#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_39
শক্ত কাঠের গুঁড়ির উপর মাথা ঠেকানো সুলতানের। দুই হাত বেঁধে দেওয়া মোটা দড়ি দিয়ে। মাথার উপরে পার্শ্ব সেনার ধারাল তলোয়ার উচিয়ে আছে কর্তনের অপেক্ষায়। বারংবার প্রচেষ্টার পরেও তলোয়ার এগোতে সক্ষম হচ্ছে না সে। রামান সৈন্যেরা কিছুতেই দেবে না তাদের সুলতানের প্রাণ নিতে। মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন তারা। তাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে মাহতাব। উত্তেজিত তার শিরা-উপশিরা। হৈ-চৈ করছে রামান সৈন্যেরা। যাই হোক না কেন সুলতানের প্রাণ নেওয়া যাবে না। নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত তারা। বিরক্ত মুখে চেয়ে আছে উমার। সকাল থেকে এই বাকবিতণ্ডা চলছে তো চলছেই। এখন বিকেল হতে চললো অথচ সুলতানের একটা পশমও কাটতে পারেনি সে। রামান সেনারা সবকিছুর বিনিময়ে তাদের সুলতানকে জীবিত চায়। সৈনাদের অনেক আগেই মুক্ত করে ফিরে যাওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা এক পাও পিছু হটতে নারাজ। হয় সুলতানকে জীবিত ছাড়তে হবে নয়তো সবাইকে ম’রতে হবে। সুলতানের কথাও এই মুহুর্তে শুনছে না তারা। এক পর্যায়ে চিৎকার করে ওঠে সুলতান, “তোমরা কেন অবুঝের মতো আচরণ করছো?”
শোরগোল কমে না রামান সৈন্যদের। হুরমুরিয়ে সুলতানের দিকে এগিয়ে আসতে চায়। সতর্ক করে উমার, “খবরদার! মে’রে দেবো এটাকে।”
ততক্ষণাৎ নিজ নিজ স্থানে নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সমস্ত রামান সৈন্য। এক পা এগোনোর আর সাধ্য কোথায় তাদের? শেহজাদির গলায় যে ধরা হয়েছে ধারাল তলোয়ার। তাক করা হয়েছে অহরহ তিরের ফলা। ঘাড় কাত করে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সুলতান। ধরা গলায় আওড়ায়, “আম্মাজান।”
অমনি মুখ বাঁধা অবস্থায় ছটফট করে ওঠে তোহফা। ছলছল নয়ন জোরায় ভয়ের বহিঃপ্রকাশ। বাঁধা হাত ছুটানোর বৃথা চেষ্টা চালায়। ছোট্ট, নরম মুখশ্রী ভয়ে, আতঙ্কে নীল হবে যেন। দড়ির শক্ত বাঁধনে লাল হয়ে গেছে হাত-পা। দূর্বল হয় সুলতান। কন্যার অসহায়ত্ব তাকে অকুল দরিয়ায় ভাসালো বুঝি। তোহফা অবিরত সুলতানের দিকে চেয়ে নোনাজল ফেলে। মাথা আগেপিছে করতে নিলেই গলায় অনুভব করে ধারাল তলোয়ার। ভরসার কন্ঠে ডেকে ওঠে সুলতান,
“ভয় পায় না আম্মাজান। কিচ্ছু হবে না। মাহতাব চাচ্চু নিয়ে যাবে তোমাকে।”
তবুও ছটফট করে তোহফা। মুখভঙ্গি এমন যেন কিছু বলতে চায় সে। অথচ তার জবান নেই। অপূর্ণ এক হতাশা দেখা দেয় সুলতানের চোখেমুখে। হয়তো শেষবার নিজ কন্যার কন্ঠ শোনার আহাজারি ছিলো সেই দৃষ্টিতে! ভেসে আসে মাহতাবের কন্ঠস্বর, “দুষ্টদের ভয় পেতে নেই শেহজাদি। দেখুন আমাদের দিকে। এত এত তলোয়ার ডিঙিয়ে ওরা আপনাকে একটা আঁচড়ও কাটতে পারবে না।”
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় প্রতিটা রামান সৈন্য। এত এত ভরসার মানুষের মাঝেও ভয়ে কেঁপে চলেছে তোহফা। আচমকা শয়তানি হাসে উমার। তার সেনা প্রধানকে ইশারা করে কিছু একটা। বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করেই খুলে দেওয়া হয় তোহফার মুখের বাঁধন। সাথে সাথেই গগণে ঝংকার তুলে ভেসে আসে সুমধুর, কোমল কন্ঠস্বর, “আব্বু।”
চমকাল সুলতান, চমকাল মাহতাব, চমকেছে পুরো রামান সৈন্যের বিরাট দল। মনের ভুল নয়তো এ কন্ঠ! সুলতানের নির্জীব, ক্লান্ত দৃষ্টি তোহফার দিকেই সীমাবদ্ধ। ও কি সত্যিই আব্বু ডাকলো? জবান পেয়েছে তার কন্যা! নিষ্প্রাণ আঁখিতে বিস্ময়ের খেলা। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে যায়। আবারো ডাকে তোহফা, “আআব্বু, ভয়, ভয়।”
“আম্মাজান!”
বিস্মিত কন্ঠ সুলতানের। এত প্রশান্তি ছোট্ট কন্ঠে! অন্তহীন এই খুশি কেন মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেই ধরা দিলো?
“ভয়, ভয়।”
অধর ফুলিয়ে ফোঁপাতে শুরু করেছে তোহফা। ভয় পাচ্ছে সে। ভীষণ ভয়। নিজের মাথায় তলোয়ার নিয়েও কন্যার ভয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সুলতান। খুশি প্রকাশ করার সময় পেলো না। বরং মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে হলেও উত্তেজিত কন্ঠে আওড়ায়, “কিছুই হবে না আম্মাজান। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকো।”
“আহ কী করুণ দৃশ্য!” হাসতে হাসতে বলে উঠলো উমার।
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল, “অবাক হয়েছিস শাহজাইন? ম’রার আগে কন্যার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছিস। কত ভাগ্যবান তুই! আর বলিস না এই ভুলটা আমার দ্বারাই হয়েছে। আমার সেনারা যখন ওকে ধরে এনেছে তখনই অতিরিক্ত ভয়ের কারনে চিৎকার করে উঠেছে। তোর কন্যা জবান ফিরে পেয়েছে আমার কারনে। তোর তো এর প্রতিদান হিসেবেও নিজেকে কুরবান করে দেওয়া উচিত।”
ছোট্ট তোহফা সে সময় কতটা ভয় পেয়েছিলো তা আন্দাজ করা দায়! ঘাড় ঘুরিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে চাইল সুলতান। সহসা ঘৃণাভরা কন্ঠে জাহির করে, “কীট তুই উমার! নর্দমার কীট! নিষ্পাপ শিশুকেও ঢাল বানাতে বাঁধলো না তোর?”
“আমার যা চাই তা আমি আদায় করে নিই। তার জন্য যে কোনো পথ অবলম্বন করতেও দ্বিধা নেই।” গর্বের আভাস উমারের কন্ঠে। নিজের সাজানো খেলায় জেতার সম্ভাবনা যেন চরমে।
“ছেড়ে দে ওকে। তুই যা চাস তাই হবে।”
“নত হচ্ছে সুলতান শাহজাইন? নিজ কন্যার জন্য? নাকি সাম্রাজ্যের জন্য?”
“দুটোই আমার কাছে অমূল্য।”
“তাহলে ম’র।”
বড় ভয়ঙ্কর আর মায়াহীন শোনায় উমারের কন্ঠ। নিকৃষ্ট এই খেলার জঘন্য চরিত্র সে। বিন্দুমাত্র দয়া বুঝি নেই তার হৃদয়ে। তোহফার নিষ্পাপ মুখশ্রী গলাতে পারে না তার নৃশংসতা। সুলতানের নীরবতা ভালো ঠেকল না। কন্যার জন্য, সাম্রাজ্যের জন্য প্রাণ দিতে ভাবলো না হয়তো দ্বিতীয়বার। রাগে হিসহিসিয়ে উঠলো মাহতাব। কপালে ফুলে উঠলো রাগের লেলিহান। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা আরোও শক্ত হলো। কেন বারবার সাম্রাজ্যের জন্য সুলতান একাই ত্যাগের ভার ওঠাবে? ভারি তলোয়ার নিয়ে ধ্যান জ্ঞান ভুলে তেড়ে এলো উমারের দিকে। খু’ন চেপেছে মাথায়। কেউ বুঝে ওঠার পূর্বেই সজোরে লাথি বসিয়ে দেয় উমারের বুকে। বলিষ্ঠ শরীরে বলের শেষ নেই। এক লাথিতেই হুরমুরিয়ে পড়লো উমার। মাটিতে পড়ে দাঁতে দাঁত লেগে মুহুর্তেই কেঁটে গেছে তার ঠোঁটের কোনা। এক মুহুর্ত সময় ব্যয় না করেই মাহতাব ঝুঁকে এসে মুখ বরাবর ঘুষি বসায় দৃঢ় হাতে। লাল হয়ে ওঠে উমারের মুখ। আকস্মাৎ কান্ডে হতভম্ব সকলেই। উমারের সেনা প্রধান ছুটে আসে। সাথে আসে আরো কিছু পার্শ্ব সেনা। সকলে মিলে টেনে ছোটাতে চায় মাহতাবকে। অথচ একচুল নড়াতে সক্ষম হয় না তারা। উল্টো আরো হিং’স্র হয়ে উমারের চুল টেনে ধরেছে। অন্যহাতে চোয়াল চেপে চিৎকার করে সহসাই, “আজ তোকে মে’রে তবেই ছাড়বো। দেখি কে বাঁচায় তোকে। তোর কোন বাপ আসে আজ আমিও দেখি।”
“ছাড়, ছাড় আমাকে।” বহু কষ্টে আওড়ায় উমার।
পেশিবহুল হাতের চাপে করুণ দশা তার। ছাড়ে না মাহতাব। চাপ বৃদ্ধি করে হঠাৎই। চোখের সামনে এবার আঁধার নেমে এলো উমারের। তার সেনা প্রধান উপায় না পেয়ে সুলতানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “ওনার কিছু হলে আপনার কন্যার প্রাণ বাঁচবে না। সরে যেতে বলুন আপনার সৈনিক প্রধানকে।”
আমলে নিলো না সুলতান। যেন শ্রবণগোচরই হয়নি কথাখানা। চুপচাপ দেখে যাচ্ছে এই ভয়াবহ দৃশ্য। মুখভঙ্গি বেজায় নাখোশ। মাহতাব সবসময় উচিত কাজটাই করে। এজন্যই তো এতো পছন্দের তার। মাহতাবের এই সঠিক সময়ের উগ্র মেজাজই তাকে পছন্দের শীর্ষে পৌঁছেছে। মে’রে ফেলুক কু’ত্তার বাচ্চাটাকে! সমস্ত ঝামেলা শেষ হোক। সুলতানের গা ছাড়া ভাবভঙ্গিতে রাগান্বিত পার্শ্ব সেনা প্রধান। উমারের অবস্থা ক্রমেই করুন হচ্ছে। ঠিক তখনই সেনা প্রধানের হুকুমে তোহফার গলার তলোয়ারের চাপ প্রয়োগ করা হয়। চিরে যায় পাতলা চামড়া। লালে রঞ্জিত তরলের দেখা মিলল নরম গলায়। ব্যথাতুর আর্তনাদ ভেসে আসে তোহফার কন্ঠে। তড়িৎ বেগে চেঁচিয়ে ওঠে সুলতান, “তোহফা!”
অধর ফুলিয়ে ভেজা, লাল চোখদুটো সুলতানের ডাকে আরোও বিচলিত হয়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ডাকে, “আব্বু, ব্যথা, ব্যথা। রক্ত।”
পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় পিতার স্থান কুড়িয়ে নিয়েছে সুলতান। আশ্বাস দেওয়ার ভাষা ফুরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। জোরেসোরে হাঁক ছাড়লো মাহতাবের উদ্দেশ্যে, “ছেড়ে দাও মাহতাব। সরে এসো।”
কর্ণগহ্বরে পৌঁছালো না মাহতাবের। সে পূর্বের মতোই চড়াও হয়ে উমারের উপর। গর্জন করে সুলতান, “মাহতাব! আমি বলছি ছেড়ে দাও।”
হাত হালকা হয়ে আসে মাহতাবের। রাগে চোখমুখ কুঁচকে উঠে আসে উমারের উপর থেকে। বড় বড় শ্বাস ফেলে রাগ দমানোর চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। রাগে কম্পিত হচ্ছে বলিষ্ঠ শরীর। কাশতে কাশতে উঠে দাঁড়িয়েছে উমার। ঠোঁটের কোনে বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্য রক্তটুকু মুছে নেয়। চোখের সামনে হাতটা ধরে দেখে নেয় রক্ত। বাঁকা হেসে বলল, “এত রাগ ভালো নয়। সামান্য সৈনিক প্রধান হয়েই এত তেজ? বিস্ময়কর! বোঝাই যাচ্ছে শাহজাইন কতটা মাথায় উঠিয়ে ফেলেছে তোকে।”
ফিরে তাকালো মাহতাব। দৃষ্টিতে অগ্নি শিখা। ইচ্ছে করলো উমারের গলাটা টিপে ধরতে। শ্বাস বন্ধ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে। সে নিয়ন্ত্রণ করলো নিজেকে। মায়ার দৃষ্টিতে তাকালো তোহফার দিকে।
“তা ম’রার জন্য প্রস্তুত তো শাহজাইন?” উপহাস করে উমার।
নির্জীব, নীরব সুলতান। কাতর চোখে তোহফাকে একবার দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। মাথাটা কাঠের গুঁড়ির সাথেই ঠেকানো। হাসে উমার। উচ্চস্বরে বলল, “নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। শুভ কাজে দেরি কেন? দাও সৈনিক, তলোয়ার চালিয়ে দাও।”
“আপনি এমন করতে পারেন না মহামান্য।” চিৎকার করে মাহতাব।
ভেসে আসে তোহফার ভীত কাঁপা কাঁপা কন্ঠ, “আআব্বু।”
আকস্মাৎ নড়ে উঠলো সুলতানের চোখের পাতা। জোর করে খিচেই বন্ধ করে রইলো চোখদুটো। মাথার উপর তলোয়ার উচিয়ে ধরেছে পার্শ্ব সেনা। কোপ বসাতে সর্বশক্তিতে। আতঙ্কিত মাহতাবসহ প্রতিটি রামান সৈন্য। অপরদিকে উত্তেজিত, কিঞ্চিত খুশির রেশ উমারসহ তার সেনাদলের চোখে-মুখে। অতিশয় গম্ভীর হয়েছে পরিবেশ। পাহাড়ের কঠিন গম্ভীরতা ডিঙিয়ে অদূরে কোথাও ডেকে উঠলো অভুক্ত শেয়াল। ক্ষুধার্ত হয়ে ওৎ পেতে আছে ময়দান ফাঁকা হবার। বিশাল পাহাড়ের উপত্যকা নারাজ বুঝি সুলতানের পরিণতিতে। অস্থির, উদগ্রীব প্রতিটা মানব। আকস্মাৎ উত্তেজিত পরিবেশ বদলে ফেলে সহস্রাধিক তিরের ফলা একসঙ্গে ছুটে এসে বিঁধে যায় পার্শ্ব সেনাদের কপালে, গলায়। সুলতানের মাথার উপর তলোয়ার ধরে থাকা সেনা অচিরেই ঢলে পড়ে নিচে। তোহফার দিকে তাক করে ধরা প্রতিটা তিরসহ সেনারা আর্তনাদ করে ওঠে। কোথা থেকে আগুনের গোলা ছুটে এসে পড়েছে তাদের শরীরে। আগুনের ভয়াবহতায় সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই চোখের সামনে ঝলসে যায় শত শত পার্শ্ব সেনা। দেরি করেনি সুলতান। তড়িৎ বেগে উঠে যায় তোহফার কাছে। বাঁধা হাত নিয়েই কনুইয়ের সাহায্যে আঁকড়ে ধরে কোলে তুলে নিলো তোহফাকে। প্রাণ ফিরে পেলো মেয়েকে কাছে পেয়ে। তোহফার গলার তলোয়ার রাখা সেনার বুকে লাথি বসায় চরম আক্রোশে। মাটিতে আছড়ে পরার সাথে সাথেই গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে। তোহফাকে বুকে আঁকড়েই প্রাণ নেয় পার্শ্ব সেনার। সদ্য বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া তোহফা পিতার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। এতোক্ষন যেন এমন একটা চমৎকার সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো রামান সৈন্যদল। মাহতাবের ইশারায় তলোয়ার উচিয়ে আক্রমণ করে বসে পার্শ্ব সেনাদের উপর। পাল্টা আক্রমণ করে পার্শ্ব ও দক্ষিণী সেনারা একযোগ হয়ে। হতভম্ব হওয়ারও সুযোগ পেলো না উমার। পূর্বেই আরো লক্ষ লক্ষ সৈন্য হুরমুরিয়ে প্রবেশ করে ময়দানে। তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে যায় রামান সৈন্যদের কাতারে। পার্শ্ব ও দক্ষিণী সেনাদের তুলনায় বহুগুণ ভারি হয়ে গেছে রামান সৈন্যদের দল। অথচ তারা রামান সাম্রাজ্যের নয়। সে কথা তাদের পোশাকই বলে দিচ্ছে। রামান সৈন্যদের পোশাক কুচকুচে কালো অথচ নতুন করে প্রবেশ করা এই লক্ষ লক্ষ সৈন্যের শরীরে ঘিয়ে রঙের পোশাক। হতভম্ব উমার চিৎকার করে শুধাল,
“কারা এরা? কোন সাম্রাজ্যের সৈন্য?”
“এরা সকলে উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সৈন্য। তাদের পোশাক সেই চিহ্নই বহন করছে।” বিস্মিত কন্ঠে জানায় উমারের সেনা প্রধান।
“ওরা এখানে কেন এসেছে? রামান সৈন্যদের সাথে কেন যোগ দিচ্ছে?”
মুখের কথা মুখেই রইল। ময়দান কাঁপিয়ে রাজার বেশে হাজির হয় একটি সফেদ রঙা ঘোড়া। পিঠে তার রাজকীয় সাজসজ্জা। পিঠে করে বহন করছে তির-ধনুকসহ সুন্দরী এক নারী। কালো গাউনে কোমরে বাঁধা শক্ত বন্ধনী। উল্টো দিকের অনিলে উড়ছে হিজাবের বাড়তি অংশ। মাথায় জ্বলজ্বল করছে ধবধবে সাদা পাথরের তাজ। শুকনো পাতা উড়িয়ে পা ফেলছে সফেদ ঘোড়া। ছুটে এসে থামে ময়দানের মাঝখানে। আশপাশ নাড়িয়ে তোলে হ্রস্বধ্বনিতে।
বিস্মিত উমার ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো, “কী হচ্ছে এসব? কে এই নারী?”
পার্শ্ব সেনা প্রধান নিশ্চুপ, নীরব। চিনতে পারছে না সে নিজেও। তবে এতটুকু নিশ্চিত ইনি রাজবংশীয় কোনো নারী। বুঝতে পারছে না কী ঘটতে কী ঘটে চলেছে এসব। উত্তরীয় সাম্রাজ্যের বিশাল এই সৈন্যদল রামান সৈন্যদের সাথে কেন যোগ দিচ্ছে? জিতে যাওয়া যুদ্ধ এভাবে ঘুরে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তারা। হিতাহিতবোধশূন্য হলো যেন হুট করে। এতক্ষণে সুলতানের বুক থেকে মুখ তুলে তাকিয়েছে তোহফা। আচমকা ভয় কাটিয়ে অধর প্রসারিত করে সেই নারীর পরিচয় জানান দিলো।
“আম্মু।”
তোহফার ডাকে চমকেছে যেমন পার্শ্ব সেনার দল ঠিক তেমনই চমকেছে সেই নারী নিজেও। হতবাক স্বরে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো, “আম্মু!”
“আম্মু।” আবারো ডাকে তোহফা।
বিস্ময়ের সীম রইল না। ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে আসে বেগম। সুলতানের বুক থেকে একপ্রকার ছোঁ মেরেই কেড়ে নিলো তোহফাকে। বুকে আকড়ে তোহফার গালে আলতো হাত রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আবার ডাকো আম্মু। আবার ডাকো।”
বুকে মুখ গুঁজে দিলো তোহফা। নেভানো কন্ঠে ডাকে, “আম্মু।”
খুশিতে এবার কেঁদেই দিয়েছে বেগম। তার কন্যা জবান ফিরে পেয়েছে! আম্মু বলে ডেকেছে তাকে! জীবনের প্রথম এই শ্রুতিমধুর ডাক যেন আনন্দের জোয়ারে ভাসালো তাকে। কাঁদতে কাঁদতে ছলছল দৃষ্টিতে চাইল সুলতানের দিকে। সব ভুলে মৃদু হাসলো সুলতান। বেগমের গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে ডাকলো, “এলি, এলি।”
উত্তর দেয় না বেগম। খুশিতে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। একটানে তোহফাসহ বেগমকে বুকে টেনে আনে সুলতান। বুকের সাথে মাথাটা চেপে ধরে মাথায় হাত বুলালো। মাথা তুলে তাকাচ্ছে বেগম। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সুলতানের মুখের দিকে চেয়ে বলল , “সুলতান, তোহফা, তোহফা কথা বলছে। আআমাকে আম্মু বলে ডেকেছে আমার কন্যা। আমার তোহফা কথা বলতে পারছে।”
“কথা বলছেন না কেন? শুনছেন আপনি? আমার তোহফা আমাকে আম্মু বলে ডেকেছে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি এলি। শান্ত হও তুমি। শান্ত হও।”
মাথায় অবিরত হাত বুলাচ্ছে সুলতান। ধ্যান নেই বেগমের। আবারো তোহফার মুখে হাত রেখে বলল, “আরেকবার ডাকো আম্মু। ডাকো।”
“আম্মু, আম্মু।”
সঙ্গে সঙ্গে ওর গালে, মুখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল বেগম। আদুরে কন্ঠে বারংবার আওড়ায়, “তোহফা, আমার আম্মু, আমার সোনা।”
“শান্ত হও এলি। তুমি কীভাবে জানলে যুদ্ধের কথা?”
“আপনি, আপনি বেইমানি করেছেন সুলতান। এতবড় কথাটা কীভাবে লুকাতে পারলেন আমার থেকে? ওরা তোহফাকে তুলে না আনলে তো আমি কিছু জানতেই পারতাম না। আর এদিকে আমার অজান্তে ক্রমেই শেষ হয়ে যেতো আমার পৃথিবী। কীভাবে এমনটা করতে পারলেন আপনি? কীভাবে? কেন মাথা রেখেছিলেন ওখানে? মে’রে ফেলতে চান আমাকে? জীবন থাকতেও মৃ’তের মতো বাঁচিয়ে রাখতে চান?”
সুলতানের বুক থেকে সরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বেগম। আবারো টেনে বুকে চেপে ধরলো সুলতান। জোর করেই কপালে অধর ছুঁইয়ে শুধাল, “জ্বর সেরে গেছে? শরীর ঠিক আছে তোমার? মুখটা এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? ”
কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না বেগম। কোনো এক অজানা সুখবর সুলতানকে জানানোর দরকার থাকলেও জানায় না অভিমানে। চেপে যায় নিজের ভেতরে। মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুলতানের থেকে। ভেবেছে টা কী মানুষটা? যুদ্ধের কথা না জানিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজে এখানে প্রাণের বলি চড়াবে! সুলতানবিহীন অমন প্রাণ দিয়ে কী করবে সে?
উমারের আহত মুখের দিকে চেয়ে বিজয়ের হাসি হাসে মাহতাব। ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বলল, “কী? চিনতে পারছিস না? উনি উত্তরীয় সাম্রাজ্যের শেহজাদি, রামান সম্রাজ্ঞী, সুলতান শাহজাইনের বেগম এলিজা সুলতান।”
উমারের চোখদুটো হঠাৎই স্বাভাবিকের তুলনায় বড় আকার ধারণ করলো। বিস্মিত কন্ঠে অধর গলে বেরিয়ে এলো, “এলিজা সুলতান! আমার বোনের মৃ’ত্যুর কারন!”
চলবে……
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_40
যুদ্ধের বিশাল ময়দানে শুনশান নীরবতা কাটিয়ে আবারো শ্রবণগোচর হচ্ছে তলোয়ারের ঝনঝন শব্দ। প্রকৃতি উচ্ছল। কমেছে রোদের প্রখরতা। পার্শ্ব সেনাদের নাজেহাল দশা। উত্তরীয় সৈন্য রামান সৈন্যদলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। এত এত সৈন্যের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে উমারের নিকট। তার সেনাপ্রধান বারবার আপোসের নিশান ওড়ানোর পরামর্শ দিলেও কানে নিচ্ছে না উমার। শাহজাইন আর এলিজাকে একসঙ্গে শেষ করার এই সুবর্ণ সুযোগ সে আর পাবে না। একবার জয় পেলেই রামান সাম্রাজ্যও থাকবে তার দখলে। লোভ আর প্রতিশোধের নেশা অন্ধ করেছে তাকে। সম্মুখেই নিজের মৃ’ত্যুর হাতছানিও চোখে বাঁধছে না এই নেশায়। তোহফাকে কোলে নিয়ে একহাতে তলোয়ার ধরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে বেগম। সুলতান লড়ছে, মাহতাব লড়ছে অথচ সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মন সায় দিচ্ছে না তোহফাকে একলা ছাড়ার বা কোনো সৈন্যের উপর ভরসা করার। সুলতান অবশ্য খুশিই হয়েছে তার এই সিদ্ধান্তে। তবে অনেকবার তাকে তোহফাকে নিয়ে সাম্রাজ্যে ফিরে যেতে বললেও যায়নি বেগম। পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে। তারা সংখ্যায় পার্শ্ব সেনাদের তুলনায় অনেক বেশি। বহুগুণ ভারি তাদের সৈন্যদল। তবুও যাবে না সে। সুলতানকে রেখে কিছুতেই যাবে না। পরিস্থিতি সবসময় তাদের অনুকূলে নাও থাকতে পারে। তার প্রয়োজন পরতেই পারে। সে চলে গেলে কী করে চলবে? সাম্রাজ্যের প্রতি তার দায়িত্ব নেহাতই কম নয়। কন্যার মায়ায় সাম্রাজ্যের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সম্রাজ্ঞীর বৈশিষ্ট্যের মাঝে পড়েনা। যুদ্ধের মাঝে মাঝে ঘুরে তাকাচ্ছে সুলতান। বেগমের চিন্তিত মুখটা দেখে নিয়ে আবারো তরবারি চালাচ্ছে। মাহতাব তলোয়ারের গতি ঠিক রেখে একবার পর্যবেক্ষণ করলো তাকে। একপা দু’পা করে এগিয়ে এসে বিনয়ী স্বরে ডাকে, “মহামান্য।”
ভাবনাচ্যুত হয় সুলতান। শুধায়, “বলো মাহতাব।”
“আপনি বরং কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন। এখন আমরা জয় পাবো নিশ্চিত। শুধু শুধু কেন কষ্ট করবেন?”
“কষ্ট তোমরাও করছো মাহতাব। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। ঠিক আছি আমি। চিন্তা শুধু এলিকে নিয়ে। কেমন যেন দূর্বল লাগছে ওকে। সদ্য জ্বর ছেড়েছে বলেই হয়তো এই পরিবর্তন চেহারার।” চিন্তিত স্বরে বলল সুলতান।
মাথা নাড়ালো মাহতাব। জানান দিলো, “কেন জানিনা তবে আসলেই দূর্বল লাগছে। ওনাকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিন। শেহজাদিও ভয় পাচ্ছে এসব দেখে।”
সায় দিলো সুলতান। কপালে ভাঁজ পড়লো কয়েকটা। তরবারির তাল বজায় রেখেই বলল, “সেই ভালো হবে।”
কথার ফাঁকে ফাঁকে অবিরত চলছে তলোয়ার। থেমে নেই যুদ্ধ। পার্শ্ব সাম্রাজ্য হারের দাঁড়গোড়াতে। সৈন্য একেবারেই কমে এসেছে তাদের। কিন্তু উমারের ভঙিমায় কোথাও আপোস করার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে তার সৈন্যদল অথচ সে নিজ সিদ্ধান্তে অটল। বেশ কিছুক্ষণ পরেও পরিস্থিতি অনুকূলে দেখে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসে সুলতান। তরবারি কোমরে গুঁজে সচেতন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো চতুর্দিক। বেগমের দিকে এগোতে এগোতে সম্মোহনী কন্ঠে ডাকে, “এলি।”
মনোযোগ দিয়ে যুদ্ধ দেখছিল বেগম। হুট করে সুলতানের কন্ঠে ধ্যান ভাঙলো। ময়দান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুলতানের দিকে চাইল। আনমনেই আওড়ালো, “হু?”
কাছে এসে দাঁড়ালো সুলতান। তোহফার কপালে চুমু এঁকে কোলে তুলে নেয়। পাশে দাঁড়িয়ে বেগমের একহাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শুধাল, “কী ভাবছো এতো?”
“কিছু না। এই যুদ্ধ কখন শেষ হবে সেই অপেক্ষাই করছি।”
“তোহফা ভয় পাচ্ছে এলি। তোমার যাওয়া উচিত।”
“আর আপনি?”
“আমি এভাবে সবাইকে রেখে যেতে পারিনা। কিন্তু তোমাকে যেতে হবে। জয় আমাদের নিশ্চিত। তুমি যাও, আমরা খুব শীঘ্রই চলে আসবো।”
নারাজ বেগম। অসন্তোষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। সুলতান পুনরায় বলল, “যাও।”
“আমি এভাবে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারবো না। সবাইকে ফেলে একা একা কিছুতেই যাবো না।”
“তোমাকে যেতে হবে এলি।” অত্যধিক গম্ভীর হয় সুলতানের কন্ঠস্বর।
মুখ ঘুরিয়ে নেয় বেগম। সে কিছুতেই যাবে না। এতক্ষণ চুপচাপ পিতা মাতার কথোপকথন শুনলেও এবার কথা বলে উঠলো তোহফা। ভীত স্বরে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়, “আম্মু, রক্ত, ভয়, ভয়।”
চমকাল বেগম। অসহায় হলো তার দৃষ্টি। সুযোগ পেল যেন সুলতান। তড়িঘড়ি করে খানিক রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো, “শুনেছো? এবার তো যাও। দেখতে পাচ্ছ না ভয় পাচ্ছে মেয়ে?”
“কিন্তু সুলতান…….”
কথা সম্পূর্ণ না করেই আকস্মাৎ চোখদুটো বিস্ময় ধারণ করলো। সজোরে তলোয়ার চালিয়ে দিলো সুলতান পাশ ঘেঁষে। পুরুষালি আর্তনাদে অবাক হয়ে পেছনে ফিরলো সুলতান। ততক্ষণে নিজের রক্তাক্ত গলা চেপে ধরে মাটিতে ঢলে পড়েছে পার্শ্ব সেনাপ্রধান। কিছুক্ষণ ছটফট করে প্রাণ ত্যাগ করলো অচিরেই। বুঝতে বাকি রইল না সুলতানকে আক্রমণ করতে এসেছিল সে। হতভম্ব সুলতান পুনরায় ফিরে তাকায় বেগমের দিকে। রাগে ফুসছে বেগম। আরেকটু হলেই সুলতানের শরীরে তলোয়ার চালিয়ে দিতো পার্শ্ব সেনাপ্রধান। হুট করে নিজের হিজাবের একাংশ ছিড়ে দ্রুতহাতে বেঁধে দেয় তোহফার চোখদুটো। অভয় দিয়ে বলল, “এবার আর ভয় করবে না আম্মু। আছিতো আমি। কিচ্ছু হতে দেবো না তোমার।”
তোহফাকে বেগমের কোলে তুলে দিয়ে নীরবে প্রস্থান করলো সুলতান। এই ঘটনার পর বেগম কখনোই যাবে না তা আর জানার বাকি নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে যুদ্ধে মনোযোগ দেওয়াটাই সঠিক মনে হলো তার নিকট। আবারো যোগ দিলো হত্যার খেলায়। হুট করে উমারের ইশারায় শত শত সৈন্য দলবেঁধে একসঙ্গে আক্রমণ করে বসলো সুলতানের উপর। প্রায় সাথে সাথেই সব ফেলে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মাহতাব। নিজের সাথে শত শত সৈন্য নিয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুলতানের চারপাশে। পার্শ্ব সেনারা যেন পন করে এসেছে সুলতান এবং মাহতাবকে মা’রার। ঘুরেফিরে তারা শুধু এই দু’জনকেই আঘাত করছে। তাদের প্রতিহত করতে ব্যস্ত করে পড়ে সুলতান ও মাহতাব। অন্যদিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলো উমার। এতক্ষণ পর যেন গুটি চালার একটা পথ পেলো সে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায় যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে। সকলের অগোচরে এগিয়ে আসে বেগমের দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সুলতান এবং মাহতাবের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলো বেগম। হঠাৎ শক্ত কিছুর আঘাতে ছিটকে পরে মাটিতে। কোল থেকে ছুটে যায় তোহফা। মুখ থুবড়ে পড়ে বেগমের থেকে পাহাড়ের কিনারায়। সাথে সাথে কেঁদে ওঠে চিৎকার করে। বেশ ব্যাথা পেয়েছে সে। হাসছে উমার। শব্দহীন হাসি যেন পৌঁছায় না সুলতান পর্যন্ত। বেগম উঠে দাঁড়ানোর পূর্বেই তলোয়ার চালায় সজোরে। নিজের তলোয়ার উচিয়ে সেই প্রহার প্রতিহত করলেও সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হলো বেগম। তোহফার দিকে ধ্যান না দিয়ে উমারের উপর সমস্ত মনোযোগ নিক্ষেপ করে সে। কন্যার ক্রন্দনরত কন্ঠ মনোযোগ নষ্ট করতে পারে না তার। শুরু হয় উমারের সাথে তলোয়ার যুদ্ধ। বেশ খানিকটা সময় পরেও বেগমের সাথে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না উমার। একেতো পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার উপর এলিজার যুদ্ধের হাত এমন দক্ষ হবে সে আগেই জানতো। বাঁকা হেসে ছুটে যায় মাটিতে বসে থাকা তোহফার দিকে। মনোযোগ নষ্ট হয় বেগমের। কিন্তু এখানেও ব্যর্থ উমার। তোহফার শরীরে হাত ছোঁয়ানোর পূর্বেই অসাবধানতাবশত তার শরীরের লোহার বর্ম খুলে পরে। পিঠ চিরে ঢুকে যায় বেগমের তলোয়ার। তোহফা একেবারে পাহাড়ের কিনারে বসে আছে। দেরি না করে তোহফাকে কোলে তুলে নিলো বেগম। উমারের আর্তনাদে ছুটে এসেছে সুলতান। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও বেগমের দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠলো উমার, “তোকে শেষ না করে মরব না আমি।”
ততক্ষণাৎ আগুন ধরলো যেন সুলতানের মাথায়। তরবারি হাতে তেড়ে যেতে নিলে আটকে দেয় মাহতাব। নরম গলায় বলল, “ওকে আমি দেখছি। আপনার সুলতানার কাছে যাওয়া প্রয়োজন।”
একহাতে রক্তাক্ত তলোয়ার, অন্য হাতে তোহফাকে কোলে নিয়ে রাগে থরথর করে কেঁপে চলেছে বেগম। হাত কেঁটে রক্তে ঝরছে অবিরত। সুলতান দ্রুত তাকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো পাহাড়ের কিনারা থেকে। খানিকটা এগিয়েও এলো বেগম। তখনই ঘটলো আরেক দুর্ঘটনা। মাহতাবকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সুলতানকে মা’রতে ছুটে আসছে উমার। সুলতানের শরীরে তলোয়ার ছোঁয়ানোর ভাগ্য আর হলো না। পূর্বেই বেগমের তলোয়ারের আঘাতে পাহাড়ের কিনারায় লুটিয়ে পড়লো সে। শ্বাস-প্রাশ্বাসের গতি কমে এলো কয়েকগুণ। অবশেষে চোখদুটো বন্ধ করে নিলো উমার। অসাড় শরীরে লাথি বসালো মাহতাব। তার মৃ’ত্যুর সাথে সাথেই বন্ধ হলো সমস্ত যুদ্ধ। রামান সৈন্যদল ততক্ষণাৎ উড়িয়ে দিয়েছে বিজয়ের নিশান। আরো একবার বিজয়ের হাসি হাসলো রামান সাম্রাজ্য। শত্রুর সমাপ্তিতে তৃপ্তির হাসি ফুটল বেগমের মুখে। মাহতাব ছুটে গেল সেনাদের দিকনির্দেশনা দিতে। সুলতান চিন্তিত মুখে বেগমের কাঁটা হাত ধরে পর্যবেক্ষণ করছে। অসহায় গলায় বলল, “অনেকখানি কেঁটে গেছে।”
মৃদু হাসলো বেগম। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো, “আপনাকে একটা সুখবর দেবার আছে।”
“সুখবর?” শুধায় সুলতান।
কিছুটা সময় নীরবেই কাটলো। নীরবতা ভেঙে ঝনঝন শব্দ তুলে যেন বেগম বলে উঠলো, “আমি অন্তঃসত্ত্বা। আপনি আবার আব্বা হতে………”
বাক্য সম্পূর্ণ করার পূর্বেই চিৎকার করে উঠলো সুলতান, “কী বললে তুমি?”
একরাশ বিস্ময় তার দৃষ্টিতে। মিটমিটিয়ে হাসছে বেগম। আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়লো না। খুশিতে গলার স্বর হারিয়েছে বুঝি সুলতান। বারংবার প্রচেষ্টার পরেও সে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে সক্ষম হলো না। চোখেমুখে এক আকাশ আত্মতৃপ্তি আর বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল বেগমের দিকে। দু’হাতে বেগমের মুখ আঁকড়ে ধরে উন্মাদের ন্যায় অগণিত চুমু আঁকলো পুরো মুখে। তোহফা কিছু না বুঝেই হাসছে। খুশি হচ্ছে অজানা কারনে। এত খুশির মাঝেও কেউ অদূরে পাতছে মৃ’ত্যুর ফাঁদ। শেষ হওয়া যুদ্ধের ময়দান আবারো রক্তে রাঙাতেই বোধহয় আগমন তার। রামান সাম্রাজ্যের সেই অজানা শত্রুর খবর কি রেখেছে কেউ? একটাবারও ভেবেছে কি তাদের খুশির মুহুর্ততে কেউ একজন শোকের ছায়া নামানোর পরিকল্পনা এটেছে? অদূরে পাহাড়ের কিনারে কেউ বিদঘুটে হাসি হাসছে। প্রহর গুনছে কারোর মৃ’ত্যুর। হিমশীতল আর ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে ওঠে, “আর দেরি নেই। মাত্র কিছুটা সময়। তোমাদের বিচ্ছেদ যখন আমার হাতেই লেখা তবে কেন প্রনয় তোমাদের কাছে বারবার ধরা দিতে চায়? শেহজাদি তোহফা, তোমাকে আমি বড্ড ভালো জানি। তোমার লালন-পালনের জন্য পিতা-মাতার মধ্যে যে-কোনো একজনই যথেষ্ট। দু’জনের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। অন্যজন নাহয় আকাশের তারকা হয়েই দেখে যাবে তোমায়।”
চলবে……