সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১১+১২

0
368

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১১

(২২)

পুকুর ঘাটে ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে রুমাইসা। তার মনে একরাশ বিষণ্ণতা ভর করেছে।
একদিকে বাবার চিন্তা, অন্য দিকে পড়াশুনা, তার উপর এখন মামা আর মামি মা এসেছেন তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। এই নিয়ে নিলুফার বেগম যা নয় তাই করছেন, সব মিলিয়ে রুমাইসার ভেতর টা কেমন হু হু করে উঠছে। এই পৃথিবীর কোথাও দু-দন্ড শান্তি নেই। এমন কেউ নেই যে তার ব্যাথা বুঝবে। রুমাইসা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার চোখের কোণে একফোঁটা জল এসে জমেছে। রুমাইসা হাতের উল্টো পিঠে সেটা মুছে ঘাটের সিঁড়ি ছেড়ে উঠতে যাবে তখনি দেখলো ঘাটের একেবারে উপরের সিঁড়িতে আয়েশ করে বসে আছে শেহ্ওয়ার। শেহ্ওয়ারকে দেখে রুমাইসা একটু হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু শেহ্ওয়ার তাতে পাত্তা না দিয়ে উঠে দুই সিঁড়ি নিচে নেমে এসে বলল,

“তুই যে এত ভাবতে পারিস আগে তো জানতাম না,সে কখন থেকে তোকে ডেকে যাচ্ছি শুনছিস না। কি এত ভাবছিস বল তো।”

“কই তেমন কিছু ভাবছি না তো।”

“বুঝতে পেরেছি। চল ওইখানটায় গিয়ে বসি।”

রুমাইসা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে দুজন গিয়ে ঘাটের শেষ সিঁড়িতে গিয়ে পাশাপাশি বসে।

“মন খারাপ?”

“কই না তো।”

“শুধু শুধু লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছিস।”

“ভাইয়া আমি ইংল্যান্ড যেতে চাই না।”

“সেটা আমি তোর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম।”

“তুমি প্লিজ মামাকে বুঝিয়ে বলো, দেখো আমি বাবাকে ছাড়া কোথাও গিয়ে থাকতে পারবো না তাছাড়া মায়ের সব স্মৃতি,শিউলিতলা এসব ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না।”

শেহ্ওয়ার কিছু সময় নিশ্চুপ রইলো তারপর আবার বলল,

“ফুফা জানের চিকিৎসার সকল খরচ আমি বহন করতে চাই রুমাইসা। বাবা চান না অন্য কেউ তোদের উপর দয়া করুক।”

শেহ্ওয়ার কথা শেষ করে রুমাইসার দিকে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করলো রুমাইসা কি বলতে চায় কিন্তু সে কিছুই বলল না প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে শেহ্ওয়ারের দিকে তাকালো।

“আপনি বোধ হয় জানেন না বাবার চিকিৎসার সকল খরচ বাবাই দিচ্ছেন কারো কাছ থেকে দয়া তিনি নিচ্ছেন না। আর আপনি বা কি করে ভাবলেন বাবা আপনাদের কাছ থেকে চিকিৎসা খরচ নিবেন?”

“তুই কি আমায় ভুল বুঝছিস রুসা।”

“না ভুল বুঝবো কেনো। এখানে ভুল বুঝার মতো কিছুই বলেন নি আপনি তবে একটা কথা আপনি ঠিক বলেন নি, কাউকে সাহায্য করা মানে এই নয় যে সে তাকে দয়া করছে। আপনি কথা ঘুরিয়ে না বললেই পারতেন।”

“কি হয়েছে বল তো? রেগে যাচ্ছিস কেনো।”

“আপনি মি.স্মরণকে আগ থেকেই চিনতেন তাই না। আর তার সাথে আপনার সম্পর্কটা যে খুব একটা ভালো না সেটাও আমি কাল রাতে আপনার আর মামা জানের কথায় বুঝতে পেরেছি।”

শেহ্ওয়ার এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। অবাক হয়ে দেখলো রুমাইসাকে। এই কি তার সেই ছোট্ট রুমাইসা নাকি অন্য কারো প্রতিমূর্তি।

“কি ভাবছেন? ”

“তুই এতটা কি করে বদলে গেলি রুসা।”

“সময় এবং পরিস্থিতি দুটো মানুষে বদলাতে বাধ্য করে সেটা নিশ্চই আপনার অজানা নয়?”

“খুব কঠিন কঠিন কথা বলতে শিখেছিস দেখছি আজকাল।”

এবার রুমাইসা তার পাংশু ঠোঁট দুটো প্রসারিত করলো। শেহ্ওয়ার লক্ষ্য করলো প্রচন্ড শীতে রুমাইসা ঠোঁট দুটো শুষ্কতা ধারণ করেছে। তবুও কি দিব্যি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।

“বেশ ঠান্ডা পড়েছে এদিকে চলুন যাওয়া যাক।”

বলে রুমাইসা উঠে দাঁড়াল। চলে যাবার জন্য
অগ্রসর হতে গেলে শেহ্ওয়ার তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,

“সেদিন বই গুলো তাহলে মি.স্মরণ তোকে দিয়েছিলো?”

রুমাইসা এবারো কোনো জবাব করলো না, ফিরে ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি টেনে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো। সে জানতেও পারলো না পুকুরের অপর পাশ থেকে কেউ একজন তাদের কথোপকথনের সাক্ষী হয়েছিলো। তার কড়া জবাবে যার মনে শ্রাবণে উত্তাল ঝড়হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।

(২৩)

মেডিকেল ক্যাম্প থেকে বিদায়ের দিন চলে এলো। সকাল থেকেই স্মরণ নিজের কাজ সেরে বিকেলের পর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ব্যাগে গুছাতে আরম্ভ করলো।

“ডাক্তার সাহাব এককান কথা কমু।”
রমিজের কথা কানে পৌঁছাতে স্মরণ মুচকি হাসলো। নিশ্চিন্দপুরে এই একজন মানুষই তার খুব কাছের হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যে সব সময় তার পাশে থেকেছে। এমনকি আজকে বিদায়ের দিনেও সে স্মরণের সঙ্গ ছাড়েনি। স্মরণের হাতে হাত লাগিয়ে সব গুছিয়ে দিচ্ছে।

“ও স্যার, একখান কথা কমু?”

“কি ব্যাপার রমিজ সাহেব হঠাৎ ডাক্তার সাহেব বাদ দিয়ে স্যার বলে সম্বোধন করছো?”

“এমনিই কইলাম আর কি। আপনারে যখন যেইডা খুশি হেইডাই তো ডাকবার পারি তাই না?”

“তা কি কথা বলবে বলছিলে?”

“করিম চাচার মাইয়া রুমাইসা আপনার লগে দেখা করতে আইসে।”

কথাটা কানে যেতেই স্মরণ কিছু সময়ের জন্য থম মেরে গেলো কিন্তু সেটা বাহিরে প্রকাশ করলো না। এই ভর সন্ধ্যে বেলায় মেয়েটা তার সাথে দেখা করতে এসেছে ভেবেই কিছুটা অবাক হলো সে।

“হে বাহিরে খাড়ায়া আছে, যদি অনুমতি দেন তবে আইতে কমু?”

“উনি এই সন্ধ্যে বেলায় আমার সাথে কেনো দেখা করতে এলেন?”

“হেইডা তো আমি কইবার পারি না ডাক্তার সাহাব। আপনি হেরেই জিজ্ঞাস কইরা নিয়েন ক্যান আইছে।”

স্মরণ আর দ্বি-উক্তি করলো না নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। রমিজ কিছুটা সময় স্মরণের কাজ দেখতে থাকলো তারপর বলল,

“হের লগে কি আপনে দেখা করবেন না? মাইয়াডা এই ঠান্ডার মধ্যি আপনার লগে দেখা করার লাইগা বাহিরে খাড়ায়া আছে।”

“রমিজ সাহেব! আপনি শুধু শুধু তাকে এখানে নিয়ে আসতে গেলেন কেনো বলুন তো? আপনি তো বেশ ভালোই জানেন উনার মা জানলে ব্যাপারটা খুব একটা ভালোভাবে নিবেন না তাও কেনো?”

“আসতে পারি?”
রুমাইসা ট্যান্টের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে বলল।
স্মরণ কাজ রেখে বাহুতে হাত গুঁজে ফিরে দাঁড়াল। রমিজ ফিসফিস করে তাকে বলল,

“মাইয়াটারে কিছু কইয়েন না স্যার। অনেক দূর থেইকা সবার চোখ ফাঁকি দিয়া আসছে।”

স্মরণ রমিজের কথায় তেমন পাত্তা দিলো কিনা বুঝা গেলো না তবে গলা ছেড়ে নিজেই বলল,

“আসুন।”

রুমাইসা ভেতরে প্রবেশ করলে রমিজ স্মরণকে কানে কানে কিছু বলে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

ঘরে ডুকে রুমাইসা নতমস্তকে এসে স্মরণের সামনে দাঁড়াল। স্মরণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কোনো কথাই সে বলছে না। কিছুটা সময় এভাবে কেঁটে গেলে স্মরণ প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে নিজেই প্রথম বলল,

“আপনার দরকার ছিলো না এতো ঝুঁকি নিয়ে এত দূর পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করার জন্য এখান পর্যন্ত আসা।”

রুমাইসা প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না আগের মতো নিশ্চুপ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকলো। স্মরণ ক্ষণকাল রুমাইসার দিকে তাকিয়ে দেখলো। এখানে এসেছে অবধি মেয়েটা একবারো মুখ তুলে তাকায় কোথাও। স্মরণ রুমাইসার এমন ব্যাবহারের মুল কারণ বুঝতে পারলো।

“কি হলো কিছু বলছেন না কেনো? করিম চাচার কিছু হয়েছে?

রুমাইসা এবার মাথা দুলিয়ে না জানালো।

“তবে এত জরুরী ভিত্তিতে এখানে আসার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। ”

রুমাইসা এবারো নিশ্চুপ। স্মরণ রুমাইসার এমন নিশ্চুপতা দেখে বিরক্ত হলো কিছুটা। আর দুই ঘন্টা বাদে তাকে ট্রেন ধরতে হবে। এখনো তার হাতে অনেক কাজ। এই অসময়ে রুমাইসা এসে তার কাজে বিঘ্ন ঘটিয়েছে।

“বুঝতে পেরেছি। আমি রমিজকে বলছি সে আপনাকে আবার বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসবে।”

“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে দয়া করে আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনবেন।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো রুমাইসা। স্মরণ এত সময় পর লক্ষ্য করলো রুমাইসার চোখ ফুলে আছে। নাকের ডগা ফুলে লাল হয়েছে নিশ্চই কেঁদেছে। এলোমেলো চুল আর বিধ্বস্ত চেহারা মেয়েটাকে বড্ড ক্লান্ত বলে মনে হলো স্মরণের তাই সে কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই বলল,

“আচ্ছা বেশ শুনবো। তার আগে আপনি ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসুন।”

রুমাইসা জড়তা নিয়ে পাশের চেয়ারটা একটু টেনে বসলো। স্মরণ এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে রুমাইসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“নিন আগে পানি খান, আপনাকে দেখতে ঠিক লাগছে না।”

রুমাইসা হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে সব টুকু পানি শেষ করে নিলো।

“আপনি ঠিক আছেন এখন?”

রুমাইসা হাল্কা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালে স্মরণ আরেকটা চেয়ার টেনে রুমাইসার সামনে স্থির হয়ে বসল।

“এবার বলুন কি হয়েছে।”

“আপনি আজই চলে যাবেন?”

স্মরণ ক্ষণকাল মৌন থেকে তারপর আবার বলল,

“আপনি নিশ্চই এটা জানতে আসেন নি?”

“আসলে,,,।”

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না আপনি অপ্রয়োজনে এত দূর পর্যন্ত ছুটে এসেছেন। তাই যে কাজে এসেছেন আগে সেটা বলার চেষ্টা করুন।”

স্মরণকে গম্ভীরভাবে কড়া ভাষায় কথা বলতে দেখে রুমাইসার বুক কেমন ধক করে উঠলো। স্মরণ হঠাৎ তার সাথে এমন করে কথা বলবে এটা যেনো সে ভাবতে পারে নি। অবশ্য এই মানুষটাকে সে খুব একটা ভালো করে চেনে না, তার ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কেও সে খুব একটা অবগত নয়, তাই হয় তো কিছুদিনের আলাপে যে স্মরণকে দেখেছে কিংবা চিনেছে তার সাথে আজকের স্মরণের কোনো মিল সে খুঁজে পায় নি বলে মনে মনে কিছুটা আহত হয়েছে সে।

স্মরণ হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রুমাইসাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দেখুন আমার হাতে খুব একটা বেশি সময় নেই।”

এবার রুমাইসা কোনো ভণিতা করলো না। স্মরণের চোখে চোখ রেখে বলল,

“আপনি শেহ্ওয়ার ভাইকে চিনেন? তার সম্পর্কে জানেন কিছু?”

স্মরণ রুমাইসার এমন প্রশ্নে বিন্দু পরিমাণ অবাক হলো না বরং সহজভাবে বলল,

“হ্যাঁ। ব্যাক্তিগত ভাবে খুব একটা বেশি চিনি না, তবে তিনি হয় তো আমাকে চেনেন।”

“আপনি জানেন যে উনার সাথে আমার তিন বছর আগে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো?”

“জানতাম না তবে জেনেছি। মি.করিম সাহেব বলেছিলেন।”

রুমাইসা অবাক হলো তারপর বলল,

“বাবা আপনাকে এসব কখন বলল?”

“দুপুরের পর গিয়েছিলাম উনাকে দেখতে তখন ই কথায় কথায় বললেন তিনি। বাই দ্যা ওয়ে কনগ্রাচুলেশন।”

“আপনি একটুও অবাক হচ্ছেন না?”

“এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু তো দেখছি না।”

“উনারা আমাকে তাদের সাথে ইংল্যান্ড নিয়ে যেতে চায়। আর সেটা আমার পরীক্ষার আগেই।”

“দেখুন মিস.রুমাইসা আমি আপনার বাবাকে ট্রিটমেন্ট করছি আর সে সুত্রে তার সাথে আমার কিছুটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি আপনার পারিবারিক বিষয়ে কথা বলবো।”

“দেখুন আমি কথাটা সে জন্য বলি নি। আপনি জানেন না আপনি আমাকে বই গুলো দিয়ে কি উপকার করেছেন তাছাড়া আমি এখন নিয়ে করতে চাই না। আমি পড়াশুনা করতে চাই। আপনি তো সেদিন বলেছিলেন শুধু অন্যের ফরমায়েশ খাটার জন্য কেউ জন্মায় না মাঝে মাঝে নিজের জন্য কিছু করতে হয়।”

“হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।”

“আমি পড়াশুনা করতে চাই। এখন বিয়ে করতে চাই না। আপনি প্লিজ বাবাকে একটু বুঝান। উনি বিয়েতে প্রথমে রাজী না থাকলেও মামা মামি মার অনুরোধে রাজী হয়ে গেছেন। প্লিজ আপনি আমাকে সাহায্য করুন।”
রুমাইসার কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়লো স্মরণের।

রুমাইসা স্মরণকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,

“আমি জানি না হঠাৎ আপনার মধ্যে এমন বদল কেনো ঘটেছে। তবে আপনি যদি মনে করেন আপনার একটু সাহায্য পেলে একটা মেয়ে তার স্বপ্ন পূরণের দিকে একদাপ এগিয়ে যাবে তবে আপনি সেটাই করবেন যেটা আপনার ভালো মনে হয়।”

“আপনি কেনো ভাবছেন আপনার বাবা আমার কথা শুনবে?”

“নয় তো তিনি আপনাকে ডেকে অনুরোধ করে বলতেন না আমার পড়াশুনা যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সে ব্যাবস্থা করতে। আর আপনিও বাবার কথা পেলতে না পেরে আমাকে বই এনে দিতেন না।”
বলেই রুমাইসা ট্যান্ট থেকে বেড়িয়ে গেলো। স্মরণ কিছুসময় মৌন থেকে প্রশস্ত নিশ্বাস ছাড়লো। সে জানে না কেনো সে না চাইতেই এই মেয়ের সকল কিছুতে এইভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো তবে বার বার তার সাথে কেনো ই বা এমন হচ্ছে। সে তো চায় না নতুন করে কারো জীবনের সাথে জড়াতে তবে কেনো বার বার নিয়তি তাকে ওই এক জায়গায় এনে দাঁড় করাচ্ছে।

চলবে,,

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১২

(২৪)

বাড়িতে ডুকতে রুমাইসার পথ আগলে দাঁড়াল শেহ্ওয়ার। অন্ধকারে রুমাইসা তার মুখ দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলো শেহ্ওয়ার অনেক রেগে আছে।

“কোথায় গিয়েছিলি এই ভর সন্ধ্যেবেলায়? ”

“কাজ ছিলো একটু।”

“আমি কাজের কথা জানতে চাইনি রুসা। কোথায় গিয়েছিলি সেটা জানতে ছেয়েছি।”

শেহ্ওয়ার কিছুটা উচ্চবাক্যে কথা গুলো বলল কিন্তু তাতেও রুমাইসার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে শেহ্ওয়ার
সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

“তুই কি ঠিক করেছিস আমার কথার উত্তর দিবি না?”

“উত্তর দেই নি কে বলল?”

“কি বুঝাতে চাইছিস তুই রুসা।”

“বলেছি তো কাজ ছিলো।”

“বুঝতে পেরেছি, তোকের আর এই বিষয়ে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। বাই দ্যা ওয়ে বসার ঘরে ফুফাজান আর বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে এলে ভালো হয়।”

রুমাইসা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে জানে বাবা আর মামা তাকে কি বলতে পারে। তবে তারা যাই বলুক না কেনো এই মুহূর্তে সে বিয়ে করতে চায় না, অনেক দূর পর্যন্ত লেখা পড়া করতে চায় সে। আজ কাল শুধু লেখাপড়া করতে চায় এর মধ্যেই রুমাইসার স্বপ্ন সীমাবদ্ধ নেই, সে স্বরণের মতো বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তার এই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে কি না তা কে বলতে পারে?

রুমাইসা কয়েক সেকেন্ড কি যেনো ভাবল তারপর
শেহ্ওয়ারের চোখে চোখ রেখে বলল,

“মামাজান আর বাবা নিশ্চই আমাকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়া নিয়েই কথা বলতে চান?”

“হবে হয় তো তাই।”

“কিন্তু আমি সেখানে যেতে চাই না।”

এবার শেহ্ওয়ার প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো। কয়েক পা এগিয়ে রুমাইসার কাছে সরে এসে দাঁড়াল, তারপর বলল,

“দেখ রুমাইসা আমরা কেউই তোর খারাপ চাই না।
এখানে তুই ভালো থাকতে পারবি না। মিসেস নিলুফারের এমন আক্রোশ থেকে তুই সহজে বের হতে পারবি না। উনি তোকে পড়াশুনা করতে দিবেন না কোনোভাবে তাছাড়া এমন পাড়াগাঁয়ে থেকে তুই কখনো নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পারবি না।”

“দেখো আমি জানি মা আমাকে পছন্দ করেন না,সব সময় আমাকে কথা শুনায় তাই বলে আমি আমার নিজের বাড়ি ছেড়ে বাবাকে ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবো?”

“তুই জানিস বাবা চাইছে আমি তোকে এখনি বিয়ে করে ওই দেশে নিয়ে যাই।”

“জানি।”

“কিন্তু আমি সেটা চাইছি না। কারণ আমি জানি তুই এই মুহূর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়, তাছাড়া তোর এখনো বিয়ের বয়স হয় নি। আমি চাই তুই পড়াশুনা কর। তোকে আমি অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করবো। এখানে পড়ে থাকলে তো সেটা সম্ভব নয়।”

রুমাইসার কথাগুলো চুপচাপ শুনতে লাগলো। এখানে কেউ নেই যে তার মনের কথা বুঝবে। সবাই তাকে নিয়ে নিজের মন গড়া গল্প তৈরী করে চলেছে আর সে সব গল্পের ভিড়ে তার নিজের গল্পটাই বেমালুম চাপা পড়ে যাচ্ছে।

(২৫)

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে স্মরণ। চারপাশে উত্তরী সমীরণ বইছে সাথে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। অন্ধকারে সামনে যতদূর দেখা যায় শুধু কুয়াশা ঘণ প্রলেপ। স্মরণ চোখ বুজে নাক টেনে নিশ্বাস নিলো। বাতাসে লেগে থাকা শিউলির শেষ ফুলটার সুবাস নিশ্বাসের সাথে গ্রহন করতে চাইলো কিন্তু সেটা আর হলো কোথায়? বিন্নি ধানের পাকা গন্ধ এসে তার নিশ্বাসের সাথে নাসিকাপথে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে নাড়া দিলো। সঙ্গে সঙ্গে স্মরণের কপালের চামড়া কুচকে উঠলো। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। চোখ খুলে সে চারপাশে তাকালো আর প্রচণ্ড বিরিক্ত নিয়ে বলল,

“পুরো মুডটাই নষ্ট করে দিলো।”

“একা একা কি কথা বলছিস ”
বলেই ফায়াজ এসে স্মরণের পাশে দাঁড়াল।

“যাবার আগে মুড খারাপ করার জন্য এই ধানের বিচ্ছিরী গন্ধটাই যথেষ্ট।”

ফায়াজ স্মরণের কথা মুচকি হাসলো। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুই সত্যি কি মেয়েটার অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে যেতে পারবি?”

“আমি কি এমন কোনো প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কেউ এসে আমাকে অনুরোধ করলো আর আমি সেটা রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবো?”

“তুই একটু বেশিই রেগে যাচ্ছিস না? মেয়েটা এই ভর সন্ধ্যেবেলায় অকারণে তোর কাছে ছুটে আসেনি স্মরণ। ”

“কি বুঝাতে চাস তুই ফায়াজ।”

“কিছুই না, শুধু বলতে চাইছি যে কারো অনুরোধ রক্ষার্থে কিন্তু তুই ওই মেয়েটার বই কিনে এনেছিলি আর সে বই কিনে আনতে তুই স্কুলের দপ্তরী কি ঠিক কত টাকা খাইয়েছিস সেটা নিশ্চই তোর অজানা নয়। তুই চাইলেই বই আনতে পারতিস একটু জোর দিয়ে বললে কিন্তু তুই সেটা করিস নি বলেছিস যত টাকা লাগে তুই তাকে দিবি তারপরো যেনো তিনি তোকে একসেট বই দেন।”

“পুরোনো কথা ঘাটাঘাটি করার কোনো মানে নেই। চল যাই অনেক ঠান্ডা পড়ছে। একটু পর গাড়ি আসবে।”
বলে স্মরণ সেখান থেকে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

“তুই সত্যি চলে যাচ্ছিস তাহলে?”

“কেনো সন্দেহ আছে তাতে?”

“আর ওই মেয়েটা।”
এবার স্মরণ থামলো কিছু একটা ভেবে ফিরে ফায়াজের সামনে এসে মুখামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“একটা কথা কি জানিস তুই আমাকে এখন যেমন দেখছিস আমি মোটেও তেমন নয় আর সেটা হয় তো তুই খুব ভালো করেই জানিস আর বুঝিস। গ্রামে যে স্মরণকে তুই দেখছিস নিজের জীবনে যে সে এমন নয় সেটা নিশ্চই তোর থেকে ভালো কেউ জানে না।”

“তুই অতটাও হৃদয়হীন নয়।”

“কি দায় পড়েছে আমার যে ওই মেয়েটাকে আমাকে সাহায্য করতে হবে।”

“যে দায়ে পড়ে তুই তার জন্য অতদূর ছুটে গিয়েছিলি, টাকা খাইয়ে বই এনেছিলি।”

“বার বার এক কথা কেনো বলছিস বলতো?”

“তুই কি শেহ্ওয়ারের উপর রাগ করে এসব করছিস?”

“মিসেস রুমাইসা তার বাগদত্তা, আমাদের কোনো রাইট নেই তাদের জীবন নিয়ে কথা বলার।”

“কোনো রাইট নেই মানে? মেয়েটা তোর কাছে ছুটে এসেছে স্মরণ, ও বিয়েটা করতে চায় না।”

“বিয়ে করতে চায় না কে বললো? সে এখন করতে চায় না বলেছে বিয়ে করবে না তা তো বলে নি। আর দেখ আমি এসব নিয়ে একদম কথা বলতে চাই না। আমার হাতে সময় নেই যদি যাবার হয় তো চল না হয় এখানেই পড়ে থাক।”

বলে স্মরণ দ্রুত গতীতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ফায়াজ স্মরণের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,

“এই ছেলে কোনো দিন কিছু বুঝবে না। শুধু নিজের জেদ আর একরোখা নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেবে।”

(২৬)

বাবার সামনে নতমুখে বসে আছে রুমাইসা। দুচোখে অশ্রু জমাট বেঁধেছে সে কখন। মনের ভেতর প্রচণ্ড ঝড় বয়ে চলেছে অনবরত কিন্তু তার খবর নেবার মত কেউ নেই। শরীরের ব্যাথা সবাই দেখতে পায় কিন্তু মনের ব্যাথা সেটা কে দেখে? রুমাইসার ভেতরটা কেমন গুড়িয়ে যাচ্ছে। সে চায় না এখন বিয়ে করতে তাও সবাই মিলে তাকে জোর করছে যাতে সে বিয়েটা করে নেয়।

করিম সাহেব মেয়ের হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

“দেখ মা তুই যদি শেহ্ওয়ারকে বিয়ে করে ওই দেশে চলে যাস তাহলে আমার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। রোজ রোজ আর এত অশান্তি তোকে সয্য করে এখানে পড়ে থাকতে হবে না। শেহ্ওয়ার অনেক ভালো ছেলে তোর অযত্ন সে কখনো করবে না।”

“বাবা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি পড়াশুনা করতে চাই।”

“তারা তো তোকে পড়াশুনা করাবে না বলে নি। অবশ্যই করাবে।”

“আমার পরীক্ষা সামনে।”

“তাতে কি? বিয়েটা না হয় দু মাস পড়েই হবে। পরীক্ষা হয়ে গেলেই হোক।”

“কিন্তু বাবা।”

“আর কোনো কিন্তু করিস না মা। আমার হাতে হয় তো আর বেশি সময় নেই। তোকে শেহ্ওয়ারের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমি শান্তিতে মরতে পারবো।”

“বাবা আমি মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাই।”

“অবশ্যই করবি। কিন্তু সেটা বিয়ের পর।”

রুমাইসা কোনো কথা বলতে পারলো না আর। এবারো তার গতিহীন জীবন বরাবরের মতো তাকে তার করুণ পরিণতির দিকে টেনে নিতে চাইছে সেটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। অথচ তার কিছুই করার নেই আর নিজের ইচ্ছাগুলোকে বলি দেয়ার জন্যই যেনো তার জন্ম হয়েছে বলে মনে হলো রুমাইসার।

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইসা। শিউলি গাছের পাতায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমেছে। সেখান থেকে টপ টপ করে কেয়েক ফোঁটা শিশির জল গড়িয়ে নিচের সবুজ গাসের উপর পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। রুমাইসা গভীর দৃষ্টিতে সে দৃশ্য চোখে ধারণ করছে। দূর থেকে ট্রেনের ঝকঝক শব্দ ভেসে আসতে শুনলো রুমাইসা। গভীর রাতে ঝকঝক শব্দটা কতটা ভয়ংকর শুনা যায় সেটা চোখ বুজে অনুভব করতে চাইলো সে। কিছুসময় চোখ বুজে পরে ধীরেধীরে চোখ খুললো। বিষণ্ণতায় ছেয়ে উঠে তার মন। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্মরণের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। হয় তো এই শেষ ট্রেনে করেই স্মরণে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। বিদায় নিয়েছে এই নিশুতি রাতের গ্রাম ছেড়ে। ধীরেধীরে রুমাইসার মন ভার হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর কেমন চিন চিন ব্যাথা অনুভব করলো সে। স্মরণের সাথে তার পরিচয় খুব একটা বেশি দিনের নয় তবুও কেনো তাকে এত কাছের বলে মনে হয় রুমাইসার? এই উত্তর সে খুঁজে পায় না।

চলবে,,,,।