়ে উঠতে নিয়ে আবারও পিছলে পড়ে গিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,
— শালা মীরজাফরের দল, তোদের কোনোদিন ভালো হবেনা, বউয়ের হাতে সকাল সন্ধ্যা উত্তম মাধ্যম খাবি তোরা, এই আমি অ’ভিশাপ দিলাম।
*
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজ জানান দিচ্ছে রাত তখন বারোটা বেজে এক, বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হোম স্টে এর পুরো এরিয়াতে বিদ্যুৎ নেই। যার দরুন তিমিরে ঢাকা পরেছে পাহাড়ি এই নির্জন বসতিটা। অরু হাত বাড়িয়ে আলগোছে একটা চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে, এখন কিছুটা আলোকিত চারিপাশ।
বজ্রপাত বিহীন শান্ত কোমল বারিধারা, তাও দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কটেজের তকতকে মেঝে, তাই অরু এবার হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যস্ত হাতে হাট করে খুলে রাখা জানালাটা বন্ধ করে দিলো।
অরু যখন রিনঝিন চুড়ি বাজিয়ে দ্রুত হস্তে জানালা বন্ধ করছিল, ঠিক তখনই অন্যপাশ দিয়ে চুল থেকে বৃষ্টিকনা ঝেড়ে সরাতে সরাতে একপ্রকার ছুটেই রুমে প্রবেশ করে ক্রীতিক। রুমে এসে আবছা আলোয় অরুকে না দেখতে পেয়ে গলা ছেড়ে ডেকে উঠলো ও,
— অরুউউ?
ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে অরু তাড়াহুড়ো হাতে নিজের শাড়িটা ঠিকঠাক করে,চুলগুলো আরেকটু ভালো মতো পরিপাটি করে হাতে একটা রেড ভেলভেট কেক নিয়ে এগিয়ে গেলো মেইন ডোরের দিকে, ক্রীতিক এখনো একই যায়গাতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, অরু এগিয়ে গিয়ে ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ওর সামনে কেকটা বাড়িয়ে দিয়ে একগাল হেসে বললো,
—- হ্যাপি বার্থডে হাসবেন্ড, জন্ম দিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে। মোমবাতিটা নিভে যাবে ঝটপট কিছু উইশ করে ফেলুন।
— আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
ক্রীতিকের দুচোখে তখন জ্বলজ্বল করছিল একটুকরো মোমবাতির নিয়ন অ’গ্নিশিখা, অথচ কেকের দিকে ওর কোনো রকম নজরই নেই, মা’দকতার অনলে ডুবে যাওয়া ঘোর লাগা দুটো চোখ আটকে আছে অরুর কাজল কালো চোখে,কৃত্তিম উপায়ে রঙিন করা রোজি দুটো ফিনফিনে ঠোঁটের ভাঁজে আর তারপর সেই আকর্ষিত একফালি নির্মেদ বাঁকানো কোমড় যা ক্রীতিকের সুস্থ সবল মস্তিষ্কটাকে অচল বানিয়ে দিতে সক্ষম,আর সেই ঘোরের মাঝেই অস্ফুটে কথাটা বলে ওঠে ক্রীতিক। ক্রীতিকের কথার পাছে অরু স্ব-ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কিছু চাওয়ার নেই মানে? এ আবার কেমন কথা?
অরুর কথায় জবাব দিলো না ক্রীতিক, উল্টে অরুর আগাগোড়া ইশারা করে ওকে প্রশ্ন ছুড়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— , ইজ ইট মাই বার্থডে প্রেজেন্ট বেইবি ?
অরু জবাব দিলো না,তীব্র সংকোচে মাথাটা নিচু করে ফেললো তৎক্ষনাৎ । মৌনতা সম্মতির লক্ষন সেটা ভেবেই বাঁকা হাসি খেলে গেলো ক্রীতিকের ঠোঁটের আগায়। ও আচমকা হাত থেকে কেকটা রেখে অরুকে ছোঁ মে’রে নিয়ে চলে গেলো কটেজের ছাঁদ খোলা বারান্দায়। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফুটো হয়ে পতিত বৃষ্টিকনা এসে ভিজিয়ে দিলো অরুর সর্বাঙ্গ, সুন্দর শাড়ি,সাজগোজ,লম্বা চুল সবকিছু ধুয়ে মুছে স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেলো ওর সমগ্র মুখ মন্ডল।
— হার্টবিট, ইউ লুকস্ প্রিটি।
ব্যাস এতোটুকুই, আর কোনো কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না ক্রীতিক। বরং কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই দু’হাতে অরুর কোমড়টা শক্ত করে চেপে ধরে ওর গলার মাঝে হুট করেই দাবিয়ে দিলো নিজের মুখটা ।
প্রতিফলিত তীব্র আ’ক্রোশের ন্যায় একনাগাড়ের গাঢ় চুম্বন দিশেহারা করে দিচ্ছে অরুকে। ক্রীতিকের এমন আ’ক্রোশ দেখে এক পর্যায়ে অরুর মনে হচ্ছে, ওকে কোনো র’ক্তচো’ষা চেপে ধরেছে, এক্ষুনি নিজের লাল চোখ আর সূচালো দাঁত বের করে শরীরের সবটুকু র’ক্ত এক নিশ্বাসে শুষে নিয়ে যাবে সে, আর অরু পরে রইবে একটা নিথর র’ক্তহীন মানবী হয়ে।
বিষয়টা ভাবতেই অরুর গায়ে কাটা দিলো।রাতের আধারে,বৃষ্টির মাঝে ক্রীতিকের এহেন অতিরিক্ত উত্তেজনা দেখে কিছুটা ভীত ও হয়ে পরলো মেয়েটা, তাই ওকে নিজের থেকে সরানোর খুব জোর চেষ্টা করে কম্পিত গলায় অরু বললো,
— আরেহ অন্তত কেকটা তো কাটুন।
ক্রীতিক অরুকে এক ঝটকায় পেছনে ঘুরিয়ে ওর পোশাকের লাগোয়া ফিতেটা মুখের সাহায্যে টেনে খুলতে খুলতে হিসহিসিয়ে বললো,
— সব পরে খাবো, তার আগে…
মাঝ পথেই থেমে গেলো ক্রীতিক, দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে সন্দিহান গলায় অরুকে বললো,
—- বেইবি, এখন অন্তত এটা বলিস না যে তুই ফিট নেই। এখনো তোর…
আবারও থেমে গেলো ক্রীতিক, ভেতরের অস্থিরতাটা দমাতে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ।
অরুর পৃষ্ঠদেশ উন্মুক্ত, ক্ষুদ্র বৃষ্টিকনা গুলো নিঃসংকোচে ঠায় নিয়েছে সেথায়,অথচ আলো পিছলে যাওয়ার মতোই মসৃণতা তার। এতোক্ষণে তো অরুও ডুব দিয়েছিল অজানা এক ঘোর লাগা শিহরণে,আর এখন এতো ঠান্ডার মাঝেও চোখমুখ গরমে জ্বলে যাচ্ছে ওর, তবুও ক্রীতিককে আসস্ত করতে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো অরু।
ক্রীতিক ওর হ্যা এর মানে বুঝতে না পেরে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
— এভাবে যন্ত্রনা না দিয়ে, মুখে বল। জাস্ট ইউজ ইওর ওয়ার্ড।
ক্রীতিকের ধমকে অরু কেঁপে উঠে নরম গলায় রিনরিনিয়ে বললো,
— ঠিক আছি।
অরুর কথাটা বলতে যতক্ষণ, তার পরক্ষনেই ঝড়ের গতিতে ওকে পুনরায় কাছে টেনে নিলো ক্রীতিক।
দিনশেষে আরও একবার অরুকেই সহ্য করতে হলো এই বেপরোয়া,খামখেয়ালি লোকটার উন্মাদনায় মত্ত মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসাময় এক দিশেহারা ঝড় তুফানের রাত। যা ওর নিকট চিরস্মরণীয়।
********************************
বেলা বেজেছে অনেক, তবে চারিদিকে চোখ বোলালে মনে হচ্ছে মাত্রই ভোর হলো। মেঘের চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি,বৃষ্টি হচ্ছে দফায় দফায়, তার মাঝেই বাইকার জ্যাকেট আর লেদার প্যান্ট পরে ফ্রন্ট ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে দুরবিনের সাহায্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখার চেষ্টা করছে ক্রীতিক।
অরুর মাত্রই ঘুম ভেঙেছে, পরনে এখনো ক্রীতিকের হুডি, সেভাবেই একজোড়া হ্যালো কিটি পায়ে চড়িয়ে কটেজ থেকে বের হয়ে এলো ও।
ফ্রন্ট ইয়ার্ডে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে চোখ ডলতে ডলতে ক্রীতিকের পাশ ঘেষেই দাঁড়িয়ে পরে অরু। অরুর আগমন টের পেয়ে দুরবিন থেকে চোখ সরিয়ে ওর কপালে শব্দ করে চুমু খেলো ক্রীতিক, অতঃপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— গুড মর্নিং বেইবি।
আদুরে বিড়াল ছানার মতো দু’হাতে ক্রীতিককে শক্ত করে আগলে ধরে আহ্লাদী গলায় অরু বললো,
— গুড মর্নিং, কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন?
— রাইডিং এ।
ক্রীতিকের কথায় অরু হকচকিয়ে উঠলো, ঘুমের ঘোর কেটে গেলো তৎক্ষনাৎ, সটান হয়ে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন গলায় অরু বললো,
— পা’গল আপনি? এই বর্ষায় কেউ রাইডিং এ যায়?
ওর কথায় ক্রীতিক ফিচেল হেঁসে জানালো,
—- পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মাঝে রাইডিং এর থেকে এডভেঞ্চারাস আর কি হতে পারে হুম?
অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
—- তাহলে আমিও যাবো।
ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ অরুর কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,
—- নো ওয়ে, তুই এখানেই থাকবি।
— কেন,আমি গেলে সমস্যাটা কি?
ক্রীতিক দুরবিনে নজর দিয়ে বললো,
— রাস্তাঘাট পিচ্ছিল, তার উপর একটু পরপর বৃষ্টি হচ্ছে এখন তোকে নেওয়া যাবে না।
অরু রুদ্ধ আওয়াজে বলে উঠলো,
— তারমানে আপনি বলতে চাইছেন রাস্তায় রি’স্ক আছে তাইতো?
—- সেটা কখন বললাম?
— এই যে এখন।
ক্রীতিক ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমি তেমন কিছু…..
— তাহলে আমাকে নিয়ে যান, আমিও আপনার সাথে রাইডিং এ যেতে চাই।
ক্রীতিকের কথার মাঝেই চট করে কথাটা বলে ওঠে অরু।
ক্রীতিক ওকে চোখ পাকিয়ে কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো,
— জিদ করছিস কেন? বলেছিতো নেব’না।
সারা রাতভর এতো ভালোবাসা দেওয়ার পরে সকাল সকাল ক্রীতিকের এতোটুকু শক্ত কথাও বেশ গায়ে লাগলো অরুর। অরু হলফ করে বলতে পারে, রাতের ক্রীতিক আর এখনকার ক্রীতিকের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যাবধান। কেন যেন না চাইতেও অভিমানি অশ্রুজলে টলটল করে উঠলো ওর দুচোখ। অরুর চোখে পানি ব্যাপরাটা বোধগম্য হতেই ক্রীতিক দ্রুত হস্তে ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,
— কাঁদছিস কেন বেইবি?এখনো শরীর খারাপ লাগছে?পেইন কি’লার নিয়েছিলি?
অরু ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
— আমাকেও নিয়ে যান, প্লিজ। আমিও আপনার সাথে যেতে চাই।
অরুর অসহায় আবদারের কাছে চরম ভাবে হেরে গিয়ে একটা তপ্ত অপারগ নিঃশ্বাস ছাড়লো ক্রীতিক,অতঃপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—- ঠিক আছে নিয়ে যাবো, তবে আমার মতো, লেদারসুট, গ্লাভস, সেইফটি প্যাড সবকিছু পরতে হবে। বল রাজি?
ক্রীতিকের কথার পাছে অরু মুচকি হেসে জোরে জোরে মাথা ঝাকালো।
*
বাইরে মুশলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, তারমধ্যেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে সিটং এর দিকে শাঁই শাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকটা। ক্রীতিক খুব সাবধানে স্পিডোমিটারের গতি কমিয়ে বাইক রাইড করছে, যা অরুর কাছে প্রচন্ড বোরিং লাগছে, বাইকে বসে ঠেলা গাড়ির ফিল নিতে নিতে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে অরু ক্রীতিকের দিকে ঝুঁকে গিয়ে বললো,
— এতো আস্তে চলছে কেন বাইকটা? আপনি না রাইডার? এই আপনার রাইড? আবার আমাকে দিয়ে সেইফটি প্যাড ও পরিয়েছেন। হুহ!
অরুর কথায় ক্রীতিক কপট হেসে বললো,
—- তোর যে ফাস্ট রাইডিং পছন্দ সেটা আগে বলিস নি কেন? আমি আরও ভাবলাম ছোট মানুষ।
ক্রীতিকের কথার আগামাথা না বুঝে অরু ভ্রুকুটি করে বললো,
— আপনি কি বলতে চাইছেন?
— কিছুনা ধরে বস।
ক্রীতিকের কথামতো অরু ওর কাঁধে রাখা নিজ হাতের বাঁধনটা জোড়ালো করতেই স্পিডোমিটারের গতি দিগুণ বাড়িয়ে ফেললো ক্রীতিক। সচকিত চোখে রাইড করতে করতে সামনের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে অরুকে শুধালো,
—- আর ইউ ওকে বেইবি?
ওর প্রশ্নের জবাবে অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, সঙ্গে সঙ্গে স্পিডোমিটারের গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ক্রীতিক। এবার অরু আর তাল সামলাতে না পেরে আচমকা পরে গেলো ক্রীতিকের পিঠের উপর। ক্রীতিক একই ভাবে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে হেলমেট পরিহিত অরুকে বললো,
—- এভাবে নয়, শক্ত করে জড়িয়ে ধর।
অরু ধরলো। এরপর আর কোনো কথা নয় দুজনই চুপচাপ একটা লং রাইডিং উপভোগ করতে লাগলো পুরোটা সময় ধরে। এতোক্ষণ একই ভাবে বসে থাকায় অরুর বেশ সাহস বেড়েছে, ও হুটহাট করেই দু’হাত মেলে দিচ্ছে মুক্ত নীড় হারা পাখির ন্যায়। অরুকে চুপচাপ রাইডিং উপভোগ করতে দেখে ক্রীতিক ডেকে বললো,
— বেইবি, হাউ ইজ ইট?
অরু মুক্ত বাতাসে দু’হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— দারুন, আমাকে এভাবে প্রশান্তির সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও আপনার আয়ু বাড়ুক, আমার সব আয়ু আপনার হোক।
অরু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাইকের ব্রেক কষলো ক্রীতিক, হঠাৎ এভাবে ব্রেক কষায় অরু কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, ও ভাবছে কোন কথায় আবার চটে গেলো ক্রীতিক, তাই একটু ইতস্তত গলায় বললো,
— কি হয়েছে?
কিন্তু না অরুর ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল হলোনা, আজ বোধ হয় ক্রীতিক পন করে নিয়েছে কোনো কিছুতেই রাগবে না সে, তাই সেই মোতাবেক, অরুকে আঙুলের ইশারা দিয়ে একটা স্থানীয় টং দোকান দেখিয়ে বললো,
—- বেইবি, চা খাবি?
— আমি খেতে পারি, কিন্তু আপনিতো সচারাচর চা খান’না।
অরুর কথায় ক্রীতিক ওর কপালে আঙুলের টোকা দিয়ে বললো,
— তোর জন্য সব খেতে পারি আমি,ইভেন ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার ও।
ক্রীতিকের কথাটা চট করেই অরুর কাছে পরিচিত শোনালো, কবে কোথায় এমন কিছু হয়েছে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়েও বেশিদূর এগোতে পারলোনা ও, তার আগেই ক্রীতিক টেনেটুনে নিয়ে গেলো চায়ের দোকানে।
চা পান করে নতুন উদ্যমে আবারও বাইক এগিয়ে যায় স্বীয় গতিতে। দুপুরের দিকে বৃষ্টিটা একটু থেমে গেলেও এখন বিকেল বাড়ার সাথে সাথে পুনরায় বৃষ্টির গতিবেগ বেড়েছে, অরুর তাতে কোনো ধরনের মাথা ব্যথা না থাকলেও ক্রীতিক কিছুটা চিন্তিত, পাছে না আবার ঠান্ডা লেগে যায় দুজনারই।
ক্রীতিক চুপচাপ রাইড করছে দেখে অরু পেছন থেকে ওর গলা জড়িয়ে ধরে শুধালো,
— আর কতদূর?
ক্রীতিক ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বললো,
— এভাবে কাছে আসছিস কেন? কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো তো।তারপর যখন তখন এ’ক্সি’ডে’ন্ট।
অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে ক্রীতিকের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,
—- উহুম, মোটেই না, আপনি খুব ভালো রাইড করেন, কতো মসৃণ, এতো দ্রুত চলেছে তাও আমি একটুও ভ’য় পাইনি।
— তাহলে তুমি করে ডাক?
ক্রীতিকের কথায় অরু ফিক করে হেসে বললো,
— আপনার তুমিতে এতো দূর্বলতা কেন বলুন তো?
ক্রীতিক বেখেয়ালে বললো,
— জানিনা, তোর মুখে তুমি ডাক শুনতে ভালো লাগে, মনে হয় দুনিয়াতে আমারও আপন কেউ আছে, আমি তার প্রয়োজন নই কেবলই প্রিয়জন।
— তুমি।
ক্রীতিকের কথা শেষ হতে না হতেই, রিনরিনে আওয়াজ ভেসে এলো অরুর দিক থেকে।
ক্রীতিক দু’চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— আবার বল।
অরু ক্রীতিকের গলাটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
— তুমি, তুমি, তুমি, তুমি শুধু আমার জেকে।
অরুর মুখে এতোবার তুমি ডাক শুনে পুলকিত ক্রীতিক, তাই ও ঘাড়টা সামান্য ঘুরিয়ে অরুকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই কিছু একটা নজরে আসতেই অকস্মাৎ চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো অরুর।
ও দেখলো বৃষ্টির মাঝে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে হুট করেই কোথা থেকে যেনো রং সাইড দিয়ে একটা কাবার্ড ভ্যান ঢুকে পরেছে মাঝ রাস্তায়, যার দূরত্ব ওদের থেকে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার বা তার ও কম।
অরুর চোখ বড়বড় হয়ে গিয়েছে, ক্রীতিক সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে হেলমেটের উপর থেকে অরুর গালে আলতো চুমু খেলো, তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠলো অরু,
— দেখেএএএএ!!
অরুর কথায় ক্রীতিক আচমকা সামনে তাকিয়ে শরীরের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে হা’র্ডব্রেক কষলো, কিন্তু তার আগেই পিচ্ছিল রাস্তা আর কাবার্ড ভ্যানের ধা’ক্কা মিলেমিশে বিশাল দেহী বাইকটা দুটো মানুষ সহ’ই ছিটকে পরলো পাহাড়ি রাস্তার খাদে।
চোখের সামনে প্লাস্টিকের খেলনার মতো একটা বাইক ছিটকে পরেছে দেখা মাত্রই কাবার্ড ভ্যানটা দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। তার পরবর্তী মূহুর্তটা একদম শুনশান নীরব। যেন আশেপাশে কিছুই ঘটেনি।
লোকালয় ছাপিয়ে এই যায়গাটা বেশ অনেকটা দূরে অবস্থিত , তাও পাহাড়ের ঢাল, বৃষ্টি হওয়ার দরুন মানুষ তো দূরে থাক একটা কাক পক্ষীও নেই আশেপাশে । রাস্তাদিয়ে তখনও সরোবরের ন্যায় কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা। সেই জলের ছাঁট চোখে মুখে আঁচড়ে পরতেই কেঁপে উঠল ক্রীতিক, শক্ত পাথর খন্ডে লেগে ওর হেলমেটটা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে, অরু তখনো ক্রীতিকের বুকের মাঝে চেতনাহীন হয়ে পরে আছে। কিভাবে কিভাবে যেন বাইকটা হাত থেকে ছুটে গেলেও অরুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছিল ক্রীতিক। যার দরুন অরুর হেলমেটটা এখনো অক্ষত।
নিভু নিভু চোখে একঝলক অরুকে দেখলো ক্রীতিক, নাহ ওর হেলমেট ঠিকই আছে, নিজেরটা আদৌও ঠিক আছে কিনা তা দেখার মতো সুযোগ হলোনা ক্রীতিকের, কারণ ওর মাথাট শক্ত জড়বস্তুর মতোই ভার হয়েছে আছে, সেই সাথে চুলগুলো আঠালো মনে হচ্ছে, চোখ দুটো ঝাপসা, পুরো দুনিয়া ওলট-পালট দেখাচ্ছে, সেই ঝাপসা চোখেই ক্রীতিকের চোখ গেলো এককোনে উল্টে পরে থাকা বাইকটার দিকে। ও নিজের র’ক্তা’ক্ত হাতে বুক পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে কি ভেবে যেন দিয়াশলাইটা জ্বালিয়ে ছুঁ’ড়ে মা’রলো বাইকটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা সমান অ’গ্নিশিখা ছড়িয়ে দাউ দাউ করে ‘জ্বলে উঠলো বাইকটা।
বহুক্ষনের প্রচেস্টায় একটুখানি উঠে বসলো ক্রীতিক, অতঃপর খুব করে চেস্টা চালালো অরুকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে কোলে নেওয়ার, কিন্তু পারলোনা,উঠে দাঁড়ানোর আগেই হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পরলো চুনোপাথরের উপর। নাক দিয়ে অনর্গল র’ক্ত ঝরছে, আজকে একটু বেশিই ঝরছে। কিন্তু কানের কাছে? এখান থেকেও কি যেন চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে, ক্রীতিক আস্তে করে হাত দিলো সেখানটায়, তারপর ভেজা হাতটা এনে ধরলো নিভু নিভু চোখের সামনে,
ধরতেই আবছা আবছা দেখতে পেলো ওর কান বেয়ে ঘন কালচে র’ক্ত গড়িয়ে পরছে,র’ক্তটা সাভাবিক নয়, ক্রীতিক তা দেখে একটু তাচ্ছিল্য করে হাসলো যেন কিছুই হয়নি। ব্যাস এটুকুই, এরপর পুরো রঙিন পৃথিবীটা ক্রীতিকের চোখের সামনে ধীরে ধীরে কালচে হয়ে এলো,হাত পা গুলো কাঁপতে কাঁপতে চোখের সামনে অকস্মাৎ আধারে তলিয়ে গেলো পুরো ধরনী। ক্রীতিক আস্তে করে পরে রইলো চেতনাহীন অরুর পাশেই।
একটু আগের খুনসুটি, অরুর গায়ের ঘ্রান, অরুর খিলখিল হাসির আওয়াজ আর সবশেষে দু’ঠোঁট নাড়িয়ে অস্পষ্ট ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ,
— মেইবি আই কুড’ন্ট প্রোটেক্ট ইউ,বাট আই লাভ ইউ হার্টবিট,
এরপর কয়েক মিনিট নিরবতা, পরক্ষনেই আবারও একটু ঠোঁট নাড়লো ক্রীতিক,
—আই লাভ ইউ আ লট। আমার সব আয়ু তোর হোক বউ। আমি না হয় তোর মধ্যেই বাঁচবো। অবশেষে আমি তুই মিলেমিশে একাকার হবো, আর বাঁধা নেই।
দেশের নামি-দামি ব্র্যান্ডেট বাইকটা তখনো দা’উদাউ করে জ্ব’লছিল এক কোনে, এটাই বোধ হয় অরুকে কষ্ট দেওয়ার জন্য অপারগ জায়ান ক্রীতিকের তীব্র রা’গের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
চলবে….
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৫১
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)
সুন্দর বাসন্তিক সকাল,ঝকঝকে নীল আকাশ,সেথায় পেজা তুলোর মতোন ভেসে বেড়াচ্ছে শুভ্র মেঘেদের ভেলা,চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্র। তবে সমুদ্র তটে যেতে হলে পারি দিতে হবে এক বিস্তৃত চেরিব্লোসমের বাগান।এখান কার চেরিব্লোসম গুলো সমসাময়িকের থেকে বেশ আলাদা,ফুলের ভারে নুয়িয়ে পরা গাছের থোকায় থোকায় গাঢ় গোলাপি রঙা কোনো ফুল নেই, এখানকার ফুল গুলো গোলাপির বদলে গাঢ় বেগুনি রঙের। পার্পল চেরিব্লোসম বলা চলে।
ঝড়ে পরা বেগুনি রঙা ফুল গুলো পায়ে মাড়িয়ে সমুদ্র তটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চারিদিকে নিজের বিস্মিত চোখজোড়া বোলালো অরু, হুট করে এমন বেগুনি ফুলের রাজ্যে প্রবেশ করে ওর চোখের মনি দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো মূহুর্তেই।হ্যাভেনের মতো এতো সুন্দর একটা যায়গায় পা রাখতে পেরে অরু কিছুটা আবেগাপ্লুত ও বটে। বিস্ময় আর আনন্দ উদ্দীপনার চরমে পৌঁছে সুন্দর বেগুনি ফুলে ভর্তি গাছগুলোর চারিদিকে ঘুর পাক খাচ্ছে ও। অরু ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে ওর পরনের সফেদ রঙা ফিনফিনে গাউনটাও ঘুরছে, কি চমৎকার সেই দৃশ্য।
এমতাবস্থায় পাশ থেকে গলা ছেড়ে অরুকে ডেকে উঠলো কেউ,
— বেইবি লুক এট দিস।
চিরাচরিত ইংরেজি বাক্য আর অতিব পরিচিত সেই সম্মোধন “বেইবি” শব্দটা কর্ণকূহরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়ালো অরু,কৌতুহল নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো, প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে সমুদ্র তটে দাড়িয়ে অরুকেই ডাকছে ক্রীতিক।
বরাবরের মতোই সেই আবেশিত চাহনি, অরু মাঝেমধ্যে বুঝে উঠতে পারেনা, ক্রীতিক কি এই নে’শা নে’শা চোখ দুটো শুধু মাত্র ওকে ঘায়েল করার জন্যই তৈরি করে?নাকি অন্য কিছু? ভেবে পায়না অরু। তবে ওর রহস্য মানবের তীক্ষ্ণ কুটিল আর গম্ভীর চেহারা ছাপিয়ে এই চোখ দুটোতে বরাবরই মায়া খুজে পায় ও, আজ বা থেকে কাল নয়, বরং সেই প্রথম দিন থেকেই সর্বনাশা চোখ দুটোর মাঝে হারিয়ে যায় ও। ডুব দেয় ভালোবাসার অতল গহ্বরে,এই যেমন এখনো হারাচ্ছে,নিজের ধ্যান,জ্ঞান, চেতনা সবকিছু ভুলে গিয়ে হারাচ্ছে ।
কিন্তু পরক্ষনেই ক্রীতিকের ইশারাতে ভাবনার ছেদ ঘটে অরুর, ওর চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই অকস্মাৎ বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পরে অরুর দু’চোখ,আপনা আপনি ফাঁক হয়ে যায় চমকপ্রদ ওষ্ঠাধর, সেদিকে তাকিয়েই অরু দেখলো, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে এক বিশাল সুউচ্চ ক্যাস্টল,যার বাইরের দিকটা মার্বেল পাথর আর দামি দামি শেতপাথরের কোটিং এ আস্তরিত।
এটা দেখে অরুর মনে হচ্ছে, ও হুট করেই ডিজনিল্যান্ডে পা দিয়ে ফেলেছে,ওই জন্যই তো এতো সুন্দর সুন্দর জিনিসগুলো ঘটছে চোখের সামনে, এবং এটা মোটেও স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব,চিরাচরিত বাস্তব। জায়ান ক্রীতিক আশেপাশে থাকলে সকল অবাস্তবই বাস্তব, সে আশেপাশে থাকলে সকল দু’শ্চিন্তা, অবসা’দগ্রস্থতা, অশা’ন্তিকে পেছনে ফেলে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে নির্বিগ্নে সস্থির নিঃশ্বাস নিতে পারে অরু, চেরিব্লোসমের রাস্তা ধরে চোখ বন্ধ করে বিনা দ্বিধায় হেঁটে যেতে পারে বহুক্রোশ ।
সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু সাগরের পারে কে বানিয়েছে এমন রাজকীয় ক্যাস্টল? সেই উত্তরের আশাতে’ই ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রীতিকের পানে চাইলো অরু, পেছনে ফিরেই আশ্চর্য হয়ে শুধালো,
— এটা এতো সুন্দর,কে বানিয়েছে এটা?আব…
তবে পেছনে ঘুরতেই অকস্মাৎ কথার মাঝপথে থেমে গেলো অরু, কারণ ক্রীতিক এখানে নেই। আশ্চর্য! একটু আগেতো এখানেই সটান দাড়িয়ে ছিল, এখন কোথায় গেলো সে? অরু ভীষণ অবাক চোখে এদিক ওদিক তাকালো, যতদূর চোখ যায় শুধু ধূ ধূ সমুদ্র তট। আশেপাশে তো দূরে থাক, বিস্তার বেলাভূমিতে যতদূর দু’চোখ যায় কোথাও কোনো মানুষের পদচিহ্ন অবধি নেই, অথচ ও স্পষ্ট দেখেছে এখানে, এই যে এখানেই দাঁড়িয়ে অরুকে ডাকছিল ক্রীতিক।
অরুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, চোখে মুখে অসহায়ত্বের নিদারুণ ছাপ স্পষ্ট, ক্রীতিককে খোজার উদ্দেশ্যে অরু এবার ছুটে গেলো পায়ে মাড়িয়ে ফেলে আসা চেরিব্লোসমের রাস্তার দিকে, কিন্তু হায়, কোথাও তো চেরিব্লোসমের গাছ নেই, উল্টো চারিদিকে খাঁ খাঁ করছে ঝাঁঝালো রৌদ্রতাপ, প্রখর রৌদ্রতাপে গাছপালা শুকিয়ে ম’রাকাঠে পরিনত হয়েছে। পায়ের নিচের গরম চিকচিকে বালিতে শরীর জ্বলে যাচ্ছে, অরু দরদরিয়ে ঘামছে, বাম হাতের পিঠ দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামটুকু আলগোছে মুছে অরু এবার চোখ ফেরালো খানিকক্ষণ আগের রাজকীয় ক্যাস্টলের দিকে, হতেও পারে ক্যাস্টলের মধ্যেই ক্রীতিক আছে।
কিন্তু এবার আরও বিশাল বড় ঝটকা খেলো অরু, কোথায় ক্যাস্টল,কোথায় কি? চারিদিকে শুধু ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। চোখের সামনে সাজানো গোছানো ডিজনিল্যান্ডটা হুট করেই কেমন উধাও হয়ে গেলো, সৌন্দর্য আর প্রাচুর্য্যে ঘেরা সুবিশাল সমুদ্র তট’টা চোখের পলকে পরিনত হয়েছে ভ’য়াবহ মরুভূমিতে, মস্তিষ্কটা পুরোপুরি ফাঁকা, যার হাত ধরে এতো দূর এগিয়ে আসা, সেও মাঝপথে হাত ছেড়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলো,এখন কি করে সামনে এগোবে অরু?
এই ভয়’ঙ্কর নির্জন মরুভূমি ছাপিয়ে কি করেই বা লোকালয়ের সন্ধান পাবে ও? অরুর মাথাটা যখন হাজারও দু’শ্চিন্তায় ফেটে যাচ্ছিল, তখনই সূদুর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাল তোলা জাহাজ নিয়ে হইহই করে এগিয়ে আসে একঝাঁক জলদ’স্যুর দল। কি বি’শ্রি তাদের মুখের হাসি। তাদের সেই নোংরা হাসির আওয়াজে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে অরু। মুখের মাঝের অবশিষ্ট তরল পদার্থ টুকু হারিয়ে যায় মূহুর্তেই, জাহাজে নোঙ্গর ফেলে অরুর দিকেই এগিয়ে আসছে লোক গুলো, অরু ভ’য়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো এবার,
— জায়ান ক্রীতিক কোথায় আপনি? ভ’য় করছে আমার।
“জায়ান ক্রীতিক”, মানুষটা অরুর কাছে সুপার হিরোর মতোই, সে আশেপাশে থাকলে ভয় ডর, বিপ’দ, বাঁধা কোনো কিছুই ছুঁতে পারে না অরুকে, এই দীর্ঘদেহী কালো পোশাকধারী পৈ’চাশিক পায়ারেটস গুলোও ছুঁতে পারবে না, এটা অরুর দৃঢ় বিশ্বাস।
কিন্তু ক্রীতিক তো নেই এখানে , কোথাও নেই। অরুকে বাঁচানোর জন্য ক্রীতিক আজ নেই, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে উল্টো পথে ছুট লাগালো অরু, শরীরের শক্তি ক্ষীণ, তবুও বাঁচার লড়াই এ জিততেই হবে ক্রীতিক তো বরাবর এটাই শিখিয়েছিল ওকে।
কিন্তু অরু পারছে না, ওর হৃদয়টা ভে’ঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে,ভা’ঙা হৃদয়ে কতক্ষণই বা এভাবে শক্তি সঞ্চার করবে ও? এর চেয়ে তো ম”রে যাওয়াই ভালো। জলদ’স্যু গুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না, অরু হাল ছেড়ে ছোটার গতি কমিয়ে দিয়েছে, জলদ’স্যুরা এখনই ধরে ফেলবে ওকে, ওদের লকলকে চাহনী আর ভ’য়ানক অ’গ্নিমূতি দেখে গা ঘিনঘিন করছে অরুর,অগত্যাই অরু থেমে গিয়েও নতুন উদ্যমে ছুটছে, আস্তে হলেও ছুটছে।
কিন্তু শেষমেশ পায়ারেটস গুলো যখন হুমড়ি খেয়ে ছুটে এসে ওর বস্র অবধি হাত ছোঁয়ালো,সঙ্গে সঙ্গে পা পিছলে চোরাবালির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে লাগলো অরু, যে গহ্বর ব্ল্যাক হোলের থেকেও বেশি অ’ন্ধকার আর বর্বর,তবুও অরু হাসলো এক চিলতে ব্যথাতুর হাসি খেলে গেলো ওর ঠোঁটের ভাঁজে। চোরাবালির অতল গহ্বরের তলিয়ে যেতে যেতে অস্ফুটে অরু বললো,
—- জীবনের রাস্তায় কারও হাত ধরে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর, সেখান থেকে একা একা ফিরে আসাটা খুব কঠিন,অসাধ্যই বলা চলে, আমিও পারিনি এই অসাধ্য সাধন করতে,তবুও শান্তি, তুমি ছাড়া আর কোনো নোং’রা হাত আমার শরীর স্পর্শ করতে পারেনি, তোমার অরু শেষ অবধিই তোমার ছিল জায়ান।
কথা শেষ করে অরু যখন শেষ বারের মতো চোখ বুজবে, ঠিক তখনই ওর হাতটা খপ করে টেনে ধরলো কেউ, হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরে ওকে উপরের দিকে টানতে লাগলো ধীরে ধীরে, কে টেনে ধরেছে এভাবে? ওই ভ’য়ানক দা’নবীয় লোকগুলো নয়তো? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে গিয়ে লাগতেই ছটফট করে উঠলো অরু, নিজের হাতটা বহু কসরতে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ক্রীতিকের নাম ধরে তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো ও ,
—- নাআআআহ, জায়ান ক্রীতিক কোথায় তুমিইই?
এক চিৎকারে আচমকা চোখ খুলে প্রচন্ড জোরে হাঁপাতে লাগলো অরু। চোখের সামনে গটগট করে ঘুরছে সফেদ রঙা সিলিং ফ্যান, এয়ারকন্ডিশার টাও ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে বেশ, চারিদিক শীতল, অথচ অরু ঘামে ভিজে একাকার, ওর শরীরটা থরথর করে কাপছে এখনো, আশেপাশের কোনোকিছু ঠাওর করা যাচ্ছে না, একটু আগের স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলো চোখের সামনে জীবন্ত, যার দরুন হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে ওর বক্ষদেশ। শুধু কানে ভেসে আসছে অস্পষ্ট কিছু কথার আওয়াজ,
—- এক্সকিউজ মি, কে জায়ান ক্রীতিক? কাকে খুঁজছেন?
একটা শুষ্ক ঢোক গিলে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকারীর দিকে আবছা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরু,
দেখলো একজন অল্পবয়স্ক সাদা এপ্রোন পরিহিত পুরুষকে,তার গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ, ডাক্তার হবে হয়তো, কিন্তু সে কি প্রশ্ন করলো এটা? অরু ভ্রু কুঁচকায়, লোকটা তৎক্ষনাৎ আবারও শুধালো,
— কাকে খুঁজছেন? আপনার তো জ্ঞান ফিরেছে, আমি আপনার মা আর বড় আপুকে ডেকে আনছি, ওয়েট।
কথাশেষ করে লোকটা পেছনে ঘুরলে অরু আস্তে করে তার কনু আঙুলটা টেনে ধরে, ফ্যাস ফ্যাসিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে কিছু বলতে চেষ্টা করে, তবে নাকের মধ্যে অক্সিজেন লাগানোর দরুন লোকটা ভালোভাবে শুনতে না পেরে, অরুর মুখের কাছে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,
— এবার বলুন।
লোকটা মুখের কাছে কান বাড়িয়ে দিতেই, অরু বেশ সময় নিয়ে আওড়ালো নামটা,
—- জায়ান ক্রীতিক কোথায়?
অরুর প্রশ্ন শুনে লোকটা ঠোঁট উল্টে অরুর নির্লিপ্ত চোখের দিকে চাইলো, কি ভীষন মায়া চোখ দুটোতে, অথচ সেই মায়া উবে গিয়ে নতুন করে জড়ো হয়েছে কাউকে দেখার ব্যাকুল তৃষ্ণা। কিন্তু কাকে? সেটাই তো বুঝতে পারলো না ডক্টর তন্ময় । অরু আস্তে করে আবারও শুধালো,
— কোথায়?
ডক্টর তন্ময় এবার বি’রক্ত হয়ে বললো,
—- আমি কি করে জানবো সে কোথায়? তাছাড়া আপনি এখনো আই সি উ তে আছেন,জ্ঞান ফিরেছে মাত্র, এবার কেভিনে সিফ্ট করা হবে, তখন যা জানার যেনে নিয়েন নিজের পরিবারের কাছ থেকে।
লোকটার বি’রক্তি ভাব গায়ে মাখালো না অরু, উল্টো প্রশ্ন ছু’ড়ে বললো,
— আমি কি এখনো দার্জিলিং এ?
হাতে ফাইল নিয়ে অরুর মেডিকেল রেকর্ড গুলো চেক করতে করতে তন্ময় ভ্রু কুঁচকে বলে,
—- কিসের দার্জিলিং? আপনি ঢাকায় আমাদের প্রাইভেট নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন, তাও গত একসপ্তাহ যাবত। আর এই যে আপনার জ্ঞান ফিরলো।
অরু চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ডুকরে কেঁদে বলে ওঠে,
— তাহলে আমার জায়ান ক্রীতিক কোথায়? উনি ঠিক আছেন তো?
—- কি জায়ান জায়ান করছেন তখন থেকে,আর বাকি অর্ধেক নাম তো আমি উচ্চারণই করতে পারছি না, সে যাই হোক, জায়ান টায়ান এখানে নেই, আপনার মা আজমেরী শেখ ম্যাম আপনাকে এখানে ভর্তি করিয়েছেন। আর আপনি এখন এতো স্ট্রেচ নিতে পারবেন না, নিজেকে শান্ত করুন, আমি বড় স্যারকে কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, উনি এক্ষুনি এসে আপনাকে চেকআপ করে যাবেন।ডোন্ট ওয়ারি।
অরু নিজের রাগটা সংযত করে ক্ষীণ গলায় বললো,
— দার্জিলিং থেকে ফিরে এলাম কি করে সেটা অন্তত বলুন?
—- কিসের দার্জিলিং, কিসের ফেরা,কি বলছেন….
তন্ময় ফাইল চেক করতে করতেই থমকে গেলো, সত্যিই তো কেসটা দার্জিলিং এর, বাইক এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল মেয়েটার।
তারমানে মেয়েটা একা ছিল না, কিন্তু একে ছাড়া তো আর কাউকে নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়নি, স্ট্রেঞ্জ।
*************************************************
সকল ফর্মালিটিস পূরণ করে অরুকে কেভিনে দেওয়া হয়েছে আজ দুদিন হলো,আর আজকে অক্সিজেনও খোলা হয়েছে, তবে এক পায়ের ফ্যাকচারটা বেশ গুরুতর, ওয়াশরুম কিংবা শাওয়ারে গেলে ক্রীসের উপর ভর করে হাঁটতে হয়, আর নয়তো বিছানায় শুয়ে দিনরাত্রি যাপন করতে হয় একনাগাড়ে, অরু ভেবে পায়না এতো বড় একটা এ’ক্সি’ডেন্টের পরেও ও কিভাবে এতোটা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে?
ওর মনে আছে শেষ বার যখন ওরা বাইক সহ পাহাড়ের খাদে পরে যাচ্ছিল,তখন ক্রীতিক বাইক ছেড়ে দিয়ে ওকে টান মে’রে নিজ বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছিল, আর তারপর পরই পুরো দুনিয়াটা ঝিননন ধরে অ’ন্ধকার হয়ে গেলো অরুর দুচোখের পাতায়।
আর এখন ক্রীতিক ও চলে গেলো ওকে এখানে একা রেখে, যার ফলরূপ মাঝেমধ্যেই ক্রীসটাকে দেখে অরু তাছিল্য করে হাসে আর মনেমনে উপহাস করে বলে,
—- আমার বাহুবলি এখানে থাকলে তোকে আর প্রয়োজন হতো না তুচ্ছ ক্রীস।
ক্রীতিকের কথা ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে গেলো অরুর,দলা পাকানো কা’ন্নার জোয়ারে আরও একবার ধরে এলো গলাটা। গলগলিয়ে উগরে আসা কা’ন্নাটাকে যথাসাধ্য দমিয়ে রাখতে ঠোঁট কামড়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি স্থাপন করে অরু। আর ভাবতে থাকে সেদিনের কথা, যেদিন অরুকে আই সি ইউ থেকে কেভিনে শিফট করা হয়েছিল,
নাকের ছিদ্রতে তখনও আটকে ছিল অক্সিজেনের নল, অরু পিটপিটিয়ে চোখ মেলে যখন দেখেছিল ওর সামনে মা আর আপা দাঁড়িয়ে, তখন আর নিজের কান্নার বাঁধ আটকে রাখতে পারেনি অরু, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ভিজিয়ে ফেলেছিল চোখের কার্ণিশ।
অরুকে এভাবে অস্থির হয়ে কাঁদতে দেখে অনু তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে শুধালো,
— কি হয়েছে বোন আমার? এভাবে কাঁদছিস কেন?কিছু খেতে ইচ্ছে করছে আপাকে বল?
এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে, ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে অরু বললো,
— আমার জায়ান ক্রীতিক কোথায় আপা? আমি তার কাছে যাবো।
অরুর কথায় মূহুর্তেই উৎকন্ঠা মিশ্রিত মুখের আদলটা শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেলো অনুর। ও শুষ্ক ঢোক গিলে অরুর কথায় কিছু একটা প্রত্যুত্তর দেবে তার আগেই পেছন থেকে আজমেরী শেখ পেপারে মনোযোগ নিবিষ্ট করে বলে ওঠেন,
—- সে ফিরে গিয়েছে।
তৎক্ষনাৎ অনু -অরু দু’বোনই চোখেমুখে হাজারো বিস্ময় নিয়ে তাকালো মায়ের পানে, আজমেরী শেখের ভাবভঙ্গিমা তাতে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না, তিনি এখনো পেপার পড়ায় বেশ মনোযোগী, মায়ের মুখে এহেন জটিল কথা শুনে অরু একটু হকচকিয়ে উঠে বসতে চাইলো, ধীরে ধীরে উঠে বসে উদ্বিগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
— ফিরে গিয়েছে মানে? কোথায় গিয়েছে?
আজমেরী শেখ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
— তার গন্তব্য যেখানে সেখানেই, সে তো আর সারাজীবন বাংলাদেশে থাকার জন্য আসেনি,কিছুদিনের অতিথি হয়ে এসেছিল আবার ফিরে গিয়েছে নিজের অসামাজিক জীবনে, তাছাড়া ফিরে যাবারই কথা,তার মতো লাগাম ছাড়া মানুষ গুছিয়ে সংসার করার জন্য বিয়ে করেছে বলে তোমার মনে হয়?
মায়ের কথা শুনে হতবাক অরু, সবগুলো কথা এখনো মস্তিষ্কে ঠিকভাবে সাজাতে পারছে না ও, তাই বাইরে থেকে চোখ মুখ স্থির।
তবে যেই মায়ের সবগুলো কথা বুঝে আসলো,ঠিক তখনই মায়ের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে অরু বললো,
—- অসম্ভব জায়ান ক্রীতিক আমাকে রেখে কোথাও যাবে না, তাছাড়া উনি তো আমাকে ছাড়া থাকতেই পারেনা।
মেয়ের কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আজমেরী শেখের, তিনি তৎক্ষনাৎ কিঞ্চিৎ খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
— মায়ের সামনে এসব বলতে লজ্জা লাগছে না তোমার বেয়া’দপ মেয়ে? একটা অভ’দ্রের সাথে দিনরাত থেকে অ’ভদ্রে পরিনত হয়েছো। তাছাড়া যার জন্য এতো আহাজারি করছো সে তোমাকে রেখে সেই কবেই ফিরে গিয়েছে, যদি ফিরে নাই যেত, তাহলে তার বন্ধু বান্ধব কাউকে তো অন্তত দেখতে পেতে কেউ আছে এখানে?
মায়ের চড়াও মেজাজে একটু খানি লাগাম টানতে এবার মুখ খুললো অনু,সে আজমেরী শেখের দিকে তাকিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলে ওঠে,
—- আহ মা, অরু অসুস্থ এখন তো একটু থামো,সুস্থ হলে সব বলা যাবে।
দুই মেয়ের দিকে গম্ভীর চাহনী নিক্ষেপ করে, কেভিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আজমেরী শেখ অনুকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—- জায়ান ক্রীতিক যে সত্যি সত্যি চলে গিয়েছে সেটা তোমার বোনকে এবার বোঝাও।
মা বেরিয়ে যেতেই অরু অনুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আস্তে আস্তে বললো,
—- আআপা সত্যি করে বল, উনি কি আসলেই ফিরে গিয়েছে? আর কেউ না জানুক তুই তো জানিস যে আমি ওনাকে কতটা ভালোবাসি, আমি জায়ান ক্রীতিকের কাছে যেতে চাই আপা। বলনা উনি কোথায়?
কথা বলতে বলতে আবারও কেঁদে ওঠে অরু। একটা দীর্ঘশ্বাসের সাহায্যে ভেতরের অস্থিরতাটাকে বের করে দিয়ে অনু অরুকে আস্বস্ত করে বলে,
—- হ্যা অরু,ক্রীতিক ভাইয়া ওনার বন্ধুরা সবাই ফিরে গিয়েছে।
—- আআমাকে ররেখেই…?
সফেদ বিছানার চাদরটা শক্ত হাতে খামচে ধরে দু’চোখের প্লাবনে বুক ভাসালো অরু। ওর এমন ব্যথাতুর কান্না সহ্য হলোনা অনুর, তাই তাড়াহুড়ো করে বোনকে বুকের মধ্যে নিয়ে অজস্র শান্ততা দিতে শুরু করলো অনু। অনুর কাঁধে মুখ লুকিয়ে অরু শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- এটাতো কথা ছিল না আপা, উনি আমাকে রেখে কেন চলে গেলো? কিভাবে পারলো আমাকে এভাবে হসপিটালে রেখে চলে যেতে? উনি কি মানুষ? মা ঠিকই বলে উনি একটা অ’মানুষ।
— শান্ত হ বোন আমার, এতোটা উত্তেজিত কেন হচ্ছিস? তোর শরীরটা দূর্বল।
অনু বারবার একই কথা বলে অরুকে শান্ত করতে চাইছে কিন্তু কাজ হচ্ছেনা, ক্রীতিকের জন্য অরুর জান বেরিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে রোগীর এহেন কা’ন্নাকাটি শুনে ছুটে আসে নার্স, পরক্ষণে তারাই ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারায় অরুকে।
**
সেই ঘটনার আজ দুদিন হতে চললো, ক্রীতিকের আর কোনো খোজ খবর পায়নি অরু, কি করেই বা পাবে? নিজেই সারাদিন ইনজেকশনের উপর ছিল, খোঁজ নেওয়ার সময় কোথায়? আর এখন যখন একটু একটু সুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে তখনও ক্রীতিক ওর খোঁজ খবর নিচ্ছে না, এটা কি মানা যায়? অরু মানতে পারছে না কিছুতেই, তাইতো বাইরে তাকিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে একমনে।
একটা দুঃস্বপ্ন, একরাশ অস্থিরতা আর এক বুক কান্না, এভাবেই সারাদিন কেটে যায় অরুর, সে বেলা ঠিক কতক্ষণ কেঁদে ভাসিয়েছিল জানা নেই ওর, চোখ মুখ ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে, সুন্দর ফিনফিনে ঠোঁট গুলো ফুলে কমলার কোষের মতো হয়ে আছে, সেখানটায় এখনো ক্রীতিকের দেওয়া গভীর ভালোবাসার ক্ষতগুলো সুস্পষ্ট, অথচ ক্রীতিক কোথাও নেই। দার্জিলিং এর পাহাড়ি বাঁকে হারিয়ে যাওয়া সুন্দর দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে অরু যখন ঘুমিয়েই যাচ্ছিল ঠিক তখনই কেভিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে অনু।ওর হাতে কিছু খাবারের বক্স। অনু খাবারের বক্সগুলোকে একপাশের টেবিলে গুছিয়ে রাখতে রাখতে অরুকে বললো,
—- সরি’রে, তোর পছন্দের খাবার গুলো বানাতে বানাতে দেরি হয়ে গেলো।
— আপা প্রত্যয় ভাইয়া কই রে?
অরুর প্রশ্নে অনু একটু দোনোমোনো করে বলে ওঠে,
— হঠাৎ প্রত্যয়ের খোঁজ করছিস যে?
অরু শোয়া থেকে উঠে, আধশোয়া হয়ে বসে পরলো, অতঃপর খুব শান্ত স্বরে বললো,
— জায়ান ক্রীতিক মঙ্গল গ্রহে থাকলে প্রত্যয় ভাইয়াও সেখানেই আছে, সেটা আমি ভালো করেই জানি।
অনু একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,
— হ্যা ঠিকই বলেছিস, প্রত্যয়ও ক্রীতিক ভাইয়ার সাথে ফিরে গিয়েছে।
— তাহলে তোকে নেয়নি কেন?
অরুর কথায় অনু একটু ইতস্তত কন্ঠে অরুর উপর জোর খাটিয়ে বললো,
—বা’রে তুই এখানে অসুস্থ, হসপিটালে পরে থাকবি আর আমি তোকে রেখে বিদেশ চলে যাবো, এটা হয় বল?
অনুর কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরু, পরক্ষণেই হাত বাড়িয়ে বললো,
—- আপা তোর ফোনটা দে তো?
—- কি করবি? আমার কাছে তো ক্রীতিক ভাইয়ার নাম্বার নেই।
অনুর ইতস্তত কন্ঠস্বর শুনে অরু ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এমন করছিস কেন আজিব?প্রত্যয় ভাইয়াকে কল দেবো, এখন দে।
অরু এমন ভাবে ফোন চাইলো যে, অনুর করনীয় আর কিছু নেই,অগত্যা নিজের ফোন বাড়িয়ে দিলো অরুর হাতে, ফোন পেয়ে অরু সবার আগে কল দিলো ক্রীতিকের ইউ এস এ এর নাম্বারে কিন্তু দূর্ভাগ্য বশত নাম্বারটা বন্ধ।
তাই এবার দ্বিতীয় কলটা টুকলো প্রত্যয়ের নাম্বারে,আর সব সময়ের মতোই ক্রীতিক ফোন না তুললেও আদর্শ স্বামীর মতো দুইবার রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন তুললো প্রত্যয়, এপাশ থেকে অরু কিছু বলার আগেই প্রত্যয় তাড়া দিয়ে বললো,
— হ্যা জান বলো, আমি একটু ব্যস্ত আসলে ক্রীতিক ভাই….
—হ্যালো!
অনুর বদলে অরুর কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই থেমে গেলো প্রত্যয়,তারপর দুইপাশেই কিছুক্ষণ নিরবতা, প্রত্যয় চুপ হয়ে আছে দেখে অরু আগ বাড়িয়ে বললো,
— ভাইয়া শুনতে পাচ্ছেন?
প্রত্যয় চট জলদি প্রত্যুত্তর করলো ওপাশ থেকে,
— হ্যা অরু, কিছু বলবে?
প্রত্যয়ের আস্কারা পেয়ে অরু চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,অতঃপর জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে কা’ন্না গুলো গলায় আটকে রেখে বললো,
— ওনাকে দিন, বলুন আমি কথা বলতে চাই।
অরুর কথার বিপরীতে প্রত্যয় নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
— অরু, ভাইতো মিটিং এ আছেন, বুঝতেই তো পারছো মাত্র দিন দশেক হলো আমেরিকা ফিরেছে সময়টা ব্যস্ততার।
অরু শক্ত গলায় প্রত্যয়কে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
— বলুন যে আমি কথা বলবো। আমার চাইতে ইম্পর্টেন্ট ওনার জীবনে আর কিছু নেই, থাকতে পারেও না।
প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ভাই সত্যিই তোমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয় অরু, তুমিকি খেয়াল করোনি যে ভাই তোমাকে ফেলে চলে এসেছে? এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে দাঁড়াও ভাইকে মিটিং এর মাঝখানেই ফোন হ্যান্ডওভার করছি, বাট সবার মাঝে তোমাকে উল্টাপাল্টা বললে আমার কিছুই করার নেই।
এবার সত্যি সত্যি দমে গেলো অরু, ঠিকই তো সবাই একই কথা বলছে, ক্রীতিক ইচ্ছে করে ওকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে, আর এখন ফোনটাও তুলছে না,কথাও বলতে চাইছে না। এই দূরত্বের কারন জানা নেই অরুর, কিন্তু ক্রীতিক যে ওকে স্পষ্ট সবার সম্মুখে ইগনোর করছে, এড়িয়ে যাচ্ছে, সেটা ভালোই বুঝতে পারছে অরু। তাই প্রত্যয়কে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিয়ে ও বললো,
— লাগবে না থাক, বলবেন সময় হলে অন্তত একটা কল দিয়ে যাতে যোগাযোগ করে, আমি অপেক্ষা করবো।
—- ঠিক আছে।
ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে পিক পিক আওয়াজে কল কেটে দিলো প্রত্যয়।
কথাশেষ হলে অনুর দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে অরু ছলছল চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ,
—-আপা, জায়ান ক্রীতিক তাহলে সত্যিই আমাকে রেখে চলে গিয়েছে, আর এখন আমার সাথে কথাও বলতে চাইছে না। কি দো’ষ করলাম আমি আপা? সবকিছুতো ভালোই চলছিল, তাহলে হঠাৎ এভাবে অবহেলা করার কি মানে আছে বলনা?
বোনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অনু গাঢ় গলায় বললো,
— আগেই বলেছিলাম তোকে, ক্রীতিক ভাইয়া মানুষটা সুবিধার না,শুনিস নি তুই, প্রেমের তোপে নিজের শরীর হৃদয় সবকিছু তাকে দিয়ে, এখন নিজের সর্বস্ব হারিয়ে বসে আছিস।
অনুর কথার পাছে অরু শুধুই চুপচাপ চোখের জল ফেললো, ওর আর এই মূহুর্তে বলার মতো কিছুই নেই।কাকে নিয়েই বা বলবে? যে ওকে হসপিটালে ফেলে রেখে সেই সূদুর আমেরিকায় ফিরে গিয়েছে, তাকে নিয়ে? সেটা কি আদৌও শোভা পায়? না পায়না, মোটেই পায়না, তীব্র অভিমান আর বিচ্ছেদের যন্ত্র’নায় অরুর কলিজা ধরে আছে, এই মূহুর্তে ওই পা’ষান, হৃ’দয়হীন, অভ’দ্র লোকটাকে নিয়ে আর একটা কথাও নয়।
*************************************************
বেলা বেজেছে অনেক,তবে আজ রোদ ওঠেনি, আকাশ ছেয়ে আছে কালো মেঘের চাদরে। তবুও ভ্যাপসা গরম চারিদিকে, বাগান বিলাশের গাছ গুলোও শূন্য পরে আছে, কোনোরকম ফুল না ফোঁটায় ক্রীতিক কুঞ্জের বিশাল গেইট টাকেও কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে।
ক্রীতিকের খালি পরে থাকা রুমের জানালা দিয়ে মহল থেকে মেইন গেইট অবধি স্পষ্ট দেখা যায়, আপাতত ক্রীতিকের শূন্য রুমের দোলনায় বসে, হাঁটু ভাজ করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে সেই ফুলবিহীন বাগানবিলাশ গুলোই একধ্যানে পর্যবেক্ষন করছে অরু।
পড়নে ক্রীতিকের শার্ট,তাতে লেগে আছে ক্রীতিকের গন্ধ, চোখ দুটো নির্ঘুম আর ক্লান্ত। মুখের আদলে বিষ’ন্নতা আর ব্যথার ছড়াছড়ি, আজ প্রায় একমাস হয়ে গিয়েছে অরু হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছে, অথচ গত একমাসে একটাও খবর পায়নি ক্রীতিকের।
প্রথম প্রথম নিজের আত্ম সম্মানের মাথা খেয়ে পা’গলের মতো কল করে গিয়েছে প্রত্যয়কে, কিন্তু প্রত্যেকবারই ক্রীতিক ওর সাথে কথা বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে, নানা ছুতোয় ফোন কল এড়িয়ে গিয়েছে, এভাবে যেতে যেতে এক পর্যায়ে অরু না চাইতেও যোগাযোগ করার চেষ্টাটা বন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি। এর পরবর্তী দিন গুলো ছিল অরুর জন্য অত্যন্ত দূ’র্বিষহ আর চরম য’ন্ত্রনার,যে মানুষটা ওর খোঁজ নেয়না,কথা বলেনা,জানতে চায়না অরু কেমন আছে, আদৌও বেঁচে আছে নাকি ম’রে গিয়েছে, তার জন্যই কত রাত যে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করে কেঁ’দেছে তা কেবল এই মহলের চার দেওয়ালই জানে।
মাঝে মধ্যে অষ্টাদশীর এমন ভালোবাসার কাতরতা চোখে সহ্য করা যেতো না, ওর হৃদয়বি’দারক চি’ৎকার আর আ’হাজারিতে না চাইতেও বাড়ির ভৃত্যদের চোখের কোটর ভিজে উঠতো। এমনও দিন গিয়েছে সারারাতে ওয়াশরুম থেকেই বের হতোনা অরু, সারারাত শাওয়ারের নিচে বসে ভিজতে ভিজতে সেখানেই টালমাটাল হয়ে ঘুমিয়ে যেত। অথচ ওর এই কষ্ট, এই অস্থিরতা, এই ব্যাকুলতা ক্রীতিকের অগোচরেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম লুটিয়ে পরে কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসালেও তারপরের কিছুদিন ইচ্ছে মতো ভা’ঙচুর করেছে ও।
স্বামীর অবহেলায়, জিদে, দুঃখে, অসহ্য য’ন্ত্রনায় ও যেন পা’গল হয়ে যাচ্ছিল, হাতের কাছে যা পেয়েছে একটু পান থেকে চুন খসলেই তাই ভে’ঙে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। বাড়ির অর্ধেক জিনিস ভে’ঙে ফেলার পরেও কেউ টু শব্দটিও করেনি অরুর সাথে , কারন যে ভেঙেছে সে ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেবের কলিজার টুকরো,এই বাড়ির আসল মালকিন, তাকে কিছু বলার সাধ্যি কার? তাছাড়া ক্রীতিক গতবার এসে সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় কিনে রেখে গিয়েছে, সুতরাং অরু যেটাই ভাঙুক না কেন, স্টোর রুমে সেটার রিপলেসমেন্ট এখনো সযত্নে রয়েছে।
প্রথমে হৃদয়ভরা আবেগের জোয়ার, এরপর তীব্র জিদের বহিঃপ্রকাশ আর এখন কিছুদিন যাবত অরু একেবারে শান্ত। সারাদিনে মুখ ফুটে দু’টো কথা বলে কিনা সন্দেহ, কথা বলা তো দূরে থাক দু’বেলা খাওয়া ছাড়া ক্রীতিকের রুম থেকেই বের হয়না ও। সারাক্ষণ ক্রীতিকের রুমে দরজা আটকে বসে নয়তো শুয়ে থাকে। মাঝেমাঝে কাঁদে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুকের ব্যথা সংবরণ করে, তবে সেটা সবার আড়ালে নিঃশব্দে।
ছোট্ট মস্তিষ্কটা কখনো কখনো কষ্টে ফেটে যায়,কখনো বা অভিমানে, তবে আজকাল অরুও নিজেকে সামলে নিতে চাইছে, অরুর অযাচিত অভিমানী মন বলে, যে মানুষটা অরুকে দেখতে চায়না, তার জন্য এতোটা বিরহ মানায় না,
—হি ডাজ’ন্ট ইভেন্ ডিজার্ভ ইট,ফা’কিং বা’স্টা’র্ড।
ক্রীতিককে সবচেয়ে খা’রাপ গা’লিটা দিয়েও মন ভরছে না অরুর, ইচ্ছে তো করছে সামনে পেলে খামচে খুমচে সুন্দর চেহারাটার স্ট্রাকচারই বদলে দিতে। কিন্তু কষ্ট দেওয়ার জন্য হলেও তো তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে হয়, সেটাই তো দেখতে পারছে না অরু, ক্রীতিক কেন বদলে গেলো এভাবে? কোন অপ’রাধের শা’স্তি সরূপ অরুকে বেচে থাকতেই মৃ’ত্যুদ’ন্ড প্রদান করা হলো, সেই কারণ ভাবতে ভাবতেই আরও একদফা নিঃশব্দে টপাটপ চোখের জল ফেললো অরু। পরক্ষণেই তা মুছে নিলো হাতের পিঠ দিয়ে। ঠিক তখনই নিচ তলা থেকে ভেসে এলো অনুর গলার আওয়াজ,
—- অরুউউ,দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলোতো, খাবি না?
বুক চিড়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের করে সাড়া দিলো অরু,
— আসছি আপা।
বিয়ের পরে অনুর এক মাথা দ্বায়িত্ব বেড়েছে বৈকি, কমেনি। এখন ওর সংসার হয়েছে দুটো। দুটো সংসারই সমান তালে সামলাতে হয় অনুকে, তারউপর ভার্সিটি তো আছেই। প্রতিদিন অন্তত দু’বার করে এ বাড়ি ও বাড়ি করতে হয় ওকে। এ বাড়িতে যেমন অসুস্থ মা আর ভগ্নহৃদয়ের বোনটাকে সামলাতে হয়, তেমনই ও বাড়িতে দু’জন মা বাবার ও দেখভাল করতে হয় অনুকে।
এতো দ্বায়িত্ব পালন করেও অনুর সুখের অভাব ছিলোনা, যদি না চোখের সামনে নিজের ছোট্ট বোনটাকে এভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখতে হতো। এখন ভালোয় ভালোয় অরুটা নিজেকে সামলে নিতে পারলেই হলো, সেই ভেবেই আপাতত সস্থির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো অনু।
অনুর কথামতো খেতেই বেড়িয়েছিল অরু, কিন্তু করিডোরের মাঝপথে মায়ের রুম থেকে ভেসে আসা কিছু কথোপকথন শুনে অকস্মাৎ থমকে গেলো অরুর পা, ভেতরে মামি কিছু বলছে হয়তো, যা স্পষ্ট নয়, মামির কথাগুলো স্পষ্ট শোনার উদ্দেশ্যে এবার আরেকটু পিছিয়ে এসে দেওয়াল ঘেঁষে দাড়ালো অরু, তৎক্ষনাৎ কানে এলো মাকে দেওয়া মামির কুটিল শ’লাপরামর্শ,
—- অরুকে এভাবে কতদিন রেখে দেবে? ওই ছেলে তো আর ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না, না ফিরলে তোমারই লাভ, এখন ভালোয় ভালোয় অরুর বিয়েটা দিয়ে দাও।
—-কিন্তু,
আজমেরী শেখের চিন্তিত কন্ঠস্বর শোনা গেলে, জাহানারা পুনরায় মা’কে আস্বস্ত করে বললেন,
— জানি জানি, মেয়ে তোমার সতীসাবিত্রী নেই, তার উপর অনুর বিয়ের দিন সকলের সামনে ভরা মজলিসে যা খেল দেখালো ওই ছেলে, তারপর আর পাত্র পাবেও না ওর জন্য, তার চেয়ে বরং একটা কাজ করো আমার রেজার সাথেই না হয় অরুর বিয়েটা, না মানে আমি মুখ থেকে একবার বললে আমার ছেলে কিন্তু না করবে না, তাতে তোমার মেয়ে যতই অন্য ছেলের সাথে শু’য়ে আসুক,আমার ছেলে আমার কথা….
—- এক্ষুনি থামো মামি!
অরুর কঠিন আওয়াজে একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো জাহানারা। তিনি হকচকিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলেন অরু র’ণমূর্তি ধারন করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে,
—- আমার মায়ের কানে শি’শা ঢালা বন্ধ করো।
আজমেরী শেখ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন শুধু, এই মূহুর্তে অরুকে কিছু বলতে কেন যেন সায় দিচ্ছেনা তার মন, তাই বললেন ও না, চুপচাপ বসে রইলেন শুধু।
ওদিকে অরুর চাওনিতে ভেতরে ভেতরে একটু ভীত হলেও, উপরে মেকি সাহস ধরে রেখে জাহানারা চোখ রাঙিয়ে বলেন,
—- বেয়া’দব মেয়ে আড়ি পেতেছিস কেন?
অরুর নিজের চোয়ালটা শক্ত করে তেঁতো গলায় বললো,
— আড়ি পেতেছি বেশ করেছি, আমার স্বামীর বাড়িতে আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তাই করবো, তুমি বলার কে? দ্বিতীয়বার যদি আমার বাড়িতে এসব ব’স্তাপঁচা বিয়ের আলাপ শুনেছি, তাহলে এ বাড়িতে তুমি আর যায়গা পাবেনা মামি।আর তোমার ছেলের জন্য যদি এতোই মেয়ের অভাব হয়, তাহলে আমাকে বলো, মোখলেস চাচার মতোন বিপরীত লি’ঙ্গের কাউকে খুঁজে দেবো। তাও দয়া করে নিজের গোবর মাথার বুদ্ধি বিলাতে এসোনা এখানে।
মামির মুখের উপর একনাগাড়ে কতগুলো কথার তী’র নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে রুম ত্যাগ করে অরু। আজমেরী শেখ এখনো মেয়ের যাওয়ার পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, আজ হুট করেই অরুর মাঝে নিজের যৌবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন তিনি, সাধারণত অনুর মাঝে একটু আধটু দাম্ভিকতা থাকলেও অরুর মাঝে তা পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল, কিন্তু আজ যখন হুট করেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো, তখন অরুও কঠোর দাম্ভিকতা নিয়ে ঝাঁজালো এক ক্রুদ্ধ কন্ঠে প্রতিবার করলো অন্যা’য়ের, যা আজমেরী শেখকে অনেকটাই বিস্মিত করেছে।
মায়ের রুম থেকে আর নিচে খেতে যাওয়া হলোনা অরুর, ও তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে দৌড়ে চলে এসেছে নিজের রুমে। রুমে ফিরে আজ আবারও বহুদিন বাদে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো অরু, অর্নগল চোখের জল ফেলতে ফেলতে ইমেইলে গিয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে টাইপ করতে লাগলো কাঁপা হাতে ,
—- টলটলে প্রেমের জোয়ারে বানভাসি হৃদয়টা যে তুমিহীন খরায় চৌচির হয়ে ফেটে যাচ্ছে, কোথায় তুমি জায়ান?
অরু বার্তা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে রিপ্লে এলো,
— আমি আছি তোমার অস্তিত্বের মিশেলে নিভৃতে, চোখ দিয়ে নয় মন দিয়ে খোঁজো, মস্তিষ্কে নয় হৃদয়ে অনুভব করো, বিলিভ মি, ঠিক খুঁজে পাবে, হার্টবিট।
হুট করে এমন একটা রিপ্লে পেয়ে খুব অবাক হলো অরু, অবাকের চরম সীমানায় পেছনের ইমেইল গুলো চেক করতে লাগলো একে একে, যেখানে ওর করা প্রত্যেকটা ইমেইলের আলাদা আলাদা রিপ্লে করেছিল ক্রীতিক।
আর সর্বশেষ যে ম্যাসেজটা ছিল,
— দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পাচ্ছি না, ভুলতে পারছি না, তবুও তুমি আছো, এ তোমার কেমন থাকা জায়ান ক্রীতিক?
ঠিক সেই ম্যাসেজের রিপ্লে ছিল এটা,
— আমি আছি তোমার অস্তিত্বের মিশেলে, চোখ দিয়ে নয় মন দিয়ে খোঁজো, মস্তিষ্কে নয় হৃদয়ে অনুভব করো, বিলিভ মি,ঠিক খুঁজে পাবে, হার্টবিট।
এরপরের ম্যাসেজ গুলোতে ক্রীতিক অটোমেটিক এই রিপ্লেটাই সেট করে রেখে দিয়েছে, যার ফলরূপ বার্তা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লে এসেছে।
আর এই মূহুর্তে এতোকিছু অবলোকন করার পরে অরুর দৃঢ় মন বলছে,
—- এই মানুষটা কোনোদিনও আমাকে ভুলতে পারেনা, মানুষটা নিজেকে নিজে ভুলে যেতে পারে কিন্তু আমাকে নয়, এটা অসম্ভব।
তৎক্ষনাৎ ল্যাপটপ ফেলে রেখে সোজা নিজে গিয়ে অনুর হাত থেকে ফোন ছি’নিয়ে নিয়ে প্রত্যয়ের নাম্বারে কল লাগালো অরু। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই অরু তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
—- আমার জায়ান ক্রীতিক কোথায়?
— অরু, আসলে,
প্রত্যয়কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরু পুনরায় বলে ওঠে,
—- অরু নই, মিসেস জায়ান ক্রীতিক বলছি, আপনার বসের ওয়াইফ, আমার হাসবেন্ড কোথায়?
অরুর কথায় এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলো প্রত্যয়, কিছুক্ষন দোনোমোনো করেও অরুকে লক্ষ্যচ্যুত করা যাচ্ছে না মোটেই, মনে হচ্ছে আজ অরু ব্যাটে বলে ছক্কা হাঁকিয়েই ছাড়বে। তবুও কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে প্রত্যয় বলে ওঠে,
— ভাই আসলে….
— একটু ও কপটতা নয়, ছাফছাফ উত্তর দিন, নয়তো মিসেস জায়ান ক্রীতিক হিসেবে নিজের ক্ষমতা গুলো ব্যাবহার করতে বাধ্য হবো আমি।
অরুর কথা শেষ হতেই একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রত্যয় বললো,
— ভাই সানফ্রান্সিকোতেই আছে, গত সপ্তাহেই লস এঞ্জেলস থেকে এখানকার হসপিটালে সিফট করা হয়েছে ভাইকে,ব্রেইনে বেশ কিছু অ’স্রপচার করার দরুন এখনো জ্ঞান ফেরেনি, তবে এখানকার ডক্টররা আশা করছেন খুব শীঘ্রই সেটা ফিরবে।
প্রত্যয় আরও কি কি বলেছে তা আর কান অবধি পৌঁছায়নি অরুর, ও ফোনটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে, কিছুক্ষন কষ্ট করে ভেতর থেকে শ্বাস টেনে তুললো,অতঃপর ধপ করে মেঝেতে বসে গগন কাঁপানো চি’ৎকার দিয়ে কেঁ’দে উঠলো, কি ভীষণ য’ন্ত্রনাদ্বায়ক সেই কা’ন্নার আওয়াজ বলে বোঝানোর নয়।
দু’হাতে নিজের চুল গুলো নিজেই টেনে ধরে চি’ৎকার করে কাঁদছে অরু, ও এতোদিন ধরে কি ভেবে এসেছে? কতোটা ভুল বুঝেছে অথচ ওর স্বামী দিনের পর দিন মৃ’ত্যু’র সাথে পাঞ্জা লড়েছে, এখনো লড়ছে।
এতোদিন তো যা ছিল ভালোই ছিল, কিন্তু এই ভুলের ব্যথা কি করে সইবে অরু? কার ভালোবাসায় স’ন্দেহের আঙুল তুললো ও? ছিহ!
বিশাল হলরুমের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পরে হৃদয় চিড়ে চিৎ’কার করছে অরু, ওর কা’ন্না দেখে পুরো মহল কাঁদছে, তখনো মহল্লার সরু গলি ভেদ করে অস্পষ্ট আওয়াজে অরুর কানে ভেসে আসছে মিনারের গাওয়া দুটো ব্য’থাতুর গানের লাইন,
” “আহারে আহারে,
কোথায় পাবো তাহারে,
যে ছিলো,
মনেরই গহীন কোণে””
চলবে….