সরি আম্মাজান পর্ব-০২

0
212

#সরি_আম্মাজান।
#পর্ব- দুই

এসআই শাহরিয়ার ও সাজু ভাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মোহসীন। কাঁদতে কাঁদতে মোহসীন পাগলের মতো হয়ে গেছে। দু-হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো ,
“ আমি এখন ভাইয়া আর আপুদের কাছে কী জবাব দেবো? আমার মাকে এভাবে কেন হত্যা করলো? মা তো কারো ক্ষতি করতে আসেনি। আমরা তো আজই চলে যেতে চাইছিলাম। ”

সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। কিছু প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে আসে ঠিকই কিন্তু সেগুলো জবাব পাওয়া যায় না। জবাব অদৃশ্য। সুপ্ত।

সাজু কুষ্টিয়া এসেছে আজকে সকালে। নিজেরা চার বন্ধু মিলে ঘুরতে আসা।
সাজু, নোমান, সাগর আর বখতিয়ার। নোমানের ফুফাতো ভাই এসআই শাহরিয়ার এখানেই পোস্টিংয়ে আছেন। তাই এসেই একদিনে চলে যাবার তাড়া ছিল না। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রাতে এসআই শাহরিয়ারের বাসায় থাকার কথা ছিল তাদের। ছিলও তাই।

বাড়িতে মেহমান ছিল বলে থানা থেকে ছুটি নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরেন৷ সন্ধ্যার পরে সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে তখন শাহরিয়ারের মোবাইলে কল আসে। জানা যায় কুঠিবাড়ির কাছেই কোন বাড়িতে নাকি এক মহিলা খুন হয়েছে। এখনই যেতে হবে তাকে।

কথাটা বলতেই সাজু বলেছিল, চলেন আমরাও সঙ্গে যাই। আপনি থানায় গিয়ে টিম নিয়ে আসেন আমরা একসাথেই যাবো৷

মুন্সি বাড়িতে আসার পরে দেখা যায় ইতিমধ্যে গ্রামের মানুষের ভিড় জমে একাকার। প্রাথমিক জিজ্ঞেসায় মোহসীনের ছোটমামা বললেন ,

“ উনি আমার বোন। চল্লিশ বছর পরে আজকে গ্রামে ফিরেছেন। হঠাৎই কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছেন। ”

রাত নেমেছে চিলেকোঠার এই ঘরে। কালো রাত নেমেছে চারিদিকে। কিন্তু আলো যেন হারিয়ে যায় অন্ধকারের ভেতর। আকাশের শেষ রক্তিম আভা মুছে গিয়ে রাত তার ছায়া বিস্তার করেছে। ভেজা বাতাসে ঘোরলাগা গন্ধ। যেন কেমন শীতল, অথচ ভারী।

চিলেকোঠার দরজার সামনে মানুষের ভিড় জমে আছে। প্রত্যেকের চোখে অজানা এক ভয়। কেউ মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে, কেউ আবার স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাদের সকলের দৃষ্টি সেই দরজার দিকে, যার ভেতরে মেঝেতে পড়ে আছেন এক মহিলা—মোহসীনের মা।

মোহসীন তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মুখে কোনো শব্দ নেই। তার হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ, চোখ ফাটা বৃষ্টির মতো ঝরছে অশ্রু। চারপাশের শব্দ যেন তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে, মায়ের নিথর দেহের পাশে গিয়ে হাতটা ধরতে পারলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।

পুলিশ জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। তাদের পদচারণায় ছাদ কেঁপে উঠছে। ছাদের বাতাস ভারী হয়ে আছে, যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
মোহসীনের কণ্ঠে আর্তনাদের সুর যেন শব্দের চেয়েও তীব্র হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

সাজু কপালে ভাঁজ ফেলে ছেলেটির দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মায়ের শোকে কতটা কাতর হয়ে বসে আছে মোহসীন। এসআই শাহরিয়ার সাজুর কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছেন।

ঘরের ভেতরে নিস্তব্ধতা। জানালার পর্দা উড়ছে হালকা বাতাসে। মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়ির ভাঁজে দলা পাকানো।
একটি চেয়ার উল্টে আছে, যেন সেখানে কোনো সংগ্রাম হয়েছে। পাশের দেয়ালে অর্ধেক ঝুলে থাকা ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে, ঠিক সন্ধ্যা ছ’টা বেজে চৌত্রিশ মিনিটে। নিশ্চয়ই ধস্তাধস্তি করার সময় ঘড়িটা আঘাত লেগেছে।

সাজু নিঃশব্দে হাঁটছে। জানালার বাইরে ছড়িয়ে থাকা ছোটো ছোটো কাঁচের টুকরো এবং ঘরের প্রতিটি কোণে তাকিয়ে দেখছে। একটা নিঃশব্দ চিৎকার যেন গোটা জায়গাটিকে গ্রাস করেছে।

মোহসীন সেখানেই দাঁড়িয়ে। তার চোখের জল থেমে গেছে, কিন্তু তার ঠোঁট ফিসফিস করছে।
“ মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। ”

এই চিলেকোঠার ঘর শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী নয়। এটি মোহসীনের জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাজু জানেন, এই অন্ধকারে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যা বের করতে হবে। কিন্তু মোহসীনের চোখের সেই যন্ত্রণা—তাকে আজ রাতে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি দেবে না।

চিলেকোঠার ঘরটা পুলিশ ক্লিয়ার করে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় শাহরিয়ার ও সাজু ভাই। তাদের পিছনে সালেক মুন্সি, সামনেই মায়ের লাশের পাশে বসে কান্না করছিল মোহসীন।
সাজু এক দৃষ্টিতে লাশের দিকে তাকিয়ে রইল। শাহরিয়ার বললো ,
“ কেমন নিষ্ঠুর জগতের মানুষ তাই না? ”
“ হ্যাঁ। এমন বয়সী মহিলাকেও গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করলো ভাই। ”
“ মনে হয় জায়গাজমি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। ”
“ কিন্তু হুট আসতেই মেরে ফেলবে? ”
“ এই বাড়ির কারো সঙ্গে কথা বলে সত্যিটা জানা যাবে না। আগে ওনার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি। আসল কাহিনি কি বোঝার চেষ্টা করে দেখা যাক। ”

সাজু বললো “ সদ্যই যার মা মারা গেছে তার কাছে এতকিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে ভাই? ”

“ জিজ্ঞেস করে দেখি, ওনারা আসার পরে কারা কেমন ব্যবহার করেছে সবকিছু জানা দরকার তাই না? তাহলে তো বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে। ”

মোহসীনকে জিজ্ঞেস করতেই সে কথা বলতে রাজি হলো৷ কিন্তু শুরু করার আগে একবার এদিক সেদিক তাকাতেই শাহরিয়ার মনের ভাব বুঝতে পারে।
ঘরের সবকিছু ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর মোহসীনের মায়ের লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্য সেখান থেকে বের করা হয়।

শাহরিয়ার বললো, “ লাশ পোস্টমর্টেম শেষে সবকিছু জানতে পারবো আশা করছি। খুনিকে ধরতে বেশি কষ্ট হবে না মোহসীন সাহেব। ”

মোহসীন দাঁড়িয়ে ছিল।
সাজু বললো , আমরা কি জানতে পারি আজ কি কি ঘটেছে আপনাদের সঙ্গে? ”

সাজু ভেবেছিল মোহসীন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেল মোহসীন সেই সকালে রওনা দেবার পর থেকে সম্পুর্ণ ঘটনা বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। নিজের মায়ের কিছু অতীত ইতিহাসও তুলে ধরেছে।

সবটা বলে মোহসীন দাঁড়িয়ে আছে একধরনের অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। তার ২৯ বছরের শক্ত চেহারা এই মুহূর্তে যেন ভেঙে পড়েছে। চোখ দুটি লাল, ঠোঁট কাঁপছে। তার বুকের ভেতর যন্ত্রণার ঝড় উঠলেও মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু ফিকে আলোয় তার হাতের চেইনের লকেটটায় ভেসে উঠছে তার মায়ের মুখ।
সাজু তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে মোহসীনের জন্য গভীর মমতা, কিন্তু মুখে সেই দৃঢ়তা যা একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দার প্রয়োজন। ধীরে ধীরে তিনি হাত রাখলেন মোহসীনের কাঁধে।

“ মোহসীন! ”
সাজুর কণ্ঠ গভীর, কিন্তু নরম। “ আমি জানি, এমন সময় কোনো কথাই যথেষ্ট নয়। মায়ের মতো মানুষ হারানোর যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু মনে রেখবেন, তিনি আপনার কাছে সবসময় বেঁচে থাকবেন। আপনার স্মৃতিতে, আপনার জীবনের প্রতিটি কাজের মধ্যে। ”

মোহসীন তার মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে ফেলল, কিন্তু মুখ তুলে তাকাল না।
সে নিচু গলায় বলল, “ কেন? কেন এমন হলো? মা আমার কাছে সব ছিলেন। কেন তাকে কেউ এভাবে কষ্ট দিল? ”

তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত অসহায়ত্ব ঝরে পড়ল।
সাজু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“ জানি, উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়া আপনার জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই উত্তর বের করাই আমাদের কাজ। আমরা আপনার মায়ের খুনিকে বের করবো ইন শা আল্লাহ। ”

মোহসীন চোখ মুছে নিল। তার মুখের অভিব্যক্তিতে একটি ছায়া দেখা গেল—অসহায়ত্ব আর ক্রোধের মিশ্রণ।
“ তোমার কথা ঠিক হতে পারে। কিন্তু আমার মাকে আমি সুবিচার দিতে চাই। যেই এটা করেছে তাকে শাস্তি পেতে হবে। ”

সাজু তার কাঁধে চাপ দিয়ে বললেন,
“ আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনার মা যে সুবিচার পাওয়ার যোগ্য, সেটি তাকে অবশ্যই দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সুবিচার পেতে হলে আপনাকেও আমাদের পাশে থাকতে হবে। সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই ঘর আর এই রাতের গল্পে। আমরা সবাই মিলে সেটি বের করব। ”

মোহসীন মাথা নাড়ল। তার চোখে ধীরে ধীরে ফিরে এলো দৃঢ়তা। মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর সুবিচারের সংকল্প যেন তার ভেঙে পড়া সত্তায় নতুন করে শক্তি জাগিয়ে তুলল।

সাজু আবার ঘরের দিকে তাকালেন। চারপাশের নিস্তব্ধতার ভেতর যেন তাদের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ঘর কেবল একটি অপরাধের দৃশ্য নয়; এটি এখন মোহসীনের মায়ের স্মৃতির শেষ ছোঁয়া আর তার সুবিচারের শপথের সাক্ষী।

সামনেই মোহসীনের দুই মামা দাঁড়িয়ে আছে। এসআই শাহরিয়ার মালেক মুন্সি ও সালেক মুন্সির দিকে তাকিয়ে বললেন ,

“ সবার আগে সন্দেহের তালিকায় আপনারই থাকবেন। ”

সাজু এগিয়ে যায় কল্পনার সামনে। সালেক মুন্সির বউ ও পুত্রবধূ কল্পনা দুজনেই নিচে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেখানে গিয়ে সাজু তাদের উদ্দেশ্যে বললো ,
“ সন্ধ্যার একটু আগে ছাদে ওঠার সময় দোতলায় দাঁড়িয়ে আপনাদের সঙ্গে মোহসীনের মায়ের কথা-কাটাকাটি হয় এটা কি সত্যি? ”

কল্পনা ও সালেক মুন্সির স্ত্রী একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারা এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কল্পনা বললো ,
“ হ্যাঁ সত্যি। ”

সাজু বললো “ আপনার স্বামীর মৃত্যুর জন্য আপনি এবং আপনার শশুর শাশুড়ী সবাই মোহসীনের মা’কে দায়ী করতেন এটাও কি সত্যি? ”

কল্পনা ও সালেক মুন্সির স্ত্রী আবারও অবাক হলো। এই অচেনা মানুষটা এতকিছু কীভাবে জানে? সাজু তাদের নীরবতা দেখে বলে ,

“ চল্লিশ বছর ধরে যার কোনো খোঁজ জানেন না। কিন্তু নিজের সন্তানের মৃত্যুর জন্য তাকেই কেন দায়ী ভাবতেন বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু খুলে বলবেন? ”

চলবে…

ইন শা আল্লাহ , বইমেলা ২০২৫ এ আমার যে বইটা প্রকাশিত হবে সেই বইয়ের প্রচ্ছদ আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায় প্রকাশ করা হবে।

কেমন হয়েছে জানাবেন। কাহিনী সাজাতে গিয়ে একটু এলোমেলো হতে পারে। আগামী পর্বে গুছিয়ে নিয়ে আসবো৷
মন্তব্য করতে ভুলবেন না কেউ।
বানান ভুল হতে পারে, ক্ষমা করবেন।

লেখা-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)