❝সম্রাজ্ঞী❞
❝লিয়ানা লিয়া❞
❝পর্ব:22❞
ভয়াবহ বিষাদ ভর করেছে মহলের আনাচে-কানাচে। তুলনামূলক স্তব্ধতা যেন একটু বেশিই। বৈঠকখানায় বসে আছে মহলের বাসিন্দারা। বেগমের থমথমে মুখশ্রী। যেন রাজ্যের আতঙ্ক ভর করেছে তার চোখে। সুলতান পার্শ্ব সাম্রাজ্যে গিয়েছে আজ প্রায় পনেরো দিন হয়ে যাচ্ছে। কোনো খোঁজ নেই তাদের। এতোগুলো মানুষ যেন হাওয়ায় উবে গেছে! পার্শ্ব সাম্রাজ্য থেকে না তো কোনো বার্তাবাহক এসেছে আর না তো তাদের পাঠানো বার্তাবাহক বার্তা নিয়ে ফেরত এসেছে। এ কয়েকদিনে কত শত সৈনিক যে প্রেরণ করা হয়েছে পার্শ্ব সাম্রাজ্যে, তার হিসেব নেই। কিন্তু আশ্চর্য! কেউ ফিরে আসেনি! ঘন অরণ্য পেরোলেই যেন হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে তারা! আর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। আতঙ্কে কাটছে মহলের বাসিন্দাদের দিন। জারনাব মায়ার দৃষ্টিতে তাকালো বোনের পাংশুটে মুখের দিকে। মেয়েটা নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছে চিন্তায়। আকস্মাৎ নীরবতা কাটিয়ে বেগম থমথমে গলায় বলে উঠলো, “আমি যাবো পার্শ্ব সাম্রাজ্যে।”
“তা কী করে হয়?” নারাজ স্বর ওয়াসিফা সুলতানের।
“কেন হয় না আম্মা?”
“তুমি এই সাম্রাজ্যের বেগম, এই সাম্রাজ্যের সম্মান। তোমার এভাবে না জেনে যাওয়াটা বিপজ্জনক হবে। আমার ছেলে যেখানে, যে অবস্থাতেই থাকুক- সে তোমার কোনো বিপদ মেনে নেবে না। প্রয়োজনে আমি আরো সৈনিক পাঠাচ্ছি।”
হতবাক নয়নে শাশুড়ির দিকে তাকালো বেগম। বেমানান কথাগুলো শাশুড়ির মুখ থেকে শুনে অতিশয় আশ্চর্য হয়েছে সে। মানুষের কতগুলো রূপ হয় তার জানা নেই। তবে শাশুড়ির এ রূপ তার অচেনা, ব্ড্ড অচেনা। কেন যেন হৃদয় নিংড়ে ডাকতে ইচ্ছা হলো আম্মা বলে। নিজেকে সংবরণ করে নিলো সে। আবেগি হবার সময় নয় এটা। সে পুনরায় শক্ত কন্ঠে বলল, “আর কত সৈনিক পাঠাবেন আম্মা? কেউ কি ফিরে এসেছে এ পর্যন্ত? কোনো বার্তা এসেছে? অথচ মানুষটার খোঁজ নেই আজ পনেরো দিন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে হাত গুটিয়ে আর কতদিন বসে থাকবো? আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালেন ওয়াসিফা সুলতান। পুত্রের চিন্তায় সে নিজেও অস্থির। তবে নিজের ভয়, চিন্তা সে নিজের মনেই দাফন করছে। এই পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে হবে তাকে। সবাই ভেঙে পড়লে সাম্রাজ্য দেখবে কে? সুলতানার দায়িত্ব যে তাকে পালন করতেই হবে। অন্যদিকে এলিজার বয়স নেহাতই কম। সে যে ধৈর্য রাখতে পারবে না তা আগে আগেই আন্দাজ করেছিলো। তার উপর মেয়েটা শাহজাইনকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তার জন্য এই উদ্বিগ্নতা অতি স্বাভাবিক। সে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, “কী করতে চাচ্ছো তুমি?”
“আমি আজই পার্শ্ব সাম্রাজ্যে যেতে চাই।”
এতোক্ষন চুপ করে সব কথা শুনছিলো আরো তিনজন মানুষ। জারনাব, তানহা ও ওয়াসিফা সুলতানের ছোট ভাই হাদিদ। সুলতান যেদিন গেছে সেদিনই সে এসেছে। বয়সটা নেহাত কম নয়, প্রায় পঞ্চাশ। কোনো কারণবশত বিবাহ করেনি সে। জারনাব মাহতাব আর সুলতানের জন্য যেমন চিন্তিত তার চেয়েও অধিক চিন্তিত বোনের জন্য। অন্যদিকে তানহার চেহারার রং-ই উড়ে গেছে। সে যেন ভয়ে, চিন্তায় কথা বলতে ভুলে গেছে। চুপচাপ শোনা ছাড়া তার আর কিছু বলার নেই। কিন্তু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো সুলতানের মামা। বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি মেয়ে মানুষ ওখানে গিয়ে কী করবে? যেখানে ছেলে মানুষই ফেরত আসছে না। এতোগুলো সৈনিক গায়েব হয়ে গেল। তোমার কিই বা করার আছে সেখানে গিয়ে? শাহজাইন কি তোমার চেয়ে কম শক্তিশালী? তার হদিস মিলছে না আর তুমি সামান্য মেয়ে মানুষ কী করবে?”
রাগে গজগজ করে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালেন ওয়াসিফা সুলতান। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে সহসা উঠে দাঁড়ালো বেগম। তার চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চস্বরে বলল, “সামান্য মেয়ে মানুষের জন্যই পৃথিবীর আলো দেখতে পেরেছেন। এ নিয়ে কোনো ভাষণ দিতে চাই না আমি। সে ইচ্ছা বা প্রয়াস কোনোটাই আমার নেই। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানো যায় না। তবে সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা শিখে নেন। প্রয়োজন পড়বে। নাহলে দ্রুতই কারাগারের দেয়ালের ফাটল গুনতে হবে। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে কথা বলার জন্য কড়া নিয়ম আছে এই সাম্রাজ্যে। জানেন না বোধহয়?”
“তুমি কি আমাকে অপমান করছো?”
“না, সাবধান করছি। পরে যেন পস্তাতে না হয়।”
রাগে গর্জে উঠলো হাদিদ। ওয়াসিফা সুলতানের দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, “বুবু, তুই কিছু বলছিস না কেন? শুনছিস না তোর ছেলের বউ আমাকে কীভাবে কথা শোনাচ্ছে?”
“ও তো মিথ্যা কিছু বলেনি। তোর কথা বলার ধরণ পরিবর্তন করা উচিত।”
ওয়াসিফা সুলতানের শক্ত কন্ঠে আরো রাগান্বিত হয়ে পড়লো হাদিদ। হনহন করে বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তানহা। এই মামা নামক লোকটাকে তার মোটেও পছন্দ নয়। সবসময় মেয়েদেরকে নিচু করে দেখে। তার আম্মার মাথায় পুত্র-কন্যার বৈষম্যের বীজ এই মানুষটাই বপণ করেছিল। এত বয়স হয়ে গেছে অথচ কথাবার্তায় কোনো মাধুর্যতা নেই। তবে আজ সে খুশি হয়েছে আম্মার কঠিন কন্ঠ শুনে। তার ধ্যান ভঙ্গ হলো আম্মার কথাতে।
“তাহলে তুমি যাবেই?”
“হ্যাঁ।” বেগমের একরোখা উত্তর।
“তবে যাও। আমি নিষেধ করলেও তুমি মানবে না সেকথা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একটা কথা, সৈনিক নিয়ে যেও সাথে।”
“আম্মা, আমি যাই ভাবির সাথে?” হুট করে বলল তানহা।
চোখ রাঙালেন ওয়াসিফা সুলতান। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, “একজন যাচ্ছে, সেই ফেরত আসবে কি-না তার ঠিক নেই আবার তুমি যেতে চাইছ! কখনোই না। একসাথে দু’জনকে পাঠিয়ে দু’জনেরই প্রাণের ঝুঁকি নিতে আমি পারবো না। তোমার ভাবি তো আর আমার কথা শুনবে না। তবে তোমাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না। যাও, নিজের কামরায় যাও।”
মুখটা ভার হয়ে এলো তানহার। নীরবে উঠে বেরিয়ে গেল সে। ওয়াসিফা সুলতান হুট করে জারনাবের দিকে ঘুরে বসলো। কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে চেয়ে থেকে বলল, “তোমারও যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না কি?”
থতমত খেল জারনাব। বুঝলো কী করে! সে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, বোন একা একা যাবে তাই ভাবছিলাম…….”
“তাই ভাবছিলে তুমিও যাবে সাথে তাই তো?”
উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো জারনাব। মুহুর্তেই ধমকে উঠলেন ওয়াসিফা সুলতান, “বাহ! ভালোই! কতো বুদ্ধি তোমাদের! যেমন তানহা, তেমন তুমি। বিপদ এমনিতেই মাথার উপর নাচছে। আর তোমরা সেটা আরো বাড়াতে উঠে পরে লেগেছো! তোমার বোন যুদ্ধ, অস্ত্র বিদ্যা- সবকিছুতে পারদর্শী। তুমি সাথে গেলে উল্টো তার বিপদ বাড়বে তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে। চুপচাপ কামরায় যাও।”
জারনাব অসহায় চোখে তাকালো বেগমের দিকে। বেগম ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে যেতে বললো। জারনাব যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ওয়াসিফা সুলতান। হতাশ কন্ঠে বললেন, “আজকালের মেয়েগুলো একটু হলেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে।”
অতঃপর বেগমের দিকে চেয়ে বলল, “আর তুমি, যেখানেই যাও সাথে সৈনিক নিয়ে যেও। বারবার বলছি নিজের বিপদ বাঁধিয়ো না। অন্তত আমার এই কথাটা শুনে কৃতার্থ করো।”
বাক্য সম্পূর্ণ করেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। তবে নারাজ হলেন না বেগম। আজ শাশুড়ির অন্য এক রূপ দেখেছে সে। শাশুড়ির এই কাঠিন্যতার আড়ালের স্নেহটা উপলব্ধি করতেই মানুষটার সম্পর্কে সমস্ত ধারনা বদলে গেছে। এভাবেও আগলে রাখা যায় প্রিয় মানুষগুলোকে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেও বেরিয়ে এলো বৈঠকখানা থেকে। গোলাকার স্থানটাতে এসে আশেপাশে নজর বোলাতেই নজরে এলো তোহফা। তার ছোট্ট মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনি এই বিষাদ। সে নিজের মতো করে হাসছে-খেলছে। পিতার নিরুদ্দেশ হবার ঘটনা সে আন্দাজও করতে পারেনি। হয়তো ভাবছে তার আব্বাজান কাজে গেছে কোথাও। এগিয়ে গেল বেগম। তোহফাকে কোলে তুলে নিতেই সে শান্ত চোখে তাকালো মায়ের মুখের দিকে। অদৃশ্য বিষাদ বোধহয় উপলব্ধি করতে পারলো সে। মায়ের দু’গালে ছোট ছোট হাতদুটো রাখলো আলতো করে। অধর ছুঁইয়ে দিলো সারা মুখে। এমন বিষাদের দিনেও তৃপ্তির অনিল ছুঁয়ে গেল বেগমের হৃদয়ে। মেয়েকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে বলল, “আম্মু, আমার আম্মু।”
টিপটিপ করে তাকালো তোহফা। মুখে কিছু বলতে না পারলেও ভাসা ভাসা চোখদুটো যেন হাজারটা কথা বলে গেল। ধীরে সুস্থে তাকে নামিয়ে দিলো বেগম। সামান্য ঝুঁকে আলতো চুম্বন করে বলল, “খেলছিলে?”
সঙ্গে সঙ্গে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো তোহফা। জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেন বেগম। তোহফার হিজাবটা ঠিক করে দিতে দিতে বললেন, “আমার আম্মু তো অনেক সাহসী তাই না?”
আবারো উপর-নিচ মাথা দুলালো তোহফা। এবার তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন বেগম। আহত স্বরে বলল, “আমি তোমার আব্বাজানকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি। তুমি নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে তো? এখন মহলে মাহতাব নেই, তোমার আব্বাজান নেই। আমি বড় দুশ্চিন্তায় আছি।”
তোহফা কী বুঝলো কে জানে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলো মায়ের দিকে। বেগম পুনরায় বলল, “একা একা কখনো থাকবে না, ঠিক আছে? সেবিকা বা সৈনিকদের সাথেও নয়। সবসময় খালামণি অথবা ফুফিজানের কাছে থাকবা। কাউকে না পেলে দাদিজানের কাছে থাকবে তবুও একা নয়। খালামণি আর ফুফিজান ব্যতীত কারোর হাতে কিছু খাবে না। কেউ ডাকলে কোথাও যাবে না। রাতে ঘুমানোর সময় খালামণির কাছে বা ফুফিজানের কাছে ঘুমাবে। আমি খুব দ্রুতই তোমার আব্বাজানকে নিয়ে ফেরত আসবো। ততদিন তুমি আমার কথা রাখবে তো?”
দ্রুতবেগে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো তোহফা। হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলো জারনাব। যথারীতি তার পেছনে ফাইজা ছুটে এসেছে। বেগমের কড়া আদেশ তার সাথে থাকতে হবে সবসময়। জারনাবের চোখে-মুখে গভীর চিন্তার আভাস।
“জোভিয়া।”
বুবুর ডাকে মাথা উচিয়ে ধরলো বেগম। তোহফাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো। সামান্য এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমার পাখিটাকে দেখে রেখো বুবু।”
“সে কথা আর তোমাকে বলতে হবে না। তোহফা আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি কি এখনি যাবে?”
“হ্যাঁ, এখনি বেরোব।”
“কিন্তু সকাল থেকে কিছু খাওনি তুমি। এভাবে চলতে থাকলে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। চলো, আগে খেয়ে নেবে। তারপর যেখানে ইচ্ছা যেও।”
চিন্তিত অঙ্গভঙ্গি জারনাবের। গলায় শাসনের স্বর। অগ্রাহ্য করতে চাইল বেগম। নারাজ গলায় বলল, “পরে খেয়ে নেবো বুবু। এখন ক্ষুধা নেই।”
“একদম চুপ। সবসময় বাহানা করবেনা। পরে তোমার জন্য খাবার নিয়ে কে বসে থাকবে? না খেয়ে কোথাও যাচ্ছ না তুমি। দাও, তোহফাকে আমার কাছে দিয়ে খেয়ে নাও।”
কিঞ্চিত পরিমাণ নড়লো না বেগম। নিজ স্থানে অটল রইল। আহত মুখভঙ্গি। রেগে গেল জারনাব। ফাইজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “রন্ধনশালায় যাও আর খাবার নিয়ে এসো। বেশি লাগবে না। সামান্য হলেই চলবে।”
“আহ বুবু! বললাম তো খাবো না।”
জবাব দিলো না জারনাব। শক্ত মুখে স্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার নিয়ে হাজির হলো ফাইজা। সাথে হাফসাও এসেছে পানির পাত্র হাতে। হাত ধুয়ে খাবার মেখে নিলো জারনাব। নিজ হাতে খাবারের লোকমা তুলল বেগমের মুখের সম্মুখে। বেগমের নড়চড় না পেয়ে ধমকের সুরে বলল, “খাও।”
মুখ কালো করে চুপচাপ খাবারটা মুখে পুরে নিলো বেগম। চোখ বড়বড় করে তাকালো তোহফা। হা করে এগিয়ে গেল খালামণি হাতের দিকে। এবার হেসে ফেলল জারনাব। আরেক লোকমা খাবার তুলে দিলো তোহফার গালে। ছোট মুখের চারপাশে খাবার লেগে যেতেই হাত দিয়ে মুছতে গেল বেগম। দ্রুত তার হাত টেনে সরিয়ে দিলো জারনাব। চোখ রাঙিয়ে বলল, “আরেহ! হাত নোংরা করছো কেন? আমি মুছে দিচ্ছি।”
দ্বিরুক্তি করলো না বেগম। বরং আহত দৃষ্টিতে তাকালো বোনের দিকে। পরপর কয়েক লোকমা খাওয়ার পর হুট করে মস্তিষ্কে উদয় হলো সুলতান খেয়েছে তো? গলায় খাবার আটকে গেল তার। ছলছল দৃষ্টি লুকিয়ে পানির পাত্র তুলে মুখে ধরলো। ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে পাত্র রাখতেই আবারো খাবারের লোকমা এগিয়ে আনলো জারনাব। মুখ সরিয়ে নিলো বেগম। ব্যস্ত হলো জারনাব। উত্তেজিত স্বরে বলল, “কী হলো? খাও? এতোটুকু খেয়ে কীভাবে এতদূর যাবে? পার্শ্ব সাম্রাজ্য তো আর কাছের পথ নয়, অনেকটা দূর।”
“আর খাবো না বুবু। জোর করো না।”
তার চোখের না বলা বাক্য যেন উপলব্ধি করে নিলো জারনাব। সে ঠিকই বুঝে নিলো জোভিয়ার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। হতাশার শ্বাস ফেলে সে আবার এগিয়ে দিলো ফাইজার হাতে। খালি পাত্রে হাত ধুয়ে বেগমের উদ্দেশ্যে বলল, “সৈনিক নিচ্ছ তো সাথে? পাকামো করে একা একা চলে যেও না যেন। ভয় করছে আমার। কেউ ফিরছে না। এতগুলো দিনের ভেতর কারোর কোনো খোঁজ নেই আর তুমি সেখানে যেতে চাচ্ছ! না গেলে হয় না?”
“চিন্তা করো না। আমি ঠিকই ফিরে আসবো। কত সৈনিক, গুপ্তচর তো পাঠানো হলো। আর কত হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? জানি না কোন হালে আছে সুলতান। তার কোনো বিপদ না হলে সে অবশ্যই কোনো না কোনো বার্তা পাঠাতো। আমি আর নিতে পারছি না। যেতেই হবে আমাকে।”
বেগমের দৃঢ় কন্ঠে আরোও বিচলিত হয়ে পড়লো জারনাব। ভয় করছে তার, বড্ড ভয় করছে। আজমাইন, সুলতান কারোর কোনো খোঁজ নেই তার ভেতর জোভিয়ার কোনো বিপদ হলে তখন কী হবে? মেয়েটার রাগ এমনিই মাথায় উঠে থাকে। তার মধ্যে সুলতান নেই তার পাশে।
“আমার মেয়েটাকে আগলে রেখো। কাউকে বিশ্বাস করবে না, কাউকে না। চতুর্দিকের হাওয়ায় মিশে আছে শত্রু। সামান্য ভুলও তোহফার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তোহফা কথা বলতে পারে না তবে বোকা নয়। একটু দেখে-শুনে রাখলেই থাকতে পারবে।”
তোহফা কিছু না বুঝে অবুজের মতো চেয়ে থাকলো। তাকে টেনে নিজের কোলে নিয়ে নিলো জারনাব। আশ্বস্ত করে বলল, “তুমি ওকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করবো ওকে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।”
আবারো এগিয়ে গিয়ে তোহফার গালে অধর ছোঁয়ালো বেগম। ছলছল করে উঠলো নয়ন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজের কান্না দমন করলো। কী ভাগ্য তার আর তার মেয়ের! সে নিজে তো কখনো মায়ের আদর-ভালোবাসা পায়নি এখন মেয়েটাকেও সময় দিতে পারছে না। এতো ছোট বাচ্চাকে রেখে বারবার দূরে চলে যেতে হচ্ছে তাকে। সে ধরা গলায় বলল, “সাবধানে থেকো আম্মু।”
প্রধান দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন ওয়াসিফা সুলতান। সে বাইরে গিয়েছিল সৈনিকদের কাছে। সবসময়ে মতোই গম্ভীর স্বরে বললেন, “পাঁচশো সৈনিক যাবে তোমার সাথে। প্রধান ফটকের সামনে সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
কামরায় গিয়ে দ্রুত পোশাক বদলে ফেলল বেগম। কালো গাউনের সাথে অতি সাধারণ একটা কালো হিজাব পড়ে বেরিয়ে এলো সে। কোমরের বন্ধনীর পাশেই বিশাল তলোয়ার। সবাইকে বিদায় জানিয়ে প্রধান দ্বারের দিকে পা বাড়ালো। অমনি ডেকে উঠলেন ওয়াসিফা সুলতান, “তোমার তাজ কোথায়?”
বোধহয় খানিক চমকাল বেগম। শূন্য মাথায় হাত দিয়ে অনুভব করলো কিছুক্ষণ। চোখ-মুখের রং বদলে গেল তার। আমতা আমতা করে বলল, “আছে আমার সঙ্গেই। অরণ্যে প্রবেশের আগেই পরে নেব।”
আরো একবার পেছনে ফিরে তোহফাকে দেখে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। শক্ত তার অঙ্গভঙ্গি। কঠিন দৃষ্টি। আজ সে ঘোড়াকেই বেছে নিলো নিজের বাহন হিসেবে। পাঁচশ সৈনিক সাথে করে ছুটলো নদীর দিকে। শয়ে শয়ে অশ্বের পায়ে পায়ে খট খট শব্দ। যতদূর নজর যায় শুধু বালু আর বালু। অর্ধ সহস্র অশ্বের পদে পদে বালু উড়ছে গগণমুখো হয়ে। তারা চলে যাচ্ছে অথচ পেছনে ফেলে যাচ্ছে ঝাপসা দৃষ্টি আর খুড়ওয়ালা পদচিহ্ন। ক্রমেই তারা এগোচ্ছে অরণ্যের দিকে। শাহ নদীর পাড় পেরিয়ে অরণ্যের সম্মুখে এসে থামলো তারা। আজ আর প্রয়োজন পড়লো না কোনো পরিক্ষা-নিরীক্ষার। সোজা ঢুকে পড়লো অরণ্যের ভেতর। অজানা গাছপালা ডিঙিয়ে এগোতে থাকলো অবিরত। অটবীর মাঝ বরাবর আসতেই থেমে গেল বেগমের ঘোড়া। তাকে অনুসরণ করে থেমে গেল পাঁচশো সৈনিক। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে নেমে দাঁড়ালো বেগম। শক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে অত্যন্ত কঠিন স্বরে বলল, “এখান থেকে বাকিটা পথ আমি একাই যাবো। ঘোড়া নিয়ে মহলে ফিরে যাও তোমরা।”
হতভম্বের ন্যায় চেয়ে থাকলো সমস্ত সৈনিক। একজন বলেই বসলো, “অপরাধ মার্জনা করবেন কিন্তু বড় সুলতানা আমাদের আপনার সঙ্গে থাকতে বলেছেন।”
“ফিরে যাও তোমরা। এটা আমার আদেশ। আম্মা শুধালে বলে দেবে আমি তোমাদের চলে যেতে বাধ্য করেছি।”
“কিন্তু আপনি একা…..”
কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না সৈনিক। বেগম রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইতেই চুপসে গেল সে। মুহুর্তেই মাথা নত করে নিলো। ঘোড়া ঘুরিয়ে আবারো ছুটলো তারা মহলের দিকে। সাথে বেগমের ঘোড়াটাও নিতে হলো তাদের। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে পুনরায় হাঁটতে শুরু করলো বেগম। আম্মা তাকে একা আসতে দিতো না কখনোই। তাই সৈনিক সাথে নেওয়ার এই ছলনাটুকু তাকে করতেই হলো। সে যে বাধ্য। তাকে একাই যেতে হবে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোমরের বন্ধনীর মধ্য থেকে একটি কাগজের টুকরো বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলো। একটি পত্র, হ্যাঁ পত্র। সবাই জানে কোনো বার্তা আসেনি। কিন্তু বেগম জানে বার্তা এসেছে। আজ খুব সকালে পত্র এসেছে বেগমের নামে। যার খবর অন্য কেউ জানে না। পত্রখানায় একবার নজর বোলাতেই অশ্রুরা দলা পাকিয়ে এলো। টপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো পত্রের উপর। পত্রের নিষ্ঠুর লেখনী যেন ভেঙে চুরমার করতে চাইছে তাকে। নিঃশেষ করতে চাইছে তার অদম্য দৃঢ়তা। এই লেখনী পরিচিত তার, অতি পরিচিত।
চলবে……
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_23
দিন দুপুরে স্তব্ধ অটবী। কঠিন নীবরতা ভেঙে ডেকে উঠছে নাম না জানা পাখি। সূর্যের চমৎকার সোনালি কিরণ সরু হয়ে ঢুকছে ডালপালার মধ্য দিয়ে। অরণ্যের মাঝে খুব বেশি আলো প্রবেশ না করলেও স্পষ্ট নজরে আসছে সবকিছু। অরণ্যের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে বেগম। কোমরের বন্ধনীতে স্থান পেয়েছে বিশাল তলোয়ার। কালো হিজাবের একাংশ টেনে বেঁধে নিয়েছে মুখটা। শুধুমাত্র চোখটাই দৃশ্যমান রয়েছে। অদম্য সাহস যেন জ্বলজ্বল করছে আঁখিজোড়াতে। সম্মুখে বিশাল সরোবর। পারপারের জন্য সরোবরে বিছানো হয়েছে কাঠের সাঁকো। এই সরোবর পেরোলেই পার্শ্ব সাম্রাজ্যে পৌঁছে যাবে সে। উদ্বিগ্ন বেগম ছুটে সেদিকে এগিয়ে গেল। কয়েক পা এগোতেই তার পা গিয়ে পড়লো লম্বালম্বিভাবে বিছিয়ে রাখা মোটা দড়ির উপর। চুল পরিমাণ সময় ব্যয় না করে তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে এলো সে। অমনি দড়ির চারপাশ ভরে উঠলো শতাধিক তীক্ষ্ম তিরের ফলা দিয়ে। তির গেঁথে রইল মাটিতে। হতভম্ব হলো বেগম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে উপরে তাকালো। গাছে গাছে ধনুক ঝুলে আছে। আবারো নিচে তাকালো। দড়ির উপর পা পড়তেই সে বুঝে নিয়েছে এটা কোনো ফাঁদ। নতুবা এই অটবীর মাঝে শুধু শুধু এতো মোটা দড়ি কেউ বিছিয়ে রাখবে না। পার্শ্ব সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে পাঠানো সৈনিক আর বার্তাবাহকদের কথা চিন্তা করেই কিঞ্চিত হতাশ হলো সে। তারা কি এই ফাঁদ পেরোতে পেরেছিল? না কি বিদ্ধ হয়েছিল এই তিরের ফলায়?
সহসা নিজের তলোয়ার দিয়ে দড়ি কেটে দিলো বেগম। বাঁকা চোখে তাকালো গাছগুলোর দিকে। অতঃপর নিজের অভিব্যক্তি শক্ত করে হেঁটে গেল সাঁকোর দিকে। এখানেই তো তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরো হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সরোবরের সামনে এসে সাঁকোর প্রথম কাঠটাতে পা রাখলো সে। নজর গিয়ে পড়লো সরোবরের নীলচে পানির উপর। পানি আর নীলচে কোথায়? রক্তবর্ণা ফ্যাকাসে রং ধারন করেছে তা। দূর থেকে লক্ষ করেনি সে। তবে এখন কাছে আসাতে স্পষ্ট দেখতে পেল পানির উপর ভাসছে শত শত সৈনিকের মৃতদেহ। অবহেলায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে লাশগুলো। এ সরোবরে যেন মাছ নয়, লাশের চাষ হয়। আৎকে উঠলো বেগম। যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছালো শুধু লাশ আর লাশ। কারোর বুকে বিঁধে আছে তিরের ফলা, তো কারোর গলা চিরেছে তলোয়ারের ধারালো আঘাতে। কারোর কারোর ফ্যাকাসে শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করেছে। বিশ্রি দুর্গন্ধে নাক সিটকালো না বেগম। পরম মমতাভরা দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো তাদের। সাঁকোর যেই স্থানে সে পা রেখেছে ঠিক তার নিচ বরাবর ভাসছে বার্তাবাহকের প্রাণহীন দেহটা। সেখানে নজর পড়তেই পা পিছলালো বেগমের। দ্রুত পিছিয়ে এসে কাঠ ধরে নিজেকে সামলে নিলো সে। আহত দৃষ্টিতে আরো একবার সেদিকে চাইতেই যেন ফাইয়াজের মতো শতাধিক ছোট্ট ছোট্ট পা দেখতে পেল। পায়ের অধিকারীরা বুঝি ছোট্ট ঠোঁটগুলো নাড়িয়ে চিল্লিয়ে বলছে, “আমার সাথে ইদ করবা না আব্বাজান?”
চোখদুটো খিচে বন্ধ করে নেয় বেগম। এমন নির্মম দৃশ্য যে ভেঙে চুরমার করছে তাকে। আর কত চলবে এই হত্যাকাণ্ড? একজন ফয়েজের খুনীকে এখনো শাস্তি দেওয়া হলো না। অথচ শত শত ফয়েজ আবারো ঝড়ে পড়লো প্রাণহীন হয়ে। আবারো এতিম হলো কতগুলো বাচ্চা তার হিসেব করতে গেলে হয়তো এখানেই অসাড় হবে তার শরীর। কোনোমতে পা টেনে টেনে সাঁকো পেরোলো সে। পার্শ্ব সাম্রাজ্যে পা রেখে কোথাও কোনো সৈনিক না দেখতে পেয়ে কিঞ্চিত বিস্মিত হলো। যতদূর চোখ যাচ্ছে ধু ধু মরুভূমি। একটা গাছপালা পর্যন্ত নজরে আসছেনা। কোনদিকে যাবে আন্দাজ করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে উঠলো সে। দিক্বিদিক ভুলে কয়ক পা এগিয়ে গেল। অথচ কোথাও কোনো মানুষ নেই। সব যেন কেমন নীরব। এতোবড় সাম্রাজ্য আর মানুষের অভাব! বোধগম্য হলো না তার। কিছুক্ষণ নীরবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে পায়ের ছাপ অনুযায়ী হাঁটতে শুরু করলো। অধিকাংশ পদচিহ্ন যেদিকে গেছে সেই পথটাই অনুসরণ করলো সে। কিছু একটা মনে করে ফেলে দিলো নিজের তলোয়ার। হিজাবের মাঝে ভালোভাবে নিজেকে আড়াল করে চলতে থাকলো। বেশ কিছুটা সময় পেরোনোর পরে বাড়িঘর নজরে আসতে শুরু করলো। বাড়িঘর আছে কিন্তু মানুষের কোনো সাড়াশব্দ নেই। আশ্চর্য! সকলে যেন একসাথে ঘুমিয়ে পড়েছে! মহল কোনদিকে জানা নেই তার। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে সে উপায়ও নেই। একটা মানুষও নেই কোথাও। চারপাশ দেখতে দেখতে নিজের আন্দাজমতো ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সে। দু’জন সৈনিক আলাপ করতে করতে তলোয়ার হাতে এদিকেই আসছিল। প্রথমে খেয়াল করেনি বেগম। কিন্তু যতক্ষণে সে খেয়াল করেছে ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। সৈনিকরা দেখে নিয়েছে তাকে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে ছুটে আসতে লাগলো তার দিকে। বড়বড় শ্বাস নিয়ে তাদের প্রাণ নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো সে। সৈনিক দুটো ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু কুচকে ধমকের সুরে শুধাল, “এই মেয়ে, কে তুমি?”
উত্তর না পেয়ে অন্যজন বললো, “কী হলো? কথা বলছো না কেন? সুলতানের আদেশ অমান্য করে বাইরে এসেছো কেন?”
প্রথমজন আবারো বলল, “তোমার কি প্রাণের মায়া নেই? সবাই গৃহবন্দি হয়ে আছে আর তুমি কোন সাহসে বেরিয়েছো?”
বেগম বুঝে গেল যা বোঝার। তারমানে সুলতান উমারের আদেশে সাম্রাজ্যের সকলে গৃহবন্দি হয়ে আছে। বাইরে আসা বারন। এ কারনেই এতো নিস্তব্ধতা চতুর্দিকে। মানুষজন সব ঘরে বসে আছে সুলতানের ভয়ে। কিন্তু কেন? উত্তর নেই তার কাছে। সৈনিক দুটোর ধমকা ধমকিতেও কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করলো না। তাকে নীরব থাকতে দেখে রাগান্বিত হলো সৈনিক দুটো। তেড়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অপরাধ করে আবার মুখ বন্ধ করে মাথা উঁচু করে আছে। এই ধর এটাকে। সুলতানের সামনে নিয়ে গেলে যখন মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেবেন তখন এর শিক্ষা হবে।”
তাকে ধরতে আসলে দুপা পিছিয়ে গেল বেগম। সে একদমই চায় না এরা তাকে স্পর্শ করুক। নিজের অভিব্যক্তি কঠিন করে কিছু বলতে নিতেই পেছন থেকে ভেসে আসে একটি পুরুষালি কন্ঠস্বর।
“তুমি এখানে কী করছো? তোমাকে তো ঘরে থাকতে বলেছিলাম। তুমি আমার একটা কথাও কেন শোনো না বলোতো।”
পরিচিত কন্ঠে চমকে উঠলো বেগম। চকিতে পেছনে ফিরতেই হনহন করে তার দিকে এগিয়ে এলো বণিক। চোখ রাঙিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “আমাকে খুঁজতে আসতে গেলে কেন? বলেই তো এলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরত আসবো। তবুও খুঁজতে চলে এলে।”
হতভম্ব বেগম কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। সে এক বাচ্চার মা জানতে পেরে এই বণিকের মাথায় গন্ডগোল হয়ে গেছে না কি? কী সব বলে যাচ্ছে তখন থেকে। কী আশ্চর্য! আমি কেন তাকে খুঁজতে আসবো! আর সেই বা কখন আমাকে ঘরে থাকতে বলল! বণিকের ভুল ভাঙাতে সে কিছু বলার পূর্বেই একজন সৈনিক বলে উঠলো, “আরে আবরার, তোমাকে তো ডেকেছিলেন সুলতান। রামান সাম্রাজ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে।”
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। মহল থেকেই আসছি। আমি কীভাবে খোঁজখবর বলবো বলো দেখি? আমিতো নিজেই সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি বেশ কয়েকদিন আগে থেকে।”
“কিন্তু এই মেয়েটা কে? তোমার কিছু হয়?” শুধাল সৈনিক।
“ওহ হ্যাঁ, তোমাদের জানানো হয়নি। আমি বিবাহ করেছি। এ জন্যই বাণিজ্য বন্ধ রেখেছি কিছুদিন। আর এইটা আমার স্ত্রী। আমি মহলে যাওয়ার আগে ওকে বলে গিয়েছি তাও দেখো চিন্তিত হয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে।”
“তোমার স্ত্রী! কবে বিবাহ করলে?”
“এইতো, ইদের পরেই।”
কী সাবলীল কন্ঠ বণিকের। অথচ অপর ব্যক্তিটির যে বিস্ময়ে দম আটকে আসছে। চোখ বড় বড় করে সে শুধু শুনে যাচ্ছে। সৈনিক আবারো বলল, “নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। কিন্তু তোমার স্ত্রী অপরাধ করেছে আবরার। ইদের পরে বিবাহ হয়েছে মানে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল তা সম্পর্কে সে অবগত। তবুও সুলতানের নির্দেশ অমান্য করে বাইরে এসেছে।”
“আসলে ও উত্তরীয় সাম্রাজ্যের তো তাই এই সাম্রাজ্যের নিয়ম কানুনের কঠিন বিধিবিধান সে জানে না। এবারের মতো ছেড়ে দাও। ওকে আমি বুঝিয়ে বলবো আর এমন করবে না।”
“তোমার ঘর এই সাম্রাজ্যে, বাণিজ্য করো রামান সাম্রাজ্যে। তাহলে উত্তরীয় সাম্রাজ্যের মেয়ে বিবাহ করলে কীভাবে?” সন্দিহান কন্ঠে বলল সৈনিক।
চির পরিচিত স্বভাব অনুযায়ী মৃদুস্বরে হাসলো বণিক। ঘাড় কাত করে বেগমের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে নেশালো কন্ঠে বলল, “ভালোবাসা সৈনিক ভালোবাসা। কখন, কোথায়, কার উপর হৃদয় আটকে যায় তার ঠিক আছে? হিসেব-নিকেশ করে কি আর প্রেম হয়? হুট করেই হয়ে যায়। প্রমিকের হৃদয় অতীত দেখে না, বর্তমান মানে না। ব্যাস! ভালোবেসে যায়।”
দাঁতে দাঁত চেপে রইল বেগম। বাক্যের গভীরতা নিতে না পেরে দুপা পিছিয়ে গেল বেসামাল হয়ে। বণিক দৌড়ে এসে ধরার পূর্বেই আবার সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। সৈনিক আবারো সন্দিহান গলায় বলল, “কিন্তু মহল তো এদিকে নয়। তোমার স্ত্রী তোমাকে খুঁজতে আসলে এদিকে কী করছিলো?”
“বললাম না ও এ সাম্রাজ্যের নয়। তাই মহল কোনদিকে সেটাও জানে না।”
“ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে, যাও তোমর। আর তোমার স্ত্রীকে ভালো করে বোঝাবে যেন দ্বিতীয়বার আর এই ভুল না করে।”
বণিক দুপা এগোলেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বেগম। শূন্য তার দৃষ্টি। আবারো ফিরে এলো বণিক। তাড়া দিয়ে বলল, “কী হলো? চলো।”
নড়লো না বেগম। ঘোর যেন কাটছে না তার। বণিক এতোক্ষন কী বলল এগুলো! কিঞ্চিত বিরক্তিসূচক শব্দ করলো বণিক। আচমকা তার হাত টেনে ধরে হাঁটতে শুরু করলো। অদূরে কোথাও যেন ঝড় বয়ে গেল। আকস্মাৎ ঘটনায় স্তব্ধ বেগমের কিছুটা সময় লাগলো বুঝে উঠতে। যখনই বুঝতে পারলো সঙ্গে সঙ্গে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। শক্ত করে চেপে ধরে থাকলো বণিক। ফিসফিসিয়ে বলল, “নড়াচড়া করো না। পেছনে সৈনিকরা এখনো আছে। ওরা সন্দেহ করবে।”
তবুও মানলো না বেগম। হাত ধরে টানাটানি করে যাচ্ছে সে। বিরক্ত হয়ে বড় বড় পা ফেলে খানিক এগিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দিলো বণিক। সৈনিকগুলো চোখের আড়াল হয়ে গেছে। চেঁচিয়ে উঠলো বেগম, “হচ্ছে টা কী এসব? অভদ্রের মতো আচরণ কেন করছেন? আমার হাত ধরার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? মরার শখ জেগেছে?”
তাচ্ছিল্য হাসলো বণিক। খানিক উপহাসের স্বরেই বলল, “মরে তো কবেই গিয়েছি আমি।”
থমকাল বেগম। তবে আর কিছু বলল না। অন্য দিকে ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। আবারো পথ আটকে ধরলো বণিক। উত্তেজিত স্বরে বলল, “ওদিকে যেও না। সৈনিকরা পাহাড়া দিচ্ছে পুরো সাম্রাজ্য। তোমাকে দেখে ফেললে ধরে নিয়ে যাবে। বন্ধ করে দেবে কারাগারে।”
“তাতে আপনার কী? দয়া করে আমাকে একা ছেড়ে দিন। অনেক উপকার করেছেন। আর চাই না।”
“তুমি বুঝতে কেন চাইছো না? পুরো সাম্রাজ্যে তোমার জন্য বিপদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখন তোমার এভাবে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো একদমই নিরাপদ নয়। আমার সাথে চলো। গৃহে থেকে তারপর যা হয় করো আস্তে ধীরে।”
“আমি মোটেই আপনার গৃহে যেতে ইচ্ছুক নই।”
“কেন? গরিবের গৃহে যেতে অনীহা না কি সম্রাজ্ঞীর?” খানিকটা বিদ্রুপ করেই বলল বণিক।
“আমি ভালো করেই জানি আপনি একা থাকেন। আর একলা গৃহে একজন পুরুষের সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার জন্য আপনারও বিপদ হবে। তাই এটাই ভালো হবে যে আপনি চলে যান।”
“আচ্ছা? আমার বিপদের কথা ভাবো তুমি? কখনো খোঁজ নিয়েছিলে আমি বেঁচে আছি না কি মরে গেছি? এতোদিনে একটাবারের জন্যও কি ভেবেছো আমার কথা? তাহলে আজ কেন ভাবছো?”
“আমি চাই না আমার জন্য কেউ বিপদে পড়ুক।” উদ্বিগ্ন কন্ঠ বেগমের।
তাচ্ছিল্য হাসলো বণিক। তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলল, “সুলতানকেও চাও না?”
আহত দৃষ্টিতে চাইল বেগম। সামান্য এগিয়ে এলো বণিক। শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “আমি জানি তুমি কঠিনভাবে চাও সুলতানকে। সুলতান শাহজাইন শাহ! তোমার হৃদয়ের পুরুষ। যার জন্য তুমি সেচ্ছাই এই মৃত্যুর ফাঁদে পা দিয়েছো।”
“নিজের স্বামীকে কোন নারী চাই না বলতে পারেন?”
“সে তুমি চাইতেই পারো। আমার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। তবে আমি থাকতে তোমাকে এই বিপদের মাঝে একা যেতে দেবো না। আমার গৃহে চলো। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমি বেঁচে থাকতে তো নয়ই।”
“আমি যাবো না আপনার সাথে। চলে যান আপনি। বারবার একই কথা বলে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলবেন না।” শক্ত কন্ঠ বেগমের।
বিচলিত হলো না বণিক। বরং অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় শান্ত স্বরে বলল, “তাহলে সুলতানকেও বাঁচাতে চাও না তুমি?”
“মানে!” বিস্মিত কন্ঠ বেগমের।
বণিক আবারো বলল, “আমার যতদূর মনে হয় বড় কোনো ষড়যন্ত্র চলছে। মহলেও কেমন গুমোট ভাব। তবে সেখানে আমি সুলতান মানে তোমার স্বামীকে দেখিনি। আমার দৃষ্টির আড়ালেও অনেক কিছু থাকতে পারে। এখন বলো আমি কীভাবে জানলাম তুমি সুলতানকে খুঁজতে এসেছো? তার উত্তর হলো সুলতান যেদিন এখানে এসেছে সেদিন তাকে আমি দেখেছিলাম। তারপরেই এই গৃহবন্দির ঘোষণা। আজ যখন তুমি চলে এসেছো এখানে, তারমানে ঘটনা জটিল। তার উপর এসেছো ছদ্মবেশে। সাথে কোনো সৈনিক নেই, সাধারণ সাজসজ্জা, মুখ ঢেকে রেখেছো। ভীষণ আশ্চর্যজনকই বটে। তোমার স্বামী সাম্রাজ্যে থাকলে নিশ্চয়ই তোমাকে এখানে আসতে হতো না বা সে আসতে দিতোও না। এখানেই তো দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাচ্ছে। মহলে তোমাকে প্রবেশ করতেই হবে। আর কারোর সাহায্য ব্যতীত মহলে প্রবেশ করতে পারবে না তুমি। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। মহলে আমার কিছু পরিচিত কর্মচারী আছে। তাদের সাহায্য নিয়ে তুমি সহজেই প্রবেশ করতে পারবে।”
“কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“আমার গৃহে চলো। সুযোগ বুঝে আমি তোমাকে মহলে নিয়ে যাবো। আর তুমি যদি মানতে না চাও তবে নিজের স্বামীর আশা ছেড়ে দাও। সুলতান উমারের পাহাড়া ডিঙিয়ে কখনোই তুমি তোমার স্বামী অব্দি পৌঁছাতে পারবে না। এ আমি নিশ্চিত। তা সে তুমি যতই বিচক্ষণ হও আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হও।”
“আপনি কিন্তু আমাকে নিখুঁতভাবে হুমকি দিচ্ছেন।”
“এটা হুমকি নয়। এটা তোমার দুর্বলতা। হ্যাঁ, সুলতান শাহজাইন তোমার দুর্বলতা।”
“সে আমার দুর্বলতা নয়। সে আমার শক্তি, আমার আত্মবিশ্বাস।” কঠোর হলো বেগমের মুখভঙ্গি।
আবারো তাচ্ছিল্য হাসলো বণিক। পথ ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে চলে যাও।”
তাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যিই চলে যেতে ধরলো বেগম। পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো বণিক, “তোমার এই জেদের কারনেই হয়তো খুব দ্রুত সুলতানের মৃতদেহ দেখতে হবে তোমাকে।”
তৎক্ষণাৎ পা থেমে গেল বেগমের। অসহায় হলো তার দৃষ্টি। নিজেকে এখন তার দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি মনে হচ্ছে। তবে যথাসম্ভব নিজের অভিব্যক্তি শক্ত রাখার চেষ্টা করলো সে। পিছিয়ে এসে শান্ত স্বরে বলল, “চলুন।”
হাসলো বণিক। নিজের গৃহের দিকে এগোতে এগোতে ভাবতে লাগল এ কোন দিশায় এসে ঠেকল তার জীবন! যাকে ভালোবাসে সে তার ছায়াটাও মাড়াতে চায় না। তার কন্ঠ শুনলে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তার গৃহেও পা ফেলতে চায় না। চতুর্দিকে সে-কী বিষাদ! হৃদয় ভাঙার শব্দ হলো বুঝি ভীষণ জোরে। কষ্ট হলো তার হৃদয় আঙিনায়। অথচ মুখের অভিব্যক্তি কেমন নিষ্ঠুরভাবে স্বাভাবিক হয়ে আছে! সবকিছুই যখন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে সে তখন মৃত্যু কেন কাছে আসছে না? ধরা দিচ্ছে না। সেদিন যখন সে যন্ত্রণায় বেসামাল হয়ে পানির বুকে আছড়ে পড়েছিলো তখনও ভাগ্য সহায় হলো না তার। বেঁচে গেল সে। রাতদিন পানির মাঝে ঘুরতে হয় তাকে। পানিতেই তার আধিপত্য। সেই পানি কি আর তাকে গিলে খায়। ঠিকই উগলে দিলো। সাঁতারে পারদর্শী মানুষটা কীভাবে পানিতে ডুবে মরবে? মৃত্যুর যন্ত্রণা যে খুব কঠিন। সব ভুলিয়ে দেয় সে যন্ত্রণা। সেদিন বেঁচে গেলেও সেই রাতের আঁধারে রামান সাম্রাজ্য ত্যাগ করেছে সে। এতোগুলো দিনের মধ্যে আর ওমুখো হয়নি। নিজের বানিজ্যও গুছিয়ে নিয়েছে রামান সাম্রাজ্য থেকে। ভেবেছিলো আর কখনোই মেয়েটার সামনে যাবে না। যত কষ্টই হোক কাঁটা হয়ে ফিরবে না তার জীবনে। কিন্তু নিয়তি নির্দয়ভাবে আবারো তাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো তার সম্মুখে!
একটি দুই কামরার ছোট্ট দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। ভয়ানকভাবে নিশ্চুপ থাকলো বেগম। ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো দু’জন। আকারে বড় কামরাটার দ্বার খুলে দিলো বণিক। হাত দিয়ে ভেতরে ইশারা করে বলল, “তুমি এখানে থাকতে পারো। গরিবের ঘরে অসুবিধে হবে, একটু মানিয়ে নিও। তুমি ভেতরে গিয়ে বসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
কামরায় একটা কাঠের পালঙ্ক, ছোট্ট একটা টেবিল, মাঝারি আকারের কাঠের বাক্স, আর দেয়ালে ঝোলানো ছোট্ট একটা দর্পণ ছাড়া তেমন কিছুই নজরে আসছে না। তবে একজন থাকার জন্য যথেষ্ট। ধীর পায়ে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো বেগম। বসলো না। উদ্গ্রীব হয়ে বললো, “আমি এখনি মহলে যেতে চাই।”
ঘুরলো বণিক। বলল, “খাবে না?”
“না।” একরোখা উত্তর বেগমের।
“জেদ করো না। এখন যাওয়া যাবে না। কঠিন পাহাড়া বসিয়েছে সুলতান। জুম্মার দিন মহল খানিকটা ফাঁকা থাকে। জুম্মা আসতে আর দেরিও নেই। অপেক্ষা করো একটা দিন।”
“কখনোই না। আমি আজই যাবো।”
বণিক পুনরায় শান্ত কন্ঠে বলল, “রাগ দিয়ে সবকিছু হয় না। তোমার বোঝা উচিত। তাড়াহুড়ো করলে সেটা তোমার বা তোমার স্বামী কারোর জন্যই ভালো হবে না। তারপরেও তুমি যেতে চাইলে রাত পর্যন্ত অন্তত অপেক্ষা করো।”
উত্তর দিলো না বেগম। ধপধপ পা ফেলে পালঙ্কে গিয়ে বসলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাবার জোগাড়। কী করছে সুলতান? কোথায় আছে? কেমন আছে? এতোগুলো সৈনিককে কেন হত্যা করা হয়েছে? কী চলছে এসব এই সাম্রাজ্যে? তার ভাবনার মাঝেই কাঠের বাক্সটা খুলে বসলো বণিক। নীল রঙা গাউনটা বের করে এনে তার পাশে রেখে বলল, “তোমার পোশাকটা নোংরা হয়ে গেছে। ওটা বদলে এটা পরে নাও।”
ভ্রু কুচকে তাকালো বেগম। তার জানা মতে এই গৃহে বণিক একাই থাকে। তাহলে এই মেয়েদের পোশাক কোথা থেকে এলো? দেখে তো একদম নতুন মনে হচ্ছে! তার চাহনির অর্থ বোধহয় বুঝে নিলো বণিক। হতাশার শ্বাস ফেলে বলল, “কিনেছিলাম কারোর জন্য। দেওয়া হয়ে ওঠেনি।”
গাউনটা নিয়ে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো বেগম। কী করছে সে এসব? কোনো পুরুষের পাশাপাশি থাকা তো দূর কল্পনা করলেও হিং’স্র হয়ে ওঠেন সুলতান। অন্য পুরুষের গৃহে অবস্থান করা কী করে মেনে নেবে সে? কখনোই মেনে নেবেন না। তাকে আর বিরক্ত করতে চাইলো না বণিক। বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে। দ্বারে বাইরে গিয়ে হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছু একটা ভেবে নিজেকেই বিদ্রুপ করে উঠলো। তাচ্ছিল্য স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল, “ভালোবেসে শেষ পর্যন্ত নিজের মাতৃভূমিকেও ধোঁকা দিচ্ছি, নিজ সাম্রাজ্যের সুলতানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। প্রতারক আমি! অবশেষে ভালোবাসা আমাকে বিশ্বাসঘাতকের তকমাটাও পাইয়ে দিলো। ভালোবেসে শুধু পাইনি নিজের প্রিয় মানুষটাকে। শুধুমাত্র প্রিয় মানুষটা ব্যতীত দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার- সবই পেয়েছি আমি।”
চলবে…….