সম্রাজ্ঞী পর্ব-৫৭

0
237

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_57

রামান সাম্রাজ্যের বিশাল রাজকীয় মহলের কোনায় কোথায় বিরহ। দেয়ালে দেয়ালে আর্তনাদ, হারাকার। মারজিয়া সুলতানের দৃষ্টিতে মাইরার মৃত্যুশোক, মসৃণ মেঝেতে সম্রাজ্ঞীর রক্ত, কঠিন অপরাধীর বুকে সরল জারনাবের নিথর দেহ, নিষ্ঠুর মাহতাবের পুড়ে অঙ্গার হওয়া হৃদয়, সুলতানের কঠিন চেহারার আড়ালে লুকোনো বিশ্বাস ভঙ্গের কষ্ট! আর কী চায় এই মহল? আর কত শোক চায় সে?

বেগমের রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত শরীরটা যখন তার বুবুর কামরায় এসে পৌঁছালো ততক্ষণে তার বুবুর ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। মাহতাবের বলিষ্ঠ বুকে জড়িয়ে আছে জারনাবের মৃতদেহ। ওর রক্তাক্ত সাদা হিজাব নুইয়ে পড়েছে মৃত্যুভারে। বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। শোকাহত বেগম সুলতানের বাহু বন্ধনও ঠেলে দিলো আজ। তার স্তব্ধ দেহখানা মেঝেতে ধপ করে পড়লো। সে কী বেদনা তার মুখখানাতে! নির্বাক, নিশ্চল দৃষ্টি। কথা নেই, বার্তা নেই, একধ্যানে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চেয়ে রইল বুবুর লাশের দিকে। চোখদুটো যেন পাথর হয়ে গেছে। পানি নেই এক বিন্দু।

“এলি।”

সুলতান অস্থির হয়ে বসলো তার সামনে। টেনে তুলতে গেলে জোর করে ছাড়িয়ে নিলো বেগম। সুলতান খানিক অবাক হয়ে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো বেগম,

“বুবুকে উঠতে বলুন, বলুন না সুলতান। ও ওভাবে কেন শুয়ে আছে শয়তানটার উপর?”

দ্রুত বেগমের মুখখানা দুই হাতে আকড়ে নিলো সুলতান। চোখে চোখ রেখে একরাশ মায়া ঢেলে বলল,
“তোমার কানতে ইচ্ছে করছে না? কাঁদো আমার বাঘিনী। দুঃখ নিংড়ে দাও অশ্রুর সাথে।”

মহলের চার দেয়ালে উচ্চকন্ঠে উচ্চারিত হলো, “মরে গেছে তোমার বুবু। চিরতরে হারিয়ে গেছে দুনিয়ার বুক থেকে।”

এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠলো বেগম। হাত-পা আছড়ে পাগলের মতো আহাজারি করতে লাগলো। লম্বা লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছড়ে পড়ছে মেঝেতে। নিজের চুল সজোরে খামচে ছিড়ে ফেলতে চাইলো। থামালো না সুলতান। কেঁদে হালকা হতে দিলো। অনেক সময় চিৎকার করে কান্নার পর ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে বেগমের গলার স্বর। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। দূর্বল শরীর ঢলে পড়ে মেঝেতে। ক্ষীণ স্বরে কেবলই আওড়ালো,
“বুবু, ফিরে আসো বুবু।”

বুকে জড়িয়ে নিলো সুলতান। বেগমের এই কষ্ট আর দেখতে পারছে না সে। ছলছল চোখে আবারো তাকালো স্তব্ধ মাহতাবের দিকে। ঐ চোখে যে কত ঘৃণা! মাহতাবের কোনো চাল চলন লক্ষ করা যাচ্ছে না। পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে আছে তখন থেকে। মৃতদেহ কোলে নিয়েও কী শান্ত ওর ভঙ্গিমা! ও যেন একেবারে নিস্তেজ, পাথর হয়ে গেছে!

আব্দুর রহমান অসুস্থ শরীরে এসে থামলো দ্বারে। সেবকরা নিয়ে এসেছে তাকে। নিজ কন্যার মৃতদেহ দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। পুরো দুনিয়া ঘুরতে লাগলো তার। সব মিথ্যে মনে হলো। এ কেমন বিদঘুটে দৃশ্য? কিছুক্ষণ বিস্মিত, নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে আকস্মাৎ বেহুঁশ হয়ে পড়লো পুরুষালি দেহখানা।

সেখানে সকলে উপস্থিত থাকলেও উপস্থিত ছিলো না সুলতান শাহজিল। থাকবে কীভাবে? আজ যে কাল কুঠুরির কয়েদির মুক্তির দিন। স্বাধীনতা আজ! নিষ্ঠুর এই দিনে কঠিন নির্মমতার সাক্ষী হতে মুক্তি মিলছে তার। আচ্ছা, স্বাধীনতাও বুঝি নিষ্ঠুর হয়?

কাল কুঠুরির তালা খুলে দিয়ে ভয়ে ছুটে পালালো সৈনিক। সুলতান শাহজিল নিজেই এগিয়ে এসে খুলে দিলো কাল কুঠুরির দরজা। ভয় নেই তার বদনে। অনেক হয়েছে। আর নয়। বহুদিন থেকে বন্ধ থাকার পর আজ করকর শব্দে খুলে গেল ওটা। কয়েদি হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। বিস্মিত দৃষ্টিতে সুলতান শাহজিলের দিকে তাকালে সে মাথা নত করে নিলো। শান্ত স্বরে বলল,
“আজ তোমার মুক্তির দিন বন্ধু।”

বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আচমকা ধমকে উঠলো কয়েদি,
“তুমি পাগল হয়ে গেছো? বন্ধ করো এই দ্বার।”

“আর কত? আর কতদিন এখানে থাকবে তুমি?”

“মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।”

কয়েদির দৃঢ় কন্ঠকে ছাপিয়ে যায় সুলতান শাহজিল,
“নিজের পুত্রের সাথেও দেখা করতে চাও না তুমি? আজ না গেলে আর কখনোই তাকে দেখতে পাবে না তুমি।”

হঠাৎই সেই কয়েদি পুরো মহলকে হতভম্ব করে দিয়ে আদুরে স্বরে আওয়াজ তুলল, “আজমাইন! আমার পুত্র। কোথায় ও?”

“চলো।” এগিয়ে এলো সুলতান শাহজিল।

“কোথায়?”

“মহলে আছে। এই সাম্রাজ্যের সৈনিক প্রধান তোমার পুত্র। তোমারই মতো সাহসী বীর সৈনিক হয়েছে ও। তোমার অবর্তমানে তোমার পদখানা সেই দখল করে আছে।”

খুশিতে চোখ চকচক করে ওঠে কয়েদির। বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
“সৈনিক প্রধান! আমার আজমাইন অনেক বড় হয়ে গেছে না? খুব সাহসী হয়েছে?”

পুত্রকে দেখার আশায় ঠিক-ভুল বিবেচনা ভুলে গেলো কয়েদি। বয়স্ক, জরাজীর্ণ দেহটা টেনে বেরিয়ে এলো। সুলতান শাহজিল তার শরীরে লাগানো শেকল ছাড়িয়ে ময়লা, নোংরা হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে হাঁটতে লাগলো। বন্ধুর হাত আবার নোংরা কীসের? বন্ধু তো সর্বদাই বন্ধু থাকে। কিছুদূর গিয়ে থামলো কয়েদি।

“কিন্তু আমার অসুখ?”

“চলো।”

আবারো টানতে লাগলো সুলতান শাহজিল। আজ এই কাজটা সে না করলে আর হয়তো নিজের পুত্রকে দেখতে পাবে না তার বন্ধু। অসুস্থ মানুষটাকে বাইরে আনাটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আজ সে মানবে না কিছু। পিতা-পুত্রের মিলন ঘটাবে। কেউ না জানলেও সে বুঝতে পেরেছে কেন আজমাইনের এই হিংস্রতা। কেন এই নির্মমতা। এতোদিনে জানার পরেও আজমাইনের পরিচয় গোপন করেছে সে। ভয়ে করেছে। যদি তার বন্ধুর জীবিত থাকার চরম সত্য প্রকাশ হয়ে যায়। যদি মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় তার বন্ধুকে। এর কারনে যে তাদের এতোবড় মাশুল দিতে হবে তা কে জানতো? আজমাইন কবে কবে এতো হিংস্র হয়েছে সে টেরই পাইনি।

হুট করে বাইরের এতো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে কয়েদির। চোখ খিচে এগোতে থাকলো তবুও। শরীর আগের মতো সবল নেই। তবুও বেঁচে আছে সে। জারনাবের কামরায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আর কোনো প্রশ্ন স্থান পেলো না তাদের মাঝে। একই কামরায় দু’জন সুদর্শন, বলিষ্ঠ পুরুষ তাদের ভালোবাসার নারীকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে। নারীদেহ দুটো অসাড়। পার্থক্য এটাই, একটা শরীরে প্রাণ আছে, অন্যটা শুধুই লাশ। যুবকের প্রিয়তমার লাশ। নিষ্ঠুর, বেদনাদায়ক সেই দৃশ্য!

কামরায় প্রবেশ করতেই দ্বারের সামনে বসা পুরুষটার পোশাকই বলে দিচ্ছে সে এই সাম্রাজ্যের সুলতান। বালক বয়সের জাইনের সাথে এই বলিষ্ঠদেহি পুরুষের একবিন্দু মিল নেই।

“জাইন।”

একই সাথে চকিতে ফিরলো মাহতাব আর সুলতান। হতভম্ব, বিস্ফোরিত ওদের দৃষ্টি। যেন ভুল কিছু দেখে ফেলেছে ওরা। কোলে থাকা দুই নারী পূর্বের ন্যায় নিশ্চল।

“চাচা।”

কামরায় ঝনঝন করে বেজে উঠলো সুলতানের কথাখানা। সৈনিকরা দ্বারের বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। বয়স্ক মানুষটাকে তারা অনেকেই চেনে। সে এই সাম্রাজ্যের সৈনিক প্রধান ছিলো এক সময়। তার বিশাল একখানা চিত্র আছে সৈনিকদের কামরায়।
তবে তাদের জানামতে লোকটা মারা গিয়েছিল আরোও অনেক পূর্বেই। মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিলো তাকে। অদ্ভুত অসুখ করেছিলো তার। জঙ্গলের অজানা পশুর আক্রমণের শিকার হওয়ার পর থেকেই সেই অসুখের উদ্ভব। অসুখটা হুটহাট বেড়ে যায়। তখন তার রক্তের তৃষ্ণা পায়। সে নিজের অজান্তেই মানুষ হত্যা করে তাদের শরীর খুবলে রক্ত পান করে। এভাবে পরপর কয়েকজন সৈনিককে হত্যা করে ফেলে। তাই শাস্তিস্বরূপ তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আজ হঠাৎ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মৃত মানুষটাকে দেখে চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম সকলের।

“আমার জাইন কত বড় হয়ে গেছে। আয়, আমার কাছে আয় বাবা।”

বেগমকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো সুলতান। নিথর দেহখানা দেখে লোকটা এগিয়ে এলো সামান্য। রক্তাক্ত বেগমকে দেখে ভ্রু কুচকে এলো তার,

“তোর বেগম?”

“হ্যাঁ চাচা। কেমন আছেন আপনি? কোথায় ছিলেন এতোদিন? হুট করে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। জানেন কতো খোঁজ করেছি আপনার। কোথায় কোথায় না খুঁজেছি। কোথাও পাইনি আপনাদের। মাইন কোথায়? অনেক বড় হয়ে গেছে ও, তাই না?”

সুলতানের উদ্বিগ্ন গলায় করা প্রশ্নগুলো সকলে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অথচ লোকটা নীরব রইল। সে বুঝতে পারলো শাহজাইন কিছুই জানে না। শুধু শাহজাইন কেন সাম্রাজ্যের কেউই জানে না। তার একমাত্র পুত্র আজমাইনও না। সুলতান আবারো অস্থির চিত্তে বলে উঠলো,

“কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনারা? সবাই বলেছিলো আপনার অসুখ করেছে। অদ্ভুত অসুখ। তাই চলে গিয়েছিলেন আপনি। কেউ কেউ বলতো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো আপনার। আমি বিশ্বাস করিনি। কেননা আমি জানি আমার পিতা আপনার কতটা কাছের বন্ধু ছিলো। সে আপনার মৃত্যুদণ্ড কিছুতেই দেবে না। আপনার অবদানও তো কম ছিলো না এই সাম্রাজ্যের প্রতি। অসুখের জন্য সব কেন ভুলে গেল সবাই?”

“এসবই নিয়তি বাবা। ভুলে যা ওসব। তোর পিতা সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো। সকলের অগোচরে লুকিয়ে রেখেছিলো যেন আমার দ্বারা আর কারোর প্রাণহানি না ঘটে। কোনো নৃশংসতা না ঘটে। সাম্রাজ্যের মানুষের সুরক্ষায় এটা করা জরুরী ছিলো। কেননা আমি আর সুস্থ নই। আমি বাইরে থাকলে এতোদিনে হয়তো আরোও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতাম অসুখে বশীভূত হয়ে। কিন্তু সে আমার বন্ধু ছিলো, আছে, আগামীতেও থাকবে। তোর বেগমের কী হয়েছে? রক্ত কেন ওর শরীরে?”

“শত্রু আক্রমণ করেছে। বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন এগুলো। আজকাল আর আপনাদের মতো দৃঢ়, বিশ্বস্ত বন্ধু কী আর পাওয়া যায়? সবই ছলনা! প্রতারণা!”

ঘৃণার দৃষ্টিতে আরোও একবার পরখ করলো মাহতাবকে। মাথা নত করে রেখেছে মাহতাব। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এতোগুলো বছর পর ওর আব্বাজান ফিরে এসেছে। যাকে সে এতো বছর মৃত ভেবে এসেছে। সেই আব্বাজান আজ ফিরে এসেছে! যার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সে এতো এতো পাহাড়সম অপরাধে লিপ্ত হয়েছে সেই আব্বাজান আজ অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে। যার বিহনে এতো বছর নিজেকে অনাথ ভেবে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে, যাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার অপরাধে এই সাম্রাজ্যের ধংসে নেমেছিলো ও, সেই আব্বাজান ফিরে এসেছে। এখন কী জবাব দেবে ও? জুঁইকে ও নিজ হাতে হত্যা করেছে একথা কি আব্বা বিশ্বাস করবে? জুঁইয়ের লাশ দেখে কি আব্বাজানও মুখ ফিরিয়ে নেবে ওর থেকে। ওকে ঘৃণা করবে!

আজও ও ভোলেনি সেই নিষ্ঠুর, কালো দিন। ওর বালক বয়সের বন্ধু ছিলো জাইন, শাহজাইন। তখন অবশ্য ওর নামের শুরুতে সুলতান যুক্ত হয়নি। শেহজাদা ছিলো। ওর পিতা আর জাইনের পিতা দু’জন কাছের বন্ধু হওয়ার সুবাদে ওদের মাঝেও সখ্যতা বেড়ে ওঠে। দু’জনের একসাথেই বেড়ে ওঠা। ওর আব্বাজান ওদের দু’জনকেই খুব ভালোবাসতো। নিজ হাতে শেখাতো অস্ত্রবিদ্যা। যুদ্ধ কলাকৌশল আব্বাজানই শিখিয়েছিল ওদের। ওর আব্বা শুধু সৈনিক প্রধান নয়, এই সাম্রাজ্যের সাবেক সুলতান শাহজিলের পরম বন্ধুও ছিলো সে। দুই বন্ধুর মাঝে ভারী ভাব ছিলো। সবসময় দু’জন একসাথে শিকারে যেতো জঙ্গলে। তারপর দুই বন্ধুর গৃহ আলো করে দুই পুত্র সন্তান হলো। মিলিয়ে নাম রাখা হলো আজমাইন আর শাহজাইন। তারা যখন বালক বয়সে পদার্পণ করলো তাদের মাঝেও বেশ ভাব হয়ে গেছে ততদিনে। দু’জন দু’জনকে কাছের বন্ধু মেনে নিয়েছে। তাদের আব্বাদের সাথে তারাও শিকারে যাওয়া শুরু করলো। জাইন ওর আব্বাকে চাচা বলে ডাকতো। আব্বাও ওকে নিজের পুত্রের মতোই সোহাগ করেছে সবসময়। হঠাৎ এক নির্মম দিন এলো ওদের জীবনে। শিকারে গিয়েছিল ওরা চারজন। আব্বাদের পেছনে ছিলো ওরা দু’জন। হুট করে এক আজব ধরনের অজানা পশু আক্রমণ করে বসে জাইনকে। সেদিন জাইনকে বাঁচাতে গিয়ে সেই পশুর কামর খায় ওর আব্বা। তারপর যদিও মহলে ফিরে এসেছিল ওরা কিন্তু সেদিনের পর থেকে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত অসুখ করলো ওর আব্বাজানের। সেই অসুখের বশীভূত হয়ে ওর সাহসী, বীর আব্বাজান পরপর কয়েকজন সৈনিককে হত্যা করে ফেলল। সৈনিক প্রধান থেকে হয়ে গেল খুনী! হায় নিয়তি! হুঁশ হারিয়ে তাদের শরীর খুবলে রক্ত পান করলো। যার শাস্তিস্বরূপ তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো। হুট করে হারিয়ে গেল ওর আব্বা। সকলে বলল, এমন কুখ্যাত অপরাধীকে নাকি গোপনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এসবের কারনে ওর ছোট্ট মস্তিষ্কে প্রভাব পড়লো। শয়তান বাসা বাঁধলো। আব্বার মৃত্যুর কারন হিসেবে ও সবসময় শাহজাইনকে দায়ী করে এসেছে। কেননা সেদিন ওকে না বাঁচাতে গেলে এমন কিছুই হতো না। তারপর আব্বার মৃত্যুর পর সুলতান শাহজিল হলো ওর দ্বিতীয় শত্রু। এই সাম্রাজ্য ধংস করাটাই ওর একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। মহল ছেড়ে ও পালিয়ে চলে গেল নিজ সাম্রাজ্যে। দক্ষিণী সাম্রাজ্যে। ওর একাকী, অনাথ জীবনের কষ্টে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠলো বালক মাইন। সেই প্রতিশোধের নেশায় কী না করেছে ও! কত কত অপরাধ করেছে! সেই আব্বাজানকে আজ সুলতান শাহজিল নিজেই হাত ধরে নিয়ে এলো। সুলতান শাহজিল মারেনি তার আব্বাকে। বাঁচিয়ে রেখেছিলো সকলের অগোচরে। সুতরাং ওর সমস্ত প্রতিশোধ বৃথা, মিথ্যে, অযথা ছিলো। ঘোর অন্যায় করেছে ও। কেউ জানতে চাইলে কী বলবে ও? যেই মানুষটা বেঁচে আছে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ ও নিয়েছে? ছিহ!

“শত্রু? কে? কার এতোবড় সাহস?”

আব্বাজানের প্রশ্নে চোখ খিচে বন্ধ করে রইল মাহতাব। নিজের মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না ও। সুলতান নীরব রইল। সে জানে না আজকের এই আজমাইন মাহতাবই ওর বালক বয়সের বন্ধু মাইন। তবুও কেন যেন বলতে পারলো না তার অপরাধের হিসেব। অথচ দ্বারে দাঁড়ানো সৈনিকেরা নির্দ্বিধায় দেখিয়ে দিলো মাহতাবকে।

মাহতাব টের পেলো আব্বাজান ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। এখন তো ওর জাপটে জড়িয়ে ধরার কথা নিজের আব্বাকে। অথচ ও ঠাঁই বসে রইল চোখ খিচে। নিজের করা অপরাধ, হিংস্রতা ওকে দমিয়ে রাখলো। উঠতে দিলো না। চোখ মেলাতে দিলো না আব্বাজানের সাথে। কেউ যেন পাহাড় চাপিয়ে দিয়েছে ওর উপর। হঠাৎই সজোরে থাপ্পড় খেয়ে হেলে পড়লো মাহতাব। অবাক, ছলছল চোখে ফিরে তাকালো আব্বাজানের দিকে। লোকটা রাগী চোখে চেয়ে আছে। সে কী এখনো জানে না এই শত্রুই তার একমাত্র পুত্র আজমাইন? হাহ! নিজের পিতা চিনছে না! এই দুর্ভাগা জীবন কেন পেয়েছিলো মাহতাব? যেখানে নিজের ভালোবাসাকে অন্যের স্ত্রী হতে দেখা যায়, তাকে বিধবা হতে দেখা যায়, নিজেকে অনাথ ভাবা যায়? পিতৃহীন থাকতে হয়, অপরাধ, হিংস্রতা, শেষমেশ নিজের ভালোবাসাকে নিজ হাতে বিষ দেওয়া, প্রিয় মানুষের লাশ বুকে তোলা, বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যে প্রতিশোধের নেশায় নিজের পুরো জীবন নষ্ট করে দেওয়া। এই কী জীবন? হ্যাঁ এটাই তো মাহতাবের অভাগা জীবন।

লোকটা রাগান্বিত স্বরে বলল,
“তুমি আঘাত করেছো? তোমার কোলে এই মেয়েটা কে? একেও তুমি আঘাত করেছো? তুমি শত্রু হলে তোমার শরীরে রাজকীয় পোশাক কেন?”

বলতে বলতে ঝুঁকে এসে জারনাবের শ্বাস প্রশ্বাস পরখ করলো। আঁতকে উঠলো।

“মেয়েটা মৃত! মেরে ফেলেছো তুমি ওকে?”

বড় মায়া নিয়ে জারনাবের দিকে চাইল মাহতাব। অসীম শোক সেই চাহনিতে। নিথর মুখটার দিকে চেয়ে কী যে হলো ওর। বুকে রাখা পাথর আরোও ভারী হলো বুঝি! ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। মৃতদেহটা আরোও শক্ত করে ধরলো নিজের সাথে। ছলছল চোখে আব্বাজানের দিকে চেয়ে উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। হ্যাঁ, সেই মেরেছে। লোকটা হতভম্ব হলো।

“কিহ! তুমি মেরেছো! আবার নিজেই স্বীকার করছো? লজ্জা নেই তোমার?”

আর পারলো না মাহতাব। জারনাবের মৃতদেহ বুকে জাপটে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি মেরেছি! আমি মেরেছি আমার ভালোবাসাকে। আমার জুঁই! তুমি জানো, ও আমায় ভালোবাসেনি! ঘৃণা করেছে আমাকে! শাস্তি দিয়েছে, চরম শাস্তি!”

চার দেয়াল বারবার, শতবার প্রতিধ্বনিত হলো,

“আমি মেরেছি, আমি মেরেছি আমার ভালোবাসাকে।”

“তুমি জানো, ও আমায় ভালোবাসেনি।”

“ঘৃণা করেছে! শাস্তি দিয়েছে, চরম শাস্তি!”

অথচ ওর আব্বাজান আটকে গেল একটা কথাতেই,
“আমার জুঁই।”

সচেতন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো মৃতদেহটা। নাহ, দেখে বোঝার উপায় নেই এটাই সেই ছোট্ট জারনাব কি-না। এ তো পূর্ণাঙ্গ এক নারী। ছোট্ট সেই জারনাব, যাকে তার আজমাইন বড় আদর করে জুঁই ডাকতো। গলা ফাটিয়ে বলতো,
“বড় হয়ে আমি আমার জুঁইকেই বিয়ে করবো। তুমি মানবা না আব্বাজান?”

লোকটা বিড়বিড়িয়ে ভীত স্বরে শুধাল,
“জারনাব?”

“না না, আমার জুঁই ও। তুমি দেখো আব্বা, ও আমারই জুঁই। অভিমান করে ঘুমিয়ে গেছে। এখন যদি আমি ওকে বিয়ে করি, তুমি মানবা না আব্বাজান?”

আর্ত চোখে তাকালো লোকটা। আব্বাজান! কর্ণগহ্বর ঝলসে যায় সেই ডাকে। এ কি তার আজমাইন? আজমাইন নাকি শত্রু? কোন পদবি দেওয়া উচিত মস্তিষ্কে খেলল না। কাল কুঠুরিতে এতো বছর থেকে মস্তিষ্ক ক্ষয়ে গেছে বোধহয়।

প্রকৃতিও কি নিঠুর খেলা খেলল তখন। পিতা-পুত্রের মধুর মিলনমেলাকে তিক্ত বিষ করে তুলল। শোক, আহাজারিতে ভরা এই মিলন কি কেউ চেয়েছিলো ওরা? উঁহু, কেউ চাইনি। এ যে নিয়তির দেওয়া উপহার! সেসময় চতুর্দিক আরোও একবার স্তব্ধ, শোকাহত করে উচ্চস্বরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাহতাব। মৃতদেহ বুকে জাপটে হাসছে সে। হেসে ফেটে পড়ছে। এ হাসিতে নেই কোনো প্রাণ, নেই উচ্ছাস। আছে কেবল বেদনা আর বিরহ। অধিক শোক বুঝি সইলো না মাহতাবের। জারনাবের দিকে চেয়ে আবারো মুচকি মুচকি হাসছে ও। কখনো লজ্জায় রেঙে উঠছে। সকলে বিস্ফোরিত চোখে দেখে যায় ওর উদ্ভট আচরণ। সাহসী বীরের এই পাগলাটে আচরণে নির্বিকার, হতভম্ব ওরা। মাহতাব উচ্ছাসিত কন্ঠে আবারো বলল,

“আমি ওরেই বিয়ে করবো। তুমি মানবা না? আমি জানি তুমি মানবা। তুমিও তো আমার জুঁইকে ভালোবাসো, তাই না আব্বাজান? বলো? বাসো না?”

নিজের বোধশক্তি কি খুইয়ে বসেছে ছেলেটা? চোখেমুখে কোথাও আর নেই সেই দৃঢ়তা, সেই প্রতিহিংসা। ওর এই উন্মাদনা সকলের মনে ভয় সৃষ্টি করলো। নিজ পুত্রকে এতো বছর পর এভাবে দেখে বেসামাল হয়ে পিছিয়ে গেল লোকটা। হুঁশ হারাবে যেন এখনি। মাহতাবের ভঙ্গিমা তখনও পাগলাটে, উদ্ভ্রান্ত। উদ্ভট ভঙ্গিমায় জারনাবের মাথায় হাত বুলাচ্ছে ও। বিড়বিড়িয়ে কিছু আওড়াচ্ছে। সুদর্শন, শক্তিশালী যুবক এক পলকেই যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। তার এই উন্মাদনা কি ভালোবাসার অকাল মৃত্যুতে? নাকি নিজ হাতে ভালোবাসাকে হত্যা করার অনুতাপে? নাকি অনুশোচনা? তার ঘটানো অযথা সব অপরাধের কারনে অনুতপ্ত ও? আফসোস! বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কোথায় তোমার ভালোবাসা বীর? কোথায় তোমার সততা? তোমার আপনজন? বদ্ধ উন্মাদের আবার কেউ থাকে নাকি? এতো এতো শোক আর ধাক্কা নিতে পারলে না তবে কেমন অপরাধী তুমি? কেমন হৃদয়হীন তুমি? কেমন নিষ্ঠুর তুমি? তোমার তো কিছুই রইলো না। না একুল রইলো আর না ওকুল রইলো। তুমি বীর হয়ে থাকতে চাইলে না আবার একজন অপরাধী হয়েও থাকতে পারলে না। উন্মাদ মাহতাব জারনাবের লাশ জড়িয়ে আবারো বললো,

“তুমি মানবা আব্বাজান। বলো জুঁই? মানবে না? তুমি বললেই মানবে। কথা বলো। বলো কথা। দেখো আব্বাজান তোমার কথা শুনতে চায়। তোমার উত্তর জানতে চায়। তুমিও তো আমাকে বিয়ে করতে চাও, বলো আব্বাকে। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো জুঁই। আমাকে চাও না তুমি?”

হায় অভাগা! বড় নির্মম সেই দৃশ্যপট!

চলবে……..