#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_24
দিনের শেষ আলোটুকু ফুরিয়ে আঁধার নামতেই সচকিত হয়ে উঠলো বেগম। উদ্গ্রীব হয়ে বেরিয়ে এলো কামরা ছেড়ে। দ্বার খুলতেই বারান্দায় লাগানো কৃত্রিম আলোতে দৃষ্টিগোচর হলো বণিকের মুখটা। দ্বারের বাইরেই কেদারা পেতে বসে ছিলো বণিক। তাকে দেখতেই দ্রুত উঠে এগিয়ে এলো। যেন তারই অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ। এসেছে পর্যন্ত ভেতর থেকে দ্বার আটকে বসে ছিলো বেগম। বণিকের সামনে একদমই পড়তে চায়নি। হয়তো অস্বস্তিবোধ হবে সেই ভয়ে। সারাদিন পর দ্বার খুলেই বণিকের মুখ দেখে দ্বিধান্বিত হলো সে। বণিক স্বাভাবিক কন্ঠেই শুধাল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
“না।” ছোট করে উত্তর দিলো বেগম।
“তাহলে? আমাকে দেখবে না বলে দ্বার আটকে বসেছিলে?”
চমকাল বেগম। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আপনি এতো প্রশ্ন করছেন কেন? ফাঁকা গৃহে একা একটা পুরুষের সাথে থাকলে যে-কোনো নারীই দ্বার আটকে রাখবে।”
“তুমি কি আমাকে ঐ সব পুরুষদের মতো ভাবছো?” ভ্রু কুচকাল বণিক।
“ঐ সব পুরুষ বলতে?”
“নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়ার মতো কাপুরুষ আমি নই। আর সেই নারী যদি হয় প্রিয় কেউ, তাহলেতো তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াব আমি। আর তুমি ভাবছো সুযোগ নেব?” তাচ্ছিল্য স্বর বণিকের।
“আমি ওসব কিছু উদ্দেশ্য করে বলিনি। আপনি বেশি বেশি ভাবছেন।” কাঠ কাঠ স্বরে বলল বেগম। দৃষ্টিতে কীসের যেন চঞ্চলতা। অঙ্গভঙ্গিতে ফুটে উঠছে উত্তেজনা।
চিরপরিচিত নিয়মেই মৃদুস্বরে হাসলো বণিক। কথা ঘুরিয়ে বলল, “ঠিক আছে। চলো, খাবে। সারাদিন খাওনি কিছু।”
“ক্ষুধা নেই।”
“কেন জেদ করছো? সারাদিন না খেয়ে থাকলে সবারই ক্ষুধা লাগে। তাই অযথা মিথ্যা বলো না। আমি পায়েস রান্না করেছি তোমার জন্য।”
“আমার জন্য!”
“হ্যাঁ, তোমার জন্য। আমি অতটা ভালো রান্না পারি না। তবে চেষ্টা করেছি। খারাপ লাগবে না আশা করি।”
কিঞ্চিত বিস্মিত হলেও প্রকাশ করলো না বেগম। ব্যস্ত স্বরে বলল, “পরে খাবো। আগে আমাকে মহলে নিয়ে চলুন। আমি আগে সুলতানকে এক পলক দেখতে চাই।”
বণিকের হৃদয়ের আশেপাশে কোথাও হয়তো মেঘ করেছে। বিজলী চমকাল বেগমের কথায়। সে স্লান হেসে বলল, “খুব দেখতে ইচ্ছে করছে?”
“হ্যাঁ, এক মুহুর্ত না দেখতে পারলে বোধহয় দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো আমি।” আনমনেই বলে বসলো বেগম। কী বলেছে উপলব্ধি করতে পেরেও কথা ঘোরালো না সে। যা সত্যি তাই তো বলেছে। এতো অস্বস্তিবোধ করার কী আছে?
“ঠিক আছে। নিয়ে যাবো কিন্তু আগে একটু খেয়ে নাও।”
হঠাৎ-ই রেগে গেল বেগম। বিরক্ত কন্ঠে বলল, “বললাম না, খাবো না। আগে সুলতানের কাছে যাবো আমি।”
বিচলিত হলো না বণিক। চুপচাপ কেদারা টেনে এনে তার পাশে রাখলো। তাকে বসতে বলে নিজ কামরায় গিয়ে পায়েসের পাত্রটা নিয়ে এসে বলল, “তুমি না খেলে কোথাও নিয়ে যাবো না আমি। ভুলে যেও না আমার সাহায্য ব্যতীত তুমি তোমার স্বামীকে খুঁজে পাবে না। তোমার জন্য এটাই ভালো হবে যে চুপচাপ খেয়ে নাও। আমার কথা যত দ্রুত শুনবে তত দ্রুত তুমি মহলে যেতে পারবে। অন্যথায় ভুলে যাও স্বামীর কথা। সহ্য করো ভালোবাসার মানুষকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা। যেই যন্ত্রণা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি।”
অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো বেগম। চেঁচিয়ে উঠে বলল, “জোর খাটাচ্ছেন? অধিকার দেখাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ দেখাচ্ছি। আর কোনোদিন দেখাতে পারবো কি-না জানা নেই। তাই আজ নিজের আক্ষেপ কিছুটা ঘুচিয়ে নেই।”
সম্মোহনী কন্ঠ বণিকের। খানিক পায়েস তুলে মুখের সামনে ধরে বলল, “হাঁ করো।”
বিরক্ত হলো বেগম। তার একেবারেই সহ্য হয় না অন্য পুরুষের সান্নিধ্য। তরতর করে রাগ উঠে যায়। কিন্তু এই লোকটা অবিরত জোর খাঁটিয়ে চলেছে তার উপর। সে কি জানে তার এই ব্যবহারের জন্য কতোটা অস্বস্তিবোধ করছে অপর পাশের ব্যক্তিটি। ছো মেরে পায়েসের পাত্রটা নিয়ে সে। হাপুস হুপুস করে খানিকটা খেয়ে বলল, “অন্য কারোর হাতে খাই না আমি। দয়া করে আপনি নিজের সীমা অতিক্রম করবেন না।”
যত দ্রুত সম্ভব খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো সে। ব্যস্ত স্বরে বলল, “এবার চলুন।”
বণিক ধীর পায়ে আবারো কামরায় ঢুকে পানির পাত্র নিয়ে এলো। বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “পানিটুকু তো অন্তত খেয়ে নাও। এতো অধৈর্য কেন তুমি?”
বিরক্ত হলেও কিছু বলল না বেগম। চুপচাপ পানিটুকু খেয়ে নিলো। হঠাৎ লক্ষ করলো বণিক একদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। ভ্রু কুচকে সে নিজের দিকে তাকালো। বণিকের দেওয়া নীল গাউনটা পরেছে সে কিন্তু মাথায় সেই কালো হিজাবটাই প্যাঁচানো। নীল গাউনের উপর কোমরের বন্ধনীটা আটকে নিয়েছে। দৃষ্টি সরিয়ে কেশে উঠলো সে। ধ্যান ভঙ্গ হলো বণিকের। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সামনে এগোতে এগোতে বলল, “চলো।”
ফটক পেরিয়ে এগিয়ে চলল তারা। সাথে নেই কোনো লন্ঠন অথবা মোমবাতি। রাতের আকাশে ঝলমল করছে জোৎস্না। চতুর্দিকের সবকিছু বেশ স্পষ্টই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। মাথার উপর সহস্রাধিক নক্ষত্রের মেলা বসেছে। বালুভরা পথ দিয়ে এগোচ্ছে তারা। বণিকের বাড়িটা একটু নির্জন জায়গায়। যার দরুন আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নজরে এলো না। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর হঠাৎ রাস্তা পরিবর্তন হলো তাদের। বালুভরা রাস্তা ছেড়ে উত্তরদিকের ইট বিছানো রাস্তাটা ধরলো। এদিকটাই অবশ্য বেশ কিছু ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। তবে লোকজনের কোনো সাড়াশব্দ নেই। হাঁটতে হাঁটতে অধৈর্য হয়ে উঠলো বেগম। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “আর কতদূর?”
শান্ত চোখে তাকালো বণিক। লক্ষ করলো মেয়েটার চোখে-মুখে সে কী উত্তেজনা সুলতানকে দেখার। তার হৃদয় ঈর্ষান্বিত হলো খানিক। উপলব্ধি করলো সূক্ষ্ম কষ্ট। মেয়েটা ভালোবাসতে জানে। লাগামছাড়া উন্মাদনায় ভরপুর সে ভালোবাসা। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই ভালোবাসা তার জন্য নয়। সেই ভালোবাসার একটা বিন্দুও আর জন্য বরাদ্দ নয়। আচ্ছা, সুলতান যদি না থাকে তাহলে কি মেয়েটা ভালোবাসবে তাকে? যদি এই ষড়যন্ত্রের মাঝে কোনোভাবে সুলতানের মৃ’ত্যু হয়? তখনও কি মেয়েটা তাকে চাইবে না? সঙ্গে সঙ্গে গগণ কাঁপিয়ে কেউ যেন গায়েবি স্বরে উত্তর দিলো ‘সুলতান ম’রলে তুমি কি বেঁচে থাকবে আবরার? সুলতানের মৃ’ত্যুশোকে মেয়েটা যে উন্মাদ হয়ে পুরো সাম্রাজ্য জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে না তার কি নিশ্চয়তা?’ বিরক্ত হলো বণিক। কেন তার আগে সুলতান এলো জোভিয়ার জীবনে? গম্ভীর লোকটাও কি তারই মতো ভালোবাসতে জানে? লোকটাকে দেখে তো মনে হয় না। তাহলে কোন টানে তাকে এত ভালোবাসলো জোভিয়া?
তার আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝে ভ্রু কুচকাল বেগম। খানিক উচ্চস্বরে বলল, “কী ভাবছেন এতো?”
হকচকিয়ে উঠলো বণিক। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংবরণ করে বলল, “না, কিছু না।”
“তাহলে বলুন আর কতদূর মহল?”
“এইতো, প্রায় চলে এসেছি। সামনেই।”
আবারো নীরবতা নেমে এলো দু’জনের মাঝে। হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা ঘেমে উঠেছে তারা। আজ বাইরে কোনো বাতাস নেই। গাছের পাতা সামান্য পরিমাণ নড়ছে না। কঠিন স্তব্ধতা পালন করছে প্রকৃতি। থম মেরে আছে চারপাশ। এ যেন কঠিন কোনো প্রলয়ের আগাম সংকেত। সমস্ত প্রলয় সাদরে গ্রহণ করতে প্রস্তুত বণিক, যদি জোভিয়া তার হয়। আসমান ফেটে যাক, জমিন চৌচির হোক শুধু সময়টা পিছিয়ে যাক। যেখানে জোভিয়ার জীবনে নেই সুলতান শাহজাইন নামক কোনো ব্যক্তি। এমনটা হবে না কি কখনো?
হঠাৎ রাস্তার মাঝে মাথা উচিয়ে থাকা ইটের সাথে হোচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে মুখ থুবরে সামনে পড়তে নিলো বেগম। খানিক ঝুঁকে পড়লেও মাটিতে পড়লো না। তার পূর্বেই বণিক নিজের হাতের মাঝে আগলে নিলো তাকে। টেনে উঠিয়ে দাঁড় করাতেই এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিলো বেগম। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সে। চোখে-মুখে আতঙ্ক। অবাক হলো বণিক। বিস্ময় নিয়ে বলল, “না ধরলে পড়ে যেতে তুমি!”
“পড়লে পড়তাম। পরপুরুষের স্পর্শ অন্তত লাগতো না শরীরে।” চেঁচিয়ে উঠলো বেগম।
হতবাক হলো বণিক। কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। ঠিকই তো বলেছে। সে তো পরপুরুষই। এভাবে স্পর্শ করা উচিত হয়নি। কিন্তু চোখের সামনে পড়ে যেতে দিতো কীভাবে? সে শান্ত স্বরে বলল, “দুঃখিত, আর হবে না এমন। ব্যথা পেয়েছো?”
“না।” অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো বেগম।
“ইটের সাথে পা বেঁধেছিল তো। কেটে গিয়েছে? দেখি দেখাও আমাকে।”
আরো খানিকটা দূরে সরে গেল বেগম। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “সামান্য কাটাছেঁড়াতে কিচ্ছু হয় না আমার। দয়া করে নিজের সীমায় থাকুন। দরদ দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সাহায্যকারীকে হত্যা করে অকৃতজ্ঞ হতে চাই না আমি।”
হতাশার শ্বাস ফেলে পুনরায় হাঁটতে লাগলো বণিক। এই প্রথম সে উপলব্ধি করলো তার ধৈর্যশক্তি অত্যন্ত বেশি। আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই অদূরে নজরে এলো একঝাঁক কৃত্রিম আলোয় আলোকিত বিশাল মহল। সোনালি রঙা মহলটার প্রধান ফটক থেকে শুরু করে প্রধান দ্বার পর্যন্ত অসংখ্য সৈনিক অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সচেতন তাদের দৃষ্টি। সৈনিকরা তাদেরকে দেখার আগেই আঁধারের মাঝে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো তারা। আচমকা বণিক অজানা কোনো পাখির শব্দ তুলল নিজ গলায়। বেশ কয়েকবার একই রকম শব্দ করলো জোরে জোরে। কী ঘটছে উপলব্ধি করতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকালো বেগম। এটা কি কোনো সংকেত? খানিক পরেই কেউ একজন দৌড়ে আসে তাদের দিকে। একজন সেবক এসেছে। তীক্ষ্ম চোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে গাছের আড়ালে চলে এলো। ভীত স্বরে বলল, “আমার খুব ভয় করছে আবরার। সুলতান জানলে গর্দান নিয়ে নেবে আমার।”
“আরেহ! কিছুই হবে না। যা আনতে বলেছিলাম এনেছো?” ফিসফিসিয়ে বলল বণিক।
কাঁপা কাঁপা হাতে দুটো পোশাক এগিয়ে দিলো সেবক। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “এইযে, এখানে একটা সেবকের পোশাক আরেকটা সেবিকার। কিন্তু তোমার স্ত্রী কোথায়?”
আঁধারের বুক চিরে এগিয়ে এলো বেগম। বরবাবরের মতোই হিজাব দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিজের মুখটা। শুধু চোখদুটোই দৃশ্যমান। স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো সেবক। বণিকের উদ্দেশ্যে বলল, “এইতো ভালো হয়েছে। মুখ বাঁধা থাকলে কেউ চিনতেই পারবে না। মহলের অনেক সেবিকা হিজাব দিয়ে মুখ বেঁধে রাখে। তাই সন্দেহও করবে না। কিন্তু তোমাকে তো চিনে ফেলবে আবরার?”।
“সেই ব্যবস্থাও আমার কাছে আছে। তুমি চিন্তা করো না। ধরা পড়লেও তোমার নাম কখনোই নেব না আমরা।”
“সে নিয়ে ভয় নেই আমার। আমিতো চিনি তোমাকে। তোমার স্ত্রীও নিশ্চয় তোমার মতোই। আমি শুধু ভয় পাচ্ছি তোমাদের নিয়ে। কেউ দেখে ফেললে আর জ্যান্ত ছাড়বে না।”
“ইনশাআল্লাহ! কিছু হবে না। তুমি দ্রুত ফিরে যাও। নাহলে কেউ সন্দেহ করবে।”
পোশাকদুটো তার হাতে দিয়ে দ্রুত চলে গেল সেবক। বণিক ঠিক কী করতে চাইছে তা বুঝে নিলো বেগম। সেবিকার পোশাকটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “চলবে।”
নিজেদের পরিহিত পোশাকের উপরেই সেবক-সেবিকার পোশাক পরে নিলো তারা। হঠাৎ বণিক কোথা থেকে যেন আলগা চুল-দাড়ি বের করে লাগিয়ে নিলো। খানিক সুরমাও লাগালো চোখে। অতঃপর গাছের আড়ালে সবকিছু রেখে দিলো। বেগমের দিকে চেয়ে বলল, “চেনা যায়?”
“চোখ যদি কেউ মাথায় নিয়ে হাঁটে তাহলে চিনবে না। আর যদি চোখ যথাস্থানে এবং ব্যক্তি যদি বিচক্ষণ হয় তাহলে চিনেই ফেলবে।”
আমলে নিলো না বণিক। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সৈনিকদের পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে মহলে ঢুকে পড়লো তারা। সেবক-সেবিকা ভেবে কেউ অতটা আমলেও নিলো না। ভেতরে এসেই সোজা মহলের কারাগারের দিকে হাঁটতে লাগলো তারা। সুলতানকে যদি কোনোভাবে বন্দি করে রাখে তবে তাকে কারাগারে মধ্যেই পাওয়া যাবে। কারাগারের সামনে এসে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ভেতরে সুলতান আছে না কি। দুর্ভাগ্যবশত একজন সৈনিক দেখে নিলো তাদের। তৎক্ষণাৎ তেড়ে এসে ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা এখানে কী করছো? সেবক-সেবিকাদের কারাগারে কী কাজ?”
চমকাল তারা। তবে যথাসম্ভব নিজের অভিব্যক্তি দমিয়ে রেখে বেগম নত স্বরে বলল, “না মানে। দেখতাম একটু কারাগারটা। অনুমতি নিয়েই এসেছি।”
অনুমতির কথা শুনতেই পিছিয়ে গেল সৈনিকটা। গম্ভীর স্বরে বলল, “কারাগার আবার দেখার কী আছে? কি জানি এদের অনুমতি কে দেয়। যা হোক, তাড়াতাড়ি দেখে বিদায় হও।”
এটাই তো চাই। বণিককে কিছু না বলেই দ্রুত কারাগারের দিকে দৌড়ে গেল বেগম। যেন এখনি কারাগারের কাছে যেতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। আচমকা এভাবে ছুটে যাওয়াতে হকচকিয়ে উঠলো বণিক। সৈনিক কপাল কুচকে বলল, “কী হলো? তোমার অনুমতি নেই না কি? তোমার সঙ্গী তো তোমাকে ফেলেই চলে গেল।”
আড়চোখে কটমট করে বেগমের যাওয়ার পানে চেয়ে ছিলো বণিক। সৈনিকের প্রশ্ন শুনে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, আমি দেখবো না। ও দেখতে চাচ্ছিল তাই সাথে এসেছি।”
“কেন প্রমিক যুগল না কি তোমরা? আশিকের মতো ওর পিছে পিছে চলে এসেছো।”
চকিতে তাকালো বণিক। তবে আর কিছু বলার সুযোগ হলো না। তার পূর্বেই ফিরে এলো বেগম। মুখ ঢাকা থাকার কারনে তার অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। তবে চোখ বলছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে সে পায়নি। ভার গলায় বলল, “সমস্ত কারাগার দেখা শেষ।”
সৈনিক তাড়া দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। এবার যাও তোমরা। কারাগারে দেখার মতো কিছু নেই। বোকার মতো কী দেখতে এসেছিলে কে জানে।”
সৈনিকের থেকে সামান্য দূরে এগোতেই বণিক ধীর স্বরে শুধাল, “পাওনি?”
ডানে-বামে মাথা নাড়ালো বেগম। আহত গলায় বলল, “সবগুলো কারাগার দেখেছি। কোথাও নেই সুলতান। এমনকি মাহতাবও নেই।”
খানিক অবাক হলেও মনে মনে খুশি হলো বণিক। না পেলেই ভালো। আরো কিছুটা সময় তারা একসাথে কাটাতে পারবে। তবে মুখের অভিব্যক্তিতে নিজের খুশি প্রকাশ করলো না সে। করুন গলায় বলল, “তাহলে চলো অন্যদিকে খুঁজে দেখি।”
সম্মতি দিলো বেগম। একে একে ঘুরে ঘুরে সমস্ত মহল দেখতে লাগলো। না পেয়ে কামরাগুলোর সামনেও নানা অজুহাতে গেল। কিন্তু কোথাও নেই সুলতান আর মাহতাব। তাদের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। হতাশ হয়ে বাইরের দিকে যেতে শুরু করলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে থেমে থেমে পা ফেলছে বেগম। কারাগারে নেই, মহলের কোনো কামরায় নেই তাহলে কোথায় আছে সুলতান? চোখ-মুখ কুচকে কিছুক্ষণ ভেবে আচমকা অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে খানিক উচ্চস্বরে বলল, “বোধহয় অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছে। মানে অন্য কোথাও বন্দি করে রেখেছে তাদের। মহলের বাইরে গিয়ে খুঁজে দেখি, চলুন। না পেলে আজই যুদ্ধ ঘোষণা করবো আমি এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে।”
প্রধান দ্বারের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে ভেসে এলো একটি সন্দিহান নারী কন্ঠ।
“কারা তোমরা?”
চকিতে ফিরে তাকালো তারা। একজন মধ্যবয়স্ক সেবিকা দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ম চোখে তাদের পর্যবেক্ষণ করে বলল, “আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না?”
“আমরা আসলে আজই এসেছি।” বলল বণিক।
“কে নিয়োগ দিয়েছে তোমাদের?”
কী বলবে বুঝে উঠলো না বেগম। বণিক পুনরায় বলল, “শেহজাদি খাস করে নিয়োগ দিয়েছেন আমাদের।”
শেহজাদির কথা শুনতেই মুখটা কালো হয়ে এলো মহিলার। পাংশুটে মুখ নিয়ে দ্রুত সরে পড়লো সে। বেগম হতবাক চোখে তাকালো বণিকের দিকে। মৃদুস্বরে হাসলো বণিক। হাসতে হাসতে বলল, “শেহজাদি দারিয়া, সুলতান উমারের ছোট এবং একমাত্র বোন। খুবই ভয়ানক আর অত্যাচারী একজন নারী। সুলতান উমার ব্যতীত সবার সাথে দুর্ব্যবহার করে সে। তাই এই সাম্রাজ্যের সবাই তাকে যমের মতো ভয় পায়। মানুষ হত্যা করতে দু’বার ভাবে না। ছোট ছোট ভুলেও গর্দান নেওয়ার মতো বড় শাস্তি দেয়। এখনো পর্যন্ত অবিবাহিত। বিবাহ করেনি। অপেক্ষা করছে হয়তো তারই মতো কোনো ভয়ঙ্কর পুরুষের জন্য।”
বিরক্ত হলো বেগম। না দেখেও সেই নারীর প্রতি অসীম ঘৃণা অনুভব করলো সে। অতঃপর কোনোকিছু না বলেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলো মহল থেকে। তার পেছনে ছুটে এলো বণিক। রসিকতার স্বরে বলল, “তুমি তো এমনভাবে রেগে যাচ্ছো যেন সে তোমার সতিন লাগে।”
অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো বেগম। ভরকে গেল বণিক। উপলব্ধি করলো মারাত্মক রেগে গেছে মেয়েটা। তাই ঠোঁটে হাত চেপে মুখ বন্ধ করে নিলো সে। মহল থেকে বেরিয়ে বাগানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলো তারা। হুট করে পরিচিত কন্ঠ পেয়ে পা থেমে গেল বেগমের। তার সাথেই দাঁড়িয়ে পড়লো বণিক। বাগানে লাগানো কৃত্রিম আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দোলনায় রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছেন সুলতান শাহজাইন। কিন্তু সে একা নয়। তার ডান পায়ের ঊরুর ওপর আবেদনময়ী ভঙিমায় বসে আছে শেহজাদি দারিয়া। কখনো যেই নারী হাসে না আজ সে প্রান খুলে হাসছে সুলতানের মুখটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে। নড়াচড়ার কারনে ঝনঝন শব্দ তুলছে তার অলংকার। সফেদ রঙা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে আছে। যে কেউ দেখলে বলে দেবে তাদের মধ্যে কঠিন এক সুসম্পর্ক রয়েছে। যা শুধু স্বামী-স্ত্রী অথবা প্রেমিক-প্রমিকার মধ্যেই থাকে। এমন নয় যে সুলতানের সায় নেই তাতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে সে। হাসিমুখে কথাও বলছে শেহজাদি দারিয়ার সাথে। ভাবখানা এমন যেন সে তার জন্ম জন্মান্তরের প্রিয়তমা। তাদের উপস্থিতি এখনো টের পায়নি তারা। হতবুদ্ধির ন্যায় বেগমের দিকে ফিরে তাকালো বণিক। কিন্তু কোথায় বেগম? সে তো আগেই তাল হারিয়ে পিছিয়ে গেছে তার থেকে খানিকটা। ভয়ঙ্করভাবে থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। স্তব্ধ দৃষ্টিতে এখনো দেখে যাচ্ছে সুলতানের দিকে। আকস্মাৎ নড়ে উঠলো বোধহয় পায়ের নিচের ভূমি। বেসামাল হয়ে পড়লো সে। দৃষ্টিও যেন আজ ছলনা করছে তার সাথে। কী সব ভুলভাল দেখছে সে। ছি! নিশ্চয়ই চিন্তায় এসব উল্টো পাল্টা দেখছে। ঘৃণায় রি রি করে উঠলো বণিকের শরীর। এর মতো চরিত্রহীন একটা লোককে জোভিয়া ভালোবাসে?
হঠাৎ সুলতানের নজর পড়লো তাদের দিকে। বেগমকে দেখে চিনতে পেরেছে ঠিকই তবে সামান্য পরিমাণও বিচলিত হলো না সে। যেন এটা হবারই ছিলো। সে শেহজাদিকে নামিয়ে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। দারিয়ার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, “আমার সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী চলে এসেছে যে। পত্র পাঠাওনি না কি তুমি?”
খানিকটা অবাক হলো দারিয়া। শুধাল, “মানে তোমার স্ত্রী এটা? বাহ! ছদ্মবেশ ধরে এসেছে দেখছি। তুমি যে পত্র দিয়েছিলে সেটা তো আমি পাঠিয়েই দিয়েছিলাম। শুনে দেখো, তালাক নিতে এসেছে বোধহয়।”
কথাগুলো শ্রবণগোচর হতেই অসাড় হয়ে এলো বেগমের শরীর। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে কোনো সংকোচ ছাড়াই আবারো তাকে নিজের হাতের মাঝে আঁকড়ে নিলো বণিক। বেগমের সেদিকে হুঁশ নেই কিন্তু সুলতান তো ঠিকই দেখেছে। তবুও কিছু বলল না সে। যেন তার শরীর কে হাত দিলো না দিলো এতে কোনো যায় আসে না তার। এতে করে আরো অবাক হলো বণিক। তবে মনের মাঝে নতুন এক আশা খুঁজে পেল সে। এবার কি জোভিয়াকে পাওয়ার সময় এসে গেল তার?
দারিয়া উচ্চস্বরে হেসে আল্লাদি হয়ে বলল, “ওকে এখনি তালাক দিয়ে দাও শাহজাইন। শুধু শুধু ঝামেলা রেখে লাভ নেই। তালাক দাও, চলে যাক ও। আর না মানলে হত্যা করে ভাসিয়ে দাও সরোবরে।”
তার কথায় সায় দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সুলতান। বেগমের দিকে এগিয়ে এসে ঘাড় কাত করে উপহাসের স্বরে বলল, “কষ্ট হচ্ছে?”
কান যেন ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো বেগমের। এটা কি সত্যিই তার সুলতান? নাকি অন্য কেউ? মানুষ কি এতো দ্রুত কখনো বদলে যেতে পারে? হাজারবার চেষ্টা করেও একটা শব্দ পর্যন্ত মুখ থেকে বের করতে পারলো না সে। শক্তি পাচ্ছে না দাঁড়িয়ে থাকার। এখনো বণিক তাকে আগলে ধরে রেখেছে নিজের সাথে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই সুলতানের। সে পুনরায় দারিয়ার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “কী দান মেরেছো দারিয়া। দেখো রামান সাম্রাজ্যের তেজস্বী নারী কীভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। চোখের পলক ফেলার আগেই যে নারীর হাতে অস্ত্র চলে সেই নারীর অবস্থা দেখো। দাঁড়িয়ে থাকতেও অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাকে।”
তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে বেগমের দিকে তাকালো দারিয়া। বাঁকা হেসে বলল, “তাহলে চলো এখনি বিবাহ করে নিই আমরা। এই মেয়েটা এতো ধোঁকা সহ্য করতে না পেরে এমনিতেই মরে যাবে। কষ্ট করে আর মা’রতে হবে না তোমার।”
রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে আছে বণিক। মানুষ ঠিক কতোটা নোংরা হলে এমন করতে পারে তার জানা নেই। তবে তার সাধ্য থাকলে এখনি এদের দুটোকে মে’রে ফেলতো সে। কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও জোভিয়াকে নিজের করে পাওয়ার লোভ আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তার মনে। একই দৃশ্য দেখতে দেখতে বেগমের চোখদুটো যেন ঝলসে যাচ্ছে। হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম। ধোঁকা, তালাক, হত্যা- তিনটা শব্দ বারবার তার কানে বাজছে। এতোবড় ধাক্কাটা নিতে পারলো না সে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। দারিয়া আবারো এগিয়ে গিয়ে সুলতানের বাহু আঁকড়ে ধরে মিশে দাঁড়ালো তার সাথে। যেন তার শরীরের মধ্যে ঢুকে যেতে পারলেই শান্তি পেতো সে। কিন্তু কী আশ্চর্য! সুলতান কিছুই বলছে না। উল্টো নিজের হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো তার হাতটা। সে কী কুৎসিত দৃশ্য! আর সহ্য করতে পারছে না বেগম। অনেক চেষ্টার পর বহু কষ্টে ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে ডেকে উঠলো সে।
“সসসুলতান।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে ফিরে তাকালো সুলতান। দারিয়ার হাত না ছাড়িয়েই সামান্য ঝুঁকে এলো তার দিকে। অধর বাঁকিয়ে পুনরায় উপহাসের স্বরে শুধাল, “খুব কষ্ট হচ্ছে?”
চলবে……….
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_25
হুট করে উজ্জ্বল তারকা বিলীন হয়ে কালচে রঙে ঢেকেছে গগণ। একটু আগেও সফেদ শুধা ছড়ানো চন্দ্রটাকে গ্রাস করেছে অসময়ের নিকষ কালো মেঘ। মাথার উপর হেলে পড়া প্রকান্ড আকারের গাছটাতে সেই কখন থেকে দুটো রাতের পাখি কর্কশ কন্ঠে ডেকে চলেছে। রাতের আঁধারে আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলছে পাখিদুটোর চোখ। তারাও যেন হিং’স্র হয়ে উঠেছে কারোর অপ্রত্যাশিত আচরণে। গগণ কাঁপিয়ে হাসছে সুলতান শাহজাইন। তার এই হাসি বোধহয় আজ আর ফুরাবে না। তার খুব কাছেই মিটমিটিয়ে হাসছে শেহজাদি দারিয়া। হাসতে হাসতে হেলে পড়ছে সুলতানের শরীরের ওপর। সুলতান নিজেও হাসতে হাসতে তাকে একহাতে আগলে ধরছে। কতোটা প্রাণোচ্ছল সেই হাসি! ঝকঝকে দাঁতগুলো বেরিয়ে এসে জানান দিচ্ছে তার সৌন্দর্যতা। এই দৃশ্য বড় কঠিন সৌন্দর্যের সাক্ষী হতো যদি না বণিকের হাতের উপর বেগমের অসাড় দেহটা পড়ে না থাকতো। এতবড় ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেই জ্ঞান হারিয়েছে বেগম। ইনিয়ে-বিনিয়ে এটা-ওটা বলে তাকে জাগানোর চেষ্টা করছে বণিক। না পেরে হিজাব টেনে মুখ থেকে সরিয়ে দিলো সে। গালে আলতো থাপ্পড় মেরে ডাকতে থাকলো, “জোভিয়া, জোভিয়া ওঠো। দেখো আমার দিকে। তাকাও একবার।”
সাড়া দেয় না বেগম। অসাড় শরীরটার সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়েছে বণিকের উপর। বেহুঁশ অবস্থায়ও তার বন্ধ হয়ে থাকা চোখের কোনা দিয়ে চুইয়ে পড়ছে নোনা জল। দাঁতে দাঁত লেগে চিবুক শক্ত হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। বণিক পুনরায় উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “চোখ মেলে তাকাও জোভিয়া। তুমি না শক্তিশালী নারী? এত সহজে ভেঙে পড়ো না। জোভিয়া, শুনতে পাচ্ছ?”
হেলেদুলে দু’পা এগিয়ে এলো শেহজাদি দারিয়া। ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করে বলল, “আরে ম’রে গেছে না কি আগে দেখো ভালো করে। হতে পারে ধাক্কা সামলাতে না পেরে হৃদস্পন্দন ধপ করে বন্ধ হয়ে গেছে।”
অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো বণিক। মানুষ কতটা নির্দয় হলে এমন সময়ে হাসতে পারে? হাসিমুখেই চেয়ে আছে দারিয়া। মনে মনে প্রচন্ড রাগান্বিত হলো বণিক। এই নারীর নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতার কথা এতোদিন শুধু শুনেই এসেছে। আর আজ স্বচক্ষে দেখছে। শেহজাদি দারিয়া এমনই এক বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ যে সে মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে মজা পায়। চোখের সামনে কাউকে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে দেখলে আনন্দিত হয়। মৃত্যু পদযাত্রী মানুষকে দেখে সীমাহীন খুশিতে উল্লাস করে। চোখে-মুখে কেমন উৎসাহ নিয়ে বেগমের দিকে চেয়ে আছে সে। কিন্তু বণিকের কিছুই করার নেই। শেহজাদির বিরুদ্ধে কিছু বললে প্রাণ নিয়ে ফেরা হবে না। কিন্তু এখন তার সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো জোভিয়াকে জাগিয়ে তোলা। সে আবারো বেগমকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, “ওঠো জোভিয়া। অশ্রু কণা মানাচ্ছে না তোমার চোখে। শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াও। ওঠো আর নিজের স্বরূপে ফিরে এসো। প্রতারকের প্রতি অন্ধ হয়ো না।”
সরু চোখে তার দিকে তাকালো সুলতান। কিন্তু কিচ্ছুটি বললেন না। তাচ্ছিল্য হেসে দারিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, “আহা ছাড়ো তো। উঠবে না ও। ম’রেও নি। শক্ত কলিজা এটার। কাউকে দিয়ে মহল থেকে তলোয়ার আনাও। মে’রে ফেলি। এখনি মে’রে না ফেললে এ আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”
দারিয়া আল্লাদি স্বরে বলল, “কী বলছো শাহজাইন? এখনি মে’রে ফেললে পুরো মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। থাক না ক’দিন এভাবে।”
“আরে তুমি জানো না এই মেয়ে কতটা ভয়ানক। একবার উঠে পড়লে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে। তার চেয়ে অজ্ঞান অবস্থাতেই কাম তামাম করে দেই। কোনো ঝামেলা হবে না।” চিন্তার স্বরে বলল সুলতান।
“কিছুই করতে পারবে না। এখন মা’রলে একটুও মজা হবে না। কিন্তু ও যখন জীবিত থেকে তালাকপ্রাপ্তা হবে, তোমার-আমার বিবাহ দেখবে নিজ চোখে তখন যেই যন্ত্রণায় তড়পাবে সেটাই আসল জিত হবে আমাদের।”
“কিন্তু ও যদি কোনো চাল চেলে বসে?”
“কী করবে ও? দেখছো না ওর অবস্থা। আর তাছাড়া তুমিই তো ওকে প্রশিক্ষণ দিয়েছো। গুরুর আবার ভয় কীসের শিষ্যের কাছে?”
“আমি! আমি প্রশিক্ষণ দিয়েছি! আরে ওর ঐ বল’দ বাপের কাজকারবার এসব। মেয়েকে শিশুকাল থেকে সমস্ত অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছে। যুদ্ধ শিখিয়েছে। চেয়েছিলো মেয়েকে নিজ সাম্রাজ্যের শাসক বানাতে। এ তো শুধু আমি ওর রূপ দেখে কিছুক্ষণের জন্য পাগল হয়ে একে বিবাহ করতে চেয়েছিলাম তাই বিবাহ দিয়ে দিয়েছে। নাহলে নিজের সাম্রাজ্য তুলে দিতো ওর হাতে।” দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল সুলতান।
হাসলো দারিয়া। সুলতানের কাঁধে আলতো করে নিজের হাতটা রেখে বলল, “বাদ দাও। এখন আমি এসে গেছি না? তুমি-আমি একসাথে থাকলে ও কিছুই করতে পারবে না। তবুও তুমি বললে আমি ওকে বন্দিশালায় আটকে দিচ্ছি। তাহলে তো আর কোনো চিন্তা নেই?”
“হ্যাঁ, সেটাই করো। যা করার খুব দ্রুত। উঠে পড়বে যখন-তখন। জানি না আমার মেয়েটাকে কোন অবস্থায় রেখে এসেছে। যত্তসব।” একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল সুলতান।
মেয়ের কথা শুনে খানিক মনোক্ষুন্ন হলেও প্রকাশ করলো না দারিয়া। মুখের হাসি বজায় রেখে বলল, “তোহফা কত বড় হয়েছে? এর মতো সুন্দরী হয়েছে?”
“তোহফাকে তুমি মেনে নেবে তো?”
“তুমি ভেবো না। তোহফাকে আমি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো, আদর করবো। ও কখনো বুঝতেই পারবে না ওর আম্মা আমি নই বরং অন্য কেউ ছিলো।”
সস্তির শ্বাস ছাড়লেন সুলতান। যেন ভীষণ চিন্তায় ছিলেন তিনি এ বিষয়ে। শেহজাদি দারিয়ার হুকুমে কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন সৈনিক আর দু’জন সেবিকা এগিয়ে এলো। সৈনিক দুটো বণিকের বাহু থেকে টেনে হিচড়ে সরিয়ে দিলো বেগমকে। বেগমের অসাড় দেহটা টানতে টানতে নিয়ে গেল সেবিকারা। চিৎকার করছে বণিক। কিন্তু সেই চিৎকার শোনার মানুষ কোথায় সেখানে? সবই যে মানুষের মুখোশের আড়ালে অমানুষ। সুলতান উমার কোনো এক জরুরি কাজে সাম্রাজ্যের বাইরে গেছে। এখন পুরো সাম্রাজ্যের দায়ভার দারিয়ার উপর। তাই তার কথায় এখন শেষ কথা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন সুলতান। অত্যধিক শান্ত তার অভিব্যক্তি। শীতল দৃষ্টি। দু’চোখে নেই কোন চঞ্চলতা, হাহাকার, ভালোবাসা। সবই যেন কিছুদিনের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে দূর অজানায়। আস্ত মানুষটাই যেন বদলে গেছে। পাশাপাশি দুটো কারাগারে রাখা হয়েছে বণিক ও বেগমকে। মাঝখানে শুধুই লোহার শিক। দু’জন দু’জনকে দেখতে পাবে, শুনতে পাবে শুধু স্পর্শ করতে পারবে না। যথারীতি কারাগারের দ্বারে পাহাড়ায় আছে সৈনিকরা। বেগমের অসাড় শরীরটা গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে মেঝেতে। জ্ঞান ফেরেনি তার। মুখটা শুকিয়ে গেছে এতোটুকু সময়ের ব্যবধানে। দুই কারাগারের মাঝের লোহার শিক ধরে ছটফট করছে বণিক। চিৎকার করে ডাকছে বেগমকে। অথচ তার কোনো সাড়া নেই। ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে বণিক। তবুও দম না নিয়ে অবিরত ডেকেই যাচ্ছে সে। শিক ধরে ঝুলে আছে। পারলে যেন এখনি এই শিক ভেঙে বেগমের কাছে ছুটে যেতো। সে আবারো চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো, “জোভিয়া, ওঠো। চোখ খোলো।”
তাকে হতাশ করে সেবারও তাকালো না বেগম। আর না তো সামান্য নড়লো। বণিকের চিৎকার চেঁচামেচিতে রাগান্বিত হয়ে পাহাড়ারত সৈনিকটা এগিয়ে এলো। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “এই চুপ কর। ধোঁকাবাজ কোথাকার। তখন মিথ্যে বলে কারাগারে এসেছিলি তোরা। এতোবড় সাহস তোদের! নিয়ম ভঙ্গ করে এখন আবার চিল্লাচিল্লি করে পরিবেশ খারাপ করছিস!”
বণিক অসহায় গলায় হাতজোড় করে বলল, “দোহাই তোমার। আমাকে একটু, শুধু অল্প কিছুক্ষণের জন্য ঐ কারাগারে ঢুকতে দাও। কথা দিচ্ছি ওর জ্ঞান ফিরলেই চলে আসবো আবার। একটু দয়া করো।”
সৈনিকের মায়া লাগলেও সে নিজেকে সংবরণ করে বলল, “হুকুমের বাইরে গিয়ে কিছু করলে আমার গর্দান যাবে। আর তাছাড়া ঐ কারাগারের চাবিও নেই আমার কাছে। শেহজাদি দারিয়া নিজের কাছে রেখেছেন চাবি।”
কথাখানা বলেই নিজ স্থানে ফিরে গেল সৈনিক। কয়েকবার তালা ধরে টানাটানি করেও কিচ্ছুটি করতে পারলো না বণিক। অগত্যা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় করতে হলো তাকে। চাতক পাখির ন্যায় তার আগ্রহী নয়ন লোহার শিক গলে ঘুরপাক খাচ্ছে পাশের কারাগারে। সময়ের গতি আবহমান থাকলো। সন্ধ্যারাত গড়িয়ে গিয়ে এখন গভীর রাত। চারপাশ নিস্তব্ধ। তবে ঠিক কতটা রাত আন্দাজ করা দায়। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো বণিক। হুট করে ঘুম পাতলা হতেই ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে। চট করে তাকালো বেগমের দিকে। বিস্ময়ে চোখদুটো বড়বড় হলো তার। বেগমের পরনে থাকা সেবিকার পোশাকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন বেগম। দু’হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে থাকার ফলে অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। অন্ধকার কারাগারের সামনে জ্বালিয়ে রাখা মোমবাতির স্বল্প আলোতে বড্ড ভয়ানক লাগছে এ দৃশ্য।
ডাকলো বণিক, “জোভিয়া।”
উত্তর নেই। অবাক কন্ঠে আবারো ডাকলো, “জোভিয়া, শুনতে পাচ্ছ?”
মুখ উঠিয়ে ফিরে তাকালো বেগম। মুখটা কেমন নীলচে হয়ে আছে। দু’চোখ এতটাই লাল যেন এখনি টপ কর রক্ত ঝরে পড়বে। খুবই শান্ত আর শীতল সেই দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ চমকে উঠলো বণিক। উত্তেজিত স্বরে বলল, “কষ্ট পেলে কান্না করো। এভাবে অশ্রু আটকে রেখো না। নোনাজলে ভাসিয়ে দাও দুঃখটাকে।”
সে কথার উত্তর দিলেন না বেগম। বরং থমথমে গলায় বলে উঠলো, “আপনি এখনো এখানে? ফিরে যাননি?”
“কোথায় যাবো!” বিস্মিত কন্ঠ বণিকের।
“কেন? আপনার গৃহে।”
“তোমাকে ছেড়ে আমি পালিয়ে চলে যাবো ভাবলে কী করে? সুলতান শাহজাইনের মতো কাপুরুষ নই আমি।”
মুহুর্তেই তীক্ষ্ম হলো বেগমের দৃষ্টি। কিন্তু ভঙ্গিমা বদলালো না। ধরে আসা কন্ঠটাকে ছাপিয়ে জোরপূর্বক উচ্চারণ করলো, “আপনিও দেখেছেন সেই দৃশ্য! তাহলে কি আমার স্বপ্ন নয় এটা?”
বিভ্রান্তের ন্যায় কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকলো বণিক। মেয়েটা কি সমস্ত ঘটনাকে স্বপ্ন ভেবেই এভাবে বসে ছিলো? দ্রুতই নিজেকে সামলে বলল, “স্বপ্ন! কীসের স্বপ্ন! সব সত্যি। চরিত্রহীন লোকটার সাথে এত বছর থেকেও তাকে চিনতে পারলে না?”
“দেখুন, আপনি আমাকে ভালবাসেন আমি জানি। তা বলে এভাবে মিথ্যাচার করবেন না আমার সুলতানের নামে। এমনিতেই খারাপ স্বপ্ন দেখে দম আটকে আসছে আমার। এখানে কীভাবে এলাম সেটাও মনে পড়ছে না। তার ভেতর এসব উল্টো পাল্টা বলে আমার মেজাজ খারাপ করবেন না।”
হতাশ হলো বণিক। রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বলল, “প্রেমে উন্মাদ না হয়ে মস্তিষ্কে জোর দাও। তোমার ভালোবাসার সুলতান শেহজাদি দারিয়ার সাথে পরকীয়াতে ব্যস্ত আর তুমি কি-না! স্বপ্ন ভেবেই তোমার চেহারার অবস্থা! আর ঐ সুলতান তোমাকে হ’ত্যা করতে চাচ্ছিলো নিজের অবৈধ প্রেমিকার সাথে মিলে। নিকৃষ্ট কিট একটা ঐ লোক। বাগানের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করো। শেহজাদি দারিয়া আর সুলতান……”
দুই কানে শক্ত করে হাত চেপে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো বেগম, “থামুন, থামুন বলছি।”
“আজ কিছুতেই থামবো না আমি। তোমার জ্ঞান হারানোর পর কী হয়েছিল জানতে হবে তোমাকে। ওরা তোমাকে তড়পে তড়পে ম’রতে দেখতে চায় জোভিয়া। হুঁশে ফেরো।”
“মিথ্যে কথা বলছেন আপনি। স্বপ্ন ছিলো সবকিছু। কিছুই দেখিনি আমি, কিছুই না। সব আপনার ভ্রম। বাগানে সুলতান ছিলো না। ভুল দেখেছেন আপনি।”
“চিৎকার করে সত্যকে মিথ্যা বানানো যায় না জোভিয়া। যত দ্রুত তুমি মেনে নেবে তত দ্রুতই উপলব্ধি করতে পারবে ঐ লোকটার আসল চেহারা।”
চোখদুটো খিচে বন্ধ করে নেয় বেগম। একে একে সমস্ত ঘটনা ভেসে উঠতে লাগলো চোখের সামনে। ‘তালাক’ শব্দটা আবারো কঠিনভাবে আঘাত হানলো তার কর্ণগহ্বরে।
“আসল চেহারা! আমার সুলতানের চেহারায় তো কোনো খুঁত ছিলো না। বরং তার মুচকি হাসির আড়ালে হৃদয়ে ক্রমশ বেড়ে ওঠা কুচকুচে কালো দাগটা দেখতে পারিনি আমি। কখন সেই কালো দাগ এতোটা বড় হয়ে গেলো আমি বুঝতেই পারিনি। মিথ্যা ভালোবাসায় যখন ভুলিয়ে রাখতো আমায় তখনও আমি অন্ধ ছিলাম।আমার আমিকেই তো আমি চিনতে পারিনি। শুনেছি ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয় কিন্তু আমার বোধহয় আজ দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো। মানুষ চেনার দৃষ্টি।”
বাঁধ ভাঙা অশ্রুকণাগুলো গলার ভেতরেই আটকে দিলো সে। বাগানের দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নতুন করে আবারো হাত-পা থরথর করে কাঁপতে শুরো করেছে। চিবুক শক্ত হলো। চাইলেও নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না সে। গলা ফাটিয়ে কাদলে বোধহয় এ ব্যথা উপশম হতো। কিন্তু হায়! এ ব্যথা সে সারিয়ে তুলতে চায় না। এ ব্যথা যে নির্মূল হবার নয়। বুকে ধারন করার ব্যথা। বুকটা ব্যথা করছে। হৃদযন্ত্রের সংকোচন-প্রসারনের কাজটা ভীষণ অসহ্য লাগছে। হৃদযন্ত্রটা বুক চিরে বের করে ফেলতে পারলে হয়তো খানিক শান্তি পেত সে। হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে দুহাতে খামচে ধরলো নিজের হিজাব।
“কী হলো জোভিয়া? অমন করছো কেন?” উদ্বিগ্ন কন্ঠ বণিকের।
বেগম শুনতে পেলো না মনে হয়। উন্মাদের মতো মেঝেতে গড়াগড়ি করছে সে। অসহ্য যন্ত্রণা কমাতে হুট করে দেয়ালে ঠুকতে চাইলো নিজের মাথাটা। আৎকে উঠলো বণিক। চিৎকার করে বলল, “না, এটা করো না। পাগল হয়ে গেছো তুমি? তুমি ব্যথা পেলে ঐ লোকটার কিছুই যায় আসবে না।”
এক নজর ফিরে তাকালো বেগম। কী করতে যাচ্ছিল উপলব্ধি করে সরে এলো দেয়ালের পাশ থেকে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না তার। সবকিছু বিরক্ত লাগছে। এক পর্যায়ে অসহ্য হয়ে নিজের হাতটাই সজোরে কামড়ে ধরলো সে। মুহুর্তেই হাত কেঁটে রক্ত চুইয়ে পড়লো মেঝেতে। তবুও শান্তি পাচ্ছে না সে। মাথার ভেতর যেন সহস্রাধিক সূচ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই শান্ত হয়ে বসতে পারছে না। যন্ত্রণা করছে! অসহ্য যন্ত্রণা!
শূণ্য দৃষ্টিতে হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে আছে বণিক। জোভিয়া কী করছে এসব? মেয়েটা কি তবে সত্যিই উন্মাদ হলো?
কারাগারে দ্বার খোলার খটখট শব্দে ঘুরে তাকালো বণিক। শেহজাদি দারিয়া এসেছে। সাথে সুলতানও আছে। বেগমের কারাগারের দ্বার খুলে দিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে দারিয়া। হাত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত যেন বড্ড বেশিই খুশি করলো তাকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বেগমের। পুনরায় হাঁটুতে মুখ গুঁজেছে সে। হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে উঠলো দারিয়া। বিদ্রুপের কন্ঠে বলল, “একি! সম্রাজ্ঞীর এ কি হাল!”
তাকালো না বেগম। তাকে আরো উস্কে দিতে পুনরায় বলল, “আহারে বেচারি! স্বামীর শোকে পাগল হয়ে নিজের হাত নিজেই কামড়াতে হচ্ছে। কী দুর্ভাগ্য!”
ভ্রু কুচকে তাকালেন সুলতান। সে ভেবেছিলো এবার হয়তো এলিজা হিং’স্র হয়ে উঠবে। কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমাণিত হলো। সে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “আরে অজ্ঞান হয়ে গেছে মনে হয় আবার। নাহলে এতোক্ষন চুপ থাকতো না কি?”
এই কন্ঠকে উপেক্ষা করা হলো না বেগমের। মাথা উঠিয়ে তাকাতেই নজরে এলো সুলতানের মুখটা। পাশেই চির সঙ্গীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে শেহজাদি দারিয়া। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না বেগমের চেহারায়। সবাইকে অবাক করে সে আবারো সুলতানের দিকে আগ্রহী নয়নে চেয়ে শুধাল, “এসব আমার স্বপ্ন ছিলো না তাহলে?”
“না।” শক্ত কন্ঠে বলল সুলতান। চোখে-মুখে তার বিরক্তির আভাস। এতো কিছুর পরেও কারোর এগুলো স্বপ্ন মনে হতে পারে? আশ্চর্য!
“আপনি কেন এতো দ্রুত বদলে গেলেন সুলতান?”
“আমি বরাবরই এমন। কেউ চিনতে ভুল করলে সেটার জন্য আমি দায়ী নই।”
“আমাকে কি ভালোও বাসেন না?”
“না।”
“সব অভিনয় ছিলো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সব অভিনয় ছিলো। বোকা না কি তুমি? আমি দারিয়াকে ভালোবাসি। দেখতে পাচ্ছো না? অন্ধ না কি তুমি? এতোকিছু জানার পরেও বোকার মতো প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করতে চাইছো আমাকে?” চিৎকার করে বললেন সুলতান।
মুহুর্তেই বদলে গেল বেগমের অভিব্যক্তি। হিং’স্রতা স্থান পেল তার দৃষ্টিতে। হাওয়ায় বেগে উঠে দাঁড়িয়ে আচমকাই শেহজাদি দারিয়ার গলা চেপে ধরলো। সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলো লোহার শিকের সাথে। আকস্মাৎ ঘটনায় ভরকে গেল সকলে। বণিকের চোখে শুধুই বিস্ময়। শ্বাস নিতে না পেরে ছটফট করছে দারিয়া। চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেছে স্বাভাবিকের তুলনায়। হিসহিসিয়ে উঠলো বেগম, “তোর মৃত্যু হলেই আমার স্বপ্ন ভেঙে যাবে। আবার সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।”
ছুটে আসলো সুলতান। বেগমের হাত টেনে ধরে ছাড়ানোর চেষ্টা করে রাগান্বিত স্বরে বলল, “ছাড়ো ওকে। এসব কী নাটক শুরু করেছো? ছেড়ে দাও বলছি।”
তার কথা মোটেই প্রভাবিত করতে পারলো না বেগমকে। সে আরো শক্ত করে ধরলো দারিয়ার গলা। ওক ওক করতে শুরু করেছে দারিয়া। ফর্সা মুখটা নীল হয়ে উঠছে। চমকে উঠলো সুলতান। বোধশক্তি খুইয়ে সজোরে ধাক্কা মেরে বসলো বেগমকে। অমনি মেঝেতে আছড়ে পড়লো বেগম। ব্যথার চেয়ে যেন হতবাকটাই বেশি হয়েছে সে। একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো সুলতানের দিকে। কিন্তু সুলতানের ধ্যান কোথায় সেদিকে? সে তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দারিয়াকে নিয়ে। গলায় আলতো করে হাত ডলে দিয়ে উত্তেজিত স্বরে শুধাচ্ছে, “ঠিক আছো তুমি?”
কাশি উঠে গেছে দারিয়ার। কাশতে কাশতে কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে বলল সে ঠিক আছে। স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন সুলতান। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো বেগমের দিকে। হনহন করে এগিয়ে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে উঠিয়ে দাঁড় করালো তাকে। কেঁটে যাওয়া হাত চেপে ধরাতে ব্যথায় চোখ-মুখ কুচকে নিলো বেগম। অগ্নি দৃষ্টিতে চাইল সুলতান। উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলল, “ভালোভাবে কথা বলছিলাম তোর সহ্য হলো না?মারতে চাস? হ্যাঁ, মারতে চাস আমাদের?”
হতবাক নয়নে শুধু চেয়ে আছে বেগম। পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো সুলতান, “কথা বল। মারবি আমাদের? এতো ক্রোধ তোর?”
রাগান্বিত সুলতান হুট করে নিজের তলোয়ার খুলে বেগমের হাতে তুলে দেয়। চিৎকার করে বলল, “তাহলে মার আমাকে। কেউ কিছুই বলবে না। প্রহার কর।”
ঘাবড়ে গেল দারিয়া। উত্তেজিত স্বরে বলল, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে শাহজাইন? কী করছো? সরে এসো ওর সামনে থেকে। ও পাগল হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি আঘাত করে দেবে।”
তার কথা উপেক্ষা করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুলতান। পুনরায় বললেন, “কী হলো? মার আমাকে। ধোঁকা দিয়েছি না তোকে?”
দৌড়ে এসে টেনে তাকে সরাতে চাইছে দারিয়া। সুলতানের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না সে। তবুও টানছে। এদিকে সুলতান নিজ স্থানে অনড়। একচুল নড়লেন না তিনি। তার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে থেকে কারাগারের বাইরে তলোয়ারটা ছুড়ে ফেলল বেগম। চমকাল দারিয়া। সে একদমই আশা করেনি হাতে তলোয়ার পেয়েও আঘাত না করে সেটা ফেলে দেবে বেগম। সে ভেবেছিলো মেয়েটা ক্রোধের বশীভূত হয়ে শাহজাইনকেও আঘাত করবে। তাচ্ছিল্য হাসলো সুলতান। উপহাস করে বললেন, “শেষ? এতোটুকুই তোর দম। মা’রতে পা পারলে এরপর থেকে এরকম নাটক করবি না শুধু শুধু।”
পিছিয়ে আসলো বেগম। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। চোখদুটো টকটকে লাল হবার পরেও অধরে মুচকি হাসি টেনে বলল, “আমার দম অনেক কম সুলতান। অল্পতেই ফুরিয়ে যেতে চায়। দয়া করে আপনারা চলে যান আমার সামনে থেকে। আমি ঘুমাতে চাই, শান্তির ঘুম।”
চোখ-মুখ কুচকে নিলো দারিয়া। ঠিক জমছে না খেলাটা। কোথায় ভাবলো তড়পাতে দেখবে তা না এই মেয়েটা ঘুমাতে চাচ্ছে! আবার তার গলাটার অবস্থা বেগতিক করে দিয়েছে। পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেছে গলায়। ব্যথাও করছে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেল সে। একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে তার পেছনে চলে গেল সুলতান। পূর্বের ন্যায় দেয়াল শরীর এলিয়ে দিলো বেগম। পাশের কারাগারের প্রাণীটির কথা বোধহয় ভুলেই গেছে সে। আহত চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে।সে আলগোছে নিজের কোমরের বন্ধনী আলগা করে বের আনলো একটি ছুরি। বারকয়েক চোখের সামনে সেটা ঘোরাতেই পাশের কারাগার থেকে চেঁচিয়ে ওঠে বণিক, “ওটা কী করবে?”
নিজের হাতের ক্ষতের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে বেগম। বণিকের কথাতে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “এই ছুরির একটা বিশেষত্ব আছে জানেন তো? সাধারণ ছুরি নয় এটা। এতে বিষের মিশ্রণ রয়েছে। শুধু প্রয়োজন একটু ক্ষতস্থান। রক্তের স্পর্শ পেলেই এই বিষ তৎক্ষণাৎ কাজ করতে শুরু করে।”
আৎকে উঠলো বণিক। চকিতে তাকালো বেগমের হাতের ক্ষতচিহ্নের দিকে। এখনো সেখানে তাজা রক্ত লেগে আছে। হুট করে যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো সে। কথা আটকে গেল গলায়।
চলবে……….