সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৬+৭

0
3

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ০৬
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য।

সানফ্রান্সিসকো থেকে মাইল ত্রিশেক দুরে ছোট্ট নির্জন এই শহরতলীর আবহাওয়া বরই অদ্ভুত। সপ্তাহে বড়জোর দু-একটিবার রোদের মুখ দেখা যায়, বাকিটা সময় ঘুটঘুটে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ নয়তো কুয়াশা ঢাকা ঝাপসা প্রকৃতি,তারউপর হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডাতো আছেই।
ঘরের মধ্যে কৃত্রিম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থা থাকায় সেই হীমধরা শীত ছুতে পারেনা মানুষের শরীর। মাইনাস জিরো ডিগ্রিতেও এদেশের মানুষের কর্মব্যাস্ত জীবন অনড়।

কিন্তু একা একা এভাবে, রুমের মধ্যে বসে বসে ঠিক কতক্ষণ থাকা যায়? গত দুদিন ধরেই এভাবে কাটাচ্ছে অরু। খাও, দাও আর ঘুমাও। আপাও সকাল হতে না হতেই হসপিটালে ছোটে। ক্রীতিক বাড়িতে থাকা না থাকা একই কথা, সে কখন আসে কখন যায় সেই ধারণাটুকু পর্যন্ত নেই অরুর। তাছাড়া এই ব’দমেজাজি লোকের সাথে মুখ দেখাদেখি না হওয়াটাই ভালো, এককথায় গুড লাক।

রুমের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করছে অরু। অলস মস্তিষ্কটা ভাবছে কি করা যায়? কিভাবে সময় কাটানো যায়, তখনই গুরুদায়িত্ব মনে পরার মতোই মনে পরে যায় নিখিল ভাইয়ের কথা। গত দু’দিনে অরুতো ভুলেই গিয়েছিল নিখিল ভাইয়ের সাথে একই দেশে আছে ও।
— কিন্তু মাত্র এই কয়েকদিনের দুরত্বে কিভাবে আপনাকে ভুলতে বসলাম আমি নিখিল ভাই?

ওর অবচেতন মস্তিস্ক বললো,
–ভালোবাসলে ভোলা যায়??

— তারমানে কি আমি তাকে ভালোবাসিনা? না না কি ভাবছি এসব। ভুলভাল চিন্তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন ভাবনা সংযোজন করলো ও, —যে করেই হোক নিখিল ভাই কে খুঁজে বের করবো আমি।কিন্তু কিভাবে?

তখনই চোখ গেলো বেড সাইড টেবিলে অযত্নে পরে থাকা মুঠো ফোনটার দিকে, যেটা গত দু’দিন ধরে বন্ধই পরে আছে।
অরু এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো, মনে মনে ভাবলো এটাকে চার্য দিয়ে লাভ নেই কারণ ওর কাছে সিমকার্ড নেই।
তাহলে এবার কি হবে??

অরু পা দুলিয়ে খাটে গিয়ে বসে পরে। তারপর ভাবতে ভাবতে আনমনে বলে,
— আমাকে ধাপে ধাপে এগোতে হবে, সবার আগে নিখিল ভাইয়ের ভার্সিটি খুজে বের করতে হবে, আর সেটা জানতে হলে তিথিকে কল করতে হবে, একমাত্র ওই জানবে নিখিল ভাই কোন ভার্সিটিতে হায়ার স্টাডিসের জন্য এসেছে। তারপর এড্রেস নিয়ে সোজা নিখিল ভাইয়ের মুখোমুখি।

কথাটা ভেবেই লজ্জায় নিজের মুখে দু-হাত চেপে মু্ঁচকি হাসে অরু।

—কিন্তু তিথির সাথে যোগাযোগ করার উপায় কি??
বুদ্ধিদীপ্তদের মতো চোখ জোড়া বড় করে অরু বললো আইডিয়া, এতোবড় বাড়িতে নিশ্চয়ই একটা ল্যান্ডলাইন থাকবে? হ্যা থাকবেই, শুধু খুজে বের করতে হবে।নিজেকেই নিজে আস্বাস দিলো ও।
তারপর আর দেরি করলো না, তৎক্ষনাৎ ডায়েরির পাতা থেকে তিথির নাম্বার টুকে রাখা পৃষ্ঠাটা ছিড়ে নিচের দিকে ছুট লাগালো নতুন কোন সুযোগের আশায়।
*************************************
বেখেয়ালি অরু একপ্রকার নাচতে নাচতেই নিচে নেমে এলো। তবে শেষ সিঁড়িটা পেরোতেই ওর পায়ের উদ্যম গতি থেমে গেলো,সেই সাথে হাস্যোজ্জল মুখটাও চুপসে গিয়ে থমথমে দৃশ্য ধারণ করলো।
অন্ধকার হল রুমে, কালকের মতোই ডিভানে বসে টি টেবিলের উপর দু’পা তুলে বাইক রাইডিং ভিডিও গেইম খেলছে ক্রীতিক।

অরু মনে মনে বিরক্ত হলো,
—এতো বড় হয়েও সারাদিন ভিডিও গেইম খেলে এই লোক,আশ্চর্য অফিস টফিস নেই নাকি?
আবার হতেও পারে কোটি পতি বংশের একমাত্র উত্তরাধীকারী মি.কুম্ভকর্ণ।

নিজের মনের কথায় নিজেই ঠোঁট টিপে হেঁসে ওঠে অরু।
সঙ্গে সঙ্গে মনিটরের গেইমটা পজ হয়ে যায়।
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড,তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,

— হোয়াট হ্যাপেন্?? এভাবে হাসছিস কেন? আমি বয়সে তোর থেকে ঠিক কত বছরের বড় তুই জানিস?

অরুর হাসি থেমে যায়, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার তার সাথে নিস্তব্দ পরিবেশ, কেবল মনিটর থেকে আসা মৃদু আলো ছাড়া আর কোনো আলোই জলছে না হল রুমে।জানালা থেকে শুরু করে, কাচের দেওয়ালের পর্দাটা পর্যন্ত টেনে দেওয়া।
এমন পরিবেশে ক্রীতিকের রাগি আওয়াজ বেশ ভ’য়ানকই ঠেকলো অরুর কানে।
আর এই মূহুর্তে ক্রীতিক যে, ওর দিকে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে,ব্যাপারটা ভয়ের উপর যা থাকে সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে। অরু এই নিরবতা ভাঙতে চাইলো,তাইতো নিস্তব্ধতা কাটিয়ে রিনরিনে আওয়াজে বললো,
— আ..আপনার অফিস নেই?

— কোন অফিস??

— এমা, কি বলছেন আপনাদের কোম্পানি, জেকে গ্রুপ।ওয়েট “জেকে “তারমানে কোম্পানিটা আপনার নামে আর কালকে ওই ভাইয়াটা আপনাকেই ডাকছিল, জায়ান ক্রীতিককে ছোট করে জেকে।

আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে অরুর করা বিশ্লেষণ ক্রীতিক শুনেছে কি শোনেনি কে জানে?

ওও আবারও মনিটরে নজর দিয়ে বললো,
— আমার সামনে একদম হাসবি না তুই। তোর হাসিটা বি’শ্রী লাগে আমার।আর ওটা আমার নয়, তোর মায়ের অফিস। আর না ওখানে আমি বসি, তুই চাইলে অবশ্য বসতে পারিস।

অরু মনে মনে ভরকায়,
—কি বলে এই লোক। আমি কেবল কলেজ পাশ করে এডমিশন নিলাম,উনিকি ঠাট্টা করছেন, মানুষ এতো সিরিয়াস ফেস নিয়েও ঠাট্টা করতে পারে? অদ্ভুত।

অরু আর ঘাটায় না ক্রীতিককে বেশি ঘাটালে হুট করে কি জানি কি অপ’মান করে বসে তার ইয়ত্তা নেই। তাই অরু কথা ঘুরিয়ে বলে।
— বলছি যে লাইটটা জ্বালাতাম, একটু কাজ ছিল।
— নো। সচকিত জবাব আসে ক্রীতিকের দিক থেকে।
— কিন্তু কেন?
— আমার অন্ধকার ভালো লাগে তাই,যা করার এই অবস্থাতেই করে যা।

হালকা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো অরুর বুক চিড়ে, ক্রীতিক বলেছে মানে, সে কথা এক চুলও নরবে না।তাই অন্ধকার হাতরেই ল্যান্ড ফোনের সামনে গিয়ে সফেদ কার্পেট বিছানো মেঝেতে বসে পড়লো অরু। কাগজ থেকে খুব সাবধানে নাম্বারটা টুকে,কল লাগালো তিথির নাম্বারে।
কয়েকবার রিং পরতেই কল ধরেছে তিথি বাংলাদেশে তখন রাত দশটা কি এগারো তবুও কথা শুনে মনে হচ্ছে ঘুমে কাতরাচ্ছে তিথি।
— তিথি আমি অরু বলছি। কেমন আছিস?

তিথি চমকায়, একেতো বিদেশি নাম্বার তার উপর দেশে থাকতেই সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল অরু, এখন হুট করেই আবার কেন কল দিলো?

তিথি কিছু বলবে তার আগেই অরু বলে,
—তিথি আমার তোর সাথে অনেক কথা আছে সব খুলে বলবো তোকে,তার আগে ছোট্ট একটা ইনফরমেশন দে, নিখিল ভাই কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য ইউ এস এ এসেছে?

তিথি ওপাশ থেকে কি বললো,সেটা শোনা না গেলেওও আপাতত মনিটরে এতোক্ষণ ধরে নির্দ্বিধায় চলতে থাকা বাইকটা ব্রে’ক ফে’ইল করে বি’দ্ধস্ত হয়ে পরে আছে।পর্দায় বড় বড় অক্ষরে লেখা উঠেছে “গেইম ওভার”।

কেন যেন হুট করে ফুপিয়ে কেঁ’দে উঠেলো অরু,

— কাঁ’দতে কাঁ’দ’তে অসহায়ের মতো করে বলছে, তিথি তুই কি ড্রাং’ক এভাবে কেন কথা বলছিস, তুই কি কোন বা’জে ছেলেদের পাল্লায় পরেছিস??বলনা?

ওপাস থেকে টলতে টলতে তিথি বললো, —বেশ করেছি বলেছি, তুই আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা রাখিসনা। আমাদের ফ্রেন্ডশীপটাকে কোনোকালেই গুরুত্ব দিস নি তুই, উল্টে সবসময় আমাকে আর নিলীমাকে ইউজ করে গেছিস,এটা বল, ওটা বল,এটা জানা, সেটা জানা, কেনরে আমিকি তোর চাকর ?? তোর ইনফরমেশন কালেক্ট করাই কি আমার কাজ?? তারউপর সবসময় এমন ভাব করে এসেছিস যেন তুইই পার্ফেক্ট, তুইই ক্রীতিক কুঞ্জের মালকীন। আর আমরা কি? লেইম?

—কি বলছিস এসব তিথি, তোর মাথা ঠিক আছে?

খানিকটা তাচ্ছ্যিল্যে হেসে তিথি আবারও বলে –আরেহ তুইতো আসলেই কচুরিপানারে।আমার মাথা ঠিক আছে কি নেই সেটা জিজ্ঞেস করার তুই কে? আমিতো এই ভেবে তোকে বন্ধু বানিয়েছিলাম যে তুই অতবড় বাড়ির মেয়ে,পুরান ঢাকার নামকরা রিয়েলএস্টেট ফ্যামিলি বিজনেস তোদের। ওমাই গড। কিন্তুু তুই তো আসলে ওবাড়ির কেউই নস, আশ্রিতা মাত্র, তোদের জন্য ওই বাড়ির একমাত্র ছেলে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী নিজ বাড়িতে পা রাখেনা পর্যন্ত।তাহলে ভাব তোরা কত নিচ। আর তোর সাহস দেখে তো আমি রীতিমত অবাক হচ্ছি,তুই কিনা নিখিল ভাইয়ের খোজ করছিস? তুই জানিস নিখিল ভাই কতবড় সাইন্টিস্ট হবে? তুই তার নখের যোগ্যতাও রাখিস না অরু। তাই তোর ভালোর জন্যই বলছি ওনার বউ হওয়ার যে দিবাস্বপ্নটা দেখছিস না? সেটা এবার বন্ধ কর।আর যাই হোক নিখিল ভাইয়ের মতো হাই স্ট্যাটাসের ছেলে অন্তত, তোকে বিয়ে করবে না।

অরু চোখ দুটো বন্ধ করে সমস্তটা শুনে গেলো। এই ভ’য়টাই তো পেয়ে এসেছিল এতো গুলো বছর ধরে। আজ এতো দুরে এসেও সেই ভ’য় থেকে পালাতে পারলো না ওও। ঠিকই মুখোমুখি হয়ে গেলো তি’ক্ততায় পরিপূর্ণ কিছু চড়ম সত্যের।
নিস্তব্দ শুনশান হল রুমে অরুর ফোঁ’পানির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
অরু কান্না ভেজা গলায় আরও একবার তিথি কে অনুরোধ করলো,
— প্লিজ তিথি তুই আমাকে যা খুশি বল আমি শুনবো, শুধু নিখিল ভাইয়ের ভার্সিটির নামটা বল প্লিইইজ। তুই না বললে আমি আর কোনো দিনও নিখিল ভাইকে খুঁজে পাবোনা।

—রিডিকিউলাস

ওপাশ থেকে এতোটুকুই শোনা গেলো, তারপর শুধু কল কে’টে যাওয়ার পিঁক পিঁক আওয়াজ হলো।

অরুর কি হলো কে জানে, আশেপাশে কে আছে কে নেই, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে কল কা’টতেই হুহু আওয়াজ করে কেঁ’দে উঠলো। হয়তো নিজের ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছ থেকে এই তিরস্কারটা মোটেই হজম করতে পারেনি ও।

আধারে ঢাকা বদ্ধ ঘরে সেই কা’ন্নার আওয়াজ বরই ব্যা’থাতুর শোনালো। লম্বা সিল্কি চুল গুলো পুরো মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে আছে, দু’হাত মেঝেতে রেখে তাতে নিজের ভর ছেড়ে দিয়ে অনর্গল কাঁ’দছে অরু।কা’ন্নার তোপে শরীরটা বারবার ঝাঁকি দিয়ে উঠছে, সেই তালেতালে মৃদু রিনঝিন শব্দ করছে পায়ে আটকে থাকা নুপুর জোড়া।পেছন থেকে ওর কালো মেঘের মতো ঘন চুল দেখে যে কেউ বলবে ডিজনি প্রিন্সেস রুপাঞ্জেল তার সবচেয়ে দুঃখের সময় পার করছে।

কিন্তু সবার দৃষ্টিভঙি এক নয়, ধ্যান ধারণাও এক নয়,কারও ক্ষেত্রে হৃদয়টা হয় বরফের মতোই নির্জীব আর অনুভূতিহীন।সামান্য কা’ন্নাকা’টি দিয়ে সেই বরফ গলানো দুষ্কর।

এই যেমন অরুর কান্নাকাটিও পাশের ডিভানে বসে থাকা ক্রীতিকের হৃদয় ছুতে পারলোনা। ওও হুট করেই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলো।
নিজের যায়গা ছেড়ে উঠে এসে অরুর হাতে হ্যাঁচকা টান মে’রে ওকে জো’র করে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর ওই হাত ধরেই টা’নতে টান’তে দরজার বাইরে বের করে দিয়ে বললো,

— আউট।

অরু কিছু বুঝে ওঠার আগেই শব্দটা উচ্চারণ করে ধাপ করে দরজা আটকে দেয় ক্রীতিক।
তারপর ভেতরে গিয়ে মেঝেতে পরে থাকা কাগজের টুকরোটা তুলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, পকেট হাতরে ফোন বের করে কাউকে কল লাগায়,
— আমি একটা নাম্বার ফরওয়ার্ড করেছি তোকে, এর এ টু জেট সব ইনফরমেশন চাই।এস সুন এস পসিবল।

বাইরে এলোপা’থারি ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শুধু ঠান্ডা বললে ভুল হবে মা’রাত্মক ঠান্ডা। আকাশটাও মেঘাচ্ছন্ন যখন তখন বৃষ্টি চলে আসতে পারে, এতো ঠান্ডা সয়ে অভ্যাস নেই অরুর তারউপর ওর পরনে কোনো শীতের কাপড়ও নেই, এককথায় জা’ন যায় যায় অবস্থা। অরু একটু সময় নিজের কা’ন্নাকা’টি থামালো, তারপর দু’হাত দিয়ে সজোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
ক্রীতিক বয়সে অরুর চেয়ে অনেক বড়, তারউপর সম্পর্কটা এতোটাও সহজ নয় ওদের, তাই কখনোই ক্রীতিককে কিছু বলেনি ডাকেনি অরু। কিন্তু এই মূহুর্তে একটু দ্বিধা নিয়েই ডাকতে শুরু করলো ও।
— ভাইয়া, ক্রীতিক ভাইয়া, দরজা খুলুন না, আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি তো। ভাইয়াআআ।

ওপাশ থেকে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া এলোনা।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ ডেকেছে মনে নেই অরুর। ডাকতে ডাকতে একপর্যায়ে দরজার সামনেই ক্লান্ত হয়ে বসে পরে ঠান্ডায় নীল হয়ে যাওয়া অসহায় অরু ।
**************************************
হাইওয়ে ধরে এগোলে রাস্তার একপাশে পেট্রোলপাম্প আর অন্যপাশে ম্যাকডোনাল্টস এর বিশাল ক্যাফেটেরিয়া। এই ছোট্ট শহরটা বেশ নীরব, তার চেয়েও নীরব এই স্টেট টা, যে কয়েকটা ফ্যামিলি আছে তারাও বৃদ্ধ বৃদ্ধা,নয়তো ক্রীতিকের মতো একঘেয়ে।মোদ্দাকথা যারা কোলাহল মুক্ত নিরবচ্ছিন্ন জীবন পছন্দ করে তারাই এই স্টেটে থাকে,নয়তো সানফ্রান্সিসকো থেকে এতোটা দুরে এমন নির্জন পরিবেশে সারাদিন কাটিয়ে দেবার মতো অযথা সময় কারোরই নেই।

দুপুর বেলা হওয়াতে ক্যফেটেরিয়ায় বেশ কিছু মানুষ আছে, তারা যে যার মতো ছাঁদ গোল টেবিলে বসে একটু একটু কফির সিপ নিচ্ছে আর গল্প করছে।
লাল সাদা লোগোর একটা গোল টেবিলে প্রত্যয় ওও বসে আছে। মাত্রই একটা গড়ম কফি শেষ করলো সে। এখন একটু নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ার জন্য মনটা নিশপিশ করছে, তাই ঠোঁটের কোনে সিগারেট নিয়ে বা হাত দিয়ে দিয়াশলাই জ্বালানোর চেষ্টায় আছে ও।

তখনই ম্যাকডোনাল্ড লোগোর টিশার্ট পরিহিত একটা ব্রাউন স্কিনটোনের মেয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁটের ভাঁজে একগাল হাসি টেনে বললো,
— সরি স্যার স্মো’কিং ইজ নট এলাউ।

প্রত্যয় মাথা তুলে একবার চাইলো,হুট একদম হুট করে চোখে চোখ রাখলো,অতঃপর হারিয়ে গেলো। মেয়েটা সাদা ফ্যাটফ্যাটে চামড়ার নয়,বরং দুধে আলতা রঙের মায়ায় ভরা চেহারা তার, প্রসস্থ হাসিতে স্নিগ্ধতা যেন উঁপচে পড়ছে ওর। ডাগর ডাগর চোখে কোন কৃতিম সৌন্দর্য নেই, চোখের নিচের সুক্ষ ডার্ক সার্কেলটাও তার সৌন্দর্যের সামিল। প্রচন্ড ঠান্ডায় ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের যখন দিনাতিপাত করাই দুষ্কর, ঠিক তখনই প্রত্যয় আবিষ্কার করলো,এক অজানা উষ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে ওর হৃদয়ের কানায় কানায়।
নিস্প্রভ তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠান্ডা হাওয়ায় ওর চোখের কোনে জল জমে গিয়েছে, তাও মনে হচ্ছে এটা শীত নয় বসন্ত। এটা বরফ গলা হাওয়া নয় বরং বাসন্তিক মনমাতানো হাওয়া।
লোকটা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে দেখে, এবার একটু ইতস্তত হয়ে হাত নাড়লো অনু।
— হ্যালো স্যার।

প্রত্যয়ের ধ্যান ভেঙে যায়,ও তৎক্ষনাৎ হুড়মুড়িয়ে সিগারেট টা ডাস্টবিনে ছু’ড়ে ফেলে দেয়।

— থ্যাংক ইউ স্যার।

মুখে একচিলতে সুশ্রী হাসি ঝুলিয়ে রেখে অনু চলে যায় অন্য কাস্টমারদের কাছে।

প্রত্যয় বলতে চাইলো,
—তুমি এমন করে আর কারও সামনে হেসোনা অপরিচিতা। তোমার এই মনোমুগ্ধকর হাসিটা আমি, হ্যা আমি কেবল একাই উপভোগ করতে চাই। কিন্তু ও পারলো না, তার আগেই অন্যপাশ থেকে ত’র্কাত’র্কির আওয়াজ ভেসে এলো।

প্রত্যয় খেয়াল করলো, অনুকে ওরা কিছু বলছে।
ভারী শরীরের গু’ন্ডা মতো একটা সাদা চামরার লোক। দেখেই মনে হচ্ছে টাল হয়ে আছে,
স্মো’কিং না করতে বলায়, লোকটা ভীষণ চটে গিয়েছে অনুর উপর , অযথা ইংরেজিতে গা’লাগা’ল করছে। এক কথায় দুই কথায় সব মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে ওদের কাছে, ক্যাফেতে এই মূহুর্তে অনু আর ওর শিফটমেট ডেইজি ছাড়া কতৃপক্ষের কেউ নেই। তারউপর অনু দুইদিন হলো জয়েন করেছে মাত্র, কিভাবে কি সামাল দেবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও।একপর্যায়ে লোকটা রে’গেমেগে গড়ম কফির মগটা ছু’ড়ে মারে অনুর দিকে। অকস্মাৎ ঘটনায় চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো অনু। এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড করে প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড অতিবাহিত হয়ে যায়, শরীরের চামড়ায় গ’ড়ম বিভ’ৎস কোনো কিছুই অনুভব করতে পারলো না ও। ব্যাপারটা কি হলো বুঝে উঠতে ভয়ে ভয়ে চোখ খোলে অনু।দেখতে পায়, একটু আগের সিলভার কালার শার্ট পরিহিত সেই লোকটা, ওকে নিজের বাহুতে আড়াল করে চোখ মুখ খিঁচে দাড়িয়ে আছে।
—তার মানে কফিটা কি ওনার শরীরে পড়লো?
হায় হায়।
অনু ব্যাস্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটা ওর দিকে একরাশ মায়াচোখে তাকিয়ে বললো,

— আর ইউ ওকে?
***********************************
রিমঝিম বৃষ্টি আর বাজ পড়ার ভ’য়ানক শব্দ কানে আসতেই ঘুম ছুটে গেলো ক্রীতিকের।
হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে উঠে বসলো ও, ঘরিতে তখন বিকেল চারটা।
তখন অরুকে বাইরে রেখে এসে কাউচে শুয়েই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল টের পায়নি ও।

“অরু” কথাটা মাথায় আসতেই নিজের চুল নিজেই খাঁ’মচে ধরলো ক্রীতিক।
—ও’নো মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা ঠিক আছেতো?

এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো ক্রীতিক।

দরজার সামনেই দু হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে অরু। চেতনা আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ গতিতে থ’রথর করে কাঁ’পছে ওর ছোট্ট শরীরটা। সেই সাথে জোর তালে নিঃশ্বাস ফেলছে । দেখে মনে হচ্ছে শ্বা’স ক’ষ্ট হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় ফ্যাকাশে নীল বর্ন ধারন করেছে পুরো শরীর।
অরুর এ অবস্থা দেখে আড়ালে দীর্ঘঃশ্বাস ত্যাগ করলো ক্রীতিক, তারপর আলগোছে বাচ্চাদের মতো করেই নেতিয়ে পরা অরুকে দু-হাতে তুলে নিলো নিজের কোলে। ওর শরীর স্পর্শ করতেই চমকে ওঠে ক্রীতিক, বরফের মতোই ঠান্ডা হয়ে আছে শরীর,আরেকটু দেরী করে দরজা খুললে কি হতো কে জানে??
চলবে……
*********************************
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি
#পর্বঃ০৭
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
শুধু মাত্র প্রাপ্তমনষ্ক ও মুক্তমনাদের জন্য।
গল্পের হিরো কোন মিস্টার পার্ফেক্ট নয়, সে রেড ফ্ল্যাগ।

একটানা সাতদিন তীব্র জ্বরের দাপদা’হ আর সর্দি কাশির মতো বিদঘু’টে অসু’স্থতায় ভুগে তবেই সেদিন সারাবেলা বাইরে থাকার পাঠ চোকালো অরু।
এখন জ্বর নেই মোটেই, গত কয়েকদিনের থেকে আজ শরীরটাও বেশ হালকা লাগছে, তবে খুসখুসে কাশিটা যেন পিছুই ছাড়ছে না, দিনের বেলা যেমন তেমন রয়ে সয়ে হয়।কিন্তু রাত হলে যেন, কাশির চৌদ্দ গোষ্ঠী এসে ওর ঘুম হারাম করে দেয়। স্বাধে কি আর অরু এটাকে বিদঘু’টে রো’গ বলে?

আজ মনে হচ্ছে একফালি রোদ উঠেছে পুর্বাকাশে, অরু উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সমেত কাঁচ সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বরফ শীতল ঠান্ডা হাওয়া নাক চি’ড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ওর। রোদের তাপ যতটা মনে হচ্ছিলো ততটাও গাড়ো না। মুখ ভার করে আবারও জানালার কাঁচ টেনে দিলো অরু, মনে মনে ভাবলো,
—এই ঠান্ডা বাতাস লেগে যদি আবারও জ্বরটা ফিরে আসে তাহলে আপা নির্ঘাত মে’রে আলুরদম বানিয়ে দেবে।

তবে পর্দাটা আর টানলো না।রুমের কোন থেকে একটা বারস্টুল টেনে নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে পরলো জানালার মুখোমুখি।
প্রকৃতির আবহমান উত্থান পতন দেখতে দেখতে যখন ভাবলেশহীন হয়ে পরে অষ্টাদশীর উদাসীন মন।
তখনই রুমের বাইরে হাতের আঙুল দিয়ে দরজায় টকটক আওয়াজ তুলে কড়া নারে,অষ্টাদশীর মনে গ্রীক গড খ্যাতি প্রাপ্ত সুদর্শন যুবক।
অরু পেছনে ঘুরলো তৎক্ষনাৎ, দেখলো, পুরো ফর্মাল ড্রেসআপে স্ব পকেটে হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক। চুল গুলোও আজ এলোমেলো নয়,বরং হেয়ারজেল দিয়ে পরিপাটি করা। সফেদ শার্টের উপর নেভি’ব্লু কোটি আর গ্রে রঙের রিস্ট ওয়াচে তাকে অসম্ভব মানিয়েছে।
অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়,প্রথম দুটো’দিন বাড়িতে সারাক্ষন গেইম খেলে কাটালেও, গত একসপ্তাহ ধরেই প্রতিদিন রেডি হয়ে কোথাও যায় ক্রীতিক। অরু জানেনা ক্রীতিক কোথায় যায়, আর জানতেও চায়না। কারন অরুর চোখে ক্রীতিক একজন নি’র্দয় মানব। কতটা অ’মানুষ হলে, একজনকে এমন প্রতিকূল আবহাওয়ায়
ঘর থেকে বের করে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারে মানুষ? ভেবে পায়না অরু, আর না ক্রীতিকের কাছে এর কোন জবাব আছে। এই লোক বেপরোয়া স্বভাবের জানতো অরু, তাই বলে এতোটা?? তাও বিনা কারনে।এখনো সেসব কথা ভাবলে মাথাটা জল’ন্ত লাভায় টগবগ করে ওঠে অরুর।
দ্বিতীয় বারের মতো ক্রীতিকের দরজায় টোকা দেওয়ার আওয়াজ পেয়ে সম্মোহন ফিরে পেলো অরু। তবে কোন কথা না বলে শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ক্রীতিকের দিকে।

জবাবে, নিজ পকেটে হাত গুঁজে রেখে একটানা কয়েক মিনিট নিস্প্রভ তাকিয়ে রইলো ক্রীতিকও। ক্রীতিকের চোখ নিস্প্রান তবে তাকালে মনে হয় কথাদের রাজ্য,এ চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না, অরুও পারলো না, চোখ নামিয়ে সংশয় বোধ করলো, তারপর বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললো
—কিছু বলবেন??

–না।
সশব্দে কথাটা বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে গেলো ক্রীতিক।

অজ্ঞাত অরু কিছু না বুঝে,সেদিকেই তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,
—এই লোকটা এমন কেন??ভারী অদ্ভুত।
*****************************************
–অবসেশন!

—মানে ঘোর??

—হ্যা ওটাই, তুই আমার প্রতি অবসেসট অর্নব আর কিছু নয়, অযথা নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করিস না। আমার জীবনটা পদ্ম পাতার জলের মতোই আজ আছি কাল নেই, দেখা গেলো নিজ বাবার হাতেই…
বাক্যটুকু আর শেষ করতে পারলো না এলিসা, তার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে ক’ড়া গলায় শা’সিয়ে উঠলো অর্নব।
— চুপ করবি এলিসা,এই এক বাসি গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে আর কতোদিন দুরে সরিয়ে রাখবি আমাকে??

— যেদিন নিজ চোখে দেখবি, সেদিন বুঝবি আমি কোনো বাসি কিংবা বেহুদা কথা বলছি না।
— যেদিন দেখবো সেদিন তুই একা থাকবি না, আমরা তিনজনই তোর সাথেই থাকবো।নিজেকে এতোটা হেল্পলেস ভাবার কিছুই নেই।

— আমার জন্য তোরা কেন বি’পদে পড়তে যাবি?
অর্নব শীতল কন্ঠে বললো,
— তুই আর আমরা কি আলাদা বল??

এলিসা জবাব দেয়না, এই অর্নবটাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে হয়রান ও নিজেই। কাজের কথা বলতে গেলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রেম টপিকে চলে আসে,আশ্চর্য।
কিন্তু অর্নবই বা কি করবে, ভালোবাসাতো আর পরিস্থিতি বুঝতে চায়না।আর না মানতে চায় কোনো বাঁধা। নইলে এলিসার মতো নাম করা পকার প্লেয়ার কেই কেন ভালোবাসতে গেলো ও, দুনিয়াতে আর কি কোনো ভালো মেয়ে ছিলোনা??
একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে এলিসা শুধায়,
— এখন কোথায় আছিস??

— গাড়িতে, আজকেই ইউ এস এ ফিরলাম, এর মধ্যে ক্রীতিক আবার কারও ডিটেইলস চাচ্ছে ওটা বের করে দিয়ে এখন বাসায় যাচ্ছি। তোদের জন্য আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির জবটা আর বৈধ থাকলো না।

—দ্য গ্রেট হ্যা’কার অর্নব সায়ন্ত যদি বেস্ট ফ্রেন্ড হয়, তবে “ফ্রেন্ড উইথ বেনিফিট “কে না চায় বল?

অর্নব উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো,
— চলনা, আজ সিনেমা হলে গিয়ে “ফ্রেন্ড উইথ বেনিফিট “মুভিটা দেখে আসি, শুধু তুই আর আমি, হেব্বি রোমান্টিক মুভি আমি দশবারেরও বেশি দেখেছি।

–তুই একটা ন’ষ্ট।
বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিলো এলিসা। এই ছেলের সারাক্ষণ মাখোমাখো ভাব।কি করে এতো নাম করা হ্যা’কা’র হলো ও?
তৎক্ষনাৎ ভাবনার সুতোয় টান পরলো ওর, অযাচিত মন বললো,
— ওয়েট, ক্রীতিক কার ডিটেইলস চাইলো অর্নবের কাছে? নতুন করে আবার কার সাথে ঝা’মেলা পাঁকাতে চাইছে ওও??
****************************************
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সন্ধ্যা সাতটা, ক্রীতিক মাত্রই বাড়িতে এসেছে,বেশভুসা দেখে মনে হচ্ছে বাইক রাইডিং এ গিয়েছিল সে।
পা’স’ওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলে হলরুমের মধ্যেখানে পা রাখতেই দু’পা নিজ গতিতে থমকে গেলো ওর। ভেতরে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পরলো অজানা লাবডুড। সেখানেই কিছুক্ষণ একইভাবে দাড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সবচেয়ে কর্নারের কাঁউচের দিকে।

ঘাড়টা সামান্য কাত করে মুখে একটা বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে দেখতে লাগলো ঘুমন্ত মেয়েটাকে । এই মেয়েটা ওর চেনা খুব চেনা। যেখানে মেয়েদের প্রতি তীব্র অনীহা ওর, সেখানে এই হাটুর বয়সী মেয়েটার প্রতি অদম্য আসক্তি। অথচ এই অনুভূতি গুলোকে কত বছর ধরে অস্বীকার করে যাচ্ছে ও।

খুবই সন্নিকটে একজনার উপস্থিতি স্পষ্ট অথচ তখনও হল রুমের নরম গদিতে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাচ্ছে অরু।
গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকায় জামা কাপড়েরওও হদিস নেই।প্লাজো টিশার্ট দুটোই যায়গা থেকে সরে গিয়ে শরীরের অর্ধেকাংশ উন্মু’ক্ত। হল রুমে জ্বালিয়ে রাখা বিস্তর ফকফকে সাদা আলোয় সে সব কিছুই ক্রীতিকের চোখে দৃশ্যমান।
ও না চাইতেও একঝলক পা থেকে মাথা অবধি পরখ করলো অরুকে। হুট করেই কেমন ঘোর লেগে এলো দু’চোখে। নে’শাগ্রস্তদের মতোই চোখ দুটো ঝাপসা লাগছে ওর। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।বারবার জিভ দিয়ে শুকনো অধর ভিজিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে শুয়ে থাকা অরুর লতানো নারীদেহের ভাঁজ গুলো বড্ড আকর্ষনীয় লাগছে ক্রীতিকের চোখে।

বয়সের তারতম্য, সম্পর্কের জটিলতা সব কিছু কয়েকমূহর্তের জন্য ভুলতে বসেছে দ্য গ্রেট পার্সোনালিটি খ্যাত জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী ।
মেয়ে মানুষে নাকি তার এলার্জী, ভার্সিটির টিচার থেকে স্টুডেন্ট সবাই তো এটাই জানে।

কিন্তু এখন এই মূহুর্তে এমন কেন হচ্ছে? আট বছর আগের তৈরী হওয়া প্রনয়াসক্তি কেনই বা হুট করে মাথা চা’ড়া দিয়ে উঠছে। তাহলে কি ক্রীতিক অরুকে নয় বরং নিজ অনুভূতি কে ঘৃ’ণা করে?? সৎ মায়ের মেয়ের প্রতি এতোটা দূর্বলতা কোন সমাজই মেনে নেবেনা, বাঙালি সমাজ তো একদমই নয়, তাইতো নিজে বাঙালী হয়েও বাঙালিদের প্রতি এতো রা’গ ওর। ভালোবাসায় আবার সমাজ কিসের? ধর্মে যার প্রাধান্য আছে সমাজে তার সীকৃত নেই কেন?? ভেবে পায়না ক্রীতিক। এই মূহুর্তে ভাবতেও চায়না কোনো কিছু । ওর চোখে পৃথিবী এখানেই থমকে গিয়েছে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরুর শিওরে ধপ করে বসে পরে ক্রীতিক, ফ্লোরে উরোঝুরো হয়ে পরে থাকা লম্বা চুল গুলোর দিকে একপলক গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ওর কানের কাছে এসে হিসহিসিয়ে ক্রীতিক বলে,
— আবার কেন ফিরে এলি এই আধ পো’ড়া জীবনে?? বাকিটা পু’ড়িয়ে দিতে??

তারপর একটা কপট হাসি খেলে গেলো ক্রীতিকের ঠোঁটের কোনে, মুখটা আর-ও একটু সামনে বাড়িয়ে, একই সুরে বললো,
—এবার যদি সত্যিই তোর আসক্তি থেকে নিজেকে সামলাতে না পারি, তাহলে বিশ্বাস কর তুইও পু’ড়’বি। আমার দহনে পো’ড়া’বো আমি তোকে। এখন তো ছোট নেই,তাহলে তুই কেন বেঁ’চে যাবি?এবার আর আমি একা নই, আমরা দুজনে মিলে প্রনয়াসক্ত হবো।

ক্রীতিক অযাচিত ঘোরের বসে আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরু ঘুমের তালে একটু নরেচরে ওঠে। অকস্মাৎ সম্বিত ফিরে ফেলো ক্রীতিক।
কি করছিল ও এটা??সঙ্গে সঙ্গে অরুর দিকে তাকিয়ে কঁপাল কুঁচকে ফেললো ও। এক ঝটকায় উঠে দাড়িয়ে ওয়ার্ডরব থেকে একটা লম্বা চাঁদর বের করে ছু’ড়ে’ মারলো অরুর উন্মুক্ত গায়ে। এমন ভাবে দুর থেকে ছু’ড়’লো যেন অরুর শরীরে কোন নোংরা লেগে আছে।

গায়ে কাথা জাতীয় কিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে সেটাকে ভালো মতো গায়ে পেঁচিয়ে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো অরু।
সরু যায়গা হওয়াতে পাশ ঘুরতেই কাঁচের টি-টেবিল থেকে ছোট্ট বাইকের শো-পিচ টা পরে যাচ্ছিলো মেঝেতে, তৎক্ষনাৎ সেটাকে ক্যাচ করে নিলো ক্রীতিক। বাইকে বসা হেলমেট পরা দের ইঞ্চি সাইজের পুতুলটাকে চোখ পাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
—-ডোন্ট ইউ ডে’য়ার টু মেইক এ সাউন্ড!!

*****************************************

সেই সন্ধ্যায় গতর ডুবে যাওয়া নরম সোফাতেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় অরু। যখন ঘুম ভা’ঙে তখন রাত নয়টা বেজে পয়ত্রিশ।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। ঘুমের রেশ কাটিয়ে আড়মোড়া ভে’ঙে উঠে বসতেই সেদিনের মতো বিশাল মনিটরের একফালি তীক্ষ্ণ আলো এসে চোখে লাগে অরুর।

সেই আলোতে ক্রীতিকের উপস্থিতি স্পষ্ট।
কানের উপর কান পট্টির ন্যায় বড় বড় হেডফোন লাগিয়ে নির্দিধায় গেমিং রিমোটকন্ট্রোলটায় হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে সে।
পড়নে বাইকার দের মতো ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট, যার সামনের দিকের চেইনটা পুরোপুরি খুলে ঘাড় থেকে খানিকটা নামানো। যার দরুন ভেতরে পরিহিত কালো স্যান্ডোগেঞ্জিটা ও দৃশ্যমান। তারউপর শরীরচর্চা করে কৃত্তিম উপায়ে বানানো অ্যাবস গুলোকে এইটুকুনি স্কিনি স্যান্ডোগেঞ্জি আড়াল করতে পারছে না মোটেই। অন্ধকারে বসে বসে আড় চোখে এসবই দেখছিল অরু। ঠিক তখনই রুমের লাইট জলে সবকিছু আলোকিত হয়ে যায়, অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ আলো চোখে পরায় কপাল কুঁচকে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো অরু।

—হা করে না থেকে,মুখের লালা পরিষ্কার কর।
সামনের মনিটরে ধ্যান রেখেই বললো ক্রীতিক।

চোখ বড়বড় করে ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকালো অরু। আগের মতোই ভাবলেসহীন মুখশ্রী।

তবে অরু আর ভাবলেসহীন হয়ে বসে থাকতে পারলো না হঠাৎ এরূপ পঁচানি খেয়ে, ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তৎক্ষনাৎ আলগোছে চুল বাঁধতে বাঁধতে দৌড়ে উপরে চলে গেলো।

তার কয়েক মূহুর্ত্ব পরে আবারও নিচে নেমে অসহায় মুখ নিয়ে ক্রীতিকের সামনে এসে দাঁড়ায় অরু।

— কি সমস্যা?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছো’ড়ে ক্রীতিক।

অরুর চোখে মুখে অ’সহায়ত্ব, কন্ঠে কাঁদও কাঁদও ভাব,কোন মনে কান্না আটকে রেখে ও বললো,
— আপা এখনো ফেরেনি।প্রতিদিন তো সন্ধ্যায় ফিরে আসে।
— তো আমি কি করবো,
ভাবলেশহীন জবাব ক্রীতিকের।
— আপনার ফোনটা একটু দিন আপাকে কল করবো।
— ল্যান্ড লাইন দিয়ে কর।
— নাম্বার জানিনাতো।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে, পকেট থেকে ফোন বের করে অরুর হাতে দেয় ক্রীতিক।

অরু কল করলো, একবার, দুইবার,তিনবার তাও ধরলো না অনু।
এতো রাত হয়ে গেছে আপা ফিরছে না, কল ও ধরছে না, অযাচিত ভ’য়েরা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল অরুকে।অজস্র খারাপ চিন্তায় পেটের মধ্যে না’ড়িভু’ড়ি কেমন উগরে আসতে চাইছে। কিন্তু না সেসবের বদলে উগরে আসলো কা’ন্নারা, অনেক চেষ্টা করেও ক্রীতিকের সামনে স্থীর থাকতে পারলোনা অরু। ধপ করে মেঝেতে বসে ফুপিয়ে কেঁ’দে উঠলো।

আবার সেই একই কা’ন্নার আওয়াজ। অরু কি বোঝেনা কোন এক অজানা কারনে এই আওয়াজে ভেতরটা ছিঁ’ড়ে যায় ক্রীতিকের? গলা কাঁ’টা মুরগীর মতোই ছ’টফ’ট করে ওঠে হৃদয়টা। ইচ্ছে করে সব কিছু ধ্বং’স করে ফেলতে।ভেতরে যা হচ্ছে হোক,সেসব কে পাত্তা না দিয়ে, আপাতত অরুকে রা’ম ধমক দিয়েই শুধালো ক্রীতিক।
— কি হয়েছে, ভ্যা ভ্যা করছিস কেন?

অরু কাঁদ’তে কাঁ’দতে জবার দেয়
— আপা কল তুলছে না, এখান আসার পর থেকেই আপা কেমন যেন ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। এখন আবার কলটাও ধরছে না।

— পার্ট টাইম জব করলে ব্যাস্ত হবেনা তো কি হবে, মুখ টিপেটিপে বললো,ক্রীতিক।
— কিছু বলছেন??
— না, তুই কা’ন্নাকা’টি অফ কর।তোর কা’ন্নার আওয়াজ বির’ক্ত লাগে।
—- আমি কাঁ’দলেও আপনার বির’ক্ত লাগে হাসলেও বির’ক্ত লাগে, করবোটা কি আমি??
—- চুপ করে থাকবি।

অরু তাই করলো,চুপ হয়ে বসে রইলো। এমনিতেই ক্রীতিকের সামনে কেঁ’দে ফেলেছে, এখন ভাবতেই কেমন লজ্জা করছে ওর, ওও তো এতোটাও বাচ্চা স্বভাবের মেয়ে নয়, যথেষ্ট স্ট্রং।
অরুর ভাবনার ছেদ ঘটে ক্রীতিকের আওয়াজে
—আমি বের হয়ে আশেপাশে খুঁজে দেখছি, তুই থাক।
অরু একটু একটু হেঁচকি তুলে বললো,
— আমিও যাবো।নিয়ে যাননা।
*****************************************
ম্যাকডোনাল্টস ক্যাফেটেরিয়ার পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে, আশেপাশের রাস্তায় হাটছে ক্রীতিক আর অরু।
ওভারসাইজ ডেনিমের পকেটে হাত ঠুকিয়ে গা ছাড়া ভাব নিয়েই হাঁটছে ক্রীতিক। দেখে মনে হচ্ছে ওর মধ্যে চিন্তার লেশমাত্র নেই।ওদিকে অরু ভেবে পাচ্ছে না হসপিটালে না নিয়ে গিয়ে ওকে এখানে কেন নিয়ে এলো পা’গল লোকটা?আপা তো হসপিটালে।
অরু বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছে আগ বারিয়ে।
কিন্তু ক্রীতিকের সোজাসাপটা উত্তর
— আশেপাশে খোঁজ এখানেই পেয়ে যাবি।

অরু সেই তখন থেকে এদিক ওদিক হন্নে হয়ে ছুটছে, সোডিয়ামের আলোয় যতদূর চোখ যায় কোথাও কোন মানুষ নেই। ক্যাফেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে খানিকক্ষণ আগে অথচ অনুর দেখা নেই।
— আচ্ছা তোর পেটের মাঝখানের তিলটা কি আসল??যখন ছোট ছিলি তখন তো দেখিনি।

পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তায় অরু যখন অনুকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল প্রায়,ঠিক তখনই ক্রীতিক জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মতো ভাবুক হয়ে এই ছাপরি প্রশ্নটা করে বসে।

এই মূহুর্তে ক্রীতিকের কথায় অরু ওর গোপন তিলকের খবর জানায় অবাক হবে,নাকি আহা’ম্মকের মতো প্রশ্ন করায় গিয়ে ঠা’টিয়ে থা’প্প’ড় মা’রবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। যত যাই হোক। বয়সে ওর চেয়ে দ্বিগুণ বড় ক্রীতিক।

তবে কিছু তো কথা শোনানোই যায়, সেই উদ্দেশ্যেই ঘুরে পেছনে এগিয়ে এলো অরু।
তখনই উল্টো দিক থেকে ডাক পরলো অনুর।
— অরুউউ

অরু চকিতে পেছনে চাইলো দেখলো, খুঁ’ড়িয়ে খুঁ’ড়িয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে আপা। তার সঙ্গে লম্বা মতো একটা ভাইয়া, অনুর হাতধরে ওকে হাঁটতে সাহায্য করছে, অনুর ছোট্ট শরীরটা লোকটার শীতের কোর্টদিয়ে আবৃত।
লোকটা কে?কি হয়?কেনইবা অনুর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে?
সে-সব নিয়ে এই মূহুর্তে একবিন্দু পরিমান মাথা ব্যাথা নেই অরুর। ও শুধু দেখছে ওর আপা ব্যা’থা পেয়েছে হাটতে পারছে না ভালো করে।

একদিক দিয়ে ক্রীতিক আর অরু এগিয়ে আসছে, অন্যদিক দিয়ে অনু আর প্রত্যয়। প্রত্যয় আর ক্রীতিকের চোখেচোখে কথা আদান-প্রদান হলো বোধ করি।
কয়েকমূহুর্তের মধ্যে অরু ছুটে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো অনুর, উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,

— আপা, আমায় রেখে কোথায় গিয়েছিলি তুই? তোর চিন্তায় চিন্তায় পা’গল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি, একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল এই অচেনা দেশে আমার আপন বলতে কেউ নেই।
অরুর কথায় ক্রীতিকের মেজাজ অকস্মাৎ তে’ড়ে উঠলো। এইটুকু সামান্য কথায় রাগ লাগার মতো কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ক্রীতিক,তবুও কয়েকমূহুর্তের জন্য চোখের রঙ বদলালো ওর। আবারও সেই ভ’য়ানক তীক্ষ্ণ চাউনি।
পরক্ষনেই প্রত্যয়ের সাথে চোখাচোখি হওয়ায় আবার তা দপ করেই নিভে গেলো।

পাছে এসে জড়ো হলো ঠোঁট গলিয়ে একটা রহস্যময়ী ক্রুর হাসি। যে হাসিতে সামিল হলো সয়ং প্রত্যয় ওও।
ওরা যে কি মনে করে হাসলো সেটা কেবল ওরাই ভালো জানে।
চলবে……….