#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_20
আজকের আবহাওয়াটা বেশ শীতল। সন্ধ্যা থেকে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সেই সাথে সল্প পরিসরে বাতাস বইছে মৃদু বেগে। প্রকৃতি নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার সমস্ত প্রয়াস চালু রেখেছে। ঘোর অন্ধকারের মাঝেও জ্বলজ্বল করছে মহলের শতাধিক কৃত্রিম আলো। রাতের খাবারের প্রস্তুতি চলছে রন্ধনশালায়। রাঁধুনিরা একের পর এক পদ তৈরি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছে। মাজেদা বানু চুপচাপ সবকিছু পরিক্ষা করে পরিবেশনযোগ্য খাবারগুলো আলাদা করে রেখে বাকিগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। তবে মেয়েদের হাতে সামান্য ভুলত্রুটি হলেও তার মুখে কোনো রা নেই। শীতল তার অঙ্গভঙ্গি। দৃষ্টি জুরে ভয়ের রেশ। তা দেখে ঠোঁট চেপে হাসছে মেয়েরা। তবে সেটা তার আড়ালে। সরাসরি হাসলে নিয়ম অনুযায়ী শাস্তির মুখে না পড়লেও সামান্য রাগ শুনতেই হবে। বেগম তাদেরও ছেড়ে দেবে না। তবে মাজেদা বানু জব্দ হওয়াতে তাদের যেন ইদ লেগে গেছে। হাফসা করুন মুখে দেখে যায় মাজেদা বানুর কার্যক্রম। তার মায়া লাগে বেচারির দুর্দশা দেখে! কী দাম্ভিকতার সাথে সবাইকে নিজের ইশারায় নাচাতো। আর আজ বেগমের ভয়ে আতঙ্কে আতঙ্কে কাটাতে হচ্ছে।
সুলতানের কামরার দ্বার বিকাল থেকেই বন্ধ। এ নিয়ে বিচলিত নয় কেউই। কারন কামরায় সুলতানের সাথে বেগমও আছেন। তাদের ব্যক্তিগত সময়ে নাক গলানোর স্পর্ধা অন্তত কারোর নেই। আজমাইন মাহতাবেরও নয়। ওয়াসিফা সুলতান অবশ্য কয়েকবার ঘুরে গেছেন কামরার সামনে থেকে। প্রতিবারই হতাশ হয়ে রাগান্বিত মুখে ফিরতে হয়েছে তাকে। তার পুত্র একজন সুলতান! অথচ তার মাঝে কোনো তা নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই! আশ্চর্য! একজন সুলতানের জীবন কখনো এমন হয় তার জানা ছিলো না। তার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তার ছেলে ঘুমের মাঝেও এলিজার নাম জপে। সে স্বীকার না করলেও এ কথা মানতে বাধ্য যে তার পুত্র বউ পাগল। শুধু পাগল নয় একেবারে উন্মাদ! ছি! লজ্জার কথা। বেগমও পেয়েছে একটা কপাল গুণে। স্বামী খুন করে আসলেও সে হাত ধুইয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে বলবে আমার সুলতান নিষ্পাপ। এভাবে জোড়া মিলে গেল কীভাবে তার বুঝে আসে না।
যে যেমন তার জীবনসঙ্গীও তেমন হয় এটাই যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। আর তার স্বামী ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। অস্ত্র, তলোয়ার, তির, যুদ্ধ, দ্বন্দ ছাড়া তো তার চোখে কিছু বাঁধতোই না। এমন পিতার সন্তান হয়ে শাহজাইন কীভাবে এমনতর হলো!
সফেদ গাউন পড়েছে বেগম। মাথায় সফেদ পাথরের তাজটা জ্বলজ্বল করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করছে। শরীরে আর কোথাও কোনো প্রকার অলংকার নেই। তবুও তার স্নিগ্ধ রূপ যেন ঝলসে দেবে চারপাশ। লম্বা একটা সোনালি রঙা টুলে বসে বসে ঝিমোচ্ছে সে। সামনেই রং-তুলি হাতে গভীর মনোযোগ দিকে তাকে এঁকে চলেছে সুলতান। আঁকতে আঁকতে বারবার নজর সরিয়ে তীক্ষ্ম চোখে দেখে নিচ্ছে বেগমকে। বেগম ঘুমিয়ে পড়লে ধমকে উঠিয়ে আবার আঁকছেন। এ যেন অঘোষিত কোনো অত্যাচার। ছবি প্রায়ই সম্পূর্ণ। ঠিক যেভাবে সে টুলে বসে আছে সেভাবেই আঁকছেন। তবে বেগমকে পরিপূর্ণভাবে রঙের মাঝে ফুটিয়ে তোলার পরেও থামলেন না সুলতান। বেগমের শরীর ঘেষে আঁকতে শুরু করলেন কিছু একটা। কিয়ৎ ক্ষণ পেরোনোর পর টুলের ঠিক সাথেই একটি দন্ডায়মান মানব শরীর অঙ্কিত হলো। মানব শরীরটির পোশাক-আশাক বলে দিচ্ছে নিজেকেই আঁকছেন সুলতান। পুরুষটির শরীর মাত্রই কোমর পর্যন্ত আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে এমন সময় ঘুমে ঢুলে টুল থেকে পড়ে যেতে ধরলো বেগম। আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন সুলতান। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে তাকে আগলে নিলো দু’হাতে। বেগমের মাথা গিয়ে ঠেকল তার পেটের খানিক উপরে। ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেছে বেগমের। আধো আধো ঘুমে সে কোথায় আছে উপলব্ধি করতে অক্ষম হলো। চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে। মাথাটা ভালো করে হেলিয়ে দিয়ে সুলতানের শরীরে মুখ গুজে পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো সে। চোখ বড়বড় করে তাকালেন সুলতান। এভাবে ঘুমানোর মতলব এটেছে না কি? সে ধমকে উঠলো মৃদুস্বরে, “ওঠো, আবার চোখ বন্ধ করছো কেন? আমি কি এভাবে তোমাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো সারারাত?”
“থাকুন না সুলতান।”
সর্বনাশ করেছে! তার সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে! তার মন যেন বেগমকে অনুকরণ করেই বলে উঠছে, ‘ঘুমাক না সে, একটু দাঁড়িয়ে থাকলে কী এমন হবে?’ অথচ এখন মনের কথা শোনার সময় নয়। নিজের মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হলেও উঠাতে হবে বেগমকে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে গিয়ে রং ছুটে ভরে গেছে তার পোশাক। সেই রং ছুটে গিয়ে লেগেছে বেগমের সফেদ গাউনটাতেও। তাছাড়া না খেয়ে ঘুমালে আবার মাঝরাতে উঠে হাবিজাবি বলবে। আর ভাবলো না সে। আচমকা ঝুঁকে পড়ে পাঁজাকোলে তুলে নিলো বেগমকে। হকচকিয়ে উঠলেন বেগম। চোখ মেলে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে আকড়ে ধরলো তার গলা। কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে হাই তুলতে তুলতে বলে উঠলো, “মন্দ নয়। এভাবেও ঘুমানো যায়। কিন্তু আপনি বেশি নড়াচড়া করছেন।”
বলতে বলতে আবারো চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সে। ইতিমধ্যে রং লেগে তার অত্যাধিক প্রসারিত গাউনটার মাখামাখি অবস্থা। তাকে কোলে তুলতে গিয়ে সুলতানের হাতটাও এখন রঙে রঙিন হয়েছে। আকস্মাৎ কী ভেবে মিটমিটিয়ে হাসলেন সুলতান। এক হাতে তাকে নিজের সাথে আগলে ধরে রংভর্তি হাতটা দিয়ে বেগমের মুখ আঁকড়ে ধরলেন। তাও বেশ জোরেসোরেই। আচমকা পুরো মুখে শক্ত আর ঠান্ডা কিছু অনুভব হতেই ধরফরিয়ে উঠলেন বেগম। ঠেলেঠুলে নেমে গেল কোল থেকে। কিয়ৎ ক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে গেল দেয়ালের সাথে সংযুক্ত বিশালাকার দর্পণটার সম্মুখে। চোখ গোল গোল দর্পণে দেখলো নিজেকে। পুরো মুখ রঙে মেখে আছে। নাকটাও বাদ যায়নি। কী বিদঘুটে লাগছে! আরেকটু হলে তো সে নিজেই নিজেকে দেখে ভয় পেয়ে যেত। এতোটাই বিশ্রি আর ভয়ঙ্কর লাগছে। অধর বিকৃত করে সে ফিরে তাকালো। সুলতান এখনো নিজ দাঁড়িয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে। হাসিটা অটল রয়েছে ঠোঁটজোড়াতে। ফুঁসে উঠলো বেগম। বিরক্ত কন্ঠে বলল, “এগুলো কী করেছেন?”
এগিয়ে আসলো সুলতান। তীক্ষ্ম চোখে তার আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলেন, “কই কী করেছি? ভালোই তো লাগছে।”
মুখে এসব বললেও তার মুখশ্রীতে রসিকতার ছাপ। সহ্য হলো না বেগমের। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো, “সুন্দর তো লাগবেই। আমার মুখে কার ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন?”
“আমার ছাড়া আর কার?” সোজা স্বীকারোক্তি সুলতানের।
ঝাঁঝালো স্বরে কিছু বলার ইচ্ছা জাগলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো বেগম। এই মানুষটাকে কিছু বলে লাভ নেই। তার কর্ম সে করেই যাবে। গটগট করে বাইরে যেতে ধরলো সে। আৎকে উঠলেন সুলতান। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “আরেহ! এভাবে কোথায় যাচ্ছ? মানসম্মান আর কিছু রাখবে না দেখছি।”
ঘুরলো বেগম। চোখ ছোট ছোট করে অবাক কন্ঠে শুধাল, “এখানে মানসম্মানের কী হলো?”
“তোমার মুখের কথা নাইবা বললাম। পোশাকের দিকেও তো একবার দেখো।”
ভ্রু কুচকালেন বেগম। পোশাকে আবার কী হলো? সে তো নতুন পোশাক পরেই বসেছিল। সফেদ রঙা গাউনটার দিকে চাইতেই চক্ষু যেন চড়কগাছ। সফেদ গাউন আর সফেদ নেই। বারো মিশেলে রঙের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে সফেদ বর্ণকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলো সুলতানের পোশাকেরও একই অবস্থা। মস্তিষ্কে সামান্য জোর দিতেই উপলব্ধি করে নিলো এই অঘটনের কারন সে নিজেই। তার ঘুমই দু’জনের পোশাক নষ্টের কারন। আচমকা কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে কপাল কুচকাল সে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তড়িৎ বেগে সব ফেলে বলে উঠলো, “তোহফা কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“তোমার মতো অলস নয় আমার মেয়ে। সে খেলা করছে ফাইয়াজের সঙ্গে।”
“ফাইয়াজ?” ভ্রু কুচকাল বেগম।
“ফয়েজের ছেলে।”
বুক চিরে হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো সুলতানের। সে তার দাদাজানের সঙ্গে সন্ধ্যার আগে এসেছে মহলে। মাহতাব তাকে জানিয়ে গেছে। বৃষ্টির কারনে আর তাদের যেতে দেওয়া হয়নি। বাচ্চাটা খুব মায়াবী অথচ ভাগ্য তাকে এতিম বানিয়ে দিলো। এতো ছোট্ট বয়সে ছিনিয়ে নিলো তার পিতাকে। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই হতাশার ছাপ মুছে গিয়ে চিন্তার ছাপ দেখা দিলো সুলতানের মুখে। দ্রুত বেগমের দিকে এগিয়ে এসে বললো, “সেদিন কি তোমাকে ফয়েজ নিয়ে গিয়েছিল পাহাড়ে?”
মুহুর্তেই যেন বদলে গেল কামরার পরিবেশ। রোমাঞ্চকর, আবেশি ভাবাবেগ পরিবর্তন হয়ে থমথমে হলো দু’জন মানুষ। মস্তিষ্কে ফয়েজ নামটা উদিত হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেগম। ফয়েজের মৃত্যুর খবর সে জানে। যেদিন ফয়েজের মৃত্যু হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে সেদিনই এই মহলে সে তোহফার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। বুবু বাড়ি ছিলো না দেখে সেই সুযোগে এখানে এসে আবার দ্রুত ফিরে গিয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে মাহতাব দেখে নিয়েছিলো তাকে। কিন্তু চিনতে পারেনি তাকে। একটুর জন্য সেদিন বুবুর কাছে ধরা পড়েনি সে। বাড়ি গিয়ে পোশাক বদলে বারান্দায় দাঁড়াতেই ফটক দিয়ে প্রবেশ করেছিলো জারনাব। তবুও একটা কিন্তু থেকেই যায়। সে যখন কারাগারের সামনে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছিল। তখন সেখানে কোনো সৈনিক ছিলো না। ফয়েজ তাকে দেখে চিনে ফেলেছিল। তাকে বেঁচে থাকতে দেখে খুশি হয়েছিল সে। ব্যস্ত হয়ে তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কারোর আসার শব্দ পেয়ে তাকে ততক্ষণাৎ চলে যেতে হয় সেখান থেকে। আফসোস! সেদিন চলে না এসে ওখানে থাকলে হয়তো আজ বেঁচে থাকতো ফয়েজ!
“বলো? ফয়েজ নিয়ে গিয়েছিল তোমাকে?”
“হ্যাঁ, ফয়েজ আমাকে সেদিন কিছু বলতে চেয়েছিল। কোনো শত্রুর ব্যাপারে। কিন্তু পাহাড়ে যেতেই হঠাৎ কেউ একজন এসে বলেছিল ফয়েজের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেক খুব ভালোবাসতো ফয়েজ তাই ছুটে এসেছিল। কিন্তু আমি ওখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এসেছি যখন একটু দাঁড়িয়েই যাই কিন্তু হুট করে একজন এসে আক্রমণ করে বসলো আমার উপর। আমি যতদূর জানি ফয়েজ কোনো শত্রুর ব্যপারে জেনে গিয়েছিল। আর সেই কারনেই তার জীবনটা সে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত প্রাণটাও দিতে হলো।”
“তাহলে এতবার জানতে চাওয়ার পরেও ফয়েজ আমাকে কেন বললো না তার নাম? নিজ হাতে কতো অত্যাচার করেছি তবুও বলেনি। কেন? তোমাকে বলতে পারলে আমাকে কেন বলতে চাইল না সে?”
উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন সুলতান। ফয়েজ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এ কথা সে কখনোই মানতে পারেনি, না তো তার মৃত্যুকে মেনে নিতে পেরেছে। তাকে আশ্বস্ত করলো বেগম, “উত্তেজিত হবেন না সুলতান। এভাবে উত্তেজিত হয়ে আবেগি হয়ে শত্রুকে শনাক্ত করা যাবে না। আমি শুধু এটাই ভাবছি যে আমি বেঁচে আছি, মহলে ফিরেছি নিশ্চয়ই শত্রু জেনে গেছে এতোক্ষনে। তারপরেও সে এত নীরব কেন?”
“সে নীরব নেই এলি। সুযোগ খুঁজছে, মোক্ষম সুযোগ। ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে নিজের চাল চালছে বিচক্ষণতার সঙ্গে। মহলের সিন্দুক থেকে নথিপত্র গায়েব। ভাবতে পারছো তুমি! কতদূর এগিয়ে গেছে সে। এসব তারই নতুন কোনো চাল।”
ছোট্ট ফাইয়াজের মুখটা স্মরণে আসতেই হঠাৎ বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল বেগমের মুখটা। দৃষ্টি জুরে নেমে এলো হিং’স্রতা। আচমকা সে শক্ত গলায় বলে উঠল, “ফয়েজের হত্যাকারী যেই হোক না কেন তাকে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম শাস্তি দেবো আমি। ছোট্ট ফাইয়াজের শরীরে যে এতিম তকমা লেপেছে তাকে কখনোই ক্ষমা করবো না, কখনোই না।”
শান্ত দৃষ্টিতেই তার মুখভঙ্গি লক্ষ করলেন সুলতান। অতঃপর হুট করে সিন্দুক খুলে ছোট্ট একটা ছুড়ি এনে বেগমের হাতে দিলো। বেগম অবাক হয়ে কিছু শুধানোর পূর্বেই সে বলে উঠল, “এটা শুধু সাধারণ ছুড়িই নয়। বিশ মিশ্রিত ছুড়ি এটা। সাবধানে রেখো। রক্তের সঙ্গে মিশলেই এই বিষ কাজ করতে শুরু করে দেবে। প্রয়োজন শুধু ছোট্ট একটা ক্ষতচিহ্নের।”
“কিন্তু এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন?”
নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সুলতান। এতোক্ষনে রং শুকিয়ে লেগে গেছে তার হাতে। সে দেয়ালের দিকে ঘুরে থমথমে কন্ঠে বলল, “যদি কখনো, কোনো পরিস্থিতিতে তোমার মনে হয় আমাকে আর ভালোবাসতে পারছো না। অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনায় যদি আমার প্রতি তোমার মনে ঘৃণার জন্ম নেয় সেদিন এই ছুড়ি আমার বুকে গেঁথে দিয়ে চলে যেও তুমি।”
“হঠাৎ হঠাৎ কী হয় আপনার? এসব কেন বলেন?”
“অপ্রাপ্তিতে ভরে যাক জীবন। প্রাপ্তিতে তুমি থাকলেই দিব্যি বেঁচে থাকবো আমি।”
কথাখানা বলেই পোশাক বদলাতে চলে গেল সে। তার কথার আগা মাথা কিছুই উপলব্ধি করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে উঠলো বেগম। হুটহাট সুলতানের কী হয়? মাঝে মাঝেই আজব কথাবার্তা বলে? হয়তো সাম্রাজ্যের চিন্তায়। এই অজানা শত্রু একদম বিষিয়ে তুলেছে তাদের জীবনটা।
বাগানের গাছগুলো দুলছে বাতাসে। দোলনাটাও নিজ ছন্দে হেলেদুলে প্রদর্শন করছে তার কর্ম। বৃষ্টি থেমে গেছে। বড়বড় গাছগুলোর পাতা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি মাটিতে পড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজতে এসেছিল জারনাব। কিন্তু আধভেজা হতেই বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। তার হিজাবটাও পুরোপুরি ভিজে ওঠেনি। হঠাৎ এভাবে বৃষ্টি থেমে যাওয়াতে মনোক্ষুন্ন হলো সে। সাহাদের কথা আজ ভীষণভাবে মনে পড়ছে। হৃদয়ের দহন কমাতেই ভিজতে এসেছিল সে। অথচ বৃষ্টিও আজ হতাশ করলো তাকে। ধুয়ে ফেলতে দিলো না তার দুঃখগুলোকে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সে। বৃষ্টি আজ নাইবা সইলো, অন্ধকারই বিলীন করুক একাকিত্ব। ভেজা দোলনাটাতে বসে চোখদুটো বন্ধ করে উপভোগ করতে চাইল বৃষ্টির পরমুহূর্তের অনুভূতি। উপরে বড় গাছটার পাতা বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়লো তার চোখের উপর। কিঞ্চিত স্বস্তি অনুভব হলো বোধহয় এতটুকুতেই। অথচ তার এই সামান্য প্রশান্তিও যেন সহ্য হলো না প্রকৃতির। আকাশে গর্জে উঠলো মেঘের উচ্ছ্বাস। চমকাল জারনাব। তবে নড়লো না কিঞ্চিত পরিমাণ। সে যেন পণ করে নিলো আজ একাকিত্ব ঘুচিয়ে তবেই যাবে। তাতেও বাঁধ সাধলো একটি পুরুষালি কন্ঠস্বর। ঠিক তার পেছনে বাগানের ফটকের সামনে থেকে কেউ খুব রাশভারি কন্ঠে ধমকে উঠলো, “এই মেয়ে, কে তুমি? বাগানে কী করছো? জানো না, বাগানে সাধারনের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটা কেবলই মহলের বাসিন্দাদের জন্য। সেবক-সেবিকাদেরও এখানে আসতে হলে অনুমতি নিয়ে আসতে হয়। আর তুমি কি-না সাধারণ হয়ে বাগানে ঢুকে পড়েছো?”
একটানে কথাটা বলে থামলো কন্ঠটা। তবে সে যে ক্রমেই বাগানের ভেতর দোলনার দিকে এগিয়ে আসছে তা তার পদধ্বনিই বলে দিচ্ছে। হুট করে এমন কথাতে লজ্জিত হয়ে পড়লো জারনাব। সামান্য অপ্রস্তুত বোধও করলো বটে। সে ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে লোকটা তাকে না চিনেই এগুলো বলেছে। নাহলে হয়তো বেগমের অতিথিকে এমন করে বলার সাহস তার হতো না। গটগট করে তার দিকে এগিয়ে এলো পুরুষটা। তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে খানিক বিচলিত হলো বোধহয় সে। ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে পুনরায় রাগান্বিত স্বরে বলে বসলো, “উত্তর দিচ্ছো না কেন? সৈনিক প্রধানের প্রশ্ন অবজ্ঞা করার শাস্তি জানো তুমি? একেতো অভদ্রের মতো অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করেছো তার উপর আমার প্রশ্ন উপেক্ষা করছো।”
এবার আর ধৈর্য ধারণ করতে পারলো না জারনাব। ততক্ষণাৎ ঘুরে তাকালো সে। মহলের মৃদু আলো এসে লাগছে তাদের মুখে। ভ্রু কুচকে তাকালো জারনাব। তার সম্মুখেই বলিষ্ঠদেহি একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে বীরের বেশে। হাতে তলোয়ার। চোখের পাপড়ি বেয়ে টপ করে পানি এসে পড়লো তার অধরে। মনোযোগ দিয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো জারনাব। আচমকা হতবাক স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো, “আজমাইন!”
হতভম্বের ন্যায় হাঁ করে চেয়ে আছে মাহতাব। এতোগুলো বছরে কিশোরী চেহারায় পরিবর্তন এসে যুবতী হয়ে উঠলেও তাকে চিনতে বিন্দুমাত্র কসুর করতে হলো না তার। কতগুলো বছর পর আবার আজমাইন ডাকটা শুনে যেন থমকে গেছে সে। এই নামে শুধু তাকে দু’জন মানুষই ডাকে। তার আব্বাও তাকে আজমাইন নামেই ডাকতো। হাত গলিয়ে তলোয়ার নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলল। সচকিত হয়ে উঠলো মাহতাব। কিছু সময় পেরিয়ে যাবার পরেও হতবাক তার অভিব্যক্তি। বিচলিত হলো জারনাব। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “দুঃখিত! আপনাকে আমার পরিচিত কেউ ভেবেছিলাম। অনেকদিন দেখা হয় না তো তাই হয়তো চিনতে ভুল করেছি।”
“তুমি ভুল করোনি জুঁই।”
পাওয়া, হারানোর এই খেলায় কেউ হয়তো জিতে যাবে। কেউবা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হবে। ভালোবাসা আর প্রতারণার এ সমীকরণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার হিসেব নেই। প্রিয় মানুষকে নিজের করে নিতে পাপ করতেও দ্বিধা নেই। অন্ধ করে দেয় যে এ প্রণয়। জন্মগত অন্ধ রাস্তার পরিমাপ করতে জানলেও প্রণয়ে অন্ধরা কোনো পরিমাপ জানে না। তাদের নিকট প্রিয় মানুষটাই যেন সর্বসুখের আঁধার। ভালোবাসা পেতে নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্ট পথ বেছে নিতেও পিছপা হয় না প্রেমিকেরা। রাতের এ সময়টাতে মহলের বন্ধ কামরায় কেউ ভালোবাসার আবেশে জর্জরিত, হৃদয়ে অজস্র প্রণয় থাকা স্বত্বেও দৃষ্টিতে হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক। কেউবা খোলা বাগানে বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় করে সম্মোহনী দৃষ্টিতে অবলোকন করছে প্রিয় মানুষটাকে। অথচ বিপরীত মানুষটার হৃদয় জুড়ে অন্য কারোর আনাগোনা, সে কথাও তার জানা নেই। ভালোবাসলে কি আর এতোকিছু জানার আগ্রহ থাকে?
শাহ নদীর পার বেয়ে সাজানো রয়েছে সারি সারি বাণিজ্যিক জাহাজ। নদীর পানিতে উত্তাল ঢেউ বইছে অবিরত। তার মধ্যেই কোনো এক জাহাজের ভেতরে অবস্থান করছে সদ্য হৃদয় ভাঙা প্রেমিক। এই শীতল রাতেও ক্লান্ত তার দু’চোখ। এলোমেলো চুলগুলো
কঠিন করে সাক্ষী দিচ্ছে তার বেদনার। তার হৃদয় ভঙ্গের বিকট শব্দ বুঝি শুনতে পাচ্ছে প্রকৃতি। তাইতো সে বৃষ্টি ঝরিয়ে শীতল করতে চাইছে তার ক্ষত। শান্ত মানুষটা হঠাৎ করেই যেন নিঃশ্ব হয়েছে, হারিয়েছে বেঁচে থাকার আগ্রহ। ঢুলতে ঢুলতে সে এগিয়ে গেল জাহাজের কিনারায়। রক্ত লাল চোখে উত্তাল পানির দিকে চেয়ে আচমকা মাথার টুপিটা খুলে ছুড়ে মারলো সেখানে। ক্ষুধা মিটল না বুঝি নদীর। আস্ত মানুষটা যখন আছড়ে পড়লো পানির বুকে তখনও উত্তাল তার ঢেউ। শুধু ঝুপ করে একবার শব্দ হলো পানির মাঝে তারপরেই সব নীরব। স্তব্ধ চারপাশ।
চলবে………
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_21
সকাল সকাল মহলের ভোজনকক্ষে বিশাল আয়োজন। সেবিকারা সুবিশাল টেবিলটাতে শতাধিক পদের খাবার সাজিয়ে রেখেছে। একে একে ভোজনকক্ষে প্রবেশ করলো ওয়াসিফা সুলতান, শেহজাদি তানহা, আব্দুর রহমান, জারনাব। সুলতান শাহজিল সাম্রাজ্যে নেই। সে নিজের কিছু ব্যক্তিগত কাজে বাইরে কোথাও গিয়েছে। সারি সারিভাবে গুছিয়ে রাখা কারুকার্যমণ্ডিত কাঠের কেদারাগুলোতে বসে পড়লো তারা। টেবিলের একপাশে বসেছে ওয়াসিফা সুলতান এবং শেহজাদি তানহা। সবসময়ের মতোই তাদের ভেতর কোনো কথোপকথন হচ্ছে না। অপর পাশে বসা আব্দুর রহমান খানিক ইতস্তত করছে। সে এখানে আসতে চায়নি। জোভিয়া জোর করে বসিয়ে দিয়ে গেছে। তার পাশে বসেছে জারনাব। আব্বাজানের মুখভঙ্গি দেখে সে চিন্তিত স্বরে শুধাল, “কী হয়েছে আব্বা? শরীর খারাপ লাগছে?”
ওয়াসিফা সুলতান এবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তাদের দিকে। তাচ্ছিল্য করলো না তবে খুব একটা খুশিও সে হয়নি। তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট বিরক্তি। শেহজাদি তানহা নির্বিকার। তানহার এসব ধনী-গরিব, বংশ মর্যাদা নিয়ে কস্মিনকালেও কোনো সমস্যা ছিলো না। আত্মীয়কে আত্মীয়ের মতোই সে দেখে। তবে তার আম্মার আবার এসব নিয়ে খুঁতখুঁত করা অভ্যাস। শুধু এসব নিয়ে হবে কেন? সে তো নিজের কন্যাকেও মূল্যায়ন করে না। তার আব্বাজানের যেমন যুদ্ধ আর দ্বন্দ্ব ব্যতীত পুরো পৃথিবী শূন্য ঠিক তেমনি তার আম্মার পুত্র আর সাম্রাজ্য ব্যতীত সবকিছু শূন্য। সে আড়চোখে একবার দ্বারের দিকে তাকালো। তখনই সেখানে প্রবেশ করলো এলিজা সুলতান। তার কোলে তোহফা চুপ করে শুয়ে আছে। সবার কোলে গিয়ে লাফালাফি করলেও সে নিজের আম্মার কোলে গেলে একেবারে শান্ত বাচ্চা হয়ে যায়। টেবিলের সবাইকে একবার দেখে নিয়ে টেবিলের একদম শেষ প্রান্তে নিজের জন্য নির্ধারিত বিশাল রাজকীয় কেদারায় গিয়ে বসলো সে। কেদারাটাও বুঝি এতোগুলো দিন পর পুনরায় নিজের মালিককে পেয়ে অহংকারী হয়ে উঠেছে। দ্বারের বাইরে পাহাড়ারত সৈনিক উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “মহামান্য সুলতান শাহজাইন শাহ।”
সচকিত হয়ে বসলো সকলেই। কামরায় প্রবেশ করলো সুলতান। সোজা গিয়ে নিজ কেদারায় গিয়ে বসে হাত বাড়ালো তোহফার দিকে। অমনি দৌড়ে এলো তোহফা। সুলতানের পাশের কেদারায় বসে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। ভ্রু কুচকে তাকালেন বেগম। মেয়ে তো দেখি আব্বাজানের ভক্ত হয়েছে! সুলতান তাকে কোলে উঠিয়ে খাওয়াতে শুরু করলেন। আড়চোখে একবার তাকালো বেগমের দিকে। অমনি মুখ ঘুরিয়ে নিলো বেগম। নিজ মনেই হাসলেন সুলতান। আফসোস করলেন দু’জনের কেদারার মাঝে এতো দূরত্বের কারনে। এসব কেমন নিয়ম! কেদারার মাঝে এতো দূরত্ব কেন হবে? একজন আসমানে তো একজন জমিনে!
ওয়াসিফা সুলতান হুট করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, “শাহজাইন।”
“জি, আম্মা। বলুন।”
“আজ তোমার মামা আসছে। যেখানেই যাচ্ছ, দ্রুত ফিরে আসার চেষ্টা করো।”
চমকে উঠলো সুলতান। মামা! লোকটাকে একদম পছন্দ নয় তার। আম্মার চেয়ে দু’বছরের বড় তার মামা। কিন্তু স্বভাব-চরিত্র একেবারেই ভালো নয়। শুধুমাত্র বংশের জোরে টিকে আছে। তবুও হাসিমুখে বলল, “ঠিক আছে, চেষ্টা করবো।”
তোহফা চুপচাপ সুলতানের হাতে খাচ্ছে আর নিজের হিজাব ধরে টানাটানি করছে। এটা তার অভ্যাস। সবসময় হিজাবটাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা। আবার কখনো তানহার দিকে তো কখনো জারনাবের দিকে চেয়ে হাত নাড়াচ্ছে, নিঃশব্দে হাসছে। তানহা এখনো আড়চোখে চেয়ে আছে দ্বারের দিকে। তড়িৎ বেগে দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলো মাহতাব। সোজা গিয়ে বসে পড়লো জারনাবের পাশের কেদারায়। খানিক হকচকিয়ে উঠলো জারনাব। মুহুর্তেই নিজেকে সংবরণ করে নিলো সে। সুলতান অবাক কন্ঠে শুধাল, “মাহতাব! তোমাকে তো জোর করেও ভোজনকক্ষে আনা যায় না। আজ এত সুবুদ্ধি কীভাবে হলো?”
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালো মাহতাব। আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, এমনিই।”
“আবার মানে মানে করছো! তোমার কথা পিছলে যাচ্ছে। কিছু হয়েছে?”
মাহতাব আমতা আমতা করে কিছু বলার পূর্বেই খেঁকিয়ে উঠলো বেগম, “সবসময় এতো প্রশ্ন করেন কেন? বেচারা খাবে না কি বসে বসে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে?”
দমে গেলেন সুলতান। আসলেই তো! খাওয়ার সময় এতো প্রশ্ন করা ঠিক নয়। সে চুপচাপ নিজের খাবারে মনোযোগ দিলেও আড়চোখে চেয়ে থাকলো তানহা। হাঁসফাঁস করছে অস্বস্তিতে। তার পাশেও তো ফাঁকা কেদারা ছিল। ওখানে বসার কী প্রয়োজন? সকলের আড়ালেই মাহতাবের দিকে তাকালো জারনাব। ফিসফিসিয়ে বলল, “তুমি এখানে বসেছো কেন? সবাই কী না কী ভেবে বসবে।”
ঠোঁট চেপে হাসি দমালো মাহতাব। মেয়েটা আগের মতোই ভিতু আছে এখনো। সে ঠাট্টার স্বরে বলল, “কেন? ভয় পাচ্ছ তুমি?”
“তুমি আমার পুরনো বন্ধু, প্রেমিক নও। ভয় পাবো কেন? আমি একদমই ভয় পাচ্ছি না।”
“তাহলে এতো কথা না বলে চুপচাপ খাও।”
কথা বাড়ালো না জারনাব। চুপচাপ খাবারের লোকমা মুখে তুলল। এখানে যে আজমাইনকে পাবে তার ধারণাও ছিলো না। দক্ষিণী সাম্রাজ্যে তাদের ঘরের পাশেই আজমাইনদের ঘর ছিলো। সেই সূত্রে ছোট থেকেই তাদের মধ্যে একটা বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। আজমাইনের পিতা অন্য কোনো সাম্রাজ্যের সৈনিক ছিলো। কোন সাম্রাজ্য তার জানা নেই। তবে ছোট থেকেই আজমাইনের খুব শখ ছিলো বড় হয়ে সেও পিতার মতো সৈনিক হবে। আজ সে সৈনিকদের প্রধানের সম্মান পেয়েছে। ছোট থেকেই সে একটু ভিতু। সকলের সাথে মিশতে পারতো না। আজমাইনই ছিলো তার একমাত্র বন্ধু। কিন্তু হুট করে আব্বাজান তাকে নিয়ে সাম্রাজ্য ত্যাগ করলো। আজমাইন তখন মক্তবে ছিলো। তাকে জানানো হলো না সে চলে যাচ্ছে। তারপর তো এখানে এসে তার বিবাহ হলো, বিধবাও হয়ে গেল কয়েকদিনের ব্যবধানে। আব্বা অসুস্থ হলো। দোকানের ভার সে নিজের কাঁধে তুলে নিলো। এতোকিছুর মাঝে কখনোই আর আজমাইনকে খোঁজা হয়নি। আজমাইন কীভাবে এই সাম্রাজ্যের সৈনিক প্রধান হলো তার জানা নেই। তবে সে যদি আগে জানতো তাহলে হয়তো আরো আগেই তাদের দেখা হতো। সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে আচমকা খাবার গলায় আটকালো। কেশে উঠলো সে। দ্রুত নিজের কেদারা ছেড়ে এগিয়ে আসতে চাইলো বেগম। চিন্তিত তার মুখভঙ্গি। তার পূর্বেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো মাহতাব। হন্তদন্ত হয়ে নিজের পানির পাত্র এগিয়ে ধরলো জারনাবের মুখের সম্মুখে। জোর গলায় বলল, “পানি খাও জুঁই।”
পানি খেয়ে জারনাবের কাশি থামলেও উপস্থিত সকলের কৌতূহল বাড়লো। ওয়াসিফা সুলতান ব্যতীত সকলেই আগ্রহী নয়নে চেয়ে আছে। বেগম তো হতবাক স্বরে বলেই বসলো, “জুঁই! বুবু তোমার নাম জুঁই কবে হলো?”
বিপাকে পড়লো জারনাব। অপ্রস্তুত হেসে বলল, “আমার নামটা একটু বড় তাই আজমাইন সবসময় জুঁই বলেই ডাকে।”
“আজমাইন!”
অবাক কন্ঠ সুলতানের। কিয়ৎ ক্ষণ পেরোতেই সে পুনরায় বলে উঠলো, “ওহ, আজমাইন তো মাহতাবের নাম। কিন্তু এ নামে তো ওকে কেউ ডাকে না।”
“আমি এই নামে ডেকেই অভ্যস্ত।” নত কন্ঠ জারনাবের।
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো তানহা। হঠাৎ করে বলে বসলো, “অভ্যস্ত মানে? তোমাদের পরিচয় তো কাল-পরশু হলো মাত্র, তাই না?”
অসহায় হলো জারনাবের মুখভঙ্গি। একসাথে সবার এতো প্রশ্ন! বেগম পুনরায় কিছু শুধানোর পূর্বেই থামিয়ে দিলো মাহতাব। কিঞ্চিত উচ্চস্বরে বলল, “আমি বলছি সবকিছু।”
অতঃপর আবার সব নীরব। সকলের উৎকণ্ঠ বৃদ্ধি পেলো। মাহতাব গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করলো সবকিছু। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে শেষ করলো তার বক্তব্য। সকলে নিজেদের উত্তর পেয়ে গেলেও উদ্বিগ্ন দেখালো তানহাকে। আচমকা কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সম্পূর্ণ খাবার পড়েই আছে এখনো। কিছুই খায়নি সে। বেগম উত্তেজিত স্বরে বলল, “কী হলো তানহা? খাবে না তুমি?”
“না ভাবি, তোমরা খাও। ক্ষুধা নেই।”
“অল্প কিছু খাও। খাবার রেখে এভাবে যেতে নেই।”
“পরে খাবো।”
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্বারের দিকে পা বাড়ালো সে। পেছন পেছন ছুটে গেল তোহফা। ঘুরলো তানহা। মিষ্টি হেসে তোহফাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না মাহতাব। চুপচাপ খাবারের লোকমা মুখে তুলল। মেয়ে না খেয়ে চলে গেছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ওয়াসিফা সুলতানের। জারনাব আগা-মাথা কিছু উপলব্ধি করতে না পেরে খাবারে মনোযোগ দিলো।
“ফাইজা।”
বেগমের ডাক পেয়ে দৌড়ে এলো ফাইজা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল টেবিলের পাশে।
“খাবারটা দিয়ে এসো শেহজাদির কামরায়। আনাবিয়ার হাতে বুঝিয়ে দেবে। শেহজাদির যখন ইচ্ছে হবে সে খেয়ে নেবে।”
মাথা নাড়িয়ে দ্রুত খাবার নিয়ে ছুটল ফাইজা। সন্তুষ্ট নজরে বেগমকে পর্যবেক্ষণ করলো সুলতান। আর পাঁচটা সাধারণ ভাইয়ের মতো নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার সুযোগ না পেলেও বোনের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা। আম্মার অনাদরে এমনিতেই তানহা একটু খিটখিটে হয়েছে। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না ঠিকমতো। শাশুড়ির দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকালো এলিজা। কেমন এক অদৃশ্য বিষাদে ঢেকে গেল মুখখানি। মায়েরা কেন এমন হয়? সে শুনেছিল মায়েরা না কি মমতার আঁধার হয়, কন্যার পরম বন্ধু হয়। কই? হিসাব তো মিলল না। সে ছোট থেকে বড় হয়েছে কখনো আম্মার খাঁটি ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারেনি। যা ছিলো সবই লোক দেখানো। তার পিতার কারনেই হয়তো অবহেলা করতে পারেনি তাকে। কিন্তু ভালোও তো বাসেনি কখনো। মাইরর জন্মের আগেও নয়, পরেও নয়। এখানে এসেও সেই একই চিত্র। তার শাশুড়ি সবসময় তানহাকে তুচ্ছ করে দেখে। কখনো ভালোবেসে দুটো কথা বলেছে কি-না সন্দেহ। তার তো সৎ মা ছিলো কিন্তু তানহার তো তা নয়। তবুও এতো অনাদর! সে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো একজন ভালো মা হয়ে দেখাবে সে। তোহফাকে কখনো এমন বিশ্রি অনুভূতির সম্মুখীন হতে দেবে না। মায়ের আসল সংজ্ঞা উপলব্ধি করাবে সে।
খাবারের পর্ব শেষ হতেই তড়িঘড়ি করে সৈনিকরা ঘোড়া প্রস্তুত করতে শুরু করেছে। যেতে হবে তো পার্শ্ব সাম্রাজ্যে। মাহতাব সেখানেই ব্যস্ত। প্রধান দ্বারে এসেও বারবার ফিরে যাচ্ছে জারনাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুরেফিরে আবারো এলো সে। চোখে-মুখে ইতস্তত ভাব। দূর থেকেই লক্ষ করলো মাহতাব। সৈনিকদের সব বুঝিয়ে দিয়ে কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে দৌড়ে এলো দ্বারের দিকে। তন্মধ্যে পুনরায় ফিরে যেতে পা বাড়িয়েছে জারনাব। তৎক্ষণাৎ উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো মাহতাব।
“দাঁড়াও।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পা থেমে গেল জারনাবের। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো মাহতাবের দিকে। তার সম্মুখে এগিয়ে এলো মাহতাব। ভ্রু কুচকে বলল, “বারবার এসে আবার চলে যাচ্ছ কেন? কী সমস্যা?”
“তুমি আগেই দেখেছিলে আমাকে?”
“হ্যাঁ, আমিতো আর কানা নই। এখন বলো, কেন এসেছিলে?”
“থাক, পরে বলবো।”
আবারো ভেতরের দিকে পা বাড়ায় জারনাব। তড়িৎ বেগে তার সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো মাহতাব। সন্দেহপ্রবন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “এড়িয়ে যেতে চাইছো আমাকে?”
“আরেহ না! তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার ছিলো। অনেকদিন তো তোমার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ছিলো না। অনেক কথা জমে আছে।”
“ঠিক আছে, এসে সব শুনবো। আজ একদম সময় নেই। ততদিন সাবধানে থেকো।” তাড়াহুড়োর মধ্যে বলল মাহতাব। সৈনিকদের দিকে ফিরে যেতে আবারো কিছু একটা ভেবে ঘুরে তাকালো। কিঞ্চিত বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুমি কি আজকাল সুগন্ধি ব্যবহার করতে শুরু করেছো? প্রবলভাবে আতরের ঘ্রাণ আসছে।”
চমকে উঠলো জারনাব। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলো তার হিজাব থেকে তীব্র সুগন্ধ এসে নাক ধরিয়ে দিচ্ছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে হিজাবের দিকে চাইতেই মনে পড়লো এই হিজাবটার ভাঁজের মধ্যেই সাহাদের আতরের শিশিটা লুকিয়ে রেখেছিল সে। আজ তাড়াহুড়ো করে এটা বের করে পরে ফেলেছে। আতরের কথাটা বেমালুম ভুলে বসেছিল। তবে কি অসাবধানতাবশত কোনোভাবে আতর ঢেলে পরেছে পোশাকের ভেতর? আৎকে উঠলো জারনাব। জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপণে ছুটলো নিজ কামরার উদ্দেশ্যে। পশ্চিমা অনিলে উড়ছে তার গাউন। হিজাব এলোমেলো হলো। তবুও তার ধ্যান নেই। এ যেন নিজের প্রাণভোমরার দিকেই ছুটছে সে! হৃদস্পন্দন থামবে বুঝি আতরের শিশি ঢেলে পড়লে। তার সহসা কান্ডে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মাহতাব। নিস্তেজ তার দৃষ্টি। এ যেন দূরত্বের নতুন কোনো ইঙ্গিত! হুঁশ ফিরতেই তার পেছনে ছূটলো মাহতাব। কিন্তু তার পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। পূর্বেই কামরায় ঢুকে দ্বার আটকে দিয়েছে জারনাব। ব্যস্ত হয়ে কাঠের বাক্সটা খুলতেই আতরের ছোট্ট শিশিটা নয়নে গাঁথলো। আতরের জন্যই বাক্সটা সাথে এনেছে সে। এটা ছাড়া যে এক মুহুর্ত চলে না তার। সাহাদের সুঘ্রাণ তো এই আতরটাই এনে দেয় তাকে। নাহ! ঢেলে পড়েনি আতর। হয়তো কোনোভাবে সামান্য লেগে গিয়েছে হিজাবে। দ্রুত আতরের শিশিটা ভালোমতো এঁটে দিলো জারনাব। শিশিটা বাক্সে বন্ধ করে সস্তির শ্বাস ছাড়তেই শুনতে পেল মাহতাবের চিন্তিত কন্ঠস্বর। আরো একবার বাক্সটাকে দেখে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দ্বার খুলে দিলো।
“কী করছিলে ভেতরে? এভাবে কেউ আসে?” ধমকের সুরে বলল মাহতাব।
“দুঃখিত! হঠাৎ প্রিয় একটা জিনিসের কথা স্মরণ হলো তাই…..”
“তাই বলে এভাবে না বলে কয়ে ছুটে চলে আসবে? ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে একেবারে।”
“তুমি এখনো অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ো আজমাইন।” শান্ত কন্ঠ জারনাবের।
নিজেকে সংবরণ করলো মাহতাব। বড় বড় শ্বাস নিয়ে দমানোর প্রচেষ্টা করলো তার উত্তেজনা। অতঃপর মিহি স্বরে বলে উঠলো, “তুমি আজ আমাকে আরো একবার ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে জুঁই।”
“আগেও ভয় পেতে না কি তুমি? কই, কখনো তো দেখিনি ভয় পেতে? কিশোরকালের সেই ফতুয়া পরা আজমাইন যতটা সাহসী ছিলো আজ এই রাজকীয় পোশাক পরিধান করা সৈনিক প্রধানও ঠিক ততটাই সাহসী রয়েছে।”
“তুমি চলে যাওয়ার পর আমি ভয় পেয়েছি জুঁই। বহুবার ভয় পেয়েছি, যা তোমার অজানা।”
মাহতাবের এ সম্মোহনী কন্ঠকেও অগ্রাহ্য করলো জারনাব। তার মস্তিষ্কে ঢুকলো না এ কন্ঠের গভীরতা। বরং বিস্মিত হলো সে। আজমাইনের আবার কীসের ভয়? নিশ্চয়ই বোকা বানাতে চাইছে তাকে। যেমনটা ছোটবেলায় বানাতো। তাকে বোকা বানিয়ে ভুবন কাঁপিয়ে হাসতো ছেলেটা। যেন বিশ্ব জয় করে নিয়েছে। অথচ আজ ভয় পাচ্ছে! কীসের ভয়?
দেয়ালে লাগানো বিশাল দর্পণটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন সুলতান। মাথার পাগড়িটা ঠিকঠাক করে পরতে পরতে দর্পণের মধ্য দিয়ে তাকালো বেগমের দিকে। পালঙ্কে বসে পা দোলাচ্ছিল বেগম। আচমকা থেমে গিয়ে বলে উঠলো, “কখন ফিরবেন?”
“ভাবছি আর ফিরবো না। ওখানেই একটা সুন্দরী তরুণী বিবাহ করে সংসার শুরু করবো। কী বলো?”
বেগমের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে পেছনে ঘুরলো সুলতান। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো বেগমের দিকে। সে আশা করেছিল বেগমের চোখের কয়েক ফোঁটা অশ্রু। অথচ বেগমের মুখভঙ্গি অত্যাধিক শক্ত। চোখের মণিতে যেন এখনি অগ্নির বর্ষণ শুরু হবে! অতঃপর সে উপলব্ধি করলো তার বাম পাঁজরের হাড় পূর্বের তুলনায় অধিক মজবুত আর শক্ত হয়েছে।
“কেন আমাকে খুনী বানাতে চাইছেন সুলতান? আপনার জীবনে অন্য কোনো নারীর আগমন ঘটার পূর্বেই আমি নিঃশেষ হবো, মিলিয়ে যাবো ধূসর রঙা ছাইয়ের ন্যায়। কিন্তু আমি বিলীন হবার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ধংস করে যাবো আপনার চতুর্দিকের সমস্ত নারীর আত্মাকে।”
পাগড়ি ছুড়ে ফেলে তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে নিলো সুলতান। চোখ বন্ধ করে আবেশি কন্ঠে বলল, “এভাবে কথা বললে আমার আর যেতে ইচ্ছে করে না। আজ থাক, পরে যাবো।”
কপাল কুচকাল বেগম। তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নারাজ স্বরে বলল, “আজকাল আপনি খুব বাহানা বানাতে শুরু করেছেন। নিজের দায়িত্বে ফাঁকিও দিচ্ছেন দেখছি।”
“হ্যাঁ, তো এতে আমার কোনো দোষ নেই। তুমিই দায়ী এর জন্য।” সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি সুলতানের।
“আমি দায়ী!”
“অবশ্যই তুমি দায়ী। এতে কোনো সন্দেহ নেই।”
“সেটা কীভাবে?”
“এতগুলো দিন তুমি দূরে থাকলে সেটা কার দোষ? তোমার। এখন দু’বছরের ভালোবাসা উসুল করতে আমাকে তো বাহানা বানাতেই হবে।”
“আচ্ছা? যুক্তিতর্ক তো ভালোই আয়ত্ত করেছেন। দু’বছরে শাশুড়ি আম্মা ভালোই প্রশিক্ষণ দিয়েছে মনে হচ্ছে।”
চোখ রাঙালেন সুলতান। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বললেন, “আবার আম্মার পেছনে লেগেছো!”
“আমি কখন পেছনে লাগলাম? ছেলে তো মায়ের থেকেই শিখবে। এটা স্বাভাবিক। আর আমিতো গর্ববোধ করি আম্মাকে নিয়ে। কী ভালো ভালো বুদ্ধি বের হয় তার মাথা থেকে! কোনো তুলনায় হয়না। তার মুখ থেকে বেরোনো এক একটা বাক্য শতাধিক মানুষের মাথা ধরিয়ে দিতে সক্ষম। আমিতো বলি, এরপর যুদ্ধ লাগলে আম্মাকে সাথে নিয়ে যাবেন। সে দুই লাইন ভাষণ দিলেই যুদ্ধ পানির মতো থেমে যাবে। সৈনিকরা অজ্ঞান হয়ে গেলে যুদ্ধ করবে কে?”
ধমকে উঠলেন সুলতান, “থামো, সবসময় বদ বুদ্ধি। কাছে এসো।”
অধর বিকৃত করে পাগড়িটা হাতে করে এগিয়ে এলো বেগম। মাথায় ভালো করে বসিয়ে দিতে দিতে বলল, “দ্রুত ফিরে আসবেন।”
সূর্য সবে গগন ভেদ করে তীক্ষ্ম কিরণ ছুড়তে শুরু করেছে। সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে গরমের তীব্রতা। মৃদু অনিলে নড়ছে গাছের পাতা। মহলের সমস্ত কার্যক্রম শেষ করে সুলতান রওনা হয়েছেন পার্শ্ব সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে। সাথে আছে আজমাইন মাহতাবসহ আরো পনেরোজন সৈনিক। সকলের কোমরে চকচক করছে ধারালো তলোয়ার। ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রাখা তির-ধনুক। অশ্ব ছুটিয়ে নিরলসভাবে চলছে তারা শাহ নদীর পাড় বেয়ে। সবার সম্মুখে সুলতান। তার থেকে দু’হাত দুরত্ব বজায় রেখে সামান্য পেছনে মাহতাব। তাদের অনুসরণ করে এগোচ্ছে সৈনিকগণ। নদীর তীর দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে ঘন অরণ্যের দিকে। সুবিশাল অরণ্যের সম্মুখে এসে থামলো সকলে। দু’জন সৈনিক ঘোড়া থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে একবার পর্যবেক্ষণ করে আসলো। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সবাই। অতঃপর আবারো ছুটলো তারা অরণ্যের বক্ষদেশে হারিয়ে যেতে। নির্জন অরণ্য ছেয়ে আছে বৃহৎ বৃহৎ অজানা সব বৃক্ষে। পাতা ঝরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চতুর্দিক। অটবীর কঠিন নিস্তব্ধতা কাটিয়ে কর্ণগহ্বরে এসে ঠেকছে পশু-পাখির ডাক। হঠাৎ সুলতান বলে উঠলেন, “সাহাদ কি আমাদের সৈনিক ছিলো মাহতাব?”
মাহতাব কিয়ৎ ক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো, “এই নামের কোনো সৈনিক ছিলো বা আছে বলে মনে পড়ছে না। হয়তো আপনার পিতার সময়কালে ছিলো।”
“হ্যাঁ, তাও ঠিক। আব্বাজানের সময়ের সৈনিক তোমার চেনার কথাও নয়। আমারো ঠিক মনে পড়ছে না।”
“কিন্তু হঠাৎ এ কথা জানতে চাচ্ছেন কেন মহামান্য? এই সাহাদ কে? আপনি তার খোঁজ করছেন মানে সে নিশ্চয়ই সাধারন কেউ নয়।”
সহসা উদ্বিগ্ন হলো সুলতান। মাহতাব কি জানে না এ ব্যপারে? সে অবাক কন্ঠে বলল, “জারনাব কিছু বলেনি তোমাকে?”
“জুঁই! জুঁইয়ের আত্মীয় হয় না কি? কই, আগেতো কখনো শুনিনি এ নাম!” কিঞ্চিত বিস্মিত কন্ঠে বলল মাহতাব।
চলবে…………