#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ২৭
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি
পুলিশ কাস্টার্ডিতে বসে আছে তাহরিমা।ওর সামনে বসে আছে দুইজন কড়া মহিলা কন্সটেপল।অনিলা আর জুনইদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহরিমার দিকে।সেই মহিলা লেডি যে কিনা অনিলার বাবার উপর অ্যাটাক করিয়েছিলো সে আর কেউ নয় সে তাহরিমা।দুই দিন টানা রিমান্ডে থাকার পর লোক গুলো তাহরিমার নাম বলতে বাধ্য হয়।যদিও তাহরিমা আজকে পালাতেই যাচ্ছিলো কিন্তু জুনইদ আর অনিলার জন্য পারেনি।জুনইদ এর তাহরিমার কন্ঠঃস্বর চেনা চেনা লাগছিলো।আর তাই সে বার বার রেকর্ডিং টা শুনে একটু সন্দেহ করেছিলো।পুরো পুরি সিউর হওয়ার জন্য ওঁকে ফলো করছিলো জুনইদ নিজেই।আর যখন তাহরিমা আজকে চলে যাবে বলে বাড়িতে জানাই তখন জুনইদ আরও সিউর হয়ে যায়।আর যখন সে শুনলো যে যেদিন অনিলার আর ওর উপর অ্যাটাক হয় সেদিন তাহরিমা প্রায় মাঝ রাতে বাড়ি ফেরে।জুনইদ এর এক্সিডেন্টর কথা শুনেও দেখতে যায়নি একবার ও।আজ ই হইতো তাহরিমা দেশ ছাড়তো।কিন্তু জুনইদ পুলিশ কে ফোন করে জানাই তার একজন কে সন্দেহ হয়।আর এদিকে পুলিশ ও ততক্ষণে জেনে গেছে এই কাজ তাহরিমার।তার উপর সকাল থেকেই আলিফ হোসেন কে পাওয়া যাচ্ছে না।অনিলা নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বাবার কথা ভাবতেই।
একজন মহিলা কন্সেন্টেপল তাহরিমার গাল টিপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,”বল কেন করেছিস এসব?কি উদ্দেশ্য ছিলো তোর?মুখ খোল নইলে এরপর দেখলি কথা বলার জন্য এই মুখ টাই আর রইলো না।”
তাহরিমা বাকা হাসি হাসলো।সবাই একটু অবাক হলো।আস্তে আস্তে হাসির আওয়াজ
অট্টহাসিতে রুপ নিলো।
“এই তুই হাসছিস কেন?ভয় করছে না তোর আমাকে?”
আবারও তাহরিমা গা জ্বালানো হাসি দিলো।তারপর মুখ টা এগিয়ে নিয়ে এলো মহিলাটির দিকে, ঝুকে বলে,”আপনাকে একটা সিক্রেট বলি।আমাকে এখানে জিজ্ঞাসা বাদ না করে যান গিয়ে ওই অনিলার বাবা আলিফ হোসেনের খোঁজ নিন।এতক্ষণে বোধহয় ওই বুড়োটা শেষ!”
সপাটে একটা থা’প্পড় পরলো ওমনি তাহরিমার উপর।
“একদম বাজে কথা নয় আগে বল কেন করেছিস এসব?তুই রুপালী কে চিনিস না।তোর হালাত ঠিক কি হবে ভাবতেও পারছিস।”
“আমি তো বললাম আমাকে ফো’র্স না করে যান গিয়ে এই এমেয়েটার বাবার খোঁজ নিন!হইতো এতক্ষণে লা’শ টাও টু’ক’রো টু’ক’রো করা শে’ষ!”
তাহরিমার কথা শুনে অনিলার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠেলো।অনিলা জুনইদ কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো।তার বাবার সঙ্গে এই মেয়েটার কিসের এতো শত্রুতা।যে এমন নৃশংস ভাবে কথা বলছে।দেখে মনে হচ্ছে কোনো পুরনো কিছুর জন্য এমন রিভেঞ্জ নিচ্ছে।আচ্ছা এখন তার বাবা কোথায়?সত্যিই এই মেয়েটা তার বাবাকে কিছু করেনি তো?তার বাবার সঙ্গে তার শেষ কথা টা বলা হবে তো?নিজেই নিজেকে হাজার টা প্রশ্ন করছে অনিলা।তারপর ক্ষ্যাপা কন্ঠে তাহরিমা কে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার বাবা কোথায় তাহরিমা?”
জুনইদ ও দাঁতে দাঁত চিবে বলে উঠলো,”আমার শশুড় মশাই কোথায় বলো?”
তাহরিমা তো মুখ খুলছেই না উলটে ঘর কাঁপিয়ে হাসছে।রুপালির শক্ত হাতের চড় খেয়ে ঠোঁটের একাংশ কে’টে র’ক্ত বেরিয়েছে।সেই রক্ত টুকু হাত দিয়ে মুছে নিয়ে বলে,
“পাবে না তোমরা ওঁই বু’ড়োকে জী’বিত।জীবিত অবস্থায় পাবে না।আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া শেষ।আমি এখন আমাকে নিয়ে চিন্তা করছি না।আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে!তাই আমাকে মারো কা’টো যা খুশি করো আমি টু ‘ শব্দ টিও করবো না।”
রুপালি এবার দ্বিগুন রেগে হাতের লা’ঠি টা দিয়ে তাহরিমার হাতের আঙ্গুলে উপর জো’রে আ’ঘাত করলো।তাহরিমার চিৎকার দিয়ে উঠার কথা কিন্তু শুধু একটা চাপা আর্তনাদ করলো।তবে মুখে সে বিদঘুটে হাসি চেপেই রেখেছে।ও হাসছে,যে রুপালির সামনে অপরাধীদের ভয়ে হাটু কাঁপে সেখানে এই মেয়েটা হাসছে।এটা ঠিক কিসের হাসি বুঝা যাচ্ছে না।এমন মনে হচ্ছে ও ব্য’থা সহ্য করবে কিন্তু শিকার করবে না কেন করেছে এসব।রুপালি জুনইদ আর অনিলা কে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আপনারা বাড়ি যান।আমরা আপনার বাবার কোনো ক্ষ’তি হতে দেবো না।আপনারা নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে যান।আর সত্যিটা তো আমি জেনেই ছাড়বো।তাও এর মুখ থেকেই।”
অনিলা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়েছে রুপালির এমন হিংস্রতায়।চোখ বন্ধ করে চোখের জল ফেলছে সে।জুনইদ আর অনিলা বেরিয়ে এলো।আর রুপালি তাহরিমাকে জ্বেলের কারাগারের ভেতর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঢুঁকিয়ে দিলো।এখানে থাকা সকল মহিলা অপরাধীরা খুব ভালো ভাবেই জানে রুপালি ঠিক কতটা ভয়ংকর।কেউ কেউ বলছে,”এই মেয়েটার বুঝি আর র’ক্ষে নেই!”
অন্য একজন আফসোসের স্বরে বলে উঠলো,
“ইশরে সত্যিটা শিকার করলেই তো হয়।মা’র টা তো খাওয়া থেকে বেঁচে যাবে।”
জুনইদ আর অনিলা বেরিয়ে আসতে যাবে তখনই অনিলার বাবা আলিফ হোসেন কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো।সাথে মায়াবী আর ওর হাসবেন্ড ফাহাদ।অনিলা ওর বাবাকে দেখেই ছুটে জড়িয়ে ধরলো।
“বাবা তুমি ঠিক আছো তো?কিচ্ছু হয়নি তো তোমার?ওই তাহরিমার লোকজন তোমাকে কোথাও আ’ঘাত করেনি তো?”
আলিফ হোসেন নিজের মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”আজ আমি বেঁচে আছি শুধু মাত্র ফাহাদের জন্য।ও না থাকলে হইতো এতক্ষনে আমি*”
মায়াবী আলিফ হোসেন কে আর বলতে না দিয়ে বলে গাল ফুলিয়ে উঠলো,”এখন তো আমি আর কেউ না।ছোট মেয়েই সব আমাকে তো ভুলেই গেছে সবাই।বিয়ে দিয়ে পর করে দিসে আমাকে একেবারে!”
মায়াবীর কথায় আলিফ হোসেন হেসে দিলেন সাথে অনিলাও কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিলো,”বুবু কি যে বলো না তুমি।আমরা কি কেউই তোমাকে ভুলতে পারি বলো?”
“হ্যাঁ হয়েছে ঢং করা হচ্ছে এখন আমার সাথে। এখন ওসব লোক দেখানো কথা বলবি না তুই যাহ।তুই আমাকে আগে আগে ভুলে গেছিস!আর তোমরা,তোমরা আমাকে যদি মনেই রাখতে তাহলে এতো কিছু হয়ে গেছে আমাকে সবই জানাতে।আসলেই তো আমি আর কেউই না।যদি হতাম তাইলে এতো টা পর করে দিতে পারতে না।”মায়াবী অভিমানি, রাশভারি গলায় বললো।
অনিলা গিয়ে মায়াবীকে জাপটে ধরলো।অশ্রুবর্ষণ করতে করতে বলে,”আমার বুবু টা!স্যরি বুবু।”
মায়াবী ও বোন কে আগলে নিলো।সব অভিমান বিসর্জন দিচ্ছে দুই বোন নিরব অভিযোগে।ওরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে দুই বোন কে।আলিফ হোসেন আড়ালে চোখের কার্নিশে আসা জল টুকু মুছে নিলেন।
জুনইদ বলে উঠলো,”বাবা এটা বলুন ফাহাদ আপনাকে কিভাবে পেলো?”
সবাই আবার সিরিয়াস দৃষ্টিতে তাকালো আলিফ হোসেন এর দিকে।মায়াবীও কিছুই জানে না।কারণ ফাহাদ বলেছে পুলিশ স্টেশন এ বলবে সবার সামনে।প্রমান সহ দেবে।আলিফ হোসেন বলেন,
“চলো সবাই ভেতরে!”
ওরা সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো।রুপালি সবে মাত্র তাহরিমা কে মা’রার জন্য উদ্যত হয়েছে ঠিক তখনই আলিফ হোসেন থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“থামুন মেডাম।ওঁকে মারতে হবে না।আমরাই বলছি সত্যি টা।”
রুপালি কন্ঠঃস্বরের অধিকারির দিকে তাকালো।তাহরিমাও অবাক চোখে তাকালো এই কন্ঠ টা শুনে।আলিফ হোসেন কে দেখেই ওর পিলে চমকে উঠে।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র চেচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি আমার আস্তানা থেকে বেঁচে ফিরলেন কি করে?”
আলিফ হোসেন রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেন,”অপরাধী যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন অপরাধ করে কি আর পার পেতে পারে।আর তুমি কি নিজেকে একাই চালাক ভাবো নাকি,আর তোমার ধারণা বাকি সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে।তোমার আর তোমার বাবার অপরাধের লিষ্টটা একটু বেশিই লম্বা।একদম বাবার র’ক্ত টাই পেয়েছো।সত্যিই র’ক্ত কথা বলে এটাই তার প্রমান।নোংরা র’ক্ত।”
“ওই বু’ড়ো ডায়লগ কমিয়ে দাও!আমার বাবার নামে একটা বাজে কথা বলবে না, একদম না।কি দোষ করেছিলো আমার বাবা!তোমার সামান্য একটা সাইন এর জন্য আজ আমার বাবা এই পৃথিবীতে নেই।তোমার জন্য আমার বাবা সুইসাইড করতে বাধ্য হয়েছিলো।”
জলে ভর্তি টলটলে চোখ গুলো তারার মতো চিক চিক করছিলো তাহরিমার।তারপর তাহরিমা নিজের মনেই আওড়ালো তবে আস্তে নয় খানিকটা জোরেই,
”ওই গর্দভ রা আবারও প্ল্যান এ ফেইল করেছে।কাজ টা আমাকেই করতে হতো।কেন যে ওই স্পাইনলেস গুলোর উপর দায়িত্ব দিতে গেছিলাম কে জানে।একেকটা অপদার্থ, ইউসলেস গুলো!”
ফাহাদ এতক্ষণে চুপচাপ শুনছিলো।এবার সে মুখ খুলে।দুই হাত পকেটে গুজে আয়েসি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলে,”তোমার ওই লোক গুলোর তো এখনো দু’ধের দাঁত ই পরেনি।ওরা তো একেকটা ব’লদ।ব’লদ দিয়ে কি আর হাল চাষ হয়।সব কটা আমার কাছে জাষ্ট চু’নো পু’টি।টিপে দিলেই শেষ!”
“এই ছেলে এতো বেগরবাই করিস না।খোলাসা করে বল?তুই এমন ভাবে কথা বলছিস মনে হচ্ছে তুই বাঁচিয়েছিস বু’ড়ো টাকে।”
রুপালি এবার রেগে গিয়ে তাহরিমার চুলের মু’ঠি চে’পে ধরে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে,”তোর তো সাহস কম না!আমার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলার মতো দুঃসাহসিক কাজ করিস।সত্যিই তোর তারিফ করতে হয় বটে।কারাগারে বন্দি হয়েও তে’জ কমেনি একটুও।”
তাহরিমা বাকা হাসে।পরক্ষণেই মুখের মধ্যে আক্রোশের ছাপ দেখা যায়।সে রোশপুর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওঁদের সবার দিকে।
ফাহাদ নির্বিকার স্বভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।ঠোঁটর কোণের মৃদু হাসি রেখে বলে উঠলো,
“তুমি ঠিকই ধরেছো আমিই বাঁচিয়েছি আমার শশুড় মশাইকে।তোমার সব প্ল্যান ভেস্তে দেওয়ার জন্য স্যরি তাহরিমা!তোমাকে তোমার মামা বাড়িতে স্বাগতম!এবার যে তোমাকে সারাজীবন জ্বেলেই কাটাতে হবে।এটা ভেবেই খারাপ লাগছে।স্যাড ভেরি স্যাড!তবে তুমি সত্যিই দারুন পাকাপোক্ত লেডি কিলার।জবাব নেই তোমার।ক্ল্যাপ!ক্ল্যাপ!সবাই ক্ল্যাপ করো।”
অনিলা আর জুনইদ তো অবাক।ঠিক ভেবে পাচ্ছে না ফাহাদ কিভাবে এতো কিছু করলো।ওকে দেখে তো মনে হয় না কাউকে ফুলের টুকাও দিতে পারে।কিন্তু ও এখন এমন ভাবে কথা বলছে যেনো এগুলো ওর বা হাতের খেল।
আলিফ হোসেন ও নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি জানেন সব টা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
“সবার থেকে বেশি অবাক মায়াবী হয়েছে।সে উৎসুক দৃষ্টিতে নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।তার স্বামীর এমন আরেকটা রুপ আছে বা থাকতে পারে ওর জানা ছিলো না।ফাহাদের মতো এমন নরম মানুষ যে এমন কোনো কাজ করতে পারে ভাবতেই পারেনি ও।ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে ওর বাবাকে ফাহাদ বাঁচিয়েছে।কিন্তু প্রশ্ন টা হচ্ছে কিভাবে?আচ্ছা ফাহাদ কি কোনো বাজে কাজে লিপ্ত আছে?কথাটি ভেবেই শিউরে উঠে মায়াবী।এতো ভয় কেন পাচ্ছে সে।তবে কি তার জীবন অনিশ্চিত!”
#চলবে
#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ২৮
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি
“ফাহাদ আপনি এতো বড় একটা কথা আমার কাছে কিভাবে আড়াল করতে পারলেন বলুন?”
ফাহাদ নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলো সাবলীল ভাবে।আজ নয় কাল তো জানতোই মায়াবী।আজ জানাবে বলেই সে মায়াবী কে নিজের সাথে এনেছে।নিরবচ্ছিন্ন সব কিছুই।কারোর মুখেই কথা নেই।অনিলা আর জুনইদ ও অবাক কম হয়নি।অনিলাও জানতো না ফাহাদের বিষয় টা।শুধুই তার বাবা জানতেন ফাহাদ এক্সাক্টলি কি করেন।তবে যে ওর বাবা বলেছিলেন ফাহাদ ভাইয়া কোনো বিজনেস করেন।সেগুলো কি মিথ্যা।আলিফ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন’
“জামাইয়ের কোনো দোষ নেই মায়া।ফাহাদ আগেই বলতে চেয়েছিলো।তোমাদের বিয়ের আগেই ফাহাদ সত্যিটা বলবে বলে এসেছিলো কিন্তু আমি বাধা দিয়েছিলাম।বলেছিলাম বিয়ের পর সব টা আমিই তোমাকে জানাবো।”
মায়াবী টলটলে দৃষ্টিতে তাকালো ওর বাবার দিকে।তার বাবা তো জানতো তার কোনো এক কারণে পছন্দ না পুলিশদের।তার ধারণা পুলিশ মানেই দুর্নীতি।তারা মানুষ কে রক্ষা করার নামে অন্যায় করে।তার ধারণা ছোট বেলা থেকেই।এটা তার বাবা জানতেন।তাও কেন এমন টা করলো তার বাবা।অঝোর ধারায় চোখের পানি পরছিলো তার।মায়াবী হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি জানতে বাবা ফাহাদ পুলিশ অফিসার?তাও আমাকে একটা বার বলো নি কেন?”
“হ্যাঁ আমি জানতাম শুরু থেকেই যে ফাহাদ পুলিশ অফিসার।দেখো সব পুলিশ রা খারাপ হয় না।ফাহাদ যথেষ্ট সিন্সিয়ার আর লয়াল পুলিশ অফিসার।তোমার পুলিশ অফিসার দের পছন্দ জানতাম আমরা।আর তাই তোমার পছন্দ না বলেই আমারও এই সম্বন্ধে ঘোর আপত্তি ছিলো।তবে ওর সততা দেখে আমি মুগ্ধ হয়।তাই সব টা আমিই আড়াল করতে বলি।সময় সুযোগ হলে জানাতাম তোমাকে বিষয় টা।আমি তোমার বাবা।আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি ফাহাদ কে পছন্দ করো।তাই আমি চাইনি তোমার কোনো রকম কষ্ট হোক এই সম্বন্ধ টা ভেঙে।তোমার মা ও বুঝেছিলেন তুমি ফাহাদ কে পছন্দ করো।”
“এখন কি আমার কষ্ট হচ্ছে না বাবা।তুমি আর ফাহাদ তোমরা দুজনেই আমাকে ঠকিয়েছো।”
কথা শেষ করে মায়াবী জায়গা টা প্রস্থান করতে গেলে একটা শক্ত পুরুষালি হাতের বাধনে আটকা পরে সে।সে জানে এটা কে।
“তুমি কোথাও যাচ্ছো না মায়া।আমার কথা না শেষ হওয়া অব্দি তো নয়ই।সব কথা শুনে তবেই তুমি এখান থেকে যেতে পারবে।”
ফাহাদের কথায় মায়াবীর হৃদয় টা যেনো ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।এতো কিছু লুকানোর পরেও সে কিভাবে এতটা শান্ত আছে।লোকটার কি ভয় হচ্ছে তাকে হারানোর।মায়াবী দাঁড়িয়ে যায়।অনিলা এসে মায়াবীর দুই কাধে হাত রেখে ওঁকে আগলে দাঁড়িয়ে রইলো।জুনইদ ও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সত্য টা জানার জন্য।এক্সাক্টলি কি কারণে তাহরিমা এমন টা করেছে।
ফাহাদ সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বলে।এক নজর তাহরিমাকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে রহস্যময় হাসি হাসলো সে।তারপর বলতে শুরু করলো,
“নগরীতে চিহ্নিত ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে দশটি অপসারণ করেই হাত গুটিয়ে বসে আছে সিটি করপোরেশনের (সিসিক)।কারণ বাকি ভবনগুলো রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাদের যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।এক বছর ধরে বাকি ভবনগুলো অপসারণ বা ভাঙার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।কিন্তু সরকারের খাতায় এখনো উল্লেখ্য আছে এসব অপসারণ অভিযান এখনো বন্ধ হয়নি।অন্যান্য কার্যক্রমে জোর দেওয়ায় সাময়িকভাবে অভিযান করা হচ্ছে না।শিগগির আবার তা শুরু হবে।এরপর বিভিন্ন স্থাপনা অপসারণ করা হলেও তালিকাভুক্ত বাকি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভাঙার কার্যক্রম আর এগোয়নি।তো এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাভুক্ত আছেন মিস্টার সোহানের এসটি ইন্ডাস্ট্রি।যেখানে মিস্টার সোহান ১০০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করে ভবন আর জমি কিনেছিলেন।যেটার জন্য মিস্টার সোহান কে ৫০ কোটির বেশি টাকা তার বিজনেস পাটনার্রদের থেকে ধার নিতে হয়েছিলো।যখন মিস্টার সোহান ভবন অপসারণের সরকারের চিঠিটা হাতে পাই তখন তিনি মরিয়া হয়ে উঠেন।তার মাথার বাজ পড়ে যেনো এতে।তিনি এক মন্ত্রীর কাছের লোকের সাহায্য নিয়ে তার ভবনটি অভিযান বন্ধ রেখেছে বলে কয়ে।”
এটুকু বলে ফাহাদ দম নিয়ে ডেস্কের উপর রাখা পানি টুকু পান করলো।সে আবার বলতে শুরু করলো,
“এরি মধ্যে তার বিজনেস পার্টনার রা টাকা ফেরত চেয়ে চাপ দিতে শুরু করলো।মিস্টার সোহান তার করা স্বপ্নের এসটি ভাবনটা বিক্রির বিজ্ঞাপন দিলে তা নেওয়ার জন্য লোক আসে।কিন্তু যখন সবাই জানতে পারে এটা সরকারি রেড ক্রসের মধ্যে মার্ক করা তখন আর কেউ এগোয় না কেনার জন্য।এভাবে যতই দিন যেতে লাগলো মিস্টার সোহানের মাথার উপর চাপ বাড়তেই থাকে।এদিকে সবাই ধারে দেওয়া পাওনা ফেরত চাচ্ছে।মিস্টার সোহানের পালিয়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা।কারণ সবাইকে টাকা ফেরত দেওয়ার মিথ্যা কৈফিয়ত দিতে দিতে তিনি হাঁপিয়ে গেছে।তো মিস্টার সোহান প্ল্যান করলেন উনি ঘুষ দিয়ে হলেও উনি উনার বাড়ির উপর লোন নিবেন।উনার ভবনের টাকা উঠে আসবে আর উনি উনার ঘাড় থেকে সমস্ত ধার দেনা মুক্ত হবেন।কিন্তু ঘুষের জন্য তো টাকা লাগবে।কিন্তু এখন মিস্টার সোহানকে আর কেউই ধার দিচ্ছেন না।উনার বন্ধুরাও আর উনার কথা বিশ্বাস করেন না।তখন মিস্টার সোহান সিদ্ধান্ত নিলেন এবং উনার এক কাছের আত্মীয়র সাথে কথা বললেন।উনি উনার থাকার বাড়ি টা ৪০ কোটি টাকার হলেও বন্ধক রাখলেন মাত্র দশ কোটি টাকায়।উনি ভেবেছিলেন ব্যাংক লোন করে বাড়িটা সহজেই সারিয়ে নিতে পারবেন।দশ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বিল পাশ করানোর জন্য নীচের শ্রেণির সব অফিসারের থেকে সাইন পাশ করানো শেষ।
তিনি যখন ম্যানেজারের ক্যাবিনে মানে আমার শশুড় মশাইয়ের কাছে মিস্টার সোহানের বিলের কাগজটা যায় তখন তিনি বুঝতে পারেন যে মিস্টার সোহান যে ভবনের উপর লোন টা চাচ্ছেন সেটা সরকারি রেড মার্ক করা।উনি বিজ্ঞাপন টা দেখেছিলেন।আর আমাকে দিয়ে খোঁজ নেওয়ান।আমি খোঁজ নিয়ে জানাই যেনো তিনি কাগজে সাইন টা না করেন।আমার কথা মতো বাবাও সাইন টা করেন নি।তাছাড়া আমার শশুড় মশাই খুবই সৎ একজন মানুষ।তাহরিমার বাবার লোনের জন্য উনি যদি সাইন টা দিতেন তবে উনার ব্যাংকের চাকরি টা থাকতো না।তার চেয়েও বড় কথা উনি সৎ মানুষ।আজীবন সৎ পথে চলেছেন তিনি।সেখানে এতো বড় ভুল টা তিনি কিছুতেই করতে পারতেন না।
পরবর্তীতে যখন তাহরিমার বাবা কোনো কিছুতেই পেরে উঠলেন না তখন তিনি তাহরিমা কে সব টা একটা চিঠি তে লিখে সুই’সাইড করেন।আর সেই জের ধরেই তাহরিমাও ওর বাবার রেখে যাওয়া কয়েকজন লোককে কাজে লাগিয়ে সেদিন আমার শশুড় মশাইয়ের উপর অ্যাটাক করাই।এরপর অনিলা কিডনাপিং।এডভোকেট সৃজন কে উধাও করা সব টা প্ল্যান মাফিক করে।এরপর অনিলার কথা বলে সাইন নিতে চাইলো সে।কিন্তু আলিফ হোসেন আগে অনিলাকে দেখতে চেয়েছিলো এই বাড়িতে।অনিলা বাড়ি ফিরলে এটা সেটা বাহানা বানান আলিফ হোসেন সাইনের জন্য।অনিলাকেউ ফিরিয়ে দেওয়ার দুই দিন পর ও যখন সাইন করা কাগজ তাহরিমা হাতে না পায় তখন আলিফ হোসেন কেই তুলে নিলো সে।
সবাই যেনো এতক্ষণ দম নিতে ভুলে গেছিলো।এতো কিছু হয়ে গেছে তাদের ধারণা ও ছিলো না।তাহরিমা আক্রোশ রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তাকালো ফাহাদের দিকে,
“তাহলে তুই এই বুড়োকে উদ্ধার কিভাবে করলি?”
ফাহাদ যেনো পারলে ঘর কাঁপিয়ে হাসবে।কিন্তু সে শান্ত রইলো।রোসানল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এটুকু বুঝতে পারলে না তুমি।এই তোমার বুদ্ধি।আমি একজন পুলিশ অফিসার।আমার দ্বারা এটা কোনো ব্যাপার না।আমি আমার শশুড় মশাই কে অনিলার ফিরে আসার দিনই একটা স্পাই ক্যামেরা দিয়ে দিই।যেটা উনি সব সময় নিজের কাছে রাখতেন।আমাদের তোমার কাছে পৌঁছনো টা জরুরি ছিলো।আর আমরাও চাইছিলাম তুমি একটা ভুল করো।তুমি ভুল করলেও আমার শশুড় মশাই কে কিডনাপ করে।আর বাকিটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না কিভাবে আমি উদ্ধার করলাম বাবাকে।
তাহরিমা রেগে গিয়ে চেচাতে শুরু করলো।চিৎকার করে করে এক সময় অজ্ঞান হয়ে গেলো সে।রুপালি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ব্যাপার টা ওই দেখবে।
ফাহাদ মাথা নিচু করে মায়াবীর দিকে এগিয়ে গেলো।দুই হাতে মায়াবীর হাত টা ধরলো।মায়াবী মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
“আ’ম স্যরি মায়া।আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি।আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ।”
মায়াবী নিরুত্তর রইলো।আলিফ হোসেন বেরিয়ে গেলেন।অনিলা আর জুনইদ ও ঠোঁট চেপে হাসলো।ওরাও বেরিয়ে এসে মায়াবী আর ফাহাদ কে একটু স্পেস দিলো।ঘর ফাঁকা পেয়েই মায়াবী ঝা’পিয়ে পরলো ফাহাদের বুকে।স্টেবল থাকতে না পেরে ফাহাদ দু পা পিছিয়ে গেলো।সেও মুচকি হেসে মায়াবীর মাথায় চু’মু একে দিলো।
“এখনো কাদবে তুমি।তুমি কাদলে তো তোমার ভেতরে বেড়ে উঠা ছোট্ট প্রান টাও কাদবে সোনা।তুমি কি সেটা চাও?”
এবারো মায়াবী নিরুত্তর রইলো।শুধু নিরবে অভিযোগ করতে থাকলো।চোখের পানিতে ফাহাদের শার্ট ভিজে গেছে কিছু টা।তাও সে থামছে না।ফাহাদ ও আর কিছু বললো না।কাদতে দিলো মায়াবীকে।কাদলে হালকা হয় মন।অভিমানের পারদ গলে যায়।দুই হাতে আগলে রাখলো শুধু তার প্রেয়সীকে।
এদিকে রুপালি চেয়ে রইলো ফাহাদ আর মায়াবীর দিকে।তার কষ্ট হচ্ছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ফাহাদ কে আর মায়াবীকে এভাবে দেখে।সেও যে এক সময় ফাহাদ নামক মানুষ টাকে চাইতো মনে প্রানে।সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো ওদের থেকে।যা হওয়ার নয় সেটা নিয়ে ভাবাও পাপ।সে না হয় নিরবেই মানুষ টার শুভ কামনা করে যাবে।চোখে আসা অশ্রু টুকু মুছে ফেললো সে।
অনিলা আর জুনইদ গাড়িতে বসে পরলো।ড্রাইভার গাড়ি চালানোই মন দিলো।আলিফ হোসেন উনার গাড়িতেই চলে গেছেন নিজের বাড়িতে।অনিলা সন্তপর্ণে জুনইদের বুকে মাথা গুজে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।আর কোনো যেনো না আসে তাদের জীবনে।এবার একটু শান্তি, একটু ভালোবাসা, একটা গোছানো জীবন চাই সে।অনিলা আলতো হেসে বললো,
“শুনছেন।”
“হুম বলো?”
”আমার একটা বাবু চাই ঠিক আপনার মতো?”
“তাই।অল রাইট, গেট রেডি টু বি টুগেদার।
শুধু একটা নয় এতো গুলা বাবু দিবো তোমাকে।
লজ্জায় অনিলা মুখ লুকালো জুনইদের বুকে।এতেও যেনো এক অন্য রকম প্রশান্তি।
#চলবে
#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ২৯
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি
মনিরা বেগম আজ ভীষণ ব্যস্ত রান্না ঘরে।দুই জামাতা,মেয়েরা এসেছে বলে কথা।রাতের রান্না করতে ব্যস্ত তিনি।দুই জামাই প্রথম বার এক সাথে এসেছে।এর আগে অবশ্য মায়াবী এসেছিলো।তবে সাথে ফাহাদ আসেনি।ওরা দুই বোন সহ সাথে দুই জামাইকে দেখে কত যে খুশি হয়েছেন তিনি।ওরা এসেছে সকালে ব্রেকফাস্ট করার পর।দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই ভাত ঘুম দিয়েছিলো।উঠে ফ্রেশ হয়ে চারজন লুডু খেলতে বসেছে।ফাহাদ অবশ্য এসব খেলা ফেলা পছন্দ করে না।কিন্তু তার মায়াবতীর কথাও সে অগ্রাহ্য করতে পারে না।কিছুতেই না।সেই সাধ্যি বোধহয় তার হয়নি।এমন কাঠখোট্টা একরোখা পুলিশ অফিসার থেকে তাকে একেবারে প্রেমিক পুরুষ বানিয়ে দিয়েছে।তার ভাস্য মতে নারীরা কোনো অদম্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।সে তো কোনো এক সময় ঠিকই করে নিয়েছিলো বিয়েই করবে না।কিন্তু প্রথম যেদিন সে মায়াবী কে দেখেছিলো সেদিনই তার মনে সুক্ষ্ম অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছিল।এরপর প্রায় অফিসে যাওয়ার আগে একবার হলেও সে অনাথ আশ্রমে যেতো।ক্ষমতা যদি নাই থাকতো তাহলে তাকে এভাবে বদলে দিলো কিভাবে।এই যে এখন কেমন তারা তাদের সেই ক্ষমতা দিয়ে প্রেমিক পুরুষের মন বদলে ফেলেছে।ফাহাদ আনমনে হাসলো।
খেলা হবে জোড়াই জোড়া।মায়াবী আর অনিলা জোড়া।আর জুনইদ আর ফাহাদ জোড়া।এই লুডু খেলাই যে দল জিতবে তাদের কথায় শোনা হবে।অনিলা আর মায়াবী শর্ত দিয়েছে যদি তারা দুই বোন জিতে যায় তবে রাতে তারা এক সাথে থাকবে।জুনইদ আর ফাহাদ ও শর্ত দিয়েছে তারা জিতলে পরে যা চাইবে তাই দিতে হবে।এখন খেলা শুরু হয়েছে।ওরা দুই বোন মুখোমুখি আর ওরা দুই ভাইরা ভাই মুখোমুখি।
জুনইদের এখনো পর্যন্ত একটা ছক্কা উঠেনি।আর এদিকে দুই বোন রাজত্ব করছে লুডুর ছকে।ফাহাদ ততক্ষণ জুনইদের জন্য চালতে পারবে না যতক্ষণ না জুনইদের প্রথম ছক্কা উঠেছে দানে।এখনো অব্দি সব গুলা গুঠি হাতে তার।ফাহাদ অবশ্য সব গুলোই বের করেছে গুঠি।কষ্টে জুনইদের কান্না পাচ্ছে এখনো একটাও গুঠি না তুলতে পেরে।জুনইদের দুই ছক্কা উঠেছিল মাঝে।সে সবেই চাল দিয়েছে পেছন থেকে অনিলা পাঁচ দিয়ে জুনইদ এর সদ্য বেরোনো গুঠি টা কেটে দিয়েছে।এবার পারলে এখন জুনইদ সত্যিই কেঁদে ফেলে।এরপর যখন অনিলা ফাহাদের গুঠি টা কেটেদিলো তখন মায়াবী দরদ দেখিয়ে বলে,
“ইশ রে কত কষ্টে গুঠি টা নিয়ে যাচ্ছিলো আমার বর টা।তুই কিনা কেটে দিলি অনিলা।এরপর তুই আমার বরের গুঠি একদম কাটবি না।”
অনিলার রাগ হলো।তার বুবু খেলার মধ্যেও তার বরের পক্ষ নিচ্ছে।তারা এখন পার্টনার সেখানে ওদের গুঠি কাটার জন্য তার বুবুর খুশি হওয়ার বদলে ক্ষীপ্ত হচ্ছে।সে গাল ফুলিয়ে বলে,
“দেখো বুবু গেইম ইজ গেইম।এখানে এসব দরদ দেখাবা না।দেখছো না আমি কেমন পাষান হয়ে গেছি।সবেই জুনইদের গুঠি কেটে দিয়েছি।বেচারির তো মাত্র একটাই গুঠি চেলেছিলো।”
জুনইদের আবার গুঠি উঠেছে।সে এবার খুব বুদ্ধি করে দান চালছে।তাকে আজ জিততেই হবে।মেয়েদের কাছে হারা যাবে না।তাছাড়া হারলে আর বউ এর সাথে থাকতে পারবে না আজ রাতে।ভাইরা ভাইয়ের সাথে থাকতে হবে নইলে একা একা অন্য একটি রুমে বউ ছাড়া নিদ্রাহীন কাটাতে হবে সারারাত।
এদিকে দুই বোনের এমন পাকাপোক্ত লুডু খেলা দেখে দুই ভাইরা ভাইয়ের নাকের পানি চোখের পানি এক হওয়ার জোগার।পর পর দুজনেরই ছক্কা উঠেছে।
“একবার আমার খেলা টা উঠতে দেও।দেখো এই আইমান জুনইদের খেল।কিভাবে তোমাদের হারাই আমি।আগে গেলে বাঘে খাই এটা জানো তো।”
“সেই তো একটাও গুঠি এখনো অব্দি পাকাতে পারলি না রে ছে’মড়া।আবার বড় বড় ডায়লগ দিচ্ছিস।তোর পার্টনারের শুধু উঠেছে গুঠি।এদিকে আমার আর অনিলার দুটো গুঠি আছে শুধু।বাকি সব উঠে গেছে।এই দুটো উঠে গেলেই আমরা উইন!”
মায়াবীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বললো না জুনইদ।জুনইদ কে মায়াবী সেদিনের পর থেকে ছোট ভাইয়ের মতো ট্রিট করে।তাই তুই সম্বোধন করে তখন থেকেই।এখন অবশ্য জুনইদ আর ফাহাদ দুজন মিলে চালছে।এতে তারাতাড়ি গুঠি উঠে গেছে।অনিলার গুঠি কানা এর জন্য উঠছে না।দানে কানা উঠলেই তারা উইন।ফাহাদের গুঠি তুলে দেওয়া শেষ তবে জুনইদ এর একটা গুঠি আছে।তার দানে চার দরকার আর আর অনিলার কা’না(এক)।টান টান উত্তেজনা খেলায়।ইশ কি যে হবে।এবার জুনইদের তিন পরে আর গুঠি চালার পর এক লাগে তার।সেইম সেইম পজিশন এ আছে অনিলা আর জুনইদ।
এবার অনিলা চোখ বন্ধ করে চাললো।এবার সে চোখ খুলবে না ছক্কার গুঠি ফেলে।তাই করলো।কিছুক্ষন নিস্তব্ধতার মায়াবী চেচিয়ে উঠলো।
“ইয়ে আমরা জিতে গেছি।”
ফাহাদ ভেংচি কাটলো।এমন ভাব করছে যেনো তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ জয় করেছে খেলায় জিতে।অনিলা উত্তেজনায় চোখ খুলতে যেনো ভুলে গেছে।আর জুনইদের মুখ টা দেখার মতো।চুপসে গেছে একেবারে।এতো চেষ্টা করেও শেষ অব্দি জয় লাভ হলো না বেচারার।সে উঠে চলে গেলো অনিলার রুমে।এরপর স্ট্রুয়ার্ট এর কাছে গিয়ে বলে উঠলো,
দেখলি তো স্ট্রুয়ার্ট আমায় কিভাবে হারিয়ে দিলো।কথায় বলবো না ঠিক করেছি বুঝলি তোর অনির সাথে।তোর অনি কে বলে দিস এই কথা।
স্ট্রুয়ার্ট কি বুঝলো কে জানে।সে অদ্ভুত ভাবে খিকখিক করতে থাকলো।অর্থাৎ সেও জুনইদ কে নিয়ে মজা লুটছে।
“হেরো,হেরো!ছেলেটা হেরো!”
জুনইদ স্ট্রুয়ার্ট কে রাগ দেখিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।এই স্ট্রুয়ার্ট কিভাবে যে এতো কথা শিখেছে।এটাও ওঁকে জানতে হবে।ভেবেছিলো স্ট্রুয়ার্ট অন্তত তার দুঃখ বুঝবে কিন্তু না সেও তাকে ক্ষেপাচ্ছে।ভালো লাগছে না তার।একদমই ভালো লাগছে না।এই খারাপ লাগা টা কি শুধুই খেলায় হেরেছে বলে।কি জানি হতে পারে।
এদিকে মায়াবী আর অনিলার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো।সামান্য লুডু খেলায় হেরে যে বেচারা জুনইদ এমন দেবদাসের মতো করবে ভাবতেও পারেনি তারা।ফাহাদ নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলো।সে বুঝতে পেরেছে জুনইদ খেলায় হারার জন্য মন খারাপ করেনি।কেন করেছে সেটা সে বুঝতে পারছে।কারণ তারা দুজনেই যে এই মুহুর্তে একই পথের পথিক।
•
সায়াহ্নের প্রহর কেটেছে বেশ অনেক আগেই।শেষে মেহেদীরাঙ্গা অম্বর নীমিলিত হলো আঁধারে।নক্ষত্রবিহীন আকাশে অজস্র মেঘের মাঝে বৃত্তকার চাঁদটির মায়াবী খেলা।নিষুপ্ত রজনিতে কারো হিংস্র ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।জুনইদ সেই যে বারান্দায় এসে বসেছিলো আর ঘরে যায় নি।অনিলা এসে দেখে জুনইদ দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।খেলা শেষ করে দুই বোন মিলে মনিরা বেগম কে রান্নার কাজে সাহায্য করেছে।এরপর দুই বুবু আর মায়ের সাথে গল্প করেছে।সে ভেবেছিলো জুনইদ হইতো ফাহাদের সঙ্গে আছে।কিন্তু মহাশয় যে এভাবে বারান্দায় ঘুমিয়ে আছে সে কি আর জানতো।সে দেখলো মৃদুমন্দ হাওয়ায় জুনইদের কপালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো বার বার লুটোপুটি খাচ্ছে।ইশ কি স্নিগ্ধ এই মুখ টা।অনিলার যেনো এই মুখ দেখে হাজার বছরের তৃষ্ণা মিটে যাবে।সে জুনইদের কাধে হাত রেখে আলতো করে ডাকলো,
“মিষ্টার ল্যাম্পপোস্ট।এই যে শুনছেন।”
এমন মিহি গলায় ডাকলেও অনেক দিন পর আবার সেই পুরনো ডাকে চোখ খুললো জুনইদ।পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের অবস্থান বুঝলো সে।তার মনে পরলো সে এখন শশুড় বাড়িতে।
“উঠুন মা ডাকছে খেতে যাওয়ার জন্য।”
জুনইদ চোখ কচলে বলে,”তুমি যাও মিস সুনামি।আমি আসছি।”
অনিলা অবাক হলো।ভীষণ ভাবে ভালোও লাগলো জুনইদ এর মুখে মিস সুনামি শুনে।আগে কতই না রেগে যেতো সে এই ডাকে।আর এখন যেনো এই ডাকেও সে প্রেম খুজে পাচ্ছে।
“আচ্ছা আসুন তারাতাড়ি।ফাহাদ ভাইয়া,বাবা মা,বুবু সবাই বসে আছে আপনার জন্য।”
“সেকি!আমার একার জন্য বসে রয়েছেন কেন উনারা।খেয়ে নিতে বলতে উনাদের।”
“তারা তাদের জামাইকে রেখে খাবে কিভাবে।আসুন আপনি।”
অনিলা মৃদু হেসে চলে গেলো।এখন তার অস্বস্তি হচ্ছে সাথে একরাশ খারাপ লাগা ঘিরে ধরলো।সে ঘড়ি দেখলো।দশটা বাজে ঘড়িতে।বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে কখন চোখ বন্ধ হয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি।সে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই সবাই স্বাভাবিক ভাবে হাসলো।এতে যেনো জুনইদের অস্বস্তি কয়েকদফা বেড়ে গেলো।সে মেকি হাসার চেষ্টা করলো।
“আপনারা এভাবে আমার একার জন্য এভাবে না বসে থাকলেও পারতেন।”
“আরে এভাবে বলছো কেন।রাত তো আর অনেক হয়ে যায়নি।তোমাকে ছাড়া আমরা খাই কিভাবে বলো তো বাবা।”
এই প্রথম বোধহয় আলিফ হোসেন জুনইদের সাথে এতো ভালো ভাবে কথা বললো।জুনইদ মনে মনে বেজাই খুশি হলো।এতো দিনে তবে সে তার শশুড় মশাইয়ের মন পেলো।মানুষ টা একটু গম্ভীর টাইপের তবে মানুষ টা যে কতটা ভালো তারা সবাই জানে এবং মানেও।সবাই এবার খাওয়া দাওয়াই মনোযোগ দিলো।খাওয়া শেষ করে আলিফ হোসেন নিজের ঘরে গেলেন।মনিরা বেগম ও চলে গেলেন একটু পরই।
কথা মতো অনিলা আর মায়াবী এক সাথে শুতে গেলো।আর জুনইদ ও কিছু বললো না এতে।মনে মনে ভীষণ ভাবে ক্ষীপ্ত হলো অনিলার উপর।সে আর ফাহাদ এক সাথে থাকবে বলে ঠিক করলো।দু’জন চোখ টিপে চলে গেলো ওদের রুমে।
অনিলা ভেবেছিলো অন্ততপক্ষে জুনইদ একবার হলেও বলবে যে অনিলা চলো না আমরা এক সাথে থাকি।এদিকে মায়াবী ও ফুলে রইলো।অনিলা আর মায়াবী শুয়ে পরলো।কোথায় ভেবেছিলো দুই বোনেতে মিলে সুখ দুঃখের আলাপ করবে কিন্তু না মন তো পরে আছে সে একটা মানুষের কাছে।মানুষ টা কি তার উপর রেগে আছে নাকি।একবার ও কথা বললো না যাওয়ার আগে।
মায়াবীর ও চোখে ঘুম নেই।ফাহাদ কেন তাকে বললো না একবার ও।খেলাই হেরেছে বলে কি সেটা মেনে নিতে হবে।একবারও কথা অব্দি বললো না তার সাথে।দুজনেই ঘাবটি মেরে শুয়ে রইলো।কেউ কোনো কথায় বললো না।
হঠাৎ করেই জুনইদের ফোনে একটা কল এলো।এতো রাতে কে ফোন করলো।না চাইতেও জুনইদ ফোন টা ধরলো।
“মিষ্টার আইমান জুনইদ নিজের বাইক ব্রাস্টের কথা কি ভুলে গেলে।ওটা আমিই করেছিলাম।তোমার সঙ্গে পুরনো হিসেব এখনো বাকি আছে মেরি দোস্ত।সেদিন তুমি ভাগ্য জুড়ে বেঁচে গেছো কিন্তু এরপরের ব্রাস্টের জন্য তৈরি থেকো।টাটা।”
“কে আপনি? হ্যালো, হ্যালো।”
জুনইদ কথা বলার সুযোগ পর্যন্ত পেলো না।তার আগেই ছেলেটা ফোন কেটে দিয়েছে।
“শিট ম্যান!কে হতে পারে এই ছেলে?”
ফাহাদ জেগেই ছিলো সে সব টাই শুনেছে।এরপর জুনইদ কে সে জিজ্ঞেস করলো কবে হয়েছে এমন টা।জুনইদ ফাহাদ কে আগের সব কিছু খুলে বললো।
“চিন্তা করো না।আমি দেখছি ব্যাপার টা।”
“ঠিক আছে ভাইয়া।”
ফাহাদ দেখলো জুনইদ মন খারাপ করে কি যেনো ভাবছে।সে মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করলো।পরক্ষণেই ফাহাদ মাথা নেড়ে বলে,
“চলো এক জায়গায় যাবো?”
“কোথায় ভাইয়া এতো রাতে তাও?”
“পাইপ বাইতে পারো?”
“ভাইয়া আপনার মাথা টা কি ঠিক আছে কি বলছেন এসব?”
“আগে বলো পারো কিনা পাইপ বাইতে?”
“হ্যাঁ কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
“আমার শালিকার কাছে মানে তোমার বউয়ের কাছে!”
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম।নামাজ কায়েম করুন।