সমাপ্তিতে রুদ্ধশ্বাস পর্ব-০৩

0
2

#সমাপ্তিতে_রুদ্ধশ্বাস🦋
#মিশকা_মুন {লেখনীতে}

|৩|

০৫.
রাত তিনটা বাজে। শহর তখনো ঘুমের আস্তরণে। কেবল কুকুরের হাউমাউ ডাক কানে বাজছে। ঐশী চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলেও ঘুম আসছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। ঘড়ির কাঁটা যেন ইচ্ছে করেই ধীরে ধীরে চলছে। মাথায় শুধু অনিরুদ্ধের মুখটা ভেসে উঠছে। আকর্ষণীয় এক ব্যক্তি সে। প্রথম দেখাতেই তার কথা বলার ভাব ভঙ্গিকে তাকে আকর্ষণ করে ফেলেছে।
সে একবার ভাবছে, লোকটা কি সত্যি বিবাহিত? নাকি তাকে পিছু ছাড়াতে মিথ্যা বলল? আবার পরক্ষণেই বুকের ভেতর শিহরণ জেগে উঠছে। বিবাহিত হলেই বা কি? তার যখন একবার মনে ধরেছে মানে তাকেই চাই।

বিগত কয়েকদিন যাবত তাকে ফলো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো ভাবেই তার হদিস পাচ্ছে না। যতই কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে ততই ইগনোর করছে সে। দেখেও দেখছে না। এইতো কালকেই যেমন সে পিছু করতে করতে যাচ্ছিল।

অনুরুদ্ধ একটা ফুলের দোকানে ঢুকলো। সেখান থেকে একগুচ্ছ লাল টকটকে গোলাপ কিনে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। ঐশী প্রথমে ভয় পেলেও পরে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল। মনের মধ্যে আলাদা অনুভূতি শিহরণ বয়ে গেল। অনিরুদ্ধ তাকে ফুল দিতে আসছে? এটা কি সত্যি? নাকি তার চোখের ভ্রম। হাত দিয়ে চোখ কচলে নিলো।

অনিরুদ্ধ তার কাছে আসতেই একটা কড়া পারফিউম স্মেল তার নাকে ভেসে এলো। সে লম্বা করে শ্বাস টানতেই তাকে পাশ কাটিয়ে সে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ মেলে তাকালো।

একটা কুকুর লেজ গুটিয়ে বসে তাকে গিয়ে ফুল দিলো অনিরুদ্ধ। অতঃপর ঐশীর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এর অর্থ তার বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না। তাকে ভালোবাসার থেকে একটা কুকুরকে ভালোবাসা ভালো। এটাই বুঝালো সে?”

প্রচন্ড আত্মাসম্মানে লাগলো তার৷ রেগেমেগে তেড়ে গেল। এতোটা অপমানিত সে কখনোই হয়নি।

অনিরুদ্ধ ফুল দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“বুঝলি কুত্তা প’রকীয়া করা নারী পুরুষের থেকে তুই বড্ড বেশি লয়্যাল। তাই ফুলগুলো শুধু তোর জন্য।”

কুকুরটা বোধহয় তাকে চেনে। তার কথা শুনেই ঘেউঘেউ করা শুরু করল। সে হেসে গায়ে হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছিল।

তৎক্ষনাৎ ঐশী এসে তার হাত টেনে ধরল। এতে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলো অনিরুদ্ধ রেগে হাত ছাড়িয়ে নিলো।

“সমস্যা কি তোমার?”
“আই লাভ ইউ অনিরুদ্ধ।”
“আমি বিবাহিত আমার থেকো দূরে থাকো।”

“আরে আ…….!!”
কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না থামলো। একটু সময় নিয়ে বলল, “আমার কোনো সমস্যা নেই।”
ঘৃণা ভরা চাহনি দিয়ে চলে গেছিল সে। কিন্তু তার এতো ভালো মানুষী বউয়ের প্রতি এতো লয়্যাল, এতো ভালোবাসা দেখে তার প্রচন্ড রাগ হলো। রেগেমেগে গিয়ে কুকুর সামনে থেকে ফুলগুলো তুলে মাঝ রাস্তায় ছুড়ে মারতেই একটা গাড়ি এসে পিষিয়ে দিয়ে গেল। এতে কুকুরটা লাফিয়ে উঠল ঘেউঘেউ করতে করতে তাকে দাঁড়িয়ে ধরল।

ঐশী কোনো মতো জান বাঁচিয়ে একটা টেক্সিতে উঠে পালিয়ে এসেছিল।

রাত বাড়ছে। সাথে বাড়ছে তার জেদ। বিছানায় অবহেলা পরে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ফেসবুক সার্চ বক্সে নাম দিল“অনিরুদ্ধ।”অনেক গুলো প্রোফাইল এলেও তার ওই শীতল চোখ, তীক্ষ্ণ ভঙ্গি কোথাও নেই। হাল ছেড়ে দিলো। কিন্তু ভেতরের কৌতূহল বাড়লো বহুগুণ।

এমন সময় জানালার বাইরে শব্দ হলো। যেন কেউ ইচ্ছে করেই লোহার গেট ঠকঠক করছে। ঐশী আঁতকে উঠে পর্দা সরাল। কিছুই নেই। তবু বুকের ভেতর ঢিপঢিপ বাড়ছে। মোবাইল ক্যামেরা অন করে বাইরে তাকাল। কিন্তু না কেউ নেই সেখানে।

ফোনে লাইট অন করতে গিয়েই তার হাত কেঁপে উঠল। আলো জ্বেলে সামনে ধরতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, লোহার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা ছায়া, মাথায় হুড ঢাকা। কিন্তু একটু সামনে এগিয়ে আসতেই চেহারা দেখতে পেল।

ঐশী স্তব্ধ হয়ে যাওয়া চাহনি ও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া কমে এলো। পরক্ষণেই ফোনটা নিভে গেলো। চারিদিকে নীরবতা। গুটি গুটি পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। বেড সাইট থেকে জগ থেকে এক ক্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। অতঃপর তাড়াহুড়ো করে সার্চ করা নামটাও ফোন থেকে ডিলিট করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।

তখনই দরজা খোলার শব্দ হলো। কেউ একজন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে।

০৬.
অন্য প্রান্তে অনিরুদ্ধ তখনও জেগে। টেবিলে একটা মোটা খাতার পাতা উল্টাচ্ছিল। খাতায় নাম-তারিখ লেখা। আর প্রতিটি নামের পাশে লাল কালি দিয়ে একটা করে ঠিক চিহ্ন দেওয়া। ঠিক চিহ্ন মানে কাজ শেষ, আর ক্রস চিহ্ন মানে এখনো বাকি আর পরের টার্গেট সে । খাতায় এক এক করে কিছু নামের লিস্ট সাজানো।

পাতা উল্টাতে গিয়ে থেমে গেলো। সেখানে মোটা করে লেখা হারুন। পাশে বড়ো করে ঠিক দেওয়া। আর তার নিচে নতুন লেখা ঐশী হাওলাদার সেখানে ক্রস চিহ্ন দেওয়া হয়।

চোখে মুখে ভয়ংকর ঝলক। ঠোঁটে সামান্য বাঁকা হাসি। বিড়বিড় করে বলল,“তুমি নিজেই এগিয়ে এসেছো মেয়ে। এবার থেকে তুমিও আমার তালিকার অংশ। একেই বলে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা।

বলেই হো হো করে হেসে উঠল।

সে মুহূর্তে তার ফোন কেঁপে উঠলো। অপর প্রান্ত থেকে মেয়েলী কণ্ঠ, গম্ভীর সুরে বলল,
“ হৈমন্তী কোথায়? মিস্টার অনিরুদ্ধ। সত্যি করে বলুন!!”

“বাবার বাসায় গেছে।”
“ফোনে কেনো পাওয়া যাচ্ছে না?”
“গ্রামে হওয়ায় নেটওয়ার্ক সমস্যা সেখানে।”
“ফিরবে কবে?”
“সপ্তাহখানেক পরে।”
“ঠিক আছে। সে আসলে তাকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসবেন।”
“আচ্ছা।”

কথা শেষ হতেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শুধু নিস্তব্ধতা। কল কেটে গেছে। অনিরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুকের মধ্যে হুট করে জ্বলে উঠল। কিন্তু এতে তার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। নিজেই নিজের বুকের উপর এলোপাতাড়ি কয়েকটি ঘু’ষি বসালো। তবুও তার সেই জ্বলন কমলো না। রেগে নিজের চুল টেনে ধরে নিজেই চিৎকার করে উঠল। তারপর বিড়বিড় করে গান ধরল,

“হাসি আমার র’ক্তমাখা, চোখে শুধু ছায়া,
অন্ধকারেই খুঁজি আমি, কারো শেষের মায়া।
ছু’রির মতো শব্দ আমার, কেটে যায় হৃ’দয়,
আমায় দেখে ভয় পাবে, আমি যে খেলনা নয়।”

০৭.

ঐশী ভয়ে ভয়ে লাইট অন করে বসে আছে। নিজের মনকে বুঝাতে চাইছে এটা তো স্বপ্ন সত্যি নয়। তবুও অশান্ত মনকে শান্ত করতে ব্যর্থ হলো। শুনেছে শেষ রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, যদি এটাও সত্যি হয় তখন? তখন কি হবে??”

সে মূলত স্বপ্ন দেখেছে। একটি অন্ধকার ঘর। সে ভয়ে চিৎকার করছে। বারবার আলো জ্বালতে বলছে কাউকে কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠে। সে এদিক ওদিক দৌড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু না এই ঘরের কোনো দরজা নেই। চারপাশে দেয়াল তোলা। ভয়ে ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে এলো। হঠাৎ পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই তাকাল। একটা মাস্ক পরিহিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কে? কে আপনি?”

তৎক্ষনাৎ মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলল। তাতেই চোখ কপালে উঠার জোগাড়। সে অবিশ্বাসের নজরে তাকিয়ে বলল,

” অনিরুদ্ধ?”

অনিরুদ্ধ হাসছে। কি বিভৎস সেই হাসি। হঠাৎ হাসতে হাসতে পেছন থেকে বড়ো একটা রা’ম’দা বের করল। সে চিৎকার করে উঠার আগেই এক কো’পে সব শেষ। অতঃপর তার পিস পিস করা মাংস কুকুরকে দিয়ে খাওয়াচ্ছে।

এমনই এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছে সে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
হঠাৎ দরজার নিচ দিয়ে কার যেন ছায়া ভেসে গেল। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সাহস সঞ্চয় করে দরজা খুলতেই দেখলো, সেখানে একটা ছোট্ট খাম পড়ে আছে।

কাঁপা হাতে খামটা খুলল। ভিতরে সাদা কাগজ। তাতে রক্তের মতো লাল কালিতে লেখ,

“ বহুত উড়াউড়ি করছিস এবার তোর ডানাকা’টার পালা।”
লিখে সাইডে একটা স্মাইলি ইমোজি দেওয়া।

ঐশীর বুকের ভেতর বজ্রপাত হলো। অজান্তেই ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল, “এটা কে রাখলো? অনিরুদ্ধ?”

কাগজটা মুঠোয় চেপে ধরতেই বাইরে আবার হাউমাউ করে কুকুর কাঁদতে লাগলো। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা। ভয়ে চিৎকার দিতেই একটা পুরুষালী হাত তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কি হলো বেবি?”

#চলবে……