সন্ধে নামার আগে পর্ব-১০

0
343

#সন্ধে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১০

(২০)

নির্লিপ্ত চাহনিতে স্মরণের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে রুমাইসা। হয় তো সে ভাবে নি অপরিচিত একজন, যে তার কেউই নয় সে মানুষটি তার জন্য এতটা করবে। রুমাইসার অবাক চাহনি দেখে স্মরণ একদপা হেসে ফেলল এতে অবশ্য রুমাইসা একটু বেশিই লজ্জা পেয়ে গেলো। স্মরণ ভ্রুবিলাস করতে করতে বলল,

” সামনে পরীক্ষা বই গুলো আপনার প্রয়োজন ছিলো, সামান্য কষ্ট করেছি ঠিকই কিন্তু তাতে এতটা অবাক হবার কিছু হয় নি।”

“আপনি কি করে জানলেন আমার বই,,,।”

“সে সব না হয় না জানলেন। বাই দ্যা ওয়ে এই এত সকাল সকাল এমন বেখেয়ালি ভাবে আর বের হবেন না। নিজের শরীরের দিকে নজর রাখবেন। আর একটা কথা মনে রাখবেন আপনার জন্ম শুধু অন্যের ফরমায়েশ খাটার জন্য হয় নি মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়েও ভাবতে হয় নিজের জন্য কিছু করা লাগে।”

রুমাইসা এবার সত্যি অবাক হলো। স্মরণ তাকে নিয়ে এতটা ভাবছে এটা যেনো বিশ্বাস যোগ্য নয়। আর হবেই বা কেনো একজন মেডিকেল ক্যাম্পে আমন্ত্রিত ডাক্তার যিনি কিনা দেশের একজন বড় মাপের হার্টসার্জন, তিনি এমন পাড়াগাঁয়ের একটি সহজ সরল মেয়ের জন্য এতটুকু করবেন এটা কারোর জন্যই বিশ্বাস যোগ্য হবার কথা নয়।

রুমাইসাকে এত ভাবতে দেখে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটালো স্মরণ। মেয়েটা হয় তো মনে মনে তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবছে তবে সে যা করেছে তা করিম সাহেবের কথা রাখতে। লোকটার প্রতি তার বিশেষ মায়া পড়ে গেছে তাই হয় তো তার কথা ফেলতে পারে নি স্মরণ।

তাছাড়া কয়েকদিন আগে সে করিম সাহেবকে দেখার জন্য ওবাড়ি গিয়েছিলো। করিম সাহ্ববের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে দেখে নিলুফার বেগম স্মরণকে ডেকে একটু বেশিই খাতির যত্ন করতে শুরু করেছিলেন। অবশ্য এত খাতির যত্নের কারণ টা যে ঠিক কি তা স্মরণ বেশ বুঝতে পারলেও তেমন কছুই বলে নি। ইতিমধ্যে নিলুফার বেগমের চালচলন এবং স্বভাব সম্পর্কে তার ভালোই জ্ঞান হয়েছে। তিনি যে শুধু সতিনের মেয়েকেই সহ্য করতে পারেন না এমনটা নয় প্রয়োজনে কাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে সেটাও খুব ভালো জানেন। স্মরণ প্রথম দিনই সব বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু প্রথম আলাপে কেউ কাউকে ভালো ভাবে চিনতে পারে না বলে সে চুপ ছিলো।

“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করবো?”

রুমাইসার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো স্মরণের। নিজেকে একটু সামলে কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,

“ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদের আশায় আমি এসব কিছু করি নি। আর হ্যাঁ মি. করিম সাহেবের হার্টের অবস্থা ভালো নয়। যত দ্রুত সম্ভব উনাকে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। আশা করছি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। আপনার মাকে বলবেন ঢাকা যাওয়া নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবনা চিন্তা না করতে উনি আমার বাড়িতে উঠতে পারেন করিম সাহেব কে নিয়ে।”

“কিন্তু?”

“কিন্তুর কিছু নেই মিস রুমাইসা। আগামীকাল আমার মেডিকেল ক্যাম্পের যাবতীয় কাজ শেষ হবে। আশা করছি রাতের ট্রেন ধরেই ঢাকা ফিরবো। আপনার সাথে হয় তো এটাই শেষ দেখা। ভালো থাকবেন আর মন দিয়ে পড়াশুনা করবেন।”

“কালই চলে যাচ্ছেন?”

“হুম, কালই যাচ্ছি। যাওয়ার পর হয় তো একদিন আসতে পারি আপনার বাবাকে নিয়ে যেতে। ”

“তবে যে বলছেন আর দেখা হবে না।”

রুমাইসার কথায় এবারো স্মরণ হাসলো কিন্তু জবাব করলো না। রুমাইসা কিছুটা সময় স্মরণের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করলো কিন্তু স্মরণের দিক থেকে তেমন কোনো সাড়া পেলো না তাই সে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

“আচ্ছা, তবে আসি আমি। মা জানতে পারলে খুব বকবে। আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন, হয় তো আরো করবেন, জানি না কখনো আপনার এই ঋন শোধ করতে পারবো কিনা। কিন্তু যদি কখনো সময় আসে তবে অবশ্যই চেষ্টা করবো।”

স্মরণ কিছু সময় নিষ্পলক চাহনিতে রুমাইসার দিকে তাকিয়ে দেখলো। মেয়েটির চোখের নিচে কালি পড়েছে। হয় তো গত কয়েকদিন ঘুমোয় নি। তবুও মলিন চেহারায় মেয়েটাকে স্বর্গীয় হুর বলে মনে হচ্ছে তার। স্মরণ অজান্তেই প্রশস্ত নিশ্বাস ফেলে আর সে নিশ্বাস এসে রুমাইসার মুখে আছড়ে পড়ে। কি উত্তাপ সেই নিশ্বাসে রুমাইসা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠে।

রুমাইসা চলে গেলে স্মরণ কিছু সময় দাঁড়িয়ে রুমাইসার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তার সারা বুক জুড়ে কেমন মৃদু ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। এই ব্যাথার কারণ যে ঠিক কি তা সে জানে না।

(২১)

বাড়ি ঢুকে সদর দরজার কাছে আসতে রুমাইসা নিলুফার বেগমকে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনল। কথার ধরনে বুঝা যায় তিনি কারো সাথে তুমুলঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়েছেন কিন্তু অপর পাশ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। রুমাইসা দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে ঘরের ভেতর পা রাখতে যাবে ঠিক তখনি সে পেছন থেকে কারো গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেলো, সে সাথে কড়া পারফিউমের সুগন্ধ।

” কোথায় গিয়েছিলি রুসা।”

রুমাইসা তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে তাকালো। আর সঙ্গে সঙ্গে ভ্রুকুঞ্চিত করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির দিকে তাঁকালো। হয় তো সে এই সময় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিতিটির অবস্থান আশা করে নি। তাই কিছুটা অবাক কয়ে বলল,

“আপনি এখানে? কখন এলেন আর মা কার সাথে ঝগড়া করছেন, মামা নয় তো?”

” এসেছি অনেকক্ষণ কিন্তু তুই কথায় ছিলি বল তো?”

শেহ্ওয়ার এর কথায় রুমাইসা নিজের হাতের দিকে তাকালো তারপর মুখ তুলে শেহ্ওয়ারের চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে আবার সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,

“মা আমার বই ছিঁড়ে ফেলেছেন তাই।”

“তা বলে এই শীতের সকালে গরম কাপড় ছেড়ে এমন খালি পায়ে বেড়িয়ে যেতে হলো?”

রুমাইসা এবার আর কোনো জবাব করলো না চুপচাপ নতজানু হয়ে শেহ্ওয়ারে সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

“হ্যাঁ, রে রুসা তোর পা দুটো কি কাঠের নাকি? দিব্যি দাঁড়িয়ে আছিস কাঁদা উপর।”

রুমাইসা এবার চোখ তুলে তাকালো শেহ্ওয়ারের দিকে। চোখ জল টলমল করছে তার।

“কি হলো কাঁদছিস কেনো সরে আয়। এখানে পানি ফেলেছে কে? আর তুইও হয়েছিস একটু দেখে চলতে পারিস না। যাওয়ার আগে কত করে বলে গেছি যে নিজের একটু খেয়াল রাখিস কিন্তু কই তোর মাঝে তো তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

রুমাইসা এবার কেঁদেই ফেললো। শেহ্ওয়ার একটু কাছে সরে এসে রুমাইসার মুখটা আঁজলা ভরে নিয়ে বলল,

“কি ভেবেছিস আর আসবো না ফিরে? এই তো দেখ এসেছি।”

” আপনি খুব খারাপ।”

“হুম জানতাম তুই এটাই বলবি। এখন ভেতরে চল মা বাবাও এসেছেন।”

“মামি মাও এসেছেন?”

“হু চল গিয়ে দেখবি।”

শেহ্ওয়ারের পেছন পেছন রুমাইসা ঘরে প্রবেশ করলো। বসার ঘরে মনোয়ারা বেগম, আজমল আহমেদ, নীলা জামান আর মনোয়ারা বেগম বসে আছেন। নিলুফার বেগম একটু পর পর সেখানে আসা যাওয়া করছেন। শেহ্ওয়ারের পেছন পেছন রুমাইসাকে ঘরে ডুকতে দেখে তিনি একপ্রকার রেগে উঠলেন। নীলা জামান এবং আজমল আহমেদের উপর যত রাগ সব যেনো তিনি রুমাইসার উপর তুলতেই প্রস্তুত হলেন। তাই রুমাইসা ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই বললেন,

“এই তো নবাবজাদি এসে পড়েছেন। সকাল থেকে কই ছিলো জিজ্ঞাস করুন আপনি আপনার ভাগ্নিকে? ওই মুখপুড়ি তোর মা তো আমাকে মরেও শান্তি দেয় নি, তোর মতো একটা আপদ আপার ঘাড়ে রেখে গেছে এখন এসেছে তার বাপের গুষ্ঠির লোক। বাহ! ”

শেহ্ওয়ার নিলুফারের কথা গুলো চুপ করে শুনছিলো কিন্তু শেষের কথাগুলোতে সে আর চুপ করে থাকতে পারলো না।

“আপনি একজন মৃত মানুষকে নিয়ে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আর আপনি হয় তো ভুলে গেছেন আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলছেন। আমার ফুঁপি মা মারা গেছেন ঠিকই কিন্তু আমরা এখনো মারা যাই নি। আপনি রুসার সাথে কি করেছেন আর করেন নি তার সব খবর ই আমি পেয়েছি কিন্তু আফসোস সব জেনেও আমরা এত দিন কিছু করতে পারি নি।”

“এই যে ছেলে খুব দেখছি দরদ উতলে উঠেছে ফুফাতো বোনের জন্য।”

“মিসেস. নিলুফার আপনি এতক্ষণ অনেক কথাই বলেছেন আমি তার কোনো উত্তর দেই নি। আপনি আমার মৃত বোনকে নিয়েও যা নয় তা বলে গেছেন। আর আমার ভাগ্নের কথা নাই বললাম। যাই হোক আমরা আপনার সাথে এই ব্যাপারে কোনো আলোচনা করতে চাই না। রুমাইসাকে আমরা নিয়ে যেতে এসেছি। এত দিন দেশের বাহিরে ছিলাম বলে আমরা কিছু করতে পারি নি বলে আপনি ওর সাথে যা নয় তাই করেছেন কিন্তু সেটা তো আর এখন হতে দেয়া যায় না। তাই বলছি আপনার আপত্তি থাক কিংবা না থাক আমার ভাগ্নিকে আমি আমার সাথে নিয়ে যাবো।

চলবে,,,।