সমান্তরাল পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
375

গল্প সমান্তরাল
শেষ পার্ট

চা এর গন্ধ টা নাকে আসতেই বুকটা এমনভাবে ধকধক করে উঠলো, এমন অদ্ভুত অনুভূতি… চোখের সামনে ফুটতে থাকা চা টা এই মুহূর্তে খেতে পারছি না বলে নাকি আমার বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত শাশুড়ির কথা ভেবে এরকম অনুভূতি হচ্ছে… জানি না। খুব কষ্ট করে নিজের শরীরটা চালিয়ে নিয়ে চুলাটা বন্ধ করলাম। আমার কি এখনই দৌড়ে ছাদে যাওয়া উচিত নাকি রাকিব কে ডেকে তোলা উচিত। ছাদের দিকে যদিও মোটামুটি অনেকেই ছুটে গেছে তবু এমন একটা খবর পেয়ে আমারও মনে হয় যাওয়া উচিত… কিন্তু রাকিব যদি ঘুম থেকে উঠে বলে, কেন আমি সাথে সাথে ওকে ঘুম থেকে তুললাম না… বাকি সবাই না হয় মা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কিন্তু আমার তো উচিত ছিল তাৎক্ষণিক রাকিব কে জাগানো… জ্ঞান হবার পর থেকেই সবাই কে সবসময় আমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে দেখেছি কিন্তু এই মুহূর্তে মাথাটা খালি খালি লাগছে .! আমি রুম থেকে বের হবার সময় দেখেছি, রাকিব নাকে মুখে কাথা মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে।
আপা কে কি ফোন করবো একটা?
মিসক্যারেজের পর থেকেই আপা অসুস্থ, ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে, গত দুইদিনে বিয়ের ঝামেলা তে শরীর টা একদম দূর্বল হয়ে গেছে আপার। গতকাল ই ভাইয়া বলছিল “আলহামদুলিল্লাহ ভালোয় ভালোয় সব মিটে গিয়েছে, এখন তুমি মোবাইল টোবাইল বন্ধ করে লম্বা ঘুম দাও..”। আপার ফোন তো নিশ্চিত ভাইয়া বন্ধ করে রেখে দিয়েছে,, সবাই এতো চেঁচামেচি করছে.. জেগে থাকলে আপা আর ভাইয়া অবশ্যই ছুটে আসবে।
রাকিব কে ডাকতে রুমে এসে দেখি সে গভীর ঘুমে জোরে জোরে নাক ডাকছে, গালের নিচে এমনভাবে হাত দিয়ে রেখেছে যে পুরা মুখ বাঁকা হয়ে আছে, ভীষণ আনস্মার্ট লাগছে দেখতে.. নতুন বউ যার ঘরে সে কি এভাবে ঘুমায়? গতকাল রাতে ও রাকিবের ব্যবহার বলা যায় আমাকে হতাশই করেছে । বাসর রাতে কি কি হতে পারে এ ব্যাপারে একটা মোটামুটি ধারণা আমার ছিল। সংসারের ঝামেলায় কোনদিনই কোন রোমান্টিক ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি। আমাদের চার রুমের বাড়িতে একটা রুম সাবলেট দিয়ে রেখেছি।বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসারে শুধুই অর্থকষ্ট.. আমি, মা আর ছোট ভাই রাশেদ… তিনজনের সংসার চলে বাবার পেনশনের টাকা আর আমার টিউশনি তে । বাবা চলে যাবার কিছুদিন পর থেকেই মা এর অল্প অল্প মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। আমার মা অসম্ভব রূপসী ছিলেন।বাবা ছিলেন সরকারি কলেজের শিক্ষক। একজন স্বামী তার স্ত্রী কে সর্বোচ্চ যতটা ভালোবাসতে পারে.. মা কে বাবা তারথেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছিলেন। বাবা আর মা এর বিয়ের পর থেকে বিশ বছরের সংসারে, কোনদিন মা কে ফেলে খাবার খান নি বাবা। একটু আধটু শরীর খারাপ যদি হতো মা এর, বাবা তখন নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন মা কে। হঠাৎ করে হার্ট এটাকে আচমকা চলে গেলেন বাবা… খাবার সামনে নিয়ে বসলেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তো মা এর। আপা তখন এইচ এস সি শেষ করে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিল, আমি ক্লাস এইটে পড়ি আর রাশেদ ক্লাস টু তে পড়ে। আমি আর রুমি আপা মা এর রূপ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। বাবার কলেজের সব কলিগরা বাসায় এসেছিল সেইসময়। কামরুল ভাই অর্থাৎ আপার হাজব্যান্ড সেইসময় নতুন জয়েন করেছিল কলেজে। আপা কে দেখে খুবই পছন্দ হয়েছিল ভাইয়ার। আমাদের ওইরকম দুঃসময়ে আপা কে বিয়ে করে ভাইয়া এই সংসারের একজন হয়ে উঠেন। বিয়ের পরে আপা পড়াশোনা শেষ করেছে। আপার বিয়ের কিছুদিন পর থেকে মা এর মানসিক সমস্যা শুরু হয়। সবসময় বাবাকে নাকি দেখতে পান মা। তখন থেকে এই সংসারের সব দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি। জীবনের অনেক রূপ দেখে দেখে বড় হয়েছি আমি। টাকার প্রয়োজন জীবনে কতটা সেটা আমার থেকে ভালো আর কে জানবে? কিছু বাড়তি টাকা পাবার জন্যই, বাসার একটা রুম কে আলাদা করে দিয়ে সেখানে একটা ছোট ফ্যামিলি যেন থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছি। সেখানে একজন হুজুর তার বউকে নিয়ে ভাড়া থাকেন। হুজুর আমাদের বাড়ির কাছাকাছি একটা মাদ্রাসা তে পড়ান। তার বউটা আমার চেয়ে সামান্য ছোট, কিন্তু দারুণ মিশুক আর চটপটে। আমার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ওর কাছে শুনেছি যে বিয়ের প্রথম রাতে হুজুর নাকি রুমে ঢুকে সালাম দিয়েছিল তাকে। তারপর দুজন মিলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ভবিষ্যতে সুখী হওয়ার জন্য অনেক দোয়া করেছে। তারপর নাকি হুজুর বলেছে “তুমি তো এখন আমার স্ত্রী, তোমাকে স্পর্শ করার জন্য অনুমতি চাইছি.. তোমার কি এতে সম্মতি আছে?” হোসনা নাকি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছে, হুজুর এর বউ এর নাম হোসনা। এরপরে হুজুর এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে… তারপর সেই কত কাহিনী। হোসনা বলে… রুবি আপা.. এইভাবে বাসর রাত সবার হয়.. সবার.. এটাই নিয়ম.. হিহিহি বলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। আমি ও এরকম কিছুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু রাকিব এতো কাটখোট্টা.. অন্য সবকিছু দূরে থাক, আমার হাত টা ও একটু ধরেনি। শুধুমাত্র দুয়েকটা নরমাল কথা … “সবকিছু এতো হঠাৎ করে হয়ে গেল.. খুব ধকল গেল, তাই না? তোমার শরীর ঠিক আছে? খারাপ লাগছে না তো?
আমি বললাম, জি না, আমি ঠিক আছি।
ঠিক আছে তাহলে, তুমি ফ্রি হয়ে নাও, যেভাবে কমফোর্ট লাগে সেভাবে ঘুমিয়ে পড়।
বলেই ঘরের একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে।
আর ওর রুমের বিছানা টা এতো বড় যে রাকিব শোবার পরে আরো চারজন শুতে পারবে সেখানে। আমার সাথে ঘুমের ঘোরেও একটু ধাক্কা লাগার সুযোগ নেই।
আমিও অবশেষে ব্যাগ থেকে কামিজ আর সালোয়ার বের করে পড়ে নিলাম। বাড়ি থেকে আসার সময় যে ব্যাগ টা এনেছিলাম সেটাই রাতে ভাইয়া উপরে দিয়ে গেছিল। তারপর ভালোই ঘুম হয়েছে আমার। বিছানা টা খুবই নরম, আমাদের বাড়িতে যে খাটে আমি থাকি সেই খাটের তোশক পুরনো হতে হতে একদম শক্ত হয়ে গেছে।
আমি রাকিবের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম, ডাকার জন্য.. এরমধ্যে ই যুথি, রাকিবের ছোট বোন.. দৌড়ে এসে খুব জোরে কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকলো। রাকিব একেবারে থতমত খেয়ে উঠে বসলো।
সবাই মিলে হাসপাতালে ছুটলাম.. বিয়ে বাড়ি.. কার যেন একটা গাড়ি নিচেই ছিল।

পাঁচ বছর পর….

আমার ছোট ভাইটা মেডিক্যাল এ চান্স পেয়েছে,। আপা আর ভাইয়া রাশেদ আর মা কে আপার বাসায় নিয়ে এসেছে। আমি অস্ট্রেলিয়া চলে আসার পর মা কে একা রাখাটা সম্ভব ছিল না। আপা আর ভাইয়া ছিল বলেই, আমি সবকিছু ছেড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়া আসতে পেরেছি। আপা অনেক রকম ট্রিটমেন্ট এর পর দুই জমজ ছেলের মা হয়েছে। আমি শুধু তাদের ছবি দেখেছি এতদিন, কিন্তু এবার বাস্তবে দেখব। হুম দেশে যাচ্ছি আমরা। আমরা মানে আমি, রাকিব, আমার শাশুড়ি, আর রাকিবের ছোট বোন। বিয়ের পরদিন কি ঘটেছিল তা আমরা কেউ এখনও পর্যন্ত পরিস্কার জানি না। হাসপাতাল থেকে আমরা আমার শাশুড়ি কে জীবিত ফেরত আনতে পেরেছিলাম ঠিক ই কিন্তু তিনি মাথায় মারাত্মক আঘাতে কথা বলার শক্তি হারিয়েছিলেন। কাউকে ভালো ভাবে চিনতে পারেন না সবসময়। মাঝে মাঝে চিনতে পারেন আবার মাঝে মাঝে একেবারে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। সত্যিই তিনি আমার হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে একসপ্তাহের মধ্যে, সবাই কে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে আসে রাকিব। আমার শাশুড়ি আর যুথির ভিসা আগেই পেয়েছিল রাকিব, শুধু আমার টা পেতে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল.. প্রথমে ট্যুরিস্ট ভিসা দিয়ে গিয়েছি তারপর কিছুদিন পর আমার ভিসা হয়েছিল.. দেশে রেখে এসেছিলাম রাকিবের বাবা কে।
অনেকটা সময় লেগে যায় আমার, এই পরিবারের সত্যের সন্ধান পেতে… বিয়ের পর তিন বছর রাকিব আমার সাথে কোন রকম শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হতে দেয়নি। নারী পুরুষের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক কে সে প্রচন্ড ঘৃণা করত।
রাকিবের বাবা কে সে আবিষ্কার করেছিল তাদের বাসায় কাজ করা চৌদ্দ বছরের কিশোরী র সাথে।
কিশোরী মেয়ে টির ভীত চেহারা কখনো ভুলতে পারে না রাকিব।
সেই মেয়েটি র গর্ভে জন্ম নেয় যুথি।
যুথিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে ই মারা যায় সেই ছোট্ট কিশোরী।
বিয়ের দশ বছর পর, আমার শাশুড়ি এই মানুষটি র কুৎসিত চেহারা ধরতে পেরেছিল। রাকিবের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাউকে কিছু জানতে দেন নি তিনি.. শুধু নিজে নিজে গুমড়ে মরেছেন। ঘৃনায় কুকড়ে মরেছেন ।
রাকিব যেদিন এই সত্যের মুখোমুখি হয়েছিল সেদিন থেকে বাবার সাথে কথা বলে নি কখনো।
আমার বিয়ের রাতেও এরকমই কিছু ঘটেছিল.. যেটা দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেন নি আমার শাশুড়ি। তবে তিনি নিজেই নিজেকে আঘাত করেছিলেন নাকি অন্য কিছু হয়েছিল সেটা জানতে পারিনি কেউ।
অনেক অনেক চেষ্টা করে রাকিবের অস্হির, অসহায়, ক্ষত বিক্ষত মনটাকে সারিয়ে তুলেছি । গত বছর ই রাকিবের বাবা মারা গিয়েছে… দেশে ফিরে আসতে আর কোনো বাঁধা নেই, রাশেদ ম্যাডিকেলে চান্স পেয়েছে, আপার জমজ ছেলে হয়েছে, এখন তো দেশে যেতেই হবে।

দুই দুঃখী মা এর দায়িত্ব আমার উপর। দুইজনই মানসিক যন্ত্রণাকে নিজের জীবনের সংগী করেছেন….

ভালোবাসা আর ধোঁকা… দুই জনের জীবনের দুইরকম প্রাপ্তি।

চলবে।