সম্রাজ্ঞী পর্ব-৩০+৩১

0
196

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_30

সূর্য কি টের পেয়েছে সুলতান-সম্রাজ্ঞীর দ্বন্দ্ব? সাত সকালে এমন তীক্ষ্ম কিরণ ছুড়ে প্রমাণ করছে এই মনোমালিন্য তার পছন্দ নয়। কারাগারের সামনে উপস্থিত প্রতিটি প্রাণী ঘেমে নেয়ে একাকার। ভিন্ন ভিন্ন কারনে মুখের রঙ উবে গেছে সকলের। সৈনিকরা তটস্থ সুলতানের ভয়ে অথচ সুলতান নিজেই শুকনো মুখে চেয়ে আছে বেগমের দিকে। দৌড়ে আসার ফলে পাগড়ি হেলে পড়েছে একপাশে। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দৃষ্টিজোড়া পর্যবেক্ষণ করছে বেগমের অঙ্গভঙ্গি। এমত অবস্থায় কী বলবে, কী করবে বুঝতে না পেরে দিশেহারা মাহতাব। তাকে যেন মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে কেউ। সাতরে না এ-কুল পাচ্ছে আর না ও-কুল পাচ্ছে। দিশা হারিয়ে সে কটমট করে তাকালো জিদানের দিকে। মেঝেতে হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে জিদান। উঁহু, মৃত নয় জীবিত সে। তবে ক্ষতবিক্ষত। পুরো শরীরে আঘাতের শতশত চিহ্ন ফুটে উঠেছে। কিছু কিছু স্থান কেটে রক্তে ঝরেছে মেঝেতে। যে কেউ দেখে বলে দিতে পারবে কী নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে তার উপর। কিন্তু এটা আসলেই কি অত্যাচার? সে তো অপরাধী। তার অন্যায়ের সাজা এটা। সামান্য কারাভোগ কখনো তার কৃত অপরাধের সাজা হতে পারে না। তার অপরাধের তুলনায় এ শাস্তিও যেন কম পড়ে যায়। মুখ বাঁধা থাকার ফলে কথা বলতে না পেরে উম, উমম শব্দ করছে জিদান। আশ্চর্য হয়ে বড়বড় হওয়া চোখদুটো যেন কিছু বলতে চাইছে। বেগম হতভম্বের ন্যায় কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিরে তাকালো সুলতানের দিকে। রাগি স্বরে শুধাল, “এ কী অবস্থা করেছেন মে’রে মে’রে?”

ভড়কে গেল না সুলতান। বেগমের দৃষ্টিতে চেয়ে সাজিয়ে তুলল কথার ঝুলি। অতঃপর শান্ত স্বরে বলল, “আমি! আমি মারিনি ওকে।”

“আপনি না মা’রলে কে মে’রেছে?”

“তুমি ভুল বুঝছো এলি। কে মে’রেছে সেটা তো সৈনিকরাই ভালো বলতে পারবে। মাইরার কথাগুলো তোমার মস্তিষ্কে জেকে বসেছে। প্রভাবিত করছে তোমাকে।”

চমকাল বেগম। সত্যিই কি মাইরার বলা কথাগুলো প্রভাবিত করছে তাকে? বিভ্রান্ত হচ্ছে সে। না কি নিজের বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে সুলতান? ভুল দিশায় চালিত করছে তার ভাবনাকে? তার বাচনভঙ্গি এলোমেলো হলো খানিকটা। উত্তেজিত স্বরে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলল, “কে করেছে এটা?”

মস্তক নুইয়ে নিলো সৈনিকগণ। অপরাধীর ন্যায় অত্যন্ত ধীর গলায় বলল, “মাফ করবেন সুলতানা। আমরা বাধ্য হয়ে ওকে আঘাত করেছি। সকালে ওকে খাবার দিতে আসলে আচমকা আক্রমণ করে বসে আমাদের উপর। তাই আঘাত করতে বাধ্য হয়েছি।”

“তাই বলে এতোটা আঘাত? কয়েদিকে আঘাত করার এই বিধান কোথায় পেয়েছো তোমরা?” গর্জে উঠলো বেগম।

“ক্ষমা করবেন। আমরা আমাদের ভুল স্বীকার করছি। তবে আঘাতগুলো শুধুই আত্মরক্ষার কারনে করা হয়েছে।”

বেগমের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে সে বিশ্বাস করেছে সৈনিকদের বয়ান। বরং কপালে ভাঁজ পড়েছে অবিশ্বাসের। সে সন্দেহের স্বরে পুনরায় বলল, “মানলাম। কিন্তু হাত-পা বেঁধে রেখেছো কেন?”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সৈনিক বলে উঠলো, “পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হুলুস্থুলু বাঁধিয়ে দিয়েছে কারাগারে তাই বেঁধে রেখেছি যেন কোনো ঝামেলা করতে না পারে।”

“আর মুখ? মুখ কেন বেঁধেছো? মুখ দিয়েও পালিয়ে যাচ্ছিল না কি?”

“আজেবাজে কথা বলে চিল্লাচিল্লি করছিলো খুব।”

বারংবার প্রশ্নের এমন চটাং চটাং উত্তর শুনে থামলো বেগম। সন্দেহ করার আর কোনো কারন না পেয়ে মৃদুস্বরে বলল, “চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।”

এদিকে হতবাক নয়নে সৈনিকদের দিকে চেয়ে আছে মাহতাব। কী নিখুঁত মিথ্যা যুক্তি দেখিয়ে দিলো বেগমকে! যেন আগে থেকেই উত্তর সাজিয়ে রেখেছিলো তারা! এরা তো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিথ্যাবাদীকেও হার মানিয়ে দেবে! বেগমকে মিথ্যা কথাগুলো বলে ইতিমধ্যে মনে মনে দোয়া দরূদ পড়তে শুরু করে দিয়েছে সৈনিকরা। কখন যেন মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে! জমিন চিরে দু’ভাগ করে মাটির নিচে যেতে পারলে হয়তো বেঁচে যেত তারা। একটুর জন্য কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায়নি। পরিস্থিতি যখন অনুকূলে এসে গেছে তখনই হঠাৎ মাহতাবের নজর পড়ে সুলতানের হাতের উপর। হাতে এখনো রক্ত লেগে আছে। শুকনো রক্ত। রক্তটা যে জিদানেরই এতে কোনো সন্দেহ নেই। সকলের অগোচরে সুলতানের খুব কাছে এগিয়ে গেল সে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “রক্ত লেগে আছে আপনার হাতে।”

সবে স্বস্তির শ্বাস ছেড়েছিল সুলতান। হুট করে মাহতাবের কন্ঠে চকিতে ফিরল সে। ব্যস্ত হয়ে হাতটা চোখের সামনে আনতেই দেখতে পেল বেশ খানিকটা রক্ত লেগে আছে। আশেপাশে রক্ত মোছার কিছু না পেয়ে দ্রুত নিজের পেছনে হাত গুটিয়ে নেয়। চোরা দৃষ্টিতে মাহতাবের দিকে চেয়ে ইশারা করলো কিছু একটা। মাহতাব নিজেও ব্যস্ত হয়ে চতুর্দিকে চেয়ে রক্ত মোছার মতো কিছু খুঁজে পেল না। এদিকে বেগম যখন-তখন তাদের দিকেই ফিরে তাকাবে। সে বোধশূণ্য হয়ে নিজের পাগড়ি খুলে মুছতে লাগলো সুলতানের হাতের রক্ত। কিন্তু এ কি! রক্ত তো একদম শুকিয়ে হাতের সাথে লেগে গেছে। আশেপাশে পানিও নেই সে ধুয়ে দেবে। তাকে বিভ্রান্ত হতে দেখে খপ করে পাগড়িটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো সুলতান। শক্ত করে ঘষে ঘষে মুছে ফেলল রক্তের চিহ্ন। বিশ্রিভাবে ঘষাঘষি করার দরুন হাত অনেকটা লাল হয়ে গেলেও পরোয়া করলো না সে। রক্ত লাগানো পাগড়িটা আবার মাহতাবের কাছে দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল। অমনি ফিরে তাকালো বেগম। সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “আমার কেন মনে হচ্ছে আঘাতগুলো আপনিই করেছেন? এমন শক্ত প্রহার সৈনিকরা কবে থেকে করতে শুরু করলো?”

“তুমি কি সন্দেহ করা বাদ দেবে? না কি আমি এখনি এই জিদানকে গলা টিপে মে’রে ফেলব? আজাইরা লোকজনের জন্য তোমার এত দরদ আমার একদম পছন্দ নয়।”

ভ্রু কুচকে কপাল ভাজ করে চেয়ে থাকলো বেগম। ফোঁস করে উঠলো সুলতান। হুট করে সৈনিকদের আদেশের সুরে বলল, “খুলে দাও ওর হাত-পা। আদর করে কোলে বসিয়ে ওষুধপত্র সব লাগিয়ে দাও। তবুও শান্তি পাক তোমাদের সম্রাজ্ঞী।”

সুলতানের কথাতে থতমত খেল সৈনিকরা। কিন্তু এক মুহুর্ত সময় ব্যয় না করে দ্রুত খুলে দিলো জিদানের হাত-পা। সুলতানের এহেন দৃঢ়তায় ভরকে গেল বেগম। চোখদুটো বড়বড় করে বলল, “আরে আমি এটা কখন বললাম? আশ্চর্য!”

কথা সম্পূর্ণ করে দম ফেলারও বোধহয় সময় পেল না বেগম। হাত ছাড়া পেতেই সৈনিকের কোমর থেকে চাবির গোছা নিয়ে সজোরে সুলতানের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে জিদান। শক্ত লোহার চাবির গোছা সোজা এসে লেগেছে সুলতানের কপালে। কপালের চামড়া ছুলে রক্ত ঝরলো নিমেষেই। খুব একটা ব্যথা না পেলেও কপাল ছুঁয়ে চোখ-মুখের ভঙিমা বিকৃত করলো সুলতান। তার ব্যথাতুর চেহারার আড়ালে বুঝি হাসি দেখতে পেল মাহতাব। এসব সামান্য ব্যথা কখনোই সুলতানকে কাবু করতে পারে না। সুলতান কি আগেই জানতো এমন কিছু করবে জিদান? তাই হাত-পা খুলে দিতে বলেছিল!
আৎকে উঠলো বেগম। ততক্ষণাৎ ছুটে এসে আঁকড়ে ধরলো সুলতানের মুখ। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “কোথায় লেগেছে সুলতান?”

“কপালে খুব ব্যথা করছে এলি।” ব্যথাতুর কন্ঠ সুলতানের।

মুহুর্তেই ছলছল করে উঠলো বেগমের দৃষ্টি। সন্দেহের পরিবর্তে উপচে পড়লো মায়া। কপালে আলতো হাত ছুঁইয়ে বলল, “কিছুই হবে না সুলতান। এখনি ঠিক হয়ে যাবে।”

জোর গলায় মাহতাবের উদ্দেশ্যে বলল, “চিকিৎসার ব্যবস্থা করো দ্রুত।”

খপ করে মেঝে থেকে চাবির গোছা তুলে সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে মারলো আহত জিদানের দিকে। ক্ষতবিক্ষত স্থানে আস্ত চাবির গোছা সজোরে আছড়ে পড়াতে আর্তনাদ করে উঠলো জিদান। চমকাল সৈনিকেরা। বিন্দুমাত্র আক্রোশ মিটলো না বেগমের। ক্রোধে ফেটে পড়ছে সে। রাগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে তেড়ে গেল কারাগারের দিকে। লোহার শিক খামচে ধরে অগ্নি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে গর্জে উঠলো, “প্রাণে মে’রে দেবো তোকে।”

বেগমের এমন প্রতিক্রিয়া বিস্মিত করলো মাহতাবকে। হুট করে যেন পুরো পরিস্থিতিই বদলে গেছে। সুলতানের দিকে লক্ষ করে দেখলো তার মুখে ব্যথার কোনো ছাপই নেই। বরং বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জিদানের দিকে। সুলতানকে নিয়ে চলে গেছে বেগম। কিন্তু বিপাকে পড়েছে মাহতাব। হৈ হট্টগোলের মাঝে কখন যে পেছনে জারনাব এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। তার ধারণা ঠিক হলে জারনাব সুলতানের হাতের রক্ত, লুকিয়ে সেই রক্ত মুছে ফেলা সবকিছুই দেখেছে। কী বলতে কী বলবে বুঝে আসলো না মাহতাবের। রাগান্বিত মুখে এগিয়ে এলো জারনাব। চির পরিচিত শান্ত স্বভাব ছেড়ে সামান্য উচ্চস্বরে বলল, “কী হচ্ছিল এখানে?”

“কই? কিছু না তো।”

“তোমরা সবাই মিথ্যাবাদী। আমি দেখেছি তুমি লুকিয়ে সুলতানের হাতের রক্ত মুছেছো। তারমানে জিদানকে সুলতানই মে’রেছে।”

“তুমি হয়তো ভুল দেখেছো জুঁই।”

“আবার মিথ্যে কথা বলছো!” চোখ রাঙালো জারনাব।

হার মানতে হলো মাহতাবকে। হতাশ স্বরে বলল, “তুমি আবার এখন রুদ্রমুর্তি ধারণ করো না। এমনিই খুব জ্বালায় আছি।”

“আমাকে সব খুলে বলো। মিথ্যা কথা বলবে না একদম।”

“সুলতানার সাথে থেকে থেকে তুমিও দেখছি ঝাঁঝালো হয়ে গেছো।”

“কী বললে?”

মাথা চুলকাচ্ছে মাহতাব। উপলব্ধি করতে পারলো সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। আপোসের সুরে বলল, “এখানে বললে সুলতানা কোনোভাবে যদি শুনে ফেলে তাহলে সুলতান আমার গর্দান নিয়ে নেবেন। আমি বুঝতে পারছি এই লুকোচুরি খেলাতে আমাকেই সবার আগে বলি চরতে হবে।”

“তুমি বলবে কি-না?” দৃঢ় কন্ঠ জারনাবের।

বাধ্য হয়ে সুলতানের হিং’স্রতা থেকে শুরু করে তার অসীম ভালোবাসা সবকিছুই খুলে বলল মাহতাব। জারনাব হতবাক হয়ে শুধাল, “তারমানে সুলতান জানে জিদান নোংরা ব্যবহার করেছিল আমাদের সাথে।”

“হ্যাঁ, সুলতানা ফিরে আসার পরেই সমস্ত খোঁজখবর নিয়েছে সুলতান।”

“তাহলে ঠিকই করেছে। ঐ ব্যাটাকে মা’রাই উচিত। কম জ্বালাইনি আমাদের।”

মৃদুস্বরে হাসলো মাহতাব। দুষ্টুমির স্বরে বলল, “তুমি তো ঝাঁঝালো হয়ে যাচ্ছ জুঁই।”

চোখ ছোটছোট করে তাকালো জারনাব। বিস্মিত কন্ঠে বলল, “ঝাঁঝালো!”

“হুম কিন্তু মাঝে মাঝে বোকা বোকা কথা বলে আমার মাথা চড়িয়ে দাও। আরো বুদ্ধিমান হতে হবে তোমাকে। সমস্ত কথা একটু দেরিতেই বোঝো তুমি।”

“ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তুমি আমাকে বুদ্ধু বলছো আজমাইন!”
বোকার মতো বলে বসলো জারনাব।

এবার নিজের হাসি চেপে রাখতে অক্ষম হলো মাহতাব। ঠোট চেপে রাখলেও হাসির আভাস ফুটে উঠলো মুখভঙ্গিতে। দেখতেই রেগে গেল জারনাব। স্বর পাল্টে রাগান্বিত হয়ে বলল, “কিন্তু তোমরা জোভিয়াকে মিথ্যা কথা বলে ধোঁকার মাঝে রাখছো। বলে দেবো আমি ওকে। নাহলে হুট করে জানতে পারলে প্রলয় বয়ে যাবে।”

“আরেহ না! তুমি এ পাপ কাজ কেন করবে? সময় হলে সুলতানই বুঝিয়ে বলবে। তুমি বলতে গেলে ঘেটে যাবে। সুলতান আরামসে আস্তে ধীরে ভালোবেসে বুঝিয়ে দেবে। খবরদার পাকামো করেছো তো।” শাসিয়ে উঠলো মাহতাব।

“নিজে তো অনেক বুদ্ধিমান। তাহলে বণিককে এনেছো কেন মহলে? খুনোখুনি বাঁধলে ঠেকাবে তুমি? তোমার আর সুলতানের মাঝে পড়ে বেচারা বণিক শুধু শুধু প্রাণ হারাবে। সুলতান হুকুম দিলেই তো তুমি নাচতে নাচতে তলোয়ার নিয়ে হাঁটা ধরবে।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল জারনাব।

আমলে নিলো না মাহতাব। বরং খানিক ভাব নিয়েই বলল, “আমি থাকতে এমন কিছুই হবে না।”

“আসছে বড় বীর!”

অপমানিত হলো মাহতাব। নিজ মনে আওড়ালো জুঁইয়ের চোখে সে কী বীর নয়? নিজের বীরত্ব নিয়ে সমস্ত অহংকার যেন এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তার। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “সুলতানকে কি তোমার স্বৈরাচারী মনে হয়? শুধু শুধু কেন হ’ত্যা করতে যাবে? তোমার বেচারা বণিক সুলতানার দিকে আশিকের হাত না বাড়ালেই হয়।”

জারনাব রেগেমেগে আবারো কিছু বলতে নেবে তার পূর্বেই আকস্মাৎ কয়েক পা এগিয়ে এলো মাহতাব। চোখে চোখ রেখে অবাক হয়ে বলল, “তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে জুঁই! কী মেখেছো?”

অতিশয় বিরক্ত হলো জারনাব। মেখেছে মানেটা কী? সে কি সুন্দর নয়! মাহতাবকে কিছু না বলে গটগট করে চলে গেল সে। পেছন থেকে আহাম্মকের ন্যায় চেয়ে থাকলো মাহতাব। কী হচ্ছে এগুলো? যে যেভাবে পারছে তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। কখনো সুলতান, কখনো সুলতানা আবার এখন জুঁই। অথচ তাদের আড়ালে আরো একজন ব্যক্তি সমস্ত ঘটনা নীরবে পর্যবেক্ষণ করেছে। সবাই চলে গেলে অগোচরেই রয়ে গেল সে। রাগ উপচে পড়ছে তার দৃষ্টিতে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সজোরে দেয়ালে আঘাত করলো। হাতের ব্যথা পরোয়া করলো না মোটেও। অতিরিক্ত রাগে কেঁপে উঠলো খানিকটা। বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো, “ভালোবাসার নাম করে ঠকাচ্ছ তোমরা। তোমাদের এই ধোঁকার খেলা কিছুতেই খেলতে দেবো না আমি। শীঘ্রই প্রকাশ পাবে সবকিছু। তাতে প্রাণ গেলেও পরোয়া করি না আমি।”

সুলতানের কপালের রক্ত মুছে পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে তাকে নিয়ে কামরায় ফিরছিল বেগম। ব্যথায় চোখ-মুখ কুচকে রেখেছে সুলতান। তখন ততটা ব্যথা উপলব্ধি না হলেও এখন বেশ ব্যথা করছে। তার চেয়েও অধিক ব্যথা যেন বেগমের লেগেছে। মুখভঙ্গিতে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। ওষুধ লাগানো স্থানটাতে থেকে থেকে আলতো করে ফুঁ দিচ্ছ সে। শরীরে ব্যথা থাকলেও মনে মনে প্রফুল্ল সুলতান। ঠোঁট গোল করে যখনি ফুঁ দিচ্ছে বেগম তখনি সে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দুনিয়াদারি ভুলছে। ঠোঁটের ফাক গলে বেরিয়ে আসা বাতাসটাতেও জান্নাত খুঁজে পাচ্ছে যেন। চেয়ে থাকতে থাকতে নেশা ধরে যাচ্ছে নিমেষেই। তীব্র গতিতে ধ্বক ধ্বক করছে হৃদয়। চোখ কপালে তুলে চেয়ে রইল সুলতান। সে কী মুগ্ধতা সেই দৃষ্টিতে! হঠাৎ জান্নাতের দ্বার বন্ধ করে বড় নির্দয়ভাবে তাদের সামনে হাজির হলো সুলতানের মামা হাদিদ। ওয়াসিফা সুলতানের ছোট ভাই। বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না সুলতান। বেগম বিনয়ী কন্ঠে সালাম প্রদান করে শুধাল, “খাওয়া-দাওয়া করেছেন মামা?”

লোকটার মনে হয় পছন্দ হলো না তার কন্ঠ। নিখুঁতভাবে উপেক্ষা করে সুলতানের উদ্দেশ্যে গম্ভীর হয়ে বলল, “শুনলাম বউয়ের জেদ রাখতে গিয়ে আসামীর বাঁধন খুলে দিয়ে মার খেয়ে কপাল কেঁটে এসেছো।”

তার কথাতে স্পষ্ট বিদ্রুপের ছাপ। তবুও কিছু বলল না সুলতান। গুরুজনের সাথে অযথা কথার যুদ্ধ করার মানুষ সে নয়। সে হাসিমুখেই বলল, “আপনি ভুল শুনেছেন মামা। তেমন কিছুই নয়।”

“শুনেছি শুনেছি। ঠিকই শুনেছি। বউকে বেশি লায় দিয়ে মাথায় তুললে এরমটাই হবে।”

রেগে গেল সুলতান। বহু কষ্টে নিজের আক্রোশ দমিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ভালোবাসার মানুষকে লায় না দিলে আর ভালোবাসলাম কই?”

“রাখো তোমার ভালোবাসা। জোয়ানকালে সবারই এমন আবেগ নাড়ানাড়ি করে। গৃষ্ম ফুরালে কৃষ্ণচূড়াও হেলায় পড়ে রয়।”

“হেলায় পড়ে থেকে যদি আরো একটা গৃষ্ম পাওয়া যায় তবে সেই হেলাই সয়ে নেব আবারো লাল রঙে রেঙে ওঠার অপেক্ষায়।”

মুগ্ধ হয়ে শুনলো বেগম। তবে রেগে গেল তার মামাশ্বশুড়। রাগান্বিত স্বরে বলল, “এই সাম্রজ্যের সুলতান তুমি। কোনো কবি নও। এসব আলগা আদিখ্যেতা বাদ দিয়ে কঠোর হও। সবসময় নিজের মন-মর্জি, জেদ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী করে তোমার বউ? তাকে মাথায় তুলে এত নাচানাচির কী আছে? একটা সভ্য মেয়ে বিবাহ করলে এতদিনে অন্তত এই সাম্রাজ্য তাদের উত্তরাধিকার পেতো, একজন শেহজাদা পেতো।”

রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই সুলতানের হাত আঁকড়ে ধরলো বেগম। হাতে আলতো চাপ দিয়ে সংকেত দিলো রাগ দমাতে। বাঁকা হাসলো সুলতান। গর্বের সাথে বলল, “আমার বেগমের গুণের শেষ নেই মামা। সে অস্ত্রবিদ্যায় অত্যধিক পারদর্শী। যুদ্ধ কলাকৌশলে তাকে হারানো দায় হয়ে ওঠে।”

“এসব সামান্য জিনিস সবাই পারে। এভাবে বুক ফুলিয়ে বলার কিছু নেই।”

“আপনি পারবেন?”

“হ্যাঁ অবশ্যই পারবো। সামান্য নারীকে হারাতে আর কী পারদর্শিতা লাগে? যে কেউ পারবে।”

“তাহলে হয়ে যাক তলোয়ারবাজী।”

“মেয়ে মানুষের সাথে লড়তে বলছো আমাকে? আমার একটা মান-সম্মান আছে। এক নিমেষেই হেরে যাবে তুচ্ছ মেয়ে মানুষ। তার সাথে আর কী লড়ব?” তাচ্ছিল্যের স্বর তার।

দমলো না সুলতান। আজ যেন সে প্রমাণ করেই ছাড়বে তার অক্ষমতা। বিদ্রুপ করে বলল, “ভয় পেয়ে গেলেন না কি মামা? বীরপুরুষরা লড়াই থেকে পিছিয়ে যায় না।”

আকস্মাৎ বেগম বলে উঠলো, “দূর্বলদের সঙ্গে লড়ে নিজেকে প্রমাণ করার ইচ্ছা নেই আমার। সেচ্ছাই যে ঘৃণ্য মানসিকতা বহন করতে চায় তাকে ফেরানো যায় না। কামরায় চলুন সুলতান।”

“দেখো শাহজাইন, দোখো তোমার বউয়ের কথার কেমন ছিড়ি! তোমার সামনে কীভাবে অপমান করছে আমাকে।”

“অপমান কোথায় করলাম মামা? বৃদ্ধকালে সকলকেই দূর্বল হতে হয়। জোয়ানকালে সে যত বীরই থাক না কেন। এতে এত আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাছাড়া আপনার বয়স হয়েছে। সঠিক সময়ে বিবাহ করলে আপনার নাতিপুতি হয়ে যেতো এতোদিনে। এখন লড়াই করা শোভা পাবে না আপনার। অচিরেই হেরে গিয়ে দুর্বলতা প্রমাণিত হয়ে যাবে।”

“শুনেছো শাহজাইন? কতটা অভদ্র এই মেয়ে! বেলাজ, ঠোঁটকাটা এমন মেয়ে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি।”

বেগমকে ধমকে উঠলো সুলতান, “আহ এলি। ভুলভাল কথা কেন বলছো মামাকে? সঠিক সময়ে বিবাহ হলে মামার নাতিপুতিরও বিবাহ হওয়ার সময় এসে যেতো। এভাবে বুঝিয়ে বলবে তো। অযথা হিসাব ছাড়া কথা বলছো। বয়স হয়েছে তাতে কী? এখনো জোয়ান বীর আমার মামা। সে কি একবারও বলেছে যে লড়বে না? নিজের বীরত্ব অবশ্যই প্রকাশ করবে সে। এতো দূর্বল ভেবো না আমার মামাকে তুমি। বরং তুমি ভয় পাও, ভালো করে প্রস্তুতি নাও লড়াইয়ের।”

মামার দিকে চেয়ে বলল, “কিছু মনে করবেন না মামা। মেয়ে মানুষ তো। বোঝে কম। তাহলে ঐ কথায় রইল। কাল লড়াই হবে খোলা ময়দানে। আপনি গিয়ে এখন বিশ্রাম করুন।”

কথাখানা বলেই আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেগমকে নিয়ে কামরার দিকে হাঁটতে লাগলো সুলতান। হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকলো তার মামা। ভাগ্নে যে তাকে সুন্দর কথায় ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে ভালোই উপলব্ধি করতে পারলো সে। তবুও সম্মান রক্ষার্থে কাল তাকে লড়তেই হবে। মেয়ে মানুষের সামনে তো আর নিজের ইজ্জত খোয়ানো যায় না। রাত নেমেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। তোহফাকে সকাল সকাল ঘুম পাড়িয়ে কামরা অন্ধকার করে পালঙ্কে বসে আছে বেগম। এমন সময় কোথা থেকে সুলতান এসে ধপ করে বসে পড়লো তার পাশে। খানিকটা চমকালেও নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলল বেগম। নারাজ গলায় বলল, “আপনি না একদম যা তা। কী দরকার ছিলো মামাকে ওসব বলে চেতিয়ে তোলার?”

“চেতিয়ে তুলব না বলছো? শুনলে না কত বড়বড় বাতেলা ঝাড়ছিল? বুইড়াকালেও নারীদের সম্মান দিতে শিখলো না। ছোট থেকে দেখে আসছি তাকে। শুধু নিজের বোনদের ছাড়া সমস্ত নারীকে তুচ্ছ করে দেখে। শুধু বয়সে আমার বড় বলে বেঁচে গেলো নাহলে আমার বেগমকে আজেবাজে কথা বলা! মুখ সেলাই করে দিতাম না আমি! গুরুজন বলে একটু ছাড় দিচ্ছি। কাল তুমি জিতে মুখ বন্ধ করে দেবে একদম।” বলতে বলতে উঠে গিয়ে কামরার আলো জ্বালিয়ে দিলো সে।

আকস্মাৎ আলো চোখে পড়াতে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো বেগম। ব্যস্ত স্বরে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে। খুব ভালো করেছেন। এখন আলোটা বন্ধ করুন তো। একটু অন্ধকারে থাকতে ইচ্ছে করছে। আলো টালো ভালো লাগছে না।”

সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে মাহতাবকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেল সুলতান। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে ঝট করে বিশাল জানালার পর্দা সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বেগমের দিকে তাকালো। জানালা দিয়ে জোৎস্নার আলো এসে সোজা বেগমের মুখে লাগছে। সৌন্দর্য যেন মুহুর্তেই বেড়ে গিয়ে চরম শেখরে পৌঁছেছে। চমকে উঠলো সুলতান। লাফিয়ে পালঙ্কে উঠে বসলো বেগমের সামনাসামনি। দু’হাতের আজলা ভরে মুখটা তুলে সশব্দে বলে উঠলো, “মাশা’আল্লাহ।”

হাসলো বেগম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত জোৎস্নার আলো ব্যতীত কোনো কৃত্তিম আলো নজরে এলো না। কোথাও জ্বলছে না কোনো কৃত্তিম আলো। দৃশ্যটা মনোমুগ্ধকর হলেও অবাক হতে বাধ্য হলো বেগম। এই রাতের বেলা পুরো সাম্রাজ্য এমন অন্ধকারে ছেয়ে আছে কেন? মহলটাও বোধহয় অন্ধকার। কোথাও যেন কোনো আলো নেই। এমন তো হয় না কখনো। সে অবাক হয়ে শুধাল, “সাম্রাজ্য এমন অন্ধকার কেন সুলতান? কেউ কি আজ আলো জ্বালাইনি? হুট করে সমস্ত আলো কী হলো?”

ভাবলেশহীন হয়ে তার কোলে গা এলিয়ে দিলো সুলতান। সুন্দর, স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তুমিই তো বললে আলো ভালো লাগছে না। অন্ধকারে থাকতে চাও। তাই সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়েছি। পুরো সাম্রাজ্য আজ অন্ধকার হয়ে বেগমের মন রক্ষার্থে মশগুল, ঠিক আমার মতো।”

চমকে উঠলো বেগম। তার সামান্য কথার এমন প্রতিক্রিয়া হবে জানলে সে কখনোই বলতো না। এই লোকটাও মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে! দিন দিন যেন পাগলামো বেড়েই যাচ্ছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, “সবসময় উল্টা-পাল্টা কাজ করেন আপনি। আমি কামরার আলো নেভাতে বলেছি, পুরো সাম্রাজ্যের নয়। দ্রুত মাহতাবকে বলুন আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে। সকলের কত অসুবিধা হচ্ছে ভাবুন তো।”

কোলে শুয়ে থেকেই আবারো উচ্চস্বরে মাহতাবকে ডেকে উঠলো সুলতান, “মাহতাব, মাহতাব।”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দ্বারের বাইরে থেকে ভেসে এলো মাহতাবের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর, “বুঝতে পেরেছি মহামান্য। এখনি আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করছি।”

আবারো ছুটলো মাহতাব সেবকদের আলো জ্বালানোর নির্দেশ দিতে। সে জানতো এমনটা হবে তাই আদেশ পাওয়ার আশায় এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধপধপ করে আলো জ্বেলে উঠলো সাম্রাজ্য জুরে। শুধু সুলতানের কামরাটায় অন্ধকার রইল। স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো বেগম। সুলতানের মাথার পাগড়িটা খুলে দিলো আলগোছে। ঝাকরা চুলগুলোর মাঝে আলতো করে আঙ্গুল চালিয়ে বলল, “শুনুন।”

“বলুন।” ঝটপট উত্তর দিলো সুলতান। অথচ তার কন্ঠে রসিকতার ছাপ।

“আরে শুনুন না।”

“আরে বলুন না।”

বিরক্ত হয়ে পড়লো বেগম। চুলগুলো শক্ত করে টেনে ধরে বলল, “আপনি একদম আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। মেজাজ খারাপ হয়।”

চট করে উঠে বসলো সুলতান। বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “এটা তুমি কী বলছো এলি! তুমি যদি বলো আকাশ দিয়ে হাতি উড়ে উড়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। সেটাও বউয়ের ‘কবুল’ শোনার মতো মনোযোগ দিয়ে শুনি আমি।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো বেগম। হাসতে হাসতে আছড়ে পড়লো সুলতানের বুকে। একটানে তার হিজাব খুলে খোলা চুলে হাত গলিয়ে বুকের সাথে গভীরভাবে চেপে ধরলো সুলতান। নেশালো গলায় বলে উঠলো, “বুকের ব্যথা কমে গিয়েও দেখি মনের ব্যথা বেড়ে গেল।”

ততক্ষণাৎ সেই হাসির শব্দে জ্বলে উঠলো কারোর হৃদয়। জানালার ওপাশ থেকে সরে গেল একটি মানবমূর্তি।

চলবে……….

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_31

মান-অভিমানের ভেলা ভাসিয়ে আবেশি, সুমধুর একটি রাত পাড় হলো। ভোররাতের ঘন অন্ধকারে নির্বাক প্রকৃতি। স্তব্ধ, নির্জন মহল। আনাচে-কানাচে গুটিকতক আলো জ্বলছে স্বল্প পরিসরে। শীতল, দমকা অনিলে বিশাল জানালার পর্দাগুলো মৃদু বেগে নড়ছে। ফজরের আজান এখনো হয়নি। হতে বেশি দেরিও নেই বোধহয়। পাহাড়ারত সৈনিকেরা ঘুমে ঢুলু ঢুলু। সুলতানের কামরার দ্বার শক্ত করে এঁটে দেওয়া। এমনকি জানালাটাও বন্ধ করে দিয়েছে সুলতান। সে চায় না বেগমের সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ মুহুর্তগুলো কোনো ঝিঁ ঝিঁ পোকাও দেখুক। এতটাই আড়াল করতে চায়। হঠাৎ তন্দ্রা ছুটলো বেগমের। ঢুলু ঢুলু চোখে নড়েচড়ে উঠলো সে। শরীরের উপর থেকে চাদর সরাতে গিয়ে উপলব্ধি করলো একটি বলিষ্ঠ হাত তাকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। হাতটা যে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর সেকথা আর বুঝতে বাকি রইল না। প্রশান্তিতে চোখ মেলে তাকাতেই মুখের সম্মুখে ভেসে উঠলো সুলতানের ঘুমন্ত মুখখানা। উস্ক শুষ্ক চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে আছে। সুলতানের হাত সরিয়ে উঠে বসতে চাইল সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন দেখলো সে নিজেই সুলতানের বুকে মাথা রেখে আরামে ঘুমোচ্ছিল। না তো তার মাথা পালঙ্কে আছে আর না তো সুলতানের মাথার নিচে বালিশ আছে। রাতে কখন যে সে সুলতানের উপর চড়াও হয়ে এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করতে পারলো না। শরীরের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে দিয়ে দ্রুত উঠে বসলো সে। সলজ্জে ফিরে তাকালো সুলতানের উদম শরীরের দিকে। এই শরীর তাকে সম্মোহিত করার পূর্বেই আড়ষ্টতা ফিরে ধরলো। লজ্জারা দল বেধে হানা দিলো প্রথম রাতের মতোই। কাঁপা কাঁপা হাতে চাদর টেনে ঢেকে দিলো সুলতানকে। লম্বা চুলগুলো দু’হাতে খোঁপা করে আশেপাশে নজর বুলালো। পালঙ্কের একপাশে তার হিজাব পড়ে আছে। মাথার ওপাশে অযত্নে পড়ে রয়েছে সুলতানের পাগড়ি। নিজের গাউন ঠিকঠাক করে উঠে দাঁড়ালো সে। দেখলো সুলতানের পায়ের অর্ধেকটাই পালঙ্কের বাইরে ঝুলে আছে। হয়তো সে সুলতানের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই মানুষটা আর তাকে না জাগিয়ে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বড্ড আফসোস হলো তার। এভাবে ঘুমিয়ে যদি শরীর ব্যথা হয় সুলতানের? কেন সে এত ঘুম কাতুরে হলো? সে ঠিকঠাকভাবেই শুলেই তো আর এত কষ্ট করে ঘুমাতে হতো না মানুষটাকে। আলতো করে পা দুটো ধরে পালঙ্কে উঠিয়ে দিয়ে কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। আকস্মাৎ অহংকার জন্মায় মনের কোনে। এই চুলগুলোর উপর শুধুই তার কর্তৃত্ব। সে ব্যতীত এগুলো ধরার, ছোঁয়ার অধিকার নেই কারোর। এই বলিষ্ঠ, সুদর্শন মানুষটাও তার একান্ত। ভাবতেই সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো আবেশে, অহংকারে। এই পুরুষটার যত ভালোবাসা, উন্মাদনা, পাগলামো সবকিছু শুধুই তাকে ঘিরে। কী সুমধুর এই অনুভূতি! কপালের ক্ষতের দিকে নজর পড়তে হতাশ হলো সে। ক্ষীণ কষ্ট হলো বুকের মাঝে। আজকাল মানুষটা কেমন নির্দয় হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার বুকে স্থান পেয়েছে হিং’স্রতা। এটা যেন কোনোমতেই মানতে পারছে না সে। বারবার ফিরে পেতে চাইছে তার আগের সুলতানকে। যার বুকে ছিলো অসীম মায়া। এক ফোঁটা নিষ্ঠুরতা সেখানে ঠাঁই পেত না। কী হতো তাদের জীবনটা আগের মতোই থাকলে? পারলে সে মুছে দিতো দূরত্বের এই দু’বছর। একই সাম্রাজ্যে থেকেও সে একটাবার ছুঁয়ে দেখতে পারেনি তার পুরুষটাকে। বিরহে যখন এই মানুষটা কাতর তখনও সে এসে বলতে পারেনি আমি আছি সুলতান, আপনার খুব কাছেই আছি। কতটা যন্ত্রণা মিশে আছে সেই দিনগুলোতে। বুবুর অধিক ভালোবাসাই হয়তো বাঁচিয়ে রেখেছিলো তাকে সেই দিনগুলোতে। নিজের স্বামীর বিবাহের ঘোষণা শুনেও চুপ থাকতে হয়েছে তাকে। অথচ হৃদয় তো বলছিলো ধ্বংস করে দে সবকিছু। কোন সাহসে ওরা গলা উচিয়ে তোর পুরুষের বিবাহের ঘোষণা দেয়? অসহ্য যন্ত্রণা বুকের মাঝে দাফন করতে হয়েছে সেদিন। কী যে কষ্ট!

কপালের ক্ষতটা কালচে হয়ে গেছে। সুন্দর মুখের মাঝে এই কালচে দাগটাও বড় সুন্দর লাগছে তার নিকট। চাঁদের কপালে কলঙ্ক লেপেছে যেন! ঝুঁকে পড়ে সেখানে অধর ছোঁয়ালো বেগম। ছলছল চোখে অনিমেষ চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আচমকা নিজের উপরেই বড্ড রাগ হলো। কেন সে জোর করে কারাগারে গেল? না গেলে তো এমন কিছু হতো না। পালঙ্কে এলিয়ে রাখা সুলতানের হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে শক্ত করে ধরলো। সে জানে মিথ্যে বলেছে সুলতান। জিদানের শরীরে থাকা প্রতিটা আঘাত এই হাতেই সৃষ্ট। সৈনিকরা জিদানকে আঘাত করেনি যেনেও কী নিখুঁত অভিনয় টাই না সে করেছে। সে তো জবান দিয়েছে সুলতানকে। কখনো যদি এই পুরুষ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি প্রমাণিত হয় সেদিনও পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে এই হাতটাই ধরবে সে। সুলতানের মুখের দিকে চেয়ে রইল হতাশ দৃষ্টিতে। বিড়বিড়িয়ে বলল, “রক্ত মুছে ফেললেই কি আঘাত বদলে যায় সুলতান? আপনার করা প্রতিটা আঘাতের পরিমাপ জানি আমি। আপনি কী করে ভাবলেন আমি বুঝব না ঐ আঘাত কার দ্বারা সৃষ্ট? বড্ড ভয় হয় সুলতান। কবে যেন এই হাতে কোনো নিকৃষ্ট অন্যায় হয়ে বসে। এই হাত যে আমার ভীষণ প্রিয়। এই হাত দ্বারা কোনো অপরাধ হলে আমি সইব কী করে? এই হাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও যে আমি ছাড়তে পারবো না হাতটা। তবে মনুষ্যত্ব বিলীন হলে শেষ হয়ে যাবো নিজের ভেতরেই। সইতে পারবো না এই হাতের অপরাধ।”

আনমনে ঝাকরা চুলগুলোর মাঝে আঙ্গুল গলিয়ে দিতেই নড়েচড়ে উঠলো সুলতান। সচেতন দৃষ্টিতে চেয়ে হাত সরিয়ে নিলো বেগম। পালঙ্ক ছেড়ে উঠে যাবে এমন সময় বন্ধ চোখে হাতরে হাতরে তার হাত টেনে ধরলো সুলতান। টেনে নিলো নিজের মাথার কাছে। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠলো, “এলি।”

“বলুন সুলতান।”

“হাত বুলিয়ে দাও।”

“নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে তো সুলতান।”

ধরফরিয়ে উঠে বসলো সুলতান। বিস্মিত কন্ঠে বলল, “কী বলছো! এতো দ্রুত রাত শেষ হয়ে গেল?”

“দ্রুত কোথায়? আমরা ঘুমাতেই তো দেরি করেছি কাল।”

থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল সুলতান। ধ্যান ফেরার ভঙ্গিমায় বলল, “ওহ হ্যাঁ। কালতো আমরা……”

হন্তদন্ত হয়ে তার মুখ চেপে ধরলো বেগম। চোখ বড়বড় করে অতি বিস্ময় নিয়ে বলল, “সকাল সকাল বেশরমের মতো কথা বললে তোহফার কামরায় চলে যাবো আমি।”

“নিয়ন্ত্রণ কিন্তু তুমিও হারিয়েছিলে। আমি তো শুধু ফাইদা লুটেছি।”

দুষ্টু হাসি তার অধরে। লজ্জায় মিইয়ে গেল বেগম। সরে বসার চেষ্টা করে আড়ষ্ট গলায় বলল, “যা তা বলতে শুরু করেছেন। ছি!”

কব্জি চেপে ধরে আরো কাছে টেনে নিলো সুলতান। তৈলাক্ত মুখে চকাস করে চুম্বন করে বসলো। ভ্রু কুচকাল বেগম। সরে বসে বিরক্ত স্বরে বলল, “এটা কী করলেন?”

“আরেকবার দেখতে চাইছো কী করলাম?”

“পুরো মুখ তৈলাক্ত হয়ে আছে দেখছেন না?”

“তো?”

“সরে বসুন। মুখ ধোয়া হয়নি এখনো। ঘিণ্যা করছে না আপনার?”

“না করছে না। কাছে এসো।”

“না, আসবো না। দিনকে দিন ইতর, বর্বর হয়ে যাচ্ছেন আপনি।”

“বউকে ভালোবেসে কত সভ্য পুরুষ ইতর হয়ে গেল। আর আমিতো আরো বেশি করে বর্বর হতে চাই সুন্দরী। কাছে এসো।”

“কিন্তু আমি মোটেই বর্বরতা সহ্য করবো না। সুলতান অসভ্য হয়ে গেলে বাকিদের কী হবে?”

“বউকে ভালোবেসে অসভ্য হলে আমি বিশেষ সম্মাননা দেবো সেইসব পুরুষদের।”

বারংবার এসব নষ্ট কথাতে কান ঝাঁ ঝাঁ করছে যেন বেগমের। দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। এক ছুটে বাইরে যাওয়ার পূর্বেই দৌড়ে এসে ধরে ফেলল সুলতান। শক্ত করে দু’হাত ধরে উদম বুকে ঠেসে ধরতেই শিউরে উঠছে বেগম। খিচে চোখদুটো বন্ধ করে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল, “অন্তত পাঞ্জাবী অথবা ফতুয়া তো শরীরে চড়িয়ে নিন। এভাবে বেলাজের মতো ঘুরছেন কেন আমার সামনে?”

“কেন? সমস্যা হচ্ছে তোমার? রাতে তো…..”

বিজলির বেগে ঘুরে তার বুকেই মুখ গুঁজে দেয় বেগম। থেমে যায় সুলতান। নীরবে কাটলো কিছুক্ষণ। বেগম বিড়বিড়িয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “স্বৈরাচারী সুলতান।”

“কী বললে?”

“স্বৈরাচারী।”

“আবার বলো।”

“স্বৈরাচারী।”

“আবার।”

বলল না বেগম। এবার সুলতান বেশ গর্বের সাথেই বলল, “এবার তো আমি এভাবেই থাকবো। স্বৈরাচারী শব্দটা এতো সুন্দর শোনায় আগে উপলব্ধি করিনি কেন? তুমি বলোনি বলেই হয়তো।”

বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরলো সে। কাঁধের ওপাশে চিবুক ঠেকিয়ে মুখটা কানের খুব কাছে এগিয়ে নিলো। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলল, “এলি।”

সাড়া দেয় না বেগম। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়েছে পূর্বের তুলনায়। সুলতান পুনরায় ডেকে উঠলো, “এলি, এলি শুনছো?”

এবারও নিশ্চুপ বেগম। বরং কানের কাছে নিশ্বাসের উষ্ণতায় আরও মিশে গিয়ে খামচে ধরলো তাকে। হাসলো সুলতান। উপলব্ধি করলো লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা। অতিরিক্তই লজ্জা পাচ্ছে। কানের কাছের চুলগুলো আঙ্গুলের সাহায্যে সরিয়ে দিয়ে বলল, “প্রতিরাত, প্রতিবার তোমার উল্টো করে গাউন পরার কারন হতে চায় এই স্বৈরাচারী সুলতান।”

এক ঝটকায় সরে দাঁড়ায় বেগম। আঁধারের কারনে উল্টো করে পরা হয়েছে গাউনটা। এতক্ষণ খেয়াল করেনি সে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। অসহায় চোখে সুলতানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো মিটমিটিয়ে হাসছে লোকটা। কী সুন্দর সেই হাসি। অথচ একটু আগেই এই সুদর্শন পুরুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লজ্জার বাক্যটা সাবলীলভাবে উচ্চারণ করেছে নির্লজ্জের মতো। এমন নষ্ট, বেশরম, নির্লজ্জ সুলতান পৃথিবীর বুকে আর কখনো এসেছে বলে মনে হয় না। পুরো সাম্রাজ্যকে লজ্জায় ডুবিয়ে দিতে এমন একটা বেলাজ সুলতানই যথেষ্ট।

সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। মহলের সামনের বিশাল খোলা উদ্যানে গোলাকার জায়গা ঘিরে কেদারা পেতে রেখেছে সেবকেরা। একে একে জায়গাটা ঘিরে নিচ্ছে সৈনিকরা। অস্ত্র হাতে সকলকে নির্দেশনা দিচ্ছে মাহতাব। জারনাব, আব্দুর রহমান, তানহা, আবরার জাওয়াদ, তোহফা, হাদিদ, ফাইজা, হাফসা, মাজেদা বানু সকলেই সেখানে উপস্থিত। সুলতান শাহজিল সাম্রাজ্যে নেই। আর ওয়াসিফা সুলতান এখানে আসেনি। উল্টো ছোট ভাইকে ইচ্ছামতো ঝেড়েছে এমন একটা প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য। কামরায় দাঁড়িয়ে বেগমের গাউনের উপর কোমরের বন্ধনী এঁটে দিচ্ছে সুলতান। উশখুশ করছে বেগম। তার একদমই ইচ্ছা করছে না মামাশ্বশুড়ের সাথে লড়তে। কিন্তু সুলতান ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়। লড়তেই হবে। ধমকে উঠলেন সুলতান, “আহ! নড়ছো কেন এত? চুপচাপ দাঁড়াও। বন্ধনীটা আটতেই দিচ্ছ না ঠিক করে।”

গলা ঝেড়ে নিলো বেগম। অসহায় গলায় বলল, “এই লড়াই বন্ধ করে দিলে হয় না?”

“না হয় না। লড়তে হবে তোমাকে। নাহলে আমি ঐ লোকের মুখ সেলাই করে দেব। সেটা কি ভালো হবে?”

আৎকে উঠলো বেগম। তাড়াহুড়োর স্বরে বলল, “না না। এমন করবেন না। আমি লড়ব।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেগমেকে সাথে নিয়ে উদ্যানে উপস্থিত হলো সুলতান। তোহফাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে সবার সামনের রাজকীয় কেদারায় গিয়ে বসলো। বেগমকে ইশারা করলো তলোয়ার নিতে। অসহায় হয়ে মাহতাবের হাত থেকে তলোয়ার তুলে নিলো বেগম। হাসছে তার মামাশ্বশুড়। সহজেই জিতে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে চোখে মুখে। দু’জন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো সুলতানের নির্দেশের। তোহফা খেলছে সুলতানের কোলে বসে। কখনো আবার ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে মায়ের দিকে। হয়তো ভাবছে মায়ের হাতে এতবড় অস্ত্র কেন? সুলতানের ঠিক পেছনেই ডানপাশে বসেছে তানহা। তারপর আব্দুর রহমান, জারনাব, বণিক। জারনাব আর বণিকের কেদারার মাঝে একটি শূন্য কেদারা পড়ে ছিলো। সমস্ত দায় দায়িত্ব শেষে সেখানে এসে ধপ করে বসে পড়লো মাহতাব। আব্দুর রহমানের মাঝে তখনও অনুতপ্ততা। সে অন্যমনস্ক হয়ে আছে নিজের অপরাধের কথাগুলো ভেবেই। ফাইজা লাফালাফি করছে উত্তেজনায়। হাফসা রাগ করে থামিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা আজকাল মাঝে মাঝেই ভীত হয়ে থাকে। কিন্তু আজ এসব আয়োজনে নিজের ভয়টাকে বোধহয় দূরে ঠেলে দিয়ে উপভোগ করতে চাইছে। তানহা একটাবারের জন্যও তাকালো না মাহতাবের দিকে। বরং সুলতানের কোলে বসে থাকা তোহফার সঙ্গে হাসিমুখে এটা ওটা বলছে সে। যেন নিখুঁতভাবে উপেক্ষা করতে চাইছে মাহতাবকে। মাহতাব খানিক অবাক হলেও বেশি ধ্যান দিলো না সেদিকে। জারনাবের দিকে চেয়ে ধীর স্বরে বলল, “জুঁই।”

ফিরে তাকালো জারনাব। অত্যন্ত চিন্তিত গলায় বলল, “এখন কী হবে আজমাইন? ব্যথা পাবে তো জোভিয়া।”

হতাশ হলো মাহতাব। নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে সহসা হেসে বলল, “চিন্তা করো না। সুলতানার কিচ্ছু হবে না। সুলতান আছেন তো এখানে।”

“সেটাই তো বড় ভয়।”

“মানে!”

“তোমার পাশে তাকিয়ে দেখো বণিক কীভাবে একদৃষ্টে চেয়ে আছে জোভিয়ার দিকে। আমার খুব ভয় করছে আজমাইন।”

ঘুরে তাকালো মাহতাব। বণিককে এভাবে হাঁ করে বেগমের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে অতিশয় বিরক্ত হলো সে। এর মতো বোকা সে আর দুটো দেখেনি। ম’রার এতো তাড়া কেন এটার তার তো বুঝে আসে না।
পুনরায় জারনাবের দিকে চেয়ে বলল, “তুমি এতো চিন্তিত হয়ো না। আমি দেখছি। কিছু হবে না তোমার বোনের আর এই বণিককেও দেখি বাঁচানো যায় কি-না। হাজার হলেও তোমার বেচারা সে।”

জারনাব কটমট করে তাকালেও আর সে দৃষ্টি নজরে এলো না মাহতাবের। সে ইতিমধ্যে কেদারা ঠেলে এগিয়ে গেছে বণিকের পাশে। কানের কাছে ঝুঁকে গিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল, “দুনিয়াতে ম’রার এত উপায় থাকতে তুমি এই পথটাই কেন বেছে নিলে?”

আকস্মাৎ এহেন বাক্যে চকিতে ফিরল আবরার। অবাক হয়ে বলল, “আমাকে বলছো?”

“আর কেউ তো বেচারা নেই এখানে। তা তোমার এত ম’রার ইচ্ছা কেন বলোতো?”

“আমার! আমার কখন ম’রার ইচ্ছা হলো?” হতবাক হলো বণিক।

তেতে উঠলো মাহতাব। রাগান্বিত স্বরে বলল, “তাহলে এভাবে আশিকের নজরে সুলতানের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি কি জানো না এর পরিণাম? প্রাণে মে’রে ফেলবে সুলতান তোমাকে। একবার যদি তোমাকে হ’ত্যার আদেশ দিয়ে বসে তাহলে আমারও কিছু করার থাকবে না। তখন না চাইলেও মা’রতে হবে তোমাকে।”

“না মানে……” থতমত খেল বণিক।

“দুনিয়াতে এতো এতো মেয়ে থাকতে তোমাকে এই মেয়েটাকেই ভালোবাসতে হলো? মানে সত্যি! কী যাচ্ছেতাই রকমের ভাগ্য তোমার। এমন একজনকে ভালোবেসে ফেলেছো যে নিজেই তোমাকে মে’রে ফেলবে বেশি ভালোবাসা প্রকাশ করলে। আর তার চারপাশে কঠিন বেষ্টনী হয়ে সুলতান তো আছেই। তার থেকে কখনোই ছাড় পাবে না।”

কিছুই বলল না বণিক। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বোধহয় পাত্তাই দিলো না মাহতাবের কথাগুলোকে। লড়াই শুরু হতে এখনো কিছুটা সময় আছে দেখে তানহার দিকে ঘুরে বসলো সুলতান। আদুরে কন্ঠে ডাকলো, “তানহা।”

তোহফার থেকে নজর হটিয়ে ফিরে তাকালো তানহা। নির্জীব হয়ে বলল, “হুম?”

“তোর কি কোনো কারনে মন খারাপ?”

“না তো।”

“কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বল। বিবাহের কারনে এরকম চুপচাপ হয়ে গেছিস? তোর অসম্মতিতে কিছুই হবে না। আমাকে বল।”

ছলছল হলো তানহার দৃষ্টি। অসহায় হয়ে চেয়ে থাকলো ভাইয়ের দিকে। সুলতান আবারো বলল, “বিবাহে সম্মতি নেই তোর?”

ঠোঁট চেপে ডানে-বামে মাথা দুলালো তানহা। ধরা গলায় বলল, “আমি এখন বিবাহ করতে চাই না ভাইয়া।”

“তোর কোনো পছন্দ আছে?”

আড়চোখে একবার মাহতাবের দিকে তাকালো তানহা। কিন্তু মাহতাবতো একদৃষ্টে জারনাবকেই দেখে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় তানহা। স্বাভাবিক গলায় বলল, “না, আমার নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। আম্মাকে একটু বোঝাও না ভাইয়া। আমি আরো কিছুদিন পরি বিবাহ করতে চাই।”

সন্তুষ্ট হলো সুলতান। তানহার জন্য বেশ চিন্তায় ছিলো সে। হাসিমুখে তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তাহলে একদম মন খারাপ করে থাকিস না। এই বিবাহ হবে না। তুই যেদিন চাইবি সেদিনই হবে। এখন একটু হেসে দেখা তো দেখি।”

মন থেকে হাসি না আসলেও ভাইকে দেখানোর জন্য অধর প্রসারিত করলো তানহা। তাকে খুশি দেখে সুলতান মুচকি হেসে ঘুরলো বেগমের দিকে। তার গতিবিধি লক্ষ করেই হুট করে বণিকের দিকে তাকালো। বণিক এখনো একদৃষ্টে, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে আছে বেগমের দিকে। যেন কতকাল দেখে না তাকে। এই মুগ্ধ দৃষ্টি সহ্য হলো না সুলতানের। ফুঁসে উঠলো মুহুর্তেই। রাগে রি রি করে উঠলো তার শরীর। কিছুক্ষণ বাদে কিছু একটা ভেবে কেদারা ছেড়ে উঠে মহলে চলে গেল বণিক। মৃত্যুর সময় আসলে বুঝি মানুষ নিজেই মৃত্যুর দিকে দৌড়ায়। আর এক মুহুর্ত সময় ব্যয় করলো না সুলতান। দ্রুত তোহফাকে মাহতাবের কোলে দিয়ে শক্ত করে ধরলো নিজের তলোয়ার। একবারও পেছনে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো মহলের দিকে। মাহতাব সবকিছু লক্ষ করলেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। আড়চোখে একবার জারনাবকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তোহফাকে নিয়ে। যেন কিছু ঘটেইনি। সে উপেক্ষা করলেও বেগমের নজর থেকে আড়াল হলো না এই ঘটনা। সব ভুলে তলোয়ার ফেলে দিয়ে দিক্বিদিক ছুটে গেল সে। সমস্ত সেবক-সেবিকা, সৈনিক আজ বাইরে থাকায় একবারে ফাঁকা মহল। স্তব্ধ হয়ে আছে। এ যেন ঝড় ওঠার পূর্বের কঠিন নীরবতা। অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা বণিকের কামরার দিকে ছুটছে বেগম। আতঙ্কে রক্তশূন্য হলো যেন শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। বণিকের কামরার দূরত্বও বুঝি আজ কয়েকশো গুন বেড়ে গেছে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে অবশেষে বোধহয় বণিকের কামরা পাওয়া গেল। দ্বার ঠেলতে উপলব্ধি হলো ভেতর থেকে এঁটে দেওয়া হয়েছে কপাট। আরোও ভীত হয়ে পড়লো বেগম। কারণ ভেতর থেকে বণিকের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বেঁচে আছে তো লোকটা? চোখের পলক পড়তেই ভেতর থেকে ভেসে এলো সুলতানের চাপা গর্জন।শিকার শেষে সিংহ যেমন গর্জে ওঠে তেমনটাই ঠেকল বেগমের নিকট। কামরার ভেতর সুলতানের অস্তিত্ব হাজারগুন উত্তেজিত করে তুলল বেগমকে। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। আজ বুঝি অপরাধের রঙে রেঙেই গেল তার প্রিয় হাতগুলো। শক্ত হাতে বারংবার দ্বারে থাবা বসিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে ডেকে উঠলো, “দ্বার খুলুন সুলতান।”

চলবে…….