সমান্তরাল
রুচিরা সুইটি
শ্বশুরবাড়িতে আজকে আমার প্রথম দিন। কাউকে সেরকম ভাবে চিনি না, নতুন বাড়ি, নতুন জায়গা, অপরিচিত পরিবেশে খুব একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার। সত্যি কথা যদি বলি, ভালোই লাগছে আমার । সারা বাড়ি জুড়ে মেঝেতে বিছানা পাতা, সারা ঘরময় পোলাউ রোস্ট, ফুল, পারফিউম সবকিছুর গন্ধ মিলে মিশে যাচ্ছে। অনেক রাত পর্যন্ত সবাই জেগে ছিল তাই খুব মুরব্বি কিছু লোকজন ছাড়া সবাই মরার মতো ঘুমাচ্ছে। সকালের আলো ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। খুব ইচ্ছা করছে একটু চা খেতে। কিন্তু কারো কাছে চাইবো নাকি নিজেই বানাবো, বানালে কয়জনের জন্য বানাবো, নতুন বৌ একা একা নিজের জন্য চা বানিয়ে খাচ্ছে বিষয়টা আবার কে কিভাবে নিবে বুঝতে পারছি না। রান্নাঘরটা কোনদিকে হতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতে সামনে এসেই কারো গলা শুনতে পেলাম। কেউ কাউকে চাপা গলায় ধমকাচ্ছে, বিয়ে বাড়িতে কতো কিছু হতে পারে, এতো মানুষের মধ্যে ধমক ধামক তো চলবেই। কোথা থেকে কথাটা আসছে সেটা খুঁজে সামনে এগুতেই চা এর সুন্দর গন্ধ পেলাম…তার মানে অলরেডি চা বানানো হচ্ছে, আরো শান্তি লাগলো । রান্নাঘরে বেশ কয়েকজন মানুষ আছে, রান্নাঘরটা তুলনামূলক ভাবে বেশ বড়, ঘরের এককোনাতে মাঝারি আকারের একটা ডাইনিং টেবিল, সেখানে একটা চেয়ারে পান্জাবি পড়া একজন লোক, মনে হচ্ছে উনি আমার শ্বশুর, উনাকেই আমার শাশুড়ি চাপা গলায় ধমকাচ্ছেন।একরকম চটজলদি বিয়ে হওয়ার কারণে গতকাল অনেক আত্মীয়স্বজন ই আসতে পারেননি, কেউ সকালে আবার কেউ অনেক রাতে এসে পৌঁছেছেন। তাই আমি অনেককেই চিনিনা এখনও পর্যন্ত। তবে যে ভদ্রলোক বসে আছেন উনাকে দূর থেকে দেখেছি গতকাল। ছেলের বাবা হলে ও উনি একটু দূরে দূরেই ছিলেন বিয়েতে। রাতেও দেখিনি উনাকে। একটু এগিয়ে এসে দেখলাম যে ভদ্র মহিলা চাপা গলায় কথা বলছেন উনি দেখতে অবিকল আমার শাশুড়ির মতো কিন্তু উনি আমার শাশুড়ি নন। তাহলে কি আমার শাশুড়ির বোন? তাই হবে… উনি রেগে রেগে কি যেন বলছেন, আর চোখের পানি মুছছেন ওড়না দিয়ে। আর যে ভদ্রলোক বসে আছেন তিনি খুব স্বাভাবিক মুখে হাসি হাসি ভংগি করে পা দোলাচ্ছেন।রান্নাঘরে আরো দুজন ভদ্র মহিলা ও খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে কি কি যেন বলছেন কাউকে ফোন করে। আমি রান্না ঘরে যাওয়া মাত্র সবাই কেমন যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। যে ভদ্রলোক কে আমার শ্বশুর মনে হয়েছে তিনিও ঠাস করে উঠে অন্য রুমে চলে গেলেন।আমার সাথে কথা বলাতো দূরে একটু তাকিয়ে ও দেখলেন না। আর যাকে আমার খালাশাশুড়ি মনে হচ্ছে তিনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন…” মা গো, বড় আপা কে তো তিন চার ঘন্টা ধরে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না, মা..” আমি বললাম ‘কাকে? কি হয়েছে? কাকে পাচ্ছেন না?
তোমার শাশুড়ি, মা… তোমার শাশুড়ি কে পাচ্ছি না কোথাও।
একটা ছোট ছেলে, মনে হচ্ছে এই বাসায় কাজ করে, সে ছাদের উপরের দিকের সিঁড়ি দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল” আন্টি, আন্টি… বড় আন্টি ছাদের উপরের বাথরুমে বেহুশ হইয়া পইরা আছে, অনেক রক্ত বার হইসে… তাড়াতাড়ি আসেন ।” বুকের ভেতর ধক করে উঠলো আমার। আজকে শ্বশুর বাড়ি তে প্রথম দিন আমার আর আজকেই এমন ঘটনা ঘটেছে, উনি বেঁচে আছেন তো?সবাই হুড়াহুড়ি করে ছাদের দিকে ছুটলো। আমি নড়তে পারছি না, মনে হচ্ছে কেউ আমার পা টা শক্ত করে ধরে আছে।
আমার বিয়েটা একেবারেই হুট করে হয়েছে, ঢাকায় আপার বাসায় বেড়াতে এসেছি, আর এখানে এসে বিয়ে হয়ে গেল আমার। যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে আপার বাসার বাড়িওয়ালার ছেলে, নাম রাকিবুল আলম। অস্ট্রেলিয়া তে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে, দেশে এসেছে অল্প সময়ের জন্য। আপার কাছে শুনেছি রাকিব নাকি বারো বছর দেশে আসেনি রাগ করে। রাতে কেউ একজন বলছিল, “রাকিব কি ওর বাবার সাথে কথা বলেছে, দেশে ফিরে?”… তখন মনে হলো, সে কোন কারণে নিজের বাবার উপরে রেগে আছে, সেজন্যই এতো বছর দেশে আসেনি। আপাও তাই আগে কখনও দেখেনি ওকে। কেন রাগ, কার সংগে রাগ আপা দুলাভাই অবশ্য কিছুই বলতে পারে না। আসলে আপাতো কখনো কল্পনা ও করেনি যে এখানে আমার বিয়ে হবে, তাই এসব ব্যাপারে আগ্রহ থাকার কথা না। আমি মাত্র দুই দিন আগেই এখানে এসেছি। আপার থার্ড টাইম মিসক্যারেজ হয়েছে কয়েকদিন আগে। খুবই মন খারাপ আপা আর ভাইয়ার। আমার অনার্স এর ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, এখনও ভাইভা হয় নি। আপার এরকম অবস্থা তাই শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে ই ঢাকায় আপার সাথে দেখা করতে এসেছি। আমি পৌঁছে দরজা নক করছি আর ওই সময়ে বাড়িওয়ালা আন্টি অর্থাৎ আমার বর্তমান শাশুড়ি, বাটিতে কি একটা খাবার নিয়ে আপার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। একসাথেই আমি আর আন্টি ঘরে ঢুকেছি। এই অল্প সময়ের মধ্যে জানি না ভদ্রমহিলা কি বুঝলেন। একদিনের মধ্যেই সবকিছু ঠিকঠাক হলো।
রাকিবের পরিবার একদিনের মধ্যে বিয়ের কাজ শেষ করে আমাকে শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ তিনতলায় আপার বাসা থেকে দোতলায় নিয়ে চলে এসেছে।এমন নয় যে বিয়েতে আমার অমত ছিল, আমি মত দিয়েছি বলেই বিয়ে হয়েছে। বাবা না থাকলে মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ভালো বিয়ে হওয়াটা সোজা কথা নয়। বিয়ের জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম, অনেকদিন যাবৎ আমার জীবনে বলার মতো বা আনন্দ দেবার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি । একেবারে সাদামাটা জীবন, লেখাপড়া, টিউশনি, টাকা পয়সার টানাটানি, মা এর কান্নাকাটি..ছোট ভাই এর লেখাপড়া,… এর মধ্যে বিয়ে টা আমার জীবনের একটা নাটকীয় ঘটনা। মনে হচ্ছে! অনেক দিন পর জীবনে থ্রীলিং কোন ঘটনা ঘটলো। রাকিবের পরিবার বেশ স্বচ্ছল, ঢাকাতে নিজের বাড়ি আছে, রাকিব ও দেখতে মোটামুটি ভালোই বলা চলে। একটা মাত্র বোন ওর, বয়সে রাকিবের থেকে বেশ ছোট। শুধুমাত্র রাকিবের বয়সটা আমার থেকে একটু বেশি। আমার বাইশ শেষ হবে আর তার বয়স পঁয়ত্রিশ এর কাছাকাছি। জানি না কেন এতদিন বিয়ে করেনি, শুধু বাবার উপর রাগ? নাকি আরও কোন ব্যাপার আছে? কোন ছ্যাকা ট্যাকা খেয়েছিল কিনা কে জানে? আস্তে আস্তে এই পরিবারের সব ঘটনা জানবো ভেবে খুব একটা মজা লাগছিল আমার। আমার যে টাকা পয়সা নিয়ে আর কোনো টেনশন করতে হবে না সেটা ভেবেই খুব শান্তি লাগছিল। রাকিবের আম্মা গতকাল রাতে আমাকে বাড়িতে এনেই বলেছে “এই সংসার এখন তোমার মা, আমার একটু বিশ্রাম চাই, তোমাকেই কিন্তু সবকিছু দেখে রাখতে হবে।” সংসার দেখে রাখা আমার কাছে ডালভাত, সেই ছোটবেলা থেকেই তো সংসার দেখে এসেছি, এই দায়িত্ব আমার কাছে নতুন বা কঠিন কিছু নয়। এতোদিন টাকা পয়সার অভাব নিয়ে সংসার সামলিয়েছি, আর এখানে তো আর যাই হোক টাকার অভাব হবে না। তাই আমার মন বেশ ফুরফুরে হয়ে ছিল। কিন্তু সকাল সকাল কি ঘটে গেল?
কোন একটা মহিলা ছাদের দিকে যাচ্ছে আর বলছে, “আপা নিজেরে শেষ করে দিল রে, শেষ করে দিল..”… এই কথার মানে কি? আমার শাশুড়ি কি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে? আল্লাহ তুমি রহম কর, রক্ষা কর আমার শাশুড়ি কে…
চুলাতে বসানো চা টা উপচে পড়ছে.. চারপাশে একটা চা এর পোড়া গন্ধ..
চলবে…