সম্রাজ্ঞী পর্ব-৪৫+৪৬

0
222

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_45

ভরা রাজ দরবার কিছুক্ষণের জন্য কিঞ্চিত অবাক হয়েছে হুট করে কারোর আগমনে। এভাবে বেগমের কাজের মধ্যে কথা বলে ব্যাঘাত ঘটানোতে রাগান্বিতও হয়েছে খানিকটা। দ্বার বরাবর দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। নীরবতা ভেঙে বেগম বলে উঠলো,

“বণিক!”

“আমাকে চিনতে পেরেছে তাহলে সম্রাজ্ঞী। কী সৌভাগ্য আমার!”

বলতে বলতে দ্বার ঠেলে ভেতরে এগিয়ে আসে আবরার জাওয়াদ। মাথার সফেদ টুপিখানা পূর্বের মতোই মাধুর্য ছড়াচ্ছে। তার কথার সুর ভালো ঠেকল না বোধহয় কারোর নিকট। বেগমের সাথে এভাবে কথা! এতো রীতিমতো অভদ্রতা! সম্রাজ্ঞীর অসম্মান! মাহতাব রেগেমেগে এগিয়ে গিয়ে তলোয়ার তুলে শাসিয়ে উঠে,

“খবরদার! সুলতানার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলো। পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি তুমি?”

“খারাপ কী বললাম আমি? শুধু শুধু এভাবে রেগে যাওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।” অবাক হওয়ার ভান ধরলো বণিক।

তার এহেন আচরণে কিঞ্চিত বিরক্ত হলো বেগম। তীক্ষ্ম কন্ঠে বলে উঠলো, “কী চাই? কেন এসেছেন? পার্শ্ব সাম্রাজ্য ধংসের পর তো মহল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আপনি। তাহলে আজ আবার কেন এসেছেন?”

“মহল ছেড়েছি, প্রণয় নয়। যাকগে সেকথা, এসেছি আমি অন্য কারনে। শুনলাম লেখনী পরিক্ষা করা হচ্ছে। আমিও তো দীর্ঘদিন এই মহলে ছিলাম। তাই ভাবলাম লেখনীটা নিজ দায়িত্বেই দিয়ে আসি।”

“লেখনী?” অবাক হয়ে শুধাল বেগম।

“হ্যাঁ, লেখনী।”

“প্রয়োজন নেই আপনার লেখনীর। এখানে শুধু বর্তমান সময়ে যারা মহলে আছে তাদের লেখনীই সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেতে পারেন আপনি।”

দু’কদম এগিয়ে এলো বণিক। অধরকোনে কোথাও যেন সূক্ষ্ম বিদ্রুপ দেখা দিলো। চিরপরিচিত শুকনো হাসি হেসে বলল, “কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা উচিত নয় সম্রাজ্ঞী। আপনার তো জানার কথা, কাছের মানুষ ধোঁকা দেয় বেশি।”

“কাছের মানুষ?” শুধাল বেগম।

“মানে আমি বলতে চাচ্ছি শত্রু না ধরা পড়া পর্যন্ত সকলকেই সন্দেহের আওতায় রাখা উচিত। বলা তো যায় না, কার মনে কী আছে।” মৃদু হেসে বলে উঠলো বণিক। রহস্য ছিলো যেন সেই হাসিতে।

“ঠিক আছে। এখানে একখানা পত্র লিখে রেখে যান।” দ্রুত তাকে বিদায় করে দিতে চাচ্ছে বেগম।

তার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে হাসি মুখেই পত্র লিখে বিদায় নিলো বণিক। দ্বারের সম্মুখে গিয়েও আবার কী ভেবে পেছনে ফিরে চাইলো বেগমের সিংহাসনের দিকে। নজর পড়লো গাউনে ঢাকা বেগমের ফোলা পেটটার দিকে। যেখানে সুলতানের সন্তান ধীরে ধীরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করছে। পৃথিবীর আলো দেখার আশায় দূর্বল করে দিচ্ছে শক্তিশালী নারীকে। কতটা দূর্বল হয়ে পড়ছে বেগম তা কেউ ধরতে না পারলেও সে ঠিকই উপলব্ধি করলো বেগমের অসহায়ত্ব। সন্তান জন্মের দিন এগিয়ে আসার সাথে সাথে তার ঐ সুন্দর মুখখানা যদিও ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে তবুও দুই নয়ন যেন এখনো সুলতানের শোকই ধরে রেখেছে। আর তার জন্য শুধুই বিরক্তি!

হতাশার শ্বাস ফেলে চলে এলো বেগমের নৈকট্য ছেড়ে। রাজসভা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতেই মৃদুস্বরে বলে উঠলো,

“তুমি কেন আমার হলে না জোভিয়া?”

কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবারও আওড়ালো, “হুট করে একদিন গোটা পৃথিবী যদি মিথ্যে হয়ে যেত। যদি সেদিন তুমি আমার হয়ে যেতে।”

মহল ছেড়ে অদূরে বালুর বুকে হারিয়ে যেতেই পুনরায় আফসোস করে বলল, “নাজানি কতবার প্রতিজ্ঞা করেছি তোমাকে ভুলে যাব। নাজানি কতবার সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি আমি। এত খারাপ তো ছিলাম না আমি। তোমার প্রণয়ে আজ আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতেও শিখে গেছি। অথচ নিজেকে এইভাবে বিলিয়ে দেওয়ার পরেও তোমাকে পাইনি আমি।”

পশ্চিমা অনিলে যখন বালু উড়ে উড়ে ঢেকে দিচ্ছে তার পদচিহ্ন সেসময় সে অনুভব করলো জোভিয়ার প্রতি সুলতানের ভয়ঙ্কর ভালোবাসা। জিদানের ক্ষতচিহ্ন, মাইরার পরিণতি, দারিয়ার করুন মৃত্যু সবকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। মারাত্মক সেই ভালোবাসার কাছে হয়তো তার চাওয়া অন্যায় ছিলো, ঠুনকো ছিলো, তবুও একবার যদি জোভিয়াকে নিজের ভাবতে পারতো সে!

অপরদিকে মহলের পরিবেশ ভীষণ গম্ভীর। কারোর লেখনী শত্রুর সাথে মেলেনি। হতাশ হয়ে একে একে সকলেই রাজসভা ত্যাগ করতে শুরু করেছে। আবরার জাওয়াদ চলে যাওয়াতে চিন্তিত ভঙ্গিমা ত্যাগ করে সস্তির শ্বাস ফেলল জারনাব। এতোক্ষন সে বড় ভয়ে ছিলো। যদিও জোভিয়া নিজের রাগের উপর কাবু করতে শিখেছে তবুও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সে। চোখ কুচকে দ্বারের দিকে চেয়ে কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে আওড়ালো,

“এই বণিকটাকে ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু এখন দেখছি লোকটার মাথায় কোনো সমস্যা আছে। সব জানার পরেও এগুলো কোন ধরনের ব্যবহার? পুরুষ মানুষ কেন এতো ইতর হয়?”

তাকে একা একা বিড়বিড়িয়ে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুচকাল মাহতাব। পরক্ষণেই চোখ বড়বড় করে বলে উঠলো,

“আবারও জ্বীনে আছর করেছে!”

ধীর কন্ঠে বললেও কথাখানা শুনতে পেল জারনাব। কটমট করে চাইল মাহতাবের দিকে। ঝাঁঝালো স্বরে শুধাল,
“কী বললে তুমি?”

“জজজ্বীন।” কাটা কাটা স্বর মাহতাবের।

“কিহ! আমাকে জ্বীন বলছো?”

“কই? নাতো।” সরাসরি অস্বীকার করলো মাহতাব।

“আমি শুনেছি তুমি আমাকে জ্বীন বলেছো। আজ তোমার একদিন কি আমার সাতদিন।”
তেড়ে আসতে লাগলো জারনাব। সে যেন কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গেল সমস্ত ঝঞ্ঝাট।

“সাতদিন নয় বোকা মেয়ে, একদিন হবে।” ভুল ধরিয়ে দেওয়ার নিদারুণ চেষ্টা চালালো মাহতাব।

“আবার বোকা বলছো!”

চমকে উঠে পিছিয়ে গেল মাহতাব। এতক্ষণে সে উপলব্ধি করলো জ্বীনে আছর করেনি বরং জুঁইয়ের অন্তরে বসবাস করা ভয়ানক জ্বীনটা জেগে উঠেছে তার রক্ত চুষে খেতে। ছোট বেলায় সে যখন জুঁইকে অযথা রাগিয়ে দিতে তার লাগানো গাছপালা উপরে ফেলত তখন জুঁই এভাবেই তার দিকে তেড়ে আসতো। সেসময় তার ভেতরের জ্বীনটা জেগে উঠতো। অতীতের কথা ভাবতেই শক্তিশালী বীর পড়িমরি করে দৌড় লাগালো দ্বারের দিকে। একজন সৈনিক প্রধান হওয়ার দরুণ যদিও তার এই বাচ্চামো আচরন শোভা পায় না তবুও সে ভুলে যাচ্ছে সমস্ত নিয়ম। পেছনে ছুটে আসছে জারনাব। হঠাৎ কারোর অযাচিত কন্ঠে বহুদিন পর দেখা পাওয়া আনন্দটুকু হাওয়ায় উবে যায় জারনাবের। সেই সাথে থমকে দাঁড়ায় মাহতাব নিজেও।

“ছি ছি! বিধবাদের এতো রং-তামাশা করতে নাই। পাপ লাগবে।”

দ্বারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে উক্তিটি জারনাবের উদ্দেশ্যে বলল মাজেদা বানু। তার সাথে ফাইজাসহ আরোও কিছু সেবিকা আছে। তারা হয়তো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজে এসেছে। তবে মাজেদা বানুর এমন কথাতে হুঁশ ফিরলো জারনাবের। শক্ত হওয়া তুষারের টুকরোর মতোই নির্বাক নয়নে দাঁড়িয়ে রইল সে। কানে আবারো বেজে ওঠে মাজেদা বানুর তীরের ফলার ন্যায় তিক্ত কথাখানা “বিধবাদের এতো রং তামাশা করতে নাই।”

“বিধবা! হ্যাঁ, বিধবাই তো আমি।” নিজ মনেই বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো জারনাব।

মাজেদা বানু পুনরায় বলে উঠলো, “ক্ষমা করবেন কিন্তু আমার দাদি বলতো বিধবাদের এতো আনন্দ উল্লাস করতে নাই। আপনি হতে পারেন সুলতানার বড় বোন বা সৈনিক প্রধানের ছোটবেলার বান্ধবী কিন্তু এইগুলো করা ঠিক না। পাপ হয়।”

খেই হারিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল জারনাব। আঁখিযুগল টইটম্বুর নোনাজলে। গর্জে উঠলো মাহতাব, “আপনি নিজের সীমা অতিক্রম করছেন মাজেদা বানু। জুঁইয়ের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস আপনি পেলেন কীভাবে?”

“আআআসসলে সৈনিক প্রধান………।” আমতা আমতা করতে শুরু করেছে মাজেদা বানু।

“এতো সাহস আপনার? আমার সামনে জুঁইকে আজেবাজে কথা শোনাচ্ছেন! তাও সামান্য একজন রাঁধুনি হয়ে!”

“আমিতো উনার ভালোর জন্যই বলেছি। পাপ হলে তো উনারই হবে। তাছাড়া আমিতো ভুল কিছুই বলিনি। উনিতো বিধবাই। খারাপ ভাগ্য না হলে কি স্বামীটা অকালে মা’রা যায়? স্বামী না থাকলে আবার কীসের আনন্দ? এমন নারীদের বলা হয় অলক্ষ…..”

সাহস জুগিয়ে বলা মাজেদা বানুর কথাগুলো মাঝ পথেই থেমে যায় মাহতাবের ধমকে,

“চুপ, একদম চুপ। জুঁইয়ের উদ্দেশ্যে আর একটাও তিক্ত কথা উচ্চারণ করলে আপনার এই জিভ টেনে ছিড়ে নেব আমি। আপনার স্পর্ধা দেখে হতবাক হচ্ছি আমি। বয়সে যদি আপনি আমার বড় না হতেন তাহলে এখনি আমি আপনাকে আপনার নিজের প্রাপ্য স্থান দেখিয়ে দিতাম।”

অশ্রু কণা ঝরে পড়ে জারনাবের চোয়াল বেয়ে। ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে উঠেছে। কেন সবাই বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয় সে একজন বিধবা? নিজের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে মুখ খলল মাজেদা বানু,

“অপরাধ নিবেন না সৈনিক প্রধান। এগুলো আপনার জানার কথাও না। বয়স অনেক অল্প আপনার। এসব আমার দাদির আমলের কথা। বহুকাল ধরে প্রচলিত।”

বহু চেষ্টায় নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে মাহতাব। ইচ্ছে করছে এখনি ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিতে। শুধুমাত্র এই মহলের সম্মান রক্ষার্থে সে এখনো নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জুঁইকে বিধবা বলার এই মহিলা কে? কেন বলবে? কোন সাহসে? জুঁই মোটেই অলক্ষী নয়। সে নিষ্পাপ, সে কোমল। নিজের রাগের উপর কাবু করার চেষ্টা চালিয়েই বলল,
“আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্বেই আপনি এই স্থান ত্যাগ করুন মাজেদা বানু। নয়তো জানিনা আমি কী করে বসবো।”

হুমকিতে ভয় পেল মাজেদা বানু। সেবিকাদের নিয়ে দ্রুত পা বাড়ালো স্থান ত্যাগ করতে কিন্তু যাওয়া তার হলো না। দ্বারের সম্মুখে গিয়ে হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো। মুখশ্রী শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। ভয়ে কয়েক কদম সরে দাঁড়ালো। চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক বিরাজ করছে। পেছন থেকে মাহতাব পুনরায় ধমকে উঠলো,
“কী হলো? যাচ্ছেন না কেন?”

“কী বলছো মাজেদা বানু? এই নিয়ম তো আমিও জানতাম না। কোন হাদিসে পেয়েছো বলোতো?”

হুট করে বেগমের বাঁকা কথা শুনতে পেয়ে ভালো করে তাকালো মাহতাব। দ্বার বরাবর সটান দাঁড়িয়ে আছে বেগম। কিছুটা এগিয়ে এসে পুনরায় বলল,
“তোমার যুক্তি অনুযায়ী বিধবা তো আমিও। তাহলে আমিও কি অলক্ষী? আমারও কি আনন্দ করা নিষেধ?”

রীতিমতো থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে মাজেদা বানু। কোথা থেকে যে বেগম চলে আসবে তা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। মনে হচ্ছে তাকে যেন কেউ ক্ষুধার্ত বাঘের সম্মুখে ছেড়ে দিয়েছে। উত্তর না পেয়ে ধমকে উঠলো বেগম,
“বলছো না কেন? এখন কেন জবান বন্ধ হয়ে গেছে? আমি কি অলক্ষী?”

“ছি ছি! একথা আমি মনেও আনতে পারি না। আপনি হলেন এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী, এই বিশাল মহলের সুলতানা। আপনি কেন অলক্ষী হতে যাবেন?”

বাঁকা হাসলো বেগম। একহাতে আলতো করে মাজেদা বানুর থুতনি চেপে খানিকটা উঁচু করে ধরলো, “বড্ড জবান চলছে তোমার। ভুলভাল হাদিস তৈরি করে আমার বুবুকে হেনস্তা করছো? আমার বুবুর সাথে খারাপ ব্যবহার করাতে জিদান কতদিন যাবত কারাগারে ছিলো সেই হিসেব বোধহয় রাখোনি তুমি। কোনো সমস্যা নেই, এখন কারাগারে বসে বসে দিন গুনে গুনে হিসেব রেখো।”

“আআআমাকে ক্ষমা করে দিন সুলতানা। এই ভুল আর কখনো হবে না। আমি এখনি আপনার বুবুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কিন্তু আমাকে বন্দি করবেন না। অন্ধকার কারাগার ভীষণ ভয় পাই আমি।”

“ক্ষমা? ক্ষমা চেয়ে কী হবে? আমার বুবুর উচ্ছাস ফিরিয়ে দিতে পারবে তুমি? পারবে তার লাল লাল দুই নয়ন এই মুহুর্তে মাধুর্যতায় ভরিয়ে তুলতে? তার ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর দাম দিতে হবে তোমায়।”

“ওনাকে ছেড়ে দাও জোভিয়া। উনি ভুল তো কিছু বলেনি।”

পেছন থেকে ধরা গলায় বলে উঠলো জারনাব। বোনের এহেন রাগ এসময় মোটেও ঠিক নয়। রাগে কি না কি শাস্তি দিয়ে বসবে জোভিয়া। তাই নিজের কষ্ট চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। তবুও কাজ হলো না বোধহয়। রাগান্বিত কন্ঠেই বেগম বলল,

“তোমার জন্যই তো ওকে ছেড়ে দিচ্ছি বুবু। নয়তো এর জবান চিরতরে বন্ধ করে দিতাম আজ।”

চলবে…….

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_46

কাল কুঠুরির কঠিন অন্ধকারে টিমটিমিয়ে জ্বলছে একটি লন্ঠন। কয়েদির ভয়ঙ্কর চিৎকারে নড়ে উঠছে যেন ভূমি। আক্রমণাত্মক হয়ে শরীরের শেকল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সে। আতঙ্ক ধরানো সেই গর্জনে ভয়ে গুটিয়ে রয়েছে পাহাড়ারত সৈনিক। খবর পেয়ে হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসেছে সুলতান শাহজিল। তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে সে। তাই দ্বারে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কারাগারের লোহার শিক ধরে তখনো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে কয়েদি। নোংরা লাল লাল দাতগুলো বের করে কিছু বুঝি খেতে চাইছে। মুখ হাঁ করে বারবার হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে। যেন কত বছরের ক্ষুধার্ত সে। অথচ কারাগারের এক কোনায় এখনো রাজকীয় খাবারভর্তি থালা অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সুলতান শাহজিলকে দেখতেই আরোও বিচলিত হয়ে পড়লো সে। চিৎকারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেল। গর্জে উঠলো কঠিন সুরে। ভয়ে-আতঙ্কে সৈনিকের অবস্থা বড়ই করুন। আচমকা ধমকে উঠলো সুলতান শাহজিল,

“চিৎকার করছো কেন? খাবার না খেয়ে এভাবে তান্ডব করার মানেটা কী?”

“ক্ষুধার্ত আমি। খেতে দাও আমাকে।” খ্যাসখ্যাসে কন্ঠ যেন হিম ধরিয়ে দেবে শরীরে।

“খাবারের থালা চোখে দেখছো না?” বলল সুলতান শাহজিল।

“রক্ত চাই আমি, তাজা তাজা রক্ত। মুক্ত করো আমাকে।”

অবাক দৃষ্টিতে চাইল সুলতান শাহজিল। চোখদুটো বড়বড় করে বলে উঠলো,

“রক্ত? আবারো তোমার অসুখ তোমাকে বস করে ফেলেছে! শয়তান তোমার মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে।”

“আমাকে রক্ত দাও। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি আমি।”

একাধারে গর্জন করে যাচ্ছে কয়েদি। বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সুলতান শাহজিল। অতঃপর নরম স্বরে রয়ে সয়ে বলল, “দেখো, তুমি একজন মানুষ। তোমার খাবার রক্ত নয়। রক্তে তোমার ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব নয়। শয়তান তোমাকে উস্কানি দিচ্ছে। নিজের মস্তিষ্কের উপর জোর দাও। শান্ত হয়ে বসো আর খাবারগুলো খেয়ে নাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”

“তততুমি মিথ্যা বলছো সুলতান। তুমি আমাকে না খাইয়ে মেরে ফেলতে চাইছো। রক্ত দাও আমাকে, তোমার শরীর থেকে একটু রক্ত দাও। দয় করো, অসহ্য যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি আমি। বাঁচাও আমাকে।”

ইতিমধ্যে কাতরাতে শুরু করেছে কয়েদি। কষ্ট ফুটে উঠলো সুলতান শাহজিলের দুই নয়নে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলে উঠলো,
“তোমাকে আমি কখনোই মারতে চাইনি। এতোটা অকৃতজ্ঞ নই আমি। তোমার ঋণ যে কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। বাঁচাতে চাই বলেই সকলের আড়ালে তোমাকে লুকিয়ে রেখেছি এখানে। বাইরে থাকলে বহু পূর্বেই তোমার হত্যার হুকুম জারি হয়ে যেতো।”

“এসব ছলনায় ভুলবো না সুলতান। তুমি বুঝতে পারছো না ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না আমি? রক্ত দাও নয়তো এখনি মেরে ফেলো আমাকে।”

থেকে থেকে হিসহিসিয়ে উঠছে কয়েদি। পারলে কারাগার ভেঙেই বোধহয় রক্ত চুষে নিতো সকলের। ভারি শেকল ঝনঝন শব্দ তুলছে। কাতরাতে কাতরাতে একসময় ধৈর্য হারিয়ে নিজের ময়লা হাতেই কামড় বসিয়ে দিলো। রক্ত বেরিয়ে আসতেই তা চুষে চুষে পরম ভক্তিতে খেতে শুরু করলো। হঠাৎ নিজের শরীরে আঘাত করাতে চমকে উঠলো সুলতান শাহজিল। কয়দির এহেন পাগলাটে জন্তুর ন্যায় আচরনে ততক্ষণাৎ চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সে। একের পর এক নিজের শরীর কামড়ে কামড়ে রক্ত খেয়ে যাচ্ছে কয়েদি। কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য! একজন সৈনিক তো বমিই করে ফেলল সেই স্থানে। তবুও থেমে নেই কয়েদি। চিৎকার করে থামানোর চেষ্টা করলো সুলতান শাহজিল,

“থামো, থামো বলছি। মরে যাবে এভাবে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে। শান্ত হও। শোনো আমার কথা।”

কে শোনে কার কথা? তার কথা মোটেই গ্রাহ্য করছে না কয়েদি। এসব কথা কানে তোলার পরিস্থিতিতে এই মূহূর্তে সে নেই। উপায় না পেয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সুলতান শাহজিল, “শাহজাইন আর নেই। বেঁচে নেই শাহজাইন।”

কথাখানা কর্ণগহ্বরে পৌঁছাতেই ততক্ষণাৎ থেমে গেলো কয়েদির জন্তুর ন্যায় আচরন। রক্তে ভরা মুখটা তুলে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সম্মুখে। কাঁটা কাঁটা স্বরে বলে উঠলো, “জজজাইন, জজাইন।”

কাঁপা হাতটা দিয়ে আকড়ে ধরলো শেকল। উদ্বিগ্ন গলায় আবারও বলল, “তততুমি ইইচ্ছা করে মিথ্যা বলছো তাইনা সুলতান? জজাইন বেঁচে আছে। আমি জানি জাইনের কিছু হয়নি। তুমি অযথায় বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছো। তাছাড়া মিথ্যা বলার সভাবটা তোমার বরাবরই বেশি।”

“নিজের একমাত্র পুত্রকে নিয়ে এ ধরণের মিথ্যা বলার মতো নিচ নই আমি।” গম্ভীর কন্ঠ সুলতান শাহজিলের।

“আমাকেও তো তুমি ছল করে বন্দি করে রেখেছো সুলতান? মুক্ত করো আমাকে। মৃত্যুর পূর্বে আমার পুত্রকে এক নজর দেখতে বড্ড মন চাই।”

আকুতি ভরা সেই কন্ঠকে তোয়াক্কা করে না সুলতান শাহজিল। বরং নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলল,

“আমি চাইলেও তোমাকে মুক্ত করে দিতে পারবো না। ক্ষমা করো আমাকে। তুমি সাম্রাজ্যবাসীর জন্য হুমকির কারন হবে। নাজানি কত হত্যালীলা চালাবে তুমি নিজের অজান্তেই। তোমার দ্বারা কত সাধারন প্রজা ক্ষতবিক্ষত হবে তার হিসেব নেই। গোটা পৃথিবীর কাছে বর্তমানে তুমি মৃত। কেউ তোমাকে মনে রাখেনি, কেউ না। কোনোদিন ভাবিনি এভাবে তোমাকে বন্দি করে রাখতে হবে। পুত্রকে দেখার আকুলতাকে সরিয়ে একটাবার সাম্রাজ্যবাসীর কথা চিন্তা করে দেখো। পূর্বের সেই মানবতা জাগিয়ে তোলো নিজের মাঝে। সেই বীরত্ব! সেই সাম্রাজ্যের প্রতি প্রেম! সাধারণ প্রজাদের প্রতি অপার দায়িত্ববোধ! সবই কি ভুলে যাচ্ছ তুমি?”

“কিছুই ভুলিনি আমি সুলতান। তুমি ভুলে যেতে পারো কারন অহংকার, ছলনা তোমার রক্তে মিশে গেছে। সামান্য এই কাল কুঠুরি আমার মানবতাকে বাঁধতে পারেনি কিন্তু ক্রমেই আমার অন্তিম সময় যে ঘনিয়ে আসছে তা ঢের বুঝতে পারছি। শেষবারের মতো নিজ পুত্রকে দেখার সাধ যে মেটাতে পারছি না। কেমন দেখতে হয়েছে ও?”

কত হাহাকার সেই কন্ঠে, ছলছলে দৃষ্টি কিন্তু কী আফসোস! তার অস্তিত্ব কেউ অনুভব করতে পারেনা। গোটা সাম্রাজ্যের কাছে মৃত হয়েও এই চার দেয়ালের মাঝে করুনভাবে বেঁচে আছে সে। কবে শেষ হবে এই জীবনের রেখা? রক্তাক্ত হাতটার দিকে একবার চেয়ে ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
“মুক্তি চাই না আমি। চাই না মুক্তি। গোটা সাম্রাজ্য রক্ষার্থে একটা প্রাণের ধংস হওয়াটা কখনোই অন্যায় নয়। কতবার যুদ্ধ করেছি এই সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে। নিজ হাতে তার ক্ষতি কী করে করবো আমি?”

“আমি জানতাম তুমি বুঝতে পারবে। ক্ষমা করে দিও আমাদের। তোমার এতো ত্যাগের বিনিময়ে কিছুই দেওয়া হলো না তোমাকে। ওষুধ পাঠিয়ে দেবো আমি। হাতে লাগিয়ে নিও আর খাবারটা খেয়ে নিও। আরো কিছু প্রয়োজন হলে সৈনিককে বলে দিও।”

“তুমি চলে যাও সুলতান। তোমাকে দেখলে দুঃখ বড্ড বেড়ে যায় আমার।” একধ্যানে মেঝেতে চেয়েই বলল কয়েদি।

হতাশার শ্বাস ফেলে চলে যেতে ধরলো সুলতান শাহজিল। কয়েক পা আগাতেই পেছন থেকে কয়েদি বলে উঠলো,
“কিন্তু জাইন?”

“শাহজাইন মৃত আর এটাই ধ্রুব সত্য। এক আকাশ সমপরিমাণ কষ্ট হলেও সেই সত্যকে মানতে আমি যেমন বাধ্য হয়েছি ঠিক তেমনি তোমাকেও মানতে হবে।”

ধরে আসছে সুলতান শাহজিলের কথা। চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরতেই দ্রুত হাতে মুছে নিলো সে। দূর্বলতা ঢাকতে হনহনিয়ে ত্যাগ করলো সেই স্থান।
অথচ মানলো না কয়েদি। মেঝেতে রক্তাক্ত হাতে আঁকিবুকি করতে করতে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,

“তুমি কিছুই জানো না সুলতান। আসবে জাইন, এসে তোমাকে চমকে দেবে শিশুকালের মতোই। ঠিক আসবে।”

মাজেদা বানুকে কারাগারে বন্দি করা হয়েছে কিন্তু কী আশ্চর্য! চিরপরিচিত নিয়মমাফিক জারনাব এগিয়ে এলো না তার বোনের দিকে। বোনের ফোলা পেট, তার দূর্বলতা কিছুই উপলব্ধি করতে পারলো না সে। বেগমকে একেবারে উপেক্ষা করেই গটগট করে চলে গেল সে। যেন বেগমের কী হলো না হলো তাতে কিছুই যায় আসে না তার। এ ঘটনায় বেগম যতটা না অবাক হয়েছে তারচেয়ে হাজারগুন বেশি হতবাক হয়েছে মাহতাব। এই মুহূর্তে সে জুঁইয়ের মাঝে বোনের প্রতি সেই চিন্তা, টান, ভালোবাসা কিছুই অনুভব করতে পারলো না। ধীরে ধীরে কি বদলে যাচ্ছে জুঁই? তা বলে এতো ভয়ঙ্করভাবে বদলে যাবে? বেগমের দূর্বল শরীরের অসহায়ত্ব সে একজন পুরুষ হয়েও ধরতে পারছে সেখানে জুঁই কোনো তোয়াক্কায় করলো না। মাহতাব যখন নিজের ভাবনায় ডুবে ছিলো সেসময় বেগম ধীর পায়ে জারনাবের কামরার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। আনমনে ভেবে যাচ্ছে, “বুবুর কি শরীর খারাপ? কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে হয়তোবা। সে নিজেকে কঠোর করেছে গুপ্ত শত্রু থেকে সাম্রাজ্য রক্ষার্থে কিন্তু বুবুর এমন আচরণ কেন? বেশকদিন যাবত সে লক্ষ্য করছে বুবু আর আগের মতো তার কাছে ছুটে আসে না। শুধুই কি তার কঠোর আচরন এর জন্য দায়ী? বুবুর এই পরিবর্তনের জন্য কি সে নিজেই দায়ী? কিন্তু ওটা তো তার দায়িত্ব তা তো বুবুর জানার কথা।”

অনেক কষ্টে হেঁটে এসে সে জারনাবের দ্বারের সম্মুখে দাঁড়ায়। কন্ঠ উঠিয়ে ডাকে,
“বুবু।”

বন্ধ দ্বার খুলে এগিয়ে এলো জারনাব। খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বলল,
“একি! তুমি এখানে কেন এসেছো জোভিয়া?”

এবার আর অবাক নয় যেন হতবাক হলো বেগম। নিস্তেজ গলায় আওড়ালো,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বুবু।”

“তুমিতো সম্রাজ্ঞী। একবার বললেই লক্ষ লক্ষ সেবা করার মানুষ পেয়ে যাবে। এখন যাও, ব্যস্ত আছি আমি।”

বেগমকে নীরব থাকতে দেখে জারনাব আবারো বলল,
“কী হলো? যাচ্ছ না কেন?”

হতভম্ব বেগম আর কিছুই বলতে পারলো না। সত্যিই এই কথার উত্তর দেবার মতো কিছু নেই তার নিকট। প্রস্থান করলো ঠিক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই। নিজ কামরায় পৌঁছানোর পূর্বেই ফাইজা মলিন মুখে এগিয়ে এলো। সেসময় ফাইজাকে ডেকে পাঠিয়েছিল সে কিছু জানার জন্য। বুবু তাকে বলেছিলো ফাইজা কোনো কারনে ভয়ে ভয়ে থাকে। গুটিয়ে রাখে নিজেকে। সেও কয়েকবার লক্ষ করেছে ফাইজা পূর্বের ন্যায় হাসিখুশি নেই এখন। সবসময় যেন কোনো একটা আতঙ্ক বিরাজ করে তার ভঙ্গিমায়। ফাইজা এসেই নত মস্তকে সালাম প্রদান করে বলে ওঠে,
“আমাকে ডেকেছিলেন সুলতানা?”

“হ্যাঁ, আমার সঙ্গে এসো।”

নিজ কামরার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় বেগম। ফাইজাও তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। কামরায় পৌঁছে আগে পানি খেয়ে নিলো বেগম। দূর্বল শরীর আর সায় দিতে চাইছে না। কিছুক্ষণ দম নিয়ে শুধাল,

“তোমার কী হয়েছে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে এই মহলে?”

“না না, কিছু হয়নি তো। ঠিক আছি আমি।” অতি দ্রুত উত্তর ফাইজার।

ভ্রু কুচকে তাকালেন বেগম। সন্দেহ তার মনে শক্তপোক্তভাবে বাসা বাঁধে। কেমন যেন একটা ভয় দেখা যাচ্ছে ফাইজার মুখশ্রীতে। বেগম নরম কন্ঠে আবারো শুধাল,
“কোনো অসুবিধা হলে আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”

“কোনো অসুবিধা হচ্ছে না আমার।”

ফাইজার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না বেগম। সে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে মেয়েটা মিথ্যা বলছে। মুখে না না বললেও নয়নে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে মেয়েটার। নিজের হিজাব খামচে ধরে রয়েছে। কিছুটা এগিয়ে এলো বেগম। তাকে আশ্বস্ত করতে হাত বাড়াতেই ভয়ে পিছিয়ে যায় ফাইজা। রীতিমতো কাঁপছে সে। বেজায় অবাক হলো বেগম। সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

“কী হয়েছে ফাইজা?”

“কককিছু না সুলতানা।”

ততক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে ভীত নয়ন আড়াল করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছে ফাইজা। আবারও একই মিথ্যা উত্তর শুনেও কেন যেন রাগ হলো না বেগমের। ধমকে ওঠার বদলে কিছুটা এগিয়ে এসে আলতো করে হাতটা বুলিয়ে দিলো ফাইজার মাথায়। বড় আদর করে ভরসাভরা কন্ঠে আওড়ায়,

“ভয় পেয়ো না। আমি আছি তোমার সাথে। আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। নির্ভয়ে বলো আমাকে।”

ছলছল নয়নে বেগমের মুখের দিকে চেয়ে থাকে ফাইজা। এবারও নিশ্চুপ সে। পুনরায় শুধাল বেগম,

“বলো?”

“মেরে ফেলবে, আমাকে মেরে ফেলবে।”

ঘনঘন কথাটা বলেই আচমকা কেঁদে ফেলল ফাইজা। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ক্রন্দনরত কন্ঠে পুনরায় বলল, “নোংরাভাবে ছুঁয়েছে আমাকে।”

প্রথম কথাটাতে অবাক হলেও দ্বিতীয়বার উচ্চারিত কথাটা যেন ধপ করে আগুন ধরিয়ে দিলো বেগমের মাথায়। বিস্তারিত আর কিছু শোনার ইচ্ছাই জাগলো না। কিঞ্চিত দৃঢ় কন্ঠে শুধাল,
“কে?”

“বববললে আমাকে মেরে ফেলবে।”

ক্রমেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে ফাইজা। তাকে আশ্বস্ত করতে নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করলো বেগম। অল্প বয়সী মেয়েটাকে নোংরাভাবে ছুঁয়েছে! তাও তারই মহলে? ছি! এমন নিকৃষ্ট কিট এই মহলে আছে বলে তার জানা ছিলো না।

“তুমি কি চাও না যেই মানুষটা তোমার নিষ্পাপ শরীরে নোংরা স্পর্শ করেছে সে শাস্তি পাক? জনসম্মুখে আসুক তার নোংরা মুখখানা?”

“চাই কিন্তু……”

ক্রন্দনরত অবস্থাতেই শুকনো ঢোক গিলল ফাইজা। সেদিন যখন বেগমের সাথে লড়াইয়ে হার মেনে নিয়েছিলো মামা হাদিদ। সেসময় ফাইজা হেসেছিল যা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলো তিনি। পরবর্তীতে সেই ঘটনার রাগ থেকেই হয়তো ফাইজাকে নানাভাবে হেনস্থা করেছে সে। বাজেভাবে ছুঁয়ে দিয়েছে দিনের পর দিন। নোংরা দৃষ্টি আর বিশ্রি স্পর্শের সাথে সাথে হুমকিও দিয়েছে যেন এ কথা কেউ না জানে। কাউকে এ কথা জানালে বা তার নাম প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলবে ফাইজাকে। সেই ভয়ে আজও ফাইজা নিজেকে গুটিয়ে রাখে তবুও কাউকে বলতে পারেনি নিজের সম্মানহানির খবর। কিছুটা উচ্চস্বরে বেগম শুধাল,

“এখানে কোনো কিন্তুর অবকাশ নেই। তুমি শুধু আমাকে বলো কে সে?”

“সে আমি। পেছনে ফিরে দেখো মেয়ে।”

হঠাৎ পেছন থেকে দ্বার বন্ধের শব্দে চকিতে ফিরলো বেগম। মামাকে নিজ কামরায় বিনা অনুমতিতে এভাবে প্রবেশ করতে দেখে রাগান্বিত হলো খানিকটা। সে এখনো ধরতে পারেনি ফাইজার শরীরে নোংরা স্পর্শ দেওয়া সেই মানুষটাই ইনি। দ্বারের সম্মুখে পাহাড়ায় থাকা সৈনিকদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়তে নিলেই বাঁধা দেয় মামা।

“ওদের ডেকে লাভ নেই। কারাগারে আগুন লেগেছে। মহলের সকলেই সেখানে আগুন নেভাতে ব্যস্ত। শুধু তোমার কান পর্যন্ত এখনো সে খবর পৌঁছায়নি। তাদেরকে আমি বলেছি এটা সম্রাজ্ঞীর হুকুম। বোকাগুলো বিশ্বাসও করে নিয়েছে। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা। কারাগারে আগুনটা আমিই লাগিয়েছি যেন মহলের সকলে ওখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর মহল ফাঁকা হয়ে যায়।”

বিস্ময়ের সীমা রইল না যেন। বিস্মিত গলায় বেগম শুধাল,
“এগুলো কোন ধরনের পাগলামি মামা? মহলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন! সেটা আবার গর্ব করে বলতে এসেছেন? বিনা অনুমতিতে আমার কামরায় প্রবেশ করে আবার দ্বার আটকে দিয়েছেন! কারন কী এসবের?”

উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মামা। তিরস্কার করে বলে উঠলো,
“নির্বোধ নারী। এখনো বুঝতে পারোনি কেন এসব করেছি আমি? কারন আমাকে আজ পালাতে হবে। এই মহল, এই সাম্রাজ্য সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে । যাওয়ার আগে ভাবলাম তোমার সাথে বোঝাপড়াটা করেই যাই।”

“মানে?”

ভীত ফাইজার দিকে একনজর চেয়ে শয়তানি হাসি হাসলো মামা। দু’পা এগিয়ে যেতেই বেগমের পেছনে গুটিয়ে গেল ফাইজা। তা দেখে আরোও মজা পেল যেন সে। নোংরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফাইজার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“পালিয়ে লাভ কী? যার কাছে লুকাচ্ছিস সে তোকে রক্ষা করতে পারবে না। তোকে কী? নিজেকেই তো রক্ষা করতে পারবে না। তোদের সম্রাজ্ঞী আর শক্তিশালী যোদ্ধা নেই। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে বড্ড দূর্বল হয়ে পড়েছে। যতই শক্তিশালী হোক মেয়ে মানুষের এই তো দূর্বলতা। এসময়টা তারা অসহায় থাকে। নির্ভর করে অন্যের উপর। তুই কি-না তার কাছে এসেছিস নালিশ করতে? তোকে এদিকে আসতে দেখেই বুঝেছিলাম আমি আজ আমার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।”

এরপরে আর কিছু বোঝার বাকি থাকে না বেগমের। ফাইজাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কন্ঠে শুধায়,

“তারমানে সেই মানুষটা আপনি! ছি ছি! আমি কল্পনাও করিনি এতোটা নীচ আর ঘৃণ্য মানসিকতা আপনার। বুক ফুলিয়ে আবার সেকথা বলতে লজ্জা করছে না আপনার?”

“জ্ঞান দিও না মেয়ে। এখন যতটা দূর্বল তুমি তাতে চাইলেও আমার কিছু করতে পারবে না। অযথা রাগ ছুটিয়ো না। পেট নিয়ে তো নড়তে পারছো না। এখনো এতো অহংকার?” বেগমকে একপ্রকার ধমকেই উঠলো মামা।

“আপনাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সেটা হবে হাত কর্তন। আমি দূর্বল হলেও আমার অস্ত্র আর সৈন্যবাহিনী সবল আছে এখনো।”

“কে শাস্তি দেবে আমাকে? তোমার সৈন্যবাহিনী তো আগুন নেভাতে ব্যস্ত। আর আমিতো এখনি চলে যাবো এই সাম্রাজ্য ছেড়ে। তুমি শাস্তি দেবে? পারবে তো? দাও, কোথায়? তোমার অস্ত্র কোথায়? ঐ দেখো দর্পণের সামনে। যাও, দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসো। ওহহো! তুমিতো দৌড়াতে পারবে না। দাঁড়াও আমি এনে দিচ্ছি।”

বলতে বলতে দ্রুত হাতে বেগমের অস্ত্রখানা তুলে নিলো মামা। শয়তানি হেসে বললো,
“দাও শাস্তি। অস্ত্র নিয়ে যাও আমার থেকে।”

তাকে অবাক করে দিয়ে ধীর পায়ে শরীর ঠেলে ঠেলে এগিয়ে এলো বেগম। এক মূহূর্ত দেরি না করে আচমকাই কেড়ে নিলো অস্ত্র। মামার নিকট কোনো অস্ত্র না থাকায় ভয় পেয়ে গেল সে। বাঘিনী যতই দূর্বল হোক কৌশল তো আর ভুলে যায়নি। তাই অস্ত্র চালানোর পূর্বেই বেগমের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। অস্ত্র নিয়ে এক রকম ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেছে। অথচ এসময় বেগমের শরীর ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ছে। উচু পেট নিয়ে মামার শক্তির সাথে অতটা সুবিধা করতে পারছে না সে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মামা হঠাৎ লাথি মেরে বসে বেগমের পেট বরাবর। সঙ্গে সঙ্গেই গগণ কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো বেগম। দু’হাতে পেট চেপে ধরে ঢলে পড়লো মেঝেতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সফেদ মেঝে। চোখ উল্টে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। কিছুক্ষণ কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল রক্তাক্ত দেহখানা। অতৃপ্তিতে ভরা দুই নয়ন তখনো খোলা রইলো। চিৎকার করে কেঁদে উঠে বেগমের কাছে ছুটে এলো ফাইজা। রক্তাক্ত দেহ ধরে ডাকতে লাগলো বেগমকে। আকস্মাৎ ঘটনায় চমকে গেছে মামা নিজেও। লাথিটা ইচ্ছা করে মারেনি সে। তার বোনের কত স্বপ্ন ছিলো এই বাচ্চাটা নিয়ে আর সে এক নিমেষে সব শেষ করে দিলো! কী হবে, কী করবে ভেবে না পেয়ে দ্বার খুলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার পূর্বে বাইরে থেকে আটকে দিলো যেন কেউ সহজে কিছু ধরতে না পারে। এক নাগাড়ে ভয়ে, আতঙ্কে কেঁদেই চলেছে ফাইজা। ক্রন্দনরত কন্ঠে বেগমকে ধরে ডাকছে,

“সসসুলতানা, উঠুন। কিছু হবে না আপনার, উঠুন।”

বেগমের সাড়াশব্দ না পেয়ে তাকে রেখে ছুটে গেল দ্বারের কাছে। দ্বারটাও বাইরে থেকে আটকে দিয়ে যাওয়ায় কয়েকবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো সে,

“কেউ আছো বাইরে। দ্বার খোলো। কেউ থাকলে দ্রুত দ্বার খুলে দাও। মরে যাচ্ছে সুলতানা।”

নাহ, কেউ নেই আশেপাশে। সকলেই আগুন নেভাতে ব্যস্ত। আবারো ডাকলো ফাইজা,
“কেউ আছো? খোলো, দ্বার খোলো। মরে যাবে এই মানুষটা। খুলে দাও। খোদা! দয়া করো।”

কাউকে সাহায্যের জন্য না পেয়ে নিজেই কতক্ষণ দ্বার ভাঙার চেষ্টা করলো। এক সময় ব্যর্থ হয়ে বসে পড়লো দ্বার ঘেষে। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করলো,
“কী করবো আমি এখন? চোখের সামনে ছটফট করে মানুষটা মরে যাচ্ছে অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। কেন এতো দূর্বল হয়ে জন্ম নিলাম আমি!”

খোলা চোখদুটোও বন্ধ হয়ে গেলো বেগমের। দু’বার বড়বড় শ্বাস নিয়ে অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,
“সুলতান, সুলতান, সুলতান।”

সেসময় তার শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে দখিনা অনিলে উড়তে আরম্ভ করলো কামরার সবগুলো পর্দা। কোথা থেকে যেন বেগম আর সুলতানের অঙ্কিত চিত্রখানা উড়ে এসে পড়লো রক্তের মাঝে। মুহুর্তেই ভিজে চুপচুপে হয়ে ছিড়ে যেতে ধরলো চিত্রখানা। এ যেন তাদের চির বিচ্ছেদের জাল ছড়িয়ে গেলো রাজ বংশের উত্তরাধিকারের মৃত্যুর সাথেই।

বণিক জানলে হয়তো ছুটে আসতো। বাঁচাতে আসতো তার না হওয়া প্রিয়জনকে। কিন্তু হায়! সে জানতেও পারলো না প্রিয় মানুষের এই দুরবস্থা। কে খবর দেবে তাকে? আফসোস! সে জানেও না মহলের চার দেয়ালের মাঝে তার বহুল কাঙ্ক্ষিত মানুষটা রক্তে ভিজে মৃতের মতো পড়ে রয়েছে। কেউ নেই আজ তাকে বাঁচানোর জন্য!

চলবে……….