#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_৩০(অন্তিম পর্ব)
(৭০)
হেমন্তের শুরু। ভোরের আলো ফুটেছে সবে। চারপাশে প্রহেলিকার মৃদু আবরণ। হেমন্তের হিমেল হাওয়া বইছে চারদিকে। ট্রেন থেকে নেমে রুমাইসা পুরো স্টেশনে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। স্টেশনটা এখন আর আগের মতো নেই। অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। দীর্ঘ সাত বছর পর আজ প্রথম সে গ্রামে এসেছে। নিজের পরিচিত সব যেনো সাত বছরে অপরিচিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য উঠবে না ই বা কেনো। সাতটা বছর তো আর কম সময় নয়। সে নিজেও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সাত বছর আগে যখন গ্রাম ছেড়েছিল তখন সে ষোলো বছরের কিশোরী ছিলো আর আজ সে তেইশ বছরের যুবতী। সময় আর বয়স এই দুটো কারো জন্য বসে থাকে না, তারা একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। এই দুটি বস্তু তাদের নিজেদের সাথে চারপাশে পরিবেশ, অবস্থানেরো পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। রুমাইসা নিজের দিকে যৎসামান্য দেখলো আর ঠোঁটে কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটালো। সত্যি সময় আর বয়স কত দ্রুত বয়ে যায়। সময় যেমন তার আপন পরিচিত ঠিকানাকে অপরিচিত করে তুলেছে বয়সও তেমনি তাকে কিশোরী থেকে যুবতীতে পরিণত করেছে।
ভোর হওয়ায় স্টেশনে খুব একটা মানুষের আনাগোনা নেই। হাতেগোনা কয়েকজন। তাদের বেশিরভাগই অপরিচিত মুখ। রুমাইসা জায়গা থেকে কয়েক পা এগিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে দেখলো। সত্যিই স্টেশনটা আর আগের মতো নেই। স্টেশনে এখন বিরাট বড় দালান উঠেছে। জায়গায় জায়গায় ল্যাম্পপোস্টেরো অভাব নেই। ভোর হওয়ার কারণে এখনো সেগুলো জ্বলছে। রুমাইসা পুরো স্টেশনটা একবার চম্পট দিয়ে ফিরে এলো।
“শেষ হয়েছে তবে?”
স্মরণ বাহুতে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ রুমাইসার কর্মকাণ্ড দেখছিলো। ফিরে আসতেই সে কথাটা জিজ্ঞেস করলো। রুমাইসা প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
“সব কিছু কেমন অপরিচিত হয়ে গেলো তাই না।”
“তা তো হয়েছে। এবার চলুন যাওয়া যাক। স্টেশনের বাহিরে রমিজ সাহেব অপেক্ষা করছেন।”
“উনি আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে এতটা পথ আসতে গেলেন কেনো? কতবারই তো মানা করেছি।”
“আপনি আছেন তো ডাক্তার সাহেবা চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলবেন।”
স্মরণের কথায় ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করলো রুমাইসা। এক পলক স্মরণের দিকে তাকিয়ে চলতে শুরু করলো। তার দীর্ঘ সাত বছরের পথচলায় স্মরণ এক মুহূর্তের জন্য তার সঙ্গ ছাড়ে নি। প্রতিটা ক্ষণ প্রতিটা মুহূর্ত তাকে তাকে আগলে রেখেছে সকল বাধা প্রতিকূল অবস্থা থেকে। এই সাত বছরে নিজের অজান্তেই রুমাইসা একটু একটু করে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
স্টেশনের বাহিরে এসে তারা রমিজকে দেখতে পেলো। ভুঁড়িওয়ালা মোটা বেঁটেখাটো রমিজ যেনো সাত বছরে অনেক খানি শুকিয়ে গেছে। তার আগের সেই মোটা ভুঁড়িওয়ালা চেহারা এখন নেই। গায়ের চামড়াও আর আগের মতো তেলচুকচুকে নেই। গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে যদিও বয়স তেমন বেশি বাড়ে নি তবুও তাকে বয়স্ক বলে মনে হচ্ছে। রমিজের এমন দশা দেখে রুমাইসা অন্তঃকরণে কষ্ট অনুভব করলো। তার এতদূর আসার পেছনে স্মরণের পর যদি আর কারো অবদান থেকে তাকে সে হলো রমিজ। লোকটা সহজ সরল প্রকৃতির। স্মরণেকে খুব ভালোবাসে তাই হয় তো স্মরণের প্রতিটা কাজে সে সঙ্গ দিয়েছিলো।
অলকানন্দপুরের রাস্তাঘাট এখন আর আগের মতো নেই। কাঁচা রাস্তার পরিবর্তে সেখানে পিচডালা রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে গাছের ফাঁকেফাঁকে ল্যাম্পপোস্ট লাগানো হয়েছে। চারপাশে নতুন নতুন অনেক বাড়িঘর উঠেছে। আগে যে রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি চলত এখন সেখানে রিকশা চলে।
অলকানন্দপুর গ্রামের প্রায় সব কিছুর পরিবর্তন হলেও ধান খেতগুলো এখনো একি আছে। রুমাইসা বরাবরের মতো আজো খেতের আইল ধরে হাঁটছে। বাতাসে বিন্নি ধানের মাধকতাময় গন্ধ। রুমাইসা চোখ বুজে বরাবরের মতো এইবারো নাক টেনে গন্ধ নিলো। মনে পড়ে গেলো সেই পড়ন্ত বিকেলের কথা খালি পায়ে ঘাসে পা দিয়ে এই খেতের আইল ধরে কত হেঁটেছে সে। বাতাসে বিন্নি ধানের সুবাস আর শিউলির মাধকতাময় সুঘ্রাণ। আবেশে কতবার চোখ বুঝেছিল সে।
রুমাইসা আগে আগে আর স্মরণ পেছনে হাঁটছে। দুহাতে সে রুমাল চেপে ধরেছে নাকে। ধানের গন্ধটা রুমাইসার পছন্দের হলেও স্মরণ সেটা মোটেই পছন্দ করে না। রুমাইসা চলতে চলতে স্মরণের দিকে ঘুরে দেখলো। স্মরণ তখনো রুমালে নাক চেপে ধরে আছে।
“ধানের গন্ধটা আপনার সত্যিই ভালো লাগে না? আমার কিন্তু বেশ লাগে। কেমন যেনো আপন আপন মনে হয় এই গন্ধটাকে।”
স্মরণ রুমাইসার কথার জবাব দিলো না। কারণ ভোর বেলায় বাতাসের সাথে গন্ধটা তীব্র হয়ে লাগছে। যা তার কাছে বিরক্তিকর বলে ঠেকছে।
“জানেন এই ধানের গন্ধটা আমার কতটা প্রিয়? ঠিক শিউলির ফুলের সুবাস যতটা আপনার কাছে প্রিয়। জানেন তো ধানের গন্ধে আমি মা মা গন্ধ পাই। আমার মায়ের গায়ে ঠিক এই গন্ধটাই পেতাম ছোট বেলায়।”
স্মরণ এবারো কোনো কথা বলল না। চুপচাপ রুমাইসার প্রতিটা কথা শ্রাবণ করলো। রুমাইসার পাশে থাকতে থাকতে অনেক অপ্রিয় জিনিসও আজকাল তার প্রিয় হয়ে উঠেছে শুধু এই ধানের গন্ধটা ছাড়া। হয় তো এটাই প্রকৃতির নিয়ম ভালোবাসার মানুষটার পাশে থাকতে থাকতে তার পছন্দের জিনিস গুলো একসময় নিজের পছন্দ হয়ে উঠে।
(৭১)
শ্মশানঘাটের কাছাকাছি এসে থামলো স্মরণ। আর মিনিট দুইয়েকের পথ তারপরই রুমাইসাদের বাড়ি। স্মরণের ইচ্ছা হলো না যেতে তাই সে রুমাইসাকে থামিয়ে বলল,
“মিস রুমাইসা বাড়িতে আপনি একাই যান। আমি যাচ্ছি না।”
রুমাইসা কিছুটা অবাক হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রুকুঞ্চিত করে বলল,
“আপনি যাবেন না? তবে এতটা পথ এলেন যে?”
“আপনাকে একা ছাড়ার ইচ্ছে হয় নি। আর তো মাত্র মিনিট দুইয়েকের পথ। তারপরই তো আপনার বাড়ি। এতবছর পর গ্রামে ফিরে এলেন। সবাই হয় তো আপনার জন্য অপেক্ষা করবে।”
“কাউকে খবর দিয়ে তো আসি নি।”
“তাতে কি। আপনি যান আমি নিশ্চিন্দপুর যাবো একবার। কাজ আছে সেখানে তাছাড়া রাতে তো দেখা হচ্ছে মেডিকেল ক্যাম্পে।”
রুমাইসা আর কিছু বলল না। স্মরণের মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে দেখলো। এই মানুষটার সাথে এতগুলো বছর কাটিয়েও সে তাকে বুঝে উঠতে পারে নি। একটা মানুষ নিজেকে কি করে এতটা আড়াল করে রাখতে পারে? আচ্ছা এই এতগুলো বছরেও কি স্মরণ তার ভালোবাসাটা বুঝতে পারে নি? একবারের জন্যও কি বুঝে নি।
“আচ্ছা ভালোবাসা কি সবসময় বলে বুঝাতে হয়। আপনি কেনো এত বছরেও আমার ভালোবাসা বুঝতে শিখলেন না। সেদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি আপনার কাছে এমনি এমনি ছুটে আসি নি। শুধু শেহওয়ার ভাইকে বিয়ে করবো না এটাই একমাত্র কারণ ছিলো না। আমি আপনাকে বড্ড বেশি ভালোবেসেছিলাম হয় তো তখন বুঝিনি। ভালোবাসি বলেই হয় তো সেদিন আপনার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। বারবার ফিরিয়ে দেয়ার সত্যেও আমি আপনার কাছেই ঘুরেফিরে গেছি।”
মনে মনে কথাগুলো নাড়াচাড়া ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়লো রুমাইসা। ব্যথিত নয়নে স্মরণকে বিদায় দিতে গিয়ে এক ফোট জল তার চোখের কার্ণিশে এসে জমা হলো। স্মরণ রুমাইসার ব্যথিত চোখের ভাষা পড়তে ভুল করলো না। সে জানে রুমাইসা মনে মনে ঠিক কি বলতে চাইছে। রুমাইসার ভালোবাসার গভীরতা সে প্রতিনিয়ত অনুভব করেছে। তাই তো সে বার বার ফিরিয়ে দিতে চেয়েও পারে নি। হাত ধরে নিশ্চিন্দপুর ছেড়েছিল রাতে আধারে।
বাড়ির উঠানে পা রাখতে রুমাইসা ছয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেলো। মেয়েটা উঠানে ছুটাছুটি করে ফড়িং ধরতে ব্যস্ত। রুমাইসাকে দেখে সে ছুটোছুটি থামিয়ে দিলো। গভীর দৃষ্টিতে রুমাইসার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে যেনো কিছু বুঝার চেষ্টা করলো। রুমাইসা হাত দিয়ে ইশারা করতে মেয়েটা তার দিকে এগিয়ে এসে গভীর ভাবে পরখ করে শেষে জিজ্ঞেস করে বলল,
“আপনে কে?”
রুমাইসা লক্ষ্য করলো মেয়েটার মুখের আদল পুরোপুরি রিমার মতো দেখতে। ছোটবেলায় রিমা যেমন দেখতে ছিলো ঠিক তেমনই।
“আপনে কে কইলেন না তো?”
মেয়েটার কথায় রুমাইসা এবার মিষ্টি হাসলো। তারপর বলল,
“আমি এবাড়ির মেয়ে। তোমার মা কোথায়?”
“নানীর কাছে। নানীর মেলা অসুখ খাইতে পারেন না, চলতে পারেন না। খালি সারাদিন কান্দে তাই তো মামা কাইল আমাদের খবর দিয়া নিয়া আইছে।”
“তোমার নানীকে আমি দেখতে পারবো?”
মেয়েটা কিছুটা ভাবুক হয়ে রুমাইসাকে দেখলো তারপর আবার জিজ্ঞাস করলো,
“আপনে কি ডাক্তার?”
“হু। কেনো?”
“নানীর অসুখ সারাইতে পারবেন?”
“চেষ্টা করে দেখতে পারি। তুমি আমায় নিয়ে যাবে নানীর কাছে।”
মেয়েটা সম্মতি জানিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এলো। সঙ্গে করে রিমাকে টেনে নিয়ে এলো কে এসেছে দেখাতে। বাড়ির উঠানে রুমাইসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিমা হতবুদ্ধ হয়ে রইলো। সে যেনো এমনটা আশা করে নি। কয়েক মুহূর্তের জন্য রিমা যেনো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নিজের আপাকে এভাবে আর কোনো দিন দেখতে পাবে যেনো বিশ্বাসই করতে পারছিলো। রিমাকে দেখে রুমাইসা ঠোঁট দুটো প্রসারিত করলো। তার ছোট্ট বোনটা কত বড় হয়ে গেছে। শুধু বড়ই হয় নি দুটো বাচ্চার মাও হয়েছে সে।
রুমাইসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো রিমা। সে যেনো নিজের দুচোখ কে বিশ্বাস করাতে পারছে না। সেই কত বছর আগে তাদের দেখা হয়েছিলো তখন রিমা মাত্র ক্লাস এইটে পড়তো আর আজ সে দুই বাচ্চার মা। রিমাকে কাঁদতে দেখে রুমাইসা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে দিল। বলল,
“কাঁদিছিস কেনো রিমা? এভাবে কাঁদতে হয় নাকি পাগলি, এখনো আগের মতোই আছিস একটুতেই কেঁদে ভাসিয়ে দিস।”
রিমা দুই হাতে বাচ্চাদের মতো চোখ মুছলো তারপর আবার রুমাইসাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কত দিন পর এলে আপা। আমাদের কথা কি তোমার মনে পড়ে না?”
এ প্রশ্নের কোনো জবাব করলো না রুমাইসা। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল,
“মা কেমন আছেন। শুনেছি অসুখ খুব।”
“আম্মা ভালো নাই আপা। কি অসুখ হইলো কেউ ধরতে পারে না। শরীরের এক অংশ অচল, কথাও ঠিক করে কইতে পারে না শুধু কান্দে।”
“ডাক্তার দেখাস নি?”
“দেখাইছি। ডাক্তার কিছুই ধরতে পারে না। তোমাদের জামাই আর সমীর নিশ্চিন্দপুর মেডিকেল ক্যাম্পে গেছে। ওখান থেকে ডাক্তার আইনা আম্মার চিকিৎসা করামু ভাবছি।”
“চল মাকে একবার দেখে আসি।”
করিম সাহেবের ঘরে চৌকিতে শুয়ে আছে নিলুফার বেগম। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়েছেন বছর দুই আগে। ডান হাত ছাড়া শরীরের কোনো অংশই নাড়াতে পারেন না। আগে একটু আধটু উঠে দাঁড়াতে পারতেন গত একবছর ধরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। রিমা সবসময় এখানে থাকে না মাঝে মাঝে এসে কিছু দিন থেকে যায়। শ্বাশুড় বাড়িতে তার নিজেরও একটা সংসার রয়েছে সেসব ছেড়ে সে এখানে খুব একটা বেশি থাকতে পারে না। সমীরই নিলুফারের দেখাশোনা করে।
নিলুফারের ঘরে পা রাখতেই রুনাইসার ভেতর টা ধক করে উঠলো। আজ কত বছর পর সে ঘরটাতে পা রেখেছে। বাবা মারা যাবার পর থেকে এই ঘরে কেউ একটা থাকতো না। নিলুফার বেগম নিজের ঘর বদলে নিয়েছিলেন কিন্তু শেষ অবস্থায় এসে তিনি নিজের স্বামীর ঘরটাতেই আশ্রয় নিলেন।
নিলুফারের মাথার কাছে বসে রুমাইসা তার গালের একপাশ টায় হাত রাখলো। কারো নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে ধীরেধীরে চোখ মেলে তাকালেন নিলুফার। রুমাইসার চেহারাটা তার চোখে দৃশ্যমান হতেই তিনি মুখ দিয়ে কুইকুই করে শব্দ তুললেন কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। রুমাইসা লক্ষ্য করল নিলুফার তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝরছে নিলুফারের। এই চোখদুটিতে এখন আর আগের মত রুমাইসার জন্য রাগ কিংবা ঘৃণা নেই। শুধু অনুশোচনার দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে দেখছেন রুমাইসাকে।
“মা শরীর খুব খারাপ লাগছে? খুব কষ্ট হচ্ছে?”
নিলুফার প্রতিউত্তরে কিছু বলতে পারলো না শুধু নীরবে চোখের জল ফেললো।
“কিছু খেতে ইচ্ছা করছে তোমার? খেতে চাও কিছু।”
নিলুফার এবারো কিছু বলতে পারলো না। কুইকুই করে মুখে শব্দ করলো।
“আম্মা কিছু কইবার পারে না আপা। শুধু কান্দে। তুমি আমার লগে বেশিক্ষণ বইসা থাইকো না। আম্মা নিজের ভুল বুঝতে পারছে সেটাই তোমারে কইতে চায়। তুমি উইঠা আসো আম্মা তোমার লাইগা কিছু জিনিস রাখছে। কইছে তুমি কোনো দিন ফিরা আইলে দিতে।”
রুমাইসা নিলুফারের পাশ থেকে উঠে এসে রিমার সামনে দাঁড়াল। তার বুকটা কেমন ভার হয়ে উঠেছে। নিলুফারের এমন অবস্থা হবে সে ভাবতে পারে নি।
রিমার সাথে ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে এসে বসলো রুমাইসা। কতদিন পর সে নিজের চির চেনা আপন নীড়টিতে ফিরেছে। কত স্মৃতি আর শৈশব কেঁটেছে এই ঘরটিতে। কাঁধে থাকা ব্যাগটা বিছানার একপাশে রেখে জানাক কাছে এসে দাঁড়াল সে। জানাল বাহিরে মায়ের হাতে লাগানো সেই শিউলি গাছটা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছটা। তার চিরচেনা শিউলিতলা ঝড়ে পড়া শিউলিতে ভরে আছে। বাতাসের সাথে শিউলির মৃদু সুবাস তার নাকে এসে ঠেকছে।
“আপা!”
রিমার ডাকে জানাল কাছ থেকে সরে এসে বিছানার একপাশে বসে রুমাইসা। একটা বাক্স হাতে করে রিমা ঘরে ডুকে রুমাইসার কাছে এসে বসে। রিমার হাতের বাক্সটা রুমাইসার পরিচিত তাই সে কোনো ভণিতা না করে জিজ্ঞাস করল,
“এটা কেনো?”
“আম্মা তোমারে দিতে কইছে।”
“আমার এসব লাগবে না রিমা এগুলো তুই রেখে দে।”
“আম্মা কইছে বড় আম্মা এগুলা তোমার বিয়ার জন্য রাইখা গেছিলেন। তাই তুমি ফিরা আইলে যাতে তোমারে এইগুলা ফিরাই দেই।”
রুমাইসার ইচ্ছা হলো বাক্সের জিনিস গুলো ছুঁয়ে দেখতে। যদিও গয়নাগুলো তার মায়ের তারপরো তার আগ্রহ হলো না গয়নার বাক্সটা খুলতে। গয়নাগুলো অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী। রুমাইসা বাক্স না খুলেই সেটা রিমার হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো আমার মায়ের গয়না। তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন আর আজ আমি সেগুলো তোকে দিলাম। বড় বোন হিসেবে তোর বিয়েতে তো কিছু দিতে পারি নি তাই এই গয়না গুলো তোকে আমি উপহার হিসেবে দিলাম।”
সন্ধ্যের পর রুমাইসা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির বাহিরে এসে দাঁড়াল। রিমা সমীর এবং রিমার স্বামী তাকে এগিয়ে দিতে গেইটে কাছ অবধি এসেছে। নিশ্চিন্দপুর মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছে রুমাইসা। প্রতিবারের মতো এবারো শহরের বড় বড় ডাক্তারদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আর তাদের মাঝে রুমাইসাও একজন।
বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমাইসা এবং সমীর রাস্তায় উঠলো। রুমাইসাকে পৌঁছে দিতে সমীরও নিশ্চিন্দপুর যাচ্ছে।
বড় রাস্তায় উঠে সমীর একটা রিকশা ডেকে এনেছে আর তাতে চেপে রুমাইসা আর সমীর মেডিকেল ক্যাম্পে যাবে। রুমাইসা বার বার সমীরকে তার সাথে যেতে বারণ করেছে কিন্তু সমীর কিছুতেই কথা শুনলো না এই ভর সন্ধ্যেবেলায় সে কিছুতে তার আপাকে এত দূর পর্যন্ত একা যেতে দিবে না।
(৭২)
চেয়ারম্যান বাড়ির পদ্মপুকুর ঘাটে একা একা বসে আছে স্মরণ। এখানে বসে আজ থেকে আট বছর আগে রমিজের সাথে কত গল্প করেছে সে। শেষবার যখন সে এই পদ্মপুকুরের ঘাটে এসে বসেছিলো সেরাতে রুমাইসার গায়ে হলুদ ছিলো। পুকুরের শান্ত জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখে মনে মনে কত কল্পনা জল্পনা এঁকেছিল সে। কত উদ্ভট প্রশ্নই না করেছিল রমিজকে। এসব মনে করে কিঞ্চিৎ হাসলো স্মরণ। রমিজ আজ পাশে নেই। সকালে একবার এসেছিলো। বেশ কিছুদিন যাবত তার শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না তাই এত দূর অবধি আর আজ আসে নি সে। অবশ্য রমিজকে চেক আপ করে কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে স্মরণ। নিয়মিত অষুধ খেলে আর একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আকাশে একফালি চাঁদ ঝুলছে। মৃদু কুয়াশা আর শিউলির মাধকতাময় সুবাস পদ্মপুকুরের চারপাশ ভরিয়ে তুলেছে। মৃদু সমীরণ বইছে চারদিকে। পুকুরের শেষ সিঁড়িতে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে সিগেরেট ধরিয়ে তাতে টান দিলো স্মরণ। আবছা আলো আবছা আধারে শিউলির মাতানো সুবাস চোখ বুজে অনুভব করতে বেশ লাগছে তার। মাঝে মাঝে সিগেরেটে টান দিয়ে সে বাতাসে দোয়া ছেড়ে দেয়। এতেও একরকম সুখানুভব করে স্মরণ। আজ অনেকদিন বাদে সে সিগেরেট পান করছে। কেনো করছে তার কারণ অজানা। বুকের বা পাশটা আজ এতদিন বাদে হঠাৎ খালি খালি লাগছে। কারো শূন্যতা খুব পোড়াচ্ছে তাকে। চোখ বুঝলেই রুমাইসার মুখখানি তার চোখে ভেসে উঠছে।
হঠাৎ কারো পদধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠছে। স্মরণের চোখ বুজেই সে পদধ্বনির শব্দ চেনার চেষ্টা করলো। পদধ্বনি শব্দ যত এগিয়ে আসছে স্মরণ ততোই রুমাইসার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে। পদধ্বনিটা পুকুরের একেবারে উপরের সিঁড়িতে এসে থামলো। স্মরণ চোখ না খুলেই বলল,
“ডাক্তার সাহেবা যে এত রাতে এখানে?”
“আপনি সিগেরেট খাচ্ছেন?”
“অনেকদিন বাদে খাচ্ছি। সিগেরেটের বড্ড নেশা পেয়েছে বুঝলেন তো।”
“প্রতিদিন না খেলে শুনেছি নেশা হয় না।”
“সব থিওরি কি সব সময় সব জায়গায় কাজে লাগে মিস রুমাইসা?”
“আপনার কি হয়েছে বলুন তো।”
“সে সব ছাড়ুন। মেডিকেল ক্যাম্পের প্রথম দিন কেমন কাটালেন বলুন।”
রুমাইসা কয়েকটা সিঁড়ি পেড়িয়ে স্মরণ এক সিঁড়ি উপরে এসে দাঁড়াল। স্মরণ রুমাইসাকে এবার খুব কাছ থেকে অনুভব করলো কিন্তু চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে হলো না। তাই চোখ বুজেই বলল,
“এতটা কাছে আসবেন না ডাক্তার সাহেবা যতটা কাছে এলে অপর মানুষটার হৃদ স্পন্দ বেড়ে যায়।”
স্মরণের কথার জবাব তৎক্ষণাৎ দিতে পারলো না রুমাইসা। স্মরণ তো আর জানে না সে আশেপাশে থাকলে রুমাইসার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে থাকে। বুকের ভেতটা কেমন ধুকধুক করে। এক অন্যরকম শিহরণ তার শরীর মন ছুঁয়ে থাকে।
“আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো আমার।”
“তার আর প্রয়োজন নেই। আমি জানি আপনি কি বলতে এখানে এসেছেন।”
“ভালোবাসেন আমায়?”
রুমাইসা ব্যথিত হৃদয় নিয়ে বলল কথাটা। স্মরণ এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আবছায়া রুমাইসার মুখটা লক্ষ্য করে বলল,
“ভালোবাসা এক কঠিন বস্তু, প্রকাশেই যার সমাপ্তি ঘটে। অঘোষিত কিছু প্রেম গোপনেই সুন্দর। আত্না প্রকাশ ঘটলেও তার মৃত্যু হয়।”
“এই যে কিছুক্ষণ আগে বললেন সব থিওরি সব সময় সব জায়গায় মানায় না। ওটার মতো এটাও কিছুটা বেমানান বলে মনে হয় না আপনার?”
“ভালোবাসা বলতে সত্যিই কিছু হয় জগতে মিস রুমাইসা।”
“চাইলেই হয়। আপনি কি পারেন না আপনার ডাক্তার সাহেবাকে নিজের করে নিতে?”
“বড্ড ভয় হয় মিস রুমাইসা। সবার জন্য তো ভালোবাসার সজ্ঞা এক হয় না তাই।”
“আমাদের মাঝে তো আর কোনো বাঁধা নেই তবে কেনো আপনি আমাকে নিজের বলে মনে করতে পারছেন না।”
স্মরণ প্রশস্ত নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর বাহুতে দুহাত গুঁজে রুমাইসার একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। রুমাইসা স্মরণের প্রতিটা নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে। তার ভেতরে অজানা শিহরণ বয়ে চলেছে। ভালোবাসার মানুষটার শ্বাসপ্রশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে তার শরীরে। মহূর্তে সে কেঁপে উঠলো। স্মরণ বুঝতে পারল কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু রুমাইসার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“তবে চলুন দুজন নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করি, যেখানে আছে দীর্ঘ প্রতিক্ষার প্রহর শেষে প্রেমের মধুমাস।”
সমাপ্ত