#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_41
যুদ্ধের সমাপ্তিতে তৃপ্তির হাসি পাহাড়ে অবস্থানরত প্রতিটা মানুষের অধরে। সৈনিকেরা যুদ্ধে ব্যবহৃত যাবতীয় সরঞ্জাম গোছগাছ করতে ব্যস্ত। অস্ত্র গুছিয়ে ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করা হচ্ছে। সকলের মাঝেই অনন্য এক উত্তেজনা। আবার ফিরবে তারা নিজ জন্মভূমিতে। ময়দান তখনও রক্তে রাঙা। রক্ত শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। মৃ’ত সৈনিকদের প্রাণহীন দেহগুলো একত্রিত করা হয়েছে। সাম্রাজ্যে পৌঁছে স্বসম্মানে দাফন করা হবে তাদের। মাহতাব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সবকিছু। সৈনিকদের প্রতি সে অজানা এক টান অনুভব করে সবসময়। সৈনিক প্রধান হবার দরুন এই মায়া হয়তোবা। শূন্য দৃষ্টিতে লা’শগুলোর দিকে দেখতেই কেঁপে ওঠে হৃদয়। এভাবে একদিন তাকেও যেতে হবে। সৈনিক প্রধানেরা যে জীবনের নিশ্চয়তা পায় না কখনোই। তবুও কতো স্বপ্ন দু’চোখে। বাঁচার ইচ্ছা, প্রিয়তমাকে নিজের করে পাবার আকুলতা। সেই কঠিন আকুলতা কি আদৌ দেখতে পায় মেয়েটা?
তার প্রেমিক হৃদয় আনমনে ভাবে, “জুঁই, জুঁই কেমন আছে? ভালো আছে তো? একবারও কি আমাকে মনে পড়েছে তোমার?”
পরক্ষণেই ভাবলো জুঁই নিশ্চয় অপেক্ষা করছে তার জন্য। দ্রুত ফিরতে হবে। জানাতে হবে জুঁইকে, সে কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে। ফিরবে সে, আবারও জুঁইয়ের কাছে ফিরবে। জুঁইকে দেওয়া কথা সে রেখেছে। অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাবে সাম্রাজ্যে। হঠাৎ যেন মহলে ফেরার তাড়া বেঁধে গেছে তার। মুহুর্তেই বদলে গেছে বীর সেনার মুখভঙ্গি। উতলা হয়েছে প্রিয়তমার দেখা পেতে। কতগুলো দিন দেখে না মেয়েটাকে। শোনে না বোকা বোকা কথাগুলো। এদিক-ওদিক চাইল অস্থির চিত্তে। উদ্বিগ্ন গলায় সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলল, “যাওয়ার প্রস্তুতি নাও সকলে। ফিরতে হবে আমাদের।”
রামান সৈন্যদল সৈনিকপ্রধানের আদেশ পেয়ে ততক্ষণাৎ প্রস্তুতি শুরু করলেও নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরীয় সৈন্য বাহিনী। ভ্রু কুচকায় মাহতাব। খানিক উচ্চস্বরে বলল, “তোমরা কি শুনতে পাওনি আমি কী বলেছি? দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“ক্ষমা করবেন। অনুমতি ছাড়া আমরা যেতে পারবো না। এমনকি পাশ ফেরার জন্যও হুকুম প্রয়োজন আমাদের।”
মাথা নুইয়ে অথচ দৃঢ় স্বরে জবাব দেয় উত্তরীয় সৈন্য। অবাকের সাথে সাথে রাগান্বিতও হতে দেখা যায় মাহতাবকে। ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে, “অনুমতি তো দিয়েছি তোমাদের। তারপরও এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
উত্তরীয় সেনাদের নীরবতা ভালো ঠেকল না মাহতাবের নিকট। আদেশ অমান্য করায় অত্যধিক রাগান্বিত হয়ে পড়লো যেন। লক্ষ লক্ষ রামান সেনা তার কথায় ওঠে আর বসে। সম্মানে বাঁধলো তার। তাকে উপেক্ষা করে উত্তরীয় সেনাপ্রধান এগিয়ে যায় পাহাড়ের কিনারে। যেখানে বেগম এবং সুলতান অবস্থান করছে। মুখভঙ্গি কঠিন করে এগিয়ে যায় মাহতাব নিজেও। অবস্থা আন্দাজ করতে সময় লাগলো না বেগমের। নরম স্বরে বলে উঠলো, “যাও তোমরা। সাম্রাজ্যে ফিরে যাও। আব্বাজানকে বিজয়ের খবর দিও।”
হুকুম পাওয়া মাত্র সম্মান প্রদর্শন করে প্রস্থান করলো সমস্ত উত্তরীয় সৈন্যদল। মাহতাবের অসন্তোষ মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা ভাবলো বেগম। অতঃপর আবারো বলে উঠলো, “কিছু মনে করো না ওদের ব্যবহারে।”
মাথা নাড়ালো মাহতাব। নাখোষ মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো খানিকটা। বুঝার ভুল ছিলো তার। ইতস্তত ভঙ্গিমা বদলাতে তোহফাকে কোলে নিয়ে হাত বুলালো মুখে। চোখ-মুখ কুচকে ফেলেছে তোহফা। ব্যথাতুর ধ্বনি উচ্চারণ করলো মুখের হাত সরিয়ে। ঘাবড়ে গেল বেগম। হন্তদন্ত হয়ে শুধাল, “কী হয়েছে আম্মু? ব্যথা পেয়েছ?”
“হু।” তোহফার ছোট্ট উত্তর। চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর। এখনি যেন দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরবে নেত্র বেয়ে।
“কাঁদে না আম্মাজান। ঠিক হয়ে যাবে।” বলতে বলতে এগিয়ে আসলো সুলতান।
“ব্যথা, ব্যথা আব্বু।”
“ইশশ! কতখানি ব্যথা পেয়েছে আমার আম্মাজান। মাহতাব, এক্ষুনি শেহজাদিকে মহলে নিয়ে গিয়ে ওষুধ লাগানোর ব্যবস্থা করো।”
“কী বলছেন আপনি? মাহতাবের সঙ্গে কেন যাবে? শুনতে পাচ্ছেন না ব্যথা পেয়েছে মেয়েটা?” রাগান্বিত কন্ঠে জাহির করে বেগম।
“শুনেছি বলেই তো বলছি। মাহতাবের সঙ্গে গেলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে। আমাদের যেতে আরো খানিকটা দেরি হবে।”
সুলতানের শান্ত ভঙিমায় তেতে উঠলো যেন বেগম। উত্তেজিত স্বরে শুধায়, “মানে?”
“ঘোড়া কম পড়ছে। কিছু ঘোড়া নিহত হয়েছে তাই এই সংকট। মাহতাবসহ সৈনিকেরা সাম্রাজ্যে গিয়ে সরঞ্জাম রেখে আবার আসবে। মৃ’তদেহগুলোও তো নিতে হবে। তোহফাকে মাহতাব নিয়ে গিয়ে ওষুধ লাগানোর ব্যবস্থা করুক ততক্ষণে। আমরা নাহয় কিছুক্ষণ পরেই গেলাম। কী বলো?”
“কিন্তু সুলতান……”
“কোনো কিন্তু নয় এলি। তোহফা ঠিক থাকবে মাহতাবের কাছে।”
ভরসার চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে। শুধাল, “ফিরে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেছে নাকি মাহতাব?”
“জ্বী মহামান্য। শুধু আপনার হুকুমের অপেক্ষা।”
“তাহলে আর দেরি করো না। রওনা দাও। মাহতাব চাচ্চুর সাথে যেতে তোমার কোনো সমস্যা নেই তো আম্মাজান?” তোহফার উদ্দেশ্যে শুধাল সুলতান।
ডানে-বামে মাথা নাড়ালো তোহফা। অস্ফুট স্বরে আওড়ালো, “উঁহু।”
অধর প্রসারিত করলো মাহতাব। হাসিমুখে বলল, “সাহসী শেহজাদি।”
“সাহসী? আমি সাহসী?” ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলে বসলো তোহফা।
“হ্যাঁ শেহজাদি। অনেক সাহসী আপনি। কেন? কোনো সন্দেহ আছে নাকি?”
“উঁহু, আমি জানিতো। অনেক সাহসী আমি। দেখলে না কীভাবে তলোয়ার দেখেও কান্না করিনি? একদম ভয় পাই না আমি।”
“আচ্ছা তাই নাকি? এত সাহসী আমাদের শেহজাদি!” অবাক হবার ভান ধরলো মাহতাব।
“খুব সাহস আমার। শুধু তোমাদের কথা ভেবে ঐ পচাঁ সেনাগুলোকে কিছু বলিনি তখন।”
কেশে উঠলো বেগম। এতটাও আশা করেনি সে। কন্যার কথায় বিষম খেয়েছে যেন আচমকাই। মিটমিটিয়ে হাসছে সুলতান। মাহতাবের মুখভঙ্গি অবশ্য অত্যন্ত স্বাভাবিক আর গুরুতর। যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে তাদের মাঝে। তার গুরুতর মুখভঙ্গিতে আরোও উৎসাহ পাচ্ছে তোহফা। একের পর এক কথার ঝুড়ি খুলছে সে। ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে বসলো। মাহতাব বিচক্ষণতার সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেল তোহফাকে নিয়ে। সৈনিকরা বিদায় নিয়ে প্রস্থান করাতে ফাঁকা হলো ময়দান। পাহাড়ের কিনারায় একলা দাঁড়িয়ে রইল সুলতান আর বেগম। হঠাৎ কটমট করে তাকালো বেগম। ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “মেয়েটা বোধহয় আপনার মতোই হবে।”
“আচ্ছা? এখন এটাও আমার দোষ?” চোখ কপালে তুলল সুলতান।
“অবশ্যই আপনার দোষ।”
নীরবে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সুলতান। বেগম সরে দাঁড়ালো তার থেকে। দ্বিমত পোষণ করলো না সে। একইভাবে চেয়ে রইল অনিমেষ। উত্তর না পেয়ে ফের কথা বলল বেগম, “চুপ করে আছেন কেন?”
উত্তর আসে না সুলতানের পক্ষ থেকে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি বুঝি থমকে গেছে আজ। বিরক্ত হয়ে উঠলো বেগম, “আরেহ! এভাবে তাকিয়ে থাকার মতো কী হয়েছে? কিছুতো বলুন।”
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তাকে বুকে চেপে ধরলো সুলতান। কতকাল পরে যেন বুকে পানি আসলো জোয়ার ভাসিয়ে। শান্তি মিলল হৃদয় আঙিনায়। সম্মোহনী কন্ঠে আওড়ালো, “এলি।”
“বলুন সুলতান।”
বুকের একপাশে নিজের হাত রেখে দু’চোখ বন্ধ করে আছে বেগম। মানুষটার শরীরের ঘ্রাণে মাতাল লাগলো নিজেকে। এই বুক তার, সম্পূর্ণ তার। সে কখনোই ছাড়বে না এই অধিকার।
“এলি, এলি।” আবারো ডাকলো সুলতান।
“শুনছি সুলতান, বলুন।” শীতল স্বরেই বলল বেগম।
কিছুই বলল না সুলতান। বরং নিজের হাতটা ধীরে ধীরে বেগমের পেটের উপর রাখলো। আদুরে হাতে বুলালো কিছুক্ষণ। পেটের মাঝ বরাবর হাতটা ঠেকতেই নিজের হাত বাড়িয়ে হাতটা সেখানেই চেপে ধরলো বেগম। মাথা তুলে তাকালো সুলতানের মুখের পানে। মুগ্ধকর দৃষ্টিতে তখনও চেয়ে আছে সুলতান। কাটা কাটা কন্ঠে বলে উঠলো, “মহলে আরো একজন সদস্য বাড়তে চলেছে অথচ তুমি আমাকে আজ জানাচ্ছো সেকথা। এটা অন্যায় এলি। তোমার কারনে আমি নতুন সদস্যকে অনুভব করতে পারিনি এতোদিন। আমার প্রতি বড্ড নিষ্ঠুর তোমার হৃদয়।”
মুচকি হাসলেও তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর দিলো না বেগম। সুলতান পুনরায় বলল, “সুলতানের প্রতি অবিচার! নির্দয় সম্রাজ্ঞী।”
কিছু বলার উদ্দেশ্যে বুক ছেড়ে সরে আসলো বেগম। আকস্মাৎ তার ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো আত্মচিৎকার। বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সুলতানকে। মাটিতে আছড়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো সুলতান। বিস্মিত নয়নে চাইল বেগমের দিকে। সবুজ পাহাড় ফ্যাকাশে হলো বুঝি এক নিমেষে। অদূরে পাহাড়ের কোনো এক কোনা থেকে বিদ্যুত বেগে ছুটে এলো ধারাল তিরের ফলা। সুলতানের শরীরে গাঁথার উদ্দেশ্য থাকলেও বেগমের কারনে পথভ্রষ্ট হলো। সুলতানের পরিবর্তে সজোরে গেঁথে গেল বেগমের বাম বাহুতে। মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয় শরীরে। পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে কম্পণ সামলাতে ব্যর্থ হলো বেগম। পা পিছলে যায় নিচে। সুউচ্চ পাহাড়ের খাদ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। আগলে নিতে চাইছে দূর্গম বুকে। তাল হারিয়ে তির সমেত নিচে পড়ছে বেগম। হতবাক হওয়ার সুযোগ পায়নি সুলতান। ছুটে এসে মাটিতে আছড়ে পড়ে হাত আকড়ে ধরলো বেগমের। চিৎকার করলো গলা ফাটিয়ে, “এলি।”
উক্ত চিত্র পছন্দ হলো না পাহাড়ের অপর প্রান্তে তির-ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানবমূর্তির। বেগমের স্থানে সে সুলতানকে দেখতে চেয়েছিল। লক্ষ বিচ্যুত হওয়ায় রাগে ফেটে পড়লো। সুলতানকে বাঁচাতে বেগমের এই হাল মোটেই ভালো লাগলো না তার। হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে খানিক এগিয়ে এসে দাঁড়ালো গাছের আড়ালে। আবারো তির ছুড়ল শায়িত সুলতানের উদ্দেশ্যে। সঠিক নিশানায় ছুটল তির। গাঁথলো সুলতানের পিঠের মাঝে। ব্যথায় মুখভঙ্গি বিকৃত হয় সুলতানের। ছাড়লো না বেগমের হাত। শক্ত করে চেপে ধরে উত্তেজিত গলায় জাহির করলো, “হাত শক্ত করে ধরে উপরে উঠে এসো এলি।”
“সুলতান।”
অপর হাতটাও এনে সুলতানের হাত আকড়ে ধরলো বেগম। তখনই আরো একটা তির এসে গাথঁলো সুলতানের শরীরে। বেগমকে ধরে থাকা হাতটা খানিক আলগা হয়ে এলো ব্যথার যন্ত্রণায়। ততক্ষণাৎ নিজেকে সংবরণ করে হাতের বন্ধন মজবুত করলো সুলতান। সেসময় পরপর আরো দুটো তির এসে বিধল তার শরীরে। দু’চোখ বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সুলতান। অসীম যন্ত্রণার মাঝেও টেনে ধরে রেখেছে বেগমকে। আবারো বলল, “আমার হাত শক্ত করে ধরো এলি।”
“সুলতান।”
“ধরে রাখো এলি।”
টেনে ধরে উপরে উঠানোর চেষ্টা করছে সুলতান। কিন্তু আহত শরীরের শক্তি নিয়ে কুলিয়ে উঠছে না যেন শেষ পর্যন্ত। যন্ত্রণায় মুষড়ে যাচ্ছে তার শরীর। চারটি ধারাল তির শরীরে নিয়েও সে উতলা হয়ে আছে বেগমের জন্য। তখনই আরো একটা তির ছুটে এসে বিঁধে গেল শরীর চিরে। না চাইতেও আর্তনাদ করে উঠলো সুলতান। হাত ফসকে পড়ে যেতে ধরলো বেগম। আরো খানিক ঝুঁকে এসে আটকালো সুলতান। বারংবার বেগমকে টেনে উপরে ওঠানোর চেষ্টা যতই করছে সে। ততই তির এসে বিধছে তার শরীরে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের শত্রুকে দেখার সুযোগও যে নেই তার। একদিকে শত্রু অপরদিকে নিজের প্রেয়সীর হাত। এই হাত তার নিকট সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। শত্রুর মুখ দর্শনের চেয়েও। বুঝতে বাকি নেই এই সেই অজানা শত্রু। তবুও সেদিকে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করছে না সুলতান। টেনে উঠাতে চাইছে শুধু বেগমকে। এক সময় সুলতানের ব্যথাতুর মুখভঙ্গি সহ্য করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয় বেগম। অসহায় কন্ঠে বলল, “আমার হাত ছেড়ে দিন সুলতান। এভাবে তির বিধতে থাকলে আপনি যে বাঁচবেন না।”
“তোমাকে ছাড়া আমি এমনিও বাঁচতে চাই না। যেখানে শুধু তোমার হাত ছাড়তেই আমার হৃদয়ের মৃ’ত্যু হতো সেখানে তোমাদের দু’জনকে একসাথে কী করে ছেড়ে দিই?”
ততক্ষণাৎ আবারো তির বিধল তার শরীরে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সুলতান। মুখভঙ্গি বেগমের চিন্তায় কাতর। চিৎকার করলো বেগম, “ছাড়ুন সুলতান। আমার হাত ছেড়ে দিন। আপনার উপর পুরো সাম্রাজ্য নির্ভর করে। এমন অবুঝ হবেন না।”
“পরোয়া করি না আমি।”
দৃঢ় কন্ঠে কথাখানা বলে ফেলল সুলতান। শরীরের রক্তে জমিন ভিজে চুপচুপে। খেয়াল নেই তার। আবারো তির এসে বিধতেই মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো তার। সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে যন্ত্রণা। এবার আর সুলতানের বারন শুনলো না বেগম। নিজেই ছেড়ে দিলো সুলতানকে। কিন্তু ছাড়েনি সুলতান। বেগম একাধারে টেনে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে তার হাত। এভাবে চলতে থাকলে সে বেঁচে গেলেও রক্তক্ষরণে ম’রে যাবে তার সুলতান। সুলতানের জীবনের বিনিময়ে জীবন চায় না তার। উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠলো সুলতান, “খবরদার এলি। হাত ছাড়বে না।”
“আমাকে ছাড়ুন। শত্রুকে শেষ করুন। যার কারনে ভালো নেই রামান সাম্রাজ্য তাকে শেষ করে দিন সুলতান।”
তখনও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বেগম। অতিশয় উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সুলতান। যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে শরীরটাও কাঁপছে বেগমের মৃ’ত্যুভয়ে। হাতের বন্ধন শক্ত করে চিৎকার করে উঠলো সহসাই, “হাত ছেড়ো না এলি। কেন এমন করছো? উঠে এসো। আমাকে ধরে উঠে এসো। বিশ্বাস করো, কিছুই হবে না আমার। এমন করে না পাখি।”
“ছাড়ুন আমাকে। আবারো পালিয়ে যাবে রামান সাম্রাজ্যের গুপ্ত শত্রু। এত কাছে পেয়েও তাকে ছেড়ে দিলে কেমন সুলতান আপনি?”
“পাগল হয়ে গেছো তুমি? তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আমি শত্রু ধরতে যাবো? হাত ধরো বলছি। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। ধংস করে দেব আমি সবকিছু।” আক্রোশে গর্জে উঠছে সুলতান।
“নিজের শরীরের অবস্থা দেখেছেন? এভাবে চলতে থাকলে আমরা দু’জনেই মা’রা যাবো। তারচেয়ে বরং কোনো একজন অন্তত বেঁচে থাকুক। ছেড়ে দিন সুলতান। আমার দোহাই লাগে ছেড়ে দিন।”
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চাইল সুলতান। ভয় ধরলো মনে। উঁহু, নিজের মৃ’ত্যুর ভয় নয়। বেগমের মৃ’ত্যুর ভয়। সে যদি এখন এভাবে মা’রা যায়। বেগমকে কীভাবে উঠাবে তবে। কী করে বাঁচাবে সে? উন্মাদ হয়ে উঠছে সে। হন্তদন্ত হয়ে বেগমকে টেনে উঠাতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, “এলি, এলি আমার কথা শোনো। কারোর কিছু হবে না। তুমি উঠে এসো দ্রুত। ধরো না আমার হাতটা? ধরো।”
খেই হারালো বেগম। ডুকরে কেঁদে উঠলো হঠাৎই। অসহায় চোখে কী নিদারুণ কষ্ট! কাতর কন্ঠ আরোও করুন হলো, “ছেড়ে দিন সুলতান। এভাবে বলবেন না। আমি জানি এভাবে চললে আমরা কেউই বাঁচব না। আপনি মিথ্যে বলে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিতে চাইছেন। তা আমি কখনোই হতে দেবো না।”
“ছছাড়বে না এলি। ধরে থাকো।”
“ক্ষমা করে দিন সুলতান। আপনার এই কথা রাখা হবেনা আমার।”
একদিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়ছে সুলতান। অপরদিকে হাত ছাড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বেগম। বিরক্ত অজানা মানবমূর্তি। কোথায় সুলতানের মৃ’ত্যু দেখবে তা না বেগমের মৃ’ত্যু দেখতে হচ্ছে। হঠাৎই হ্যাঁচকা টানে বেগমকে টেনে উপরে উঠিয়ে আনে সুলতান। শেষ শক্তিটুকুও ব্যায় করে এলিয়ে পড়েছে সে। খুব বেশিই ঘাবড়ে গেছে বেগম। জোরে জোরে শ্বাস টানছে সুলতান। আৎকে উঠে বেগম নিজের হাতের তির টেনে তুলে ছুড়ে মারে অদূরে। হন্তদন্ত হয়ে আঁকড়ে ধরে সুলতানকে। ক্রন্দনরত কন্ঠে বারবার ডাকে, “সসুলতান, সুলতান তাকান আমার দিকে।”
সময় ফুরিয়ে এসেছে সুলতানের। চোখ উল্টে যাচ্ছে। শ্বাস ভারী হয়েছে। সে ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে মৃ’ত্যু তার সন্নিকটে। অনিবার্য মৃ’ত্যুকে হার মানানোর সাধ্য তার নেই। সুলতানের রক্তে ভেসে যাচ্ছে বেগমের গাউন। ভয়ে কন্ঠস্বর হারিয়েছে যেন বেগম। কয়েকবার চেষ্টা করেও উচ্চারণ করতে পারলো না একটি শব্দও। মৃদু হাসলো সুলতান। দু’হাতে তার মুখটা আগলে ধরে শেষ সময়ে এসেও আওড়ালো, “আমায় ভুলে যেও না যেন। তোমার জন্য আবারো অপেক্ষা করবো আমি অনন্তকাল ধরে।”
কান্না ব্যতীত একটা শব্দও বলতে অক্ষম বেগম। এমন দৃশ্য কোনোদিন তাকে দেখতে হবে সেই ধারনা মনেও আসেনি কোনোদিন। কেন সে বাঁচাতে পারছে না তার সুলতানকে? কী করে বাঁচাবে। রামান সাম্রাজ্য যে বহু দূরে। পার্শ্ব সাম্রাজ্যেও চিকিৎসা সম্ভব নয়। যুদ্ধে ধংস হয়ে গেছে এখানের সমস্ত ব্যবস্থা। রক্তাক্ত হাতটা বেগমের পেটে আলতো করে রাখলো সুলতান। অধর প্রসারিত করেই বলল, “এলি, তাকে জানিয়ে দিও তার পিতার বড্ড আশা ছিলো তাকে দেখার। তুমি, তুমি ভালো থেকো আমার বাঘিনী। রামান সাম্রাজ্যের জন্য তাদের সম্রাজ্ঞীকে রেখে গেলাম আমি। শুধু তোমার জন্যই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। তোহফা, তোহফফফ………”
সুলতানের চোখদুটো চিরতরে বন্ধ হতেই গগণ কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো বেগম। অসাড় হয়ে ঢলে পড়লো সুলতানের পাশেই। গম্ভীর প্রকৃতি সাদরে গ্রহন করে নিলো খোলা প্রান্তরে শায়িত দুটি অসাড় শরীর।
চলবে……..
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_42
ভয়াবহ যুদ্ধের পর কেটে গেছে আরো বেশ কয়েকটা মাস। সময়ের কাটা থেমে নেই কারোর অনুপস্থিতিতে। মাত্র কিছু মাসের ব্যবধানে পাল্টেছে অনেক কিছুই। ঠিক নেই ভালোবাসার সমীকরণ। ক্ষমতা আর দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে গেছে সম্রাজ্ঞীর হাহাকার। বিগত কয়েক মাসে যেন রামান সাম্রাজ্যের রং-রূপই বদলে গেছে। যেই সাম্রাজ্যের কোথাও নেই সুলতান শাহজাইনের অস্তিত্ব। যেহেতু সুলতানের ছোট্ট অস্তিত্ব রয়েছে বেগমের গর্ভে তাই ওয়াসিফা সুলতানের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সম্রাজ্ঞীর উপর। বিনাবাক্যে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাসী। বর্তমানে রামান সাম্রাজ্যের শাসক কোনো সুলতান নয় বরং একজন সম্রাজ্ঞীর কাঁধে ভর করেই টিঁকে আছে এই বিশাল সাম্রাজ্য। সম্রাজ্ঞী এলিজার বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা আর বৈষম্যহীন বিচারকার্যে মুগ্ধ সাম্রাজ্যবাসী। আনাচে-কানাচে শুধু তারই প্রশংসাধ্বনি উচ্চারিত হয়। তবুও দিনশেষে সকলের মনে একটা আক্ষেপ থেকেই যায়,
“নেই সুলতান শাহজাইন শাহ। কোথাও নেই। যুদ্ধের ময়দান থেকে আর নিজ সাম্রাজ্যে ফেরেনি সে। সাম্রাজ্যজুড়ে ঘোষণা করা হয়েছে তার মৃত্যুসংবাদ। যুদ্ধ শেষে অজানা শত্রুর প্রাণঘাতী আক্রমণে প্রাণ ত্যাগ করেছে সে। তার মৃতদেহটাও নসীব হলো না সাম্রাজ্যবাসীর কপালে! হায় আফসোস! মৃতদেহটাও ঢলে পড়েছে পাহাড়ের অতল গহ্বরে। এতটাই নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হলো তাদের সুলতানকে!”
মহলে বরাবরের মতোই গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। সুলতানহীন বিশাল মহল যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নিজের মাঝে হাজার ষড়যন্ত্র বিলীন করে। সম্রাজ্ঞীর উচ্চ আসনে বসে আছে এলিজা সুলতান। দাম্ভিকতা তার নয়নে নয়নে। সফেদ তাজ নিজের ক্ষমতার জোর খাটাচ্ছে কালো হিজাবটার উপরে। সমান পেটটা সামান্য উঁচু হয়েছে যা ঢোলাঢালা গাউনের উপর দিয়ে খুব একটা ঠাহর করা যাচ্ছে না। পাশেই তলোয়ার হাতে সটান দাঁড়িয়ে আছে আজমাইন মাহতাব। সম্রাজ্ঞীর প্রধান দেহরক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে তাকে। সবসময়ের মতোই নিজের দায়িত্ব নেভাতে তৎপর সে। রাজ সভার নীরবতা ভেঙে গম্ভীর গলায় সৈনিকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ছেন এলিজা সুলতান, “মহলের প্রতিটা কামরার সম্মুখে নতুন সেনা নিযুক্ত করা হয়েছে?”
এগিয়ে এলো একজন সৈনিক। মস্তক নুইয়ে বলল, “জ্বী মহামান্য।”
“প্রধান ফটকের দ্বার নতুন করে তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে?”
“জ্বী, আপনার হুকুম মতোই সবকিছু করা হয়েছে।”
সবকিছু তার হুকুম মাফিক করা হলেও সন্তুষ্ট হতে দেখা গেল না বেগমকে। এবার মাহতাবের দিকে নজর ফেলল সে। কন্ঠের গম্ভীরতা বজায় রেখেই বলল,
“আমার অনুমতি ব্যতীত মহলের একটা প্রাণীও যেন প্রধান ফটকের ওপারে না যায়। সেই সাথে বাইরের কেউও ভেতরে আসবে না। নাতো ভেতরের কেউ বাইরে যাবে আর নাতো বাইরের কেউ ভেতরে আসবে। কেউ না মানে কেউ না। এদিকটা তুমি নজর রাখবে মাহতাব।”
সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো মাহতাব। এতক্ষণ যেন সে হুকুমের অপেক্ষাতেই ছিলো। নম্র কন্ঠে বলে উঠলো, “অবশ্যই সুলতানা।”
আলোচনা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো বেগম। বৈঠকখানা ছেড়ে প্রস্থান করতে গিয়েও আবার কী ভেবে থেমে গেল। মস্তক ঘুরিয়ে আবারো বলে উঠলো, “আমার হুকুম ব্যতীত মহলের একটা খাদ্যের দানাও যেন এদিক থেকে ওদিক না হয়। কতটা নিষ্ঠুর হতে পারি আমি তার প্রমাণ নিশ্চয়ই এতদিনে পেয়ে গেছো তোমরা? আমার আদেশের বাইরে গেলে তার শাস্তি হবে শুধুই মৃত্যুদণ্ড। কথাগুলো যতক্ষণ মাথায় গেঁথে রাখবে ততক্ষণই জীবিত থাকতে পারবে আমার মহলে।”
বক্তব্য সম্পূর্ণ করেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সে। এতোক্ষনে যেন সস্তির শ্বাস ফেলল সৈনিকগণ। শ্বাস যেন আটকে ছিলো বেগমের উপস্থিতিতে। গত কয়েক মাসে বেগমের যে রূপ দেখেছে তারা এই রূপের সঙ্গে তারা একেবারেই অপরিচিত। পান থেকে চুন খসলেই শাস্তি পেতে হচ্ছে এই মহলে। এমনকি রন্ধনশালাতেও সৈনিক নিযুক্ত করেছেন তিনি। জানালা, দ্বার সবকিছু নতুন আর পূর্বের তুলনায় বহুগুণ মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে অজানা শত্রুর আক্রমণের ভয়ে। এই মহলের প্রতিটা মানুষ ভয়ে ভয়ে কাজ করে। রাজ পরিবারের সদস্যরাও বিরক্ত বেগমের হুকুম নামক জোর জবরদস্তিতে। সুলতান শাহজিল, যে কিনা সাবেক সুলতান এই সাম্রাজ্যের। তাকেও মহলের বাইরে যেতে হলে বেগমের দ্বারস্থ হতে হয়। যার যার নির্ধারিত কামরা ব্যতীত কোথাও স্বাধীন নয় তারা। যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসার পর থেকেই পুরোপুরি বদলে গেছে বেগম। সাম্রাজ্যবাসীর উপর এর বিন্দুমাত্র প্রভাব না পড়লেও ক্ষণে ক্ষণে পুড়তে হচ্ছে মহলবাসীকে। মহলের অধিকাংশ মানুষের ধারনা ক্ষমতার লোভে সুলতানকে নিজেই হত্যা করেছে বেগম। তবে এ কথা শুধু চাপা গুঞ্জন হয়েই রয়ে গেছে মহলের চার দেয়ালের আড়ালে। বেগমের গর্ভে সুলতানের সন্তান বেড়ে উঠছে জানার পর থেকেই ওয়াসিফা সুলতান বেগমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। সেখানে তারা কী বলতে পারে?
বৈঠকখানা ত্যাগ করে সামান্য এগোতেই বোনের দেখা পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলো জারনাব। নরম স্বরে আওড়ালো, “জোভিয়া।”
“বুবু!”
খানিক চমকাল বেগম। ততক্ষণাৎ নিজেকে সংবরণ করে পুনরায় কঠিন কন্ঠে জাহির করলো,
“তুমি এখানে? কিছু বলবে?”
“আমার একটু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন। আমাদের গৃহ থেকে আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনার ছিল।”
“এখন বাইরে যাওয়া যাবে না। যা যা প্রয়োজন তার একটা তালিকা তৈরি করে রেখো। আনিয়ে দেবো আমি। এখন কামরায় যাও।”
কথা সম্পূর্ণ করার মাঝে একটাবার বোনের দিকে তাকালো না পর্যন্ত বেগম। অন্য দিকে দৃষ্টি রেখে সহসাই বাক্য সম্পূর্ণ করলো সে। বোনের এরূপ আচরন বিগত কয়েক মাস যাবত দেখতে দেখতে খানিকটা সয়ে গেছে জারনাবের। তবুও যেন মনোক্ষুন্ন হলো খানিকটা। কন্ঠে খানিক জোর এনে আবারো বলল, “কিন্তু জোভিয়া……..”
“আমি তোমাকে কামরায় যেতে বলেছি।”
এবার খানিক উচ্চস্বরেই বলল বেগম। ঘাবড়ে গেল জারনাব। যতটুকু সাহস সঞ্চয় করেছিল সব যেন মুহুর্তেই হাওয়ায় উবে গেল। তাকে উপেক্ষা করে চলে গেল বেগম। অবাক চোখে ঠাই দাঁড়িয়ে রইল জারনাব। কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার হিসেব নেই।
“জুঁই।”
হঠাৎ মাহতাবের ডাকে ধ্যান ফিরল তার। এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মাঝে ছিল সে। ততক্ষণাৎ এগিয়ে আসে মাহতাবের দিকে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“আজমাইন, তুমি অন্তত আমাকে যেতে দাও। জানিনা জোভিয়ার কী হয়েছে। আমাকে বেরোতেই দিচ্ছে না। কেন যে এমন হয়ে গেল আমার বোনটা। খোদা জানেন, যুদ্ধের ময়দানে কী এমন ঘটেছিল যে এতটা বদলে দিয়েছে আমার বোনটাকে! সুলতানের অকাল মৃত্যুই কি তাকে এমন নিষ্ঠুর করে তুলেছে?”
সুলতানের মৃত্যুর কথা বলতে বলতেই চোখদুটো ছলছল করে উঠলো জারনাবের। কিঞ্চিত ব্যথা ফুটে উঠলো নেত্রযুগলে। তার সাহাদও তো এভাবেই অকালে ছেড়ে গিয়েছিল তাকে। একলা করে দিয়েছিল তাকে। আজ কয়েক বর্ষ পরে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো জোভিয়ার সাথেও। সুলতানও চলে গেল তার বোনটাকে ছেড়ে। ভালোবাসারা কেন এতো দ্রুত সুখময় দিনগুলোর সমাপ্তি টেনে দেয়? সেসময় গলা খাকারি দিলো মাহতাব। সে যেন সুলতানের কথা ভেবেই শোকে মূর্ছা গেল । আক্রোশবিহীন বীরের সেই দুই নয়ন শুধুই শোকের বাহক। ব্যথিত স্বরে বলল,
“সুলতান আর নেই! জানো জুঁই, একথা আমি মানতেই পারি না। এই দুঃস্বপ্ন যেন আর ফুরাবার নয়।”
আনমনা হলো মাহতাব। বিষাদ তাকে ঘিরে ধরেছে যেন আষ্টেপিষ্টে। পুনরায় ভেসে এলো জারনাবের কাতর কন্ঠ, “আমার জন্যই বোধহয় এমন হলো। ভাগ্য খারাপ আমার। বোনটার কপালও বুঝি পুড়ালাম! নাহলে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! আজও সাহাদের মৃত্যু শোক বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আমার জোভিয়া কী করে বাঁচবে সুলতানকে ছাড়া? কী করে সহ্য করবে এই দহন?”
সাহাদের কথা তুলতেই তিক্ততা ভর করলো মাহতাবের ভঙ্গিমায়। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
“এসব কিছুই নয়। তুমি অযথা নিজেকে দোষারোপ করো না। ভাগ্যের লিখন কেউ খন্ডাতে পারে না। এটাই হয়তো লেখা ছিলো।”
“সান্ত্বনা দিচ্ছ আজমাইন?”
“না, মনের ভাব প্রকাশ করেছি মাত্র।”
“মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে আমি সম্পূর্ণ চিনতেই পারিনি এখনো। এই অহেতু ভাবনার কী ব্যাখ্যা আছে বলোতো?”
আনমনে প্রশ্ন ছুড়ল জারনাব। পূর্ণ দৃষ্টিতে তার কাজল কালো নয়নজোরা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে মাহতাব। অথচ এই নয়নের সমস্ত ব্যথা সাহাদের জন্য, তার জন্য নয়। হঠাৎ তাচ্ছিল্যের দেখা মিলল তার অধরকোনে। ক্ষীণ হেসে অবলীলায় বলে উঠলো,
“সত্যিই বলেছো বটে। তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। এই আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার নিকট অচেনা হয়েই থাকতে চাই জুঁই।”
“কেন?”
তীক্ষ্ম চোখে চাইল জারনাব।
“না এমনিই। যাও, কামরায় যাও।” তড়িঘড়ি জবাব মাহতাবের।
“কিন্তু আমি একটু বাইরে যেতে চাই। তুমি দয়া করে আমাকে সাহায্য করো।”
অনুরোধ করলো জারনাব। বীরের মন গলল না তার অনুরোধে। নিজের দায়িত্ব থেকে পিছু হটার পাত্র নয় মাহতাব। ভালোবাসার মানুষের অনুরোধেও নয়। সে কঠোর স্বরে আওড়ালো,
“ফিরে যাও জুঁই। কারোর বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। মেহেরবানি করে আমাকে তোমার সাথে কঠোর হতে বাধ্য করো না।”
চটে গেল জারনাব। আচমকা তিক্ত হতে শুরু করলো তার মুখভঙ্গি। ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো, “কী শুরু করেছো তোমরা এসব? বাইরে কেন যেতে দিচ্ছ না আমাকে? আমি কি শত্রু নাকি তোমাদের? এভাবে গৃহবন্দি হয়ে কতদিন থাকা যায়?”
হুট করে এভাবে রেগে যাওয়াতে খানিকটা অবাক হলো মাহতাব। জুঁইয়ের ব্যবহার কেমন যেন অদ্ভুত লাগে তার নিকট। সাহাদের শোকে হয়তোবা! কিন্তু এভাবেই চলতে থাকলে নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা কখনোই হবে না তার। এমনিতেও সে নিশ্চিত বহিঃপ্রকাশ করেও কিছু লাভ হবে না। জুঁই কখনোই তার হবে না। একরাশ হতাশার দেখা মিলল বীরের নয়নে। তখনই আবার বেগমের গম্ভীর কন্ঠ পেয়ে সাথে সাথেই মস্তক নুইয়ে নিলো সে। বেগমের সামনে মস্তক উঁচু করে থাকলেই যে তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত করা হবে। শাস্তিতে সে ভয় পায় না। তবে সুলতানের রেখে যাওয়া অমূল্য এই সম্পদের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা তার নেই।
“আজকাল অযথায় বড্ড রেগে যাচ্ছ বুবু। এতো তাড়া কেন বাইরে যাওয়ার? কোনো বিশেষ কারণ?”
বেগমের কন্ঠ পেয়ে মিইয়ে গেল জারনাব। বোনের গম্ভীর কন্ঠকে তোয়াক্কা না করেই বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা আওড়াতে আওড়াতে ছুটলো নিজের কামরার দিকে। জোভিয়াটা আজকাল নজরদারি শুরু করেছে নাকি সবার উপর? তার সাথে মন খুলে দুটো কথা বলাও দায় হয়ে উঠেছে। জোভিয়ার গর্ভে নতুন অতিথি আসতে চলেছে কিন্তু মেয়েটার কোনো খেয়ালই নেই। এ সময়টায় সুলতানের ওর পাশে থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরী ছিল। হায় আল্লাহ! সহায় হও।
“তোমার প্রণয় যেন তোমার কর্মে হস্তক্ষেপ করতে না পারে মাহতাব। সতর্ক থেকো।”
বেগমের কথায় খানিকটা চমকে উঠলো মাহতাব। প্রণয়! তবে কি সুলতানা জানে তার মনের কথা? জুঁইকে ভালোবাসে একথা তো কাউকেই বলেনি সে এ পর্যন্ত। অবাকের চরম সীমায় পৌঁছাল যেন।
অন্যদিকে ওয়াসিফা সুলতানের কামরায় চলছে বিরাট তর্ক-বিতর্ক। সুলতান শাহজিল এক প্রকার মহা বিরক্ত এলিজা সুলতানের উপর। সে ভেবেই পায় না। এই মেয়ের এতো সাহস যে তার উপর হুকুম চালায়! রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ওয়াসিফা সুলতানের উপর চিৎকার করছে সে,
“সারাজীবন তোমার কথা শুনে চলে অনেক ভুল করেছি আমি। তা বলে শেষ বয়সে এসে কিনা এসব সহ্য করতে হবে? কী ভেবে তুমি ওকে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে দিলে ওয়াসিফা? শুধুমাত্র উত্তরাধিকারের জন্য? পুত্র সন্তান তো নাও হতে পারে? তখন কী হবে? সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার আনতে গিয়ে নিজ পুত্রের হত্যাকারীকে আপ্যায়ন করছো তুমি! ছি!”
স্বামীর উপর কথা বলার ইচ্ছা নেই বোধহয় ওয়াসিফা সুলতানের। নীরবে জানালার পর্দা সরিয়ে অদূরে চেয়ে থাকলো অনিমেষ। বাক্য বিনিময় করার খুব একটা প্রয়াস নেই। অঙ্গভঙ্গি অন্তত শীতল। নয়নজোরা পুত্রশোকে কাতর। হাজার কঠোর হোক, দিনশেষে একজন মা সে। সাম্রাজ্যের প্রতি যেমন তার দায়িত্ব রয়েছে তেমনি বুকভরা ভালোবাসা রয়েছে একমাত্র পুত্র শাহজাইনের জন্য। সুলতান শাহজিল পুনরায় বলে উঠলো,
“কী হলো? কিছু বলছো না কেন? কতদিন এভাবে চুপ করে থাকবে? তোমার কারনে মহলের আজ এই হাল আর তুমি কিনা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো গত কয়েকটা মাস ধরে।”
এবারও নিশ্চুপ ওয়াসিফা সুলতান। কথোপকথন আগানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। যেন আজন্মকাল এভাবেই চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। স্ত্রীর এহেন অস্বাভাবিক আচরণে রাগে ফেটে পড়লেন সুলতান শাহজিল। উচ্চস্বরে বললেন,
“নিজের একমাত্র পুত্রের করুণ মৃত্যুর শোক বড্ড কম তোমার ওয়াসিফা। যেখানে আমার গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে সেখানে তুমি মা হয়ে কীভাবে পারো চুপ থাকতে? তোমার কি মনে হয়না ঐ মেয়ে ক্ষমতার লোভে নিজেই হত্যা করেছে শাহজাইনকে?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বললেন, “কিছু বলো ওয়াসিফা? এভাবে চুপ করে থাকার মানেটা কী?”
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরেও স্ত্রীর নীরবতা ভাঙাতে ব্যর্থ হয়ে রাগান্বিত অবস্থায় কামরা ত্যাগ করলেন সুলতান শাহজিল। কয়েক মাসে কম তো চেষ্টা করেনি স্ত্রীর নীরবতা ভাঙাতে। আর কত? পুত্রশোক স্তব্ধ করে দিয়েছে যেন ওয়াসিফাকে। অপরদিকে যে নারী সদ্য স্বামীহারা হয়েছে সে দিব্বি স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। যখন ইচ্ছা নিজের হুকুম প্রণয়ন করছে মহলবাসীর উপর। ক্ষমতা বিস্তার করছে সাম্রাজ্য জুড়ে। স্বামীর মৃত্যুতে যেন তার কিছুই যায় আসে না। শুধুমাত্র এলিজার গর্ভে এই সাম্রাজ্যের নতুন উত্তরাধিকারী আসছে বলে সে এসব সহ্য করছে মুখ বুজে।
সারাদিনের ঝঞ্ঝাটের মধ্য দিয়ে কেটে গেল আরো একটা মায়াহীন দিন। রাত নেমেছে নিজের বক্ষে আঁধার ধারণ করে। মহলের পরিবেশ তখনও নির্জীব। সকলে ভয়ে ভয়ে নিজ নিজ কর্ম সম্পাদন করছে। বেগমের কামরার চিত্র অবশ্য বড়ই সুন্দর। শেহজাদি তোহফা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। বেগমও পরম যত্নে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কন্যার মাথায়। ঘুমে তোহফার চোখ প্রায়ই বন্ধ হয়ে এসেছিল। ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে গিয়েও আবার চোখ পিটপিট করে তাকালো মায়ের দিকে। আলতো কন্ঠে ডাকলো, “আম্মু।”
তোহফার ডাকে বেগমের অধর খানিকটা প্রসারিত হলেও হাসলেন না তিনি। কোমল কন্ঠে শুধাল,
“তুমি ঘুমাওনি?”
“উঁহু।” বড্ড নিষ্পাপ উত্তর তোহফার।
“কেন আম্মুজান? ঘুম আসছে না?”
“আব্বু….. আব্বুর কাছে যাবো।”
নিছকই আদুরে আবদার তোহফার। অথচ মিলিয়ে গেল বেগমের প্রসারিত অধরের বিস্তৃতি। মাথায় অবিরত বুলিয়ে দেওয়া হাতটা থেমে গেল হুট করেই। পরক্ষণেই কোমল কন্ঠে বলে উঠল, “আব্বু তো এখন এখানে নেই আম্মুজান।”
“কেন আসে না আব্বু?”
“আসবে সোনা। তুমি ঘুমালেই আসবে।”
“আব্বু কি আমাদের ভুলে গেছে?”
কন্যার বারংবার প্রশ্নে দ্বিধায় পড়লো বেগম। রোজ রোজ এই একই প্রশ্ন করে তোহফা। বারবার কীভাবে মিথ্যা বলবে সে মেয়ের কাছে? তোহফা পুনরায় অভিমানী কন্ঠে আওড়ালো,
“আব্বু আর ভালোবাসে না আমাকে। তোমাকেও না।”
“বাসে সোনা। আব্বু তোমাকে অনেক ভালোবাসে।” বোঝানোর চেষ্টা করলেন বেগম।
“আর তোমাকে?”
“আআআমাকে?” কন্ঠে টান পড়লো বেগমের। বেঁধে যাচ্ছে উচ্চারিত শব্দ।
“আব্বু পচাঁ। খুব পচাঁ। তোমাকেও ভালোবাসে না, আমাকেও না। তুমিও আমার মতো আড়ি করে দেবে আব্বুর সাথে। ঠিক আছে?”
অধর ফুলিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছে যেন ছোট্ট সম্রাজ্ঞী। মেয়েকে বুকের সাথে আগলে ধরলেন বেগম। সূক্ষ্ম গলায় বলল, “তুমি এখন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো। তারপর সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখবে। সেই স্বপ্নে তোমার আব্বুজানও থাকবে।”
“সত্যিই থাকবে?” জিজ্ঞাসু স্বর তোহফার।
“হ্যাঁ, থাকবে তো।”
খানিকটা থামলো বেগম। অতঃপর পুনরায় আনমনে আওড়ালো,
“সুলতান দেখা করতে আসবে আমার শেহজাদির সাথে। সে আসবে তোমার স্বপ্ন হয়ে, বড় রঙিন সেই স্বপ্ন।”
চলবে……..