#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_32
তীব্র আঁধার ছুঁয়ে দিয়েছে মহলের গুপ্ত স্থানে অবস্থিত কাল-কুঠুরিকে। বিকেলের এই সুন্দর প্রকৃতি ছুঁতে পারছে না সেই স্থান। আলো নেই বিন্দুমাত্র। ছোট্ট লোহার কারাগার জুরে পিনপন নীরবতা। মেঝেতে বসে ঝিমোচ্ছে কাল-কুঠুরির এক এবং একমাত্র কয়েদি। যার খোঁজ জানে না দুনিয়াবাসি। আর না তো কখনো জানতে পারবে তার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। শক্ত লোহার বেড়ি তার হাত-পা, গলায় দাগের সৃষ্টি করেছে। শরীরে পেঁচিয়ে আছে ভারী শেকল। আকস্মাৎ কারোর উপস্থিতি পেয়ে আঁখি মেলল সে। লাল টকটকে সেই দৃষ্টি। লম্বা লম্বা চুল-দাঁড়িগুলো অযত্নে সফেদ বর্ণ ধারণ করেছে। গালে-মুখে ময়লা। কতকাল পানির স্পর্শ পায় না যেন। পাংশুটে মুখভঙ্গি। একজন সৈনিক এগিয়ে এলো ভীত মুখে। এক হাতে মশাল অন্য হাতে খাবার। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সযত্নে লোহার শিক গলিয়ে কারাগারের ভেতরে ছুড়ে দিলো খাবার। পানির একটা বড় কলসি কারাগারের ভেতরেই থাকে। সুযোগ বুঝে কয়দির ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাতে পানি ভর্তি করে দেওয়া হয়। সৈনিক কোমরে গুঁজে রাখা ওষুধের শিশি এগিয়ে দিলো কারাগারের ভেতরে। হাসলো কয়েদি। সৈনিকের ভীরুতা দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো। তবুও যেন সৌন্দর্য মেলল সেই হাসিতে। চেহারায় সে কী দাম্ভিকতা। সেই বোধহয় প্রথম কয়েদি যে কি-না বন্দি হয়েও এত সেবাযত্ন পায়। হাত-পায়ের ক্ষতগুলোর দিকে চেয়ে মলিন হলো তার অভিব্যক্তি। কবে, কোন সময় এই ক্ষতগুলো সৃষ্টি হয়েছে মনে পড়লো না। অবশ্য এই ঘটনা আজ নতুন নয়। এ তার নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রত্যহ কাজগুলো অনেক কিছুই মনে থাকে না তার। এই যেমন এখন সে কত স্বাভাবিক আছে। নিজের নাম-পরিচয়, পরিবার-পরিজন সবকিছুই তার মস্তিষ্কতে জীবিত। অথচ কী যে হয়। সে সব ভুলে যায়। আক্রমণ করে বসে যাকে-তাকে। ভুলে যায় সবকিছু। সৈনিককে ভয় পেতে দেখে সে মৃদু হেসে বলল, “ভয় পাচ্ছো কেন? আমি কি খেয়ে ফেলব তোমাকে?”
ভয়ে কুঁকড়ে গেল সৈনিক। এই রাশভারি কন্ঠ আতঙ্ক ধরালো। মৃ’ত্যুর আতঙ্ক। ভয়ে ভয়েই তাকালো কয়েদির দিকে। কী সুন্দর হাসছে। যেন এত ভালো মানুষ দুনিয়ার বুকে আর নেই। অথচ যখনই তার নেশা চেপে বসে তখনই সে জানোয়ার হয়ে ওঠে। হিং’স্র বাঘের ন্যায় আচরন করে। কাউকে না পেলে নিজেকেই নিজে আঘাত করে। তাই প্রতিদিন তাকে খাবারের পাশাপাশি ওষুধও দেওয়া হয়। এক ছুটে পালিয়ে যেতে ধরলো সৈনিক। নিরাশার চাদরে ঘিরে ধরলো উক্ত কয়েদিকে। একটু কথাও কেউ বলে না তার সাথে। কত বছর সে কথা বলতে পারে না। বাইরের জগতের কাছে হয়তো সে মৃত। কিন্তু গুটিকয়েক যেই মানুষগুলো জানে তার অস্তিত্বের সন্ধান তারাও ভয় পায় তাকে। সে উচ্চস্বরে বলল, “ওকে বলো, এখানে যেন একটা ছোট লন্ঠন লাগিয়ে দেয়। অন্ধকারে ভালো লাগে না আমার।”
ততক্ষণে পালিয়ে গেছে সৈনিক। শুধুমাত্র পেটের দায়েই হয়তো এই কাজ করতে হয় তাকে। নাহলে কেই বা চাইবে রোজ রোজ এভাবে ভয়ে ভয়ে কর্ম করতে। স্লান হেসে হাতে-পায়ে ওষুধ লাগাতে ধরলো। খেতে ইচ্ছে করলো না। যত দ্রুত ম’রতে পারবে তত দ্রুতই সকলে আতঙ্কমুক্ত হবে। সে জানে কাল লন্ঠন জ্বলবে এই কারাগারে। তার কোনো কথাই যে ফেলে দেওয়া হয় না।
খাবার, ওষুধ সবই দেওয়া হয় তাকে। এমনকি ইদের পোশাক, পায়েসটাও পাঠানো হয় এই কারাগারে। শুধু বাইরের আলো দেখা হয় না তার। ছুঁয়ে দেওয়া হয় না প্রিয়জনদের। এতে তার কষ্ট, আফসোস হলেও রাগ হয় না। সে জানে তাকে এখানে আটকে রাখা ব্যতীত উপায় নেই। সে যে আর খোলা পাখির ন্যায় জীবনযাপন করার অবস্থাতে নেই। অন্য কোনো সাম্রাজ্য হলে হয়তো এতদিনে ফাঁসি দিতো তাকে। হ’ত্যা করা হতো বহু পূর্বেই। শুধুমাত্র মায়া থেকেই তাকে এখনো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সুলতান শাহজিলের প্রতি একচুল পরিমাণ অভিযোগ নেই তার। যা আছে তা কেবলই শ্রদ্ধা, মায়া, সম্মান। কাতর চোখজোরা বুঁজে নিলো সে। বন্ধ দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো দু’জন ফুটফুটে কিশোরের হাস্যজ্জ্বল চেহারা। তলোয়ার হাতে দৌড়ে ছুটতে ছুটতে যেন তার দিকেই আসছে তারা। দু’জন একসাথে তার বুকে হামলে পড়তেই দৃষ্টি মেলল সে। ছলছল করে উঠলো নয়ন। কাঁপা কাঁপা অধর নাড়িয়ে বলল, “কত বড় হয়েছে ওরা? যুবক হয়েছে? তাগড়া যুবক। অস্ত্র ধরতে শিখেছে কি আমার মতো? না কি আমার চেয়েও দক্ষ হয়ে উঠেছে সেই কাঁচা হাতগুলো?”
কিছুক্ষণ থেমে বড়বড় শ্বাস নিলো। আবারো বলল, “সে কি সুলতান হয়েছে? অত্যাচারী শাসক হয়নি তো? না না, সে কখনোই অত্যাচারী হতে পারবে না। নিশ্চয়ই দায়িত্ববান একজন সুলতান হয়ে উঠেছে। বিবাহ করেছে কি?”
বণিকের দ্বারের সম্মুখে অস্থির বেগম। শক্ত হাতে কয়েকবার থাবা বসাতেই কড়কড় শব্দ তুলে খুলে গেল দ্বার। স্বাভাবিক, গম্ভীর ভঙ্গিতে দ্বার ঠেলে বেরিয়ে এলো সুদর্শন পুরুষ। তলোয়ার কোমরে ঝুলছে নিয়মমাফিক। পেছনে আরো একজন পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে দ্বারের সম্মুখে। সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না বেগম। বরং রক্ত লাল দৃষ্টিতে গম্ভীর পুরুষের মুখ পানে চেয়ে রইল। ভেজা চোখের পাপড়ি। বিন্দুমাত্র নড়চড় নেই। দুপা এগিয়ে এলো সুলতান। অনিমেষ চেয়ে থেকে হুট করে বলে বসলো, “মাশা’আল্লাহ।”
কিছু না বুঝে বোকার মতো তাকালো বেগম। অধর গলে বেরিয়ে এলো, “হু?”
“সুন্দর লাগছে। অত্যধিক সুন্দর।” পুনরায় বলল সুলতান।
বাক্যের আগা-মাথা উপলব্ধি করতে সময় লাগলো বেগমের। মস্তিষ্ক সদয় হতে আঁখি নড়ে উঠলো। পরপর ভেজা পলক পড়লো দু’বার। ‘কীসের ভেতর কী, পান্তা ভাতে ঘি’ প্রবাদের যথার্থতা টের পেল এই মুহুর্তে। সুলতান আবারো তাকে এলোমেলো করতে গাঢ় দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে আওড়ালো, “চোখের পানি নারীকে অপরূপার খেতাব কুড়িয়ে দেয়।”
“আর আমার বেগমকে জান্নাতের হুর। না না, হুর নয়। হুরদের সর্দারনী।”
কিছুক্ষণ থেমে থেমে বলল সে। এলোমেলো হলো বেগম। দৃষ্টিতে বিস্ময় নিয়ে এক ফোটা শব্দ বেরোলো না মুখ থেকে। ধোঁয়াশা হলো চতুর্দিক। সবকিছু ভুলে যেতে ইচ্ছে করলো নিমেষেই। বদলে গেল সুলতানের ভাবাবেগ। ভ্রু কুচকে বলল, “কাঁদছিলে? কেন কাঁদছিলে? ম’রে গেছি আমি? বলো, ম’রে গেছি আমি?”
বাঁধ ভাঙা স্রোতের ন্যায় পুরুষালি বুকটাতে আছড়ে পড়লো বেগম। বুকের কাছের কাপড়টুকু শক্ত করে খামচে ধরলো। ভীত আর ধীর গলায় বলল, “ভয় পেয়েছিলাম আমি।”
“ভয়! কিন্তু কেন?”
এই নারীর ভেজা চোখ সহ্য করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সুলতানকে। তবুও কেন যেন মনে হলো তার জন্য কাঁদছে না এই হুর। পেছনে দ্বারে দাঁড়ানো বণিকের মৃত্যুভয়ে কাঁদছে। রাগে-অভিমানে মুষড়ে উঠলো যেন। এই ভেজা চোখ অন্য পুরুষের জন্য সেকথা মানতেই চাইল না সে। মেয়েটার অশ্রু বড্ড পোড়ায় তাকে অথচ অন্য পুরুষের জন্য ফেলানো সেই অশ্রুই যেন কাঁটার মতো বিধছে শরীরে। পীড়া দিচ্ছে। বক্ষদেশে গলিয়ে রাখা মাথাটাকে বুকে চেপে ধরার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা না চাইতেও গুটিয়ে নিলো। তার বুকের ওপর নাক ডলছে বেগম। শিউরে উঠলো সে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছাটাকে দমন করে খসখসে কন্ঠে শুধাল, “বণিকের জন্য কাঁদছিলে? কী হয় সে তোমার? বিশেষ কেউ? যার জন্য চোখের পানি ফেলানো যায় বিনা সংকোচে।”
চকিতে মাথা উঠালো বেগম। বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল গম্ভীর আর কঠোর মুখটার দিকে। মায়া-দয়া কি বিলীন হয়ে গেছে এই মুখটা থেকে? কী বলছে এসব সুলতান! সে কেন বণিকের জন্য কান্না করবে? উঁহু, অন্য পুরুষের জন্য চোখের পানি ঝরাইনি সে। উত্তেজিত গলায় বলল, “সুলতান।”
“উত্তর দাও এলি।”
“ভুল বুঝছেন আপনি।”
“অন্য পুরুষের জন্য চোখের পানি ঝরানোর অনুমতি আমি দেইনি।”
শান্ত, শীতল তার কন্ঠ। শান্ত ভঙ্গিমার পেছনের রাগটা যেন ধ্বংস করে দিতে সক্ষম পুরো পৃথিবী। বেগমকে চুপ থাকতে দেখে অধৈর্য হয় শান্ত পুরুষ। হাঁসফাঁস কন্ঠে উত্তেজনা মিশিয়ে শুধায়, “কেন এলি? কেন অন্য পুরুষের জন্য কাঁদবে তুমি?”
“আমি অন্য পুরুষের জন্য কাঁদিনি সুলতান। বিশ্বাস করুন, এই পানি অন্য পুরুষের জন্য নয়।”
খুব করে বিশ্বাস করতে চাইল সুলতান। কিন্ত চোখের পানির আর কোনো কারন খুঁজে পেল না। অস্থির চিত্তে শুধায়, “তবে কেন এই নোনাজল? বলো এলি। কেন ছুটে এসেছো তুমি?”
কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য বাক্য সাজালো বেগম। খানিকটা সময় নিলো। অথচ বলা হলো না কিছুই। পূর্বেই এগিয়ে এলো বণিক। বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে দৃষ্টিতে চঞ্চলতা ফুটিয়ে কিছু বলবে সজোরে ধমকে উঠলো সুলতান, “চুপ, একদম চুপ। মাঝখানে কেউ কথা বলা পছন্দ নয় আমার। আমার বেগমের পাশে কেউ দাঁড়াক সেটা আরোও অপছন্দনীয়।”
হুট করে জোরালো ধমকে কেঁপে উঠলো বেগম। ভয় ধরলো বুকে। তার আতঙ্কিত মুখ বোধহয় সহ্য হলো না বণিকের। একবার তাকিয়েই ব্যস্ত হয়ে সরে দাঁড়ালো সে। দূরত্ব বাড়ালো বেগমের থেকে। উত্তেজিত হয়ে সুলতানের উদ্দেশ্যে বলল, “চিৎকার করবেন না। সরে দাঁড়াচ্ছি আমি। হুটহাট চিৎকারে চমকে উঠছে জোভিয়া।”
হতবাক দৃষ্টিতে বেগমের দিকে চাইল সুলতান। সত্যিই চমকে উঠেছে মেয়েটা। কেমন কুঁকড়ে গিয়েছে আতঙ্কে। উঁহু, এভাবে চিৎকার করা একেবারেই উচিত হয়নি। ভুল করেছে সে। বড্ড ভুল করেছে। ভীষণ রাগ হলো। সে কেন ভুলে গেল চিৎকার-চেঁচামেচি সইতে পারে না তার বেগম। আৎকে ওঠে আকস্মাৎ চিৎকারে। নিজের রাগ দমন করার বৃথা চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। রাগ কেন কমছে না? এই ভেজা চোখ অন্য কারোর জন্য বলেই কি? অতঃপর অত্যন্ত শান্ত গলায় কটাক্ষ করে বলল,
“খুব চিন্তা হচ্ছে? পরের স্ত্রীর প্রতি এত দরদ?”
শেষবারের মতো পূর্ণ দৃষ্টিতে বেগমের আতঙ্কিত মুখ পানে তাকালো বণিক। হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। খুব ইচ্ছে করছে এই মুখের পানে চেয়ে পুরো জনম পাড় করে দিতে। কিন্তু হায়! ভাগ্য তার সহায় নয়! তার ভালোবাসা তার নয় ভাবতেই যেন বুকে চিনচিনে নিখুঁত ব্যথা অনুভূত হলো। বেগমের থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে কন্ঠে কঠিন রকম ব্যথা ধারণ করে বলে উঠলো,
“দয়া করে ওকে কাঁদাবেন না। আমি ওয়াদা করছি সমস্ত অনুভূতি মুছে ফেলব নিজের হৃদয় থেকে। ভুলক্রমে নজর পড়ে গেলেও সেচ্ছাই কখনো এই মুখ দেখব না। দূরত্ব বজায় রাখবো আকাশসম।”
কথাখানা বলেই সবকিছু উপেক্ষা করে কামরায় গিয়ে দ্বার এঁটে দিলো সে। হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো দ্বারের সামনেই। অগ্রসর হবার জন্য আর শক্তি নেই শরীরে।
ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়া অশ্রুধারা বাঁধ মানলো না। জোরপূর্বক ভিজিয়ে তুলল নয়ন। বাঁধ ভাঙা কষ্টে নিমজ্জিত হলো পুনরায়। ভালোবাসা আর বিষাদ বুঝি একই তিথিতে জন্ম নিয়েছিল! তাইতো এত ভাব তাদের। যেখানে ভালোবাসা গড়ে ওঠে সেখানেই বিষাদ নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। কে বলেছে ভালোবাসার মানুষ ভালো থাকলেই অপর প্রান্তের মানুষটা ভালো থাকে? এ যে চরম মিথ্যা উক্তি। সে তো ভালো নেই। তার ভালোবাসা ভালো আছে সুলতানকে নিয়ে অথচ সে ভালো নেই। ক্ষণে ক্ষণে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে হৃদয় আঙিনা। ‘প্রিয় মানুষটা ভালো আছে অন্যের ভালোবাসায়’ এ যেন প্রাণনাশক এক বাক্য। সে ভেবেছিলো সুলতানের সমস্ত মিথ্যা, ছলচাতুরি বলে দেবে জোভিয়াকে। যেন পরবর্তীতে মেয়েটাকে ধোঁকায় পড়তে না হয়। মাইরার ঘটনা, কারাগারের ঘটনা সবই বলে দিতে চেয়েছিলো জোভিয়ার নিকট। সে চায়নি মেয়েটা ধোঁকায় পড়ুক। কিন্তু তখন মাহতাবের কথাগুলো শুনে যখন সুলতানের দিকে তাকালো তখন যেন সমস্ত ভুল ধারনা ভেঙে গেল নিমেষেই। সুলতানের সেই মুগ্ধকর দৃষ্টিতে সে দেখেছে জোভিয়ার জন্য সাজিয়ে রাখা অগণিত স্বপ্ন, ভালোবাসার উন্মাদনা, আগলে রাখার দৃঢ়তা। তাইতো সব ফেলে চলে এসেছিল নিজ কামরায় দুঃখ লুকোতে। দ্বার আঁটার আগেই তেড়ে আসলো সুলতান। শাসিয়ে উঠলো অগ্নি দৃষ্টিতে। সহসা তলোয়ার উচিয়ে কী তেজি কন্ঠেই না বলে উঠলো, “খবরদার তাকাবে না আমার এলির দিকে। আরেকবার তাকিয়েছো তো চোখ তুলে ভাসিয়ে দেবো শাহ নদীতে।”
চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়েছিলো বণিক। সুলতান তাকে শাসাচ্ছে অথচ সেই অগ্নিঝরা দৃষ্টিতেই সে দেখতে পেয়েছিলো প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলার ভয়, আতঙ্ক। হতাশ হয়েছিল বণিক। দ্বার খুলতেই জোভিয়ার অশ্রু ভেজা নয়নে দৃষ্টি আটকেছিল তার। সেখানেও সে খুঁজে পায়নি নিজেকে, পেয়েছিল সুলতান শাহজাইনকে। নিজের উপরেই তাচ্ছিল্য হেসেছিল বণিক। এত এত ভালোবাসার মাঝে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে যে পাপ হবে। ভীষণ অন্যায় হবে। সাধ্য থাকলে সে নিজের সমাধিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখে দিতো-
‘আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে ছিলো দূর দেশের ক্ষমতাশালী এক রাজার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ’
মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেগম। চোখ মেলানোর সাহস হলো না সুদর্শন পুরুষের চোখে। তাকাতে পারছে না তার নিজস্ব, একান্ত চাঁদটির দিকে। জড়তা ঘিরে ধরেছে তাকে। সাহস হলো না কিছু বলার। রেগে আছে কি পুরুষটা? বড্ড বেশিই রাগান্বিত বুঝি তার পুরুষটা। এই পুরুষের রাগ যে বড় ভয়ানক হয়। দুমড়ে মুচড়ে দেয় তার দৃঢ়তাকে। মাটিতে মিশিয়ে দেয় সমস্ত সাহস, দাম্ভিকতা। বারংবার প্রচেষ্টার পরেও চোখে চোখ রাখতে অক্ষম বেগম। অভিমান হলো হঠাৎই। মানুষটা কি দেখতে পাচ্ছে না সে কাঁদছে? কেন জড়িয়ে নিচ্ছে না তাকে? সে কি বেশি নিষ্ঠুর হতে চাচ্ছে? সমস্ত আড়ষ্টতা ঠেলে আওড়ালো, “সুলতান।”
“এই অশ্রু আমার জন্য? বলো এলি?”
নীরব রইল বেগম। প্রিয় পুরুষের আবেশি স্বরে খেই হারালো কথার। শব্দভাণ্ডার হাতরালো অস্থির চিত্তে। উত্তেজিত, অধৈর্য সুলতান। সইল না এই নীরবতা। পুনরায় অস্থির স্বর, “উত্তর দাও এলি। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। এই অশ্রু আমার জন্য?”
“আপনার জন্যই সুলতান। অন্য কারোর জন্য নয়।”
তড়িৎ বেগে শীতল স্রোত বেয়ে গেল শীড়দারা বেয়ে। বিচলিত হলো শক্ত পুরুষ। নিয়ন্ত্রণ হারালো সম্পূর্ণভাবে। এই একটা বাক্য যেন ফিরিয়ে দিলো তার আটকে থাকা প্রাণ। খলবলিয়ে উঠলো উচ্ছ্বাসিত হৃদয়। নিজ মনেই আওড়ালো,
“যদি কখনো মাটি হও তুমি, আমি বর্ষণ হব। তোমার বুকে আছড়ে পড়ব মেঘলা আকাশ সরিয়ে।
যদি বসন্তের ঝরে যাওয়া ফুল হও তুমি, আমি ঝড়ো হাওয়া হব। তীব্র অনিলে নিজের সাথে উড়িয়ে নেব তোমায়।”
সুলতানের নীরবতা ব্যথিত করলো বেগমকে। আগ্রহী নয়নে চাইল নিজের পুরুষের পানে। বোঝার চেষ্টা করলো তার ভাবাবেগ। অস্থির হয়ে বলল, “কিছু বলুন সুলতান। এভাবে চুপ থাকবেন না। ভয় হয় বড্ড।”
পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল সুলতান। ইচ্ছে করলো এক টানে নিজের বুকে মিশিয়ে নিতে মেয়েটাকে। হাত নিশপিশ করে, অশ্রু ভেজা নয়নজোরা ছুঁয়ে দিতে। বড় কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে। চাপা অভিমান জড়াচ্ছে বুকে। বণিকের মৃত্যুভয়ে কেন ছুটে আসবে এলি? একদম আসবে না। শুধু তার জন্য ছুটে আসবে। মানের পাল্লা ভারি হলো। বুকে জড়িয়ে নেওয়ার পরিবর্তে বড় বড় কদম ফেলে হনহনিয়ে চলে গেল সে। ফেলে যাওয়া প্রতিটি পদচিহ্নের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইল তার প্রেয়সী। ধীর পায়ে সেও বেরিয়ে এলো মহল ছেড়ে। সুলতান ইতিমধ্যে নিজ কেদারায় গিয়ে বসে পড়েছে। কোলে তুলে নিয়েছে তোহফাকে। তোহফার ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো খেলা করছে পিতার দাঁড়ির মধ্যে। মাঝে মাঝে দাঁড়িগুলো টেনে ধরে দুষ্টু হাসছে সে। অথচ কন্যার সাথে আজ হাসছে না সুলতান। সে নীরব, গম্ভীর। কালবৈশাখী মেঘ করেছে বুঝি গগণে। নিরাশ হয় বেগম। কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে তার নিজস্ব চাঁদটাকে। আনমনেই তলোয়ার তুলে নিলো সে। পরখ করলো একবার মামাশ্বশুড়কে। লোকটা বোধহয় লড়াইয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই খেলায় সেই জিতবে আজ। তাচ্ছিল্য হাসলো বেগম। ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হলো লড়াই। তলোয়ারে তলোয়ারে সংঘর্ষ। একের পর প্রহার করছে দু’জন। উত্তেজিত উপস্থিত দর্শকগণ। চারপাশে টহল দিচ্ছে সৈনিকেরা। লাফাচ্ছে তোহফা। খুশি হচ্ছে সে। ফাইজাকে জোর করে ধরে রেখেছে হাফসা। গভীর চিন্তা, ভয়ে নিমজ্জিত জারনাব। এই বুঝি ব্যথা লাগলো। তলোয়ার বুঝি আঁচড় কাটলো তার বোনের শরীরে। চিন্তিত আব্দুর রহমানও। তানহার অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। সে বরাবরের মতোই নিশ্চুপ। স্বাভাবিক মুখভঙ্গি। মাহতাব আড়চোখে জারনাবের দিকে চেয়েই আছে। তার ধ্যান নেই এই লড়াইয়ে। মনের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমলো যেন। এই মেয়ে কি তাকে কখনোই চোখে দেখবে না? আগেও বোকা ছিলো এখনো বোকা আছে। মাঝখান দিয়ে তাকে পাগল করে তুলেছে। এখন আবার পেয়েছে সুলতানাকে। সারাক্ষণ মুখে শুধু বোন, বোন আর বোন। বোন ব্যথা পাবে, বোন কষ্ট পাবে। কেন? তাকে কি চোখে বাঁধে না? অনুভব করে না তার অনুভূতিগুলোকে?
লড়াইয়ের মাঝে মাঝে সুলতানের দিকে তাকাচ্ছে বেগম। তলোয়ার ধরতে অমনোযোগী হচ্ছে সে। ধ্যান ছুটছে লড়াই থেকে। অথচ সুলতান একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না সেদিকে। নিখুঁতভাবে উপেক্ষা করে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে সে। ব্যথিত হয় বেগম। কমে আসে তলোয়ারের গতি। বেসামাল হয় তার দৃষ্টির তীক্ষ্মতা। এই সুযোগটাই যেন খুঁজছিল হাদিদ। তলোয়ার উচিয়ে ধরে বেগমের উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রহার করা হয়ে ওঠে না। নিয়ন্ত্রণ করে নিচ্ছে বেগম। আবারো লড়াইয়ে মনোনিবেশ করে বেগম। দক্ষ হাতে চালায় অস্ত্র। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার মনোযোগ আবারো ফিরে তাকালো সুলতানের দিকে। এদিকেই বোধহয় চেয়ে ছিলো সুলতান। তাকে তাকাতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অভিমানে। তাকাবে না সে। কিছুতেই তাকাবে না। কেন তাকাবে? আজ সে কিছুতেই দূর্বল হবে না। পেয়েছে টা কী এলি? যা ইচ্ছা তাই করবে? অশ্রু ঝরাবে ঐ বণিকের জন্য? তাহলে এখন আবার তার দিকে তাকাচ্ছে কেন বারবার? যা ইচ্ছা করুক সে কিছুতেই পাত্তা দেবে না। তাকাবেও না বেগমের দিকে। গোমরা মুখে বসে রইল তোহফাকে নিয়ে। স্থায়ী হলো না সেই দৃঢ়তা। আড়চোখে আবারো তাকালো। মামাকে সে যতটা দূর্বল ভেবেছিল ততটা নয়। ভালোই লড়ছে তখন থেকে। আকস্মাৎ বিচলিত হয়ে উঠলো সে। মামা যদি আঘাত করে বসে এলির শরীরে? মেয়েটার তো একেবারেই মনোযোগ নেই লড়াইতে। হন্তদন্ত হয়ে তোহফাকে তানহার কোলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পরপর চারবার চক্কর লাগালো লড়াইয়ের গোলাকার স্থানের চারপাশে। গম্ভীর আর শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো মামার দিকে। অগ্নি ছিলো বুঝি সেই দৃষ্টিতে। চমকে উঠলো হাদিদ। ভাগ্নের দৃষ্টি বলছে একটা আঘাত যদি মেয়েটার শরীরে পড়ে তাহলে সে আর আস্ত থাকবে না। সুলতানকে উঠে আসতে দেখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে বেগমের অধরে। মনোযোগ ফিরে পেলো যেন এক নিমেষে। এবার বুঝি আসল লড়াই শুরু হলো। জোর হাতে আঘাত করছে সে। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানেই নাস্তানাবুদ হয়ে উঠলো হাদিদ। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। এবার উচ্ছাসিত হলো ফাইজা। চেঁচিয়ে বলল, “লেবুর শরবত দেব না কি মামা?”
এমন উপহাসে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলো হাদিদ। দ্রুত ফাইজার মুখ চেপে ধরলো হাফসা। চোখ রাঙিয়ে বলল, “একদম চুপ।”
হাঁপাচ্ছে হাদিদ। খানিক বাদেই বেগমের নিকট হার মানতে হলো তাকে। তলোয়ার ফেলে দিয়ে মুখ লুকাতে গটগট করে ঢুকে পড়লো মহলে। সামান্য এক নারীর কাছে হেরে ভীষণ অপমানিতবোধ করলো সে। বেগমের জেতার খুশিতে উল্লাসিত ধ্বনি তুলল সৈনিকগণ। বড়বড় শ্বাস নিয়ে সুলতানের দিকে চেয়ে অধর প্রসারিত করলো বেগম। কিন্তু এই হাসিতে একদমই গলবে না আজ সুলতান। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মহলে চলে গেল। একবারের জন্যও ফিরলো না বেগমের দিকে। হতাশ হলো বেগম। সে ভেবেছিলো তার কাছে এগিয়ে আসবে মানুষটা। ভীষণ ক্লান্ত দেহ নিয়ে তোহফার কাছে এগোলো সে। ঘামার্ত হাতদুটো বাড়িয়ে বলল,
“প্রস্তুত হয়ে নাও আম্মু। অভিমান ভাঙাতে হবে যে আমাদের। প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে মনে হচ্ছে।”
সকলে প্রস্থান করলেও রয়ে গেছে জারনাব। সুলতান আর বেগমের রাগারাগি, মান অভিমানই লক্ষ করছিল সে। হতাশ হয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, “কে জানে আবার কী করেছে জোভিয়া? এই মেয়েটাও না।”
পেছন থেকে এগিয়ে এলো মাহতাব। কাঁধের কাছে মুখ এগিয়ে বলল, “শান্তি পেয়েছো এবার? জিতে গেছে তোমার বোন আর ব্যথাও পায়নি।”
“শান্তি আর পেলাম কই? জোভিয়া নিশ্চয়ই আবার উল্টো পাল্টা কিছু করেছে। সুলতান কেমন উপেক্ষা করে চলছে ওকে দেখলে না?” আফসোসের স্বর জারনাবের।
বিরক্ত হলো মাহতাব। আবার বোন! ঝাঁঝালো গলায় বলল, “আমার কিছু বলার আছে তোমাকে। আজ্ঞা করলে ব্যক্ত করতে পারি?”
ফিরলো জারনাব। ব্যস্ত হয়ে বলল, “আমারো কিছু বলার আছে তোমাকে।”
“আগে আমি।”
“না, আগে আমি বলবো।”
“ঠিক আছে বলো।” হার মানলো মাহতাব।
কোনোকিছু না ভেবেই জারনাব বলে উঠলো, “আমি বিবাহিত আজমাইন। জানো তুমি?”
ভ্রু কুচকাল মাহতাব। বিরক্ত কন্ঠে বলল, “মানেটা কী? একদম আজেবাজে মজা করবে না বলে দিচ্ছি।”
“মজা নয় আজমাইন। সত্যিই বিবাহিত আমি। শুধু বিবাহিত নয়, বিধবাও।”
চমকাল মাহতাব। রাগান্বিত হয়ে বলল, “থামো। আমার এ ধরনের মজা পছন্দ নয় জুঁই।”
“আমি সত্যি বলছি। এই সাম্রাজ্যে আসতে না আসতেই আব্বাজান আমার বিবাহ দিয়েছিলো কিন্তু কিছুদিনের ব্যবধানেই আমার স্বামীর মৃত্যু হয় যুদ্ধে। একজন পঁচিশ বছর বয়সী মেয়ে অবিবাহিত কীভাবে থাকবে বলো? আমি সাহাদকে খুব ভালোবাসি এখনো তাই একা রয়েছি। তোমাকে জানানো হয়নি। তাই আজ জানিয়ে দিলাম।” স্বাভাবিক কন্ঠ জারনাবের। বিন্দুমাত্র মিথ্যা রেশ নেই দৃষ্টিতে।
কয়েক পা পিছিয়ে গেল মাহতাব। শান্ত দৃষ্টি অশান্ত হলো। কানের কাছে বেজে উঠলো একটিই বাক্য ‘সাহাদকে খুব ভালোবাসি আমি’। সাহাদ নামটা বড্ড বিষাক্ত ঠেকল। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অচেনা, অদেখা, মৃত সাহাদ তার ঘৃণার কারন হয়ে উঠলো মুহুর্তেই।
চলবে……….
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_33
“বউয়ের জেদ রাখতে আমি নিজেকে ধ্বংস করতেও দু’বার ভাববো না। এ তো সামান্য কপাল কেঁটেছে মাত্র।”
ছেলের এহেন বেপরোয়া কথাবার্তায় রাগে গজগজ করে উঠলো ওয়াসিফা সুলতান। বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো সে। রাগলে চলবে না। সে জরুরি কথা বলতে শাহজাইনকে ডেকেছে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। নিজেরও, ছেলেরও।
নিজের কেদারা খানিকটা এগিয়ে নিলো ছেলের দিকে। শান্ত ভঙ্গিমায় বলল, “তুমি কি টের পাচ্ছ নিজের উন্মাদনা? পূর্বের তুলনায় কতটা হিং’স্র হয়ে উঠেছো তুমি? জিদান নামের কয়েদিকে অযথা মেরেছ জানোয়ারের মতো। ইচ্ছা করে এলিজাকে দেখাতে গিয়ে ওর হাত-পা খুলে দিয়ে নিজের কপাল কেঁটে এসেছ। এর আগেও এলিজার কারনে বহু অন্যায় করেছো তুমি। বারবার নিয়ম ভেঙেছ, বিধান বদলেছো। দারিয়াকে হ’ত্যা করেছো সেটা নাইবা বললাম। ওটা জরুরী ছিল। কিন্তু বাকিদের কেন? এর আগে কতগুলো ছেলেকে নৃশংসভাবে মে’রে তাদের লাশ বালুতে গেড়ে দিয়েছো। সেই খবর এখনো জানে না এলিজা। কিন্তু আমি জানি। এলিজাকে ভালোবাসতে গিয়ে আর কত নিচে নামবে তুমি?”
“যতটা নিচ পর্যন্ত এলির অস্তিত্ব খুঁজে পাব।”
দৃঢ় কন্ঠ সুলতানের। বিরক্ত হয়ে উঠলো ওয়াসিফা সুলতান। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “কিন্তু এলিজা তোমার এই হিং’স্র রূপ পছন্দ করে না। তোমার কোমল রূপটাকেই ভালোবেসেছিল সে।”
“এ কারনেই আমি নিজের কোমল রূপটাই প্রকাশ করি ওর সামনে। হিং’স্রতা তো প্রকাশ করিনি। তাহলে ভালোবাসবেনা কেন? বাসবে ভালো।”
হতাশ হলো ওয়াসিফা সুলতান। ছেলে যেন তার বাচ্চাদের মতো জেদ করছে। যখন থেকে তার কামরায় এসেছে সে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছে এই হিং’স্রতা অশান্তি টেনে আনবে তাদের সংসারে। কিন্তু ছেলে বুঝলে তো। কপট রেগে বলল, “আর আজ কী করলে তুমি? ঐ ছেলেটাকে তখন মা’রতে গিয়েছিলে তাই না? আমি দেখেছি তোমার রাগান্বিত চেহারা। মা’রলে না কেন শেষ পর্যন্ত?”
“ওকে মা’রলে এলি রাগ করতো। বাহানা করতো দূরে যাওয়ার। আর আমি এক্ষেত্রে কোনো সুযোগ দিতে চাই না। একচুলও না।”
“সব বোঝো আর এটা বোঝো না যে যার জন্য এসব করো তুমি সেই পছন্দ করে না তোমার এই কাজকর্ম? কোনোদিন জানতে পারলে সে নিজেই ছেড়ে যাবে তোমাকে। এলিজার জেদ সম্পর্কে অবগত তুমি।”
“এলি কখনোই ছেড়ে যাবে না আমাকে। আসমান ভেঙে জমিনে মিশলেও না। হয়তো রাগ করবে, তবে তা ক্ষণস্থায়ী। মানিয়ে নেব আমি।”
“তবুও তুমি তোমার উন্মাদনা ছাড়বে না তাই তো? আজ কপাল কেঁটে এসেছো, কাল গলা কেঁটে আসবে। সাম্রাজ্যের প্রতি চিন্তা চেতনা কিছু বাকি আছে তোমার? না কি এলিজাকে ফিরে পেয়ে সবকিছুই ভুলে গেছো?”
“সবই মনে আছে আম্মা। কিছুই ভুলিনি। আপনি তো আমাকে জানেন তাহলে এসব কেন বলছেন অযথা? রাগটা আমার ছোট থেকেই বেশি। এলির জন্যই বিবাহের পর সেটা কমিয়ে শূন্যের কোঠায় এনেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার যেই কোমল রূপটাকে এলি ভালোবেসেছে সেটাই আপন করে নেব। কিন্তু আমার কোমল রূপ এলিকে বাঁচাতে পারেনি, আগলে রাখতে অক্ষম হয়েছে। প্রকৃতি নির্দয়ভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল এলিকে। কেউ ফিরিয়ে দিতে পারেনি, কেউ না। কিন্তু সবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে আবার আমার কাছে ফিরে এলো এলি। আমি আরো একবার সুযোগ পেলাম। এই সুযোগে আমি পায়ে ঠেলব না। এবার আমি এক বিন্দু কাউকে ছাড় দেবো না। যে সামনে আসবে তাকেই ম’রতে হবে।”
কেমন যেন ঝংকার তুলল সেই কন্ঠ। হার মানলো ওয়াসিফা সুলতান। ছেলে এখন তার কথা শুনবে না তা সে বুঝে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা বাদ দাও। তা যুদ্ধের ব্যপারে কিছু ভেবেছো? তোমার পিতা বলছিল যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে।”
“হ্যাঁ, দ্রুতই পার্শ্ব সাম্রাজ্য আক্রমণ করবো। মাহতাবকে বলে দিয়েছি যেন সাম্রাজ্যে কোনো নতুন লোক দেখলে বন্দি করে ফেলে। উমার নিশ্চয়ই খবরাখবর নিতে গুপ্তচর পাঠাচ্ছে। যুদ্ধ ব্যতীত কোনো সমাধান নেই। কিন্তু তার আগে এলিকে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে রেখে আসতে হবে।”
কপাল কুচকে ফেললেন ওয়াসিফা সুলতান। শুধাল, “কেন? হঠাৎ সেখানে কেন?”
“পিতার মহলে যেতে কারন লাগবে এখন?”
“না কিন্তু হুট করে পাঠাতে চাইছ। এলিজাকে ছাড়া তুমি থাকবে বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার সাম্রাজ্য ছেড়ে বউয়ের আঁচল ধরে সারাজীবন ওখানে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করোনি তো?”
“কী সব বলছেন আম্মা? আমি কোথাও যাবো না। মাহতাব রেখে আসবে গিয়ে। ও এখানে থাকলে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করা যাচ্ছে না। আমাদের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার বায়না ধরবে। আর একবার তালবাহানা শুরু করলে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত থামবে না। বাধ্য হয়ে তখন আমার ওকে নিয়ে যেতে হবে সাথে।”
“তাতে সমস্যা কোথায়? এলিজা দক্ষ যোদ্ধা। সে সাথে গেলে তোমার সুবিধাই হবে।”
আকস্মাৎ যেন আৎকে উঠলো সুলতান। শঙ্কা দেখা দিলো দৃষ্টিতে। ভীত মুখভঙ্গি। ততক্ষণাৎ উত্তেজিত অধর নাড়িয়ে বলল, “কিছুতেই না। উমার ওকে ব্যবহার করবে আমাকে পরাস্ত করতে। এটা যুদ্ধক্ষেত্র, কোনো দাওয়াত রক্ষা করতে যাচ্ছি না যে বউ সাথে করে নিয়ে যাবো। ও যাবে না ওখানে।”
“বলো যে তুমি ভয় পাচ্ছো ওর ক্ষতি হয়ে যায় যদি সেই ভেবে।”
“হ্যাঁ পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি আমি। এলি যাবে না যুদ্ধে।”
খানিকটা উচ্চস্বরেই চিৎকার করে উঠলো সুলতান। মোটেই অবাক হলো না ওয়াসিফা সুলতান। যেন সে জানতো সুলতানের নিকট থেকে এমন প্রতিক্রিয়াই আসবে। তবে রাগ হলো বড্ড। জেনেশুনে একজন ভালো যোদ্ধাকে সাথে না নেওয়া এইটা কেমন সিদ্ধান্ত?
একজন সুলতানের নিকট অন্তত এমন আচরণ শোভা পায় না।
“ওকে ছাড়া এতদিন থাকতে পারবে তুমি? যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে অন্তত পাঁচদিন লেগে যাবে। আর যুদ্ধে গিয়ে কতদিন লাগবে তার তো হিসেবেই নেই। পারবে তো থাকতে?”
নড়ে উঠলো গম্ভীর পুরুষ। কাতর হলো তার দুই নয়ন। কেদারার হাতল শক্ত করে চেপে ধরে অনুভব করলো কীভাবে থাকবে সে। উঁহু, একদম থাকতে পারবে না। খুব কষ্ট হবে তার। কিন্তু সেই কষ্ট অবশ্যই চিরতরে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলার কষ্টের চেয়ে বেশি নয়।
দৃঢ় কন্ঠে বলল, “পারবো। সামান্য এ কদিনে কিইবা হবে। দেখতে দেখতে কেঁটে যাবে।”
অথচ তার দৃষ্টিতে ব্যথার রেশ এখনি ফুটে উঠেছে। স্বীকার না করলেও ছেলের মনোভাব বুঝতে বেগ পেতে হলো না ওয়াসিফা সুলতানকে। খুবই ধীর স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল, “পারবে না তুমি শাহজাইন। মাঝপথে তুমি যুদ্ধ ফেলে চলে আসলেও অবাক হবো না আমি। এলিজা ব্যতীত তুমি টিকতে পারবে না দু’দন্ড।”
কিন্তু মুখে বিষয় বদলে বললেন, “তানহা কী বলেছে? বিবাহের কথা আগাবো?”
“না, ও এখন বিবাহ করতে চায় না। খানিকটা সময় চেয়েছে। তাই আপাতত এই আলোচনাটা বন্ধ থাক। ওর সম্মতিতে আবার শুরু করা যাবে।”
“ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝো।”
আলোচনা শেষ বুঝে উঠে দাঁড়ালো সুলতান। সালাম প্রদান করে পা বাড়ায় দ্বারের দিকে। পেছন থেকে ভেসে এলো ওয়াসিফা সুলতানের উচ্চ কন্ঠ, “অযথা হিং’স্রতা কিন্তু একদমই পছন্দ করে না এলিজা।”
থেমে গেল সুলতান। কিয়ৎক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণেই পা চালিয়ে পেছনে না ফিরেই বলে উঠলো, “আমাকে পছন্দ করে এলি। আমার সবকিছু পছন্দ করে।”
বিরক্ত মুখে বিষাদ ধারণ করে জারনাবের কামরায় বসে আছে বেগম। পালঙ্কে বসে পা দোলাচ্ছে আনমনে।একেতো সুলতানের কোনো পাত্তা পাচ্ছে না। সেই বিকাল থেকে সে তার সামনেই আসছে না। সবসময় সৈনিক অথবা সেবকের ভীরে থাকছে। এখন আবার আম্মার কামরায় গিয়ে বসে আছে। সে আশেপাশেও ভিড়তে পারছে না। কোনো মানে হয় এসবের? তার উপর তার মহান বুবু ঝরঝর করে মাহতাবকে নিজের সবকিছু বলে দিয়ে এখন আরামে বসে আছে। এদিকে মাহতাব বেচারার কোনো খোঁজই নেই তারপর থেকে। নিশ্চয় খুব কষ্ট পেয়েছে। অথচ তার বুবু বুঝতেই পারছে না সে কাউকে কতটা আঘাত দিয়েছে। কবে বুঝবে? ম’রার পর? অসহ্য লাগছে একদম। একদিকে সুলতান আরেকদিকে বুবু। ইচ্ছে করলো একবার মাহতাবের কথা শুধাতে। আবার ভাবলো, কী দরকার? নিজেদেরটা নিজেরা বুঝে নিক। মাঝখানে ঢুকে রুটি পাকানোর ইচ্ছা হলো না মোটেও। তোহফাকে কোলে নিয়ে এটা-ওটা বলছিল জারনাব।এমন সময় দ্বারে কড়া নাড়লো কেউ। অনুমতি পেয়ে দ্বার ঠেলে প্রবেশ করলো শেহজাদি তানহা আর তার পেছনে সেবিকা আনাবিয়া। তানহাকে আসতে দেখে ভীষণ অবাক হলো জারনাব। এসেছে পর্যন্ত তাদের কোনো কথা হয়নি আর না তো আলাপচারিতা হয়েছে। তাহলে হঠাৎ এখানে! ভাবনার মাঝেই মুচকি হেসে এগিয়ে এলো তানহা। সালাম প্রদান করলো মিষ্টি ভাষায়। অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তোহফাকে নিতে এলাম।”
তোহফা ছুটে তার কোলে উঠে যায়। তানহা পুনরায় বলল, “আপনি বলব না কি তুমি বলব? আপনিই বলি। যেহেতু আপনি ভাবির বড় বোন।”
“যেটা ইচ্ছা বলতে পারো। সমস্যা নেই।”
খানিক ইতস্তত করছে জারনাব। সাম্রাজ্যের শেহজাদি তাকে আপনি করে বলবে! হুট করে সম্পর্কগুলো কেমন বদলে যায়! সামান্য কিছু আলাপচারিতা করে চলে যায় তানহা। যাওয়ার পূর্বে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “কিছু হয়েছে ভাবি? কাতর দেখাচ্ছে তোমাকে?”
“কী করবো বলো? তোমার ভাই ফুলে রুটি হয়ে আছে।”
“রুটি!” ভ্রু কুচকাল জারনাব।
“সিদ্ধ করে গলিয়ে নরম করে ফেলো।”
হাসতে হাসতে চলে গেল তানহা। দ্বার এঁটে দিলো জারনাব। বোনের গোমড়া মুখের দিকে আড়চোখে তাকালো। হয়েছে টা কী? তখন থেকে অমাবস্যা লেগেছে যেন মুখে। গলা খাকারি দিয়ে বলল, “এভাবে থম মেরে এখানে বসে না থেকে যাও, গিয়ে রাগ ভাঙাও।”
সহসা চোখ-মুখ কুচকে নিলো বেগম। আক্ষেপ করে বলল, “এই কথাটা তুমি অন্তত বলো না। শোভা পাচ্ছে না।”
“কেন? কী করেছি আমি?”
কটমট করে তাকালো বেগম। এতকিছু করে এখন জিজ্ঞেস করছে কী করেছি!
“মুন্ডু করেছো। আমার মুন্ডু করেছো তুমি।”
হাঁ করে চাইল জারনাব। হয়েছে টা কী? তার উপর ক্ষেপেছে কেন আবার? সে করেছে টা কী সেটাই তো বুঝতে পারছে না। তখন আজমাইন মুখ ফুলিয়ে চলে গেল আর এলো না। এখন জোভিয়া মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ওদিকে সুলতান না কি ফুলে রুটিই হয়ে গেছে। কেন রে? ফুলাফুলির প্রতিযোগিতা চলছে না কি? কই সে তো জানে না। জানলে সেও একটু অংশগ্রহণ করতো। বেগম পুনরায় বলল, “মাহতাব কোথায়?”
“জানি না। কোথায় যেন গেল। মন খারাপ মনে হলো কোনো বিষয়ে।”
“আচ্ছা? এতোকিছু বোঝো তুমি?” অবাক হওয়ার ভান ধরলো বেগম।
“আহ জোভিয়া! কী শুরু করেছো? সমস্যা কী বলবে তো? উল্টো-পাল্টা কাজ করেছো। এখন সুলতান পাত্তা দিচ্ছে না। সেই ঝাঁঝ আমার উপর কেন উঠাচ্ছো?”
অসহায় চোখে তাকালো বেগম। বুবুর হৃদয়, মস্তিষ্ক, সর্বাঙ্গ জুরে মিশে আছে সাহাদ। সেই পুরুষের মৃত্যুর পরেও এতগুলো বছর খুব যতনে তার স্মৃতি বুকে ধারন করছে। পাগলের মতো এখনো ফিরে পেতে চাই তাকে। মৃত্যুর দ্বার ভাঙার সাধ্য থাকলে বোধহয় সেখান থেকেই ফিরিয়ে আনতো সাহাদ নামক প্রেমিক পুরুষটিকে। তার ধারণা সাহাদ অপেক্ষা করছে তার জন্য। ওপারে তার আশাতেই পথ চেয়ে আছে। সে কী করে এখন বলবে তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুটাও তোমাকে চায়। খুব করে চায়। তুমিই তার মন খারাপের কারন। বলতে পারবে না সে। কিছুতেই বলতে পারবে না। বড্ড কষ্ট পাবে তার বুবু। হয়তো চলেও যাবে এখান থেকে। তারচেয়ে মাহতাব যদি এখনো চায় বুবুকে। তবে ধীরে ধীরে তাকে আঁকড়ে নিক ভালোবাসার জালে। বুবু ফিরে পাক একটা রঙিন জীবন। সাহাদকে ভুলে নয়। বরং তার পাশাপাশি খানিকটা জায়গা নিয়ে চলুক মাহতাবের হাত ধরে। প্রিয়তমাকে ভালো থাকতে দেখে সাহাদ কি রাগ করবে? উঁহু, রাগ করবে না। শান্তি পাবে সে। প্রিয়তমার রঙিন জীবন শান্তি দেবে তাকে। সাহাদ নামক পুরুষটাকে সে কখনো দেখেনি। তবে যতটা শুনেছে ততটুকুতেই আক্ষেপ জাগে মানুষটা বেঁচে নেই বলে। ভালো থাকুক সে। জান্নাতবাসী হোক।
সে উঠে চলে যেতে ধরলে ডেকে উঠলো জারনাব, “কোথায় যাচ্ছ?”
“সুলতানের কাছে।”
হাসলো জারনাব। প্রসারিত অধরের আড়ালে ব্যথিত হলো তার নারী হৃদয়। সাহাদ বেঁচে থাকলে তাদেরও এমন একটা খুনসুটিময় সংসার হতে পারতো। রাগ থাকতো, অভিমান থাকতো। তোহফার চেয়ে বড় হতো নিশ্চয়ই তাদের সন্তান। কিন্তু আজ সে একা! নেই সাহাদ। কোথাও নেই। এতোবড় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। ছলছল আঁখি বেয়ে ঝপ করে পড়লো অশ্রুকণা। কাতর স্বরে আওড়ালো, “কেন সাহাদ? কেন ফাঁকি দিলে আমাকে? আসোনা। একটাবার ফিরে আসো। দেখো, আমি ভালো নেই। একটুও ভালো নেই। প্রতি মুহুর্তে ছটফট করি তোমার সুঘ্রাণ পেতে। তোমায় একটাবার ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য কত হাহাকার আমার! লম্বা চুলগুলোতে কত বছর বিনুনি গাঁথি না তা কি দেখো না তুমি? হিজাবের আড়ালে পড়ে রই এলোমেলো হয়ে। তোমার কি ইচ্ছা হয় না সযত্নে গুছিয়ে দিতে? আমার কাছে ফিরে এসো একবার। শুধু একবার এসে ধরা দাও। কতদিন দেখি না তোমায়!”
আম্মার কামরা ছেড়ে নিজ কামরার দিকে হাঁটছিলো সুলতান। পথিমধ্যে বেগমকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কদম থামলো। কপাল কুচকাল। গোমড়া মুখে দু’কান ধরে অধর বিচড়াচ্ছে বেগম। সহসা ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে চাইল সুলতান। নাহ, কেউ নেই। সেবক-সৈনিক কারোর অস্তিত্ব নেই আশেপাশে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বুকে হাত দিলো। কেউ দেখলে যেন বিশাল ক্ষতি হয়ে যেত তার। চোখ-মুখ কুচকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে দেখলো বেগমের দিকে। অধর বিচড়াচ্ছে! আবার গোমড়া মুখে অধর বিচড়াচ্ছে! কী মারাত্মক সুন্দর দৃশ্য! চোখদুটো বড়বড় হলো মুহুর্তেই। কিন্তু হুট করে মনে পড়লো সে তো রাগ করেছে। কথা বলবে না। ভুলবে না এসব সৌন্দর্যে। যা ইচ্ছা করুক। বেগমকে উপেক্ষা করে হনহনিয়ে চলে গেল সে। খুব বেশি এগোতে পারলো না। ছুটে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় বেগম। এক পা দু’পা করে তার দিকে এগোচ্ছে। বারংবার চমকে উঠছে সুলতান। গলা শুকিয়ে এলো। অসহায় হলো শক্ত পুরুষ। দূর্বলতা দমাতে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো, “এসব কোন ধরনের অভদ্রতা? পথে ঘাটে এমন ব্যবহার করতে লজ্জা করছে না তোমার? লাজ লজ্জা সব গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছ?”
“প্রথমত এটা পথঘাট নয়, আমার একমাত্র স্বামীর মহল। দ্বিতীয়ত লাজলজ্জা সত্যিই গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছি একটা নির্লজ্জ লোকের সাথে থাকতে থাকতে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে এটাকে।”
বেশ ভাবের সাথেই কথাখানা বলে উঠলো বেগম। চুপসে গেল সুলতানের মুখশ্রী। তার রাগ ভাঙাতে এসে তাকেই অপমান করছে! সাম্রাজ্যবাসী শুনলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে সুলতানের আসন থেকে নামিয়ে দিতো। নিজের রাগ আর মানসম্মান দুটোকেই বাঁচাতে চাইলে এখনি এই নারীর সামনে থেকে চলে যেতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বেগমকে ডিঙিয়ে হাঁটা ধরলো কামরার দিকে। বেগমও যেন আজ পন করেছে তার পিছু ছাড়বে না। সুলতান একপা বাড়ালে সে দুই পা বাড়ায়। এমনকি সুলতানের হাঁটার ভঙিমাও নকল করছে। সুলতান পাগড়িতে হাত দিলে সে হিজাবে হাত দেয়। এতটাই মনোযোগ দিয়ে সুলতানের দিকে চেয়ে আছে যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো কাজ নেই তার জীবনে। সুলতান ডান দিকে তাকালে ডান দিকে তাকায়, বাম দিকে তাকালে বা’দিকে তাকায়। পারলে যেন শ্বাস প্রশ্বাসটাও অনুকরণ করতো সে। পেছনে না ফিরেই রাগে কিড়মিড় করে উঠলো সুলতান। পৃথিবীতে বোধহয় রাগ ভাঙানোর এমন অভিনব কৌশল এবারই প্রথম আবিষ্কৃত হচ্ছে। রাগে গজগজ করতে করতে কামরায় চলে গেল। শব্দ কর দ্বারের কপাট খুলল। পালঙ্কে বসে পা ঝুলিয়ে আচমকা গম্ভীর হয়ে উঠলো। চিন্তা হচ্ছে। যুদ্ধে কী ঘটবে জানা নেই। এলিকে কিছুতেই ওখানে নেবে না সে। কিন্তু মেয়েটা যে একদমই মানবে না তার কথা। উত্তরীয় সাম্রাজ্যে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে ঘাম ছুটে যাবে তার তা সে ভালোই টের পাচ্ছে। ভাবনার মাঝেও শান্তি মিলল না। চারপাশ ভরে উঠলো রজনীগন্ধার সুবাসে। পায়ে নরম হাতের ছোঁয়া পেতেই চকিতে ফিরল সে। মধুর এ স্পর্শে বিচলিত হলো মুহুর্তেই। দু’হাতে তার পা জড়িয়ে ধরে পা ভাঁজ করে মেঝেতে বসে আছে বেগম। তাকে তাকাতে দেখে মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে শক্ত গলায় বলল, “বলুন ক্ষমা করে দিয়েছেন।”
অস্বস্তিতে পড়লো সুলতান। বেকুব একটা। এভাবে কেউ পা ধরে রাগ ভাঙায়! ঝুঁকে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। বিব্রত কন্ঠে বলল, “এলি এলি, ছাড়ো। কী করছো? ছাড়ো বলছি। ওঠো।”
“আগে বলুন, ক্ষমা করবেন কি-না?”
“না, কিছুতেই না। আরো অশ্রু ঝরাও ঐ ছেলেটার জন্য। নিষেধ তো করিনি। তাহলে বিরক্ত করছো কেন?”
“তাহলে আমিও ছাড়ব না। বললাম তো অশ্রু বণিকের জন্য ছিলো না।”
“ছুটে তো এসেছিলে ওর জন্যই। তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ এলি। পুড়িয়েছ আমার প্রমিক হৃদয়।”
“আমি দুঃখিত সুলতান।”
“বেশ! ছাড়ো এখন।”
কান্নার ভান ধরতে চাইল বেগম। কিন্তু কান্না কিছুতেই আসছে না। উল্টো ভালো লাগছে এভাবে পা ছুঁয়ে বসে থাকতে। আশ্চর্য! বেশ খানিকটা সময় চেষ্টা করে অতিশয় বিরক্ত হয়ে উঠলো। এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত বেরোলো না। কী আজব! সহসা তার অন্তর যেন কটাক্ষ করে বলে উঠলো, “আসবে না। পানি আসবে না চোখে। সুদর্শন পুরুষের শরীর ছুঁয়ে বসে থাকলে কান্না আসবেও না। নির্লজ্জ নারী!”
লজ্জা আর রাগের মিশ্রণে একরোখা মুখভঙ্গি বদলে গেল তার। এদিক-ওদিক তাকালো সুলতানের থেকে আড়াল করতে। সুলতান ভ্রু কুচকে তাকাতেই পা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। উপহাস করলো সুলতান, “আত্মসম্মানে লাগলো?”
কটমট করে তাকালো বেগম। ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “স্বামীর পা ধরলে সম্মান চলে যায়! কোন হাদিসে পেয়েছেন এসব উদ্ভট কথা?”
“তাহলে?”
এক ছুটে বেরিয়ে গেল বেগম। ততক্ষণাৎ নিজের পাগড়ি খুলে ছুড়ে মারলো সুলতান। গর্জে উঠলো রাগে। এলি আর ভালোবাসে না তাকে, পরোয়া করে না তার রাগ-অভিমান। রাগে, উত্তেজনায় অস্থির হয়ে যেই না কোমর থেকে তলোয়ার খুলে ছুড়ে ফেলবে তখনই দ্বার ঠেলে প্রবেশ করলো বেগম। সঙ্গে সঙ্গে সুলতান গুটিয়ে নিলো তলোয়ার। আলগোছে রাখলো পালঙ্কের একপাশে। গম্ভীর করে তুলল মুখভঙ্গি। বেগমের কোল থেকে টেনে হিচড়ে নিচে নামল তোহফা। মেঝেতে অগোছালো হয়ে পড়ে থাকা পাগড়িতে নজর আটকে গেল বেগমের। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজের দেখা মিলল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো এতোটুকু সময়ের ব্যবধানে কী অন্যায় করে বসলো পাগড়িটা? যে একেবারে মাথা থেকে মেঝেতে এসে পড়েছে! আলগোছে পাগড়িটা তুলে দুটো ঝাড়া দিয়ে পালঙ্কে রাখলো। আবারো পা ভাঁজ করে বসলো সুলতানের সামনে মেঝেতে। এবার আর পা ধরলো না। বরং দু’জনের মাঝে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো তোহফাকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে সুলতান। চমকাতে বাধ্য হলো ভীষণভাবে। পরোয়া করলো না বেগম। তোহফার গালে চুমু আঁকলো শক্ত করে। হাসছে তোহফা। কিছু একটা ইশারা করতেই সুলতানের কোলে হামলে পড়লো সে। শক্ত করে চুমু এঁকে দিলো আব্বাজানের গালে। মেঝেতে নেমে দু’হাতে তালি বাজিয়ে লাফিয়ে উঠলো হঠাৎই। বাঁধভাঙা খুশির জানান দিচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বোকাবনে গেল সুলতান। হতবাক স্বরে বলল, “কী হচ্ছে এসব?”
তোহফা নিজের গাল এগিয়ে দিলো আব্বাজানের দিকে। বিস্ময় ভুলে মুচকি হেসে চুমু এঁকে দিলো সুলতান। এক মুহুর্ত দেরি করলো না তোহফা। ততক্ষণাৎ ছুটে বেগমের কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় গালে। চুমু দেওয়া স্থানে হাত ঘষে সুলতানের দিক চেয়ে ক্রুর হাসলো বেগম। জিতে যাওয়ার হাসি। তোহফাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বড় গর্বের সাথে বলল, “শোধবোধ।”
“শোধবোধ! কীসের শোধবোধ?”
“আমি আপনাকে চুমু দিয়েছি। তার বিপরীতে আপনিও দিয়েছেন। তারমানে রাগ ভেঙে গেছে আপনার।”
“আমি কখন তোমাকে চুমু দিয়েছি?” বিস্মিত কন্ঠ সুলতানের।
দুষ্টু হাসলো বেগম। রসিকতার সুরে বলল, “মাত্রই তো দিলেন। এখনি অস্বীকার করছেন!”
তোহফাকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেছে বেগম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকলো সুলতান। কিছুক্ষণ ভাবতেই উপলব্ধি করতে পারলো বেগমের কথার মর্মার্থ। ক্ষণিকের জন্য চোখদুটো বড়বড় হলেও সহসা মুচকি হাসি ফুটে উঠলো অধরে। বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো, “অভিমান ভাঙানোর পদ্ধতি যদি হয় এমন মধুর। তবে অভিমান করবো আমি কারনে-অকারনে, বহুবার, সহস্রবার।”
রাত নেমেছে। তখনকার পর আর সুলতানের সামনে আসেনি বেগম। না তো সুলতান গেছে তার সামনে। যুদ্ধের চিন্তায় অস্থির সে। কীভাবে বেগমকে উত্তরীয় সাম্রাজ্যে যাওয়ার কথাটা তুলবে সেটাই যেন সাজিয়ে উঠতে পারছে না। ক্রমাগত দহন বাড়ে হৃদয়ের। এলি ছাড়া কীভাবে থাকবে সে এতগুলো দিন? কাতর হয় দৃষ্টি। অসহায়ত্বের দেখা মিলল সুন্দর, গম্ভীর মুখটাতে।
মহলের বিশাল গোলাকার কামরায় মাহতাবের সাথে বসে যুদ্ধ সম্পর্কিত জরুরী আলোচনা করছে সুলতান। চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আশেপাশে গুটিকয়েক সেবক-সেবিকা কাজ করছে। আকস্মাৎ সেখানে আগমন ঘটলো বেগম আর জারনাবের। জারনাব তো দ্বারের থেকে কয়েক পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো কিন্তু বেগম একদম সুলতানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু উচিয়ে ধরে সুলতান। শুধাল, “আবার কী চাই?”
“এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম ফলাফলটা শুনেই যাই।”
বলতে বলতে মাথার তাজ খুলে অধর গলিয়ে ফুঁ দিলো তাতে। একদৃষ্টে চেয়ে আছে সুলতান। পলক পড়লো না কিছুক্ষণ। এই নারী সবসময়ই ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্যতা বহন করে। এই যেমন এখন কত স্বাভাবিকভাবে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিচ্ছে অথচ সুলতানের নিকট এটাই যেন অপার দৃশ্য। চোখ ফেরানো দায় হয়ে উঠছে! পুরো জনম চেয়ে থাকলেও যেন দেখার শুধা মিটবে না! কেশে উঠলো মাহতাব। ঘোর ভাঙে সুলতানের। একবার দৃষ্টি সরিয়ে আবারো তাকায় বেগমের দিকে। অবচেতন মন বলল মেয়েটা ইচ্ছা করেই এখানে এসেছে, তাকে জ্বালাতে। জেনেশুনেও জ্বলতে চাইছে সে। আরো একটু এগিয়ে এলো বেগম। ঘাড় কাত করে বাঁকা চোখে তাকালো তার দিকে। এতক্ষণে সরে দাঁড়িয়েছে মাহতাব। বেগমের বাঁকা দৃষ্টিতে চোখ রাখতেই সুলতানের অন্তর ধমকে উঠলো ততক্ষণাৎ, “তাকাস না। ঝলসে যাবি মূর্খ সুলতান।”
সুলতান মানলো না সেই সতর্কবাণী। পায়ে ঠেলল সমস্ত নিয়ম, লোকলজ্জা। স্থান, কাল ভুলে দৃষ্টি মেলালো ঐ নয়নে। এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আফসোস থাকবে না তার। অথচ নির্দয়ভাবে ডেকে উঠলো মাহতাব, “মহামান্য।”
ব্যাঘাত ঘটতেই বিরক্তিতে চোখদুটো কুচকে নিলো সুলতান। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো মাহতাবের দিকে।
হুট করে নিজের অবস্থান মনে পড়তে সংযত হলো খানিক। তপ্ত শ্বাস ফেলে সংবরণ করলো নিজেকে। বেগমের দিকে চেয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল, “এখানে কী তোমার? কেন এসেছ?”
“বললাম তো ফলাফল শুনতে এসেছি। নিজে এতক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে উল্টো এখন আমাকেই ধমকাচ্ছেন। স্বৈরাচারী সুলতান।”
কন্ঠে অভিমান থাকলেও দৃষ্টিতে দুষ্টুমি খেলা করছে তার। রাগ ভুলে বেগমের আড়ালেই মৃদু হাসলো সুলতান।
“বড্ড দুষ্টু হয়েছো। কীসের ফলাফল?”
“রাগ। আপনার রাগ ভেঙেছে? তখন তো ফলাফল না শুনেই চলে এসেছিলাম।”
আহাম্মক বনে গেল সুলতান। রাগ ভেঙেছে কি-না শুনতে এখানে চলে এসেছে! বেকুব একটা। অথচ মুখে বলল, “না ভাঙেনি। যাও তুমি।”
“তাহলে এখনি ভাঙিয়ে দেই।”
“মানে!”
এগোচ্ছে বেগম। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই এগোচ্ছে সুলতানের দিকে। গলা শুকিয়ে এলো সুলতানের। ঢোক গিলল পাংশুটে। কেদারা ছেড়ে এক পা দুপা করে পেছাতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল, “না, এলি। এলি, না বলছি কিন্তু।”
শুনলো না বেগম। সে নিজের মতোই এগোচ্ছে। আজ বুঝি এই শক্ত পুরুষের দুর্বলতা প্রমাণ করেই ছাড়বে সে। অধরে বাঁকা হাসি। ভয় পাচ্ছে রামান সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সুলতান! হাত দেখিয়ে সুলতান আবারো বলল, “এলি এলি, না।”
আকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠলো সুলতান, “মাহতাব, আলো নিভিয়ে দাও।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধপ ধপ শব্দে নিভে গেল সমস্ত কৃত্রিম আলো। অন্ধকারে বিলীন হলো পুরো কামরা। সাথে সাথেই বেগম ঝাঁপিয়ে পড়লো সুলতানের শরীরে। তাল হারিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সুলতান। বেগম খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো শব্দ করে। চারপাশ মুখরিত হয় হাসির শব্দে। মুগ্ধ হয় সুলতান। সে একহাতে বেগমেকে ঠেলে সরাতে চাইলেই বেগম বলে ওঠে, “আলো জ্বালিয়ে দাও মাহতাব।”
“খবরদার আলো জ্বালাবে না।”
চিৎকার করে সুলতান। গোবেচারা মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রই মাহতাব। কার কথা শুনবে আর কার শুনবে না। বিভ্রান্ত হচ্ছে সে। হঠাৎ কোমরে সুলতানের বলিষ্ঠ হাতের শক্ত বন্ধনী পেয়ে জমে যায় বেগম। ঠেলে সরাতে চাইল সুলতানকে। এখন কী আর সে সুযোগ আছে? সুযোগ পেরিয়ে গেছে বহু পূর্বেই। বাঁকা হাসে সুলতান। উচ্চস্বরে বলল, “আলো জ্বালিয়ে দাও মাহতাব।”
আৎকে উঠলো বেগম। সুলতানের হাত শক্ত করে ধরে চিৎকার করলো, “খবরদার আলো জ্বালাবে না।”
মাহতাব ফিসফিসিয়ে জারনাবের উদ্দেশ্যে বলল, “শেখো কিছু। শিখতেও তো পারো।”
কটমট করে তাকালো জারনাব। ঝাঁঝালো গলায় বলে, “আমি কেন শিখতে যাবো? তোমার সময় এখন। তুমি শেখো। আর তাড়াতাড়ি বিবাহটা করে নাও।”
“করবো, যেদিন প্রিয়তমা চাইবে।”
কাতর কন্ঠ মাহতাবের। প্রিয় কিছু পাওয়া, না পাওয়ার মধ্যখানে ঝুলে প্রিয়তমাকে চেয়ে বরবাদ হয়েছে সে। তবুও চাইবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চাইবে। নিজের শেষ নিশ্বাসটাতেও লিখে দেবে প্রিয়তমার নাম, তার বোকা চোখের চাহনি।
চলবে………