সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-২৩+২৪

0
319

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৩

(৫২)

পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উলট পালট করছে রুমাইসা। আজকাল তার মন অল্পতেই খারাপ হয়ে উঠে। গ্রাম থেকে এসেছে প্রায় একমাস হতে চলল অথচ নিজের বাড়ি আর বাবাকে ছাড়া সে কখনো কোথাও গিয়ে এত দিন থাকে নি। অলকানন্দপুর ছোট্ট গ্রামের সারি সারি ধান খেত, পথঘাট,শিউলি তলা আর মায়ের কবর ছেড়ে আজ সে বহু দূরে। চাইলেও এখন আর তার মায়ের কবরের কাছে যেতে পারে না, কষ্টগুলোও আর মাকে বলা হয়ে উঠে না। এসব ভাবতে ভাবতে রুমাইসার বুক ভার হয়ে আসে, নেত্রপল্লব দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে।

“মিস রুমাইসা।”
হঠাৎ স্মরণে কন্ঠস্বর কানে আসতে দ্রুত চোখ মুছে নিলো রুমাইসা। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে স্মরণের সামনে এসে দাঁড়ায়।

“গ্রাম থেকে আপনার বাবার চিঠি এসেছে। তিনি বোধহয় কিছুটা অসুস্থ, রমিজের চিঠি পড়ে তাই মনে হলো।”

“বাবা অসুস্থ?”

“তাই তো বললেন রমিজ সাহেব। তবে সব খুলে বলেন নি তিনি কিছুটা বলেছেন। আপনি আপনার বাবার চিঠি পড়লে হয় তো কিছু জানতে পারবেন।”

“আমরা গ্রামে ফিরবো কবে?”

“ফেরার জন্য কি গ্রাম ছেড়েছিলেন?”

“আমার পরীক্ষা?”

“সেটার জন্য নিশ্চিন্দপুর যাওয়া হলেও অলকানন্দপুর যাওয়া হবে কিনা কথা দিতে পারছি না।”

“বাবার সাথেও দেখা করা হবে না?”

“হতেও পারে। এসব নিয়ে আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। যেটার জন্য আপনি সব ছেড়ে এখানে এসেছেন আগে সেটায় মনোযোগ দিন। পড়াশোনাটা ভালো করে করুন আপনার হাতে খুব একটা বেশি সময় নেই। তাই যতটুকু সময় আছে কাজে লাগান, পড়াশুনা করুন।”

“আপনাকে খুব বিপদে ফেলে দিলাম তাই না।”

“সেটা আপনাকে এখন না ভাবলেও চলবে মিস রুমাইসা। আর আপনি আমাকে বিপদে ফেলতে চাইলেই যে আমি বিপদে পড়ে যাবো তা কিন্তু নয়। সেদিন আপনি আমার কাছে এসেছিলেন আমি চাইলেই আপনাকে আবার ফিরিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু সেটা আমি করি নি। আর বিপদে যদি পড়ে থাকি সেটা আমি নিজেই নিজের জন্য পড়েছি আপনার জন্য নয়। তাই আর এসব নিয়ে কথা না বলাটাই ভালো। ”

বলেই স্মরণ রুমাইসার দিকে চিঠি এগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। স্মরণ চলে গেলে রুমাইসা বিছানার একপাশ দখল করে বসে। কাঁপা কাঁপা হস্তে খাম ছিঁড়ে একটুকরো চিঠি বের করে সেটা চোখের সামনে মেলে ধরে। চিঠিতে বাবার হাতে লেখার উপর দৃষ্টি পড়তে তার দুচোখ ছলছল করে উঠলো। অন্তঃকরণে চাপা কষ্ট অনুভব হতে লাগলো। বাবাকে ছেড়ে এতদূর আসতে হবে কখনো আসতে হবে সেটা সে ভাবে নি।

আজকাল করিম সাহেবের স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মেয়েকে একটিবার দেখার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রোজ রমিজকে ডেকে তিনি নানানভাবে রুমাইসার খবর জানতে চাইতেন কিন্তু রমিজ তাকে তেমন কোনো খবরই দিতে পারে নি গত একমাস যাবত। রুমাইসাকে শহরে নিয়ে আসার পর নানান ঝামেলায় পড়ে রমিজকে আর চিঠি পাঠানো হয় নি স্মরণের। এমনকি রমিজের দেয়া চিঠিরও সে কোনো উত্তর করে নি। অন্যদিকে মেয়ের কোনো খবর না পেয়ে চিন্তায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন করিম সাহেব। দিন চার কি পাঁচেক আগে স্মরণ যখন একটু অবসর পেল তখনি সে রমিজের নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলো তার উত্তরেই আজ রমিজ তাকে চিঠি পাঠিয়েছে আর সাথে করিম সাহেবও মেয়ের উদ্দেশ্যে একখানা চিঠি পাঠালেন।

চিঠি শেষ করে রুমাইসা চোখ মুছল। অনেকদিন পর সে বাবার খবর পেয়েছে। এখন তার একটু নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে। তবে একটা ব্যাপারে সে কিছুটা চিন্তিত কারণ স্মরণের কথা অনুযায়ী রমিজ বলেছিলো তার বাবা অসুস্থ অথচ পুরো চিঠির কোথাও অসুস্থতার কথা লিখে নি তার বাবা বরং বার বার করে বলেছে তিনি সুস্থ আছেন, রিমা এবং সমীর দুজনই তাকে দেখে রাখছে।

বেশ কিছুটা সময় রুমাইসা বাবার চিঠি বুকে জড়িয়ে উপর হয়ে শুয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ কি যেনো ভেবে সটান করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল আর বালিশের তলায় চিঠি রেখে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

(৫৩)

“আচ্ছা বাবা স্মরণের মাথা কি ঠি আছে বলুন তো?”

“কেনো বউ মা স্মরণের আবার কি হলো?”

“এই যে গ্রাম থেকে অচেনা অজানা একটা মেয়েকে তুলে এনে বাড়িতে রেখেছে লোকে জানলে কি ভাববে বলুন তো।”

“তুমি কি বলতে চাইছো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বউ মা।”

“এই যে রুমাইসা মেয়েটা ওকে এইভাবে বাড়িতে এনে তোলার কি কোনো মানে আছে? কোথাকার কোন পাড়াগাঁয়ের মেয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য আপনার নাতি কিনা করছে শেষ পর্যন্ত বাড়িতে এনে তুলেছে তাও এক দুই দিনের জন্য নয় একেবারে সারাজীবনের জন্য মনে হচ্ছে।”

“বউ মা তুমি এই কথা কি করে বলতে পারছো? আমার দাদুভাই কি খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছে? একটা অসহায় মেয়েকে সে সাহায্য করেছে তাতে খারাপের কি দেখলে তুমি। আর বার বার মেয়েটাকে তুলে এনেছে বলছো কেনো?”

“বাবা আপনিও স্মরণের মতো এত দিল দরদী হয়ে যাবেন না। কে জানে কোন উদ্দেশ্যে আমার ছেলের ঘাড়ে এসে চেপেছে মেয়েটা।”

“বউ মা ভদ্রভাবে কথা বলো তোমার মুখে এমন কথা মানায় না, আর আমি তোমাকে যতটুকু চিনি তুমি তো এভাবে কথা বলার মেয়ে না, তবে কেনো বলছো এসব। আর এই মেয়েটাকে নিয়ে তোমার কি এত সমস্যা কিসের আমি তো বুঝতে পারছি না।”
বলেই মাহতাব শেখ নিজের পুত্রবধূর মুখের দিকে তাকালেন।

সেলিনা রহমান কিছুটা রেগে আছেন কিন্তু শ্বশুরের চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো রাগটা কিছুটা প্রশমিত করে আনলেন।

“বউ মা ভুলে যেও না তোমার নিজেরো একটা মেয়ে আছে তাই অন্যের মেয়েকে নিয়ে দুটো কথা বলার আগে একটু ভাবনা চিন্তা করে বলবে।”

“বাবা আপনার ছেলে এখন বাড়ি নেই দুদিন পর তিনি আসলে কি জবাব দেবো আমি বলতে পারেন?”

“তোমাকে কোনো কিছু নিয়ে বাবার কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না মা।”
হঠাৎ পেছন থেকে স্মরণের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠলেন সেলিনা রহমান। চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে যেমন হয় সেলিনা বেগমেরও এখন ঠিক সেইরকম অবস্থা। তিনি ভাবতে পারেন নি স্মরণ তার কথাগুলো শুনে ফেলবে তাই নিজের দোষ ডাকতে বললেন,

“আরে বাবা আমি সে জন্য বলছি না, তুই আমাকে একদম ভুল বুঝিস না।”

“আপনি কি জন্য কথাগুলো বলেছেন তার কৈফিয়ত আমি আপনার কাছে চাইনি আম্মা। আপনি যা বলার তা তো বলেই দিয়েছেন। আপনার যখন মিস রুমাইসাকে বাড়িতে আনা নিয়ে এত সমস্যা তাহলে প্রথম দিন কেনো বারণ করেন নি। আর হ্যাঁ ভুলে যাবেন না এই বাড়িটা শুধু আপনার একার, এই বাড়িতে আরো মানুষ বাস করে, কই তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না একলা আপনারই কেনো উনাকে নিয়ে এত সমস্যা হচ্ছে।”

“স্মরণ তুই আমাকে এবারো ভুল বুঝছিস। তোর বাবা ব্যাপারটা জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?”

“আপনি কি ভাবছেন বাবা ব্যাপারটা জানেন না?”

“মানে?”

“মানে কিছুই নয়, মিস রুমাইসা যে এখানে আছেন সেটা বাবা প্রথম দিন থেকেই জানেন। তাই বাবা জানবে বাবা জানবে বলে আপনাকে এত মরিয়া হয়ে উঠতে হবে না।”
বলেই স্মরণ কিছুটা রেগে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। স্মরণ চলে গেলে মতলব শেখ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তারপর পুত্রবধূর দিকে হতাশ চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,

“মেয়েটাকে নিয়ে তোমার সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি বউ মা। তুমি আসলে যা চাইছো তা কখনোই স্মরণ মেনে নিবে না। মা হয়ে যে এখনো নিজের ছেলেটাকে বুঝতে পারো নি তা যে কারোই আর অজানা নেই।”

বলে মতলব শেখও নিজের ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। সেলিনা রহমান মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে বেশ রুষ্ট হলেন রুমাইসার উপর। মেয়েটাকে তিনি প্রথম দিন থেকেই সহ্য করতে পারেন না। স্মরণ যেদিন রুনাইসাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসে সেদিনই তিনি ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখন নি, যদিও ছেলের মুখের সামনে কিছু বলতে সাহস করেন নি তবে তিনি যে তাতে খুব একটা খুশি হননি তা আচরণে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। রুমাইসাকে এই বাড়ির প্রত্যেকে খুব ভালোবাসে। ইতিমধ্যে অর্শাও তার বন্ধু হয়ে উঠেছে। স্মরণের বড় ভাই শয়নও তাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে শুধু সেলিনা রহমানই রুমাইসার উপর বিরক্ত।

(৫৪)

রুমাইসাদের বাড়ির সামনে বিরাট বড় ভিড় জমেছে। মধ্যরাতে বাড়ির অন্তঃপুর থেকে কারো ক্রন্দনরত সুর শুনে আশেপাশে লোকজন ছুটে আসে রুমাইসাদের বাড়ির উঠানে। করিম সাহেবের মৃতদেহের পাশে বসে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছেন নিলুফার বেগম। সমীর রিমা এক পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে। মনোয়ারা বেগম শক্ত হয়ে ছেলের লাশের পাশে ঠায় বসে আছেন। এতটুকু জল নেই চোখে, যেনো অতি শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি।

উঠানে মানুষের ভিড় ঠেলে ঘরের দিকে ছুটে গেলো রমিজ। তিনি যেনো এমন কিছুর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। করিম সাহেবের মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে তিনি থ হয়ে গেলেন। বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তের তার কি করা উচিত।

ইতিমধ্যে গ্রামের সব লোক জড়ো হয়েছে রুমাইসাদের বাড়িতে। শেহওয়াদেরও খবর পাঠানো হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ সময় আগে। আত্নীয় স্বজনরাও শেষ রাতে এসে পৌঁছে গেছে। রমিজ এই দিকের সব দেখা শুনা করে দ্রুত মফস্বলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে শহরে পৌছে স্মরণকে টেলিফোনে খবর জানাতে হবে নয় তো পরবর্তীতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। রুমাইসা তার বাবাকে শেষ দেখা টুকু দেখতে পাবে না।

চলবে,,,।

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৪

(৫৫)

শেষ রাতে স্মরণের ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে যা তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। রমিজের স্বর ভাঙা কন্ঠে করিম সাহেবের মৃত্যুর খবরটা যেনো তার কানের পাশ দিয়ে গেলো। রমিজের কল কেঁটে স্মরণ শোয়া থেকে উঠে দ্রুত রুমাইসার ঘরের দিকে যাবার জন্য অগ্রসর হলো। রাতের শেষাংশে সারা বাড়িতে শুধু দুটো লাইট জ্বলছে। একটি ছাদের সিঁড়ি ঘরে অন্যটি দোতলার দক্ষিণে থাকা ব্যালকনিতে। নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে লাইটের স্বল্প আলোতে রুমাইসার ঘরের দিকে চলতে চলতে স্মরণের মনে হলো এই মুহূর্তের বাবার মৃত্যুর খবরটা রুমাইসাকে দেয়া ঠিক হবে না, মেয়েটা হয় তো এতটা শোক সামলে উঠতে পারবে না ভেঙে পড়বে। অন্তঃকরণে এসব চিন্তা করতে করতে সে রুমাইসার ঘরের সামনে এসে থামলো। ঘরের ভেতর থেকে হারিকেনের টিমটিমে আলো দরজার নিচ থেকে দেখা যেতে দেখে স্মরণ নিজের ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো। রাতে শেষাংশেও রুমাইসার ঘরে আলো জ্বলছে দেখে কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলো সে। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করবে কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে শেষে কড়া নেড়ে বলল,

“মিস রুমাইসা আপনি কি জেগে আছেন? আমি ভেতরে আসছি।”

স্মরণ দরজার এপারে দাঁড়িয়ে খানিকটা সময় রুমাইসার জবাবের অপেক্ষা করলো কিন্তু ভেতর থেকে তেমন কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে আবারো বলল,

“মিস রুমাইসা আমি কিন্তু ভেতরে আসছি, আপনার সঙ্গে জরুরী কথা আছে আমার।”

এবারো দরজার ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। স্মরণ হতাশ হয়ে শেষে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখলো রুমাইসা টেবিলের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। হয় তো পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। স্মরণ কয়েক পা এগিয়ে রুমাইসার অতি নিকটে এসে দাঁড়ায়। হারিকেনের টিমটিমে লাল আলোয় রুমাইসার ঘুমন্ত মুখের দিকে স্থির চাহনিতে তাকিয়ে প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো সে। ঘুমন্ত অবস্থায় যে মেয়েটাকে এতটা মায়াবী মনে হয় সেটা দ্বিতীয় বারের মতো অনুভব করলো স্মরণ। রুমাইসার কপালে একপাশ চুলে ঢেকে আছে। কি অবলীলায় তারা তার কপাল স্পর্শ করে আছে স্মরণের খুব ইচ্ছে হলো রুমাইসার এলো চুল গুলো কপালের কাছ থেকে সরিয়ে কানের একপাশে গুঁজে দিতে কিন্তু পারলো না একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে প্রাণপণে বাঁধা দিচ্ছে এমনটা করতে।

ঘড়িতে ভোর পোনে পাঁচটা বাজে। রুমাইসার ঘুম ভাঙলেই স্মরণ তাকে তাড়া দিয়ে রেডি হতে বললে রুমাইসা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে এই ভোর বেলায় তারা কোথায় যাবে কিন্তু স্মরণ তার কোনো কথার জবাব না দিয়ে দ্রুত রেডি হতে বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

স্মরণ চলে গেলে রুমাইসা উঠে রেডি হয়ে নেয়। নিজের কিছু দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নেয়। স্মরণ তাকে বলে গেছে নিজের তৈরি হয়ে যেনো সাথে কিছু জামা কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নেয়। কয়েকদিনের জন্য তাড়া শহরের বাহিরে যাচ্ছে কিন্তু এত ভোর বেলায় তারা কোথায় যাবে সেটা বলে নি। রুমাইসা রেডি হয়ে ধীর পদে স্মরণের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। ভেতরে প্রবেশ করার আগে জিজ্ঞাস করে বলল,

“আমি ভেতরে আসতে পারি?”

“হ্যাঁ আসুন।”

“আমরা এত তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছি?”

“যাচ্ছি কোথাও সেটা না হয় একটু পর জানবেন।”

“কিন্তু এত ভোরে? এখনো তো বাহিরে আলো ফুটেনি।”

স্মরণ নিজের গায়ে জেকেট জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

“তাতে কি এখন আলো ফোটে নি একটু পর তো ফুটবে।”

“আপনি এত রহস্য করেন কেনো?”

“কারণ রহস্য করতে আমার বেশ ভালো লাগে মিস রুমাইসা।”

“আমার একটুও ভালো লাগে না।”

স্মরণ এবার ঠোঁট দুটো মৃদু প্রসারিত করলো। বলল,

“চলুন যাওয়া যাক।”

” বাড়ির কাউকে বলে যাবেন না?”

“এতটা আবশ্যকীয় নয় আর আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।”

“কিন্তু আপনার মা তো রাগ করবেন।”

“সেটা না হয় আমি বুঝে নিবো, এখন তাড়াতাড়ি চলুন না হয় শেষ দেখাটাও আর হবে না।”

“আপনি কিসের শেষ দেখার কথা বললেন?”
মুখ থেকে ভুল করে কথাটা বের হয়ে গেছে ভেবে স্মরণ কথা কাটিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু রুমাইসা বারবার তাকে একই কথা জিজ্ঞাস করে অস্থির করে তুলছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে চায় না রুমাইসা বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভেঙে পড়ুক। তাই সে রুমাইসার কথার জবাব না দিয়ে বের হতে ইশারা করলো।

(৫৬)

সারা বাড়ি আত্নীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীতে গিজগিজ করছে। তাদের ক্রন্দনধ্বনি অনেক দূর পর্যন্ত হাওয়ায় বেসে চলেছে। নিলুফার বেগম এই নিয়ে বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছেন। গ্রামের কয়েকজন মহিলা তাকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু তিনি বার বার মূর্ছিত হয়ে পড়ছেন। গ্রামের কয়েকজন হুজুর সহ শেহওয়ার এবং আজমল আহমেদ গেছেন করিম সাহেবদের পারিবারিক কবরস্থানে, যেখানে শুয়ে আছেন করিম সাহেবের বাবা এবং তার স্ত্রী। কবরস্থানের কাছাকাছি এসে শেহওয়ার একটু দাঁড়াল পর পর পাশাপাশি দুটি করবরের সাথে আরো একটি নতুন কবর খনন করা হবে আর তাই সেখানে কয়েকজন লোক এসে জড়ো হয়েছে। তারা কবর খনন করার জন্য কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী নির্দেশের জন্য।

ইতিমধ্যে কবর খননের কাজ শুরু হয়ে গেছে। শেহওয়ার এবং আজমল আহমেদ দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। তার বোনের পাশে আজ আরো একটি কবর খনন হচ্ছে আর তাতে চির শায়িত হবেন তার একমাত্র বোনজামাই। অজান্তেই আজমল আহমেদের চোখ সিক্ত হয়ে উঠলো। উনি চাননি কখনো রুমাইসা একেবারে এতিম হয়ে যাক কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস সে তো আর কারো ইচ্ছায় চলে না। কবর প্রায় অর্ধ খনন হয়ে গেছে। শেহওয়ার এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ফুফার চলে যাবার পেছনে তোমার কোনো হাত নেই তো বাবা?”

ছেলের মুখে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিৎ চমকালেন আজমল সাহেব। অবাক চাহনিতে শেহওয়ারের দিকে তাকাতে শেহওয়ার আগের ভঙ্গিমায় বলল,

“আমি কখনো চাই নি রুমাইসা এতিম হয়ে যাক বাবা। কিন্তু তোমরা সকলে মিলে মেয়েটাকে এতিম করে দিলে।”

“দুলাভাইর মৃত্যুর জন্য কি তুই আমাকে দায়ী করছিস।”

“তুমি কি মনে করো আমি কিছুই জানি না বাবা?”

“তুই কি জানিস।”

“তা আর বলার আবশ্যকতা নেই। আমি সব সময় চেয়েছি রুমাইসা ভালো থাকুক।”

“তাই যদি চাও তবে বিদেশে বউ রেখে এখানে আবার বিয়ে করতে এসেছিলে কেনো।”

“বাবা এটা তুমিও জানো আমি কেনো ওইদেশে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম কিন্তু আমি চাইনি রুমাইসাকে ঠকাতে। কি করে ঠকাতাম আমি ওকে বড্ড বেশি ভালোবেসেছিলাম।”

“তুই বলছিস তুই মেয়েটাকে ঠকাতে চাস নি, তবে সত্য গোপন রেখে বিয়ে করতে গেলি কেনো।”

“সেটা তো তুমি আর ওই মহিলাও চেয়েছিলে।”

“বাহ, এখন সব আমার দোষ হয়ে গেলো?”

” আমি না হয় বিয়ে করতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম কিন্তু তোমরাও তো বাঁধা দাওনি বরং রুমাইসা চলে যাওয়ায় রিমার মতো ছোট্ট মেয়েটাকে আমার স্ত্রী করার জন্য বেছে নিলে।”

“বিয়ে তো আর হয় নি তাহলে এসব কথা আর কেনো বলছো।”

“বাবা আমি রুমাইসাকে এখনো ভালোবাসি। আমি হয় তো আর তাকে পাবো না কিন্তু আমি চাই সে ভালো থাকুক।”

“তাতে আমার কি করার ছিলো।”

“কিছু করার ছিলো না বলছো?”

এবার আজমল সাহেব কিছুটা নীরব হয়ে গেলেন। তিনি জানেন তার আর নিলুফার বেগমের অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পেরেই করিম সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এতটা যন্ত্রণা আর অপমান ঘৃণা লজ্জা সহ্য করতে পারেন নি বলেই হয় তো দ্বিতীয়বারের মতো হার্ট এট্যাক করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

“বাবা!”
শেহওয়ারের ডাকে ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলেন আজমল সাহেব। নিজেকে কেনো জানি আজ বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছে তার। ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু কেনো? এমনতো আর হয় নি কখনো যখন ওই দেশেও তিনি,,,।

“রুমাইসা কোথায় আছে জানিস তুই?”

“স্মরণের বাড়িতেই আছে।”

“জানে ব্যাপারটা?”

“রমিজ পিয়ন হয় তো অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।”

“এতটা সিউর হচ্ছিস কি করে তুই?”

“বাবা তুমি কি ভাবছো আমি জানি না রুমাইসা কার উপর ভরসা করে নিজের বাড়ি, গ্রাম আর বাবাকে ছেড়ে গেছে।”

“যদি সবই জানিস তবে যেতে আটকালি না কেনো?”

“যখন জেনেছি তখন আর আটকানোর সময় ছিলো না, আর তাই ইচ্ছা হয় নি তাকে খুঁজতে।”

“কেনো বল তো?”

“কারণটা তুমি জানো বাবা।”

“এতটা ভরসা করো আজও?”

“ভরসা না করার মতো কোনো কাজ আজ অবধি স্মরণ করে নি বাবা, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবার পেছনে আমি দায়ী ছিলাম স্মরণ নয়।”

“রুমাইসা আসবে বলছো?”

“স্মরণ তাকে নিয়ে আসবে জানি।”

বলে শেহওয়ার আর আজমল আহমেদ উভয় নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। শেহওয়ার মনে মনে ঠিক করলো রুমাইসা এলে কোনো ভাবেই তার সামনে নিজের মুখ দেখাবে না এমনকি সামনেও পড়বে না তবে স্মরণের সাথে কিছু বুঝাপড়া তার বাকি আছে যেগুলো না হলে সারাজীবন সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।

(৫৭)

ট্রেনের একটা কামরার মুখোমুখি দুটো সিটে বসে আছে স্মরণ এবং রুমাইসা। বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনার পর থেকে সে একেবারেই চুপ হয়ে গেছে। আস্ত একটা জীবন্ত মূর্তির মতো স্থির হয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। এক ফোটঁ জল নেই তার চোখের কোণে। স্মরণ রুমাইসার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো। এই মুহূর্তে রুমাইসার ভেতর যে ঝড় বয়ে চলেছে তা যে তাকে কতটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না স্মরণের। বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে মেয়েটার যতটা কেঁদে বাসিয়ে দেয়া উচিত ছিলো তার কিছুই সে করছে না বরং পাথর হয়ে বসে আছে। মেয়েটা যে কি করে নিজেকে এতটা স্থির রেখেছে তা ভেবেই স্মরণ ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়লো।

“মিস রুমাইসা আপনি কিছু খাবেন?”

“উঁহু।”

“পানি?”

রুমাইসা এবার আর জবাব দিলো না। স্মরণ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ছিপি খুলে রুমাইসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“নিন একটু পানি খেয়ে নিন। আপনাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে খুব।”

হাত বাড়িয়ে স্মরণের হাত থেকে বোতল নিয়ে ডক ডক করে পুরোটা পানি শেষ করে নিলো রুমাইসা। তার ভেতরটা ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে যাচ্ছে অথচ চোখ থেকে এক ফোঁটা জল বেড়িয়ে আসছে না। আজ থেকে তো সে পুরোপুরি অনাথ হয়ে গেলো তাও কেনো তার চোখে এতটুকু জল নেই? ভাবতে ভাবতে রুমাইসা স্মরণের দিকে তাকালো। জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে স্মরণ। বাতাসে তার সামনের চুল গুলো অনবরত কপাল ছুয়ে যাচ্ছে। রুমাইসা সেদিকে লক্ষ্য করে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

“আর কত দূর? বাবাকে দেখতে পাবো তো।”

স্মরণ দৃষ্টি ফিরিয়ে রুমাইসার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভয় হচ্ছে খুব?”

“বাবার নিথর দেহটা আমি কি করে নিজের চোখে দেখবো?”

“নিজেকে শক্ত করুন।”

“শক্তই তো আছি দেখছেন না একটুও কাঁদছি না। পাকাপাকিভাবে অনাথ হয়ে গেলাম দেখুন কই তবুও তো চোখ দিয়ে জল পড়ছে না।”

রুমাইসার রাশভারী গলায় কথাটা শুনে স্মরণের বুকের ভেতটা কেমন চিনচিন করে উঠলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো উঠে তার পাশে গিয়ে বসতে, হাতে হাত রেখে বলতে,

“আমি আছি তোমার পাশে। কথা দিচ্ছি কখনো কষ্ট পেতে দিবো না।”
কিন্তু না স্মরণ তা বলতে পারলো না। নিজের কঠিন আবরণের বাহিরে বেরিয়ে এসে এতটা কোমল সে হতে পারলো না।

চলবে,,,