#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ১৩
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
[সকল দৃশ্যপট কাল্পনিক ]
শীত পেরিয়ে সেই কবেই বসন্ত নেমেছে ধরনী জুড়ে। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার জগাখিচুড়ী আবহওয়ায় সেই বসন্ত খুব একটা উপভোগ্য নয়। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর থেকে দু কদম বাইরে দিলেই যেন যত্রতত্র শীত বুড়ি এসে জড়িয়ে নিচ্ছে আষ্টেপৃষ্টে।
দীর্ঘদিন ধরে বইতে থাকা শীতের সেই দাঁত কাঁপানো কনকনে হাওয়াকে হটিয়ে , আজ সকাল সকাল বাসন্তিক হিমেল হাওয়া বইছে পুরো ক্যালিফোর্নিয়া টু সানফ্রান্সিসকো জুড়ে। নাক চেনে বুক ভরে বাতাস নিলে মনে এটা শহুরে জনবহুল স্টেট থেকে আসা কোন দূষিত বাতাস নয়,বরং প্রশান্ত মহাসাগর ছাপিয়ে আসা বিশুদ্ধ দক্ষিনা বাতাস।বাতাসের তালে তাল মিলিয়ে ভেসে আসছে চেরিব্লোসমের দারুণ মিষ্টি সুবাস।হাইওয়ে বা জনবহুল কোনো ফুটপাত কিংবা নামি দামি কর্পোরেট অফিস, চেরিব্লোসমের কারনে আজকাল সব যায়গাকেই কেমন ফুলের বাগান মনে হয়।
বছর তিনেক আগে কেনা ক্রীতিকের ডুপ্লেক্স বাড়িটার ফ্রর্ন্ট ইয়ার্ডেও দু’টো চেরিব্লোসম গাছ রয়েছে। কালো ফেঞ্চ গেইটটার দুইধারে পাহারাদারের মতোই সর্বক্ষন পাহাড়ায় দাড়িয়ে তারা। বসন্ত হওয়ার দরুন চেরিব্লোসমের ভারে কেমন নুয়িয়ে পরেছে গাছ দুটো।
অরু একঝলক গেইটের দু’পাশে ব্লোসম সজ্জিত গাছের দিকে তাকাচ্ছে, তো পলক ফেলে আবার ক্রীতিকের দিকে।
যে এই মূহুর্তে কপাল কুঁচকে রেখে, শক্ত মুখে অরুর দিকেই তাকিয়ে আছে।
ফর্মাল ড্রেসআপ, হাতে ম্যাকবুক, চোখে মুখে কঠিন বিরক্তির ছাপ, গত পাঁচ মিনিট যাবত এভাবেই চলমান মূর্তি হয়ে হলরুমে দাঁড়িয়ে আছে ক্রীতিক।
আর অরু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের মুখের পানে, যেন ক্রীতিক জাদুঘরে সংরক্ষিত কোন বিশেষ বস্তু, সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখলেই নয়।
তবে ক্রীতিকের মতো রগচটা মানুষের কাছে ব্যাপারটা বেশ বিরক্তি কর। কথা নেই বার্তা নেই পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্রেইঞ্জ।একটানা একই যায়গায় বিনা বাক্যে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে এতোক্ষণে সেই বিরক্তি কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে পৌঁছালো সপ্তম আসমানে, ক্রীতিক নিজের তীক্ষ্ণ চোয়ালে আরও খানিকটা তীক্ষ্ণতা ধারণ করে বললো,
— সেই কখন থেকে পথ আটকে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস,কি সমস্যা?
চোখে কয়েকবার পলক ফেলে, ঢকাত করে এটা শুকনো ঢোক গিলে অরু শুধায়,
— ভাবছি, আপনি কি আসলেই কালকের সেই মানুষটা?? যে ওভাবে বল নাচ…
— শাট আপ।
ক্রীতিকের ধ’মকে অরুর কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো।
—আমি বয়সে তোর থেকে কত বড় তা খেয়াল না রেখেই যা মুখে আসছে তাই বলে দিচ্ছিস,স্টুপিড একটা।
ধ’মক খেয়ে অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
— আপনি বড় সেতো আমিও জানি, আর তাইতো আরও বেশি আশ্চর্য হচ্ছি, কালকের আপনাকে তো আমি চিনতেই পারছিলাম না,জানেন? কেমন কেমন যেন লাগছিল আপনাকে, আর ওই চোখ গুলো।
অরু হাত উচিয়ে ক্রীতিকের চোখে ইশারা করতেই ক্রীতিক ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেলে, তারপর গমগমে আওয়াজে বলে,
— জ্ব’রটা এখনো আছে তাই ভুলভাল বকছিস, আজ আর ভার্সিটি যেতে হবে না।
অরু নিজ ভ্রুকুঞ্চিত করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে, মুখে বির’ক্তির ছাপ টেনে ক্রীতিকের আদেশের ঘোর বিরো’ধীতা করে বললো,
— ভার্সিটি যাবোনা মানে? দেখছেন সকাল সকাল রেডি বেরিয়েছি, তাও বলছেন ভার্সিটিতে যাবোনা?
— তোর শরীরটা ভালো নেই তাই বলছি, নয়তো তুই কোথায় যাবি, না যাবি সেসবে আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই।
অরু নিজের গাল গলায় হাত ছুয়িয়ে বললো,
— এতোটুকু জ্বরে কিছু হবেনা। সরুন তো আমি ভার্সিটি যাবো, আজ নিখিল ভাইয়ের সাথে ট্যুরের ব্যাপারে দরকারি কথা বলার আ…
তপ্ত গালে খরখরে হাতের শ’ক্ত চা’প অনুভব করতেই অরুর কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো,ক্রীতিকের হঠাৎ আ’ক্রমনে স্ব স্থান থেকে কয়েককদম পিছিয়ে অরুর পিঠ গিয়ে ঠেকলো কাঁচ লাগানো প্রসস্থ দেওয়ালে,ক্রীতিক এমন ভাবে চোয়াল চে’পে ধরেছে যেন মনে হচ্ছে এখনই গাল ফেটে র’ক্ত বেরিয়ে আসবে।
ক্রীতিক নিজ হাতের বাধন ঢিলে না করেই রুষ্ট কন্ঠে বললো,
— আমি বলেছি,” না” তার মানে না’ই।কথার উপর পাল্টা যুক্তি আমার একদম পছন্দ নয় অরু। একদিন একটু নরম বিহেভিয়ার দেখেছিস বলে এইনা যে, আমি প্রতিদিন সেটা কন্টিনিউ করবো। এখন যেটা দেখছিস এটাই আমি, রুড,উ’গ্র, বেপরোয়া। আর এই রুড মানুষটাকেই সারাজীবন সহ্য করতে হবে তোর। এন্ড দিস ইজ মাই সেকেন্ড টাইম ওয়া’র্নিং। নেক্সট টাইম আর ওয়া’র্নিং দিতে আসবো না ডিরেক্ট একশন নেবো,মার্ক মাই ওয়ার্ড।
অরুর মুখ থেকে অস্পষ্ট সুরে কথা বেরুলো এতোক্ষণে,
— উমম লা..লাগছে আমার..
ক্রীতিকের হঠাৎ প্রতিক্রিয়াটা ভেতর থেকে এসেছিল,তাই নিজেও বুঝতে পারেনি ও অরুকে নিজ হাত আর কথার দ্বারা ঠিক কতটা ব্যাথা দিচ্ছে।
তবে খানিকক্ষণ আগে অরুর বলা,” লাগছে আমার” কথাটাই যথেষ্ট ছিল ক্রীতিকের গ’র্জে ওঠা অ’গ্নিস্ফু’লিঙ্গতে শীতল জলের ছাট দেওয়ার জন্য। ক্রীতিক নিরবে অরুর গালটা ছেড়ে দিতেই অরু নিজের নরম গাল দুটোতে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্ত সুরে অস্ফুটে বললো,
— সারাজীবন তো দূরে থাক, উপরওয়ালার ইচ্ছায় মা সুস্থ হয়ে গেলে, আপনার মতো মানুষের সাথে এক ছাদের তলায়, তারপর আর এক মূর্হুত ও নয়।
অরুর বিড়িবিড়িয়ে বলা বাক্যটা ক্রীতিক খুব ভালো ভাবেই শুনলো, অতঃপর নিজ পকেটে দুহাত গুঁজে রেখে সটান দাড়িয়ে ঘাড়টা একটু কাত করে জবাব দিল,
— বিলিভ মি অরু, তুই শুধু আমার সাথে এক ছাঁদ নয়,আরও অনেক কিছু শেয়ার করবি। তাও নিজ ইচ্ছাতে, আই সয়ার।
অরু এবার আর মুখে কোনো কথায়ই উচ্চারণ করলো না,বরং মনে মনে বললো,
— এই জীবনে অন্তত তা হবে না। মা সুস্থ হয়ে গেলেই দেশে ফিরে যাবো আমরা। তারপর আপনি আর আপনার বোরিং জীবন, দুটোর হাত থেকেই রেহাই পাবো আমি আর আপা।
অরু এখনো দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক বললো,
— এবার পথ ছাড়, নয়তো কাঁ’ধে তু’লে গেইটের বাইরে ফে’লে রেখে আসবো।
অরু তৎক্ষনাৎ সরে দাঁড়ায়। অরু সরতেই ক্রীতিক গটগট পায়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো পেছনে তাকিয়ে অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— টেইক সাম রেস্ট,ইউ আর উইক।
ভার্সিটি যেতে দেয়নি দেখে অরুর মেজাজ এমনিতেই সপ্তম আসমানে চড়ে ছিল, ক্রীতিকের দরদী কথায় তাতে যেনো আগু’নে ঘি ঢালার উপক্রম হলো,ও তেতিয়ে উঠে বললো,
— মোটেই আমি উইক না বুঝেছেন, মেয়ে মানুষ বলে এতো স’স্তা ভাববেন না, লাগতে আসলে আপনাকেও দু’হাতে তুলে গেইটের বাইরে ফে’লার ক্ষমতা আমি রাখি।
ক্রীতিক পেছনে না তাকিয়েই চোখের উপর সানগ্লাস বসাতে বসাতে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— সময় হলে সে ক্ষমতা নিশ্চয়ই দেখবো জান।
কথাটা বলার সময় ক্রীতিকের ঠোঁটের কোনে দৃশ্যমান ছিল সেই মনোমুগ্ধকর বাঁকা হাসি।
*****************************************
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। সকালের পর থেকে অরুর জ্ব’রটা বেড়েছে দিগুণ অথচ পুরো বাড়িতে কেউ নেই। কি করে থাকবে? অনু ডাক্তারের আর্জেন্ট কলে সেই সকাল সকাল হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে এখনো ফেরার নাম নেই। আর ক্রীতিকের থাকা না থাকা অরুর জন্য সমান কথা।কারন আর যাই হোক অরু জ্বরে জ্ঞান হা’রিয়ে পরে থাকলেও ক্রীতিকের মতো মানুষ অন্তত ওকে সেবা করতে আসবেনা,নিশ্চয়ই?
সেই সকাল থেকে হল রুমের কাউচে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অরু, শরীরের প্রচন্ড দাপদাহে সারাদিনে কিছু খাওয়ার ইচ্ছাও হয়নি আর। ক্রীতিকের ভ’য়ে ভার্সিটি না গিয়ে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, ভার্সিটিতে বসে এমন জ্ব’র বেড়ে গেলে তো মহা মসিবত হতো। পাছে না আবার সেদিনের মতো ভরা ক্যাম্পাসে সবার সামনে অজ্ঞান হয়ে পরে গিয়ে মানসম্মানের বারোটা বেজে যেতো ।
জ্বর ওঠার মূহুর্তটা রোমাঞ্চকর,আপাতত সেই রোমাঞ্চকর সময়টাই পার করছে অরু। গড়ম কম্ফোর্টারের মাঝে শুয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাথায় কিলবিল করছে হাজার খানেক প্রশ্ন। কখনো অজান্তেই মনে পরে যাচ্ছে বাংলাদেশের আঁকাবাকা মেঠোপথ, তো কখনো আরাম প্রিয়, সংস্কৃতি মনা, নানা বৈশিষ্ট্যের অধিকারি নিজ দেশের সরলমনা মানুষ গুলোর কথা। বাঙালি, সংস্কৃতি এসব ভাবতেই অরুর মনে পরে যায়, কাল পার্টিতেও কোনো একটা বাংলা গান বাজছিল, তারপর ক্রীতিকের মাঝেই যেন অন্য কেউ হানা দিলো, একজোড়া মাদকতা জড়ানো বেসামাল নিস্প্রভ চোখ। যে চোখে কয়েকমূহুর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল অরু। আর তারপর? তারপর ওর সাথে যে ভ’য়ং’কর আর বা’জে কাহিনিটা ঘটলো। যার
ফলস্বরূপ এখন এই মূহুর্তে একশো তিন ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্ব’রে ঝ’লসে যাচ্ছে অরু।
জ্বরে পুড়’তে পুড়’তেই হঠাৎ বোধ হলো,কালকে ক্রীতিকের অনুমতি ছাড়া পার্টিতে যাওয়া মোটেই উচিৎ হয়নি ওর। হাজারো চিন্তার মাঝেই অরুর বুক চিড়ে বেড়িয়ে এলো একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস। ঠিক তখনই কানে ভেসে আসে পাসওয়ার্ড টিপে মেইনডোর খোলার পিকপিক আওয়াজ। কে এসেছে দেখার জন্য অরু কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়েই উঠে বসলো, তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের নাম করে হাঁক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে ভেতরে প্রবেশ করলো এলিসা।
এলিসার চোখে মুখে রা’গের ছাপ স্পষ্ট।রা’গের তোপে এই মূহুর্তে নাকের ডগাটা তিরতির কাঁপছে ওর। অরু এলিসার অ’গ্নি মূর্তি দেখে খানিকটা ভরকালো,অতঃপর সাহস জুগিয়ে শুধালো
— কোন সমস্যা আপু?
এলিসা দোতলার করিডোর থেকে চোখ সরিয়ে অরুর পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঠকাঠ আওয়াজে জিজ্ঞেস করল ,
— জেকে কোথায় অরু?
— সকালেই ভার্সিটিতে গেলো।
মিনিমিনিয়ে জবাব দেয় অরু।
অরুকে ভারি কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে থাকতে দেখে এলিসা নিজের রা’গী ভাব আড়াল করে নরম কন্ঠে শুধায়,
— তুমি ঠিক আছো অরু, কাল শুনলাম তুমি নাকি সে’ন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে? কিন্তু কেন? আমিতো তোমাকে সাথে সাথেই রেখেছিলাম সারাটাক্ষন মাত্র কয়েক মূহুর্তের জন্য ক্লাবের বাইরে গিয়েছিলাম তাও অত্যাধিক প্রয়োজনের বশবর্তী হয়ে। এর মাঝে তুমি কি এমন দেখলে যে এভাবে জ্ঞা’ন হারালে? বলো আমাকে?
অরু হাসার চেষ্টা করে বললো,
— আমি বদ্ধ কিংবা আটকানো যায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা আপু,দ’ম ব’ন্ধ হয়ে আসে। সে কারনেই তো প্রতিদিন মায়ের কাছে যাই না, সপ্তাহে একবার করে যাই।
এলিসা সচকিত হয়ে বললে,
— কে আটকে রেখেছিল তোমায়??
এলিসার প্রশ্নে অরুর মুখটা পাংশুটে রূপ ধারণ করলো।ও কেন যেন জবাব দিতে চাইলো না।
এলিসা আবারও অরুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ফোন কল চলে আসাতে জিজ্ঞাসাবাদ পর্বের এখানেই ইতি ঘটে। এলিসা ফোন কানে তুলে মেইনডোর দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে অরুর উদ্দেশ্যে বললো,
— আমি একটু তাড়ায় আছি অরু। নেক্সট টাইম এসে শুনবো।
এলিসা চলে যাওয়াতে অরু যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো। জ্ব’রের ঘোরে এটা ওটা এতো প্রশ্নের মোটেই উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না অরুর,এলিসা চলে গিয়েছে ভালোই হয়েছে।
মুখে আটকে রাখা দমটা এক নিঃশ্বাসে বের করে দিয়ে, আবারও সাবধানে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো অরু। ঠিকঠাক হয়ে শুতে শুতে অস্ফুটেই বললো,
— এলিসা আপু হঠাৎ ক্রীতিক ভাইয়ার খোজ করছে কেন? তাও বাড়ি বয়ে এসে?ফোন করলেই তো হয়, অদ্ভুত মানুষ।
****-******-*********-********-******-**
ভার্সিটির গেইটে এসে দাড়াতেই সিকিউরিটি গার্ডটা এলিসার পথ আটকে দাঁড়ালো। অতঃপর প্রশিক্ষন প্রাপ্ত রোবটের ন্যায় একনাগাড়ে বললো,
— সরি ম্যাম, আইডি কার্ড ছাড়া ভেতরে প্রবেশ এলাউ না।
এলিসা মাথা নিচু করে কথাটা শুনলো, অতঃপর নিজের এ্যাথলেটিক পাঁচ আঙুল মু’ঠিবদ্ধ করে সিকিউরিটি গার্ডের নাক বরাবর একনাগাড়ে দুই তিনটা পা’ঞ্চ বসিয়ে কটমটিয়ে বললো,
— কে আটকাবে আমায়??বল কে আটকাবে?
এলিসার শক্ত হাতের ঘু’ষি খেয়ে সিকিউরিটি লোকটা সেখানেই পরে রইলো, আর এলিসা ঢুকে গেলো ক্যাম্পাসের ভেতর।
ভার্সিটিতে নিজের অফিস রুমে বসে ম্যাকবুকে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে ক্রীতিক। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার দরুন, সুন্দর চোখ দুটো স্ক্রীনেই আটকে আছে,সেইসাথে খানিক বাদে বাদে অজান্তেই দাঁত দিয়ে নিজের অধর কা’মড়ে ধরছে ও। ব্যাপারটা বেশ চমৎকার দেখাচ্ছে। এই দৃশ্যটা এক পলক দেখলে যে কোন মেয়ের মুখ থেকেই বেরুবে একটা বাক্য,
— হাউ ম্যানলি।
তবে এলিসা তো কোন সাধারন মেয়ে নয়,বরং আস্ত একটা ডে’ঞ্জার। তাই ওর এসবে খেয়াল ও কম।আর এই মূহুর্তে এলিসা নিজের মেয়েলি চেহারার নিচে আসল রূপটা দেখিয়েও দিলো, ও ক্রীতিকের কেভিনের দরজাটা সশব্দে খুলে, জেকে বলে চেঁচিয়ে উঠলো ।
ক্রীতিক ওর দিকে চোখ না ঘুরিয়েই শান্ত স্বরে বললো,
— হোয়াটস রং চেচাচ্ছিস কেন? এটা বিদ্যাপিঠ ভুলে গিয়েছিস?
এলিসা ধাপধাপ পায়ে দু’কদম এগিয়ে এসে বললো,
— তুই ক্যাথের সাথে এটা কেন করেছিস ক্রীতিক?
— কি করেছি?
ক্রীতিকের দায়সারা উত্তর শুনে বিরক্ত লাগছে এলিসার। তবুও চোখ বন্ধ করে নিজেকে খানিকটা সংবরণ করে বললো,
— তুই ক্যাথলিনের চুল কেন কে’টে দিয়েছিস?তাও এমন ভাবে কে’টেছিস মেয়েটার ন্যাড়া হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
এলিসার কথায় আপাতত ক্রীতিকের কোনো হেলদোল নেই, ও মনদিয়ে ম্যাকবুকে কিছু একটা টাইপ করে যাচ্ছে এক নাগারে।
এলিসা এবার রে’গে ক্রীতিকের ডেস্কের উপর সজোরে বারি মেরে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
— পা’গলামির একটা সীমা থাকে ক্রীতিক। তুই যখন যা করিস আমরা তোকে সবসময় সাপোর্ট করে যাই।হোক সেটা ভালো কাজ কিংবা খারাপ। তাই বলে এতোটা জ’ঘন্য কাজ? তুই কি আদৌও জানিস একটা মেয়ের কাছে তার চুল কতোটা মূল্যবান? চুল হারানোর দুঃখে মেয়েটা লিটরেলি সুই’সা’ইড করতে গিয়েছিল। ক্যান ইউ ইমাজিন?
এবার ম্যাকবুক থেকে চোখ সরিয়ে কথা পারলো ক্রীতিক,
— একজ্যাকলি আই ক্যান ইমাজিন। এন্ড দ্যাটস হোয়াই আই ডিড ইট। কারণ ক্যাথলিনেরও বোঝা উচিৎ অন্যকারও চুল
আমার কাছেও ঠিক কতোটা মূল্যবান।
মখমলের ন্যায় মসৃণ কন্ঠস্বর অথচ কথার পরতে পরতে তীব্র রা’গের বহিঃপ্রকাশ।
এলিসা বি’রক্ত হয়ে বললো,
—তোর কথার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার জেকে। প্লিজ এই হাইড এন্ড সিক গেইমটা এবার অফ কর।
ক্রীতিক কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
— খুলেই তো বললাম, আমিই ক্যাথলিনের চুল কে’টে দিয়েছি।
— কেনো কে’টেছিস?
কারণ ক্যাথলিন অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলো। থ্যাংকস টু সায়র এন্ড অর্নব ভুলটা করার আগেই ওরা ঘটনাস্থলে চলে আসে। ক্যাথলিন যে ভুল করার সাহস দেখিয়েছে তারজন্যই স্রেফ ছোট্ট একটু শা’স্তি দিলাম।
ক্রীতিকের ঘুরানো প্যাঁচানো কথার জট খুব বেশি খোলা হলোনা এলিসার, তার আগেই কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড এসে ক্রীতিককে আর্জি জানিয়ে বলে,
— স্যার উনি, গেইটের সিকিউরিটি গার্ডকে মে’রে ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। কতৃপক্ষ থেকে ওনাকে ধ’রে ক্যাম্পাসের বাইরে বের করে দেওয়ার অর্ডার এসেছে ।
এলিসা চোখ ছোটছোট করে ক্রীতিকের তাকিয়ে ইশারা করে বললো,
— কিরে বল আমি তোর ফ্রেন্ড?
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে একবার এলিসার ইশারা’রত মুখের পানে চাইলো তারপর সিকিউরিটির পানে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,
— যা বলা হয়েছে তাই করুন, টেনে টুনে নিয়ে যানতো। সেই কখন থেকে এসে কানের মাথা খাচ্ছে, পা’গল মনে হয়।
এলিসা ক্রীতিকের দিকে তে’ড়েমে’রে এসে বললো,
— জেকের বাচ্চা আমাকে তোর পা’গল মনে হয়?
তবে খুব বেশি কাছে আসার আগেই সিকিউরিটিরা সবাই মিলে ধরে ওকে টান’তে টান’তে নিয়ে গেলো একেবারে ক্যাম্পাসের শেষ মাথায় গেইটের কাছে।
ক্রীতিক থাই লাগানো জানালার সামনে দাড়িয়ে কফি পান করতে করতে সে দৃশ্য দেখেই ঠোঁট কাম’ড়ে হাসছে। হাসতে হাসতেই চোখ মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেলো ওর। এতোক্ষণের হাস্যোজ্জল গৌড়বর্ণ মুখটা ক্ষনিকের মাঝেই কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেলো, মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো কাল সিসিটিভি ক্যামেরায় ব’ন্ধি অযাচিত মূহুর্ত গুলো।সেই সাথে কালকের পার্টিতে ঘটে যাওয়া ছোট বড় প্রত্যেকটা ঘটনা।
.
.
কাল বল নাচের সময় অরুকে এতোটা কাছে পেয়ে ক্রীতিক নিজের মধ্যে ছিলনা। অজান্তেই আটকে গিয়েছিলো অরুরময় ভ্রমের গোলকধাঁধায়। সবসময়ের বাধ্য মস্তিষ্কটাও তার তাল হালিয়ে চলে গিয়েছিল অ’বাধ্য মনের বশে।
তারপর অরু যখন ওভাবে দৌড়ে চলে গেলো,তখনই সম্বিত ফিরে পায় ক্রীতিক, ফিরে আসে কঠিন বাস্তবতায়।তবুও কোন এক অযাচিত বি’পদ থেকে অরুকে প্রটেক্ট করতেই পিছু নিয়েছিল ওর। কিন্তু অরু স্টেজের পেছনে চলে গেলেও ক্রীতিকের আর যাওয়া হয়নি সেদিকে, তার আগেই ওকে ডেকে ক্লাবের বাইরে নিয়ে যায় এলিসা। নিয়ে যাওয়ার অবশ্য যথাযথ কারন ছিলো, তাই মনের মাঝে হাজারটা দিধা থাকা সত্বেও ক্রীতিকের যেতে হয়েছিল এলিসার সাথে।
*****************************************
ওদিকে অর্নব আর সায়র এলিসাকে খুঁজতে খুঁজতেই ব্যাক স্টেজে এসেছিল। কারণ এই পার্টিতে ওদের একমাত্র মিশন আর ভীষণ এলিসাকে প্রটেক্ট করা,কিন্তু আপসোসের বিষয় এলিসা ওদের থেকে ক্রীতিককে বেশি ভরসা করে। সায়র আর অর্নব যখন ব্যাকস্টেজের অন্ধকার করিডোর দিয়ে পা টিপে টিপে এগুচ্ছিলো, তখনই পাশের রুম থেকে কারও গো’ঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে সেদিকে দৌড়ে যায় ওরা,
রুমটা তখন পুরোপুরি অন্ধকার ছিলোনা, ভেন্টিলেটরের থেকে আসা বাইরের মৃদু আলোতে ওরা ভালোভাবেই দেখছিল ফ্লোরে অগোছালো হয়ে পরে মৃদু আওয়াজে কাতরাচ্ছে কেউ। দেখে মনে হচ্ছে খুব চো’ট পেয়েছে কিন্তু কোথায় পেয়েছে?? ব্যাপারটা বোঝার জন্য ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতেই অরুর মুখটা দেখে আঁ’তকে ওঠে সায়র। সায়র কে এভাবে শকট হতে দেখে অর্নব শুধালো,
— কিরে আঁ’তকে উঠলি কেন?
সায়র চোয়াল শক্ত করে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— অর্নব এটাতো অরু, ক্রীতিকের স্টেপ সিস্টার।
— হ্যা তাই তো দেখছি, কি হলে বলতো মেয়েটার?
সায়র অর্নবের কলার চে’পে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
— তাইতো দেখছি মানে? খবরদার এটা যাতে জেকের কান অবধি না পৌঁছায়,তাহলে তোর এ্যারেঞ্জ করা এই পার্টি ফার্ট ল’ন্ডভন্ড করে দিতে ও এক সেকেন্ডও ভাববে না, এখন চল তারাতারি ওকে সারিয়ে তুলতে হবে।
অর্নব সায়রের হাত টেনে থামিয়ে দিয়ে,
— ওয়েট, তুই এতো প্যানিক হচ্ছিস কেনো? তাছাড়া ও স্টেপ সিস্টার হয় জেকের। আ…
সায়র ওকে মাঝে পথেই থামিয়ে দিলো, দেওয়ালেরও কান আছে এমন মুখভঙ্গিমা করে বললো,
— তুই ভুল ভাবছিস অর্নব, ওসব সিস্টার ফিস্টার কিছুইনা। জেকে এই মেয়েটার প্রতি লিটরেলি অবসেশট। এই মেয়েটার জন্য ওর পা’গলামি তুই নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না, ও সবার সামনে এমন ভাব দেখায় যেন, হি ডিডন্ট ফা’কিং কেয়ার,বাট এক্সুয়ালি হি কেয়ার, নো নো কেয়ার ইজ আ লেইম ওয়ার্ড এর থেকেও বেশি কিছু।
অর্নব সায়রের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,
— আজ বোধ হয় তুই একটু বেশিই খেয়েছিস সায়র, ক্রীতিক? হাটুর বয়সই একটা মেয়ের প্রতি অবসেশট?তাও যার সাথে কিনা সম্পকের দিক দিয়ে ওর দা-কুমড়া সম্পর্ক।আর তুই এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?হাহ!
একটা উপহাসের হাসি বেড়িয়ে এলো অর্নবের ঠোঁট গলিয়ে।
তবুও যদি তুই হতি তাহলে একটা কথা ছিল। ক্রীতিকের মতো পার্সোনালিটিতে কোনোরূপ কম্প্রোমাইজ না করা মানুষ কিনা নিজের অর্ধেক বয়সী স্টেপ সিস্টারের প্রতি অবসেশট হাহাহা,ভেরি নাইস জোক্স।
অর্নবের যুক্তির পেছনে সায়র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, আচ্ছা তোকে বিশ্বাস করতে হবে না, এটলিস্ট আমার কথাটা রাখ ব্যাপারটা ক্রীতিককে জানানো যাবেনা, কোন ভাবেই না।
— কি জানানো যাবেনা আমাকে সায়র?
পেছনের দরজা থেকে ক্রীতিকের চমৎকার পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সায়রের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।আড়ালে শুকনো ঢোক গিলে সায়র শুধালো,
—জজেকে তুই এখানে হঠাৎ?
ক্রীতিক এগিয়ে আসতে আসতে জবাব দিল,
— হুম একজন কে খুজছি। অর্নব সরতো,কে পরে আছে ওখানে?
এতোক্ষণ সায়রের কথায় মজা নিলেও এখন কেন যেন অর্নবের ও একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে। তাই ও নিঃশব্দে সরে গেলো।অর্নব সরতেই অরুর মলিন অবচেতন মুখটা দৃশ্যগত হলো ক্রীতিকের। খানিক্ষন আগে একটু একটু কাতরালেও এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ অরু। মায়বী,কোমল গোলগাল মুখটায় ফ্যাকাশে ছাপ সুস্পষ্ট। ক্রীতিক টু শব্দও না করে, চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে আলগোছে কোলে তুলে নিলো অরুর তুলতুলে নরম অসার শরীরটাকে।অর্নব সায়র কেউই ক্রীতিকের নিস্তব্ধতা নিতে পারছে না,এ যেন ঝ’ড়ের পূর্ব লক্ষন।
— কে করেছে এটা?
ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে সায়র জবাব দিলো,
— জানিনা, হঠাৎ কারও গো’ঙানির আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলাম আর এসে দেখলাম অরুকে।
ক্রীতিক অরুকে নিয়ে ওই রুম ত্যাগ করতে করতে রু’ষ্ট কন্ঠে অর্নবকে আদেশ করার মতোই বললো,
— পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ গুলো সেন্ড করবি আমাকে।কোনো অন্ধকার রুমের ফুটেজও যাতে বাদ না থাকে।
*****************************************
ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর ঘর ছুঁই ছুঁই। বাইরে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। রাস্তাটা পুরোপুরি নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। একের একের সোডিয়ামের নিয়ন আলো পেছনে ফেলে সামনে এগুচ্ছে ক্রীতিকের কালোরঙা মার্সিডিজটা। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে,খুব সাবধানে প্যাসেঞ্জার সিটে অরুকে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়েছে ক্রীতিক। মাথাটা সাবধানে রেখে দিয়েছে গাড়ির ব্যাকসিটে।
যাতে অরুর কোনোরূপ কষ্ট না হয় তাই হাইওয়ে রাস্তাতেও খুব অল্প স্পিডে ড্রাইভ করছে ক্রীতিক। কিন্তু ভেতরের কুন্ডলী পাঁকানো ক্রো’ধের তোপে বারবার নিজের অজান্তেই সেই স্পিড বেড়ে যাচ্ছে দিগুণ। পরক্ষণেই অরুর মলিন অচেতন মায়া মায়া মুখের পানে তাকিয়ে সে স্পীড কমিয়ে আনছে পুনরায়।
এমন ভাবেই মেজাজের তারতম্য চলছিল পুরো রাস্তা জুড়ে, কিন্তু হঠাৎ করেই ফোনের ভাইব্রেট আওয়াজ পেয়ে পুরোপুরি গাড়ি থামিয়ে দিলো ক্রীতিক। অতঃপর ব্লুটুথ কানে লাগিয়ে ফোনের ভিডিওস চেইক করতে করতে বললো,
— হ্যা বল অর্নব।
অর্নব ক্ষীণ আওয়াজে বলে,
— বলছি যে, যে এই কাজটা করেছে তার সাথে কি করবি?
ক্রীতিকের ফোনে ততক্ষণে আসল কা’র্লপিটের চেহারা ভেসে উঠেছে,
— তাকে তার কাজের পারিশ্রমিক দেবো।
চোয়াল শ’ক্ত করে কথার জবাব দিয়ে,কল কেটে, ভিডিওতে মনোযোগ দিলো ক্রীতিক,যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ক্যাথলিনের মুখের সামনে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালানো, ও প্রথমে অরুকে রে’খেমে’গে কিছু বলে তারপর জামার আড়াল থেকে কিছু একটা বের করে অরুর মুখের সামনে স্প্রে করতেই অবচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অরু। অরু যখন পুরোপুরি অচেতন ঠিক তখনই এর থেকেও ভ’য়ংকর কাজ করতে উদ্যত হয় ক্যাথলিন। ও কোথা থেকে যেনো একটা কাঁ’চি এনে অরুর চুল গুলো মু’ঠিবদ্ধ করে ধরে সেগুলো কা’টার জন্য উদ্যত হবে, ঠিক তখনই সায়র আর অর্নব চলে আসে ওখানে, আর ক্যাথলিন লুকিয়ে পরে ডেকোরেশনের স্তুপাকার কাপড় চোপরের আড়ালে।
ক্রীতিক পুরো ভিডিওটা দেখে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— তারমানে ক্যাথলিন এখনো পার্টিতে উপস্থিত।
অতঃপর মোবাইলটা আগের যায়গায় রেখে অবচেতন অরুর দিকে খানিক ঝুঁকে গিয়ে মৃদু আওয়াজে ক্রীতিক বলে,
—আমার কথা কেন শুনিস না বলতো? কে আছে এই দুনিয়ায়, যে আমার মতো করে তোকে প্রটেক্ট করবে?
ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসটাকে বের করে দিয়ে ক্রীতিক অরুর মুখটা তীক্ষ্ণ চোখে খুব কাছ থেকে পড়খ করে বলে,
— আ’ম সরি হার্টবিট। বাট আই উইল টেইক রি’ভেঞ্জ।
*****************************************
গতকাল রাতের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে হাতের কফিটা শেষ হয়ে গিয়েছে টের পায়নি ক্রীতিক। কিন্তু যখন টের পেলো মগটা পুরোপুরি খালি হয়ে গিয়েছে তখন ও কফি হীন চ্যাটচ্যাটে মগটার দিকে তাকিয়ে কপট হেঁসে বললো,
— সরি ক্যাথলিন, তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কাজিন, কিন্তু তুমিতো খুব বড় ভু’ল করেছো, আমার দূর্বলতায় হাত দিয়ে ফেলেছো, তাই ছোটখাটো শা’স্তি তো তোমাকে পেতেই হতো।
ক্রীতিক নিজ কথা শেষ করে সিরামিকের কফির মগটা আস্তে করে ফেলে দিলো মেঝেতে, সঙ্গে সঙ্গে বিকট ঝনঝন আওয়াজে মুখরিত হলো পুরো অফিস রুম। এতোকিছুর পরেও ক্রীতিকের মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন গেঁথেই রয়,
সব কিছু রেখে শুধুমাত্র অরুর চুলই কেন কা’ট’তে গিয়েছিল ক্যাথলিন?
চলবে…..
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ১৪
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[প্রাপ্ত মনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য ]
দিনের অন্তিম প্রহর চলমান। সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গিয়েছে সেই কবেই। তাও সূক্ষ্ম সোনালী মিয়িয়ে যাওয়া আলোর ছঁটা দেখে মনে হয় রাত নামেনি,এখনো সন্ধা বেলাতেই আটকে আছে প্রকৃতি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ আলোটুকু হানা দিলেও পুব আকাশে ঠিক তার বিপরীত।সেথায় ঘন-কালো মেঘ গুরগুর করছে, এক পলক তাকালে মনে হয় এখনই তুফান ধেয়ে আসবে।
ভর সন্ধ্যা বেলা মেঘমল্লার গুরগুরানি আর দমকা হাওয়া পেছনে ফেলেই বাসায় ফিরেছে ক্রীতিক। সাধারণত সপ্তাহে তিনদিন ম্যাক্রোকোনোমিক্স এর উপর ক্লাস থাকে ক্রীতিকের। এছাড়া বাকিটা সময়, পাহাড়ি দূ’র্গম কোন রাস্তায় বাইক রাইডিং নয়তো অন্ধকার রুমে শুয়ে বসে অডিও বুক শুনে কাটিয়ে দেয় ও। নিজের একঘেয়ে জীবনটা বর’ই অপ্রীতিকর ক্রীতিকের কাছে।মাঝেমধ্যে ই মনে হয়, এমন জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই শ্রেয়।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেওয়া ক্রীতিকের আশেপাশে মানুষের অভাব ছিলোনা কোনো কালেই।তবুও সে ছিল চিরাচরিত একা। এতো টাকা, পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স ক্ষমতা সব কিছুই ওর কাছে মূল্যহীন ছিল বরাবরই, বুঝ হবার পর থেকে কোনদিন কোনো আবদার অপূর্ণ থাকেনি ক্রীতিকের। হোক সেটা ন্যায় আবদার কিংবা অন্যায়।এই সোনায় মোড়ানো জীবনে ক্রীতিক আজন্ম যেটা পায়নি সেটা হলো, ভালোবাসা,আদর, স্নেহ আর পরিবার নামক অদৃশ্য বন্ধন। যার দরুন ছোট থেকেই নরম হৃদয় তৈরি হওয়ার জন্য সকল উপকরণ সর্বেসর্বা বাদ দিয়ে, স্কুল, কলেজ,ভার্সিটি সব খানে তৈরি করেছে নিজের ক্ষমতা আর নেতৃত্বের প্রভাব। নেতৃত্ব আর কতৃত্বের মাঝে র’ক্ত মাং’সের হৃদয়টা কবেই যে পাথর রূপ ধারণ করেছে তা টের পায়নি ক্রীতিক। ঢাকা দক্ষিণের প্রাক্তন মেয়র তারউপর বর্তমান মন্ত্রী জামশেদ জায়ান চৌধুরীর একমাত্র ছেলে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। পাবলিক ভার্সিটির বাঘা বাঘা ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে এলাকার ছোট বড় পাতি নেতা,সবাই সমীহ করে চলতো নর্থসাউথে পড়া অবাঙালি চেহারার ক্রীতিককে। পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে যে কোন চায়ের আড্ডা কিংবা মিছিল মিটিং ক্রীতিকের নাম ছিল সবার মুখে। দিন আর রাত নেই, মা’রামা’রি কা’টাকা’টি, মিছিল মিটিং থেকে শুরু করে সব কিছুতে ক্রীতিকের এক ইশারায় সবাই তৎক্ষনাৎ হাজির হতো বিনাবাক্যে। সে সসময়ে পুরান ঢাকার রাস্তাঘাটে সবাই একই বুলি আওরাতো,
—-জামশেদ জায়ানের বডিগার্ডের দরকার নেই ,তার ছেলে একটাই একশো।
একটা অপারগ, অনিশ্চিত, হৃদয় নিংড়ানো অদম্য কষ্টকে হটাতে হৃদয়টাকে পাথর বানিয়ে, নেতৃত্বের জয়জয়কারে তখনও ভালোই ছিল ক্রীতিক।উঠতে বসতে দলের লোকেদের ভালোমন্দ খেয়াল রাখতে রাখতে সময় কে’টে যেত ওর।
কিন্তু আটবছর আগে হঠাৎ করে হৃদয়ে অরুর আগমন, আর অরুর সাথে করা সেই ছোট্ট একটা ভুলের জন্য সব ছাড়তে হয়েছিল ওকে।নিজের বাড়ি,নিজের দেশ,নিজের কতৃত্ব, নিজের দল, নিজের লোক সব,সবকিছু।
সবকিছু ছেড়ে হাজার মাইল দূরে এসে,ধরাবাধাহীন ক্রীতিক কে বন্ধী হতে হয়েছিল আমেরিকার মতো নিয়মতান্ত্রিক সমাজে। তখন থেকেই মানুষের উপর ক্রীতিকের চরম বি’রক্তি। তখন থেকেই ওর কাছে ভালোবাসার মানেই স্বার্থ হাসিল। স্বার্থের পৃথিবীতে নিঃস্বার্থে ভালোবেসে বুকে টেনে নেওয়ার মানুষের উপস্থিতি কল্পনা বইকি কিছুই না। প্রথম দিকে আমেরিকার দিন গুলো ক্রীতিকের জন্য ছিল, ভ’য়ংক’র ক:ষ্টদায়ক আর বিভৎস। যে ক্রীতিক ডানে বামে, পেছনে, মানুষ ছাড়া এককদম বাইরে পা বাড়াতো না, সে নিজের জন্য একটা হাউজ মেইড কিংবা সার্ভেন্ট পর্যন্ত নিয়োগ দেয়নি। আমেরিকা আসার পরেই যোগাযোগ ছিন্ন করেছে দেশের প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেকটা শুভাকাঙ্খীর সাথে।এমন কি নিজের বাবার সাথেও। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে কক্ষব’ন্ধী দূর্বিষহ জীবন কাটিয়েছে ও । এভাবে দিন মাস যেতে যেতে একটা পর্যায়ে এসে উ’গ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে ক্রীতিক। হুট করে রে’গে যাওয়া, যাকে তাকে একটুতেই আ’ঘাত করে বসা, দিকভ্রান্তের মতো বাইক রাইড করা থেকে শুরু করে নিজেই নিজের হা’ত কাঁ’টা কি করেনি ও। ক্রীতিক যখন নিজেই নিজের জন্য অনিরাপদ হয়ে পরে,তখনই এঞ্জেল এর মতো আবির্ভাব ঘটে ওরই মতো ছ’ন্নছাড়া আরও তিনজন মানুষের। তাদের জীবনেও ভালোবাসার বড্ড অভাব। একেকজনার জীবন যেন একেকটা ট্রা’জেডী।
এলিসা, অর্নব আর সায়রই পরক্ষনে সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শে একটু একটু করে, সাভাবিক করে তোলে ক্রীতিককে। ওই জন্যই তো ক্রীতিকের হাউজ পাসওয়ার্ড প্রতিবার হ্যা’ক করে ওরা। আর সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ মতেই প্রত্যেক উইকএন্ডে একজন না একজন চলে আসে জনমানবহীন শুনশান এই শহরতলীতে।
আর অরু? সেতো তখন খুব ছোট ক্রীতিকের পুরুষালী হৃদয়ে হঠাৎ করে জন্মানো অজানা মায়া, অজানা অনূভুতি, অজানা আসক্তি কিছুই ওর বোধগম্য নয় তখন। তবুও ক্রীতিকের অরুর উপর আকাশসম রা’গ,জি’দ আর অভিমানের ছড়াছড়ি। আট বছর পরে এসেও না ও অরুকে ভুলতে পেরেছে আর না নিজের রা’গটা অরুর উপর ঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছে।এতোবছর পর আবারও আটকা পরেছে বহুদূরে ফেলে রেখে আসা সেই পুরনো মায়াডোরে।কেনইবা পরবে না? অরুর প্রতি ক্রীতিকের আসক্তি টা যে এক দুদিনের নয়, তারউপর অরু এখন সদ্য যৌবনে পা রাখা অষ্টাদশী রমনী। ক্রীতিক যখন মায়ায় পরেছিল তখন নিতান্তই কিশোরী অরু, গরন বরন ও তেমনই ছিল।
আর এখন, সর্বাঙ্গে রূপের ছড়াছড়ি তার।
কি নেই? ভালোবাসা হীন একাকী হৃদয়ের ক্রীতিকের অদম্য বাসনা পূরনের জন্য সব কিছুই উপস্থিত ওর মাঝে। তাহলে ক্রীতিক কেন পারছে না খুব সহজে অরুকে আপন করে নিতে? ক্রীতিক তো সমাজের নিয়ম কিংবা নি’ন্দা কোনোটাতেই পরোয়া করেনা কোনোকালেই , তবুও হৃদমাঝারে কেন এই পাহাড়সম দূরত্ব ? আপাতত নিজ মন গহীনের অযাচিত প্রশ্নের কোন উত্তরই নেই ক্রীতিকের কাছে। তাই পেছনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, ভেতরের দীর্ঘশ্বাস নিংড়ে বের করে পাসওয়ার্ড টিপে মেইন ডোরের লক খুলে ঘরের দিকে পা বাড়ায় ক্রীতিক।
***********************************************
পুরো হলরুম না,পুরো বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। তিমিরে ঢাকা ঘরের দুয়ারে পা রাখা মাত্রই, পায়ের কাছে নরম কিছুর অনুভূতি হতে, ভ্রুকুঞ্চিত করে নেয় ক্রীতিক। তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে জ্বলতে থাকা সবুজ চোখ জোড়া দেখে বুঝতে পারে এটা অরুর নেউটে বিড়ালটা। বিড়াল এখানে তাহলে অরু কই?
তাছাড়া বিড়াল সব যায়গায় গেলেও ঘুনাক্ষরেও ক্রীতিকের সামনে আসেনা, তাহলে আজ হলোটা কি? আশ্চর্য। বিড়ালের এমন আকষ্মিক গায়ে মাখামাখি ভাব দেখে ভাবনায় পরে গেলো ক্রীতিক। তাই দেরি না করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো লাইটের সুইচবোর্ডের কাছে। অন্ধকারে ক্রীতিক নতুন হাটছে না, তাই সুইচবোর্ড পর্যন্ত যেতে মোবাইলের আলো জ্বালানোর আর প্রয়োজন পরেনি ওর।
একযোগে পুরো বাড়ির প্রত্যেকটা রুমের আলো জ্বালিয়ে ডোরাকে খুজতে দরজার দিকে চোখ রাখলো ক্রীতিক,কই দরজার কাছেতো নেই,তাহলে? চারিদিকে হাতরিয়ে একটু পর খেয়াল করলো বিড়ালটা ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। বিড়ালের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে ক্রীতিক বললো,
— হোয়াটস রং? কাপড় নোংরা করছিস কেন? এক্ষুনি দুরে যা বলছি। নয়তো তোকেও তোর মালকিনের মতো চ’ড়ি’য়ে গাল লাল করে দেবো।
ক্রীতিকের বাংলা ইংরেজি মিলানো ধমকেও কাজ হলোনা,ডোরা আগের ন্যায়ই দাঁড়িয়ে আছে। সেই দেখে ক্রীতিক দুকদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
—- ইউজলেস ক্যাট, কথা না শুনলে একদম ঘর থেকে বের করে দেবো। যেমন মালকিন তার তেমন পোষা বিড়াল, নিজে সারাদিন বে’য়াদবি করে করে, বিড়ালটাকেও বে’য়াদবি শিক্ষা দিয়েছে। ইচ্ছে করছে দুটোকেই ধরে আ’ছাড় মা’রি।
ডোরার দিক থেকে পাকাঁনো চোখ সরিয়ে ক্রীতিক দোতলার করিডোরের দিকে তাকিয়ে চেচাঁতে লাগলো,
—- কোথায়, তোর বে’য়াদব মালকিনটা? কতবার বলেছি আমার চোখের সামনে যাতে এই নেউটে বিড়ালটা না আসে। একে দেখলে আমার ইরেটেটিং হয়। অরু,এ্যাই অরু এক্ষুনি নাম নয়তো তোর বিড়ালকে ঘাড় ধরে বের করে দেবো আমি। অরু???
ডোরা কাঁউচের সামনে গিয়ে মিঁয়াও মিয়াঁও করছে দেখে ক্ষী’প্ত ক্রীতিকের চোখ গেলো সেদিকেই। দেখলো কাউচের উপর জুবুথুবু হয়ে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অরু। হাটু সমান লম্বা খোলা চুল গুলো মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর । দেখে মনে হচ্ছে চেতনা নেই।
অরুকে এমন অসার হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে ক্ষনিকের মাঝে হৃদপিন্ড ধরাক করে উঠলো ক্রীতিকের। এতোক্ষণ ধরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা মেজাজটা দপ করে নিভে গিয়ে অজানা ভয়ে ছেয়ে গেলো মস্তিষ্ক। ও এক পা দু’পা করে এগিয়ে হাঁটু গেড়ে কাউচের সামনে অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে পরলো, অতঃপর মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠলো,
— অরু?
অরু নিশ্চুপ।
গলার মাঝে কাঁ’টার মতো তীক্ষ্ণ কিছু বিঁধছে মনে হচ্ছে গলার স্বর বের হওয়ার যো নেই,ক্রীতিক সেটাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে আবারও ডাকলো অরুকে।
—- অরু,
এবার গলার স্বরটা আরও খানিকটা নরম শোনালো ওর।
এক বার, দুইবার, তিনবারের সময় ব্যাস্ত হয়ে পরলো ক্রীতিক, ভেতরে জমিয়ে রাখা দূরত্ব, জরতা,অভিমান,আক্রোশ সব কিছুকে সাইডে সরিয়ে, দু’হাতে আঁজলা করে ধরলো অরুর জ্বরে লাল টকটকে হয়ে যাওয়া মুখটা।অতঃপর উদগ্রীব হয়ে ওর মুখমন্ডল ঝাঁকিয়ে উঠে বললো,
—- অরু,এই অরু, হার্টবিট, ক্যান ইউ হেয়ার মি?
এই প্রথম মনে মনে নয় বরং মুখ ফুটে অরুকে আদুরে নামে ডাকছিল ক্রীতিক। যদিও ক্রীতিকের আপাতত কোনোকিছুতেই খেয়াল নেই। ও তো স্রেফ অরুকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে।
.
অবশেষে প্রায় আধঘন্টার প্রচেস্টায় ঢুলুঢুলু করে চোখ খোলে অরু, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। তীব্র জ্বরে কি যেন বিড়বিড় করছে অস্পষ্ট আওয়াজে। অরু চোখ খুলেছে দেখে সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে ক্রীতিক। মনে মনে ঠিক করে এখনই একবার ডক্টর কে কল করে আনতে হবে।
কিন্তু ওর ভাবনার ছেদ ঘটে তপ্তদুটো নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে। জ্বরের ঘোরেই দুহাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরেছে অরু। ক্রীতিক সে অবস্থাতেই স্থীর হয়ে বসে আছে,যেন নড়াচড়া করতেই ভুলে গিয়েছে ও। এবার পাশঘুরে শুয়ে নিজের হাতদুটো আরও শক্ত করে নিলো অরু। সঙ্গে সঙ্গে অরুর দিকে ঝুঁকে পরলো ক্রীতিক, অরুর তপ্ত প্রশ্বাস, কাঁপা কাঁপা অধর আর নিঃশ্বাসের তালে তাল মিলিয়ে বারবার ওঠানামা করা ধনুকের মতো শরীরটা এক ঝলক পরখ করে দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয় ক্রীতিক।অরু জ্বরে পুড়ছে, এই সময় নিজের মস্তিষ্কের অযাচিত কামুক চিন্তা ধারা গুলো একধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ও জ্বরের ঘোরে থাকা অরুকে শুধালো,
—- অরু, ক্যান আই টাচ ইউ?
অস্পষ্ট সুরে কিছু একটা বিড়বিড়ালো অরু,ক্রীতিকের কান অবধি তা পৌঁছায় নি। তাও নিজের কোর্ট আর টাইয়ের নট’টা খুলে সেগুলোকে একপ্রকার ছু’ড়ে ফেলে, কাউচের উপর উঠে বসে, কম্ফোর্টার সহ’ই আলগোছে অরুকে কোলের মাঝে নিয়ে নিলো ক্রীতিক।
কম্ফোর্টার আর ক্রীতিকের শরীরের ওমে, মূহুর্তেই মুখের বিড়বিড়ানি বন্ধ হলো অরুর,মনে হয় শীত কমেছে।
ক্রীতিক অরুর মুখের পানে তাকিয়ে বলে,
—- এমন কেন করিস অরু? আমাকে কি একটু আপন ভাবা যায়না? একটা কল দিলে কি হতো? আমি নাহয় খুব খারাপ, অনুকে কি কল দেওয়া যেত না? এতো বেখেয়ালি কেন তুই?? তুই এমন করলে আমার অগোছালো জীবনটা কে সাজাবে বল?
অরুর কাছ থেকে জবাব আসেনা, আসার কথাও না, অরুতো এখন নিজের মাঝেই নেই।
ক্রীতিক একটু থেমে আবার বলে,
—- এখন তুই জ্বরের ঘোরে আছিস,কিছু বললেও মনে থাকবে না তোর, রাইট??এখন যদি আমি বলি,
ক্রীতিক কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো তারপর বললো,
—- কিছুনা। তোর যথেষ্ট বয়স হয়েছে বোঝার,আর আমাকেও তোর বুঝেই নিতে হবে। নেক্সট টাইম নিখিল নিখিল করলে তোকে চি’বিয়ে খাবো আমি। সেই সাথে ওই ধূর্ত নিখিলকেও পুঁ’তে রেখে দিয়ে আসবো ।
. বেশ অনেকটা সময় পর অরুকে কোলে তুলে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে আবারও নিচে নামে ক্রীতিক।ফর্মাল শার্টের উপরেই এ্যাপ্রোন পরে পুরো রুম গুছিয়ে ফেলে সে। তারপর কিচেনে গিয়ে হোয়াইট পোরিজ বানিয়ে নিয়ে যায় অরুর কাছে। মাথার জলপট্টিটা উল্টে দিয়ে অরুর মুখে একটু একটু পোরিজ দিতে দিতে ক্রীতিক আহত সুরে বলে,
—– আমি খুব খারাপ তাইনা? সব সময় কষ্ট দিই তোকে। কথার আ’ঘাতে হৃদয়টা বিষিয়ে দিই। কি করবো বল? তোর জন্যই আমি এমন….
***********************************************
ক্যাফের সর্বশেষ কাস্টমারকে বিদায় জানিয়ে মাত্রই পার্ট টাইম শেষ করে বেরিয়েছে অনু। আজ কাজের অনেক চাপ ছিল, তার উপর সেই সকালে বেরিয়েছে,আসার আগে দেখে এসেছে অরুর শরীরটা ভালো নেই,তাই দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে ফোন বের করে ডায়াল করলো ক্রীতিকের বাসার ল্যান্ডলাইনে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কলটা কেউ তুললো না, বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। অনু অবশ্য ছাতা নিয়েই এসেছে সাথে করে, তাই আর বৃষ্টি কমার অপেক্ষা না করে ছাতা মাথায় বেড়িয়ে পরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাতের বেলায় ঝুম বৃষ্টিতে পিচ ঢালা রাস্তা গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পরছে গিয়ে ঢালু জমিনে। কুর্তি আর স্কিনি ডেনিম পরিহিতা অনু,সেই বৃষ্টির পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে হাটছে ঠিক ছোট বেলার মতো। এভাবে কিছুক্ষণ হাটতে হাটতে অনু খেয়াল করে ও একা নয় ওর পাশে আরও একজন ওর সাথে তাল মেলাচ্ছে। বিস্ময়ে, বিহ্বলিত হয়ে অনু ছাতা তুলতেই দেখতে পায় পরিচিত সেই হাসি মুখখানা। প্রত্যয়ের মুখটা একবার পরখ করে আবারও ছাতা নামিয়ে নিয়ে অনু বলে,
—– আপনি সবসময় রাতের বেলা উদয় হোন কেন বলুনতো?
—- কারন আমি চাঁদ।
অনু একই ভাবে ছাতা তুলে শুধালো,
—– কি বললেন?
প্রত্যয় এবার নিজের ছাতাটা উঁচিয়ে বলে,
—- দিনের বেলা অফিস থাকে ম্যাডাম।
নিজের কাজ জেকে ভাইয়ের কাজ দু’টো একসাথে সামলাতে হয়।
—- আপনি ক্রীতিক ভাইয়াকে ভাই ডাকেন কেন?
প্রত্যয় জবাব দেয়,
—- সে আমার বহু পুরোনো বড় ভাই। সে জন্য।
—- আর আপনার পরিবার?
—– সবাই আছে বিডিতে।
অনু বুঝতে পারার মতো উপর নিচ মাথা নাড়ালো।
ততক্ষণে উল্টে প্রশ্ন ছু’ড়লো প্রত্যয়,
—- আপনার মা তো কোম্পানির চেয়ার ওয়েম্যান, তাহলে এতো কষ্ট করে পার্ট টাইম কেন করেন?
অনু হাসার চেষ্টা করে বললো,
—– আমাদের আর ক্রীতিক ভাইয়ার সম্পর্কের জটিলতা তো জানেনই। উনি মায়ের চিকিৎসার জন্য এতোএতো খরচ বহন করছে সেই অনেক। তাছাড়া মায়ের অধিকার থাকলেও আমাদের তো এসবে কোনো অধিকার নেই, তাই নিজের আর অরুর হাত খরচ মেটানোর জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটার ব্যাবস্থাই করা আর কি।
অনুর আত্মসম্মান প্রগার, নিতান্তই ঠ্যাকায় পরে মাকে নিয়ে এতোদূর এসেছে, অনুর কথার টোনে তা স্পষ্ট বোধগম্য হলো প্রত্যয়ের। তাই ও এসব ফিন্যান্সিয়াল কথার বাইরে গিয়ে শুধালো,
—- আপনার মা এখন কেমন আছেন?
অনু হাসি মুখে জবাব দেয়,
—- ভালো আছেন। ডাক্তার বলেছেন শারীরিক উন্নতি হচ্ছে দ্রুত। এরকম হলে খুব শীঘ্রই অপা’রেশন করানে সম্ভব হবে।
প্রত্যয় সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—- আপনাকে খুশি দেখতে ভালো লাগছে। আপনার হাসিটা আমার হৃদয় ছুয়ে যায়। দেখলে মনে হয়,হৃদপিন্ডে ছো’ড়া তরতাজা তী’রের ফলা।
অনু হাটার গতি পুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে প্রত্যয়ের পানে চেয়ে বললো,
—- প্রত্যয় সাহেব, বৃষ্টিতে ভিজবেন? বসন্তের বৃষ্টিতে?
প্রত্যয় তৎক্ষনাৎ নিজের ছাতা ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
—– আপনার এই খুশিটুকু ধরে রাখার জন্য জান কোরবান।
প্রত্যয়ের সাথে সাথে অনুও নিজের ছাতাটা নামিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বরফ শীতল বারিধারা এসে ছুঁয়ে যায় দুটো উচ্ছ্বাসিত,রোমাঞ্চকর প্রান।
চলবে…..