সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-১৫+১৬

0
14

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ১৫
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

অন্ধকার বদ্ধ রুমে আটকে থাকার ফলস্বরূপ, অরুর শরীরে যে জ্বরের দাপদাহের সূচনা হয়েছিল,আজ প্রায় পাঁচ দিনের মাথায় তা একটু একটু কমেছে। জ্বর পুরোপুরি না কমলেও অরু যেচে পরে সবার কাছে নিজের সুস্থতা প্রমান করতে চাইছে, কারণ আগামীকাল নিখিলদের ট্যুর।
ধরনীতে নতুন সূর্য উদীয়মান। সুন্দর ঝকঝকে সকাল। ছাঁদবারান্দার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের তীক্ষ্ণ মোলায়েম আলো এসে হানা দিচ্ছে দোতলার সরু করিডোরে। রুম থেকে বেরিয়ে, করিডোর ধরে সামনে এগুচ্ছে অরু, সাথে পিছু নিয়েছে ওর ছায়াটাও।গন্তব্য ক্রীতিক সাহেবের রুম।

ক্রীতিকের রুমটা করিডোরের শেষ প্রান্তে।হাতে একটা ম্যাক্রোকোনোমিক্সের বই আর ডোরাকে কোলে নিয়ে ক্রীতিকের রুমের দরজায় এসেই থামলো অরু। সেই যে প্রথম দিন এসে ক্রীতিকের বেডে ঘুমিয়েছিল, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ওর রুমের চৌকাঠ অবধি মাড়ায়নি অরু। কিন্তু আজ তো আসতেই হতো, যে করেই হোক ক্রীতিককে রাজি করিয়ে, আগামীকাল ভার্সিটিতে যাওয়ার ব্যাবস্থা করতেই হবে, আর তার পর ভার্সিটি থেকে সোজা নিখিল ভাইয়ের সাথে ট্যুরে।

সেই কখন থেকে দরজার সামনে সটান দাড়িয়ে আছে অরু।নক করতে কেমন যেন ইতস্তত লাগছে ওর। রুমের দরজা লাগিয়ে ক্রীতিক কি না কি করছে, কি করছে কে জানে? দেখা গেলো নক করতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে অকস্মাৎ থাপ্প:ড় লাগিয়ে দিলো দু’গালে। সেসব হাবিজাবি ভেবে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বুকের মাঝে অনেকটা সাহস জুগিয়ে শেষমেশ দরজায় টোকা মে’রেই দিলো অরু। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কাঠকাঠ আওয়াজ ভেসে এলো ক্রীতিকের,
— কি চাই?

অরু বাইরে থেকেই জবাব দিল,
— কিছু চাইনা, একটু একটু….

অরু কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক বললো,
— দরজা খোলাই আছে।

ক্রীতিকের জবাব শুনে অরু তারাহুরো করে ডোরাকে কোল থেকে নামিয়ে নিজের শরীরটা ঝেড়েঝুরে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকতেই অরু দেখতে পায় ক্রীতিক তোয়ালে দিয়ে চুল মুচ্ছে,পড়নের ট্রাউজার আর টিশার্ট দুটোর রঙই কালো। মনে হচ্ছে শাওয়ার শেষে মাত্রই বেরিয়েছে সে। পুরোরুম জুড়ে স্যান্ডালউড পারফিউম আর মাতাল করা পুরুষালী গন্ধ মো মো করছে। ক্রীতিকের রুমে, ক্রীতিকেরই সামনে দাড়িয়ে, অরু বেহায়াদের মতো মনে মনে ভাবছে,
— আচ্ছা, রুম থেকেই এতো সুন্দর সুঘ্রাণ বের হচ্ছে । তাহলে ওনার শরীরের গন্ধটা কেমন? ওনার বউতো মনে হয়, ওনার শরীরের সুঘ্রানেই পাগল হয়ে যাবে।
আপন মনকে দাঁত খিঁচিয়ে অরুর অন্যমনটা বলে ওঠে,
—ছি ছি আবারও ভুলভাল ভাবছি। তওবা তওবা।

অরুকে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
—কিছু বলার না থাকলে যেতে পারিস। আমি রেডি হবো, ম্যাচ আছে।

অরু তৎক্ষনাৎ ভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
— ইয়ে মানে, একটু পড়া বুঝতে এসেছিলাম কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।

অরু পড়া বুঝতে এসেছে তাও ক্রীতিকের কাছে?ব্যাপারটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়,নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে,সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে ক্রীতিক, তবুও অরুর উদ্দেশ্য ধরার জন্য বললো,
— আমি যখন ক্লাসে লেকচার দিই,তখন মন কোথায় থাকে তোর? বিশ্বাস কর অরু ফার্স্ট সেমিস্টারে ফেইল করলে তোকে আর পড়াবো না আমি।

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— এতোকথা কেন শোনাচ্ছেন, দিননা একটু বুঝিয়ে, টিচার হোন আপনি আমার,স্টুডেন্টের প্রতি এইটুকুনি কর্তব্য তো আছে, নাকি?

— তোর আমাকে কর্তব্য শিখাতে হবে না।এসব কর্তব্য টর্তব্যের ধারধারিনা আমি।

অরু জানে ও কিছুতেই ক্রীতিকের সাথে তর্কে পেরে উঠবেনা, তাই দমে গিয়ে নরম সুরে অনুনয় করে বললো,
—- দিননা প্লিজ।

অরুর অনুরোধে বোধ হয় কাজ হলো,ক্রীতিক অরুর মুখের উপর নিজ তোয়ালেটা ছু’ড়ে মে’রে বললো,
— ঠিকাছে বুঝিয়ে দিবো, তার আগে কাজ শেষ কর।

অরু কয়েক কদম এগিয়ে এসে ক্রীতিকের মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে ওর চুল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে, পা উঁচু করে, দু আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ক্রীতিকের চুল মুছতে যাবে, তার আগেই ক্রীতিক ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— হয়েছে আর লাগবে না, এইটুকু কাজ সেটাও ঠিক মতো করতে পারিস না, বিয়ে হয়ে গেলে তখন কি করবি?

অরু মিনমিনিয়ে বললো,
— খাম্বার মতো দাড়িয়ে ছিলেন কেন?মাথাটা একটু নোয়ানো যেতো না?

— কিছু বললি?

অরু না সূচক মাথা নাড়ালো।
— কোন টপিকটা দেখিয়ে দিতে হবে?

অরু বই সমেত ক্রীতিকের দিকে এগিয়ে এলেই ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে ক্রীতিক বলে,
— খবরদার কাছে আসবি না, যা বলার ওখানে দাঁড়িয়ে বল।

— কাছে না এলে, পড়া বুঝবো কি করে?

— সে আমি জানিনা, তুই আমার কাছে আসবি না ব্যাস।

অরু অসহায় মুখে ক্রীতিকের পানে তাকিয়ে আছে, আর ক্রীতিক তীর্যক চোখে অরুর আগা গোড়া পরখ করছে,কালো ফ্রক আর লেগিংস, সেই সাথে মেঘের মতো ঘন কালো লম্বা চুল। সব কিছু কালোরঙ দিয়ে মুড়িয়ে রাখায় ফর্সা শরীরটা যেন জলজল করছে ওর। দেখলেই কেমন চোখ ধরে যায়।হৃদয়টা নিসপিস করে।

কিছু একটা ভেবে ক্রীতিক অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— তুই স্টাডি টেবিলে গিয়ে বস, আমি এখান থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছি।

অরু ক্রীতিকের কথা মতো তাই করলো।গিয়ে বসলো ক্রীতিকের অত্যাধুনিক টেবিল চেয়ারে। এরপর শুরু হলো ক্রীতিকের প্রফেশনাল আচরণ। একে একে পুরো চ্যাপ্টারের প্রত্যেকটা টপিকের উপর টানা একঘন্টা লেকচার দিয়ে তবেই থামলো সে।এই একঘন্টায় অরু পাঁচ মিনিট ঠিক মতো শুনেছে কিনা সন্দেহ। ও কতক্ষণ নিখিল ভাইয়ের কথা ভেবেছে, তো কতক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্রীতিকের রুমটা পর্যবেক্ষন করেছে। পুরো রুমটা গ্রে থীমে সাজানো। সবকিছুতেই কেমন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। দেখলে মনে হবে,রুমের সব আসবাবপত্র মুখ গোমড়া করে বসে আছে। যেমন মালিক তেমন তার ঘর বোরিং।

— কি বোরিং?

ক্রীতিকের হঠাৎ ছোঁ’ড়া প্রশ্নে কম্পিত হয়ে উঠলো অরু, মুখ ফসকে কখন যে কথা বেরিয়েছে সে খেয়াল নেই ওর। দাঁত দিয়ে জিভ কেটে,তারাহুরো করে উত্তর দিল,
— আআপনাকে বলিনি, রুমের কথা বলেছিলাম।

ক্রীতিক নিজের কপালে গম্ভীরতার ভাজ টেনে এগিয়ে এসে অরুর গাল চেপে ধরে বললো,
— আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছিস কেন? কি চাই, সত্যি করে বল?

ক্রীতিকের র’ক্ত চক্ষুর দিকে একপলক তাকিয়ে, চোখ নামিয়ে অরু বলে,
— আমি কাল ভার্সিটিতে যেতে চাই।

— কেন, কাল কি আছে?

নিখিলের ব্যাপারটা পুরোপুরি এরিয়ে গিয়ে অরু বলে,
— এএ..একদিনের একটা ট্যুর আছে, শুধু আমাদের ব্যাচ। সবাই যাবে, তাই আমিও যেতে চাই।

ক্রীতিক কিছুক্ষণ নিস্প্রভ তাকিয়ে রইলো অরুর মুখের পানে, তারপর বেশ সাবলীল ভাবে জবাব দিলো,
— ওকে ফাইন।ইউ ক্যান গো।

ক্রীতিকের সম্মতি পাওয়ার সাথে সাথে অরুর বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো। চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। সবচেয়ে কঠিন কাজ সম্পাদন করার মতোই আনন্দ হতে লাগলো ভেতরে ভেতরে। ও আর ক্রীতিকের রুমে বসে থাকলো না,কারণ এখানে তো ওর আর কোনো নেই,তাই নাচতে নাচতেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

বুকে দু’হাত গুঁজে টেবিলে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ক্রীতিক বললো,
— কি সুন্দর মিথ্যা কথা বলতে শিখেছিস জান।
কথাগুলো বলার সময় অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল ওর।
*****************************************
বিকেল বেলা এলিসা আর অর্নব এসেছে ক্যাথলিনের ডরমেটরিতে। গত একসপ্তাহ ধরে মেয়েটার কোন হদিস নেই। এলিসার বাবা জে’ল থেকে ছাড়া পেয়েছে কয়েকমাস হলো। সেই থেকেই বিভিন্ন পকার ক্লাব থেকে একেরপর এক হু’মকি আসছে ওর নিকট।সবাই নাকি ওর বাবার কাছ থেকে টাকা পায়, ওর বাবা বারবার জু’য়ায় হেরে মোটা অঙ্কের ঋণগ্রস্থ। এখন এলিসাকেই সেইসব টাকা পকার খেলে শোধ করতে হবে। নয়তো ওর বাবাকে শ্যু’ট করে মে’রে ফেলা হবে। এলিসা কখনোই চায় না ওর বাবা টাকার জন্য মা’রা যাক, কিন্তু আগের বার ঠিক একই কৌশলে এলিসাকে ওই পাপের খেলায় সামিল করেছিল ওর বাবা। এবারও যে একই নোংরা কাজ করবে না তার গ্যারান্টি কি?
কারন ওর বাবার কাছে এলিসা মেয়ে নয়, কেবলই টাকা বানানোর মেশিন মাত্র। সেবার ক্রীতিক, অর্নব আর সায়রের সাহায্যে জুয়ার জগত থেকে বের হতে পেরেছিল এলিসা, অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই একই পিছুটান ওকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে যত্রতত্র। এলিসা জানে এবার আর এতো সহজে সবটা সমাধান হবেনা,এবার হয়তো সত্যিই ওর বাবা জু’য়ারিদের হাতে মা’রা পরবে। মা’রা পরলে পরুক,তবুও আর ওই পাপের খেলা খেলবে না এলিসা।
নিজের মধ্যে গুমোট হয়ে কুন্ডলী পাকানো এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝেই ক্যাথলিনের সাথে কি থেকে কি হয়ে গেলো। ওরই বেস্টফ্রেন্ড এই নিন্দনীয় কাজটা করেছে, ভাবতেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে এলিসার।
—ক্যাথলিন মেয়েটা জেকে কে চোখে হারাতো অথচ জেকে এটা কি করলো?বিরক্তিতে ফোসফাস করছে এলিসা।
পাশ থেকে অর্নব বললো,
— ক্যাথলিনের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল,ও যার লেজে পা দিয়েছে সে কোনো ডোড়া সাপ না,বরং বি’ষ দিয়ে ভরা ড্রাগন।

এলিসা ভ্রু কুঞ্চিত করে অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কি এমন করেছে আমার ছোট্ট বোনটা? আর যদি কিছু করেও থাকে সেটা কি মুখে বলে সমাধান করা যেত না?? এরকম একটা অ’পমান জনক কাজ করতে হলো? একটা মেয়ের জন্য চুল ঠিক কতোটা ইমোশন ধরে রাখে তোরা ছেলেরা আদৌও তা বুঝিস? ভালো বলিস আর খারাপ বলিস জেকে একটা হার্টলেস, একটা মেয়ের চুল কে’টে দিতে ওর বুক কাঁপলোনা একবারও?

—- ক্যাথলিন যখন অরুর চুল কা’টতে গিয়েছিল তখন ওর বুক কেঁপেছিল?
অর্নবের কথায় ডরমিটরির গেইটে এসে হাটার গতি থেমে যায় এলিসার।

— কিহ! কার চুল কে’টেছে?

— কা’টেনি কা’টতে চেয়েছিল, তাছাড়া ক্যাথলিনই অরুকে ব্যাকস্টেজের বেজমেন্টে আট’কে রেখেছিল।

আরও একবার চমকালো এলিসা, মুখ ফুটে বললো,
— ক্যাথ হঠাৎ এসব কেন কেন করতে যাবে?

অর্নব এলিসার হাতটা ধরে যেতে যেতে বললো,
— সেটা তো আমারও প্রশ্ন।চল এবার ক্যাথলিনকে দেখে আসি।

এলিসা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— হাত ধরেছিস কোন অধিকারে? হাত ছাড়।

অর্নব পুনরায় ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
— তোকে আমি ভালোবাসি, বিয়ে করবো, তুই আমার ভবিষ্যত বাচ্চার মা, সেই অধিকারে ধরেছি, এখন চুপচাপ চল।
*****************************************
ডরমিটরিতে এসে একটানা আধঘন্টা যাবত ডাকাডাকির পরে রুমের দরজা খুললো ক্যাথলিন। ওর চোখ মুখের অবস্থা বি’ভৎস দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন রাত একাকার করে কেঁ’দেছে।বাদামি রঙের বেনি হ্যাট দিয়ে পুরো মাথাটা ঢেকে রেখেছে বলে, চুল আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। এলিসাকে দেখে পুনরায় আরও এক দস্তুর কেঁদে ভাসালো ক্যাথালিন। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আপু জেকে ভাইয়া আমার সাথে এসব কেন করলো বলোতো?

এলিসা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালো,
— এসব মানে?

ক্যাথলিন হেঁচকি টেনে জানায়, শুধু চুল কা’টা নয়, সেদিন ক্রীতিকের বাসায় ইলেকট্রিক্স শকট টাও ক্রীতিক ইচ্ছা করেই দিয়েছে।

ক্যাথলিনের কথায় এলিসা অর্নবের চোখ কপালে। এলিসা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
— তুই কি করে জানলি কাজটা ক্রীতিক করেছে?
— জেকে ভাইয়া নিজ মুখে বলেছে।
পেছন থেকে অর্নব শুধালো,
—কি বলেছে?

— বলেছে তুমি আমার হৃদয়ে আ’ঘাত করেছো তাই তোমাকে সেদিন ইলেকট্রিক্স শক টা আমিই দিয়েছি। আর আজ আবারও একই ভুল করেছো, তাই আজও শা’স্তি দেবো। জানো আপু, তখন আমি জেকে ভাইয়াকে চিনতেই পারছিলাম না,কি ভ’য়ানক দেখতে লাগছিল,আর তারপর….কথাটুকু শেষ করার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ক্যাথলিন।
অর্নব দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— সায়র ওয়াজ কমপ্লিটলি রাইট।হি ইজ অবসেশট উইথ হিজ স্টেপ সিস্টার। হলি শীট…
****************************************

মন মস্তিষ্কের আন্দোলন তীব্র বেদনাদায়ক।তারউপর মনের মানুষটার মন যদি হয় অন্যকারও দখলে। এতোদিন ধরে ক্রীতিক যেটা আড়ালে অনুভব করে এসেছে। আজ তা সরাসরি অনুভব করলো অরু। সকাল সকাল এতো এক্সাইটমেন্ট এতো আনন্দ সব কিছু পু’ড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে এতোক্ষণে। হবে নাই’বা কেন? আনন্দঘন দিনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছে নিখিল ভাই আসলে ওকে কথার কথা ট্যুরে ইনভাইট করেছিল। আসলে ওর যাওয়া না যাওয়ায় নিখিলের কিছুই আসে যায়না।

সকাল সকাল বাসে উঠে অরু যখন নিজের পাশের বে’দখল সিটটা নিখিলের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল, তখনই বাসের লুকিং গ্লাসে অরু দেখতে পায়, নিখিল ভাই আর তার বিদেশিনী বান্ধবী ইতিমধ্যে বাসে উপস্থিত। তারা কি নিয়ে যেন উল্লাসে মেতে আছে ঠিক সেদিনের মতোই। অরু এসেছে কি আসেনি সেদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই নিখিলের। অরু যখন অসহায়ের মতো ঠোঁট কামড়ে পেছনে তাকিয়ে ছিল তখনই ওর পাশে এসে বসে পরে সায়নী।
সায়নীকে দেখে অরু, দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে শুধায়,
— আচ্ছা সায়নী, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যদি সারাক্ষণ একসাথে থাকে, একসাথে হাসাহাসি করে, তাহলে কি তারা শুধু বন্ধু?

ওপাশ থেকে সায়নীর নির্লিপ্ত জবাব আসে,
— হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।

অরু ভেতরে ভেতরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে, এমনটা নয়তো,এই বিদেশিনীই নিখিল ভাইয়ের প্রেমিকা? এমনটা হলে অরুর হৃদয়টা ভে’ঙে যাবে পুরোপুরি।

কিন্তু এই মূহুর্তে সকালের সেই অযাচিত প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব অরুর সামনে। সন্ধ্যা রাতে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, সউচ্চ চূড়া থেকে নেমে আসা ঝরনাকে সাক্ষী রেখে অ’ন্তরঙ্গ সময় পার করছে নিখিল আর তার বান্ধবী। অরু সকাল থেকেই নিখিল কে চোখে চোখে রেখেছিল। সারাদিন ওরা কি করেছে না করেছে সবই আড়ালে খেয়াল রেখেছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার আগে আগে হঠাৎ করে সবার চোখের আড়াল হয়ে যায় ওরা দুজন। তবে অরুর নজর তো নিখিলের দিকেই ছিল, তাই চুপিচুপি পিছু নিয়েছিল ওদের। খুজেও পেয়েছিল খুব সহজে। কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখতে হবে তা কল্পনাতেও ভাবেনি অরু।

সেই জগন্নাথে পা রাখার পর থেকে নিখিল ভাইয়ের পিছনে ছুটেছে ও।মায়ের অসুখ, আপার বকুনি কিংবা ক্রীতিকের অ’পমান কোনো কিছুই দমাতে পারেনি ওকে। সেই একই নিখিল ভাইয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে আজ এতোদূর চলে এসেছে ঘর কুনো মেয়ে অরু। অথচ আজ মনে হচ্ছে,এখানেই থেমে যেতে হবে ওর, আর কোনো আশা নেই,নিখিল ভাই নিজ হাতে ওর ছোটার রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে।

শরীরের জ্বরটা বোধ হয় হুহু করে বারছে। নিরব অস্রু জ্বলে ভিজে যাচ্ছে গ্রীবা। মেয়েটাকে করা নিখিল ভাইয়ের একেকটা চুম্বন অরুর শরীরে যেন বিষা’ক্ত তী’রের মতো বিঁধ’ছে, এই দৃশ্য কতক্ষণই বা দাড়িয়ে থেকে দেখা যায়? অরুও দাড়িয়ে রইতে পারলো না। কাঁ’দতে কাঁ’দত ধপ করে বসে পরলো অসম ভূমিতে। ঘাস আবৃত জমিনে দু’হাত চাপরাতে চাপরাতে বললো,
— কেন এমন করলেন নিখিল ভাই? আপনি যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসবেন তাহলে আমাকে কেন নিয়ে এলেন? আমি তো কোনো কালেই ট্যুরে আসতে চাইনি, কেবল আপনার একটা কথাতে সবাইকে মিথ্যা বলে,অসুস্থ শরীরটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছি আমি, তাহলে এটা কি দেখালেন আপনি? আমার হৃদয়ে ফোঁটা প্রথম প্রেমের ফুলটাকে আপনি এভাবে পা দিয়ে পিষি’য়ে দিলেন।কেন?

— প্রেমে পরা কি এতোই সহজ?

পরিচিত,চমৎকার পুরুষালি কন্ঠস্বরটা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই অকস্মাৎ থেমে গেলো অরু।তরিৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। মাথায় বাকেট হ্যাট, পরনে হোয়াইট ওভার সাইজ টিশার্ট। অরু বুঝতে পারছে না ক্রীতিককে দেখে ও কি খুশি হবে নাকি,লজ্জা পাবে।
— কি হলো আর কতো কাঁদবি, ক্রাশের জন্য?

অরু নাক টেনে জবাব দিলো,
— ভুল ভাবছেন উনি আমার ক্রাশ না।
তারপর হুট করেই বললো,
— আপনি সবটা জানতেন তাইনা? সব জেনে শুনেই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাইনা? কিভাবে পারলেন আপনি?

ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে অরুর হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওকে দাঁড় করায়,অতঃপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— বিশ্বাস কর অরু, এই মূহুর্তে তোকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একটা থা’প্পড় দিতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু কি জানিস তো? সেটা আমি পারবো না।কারন আমার হাত অগ্রসর হওয়ার আগে আমার কলিজা কেঁপে উঠবে।

অরু ক্রীতিকের কথায় খানিকটা ভরকে গিয়ে আবারও নিখিলদের দিকে তাকালো, যারা এখন গভীর চুমুতে মত্ত।

— হি ইজ আ প্লেবয়, ওই যে মেয়েটা দেখছিস,ও আর ওর বান্ধবী দুইজনার সাথেই একত্রে লিভ টুগেদারের আছে বা’স্টার্ডটা।

অরু চমকে গিয়ে বোকার মতো শুধালো,
—দুইজনার সাথে, একই সাথে কিভাবে কি?

অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক ঠোঁট টিপে হাসলো, কষ্ট পেয়ে মেয়েটা বোধ বুদ্ধি সব খেয়ে ফেলেছে মনে হয়। তবুও ক্রীতিক ওর কথার জবাব দিয়ে বলে,
— ট্রিও রিলেশনশীপ, এর বেশি বুঝাতে পারবো না, ব্যাপারটা তোর আর আমার বয়সের সাথে যায়না। তাছাড়া তোর বান্ধবী তিথির সাথেও দীর্ঘদিন ফিজিক্যাল রিলেশনে ছিল ও।

একদিনে ঠিক কতোগুলো শক নেবে বুঝতে পারছে না অরু, ওর মাথাটা ভঁনভঁন করে ঘুরছে, সেইসাথে নিখিলের প্রতি জমাট বাঁধা অভিমানটা পরিনত হয়েছে তীব্র ঘৃণায়।মনে মনে ভাবছে তাইতো সেবার তিথি এতোটা বা’জে ব্যাবহার করেছিল ওর সাথে।

— তুই বসে বসে তোর প্লেবয় নিখিল ভাইয়ের জন্য কাঁদতে থাক আমি গেলাম।
বাইকের চাবির রিংটা আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে যেতে যেতে কথাটা বললো,ক্রীতিক।

অরুর ভ্রম ভেঙে গেলে ও ছুটে এসে ক্রীতিকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাক টেনে বললো,
— আমি কি করে যাবো?

—কেন তোর নিখিল ভাইয়ের সাথে যাবি।

ক্রীতিকের কথায় অরু আবারও অসহায় দৃষ্টিতে নিখিলদের দিকে তাকালো, পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে গলার আওয়াজ শক্ত করে বললো,
— কক্ষনো না।

— তাহলে কিভাবে যাবি?

অরু মুখ ফুলিয়ে বললো,
— আপনার সাথে।

ক্রীতিক বাইকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— আমি মেয়ে মানুষ বাইকে নেইনা।

অরু দুকদম এগিয়ে এসে বললো,
— প্লিজ নিয়ে যান, আমি ওই বাজে লোকটার মুখোমুখি হতে চাইনা এজীবনে।

ক্রীতিক অরুর চোখে চোখ রেখে বললো,
— নিয়ে যাবো, বিনিময়ে আমি কি পাবো?

— যাই চাইবেন তাই দেবো, এখন চলুন।

ক্রীতিক বাঁকা হেসে শুধায়,
— আর ইউ সিওর যা চাইবো তাই?

—হ্যা তাই, শুধু আমাকে আর ডোরাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইবেন না দয়া করে।

অরুর কথায় ক্রীতিক অন্যদিকে ঘুরে হাসি সংবরণ করলো,মনে মনে ভাবলো,
— পিচ্চি মেয়ের মায়ায় পরলে এই হয়।

—কি হলো, চলুন।

ক্রীতিক নিজের বাকেট হ্যাট, ওয়ালেট, সিগারেট সবকিছু বের করে অরুর হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্নাটা বন্ধ কর, নয়তো ফেলে চলে যাবো।

অরু নাক টেনে ক্রীতিকের জিনিস গুলো নিজের ব্যাগে ভরে নিলো। যেন ওই বহু বছর ধরে ক্রীতিকের গিন্নি দায়িত্ব পালন করে আসছে।
ক্রীতিক বাইকে বসে নিজে হেলমেট পরে আরেকটা হেলমেট বাড়িয়ে দেয় অরুর দিকে,
অরু করুন সুরে জিজ্ঞেস করে,
— এটাও ব্যাগে রাখতে হবে?

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজ হাতে অরুকে হেলমেট পরিয়ে দিতে দিতে বলে,
— স্টুপিড কি তোকে সাধে বলি???
.
নিশুতি রাতে পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকটা। ঝিরিঝিরি মিষ্টি বাতাসে এতোক্ষণে বুকটা হালকা লাগছে অরুর। যদিও ভেতরের ক’ষ্টটা আকাশসম,তবুও ক্রীতিকের ভ’য়ে জোর করে কা’ন্না থামিয়ে রেখেছে ও।যার দরুন হেঁচকি ওঠাটাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন। অরুর দুইহাত ক্রীতিকের কাঁধের উপর নিবদ্ধ । রাস্তার মোড় ঘুরতেই সেই হাতের বাধন বারেবারে শক্ত হয়ে ওঠে দিগুন তালে। এভাবেই যেতে যেতে একপর্যায়ে বহু সময়ের নিরবতা ভেঙে অরু শুধায়,
—- আপনি হঠাৎ পাহাড়ে কেন এলেন?
ক্রীতিক জবাব দেয় না, মনে মনে বলে,
— শুধু তোর জন্য…..
চলবে……

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ১৬
#লেখনীতে_suraiya_rafa

একতরফা ভালোবাসা বরাবরই বিরহের। নিজের অস্তিত্ব জানান না দিয়ে তাকে দিনের পর ভালোবেসে যাওয়া, তার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অভ্যাসটাকে চুপিচুপি আপন করে নেওয়া। কিংবা পুরো মানুষটাকে ঘিরেই অজানা সুখের সপ্নজাল বোনা, এমন আশাতীত সপ্ন বিলাশ সবাই করতে পারেনা।কারন সবাই তো আর ভালোবেসে কষ্ট সইতে চায়না। তাছাড়া হৃদয়ে লুকোনো ভালোবাসার অস্তিত্বের খোজ সচারাচর কয়জনই বা করে? তবে সেই অস্তিত্ব, সেই সপ্ন যদি এক নিমিষে গুড়িয়ে যায়?অন্তরের অন্তস্থলে থাকা মানুষটা যদি সবচেয়ে জঘন্য আর ঘৃণিত মানুষে পরিনত হয়? তাহলে ভুলটা কার? যে ভালোবেসেছিল সেই মানুষটার নিশ্চয়ই? তাইতো অরুও আজকাল নিজেকে অপরাধী ভাবে। ভালোবাসার দোষে অপরাধী।
কিন্তু অরু যেটাকে একপাক্ষিক ভালোবাসা ভেবে বসে আছে সেটা কি আদৌও ভালোবাসার অনুভূতি ছিল? নাকি নিতান্তই টিনএজ ফ্যান্টাসি? যদি তা নাই হবে,তবে নিখিলের বাইরে দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে ক্রীতিকের কাছে আসাটা কেন এতো রোমাঞ্চকর?কেন ডানা ঝাপটানো বন্য পাখির ন্যায় বেসামাল, আর ব্যাতিগ্রস্থ।

আজ আবহাওয়াটা বেশ ভালো।মাথার উপর তীর্যক আলো ছড়াচ্ছে সূর্য কীরন।তবুও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাতাসে ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। ঠান্ডা থাকা সত্বেও অন্যান্য শীতল দিনের সাথে তুলনা করলে বলা যায় আজ গড়ম পরেছে বেশ।
নিয়ন সূর্যতাপ গায়ে মাখাতে মাখাতে রাস্তার ফুটপাত ধরে এলোমেলো পা ফেলে হাটছে অরু। পরনে লংস্কার্ট আর ডেনিম টপস তারউপর পাতলা কালো কোর্ট।হাতের ভাজে পোকেমোন আঁকা কালো রঙা টেটো ব্যাগ।
মাত্রই বাস ধরে হসপিটাল থেকে ফিরেছে সে। আর এখন গন্তব্য ক্রীতিকের জনমানবহীন শুনশান শহরতলী।আজ প্রায় সপ্তাহ খানিক পর বাইরের পৃথিবীর মুখ দেখলো ও। তাও আপার জোরাজোরি তে। গত একসপ্তাহে ভার্সিটি যায়নি অরু, আর নাতো যাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে মনে।সারাদিন কক্ষবন্ধী হয়ে থাকে বলে,আজ জোর করেই অনু হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। মায়ের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আজকালের মধ্যেই অপারেশন হবে। আর তারপর হয়তো সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। অরু অনুর দুঃখের দিন ঘুচে যাবে। কিন্তু আদতে কি ঘুচবে? ভেবে পায়না অরু। কিকরেই বা পাবে? মাত্র কয়েকমাসের ব্যাবধানে ওর হৃদয়টা যে ভে’ঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। একটা জঘন্য চরিত্রের মানুষকে দিনের পর দিন অন্ধের মতো মনেমনে ভালোবেসে গিয়েছে ও,অথচ তার ওই নোংরা চোখের ভাষা টা অবধি বুঝতে পারেনি,ছিহ।
নিজের উপর আরও একবার রাগের নদীতে তে জোয়ার এলো অরুর। ও যে কতবড় আহাম্মক সেটা ভেবে নিজেকেই নিজে হাজারটা চ’ড় থা’প্পড় আর গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে ওর।

অরু যখন হাজারটা দোষী সাব্যস্ত করে বারবার নিজেকেই নিজে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। ঠিক তখনই রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে জেব্রা ক্রসিং পার হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একজন। পুরো শরীর তার কালো দিয়ে আবৃত। এমন কি মুখটাও মাংকি টুপি দিয়ে আটকানো। চোখ দুটোতে হিং’স্রতা জ্বলজ্বল করছে লোকটার। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা বিশ্রী ভাবে হাসছে।
লোকটাকে দেখে ভাবনায় পরে গেলো অরু, ওর মনে হচ্ছে এই চোখ দুটো এর আগেও কোথায় যেন দেখেছে ও। দেখলে দেখেছে কিন্তু এভাবে পথ আটকে দাড়ানোর মানে কি?
নিজ ভ্রু কুঞ্চিত করে অরু বিরক্ত সুরে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো,
— আপনি আবার কোন ক্ষেতের মুলা? এমনিতেই ভারী অশান্তিতে আছি পথ ছাড়ুন তো।
লোকটা বোধ হয় অরুর কথা বুঝলো না,বিদেশি হবে হয়তো। তাই ও ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলো,
—- হু? হু আর ইউ??

লোকটা জবাব দিলো না নিঃশব্দে, নির্লিপ্ত কপট চোখ দুটো নিক্ষেপ করলো নিজের হাতের দিকে। অরু ও তার চোখ অনুসরণ করলো, আর যা দেখলো তাতে পিলে চমকে উঠলো ওর। লোকটার কালো রঙের গ্লোভস পরা হাতে বেশ বড়সড় একটা ধারালো ছু’রি। দেখে মনে হচ্ছে অরুকে আঘাত করার জন্যই অগ্রসর হচ্ছে তার হাতটা। কিন্তু কেন? আমেরিকার মতো একটা অচেনা, অজানা দেশে অরুর মতো একটা তুচ্ছ দু পয়সার মেয়ের সাথে কিসের এমন শ’ত্রুতা এই ভ’য়ানক লোকটার?

সে যে শ’ত্রুতাই হোকনা কেন,আপাতত এই লোকটার থেকে পালিয়ে প্রানে বাঁচাটা জরুরি। নয়তো এই শুনশান নিরব রাস্তায় ওকে বাঁচানো তো দূরে থাক,ওর লা’শটাও খুঁজতে আসবে না কেউ । অজস্র কুন্ডলি পাঁকানো দুশ্চিন্তারা ঘীরে ধরেছে অরুর মন মস্তিষ্ক। ভেতরের ভয়টা দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে এসেছে। অরু যেন শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। তবে ওর এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলো না লোকটা। বরং তার আগেই ক্ষীপ্ত গতিতে তেড়ে এসে ছু’রিকাঘাত করতে অগ্রসর হলো অরুর পানে। ঘটনাটা এতোই দ্রুত ঘটছে যে, কিছুই ঠাহর করতে পারলো না অরু। লোকটা এগিয়ে আসতেই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে প্রানপনে উল্টো দিকে দৌড় লাগালো ও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো লোকটা ওর পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে না, বরং সাইকোপ্যাথ দের মতো চা’কু হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা জানে অরুর শেষ গন্তব্য কোথায়?

*****************************************
একটানা দিগ্বিদিক দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে অরু। শেষমেশে আর দৌড়াতে না পেরে রাস্তার মাঝেই হাটুতে দু’হাত ভর করে দাঁড়িয়ে পরলো ও। হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে তাকিয়ে খুব সাবধানে পরখ করে নিলো রাস্তার অদূর পর্যন্ত। নাহ, দু একটা চলন্ত গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে অরু ভাবছে,
—- আহ!তার মানে এ যাত্রায় প্রানে বেঁচে গিয়েছি।

ঠিক তখনই ওর খুব কাছ থেকে ভেসে এলো একটা অচেনা অপ্রিতীকর কন্ঠস্বর,
— জেকে স বেবি গার্ল, আই কট ইউ।

আচমকা এমন একটা ভয়ানক আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সামনে তাকালো অরু, দেখলো তখনকার লোকটা ওর সামনেই, কিচ্ছু বদলায় নি।আগের মতোই বিশ্রী চাহনি দিয়ে ওর পানে তাকিয়ে আছে সে। হুট করে আবারও ওই লোকটাকে দেখে অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠে পেছনের পিচ ঢালা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো অরু। শুষ্ক ঢোক গিলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো এতোক্ষণ দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুরে ফিরে গোলকধাঁধাঁর মতো আবার আগের যায়গাতেই ফিরে এসেছে ও। নিজের মূর্খামির ফল সরূপ আরও একবার ফেঁ’সে গেলো অরু। আপা কতো করে বলেছিল আমি এগিয়ে দিয়ে আসি, অথচ অরু শোনেনি। আর এখন সামনে মৃ’ত্যু খেলা করছে ওর। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।
লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অরুর দিকে। অরু যে উঠে দাড়িয়ে আবারও দৌড়ে পালাবে সেই শক্তি নেই ওর শরীরে, উল্টে হাত পা কন্ঠ সব কিছু রোধ করে রেখেছে এক অজানা আ’তংক। অরুকে ভয় পেতে দেখে লোকটা খিকখিক করে হেঁসে বললো,
— এ্যান্ড আ’ল কি’ল ইউ, প্রিন্সেস।

অরু এবার ঠোঁট চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতেই দু’হাতে ভর করে পেছাতে লাগলো কুচকুচে পিচঢালা রাস্তা ধরে । তবে লোকটার গতিবেগ ছিল দিগুন। সে এতোক্ষণে ওর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরেছে। মাথাটা এদিক ওদিক কাত করে ঘাড় ফুটিয়ে,তীব্র আক্রোশে উদ্যত হয়েছে অরুকে ছু’ড়িকাঘাত করার জন্য। লোকটার পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভেবেই অরু চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেললো , এই মূহুর্তে প্রিয়জনের মুখগুলো ভাসছে ওর মানসপটে, মা, আাপা, আর তো কেউ নেই। অথচ মানসপট জুড়ে দুটো নয়, বরং তিন তিনটে মুখ ভেসে উঠছে। মা আপা আর সব শেষে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। ওর স্টেপ ব্রাদার, যে ওকে সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, সবার কাছে বাড়ির চাকর হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়, ওর গা’য়ে হা’ত তোলে, ওকে শীতের রাতে ঘরে থেকে বের করে দেয়, মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়, হুটহাট রেগে গিয়ে সবার সামনে অপমান করতেও দু’বার ভাবে না। অথচ এই মূহুর্তে হৃদয়টা তাকে ঘৃণা করতে চাইছে না,মনে হচ্ছে ক্রীতিক নিজেকে ঠিক যতটা খারাপ প্রমান করতে চায়, ততটাও খারাপ সে না, নয়তো তিঁতে হয়ে যাওয়া হৃদয়টা তাকেই কেন স্বরণ করছে বারবার তাও এমন একটা মূহুর্তে? ক্ষনিকের জন্যে হলেও মনে হচ্ছে আজ ক্রীতিক থাকলে ওকে এতোটা বি’পদে পরতে হতো না। কোনো না কোনো ভাবে ঠিক বাঁচিয়ে নিতো সে।
অরু সেই কখন থেকে আজগুবি চিন্তায় বিভোর, অথচ লোকটা ওকে আ’ঘাত না করে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে, তা কি করে হয়?

কপালের উপর তরল জাতীয় কিছু অনুভব হতেই, ভাবনার সুতো ছিড়ে যায় অরুর। জিনিসটা কি তা দেখার জন্য, হাত দিয়ে কপালটা স্পর্শ করে সেটা চোখের সামনে এনে ধীরে ধীরে চোখ খুললো ও । দেখলো ওর হাত ভর্তি তরতাজা র’ক্ত। তাহলে কি লোকটা ওকে আঘাত করেছে? কই ব্যাথা লাগলো না তো? নাকি ইতিমধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেছে অরু?

ব্যাপারটা ঠিক ভাবে আন্দাজ করার জন্য আচমকা মাথা তুলে চাইলো অরু। আর যা দেখলো তাতে ওর দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হলো। বিশ্বাস করতেও খানিকক্ষন কষ্ট হলো।কিন্তু চোখের সামনে ঘটতে থাকা ঘটনা তো আর মিথ্যা হতে পারেনা। তাই চোখে কয়েকবার পলক ছেড়ে আবারও খেয়াল করে তাকালো ও,দেখলো ওই ধারালো ছু’রিটাকে নিজ হাতে মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। এতো জোরেই সেটাকে চেপে ধরেছে যে, ক্রীতিকের হাত কে’টে টুপটুপ করে র’ক্ত অরুর কপাল আর নাক বেয়ে চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে। কারণ ওই লোকটা ক্রীতিকের মধ্যেখানে বসে আছে অরু।

ক্ষনিকের মধ্যে ক্রীতিকের ঝরে পরা র’ক্তে অরুর জামা কাপড়ও র’ক্তরঞ্জিত হয়ে উঠেছে,তবুও ছু’ড়ি কিংবা ওই মুখ ঢাকা ছদ্মবেশি লোকটাকে কিছুতেই ছাড়ছে না ক্রীতিক। এক পর্যায়ে অরু সচকিত হয়ে উঠে দাড়িয়ে ক্রীতিকের ছু’ড়ি চেপে ধরা হাতটা টানতে শুরু করলো, আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— কি করছেন ? এটাকে ছাড়ুন, আপনার হাত কে’টে যাচ্ছে তো।

ক্রীতিকের অরুর কথায় কান নেই একটুও।ও তো ওই লোকটার মুখোশ উন্মোচনে ব্যাস্ত। এক পর্যায়ে টানতে টানতে লোকটার মাংকি টুপিটা খুলেই ফেললো ক্রীতিক। এভাবে নিজের ছদ্মবেশ খুলে যেতেই লোকটা নিজের ছু’ড়ি আর টুপি ফেলে রেখেই দু’হাতে মুখ ঢেকে তরিৎ গতিতে দৌড়ে পালালো।

লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে দেখে ক্রীতিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেদিকে। মনে হচ্ছে ও আজ লোকটাকে ধরেই ছাড়বে।কিন্তু সেসব চিন্তার ইতি ঘটিয়ে অরু ওর হাত টেনে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
— আ..আমার ভয় করছে, যাবেন না দয়াকরে।

ক্রীতিকের পূর্ন দৃষ্টি এবার অরুর দিকে চলে গেলো, যে এই মূহুর্তে ওর র’ক্তে মাখামাখি হয়ে দাড়িয়ে আছে। র’ক্তে ভেজা অরুকে দেখে ক্রীতিকের চোখ জ্বলে উঠলো, কপালে তৈরি হলো দুশ্চিন্তার কয়েক খানা ভাঁজ। ও দ্রুত হাতে অরুর বাহু চেপে ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে, আহত সুরে শুধালো,
— কোথায় লেখেছে তোর? এতো র’ক্ত কেন?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বিস্ময়ে বিমূর্ত হয়ে জবাব দিলো,
— এগুলো আপনার র’ক্ত। হাত কেটে গিয়েছে আপনার। ভুলে গেলেন?

অরুর কথায় ক্রীতিক সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওকে হুট করেই বুকে চেপে ধরে বললো,
— ওহ, থ্যাংকস গড।

এবার আর দূর থেকে নয়, ক্রীতিকের শরীরের স্যান্ডালউড পারফিউমের মারাত্মক পুরুষালী গন্ধটা খুব কাছ থেকে এসে সুরসুরি দিলো অরুর নাকে। তবে ও আপাতত এসব কিছু ভাববার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। তাই ক্রীতিকের বাহুতে আগলে ধরাটা নিতান্তই সাভাবিক আর আন্তরিকতার চোখেই দেখলো অরু।
*****************************************

অরুকে পাঠিয়ে দিয়ে সারাদিন হসপিটালেই ছিলো অনু। আজ আর পার্ট টাইমেও যাওয়া হয়নি ওর।খুব শীঘ্রই অপারেশন হবে মায়ের। অনুর জন্য এই মূহুর্তে হসপিটালে থাকাটা খুব জরুরি। তাই অনু ভেবেছে পার্ট টাইম থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে, পুরো সময়টা হসপিটালে কাটাবে ও। এখন সন্ধ্যারাত, অনু কেবলই হসপিটাল থেকে বেরিয়েছে, সারাদিন কিছু না খাওয়ার দরুন শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। হসপিটাল থেকে কিছুদূর হেটে গেলেই একটা গ্রোসারি শপ পাওয়া যায়। অনু হাটতে হাটতে গ্রোসারিতে গিয়ে কিছু খাবার কিনে নিলো। তারপর গিয়ে বসলো রাস্তার পাশের একটা খালি বেঞ্চিতে, সেখানে বসেই খেতে আরম্ভ করলো শুকনো খাবার গুলো । ওর মনটা আজ বড্ড ফুরফুরে,সেই সাথে ভেতরটাও হালকা লাগছে কয়েকগুণ। মনে হচ্ছে এতোদিনের কষ্ট, পরিশ্রম, ত্যাগ কোনোটাই বিফলে যায়নি। অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে ওরা। হাতে থাকা বাবল টিতে একটা লম্বা সিপ টেনে মুচকি হেঁসে অনু আনমনে বলে ওঠে,
— আপনাকে খুব মিস করছি। প্রত্যয় সাহেব।

তারপর আবারও একটা লম্বা সিপ…. তবে এবার অনু চা’য়ের সিপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা আর গলা থেকে নামাতে পারলো না, তার আগেই ওর দৃষ্টিগত হলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্য।
গ্রোসারি শপের সামনেই প্রত্যয় একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে , ওর হাতেও দুটো বাবল টি এর জার।মেয়েটার ভাবভঙ্গিমা এমন যেন এখনই লাফ দিয়ে কোলে উঠে পরবে প্রত্যয়ের।

অনু বড্ড আত্মসম্মানী, একনজর দেখেছে বলে সারাক্ষণ হ্যাংলার মতো তাকিয়ে তাদের কান্ডকারখানা দেখবে এতোটাও নির্লজ্জ মেয়ে ও নয়। তাই প্রত্যয়ের চোখ এদিকে আসার আগেই অনু হাটা দেয় উল্টো পথে। হাটার সময় রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ছুড়ে মা’রে হাতে থাকা বাবল টি ভরতি জারটাকে। অনুর মতে এটা বারাবাড়ি নয়, এটাই ওর আত্মসম্মান। যা ও খুব সহজে খেলার জন্য কারও হাতে তুলে দেবেনা। যদিও প্রত্যয়কে সেটা তুলে দেওয়ার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছিল হৃদয়টা। তবে এখন মনে হচ্ছে সেটা নিতান্তই ভুল সিদ্ধান্ত
হতো।
*****************************************
অন্যান্য দিনের মতো আজও হল রুমের কাউচে বসে নিচের ক্ষ’ত সারাতে বসেছে ক্রীতিক।
তখন অরু খেয়াল করেনি, ক্রীতিক আগে থেকেই আ’হত ছিল, ওর দু’পা,কপালের কিছুটা অংশ, সব খানেই র’ক্তা’ক্ত ক্ষত ছিল। সেই সাথে বাইকার লেদার জ্যাকেটটাও ছিল ছেড়া।

জামা কাপড় পাল্টে নিজেকে পরিষ্কার করে মাত্রই নিচে এসেছে অরু।আপা বাড়িতে ফেরেনি, বিকেলের ঘটনার পর থেকেই ভেতরে অজানা আ’তংকটা জেনো জেকে বসেছে দিগুণ হারে। রুমের মধ্যেও একাএকা থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করছে ওর। তাইতো রুমের কাজ সেরে দ্রুত নিচে নেমে এসেছে অরু। ক্রীতিক আজও ফার্স্টএইড নিয়ে বসে আছে। তবে ওর মুখ ভঙ্গিমা কেমন যেন অন্যরকম, নিজের শরীরের এতো এতো ক্ষত তে কোনোরূপ খেয়াল নেই ওর।মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে ক্রীতিক। অরু সেদিনের মতো করে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে আগ বাড়িয়ে বললো,
— দিন আমি ট্রিট করে দিচ্ছি।

হঠাৎ, অরুর আওয়াজে ধ্যান ভাঙে ক্রীতিকের। ও বিরক্ত হয়ে বলে,
— তুই পারবি না, যাতো নিজের কাজ কর গিয়ে।
অরু পাত্তা দিলোনা ওর কথায়। উল্টে গিয়ে বসলো ক্রীতিকের পায়ের কাছে। মেঝেতে বসে তুলার মধ্যে এন্টিসেফটিক লাগিয়ে ক্রীতিকের হাটুর উপর চেপে ধরতেই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো ক্রীতিক।তবে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হলোনা ওর। অরু বিরক্ত হলো, লোকটার অনুভূতি বলে কিছু নেই নাকি? ও কেন যেন ধূর্ততা অবলম্বন করলো। হুট করেই, হাতের তুলাটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে। এবারও চুপচাপ নির্বিগ্ন সে।
শুধু চোখ বুঝেই হাস্কি স্বরে বললো,
— আমাকে ব্যাথা দিয়ে শান্তি পাস?

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো অরু, তারমানে ক্রীতিকেরও ব্যাথা লাগে, শুধু মুখে প্রকাশ করে না। ও পুনরায় এন্টিসেফটিক লাগাতে লাগাতে বললো,
— কি করে ব্যাথা পেলেন?

ক্রীতিক জবাব দেয়,
— যাস্ট এ মাইনর বাইক এ’ক্সি’ডেন্ট।

— বাইকে আপনার এতো আসক্তি?এতো ব্যাথা পাওয়ার পরেও বাইক রাইডিং ছাড়েন না।

ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে একটু হেসে বলে,
— তোর থেকে বহুগুন কম। তাহলে ভাব তোকে কিভাবে ছাড়ি?

পায়ের ক্ষতগুলোতে অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে,ক্রীতিকের পাশে বসে ওর হাতটা দেখতে দেখতে অরু বললো,
— কি বললেন? শুনিনি।

— নাথিং, আমি যখন কথা বলি তখন কান কোথায় থাকে তোর?

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— আমি ভাবছি হাতের ক্ষ’তটা অনেক গভীর, এটা আমি কিভাবে ব্যান্ডেজ করবো? দেখেতো মনে হচ্ছে সেলাই লাগবে।

ক্রীতিক নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
— না পারলে, দুরে সর। নিজেই তো পাকনামি করে এসেছিস সাহায্য করতে।এখন বলছিস পারবো না।আমি বলেছিলাম আসতে?

অরু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিকের হাতটা আবারও টেনে নিয়ে সেখানটায় ব্যাথা নাশক লাগাতে লাগাতে বললো,
— আপনি এমন কেন?

— কেমন আমি?

— ঝগরুটে, তিল কে তাল বানিয়ে ফেলেন, আপনার বউয়ের কপালে দুঃখ আছে।

অরুর কথায় ক্রীতিকের ঠোট বাঁকা হাসিতে প্রসস্থ হয়। তারপর হুট করেই চোখ মুখ কুঁচকে সামনের মনিটরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক বলে,
— ঠিকই বলেছিস, আমার কথা না শুনলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।

— হ্যা সেতো জানিই, আপনি ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব কিনা, দুঃখ তো থাকবেই। আচ্ছা তখন হঠাৎ ছু’ড়িটা চেপে ধরতে গেলেন কেন শুনি?
— চেপে না ধরলে তো তোর আ’ঘাত লাগতো।

ক্রীতিকের হাতের ক্ষ’তটা অনেক বেশি গভীর, অরুর ভেতর ভেতর অনুশোচনা হচ্ছে ওর জন্যই আজ এমনটা হয়েছে। তাই ও ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে হালকা ফু দিয়ে এনসেফটিক লাগাতে লাগাতে নরম সুরে শুধালো,
— বেশি ব্যাথা লাগছে?

নিজের শরীরটাকে কাউচে উপর ছেড়ে দিয়ে ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে বললো,
— এখন কম লাগছে।
*****************************************
মাঝরাত চলমান…. দিনের আলো শেষ হতেই তাপমাত্রা নেমে গিয়ে চারিদিকে কনকনে শীতল হাওয়া বইছে, অনু আর অরু বোধ হয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ ছাঁদ বারান্দায় এখনো টিমটিমিয়ে ফেইরী লাইট জ্বলছে। সেখানে গোল হয়ে বসে আছে অর্নব, সায়র, এলিসা। ক্রীতিক ওদের থেকে খানিকটা দুরে দাড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ব্যাস্ত। ওরা সবাই সারারাত ধরে কিছু একটা পরামর্শ করেছে, অর্নব কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে এখনো কি যেন করছে। এলিসা দ আকারে বসে অর্নবকে বললো,
— তুই কবে এসব বন্ধ করবি অর্নব?

অর্নব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— বন্ধ করবো মানে? তোর বাবাকে ওরা আটকে রেখেছে, ভিডিও প্রুফ পাঠিয়েছে, তুই না গেলে ওরা তোর বাবাকে মে’রে ফেলবে, আর তুই ভাবছিস তোকে আমরা ওই রিস্কি যায়গায় একা যেতে দেবো?

সায়র পাশ থেকে বললো,
— আচ্ছা আমরা পুলিশ কে কেন বলছি না?

অর্নব দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,
— গর্ধব পুলিশকে জানালে এলিসাও ফেঁসে যাবে, তাছাড়া ক্লাবটা ইউ এস এ’র নয় থাইল্যান্ডের।
ওদের বাকবিতন্ডার মাঝে ক্রীতিক না ঘুরেই বললো,
— অর্নব প্রাইভেট জেট বুক কর, অরুর ফ্লাইট ফোবিয়া আছে ওকে নিয়ে বিজনেস ক্লাসে যেতে পারবো না।

আশ্চর্য্যের শেষ সীমানায় গিয়ে সায়র, অর্নব, এলিসা সবাই একই সুরে বললো,
— অরু???

তীরের ছিলার মতো এক ভ্রু উঁচিয়ে ক্রীতিক জবাব দেয়,
— ইয়েস অরু।

সায়র ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,
— লাইক সিরিয়াসলি জেকে? আমরা একটা মিশন নিয়ে থাইল্যান্ড যাচ্ছি, আর তুই সেখানে বিপ’দের মধ্যে অরুকে নিয়ে যাবি?
— আমি যেখানে থাকবো, সেখানে অরুর কোন বি’পদ নেই।

এলিসা শুধালো,
— কিন্তু হঠাৎ অরুকে, এভাবে?

ক্রীতিক সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ে পিষ্ট করে দাঁত চেপে বললো,
— ইয়েসটারডে সাম ওয়ান ট্রাইড টু এ্যা’টার্ক হার।
এবারও সবাই তারস্বরে বলল,
— কিহ?

ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—ঠিকই শুনেছিস, কাল ওই বা’স্টা’র্ড টার ভাগ্য ভালো ছিল যে আমি উইক ছিলাম। তবে চিন্তা নেই খুব শীঘ্রই নিজ কর্ম ফল ভোগ করবে সে। কিন্তু এই মূহুর্তে আমি অরুকে একা রেখে দেশের বাইরে গিয়ে কিছুতেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো না।

— কিন্তু অনু?ওর উপর কোনো এ্যা’টার্ক আসবে না তার কি গ্যারান্টি?

এলিসার প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক বলে,
— অনুর জন্য চিন্তার কারন নেই কারন ও বেশির ভাগ সময়ই হসপিটালে থাকে। তাছাড়া প্রত্যয় থাকতে অনুর সাথে খারাপ কিছু হওয়ার চান্স নেই।

এতোক্ষন পর সায়র উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো,
— ভালোই হবে, তোরা তোদের মিশন, ফিশন শেষ করবি, সেই ফাঁকে আমি আর অরু, একটু ব্যাংককের সমুদ্র বিলাশ সেরে আসবো।নট আ ব্যাড আইডিয়া ।

তৎক্ষনাৎ ওর পশ্চাৎদেশ বরাবর লা’ত্থি মে’রে, কনকনে বরফ শীতল ঠান্ডা পানিতে ফেলে দিয়ে ঠোটের কোনে একটা কপটতা মিশ্রিত হাঁসি ঝুলিয়ে ক্রীতিক বলে,
— নো চান্স ব্রো, শি ইজ মাইন …..

চলবে…….