সর্বনাশিনী পর্ব-১৩

0
489

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-১৩

জমকালো এক সন্ধ্যা…চারিদিকে রঙিন আলোয় আরো মনোরম পরিবেশ করে তুলেছে। লাভ ফ্যারি এই বিশাল বড় রেস্টুরেন্টে হাই ক্লাস সোসাইটির মানুষজনের আনাগোনা। সকলেই আসে তাদের যুগল নিয়ে। কেউ আসে একাকীত্ব দূর করার জন্যে । আবার কেউ আসে ভোজন উপভোগ করতে। এমনি একটি জায়গায় এ-সময় বসে আছে স্নেহা। হাতের ঘড়িটি বার বার দেখে যাচ্ছে। আকৃতার মা-বাবা এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়েছে এখানে কি এক সারপ্রাইজের জন্য। এদিকে তারুন আউট ওফ টাউন…. হাজারটা কল করেও পায়নি তারুনকে । স্নেহা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ঘড়ির কাঁটাটি এবার আটটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। স্নেহা বিরক্তিবোধ করছে খুব। কে এমন আসবে তাকে সারপ্রাইজ করার জন্য, কার জন্যই বা তার এত অপেক্ষা?? মনের কনে পরক্ষণেই প্রশ্ন উঠলো,

” আকৃতা শেখের কোনো বয়ফ্রেন্ড, টয়ফ্রেন্ড নেই তো? বা কোনো বাগদত্তা? এই জন্যই কি মা এখানে পাঠিয়েছে? তারুন ভাইয়াতো তেমন কিছু উল্লেখ্য করে নি? ”

কিছু মুহূর্তেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো স্নেহার। স্নেহে এই মুহুর্তে কি করতে পারে? কি করবে সে?? কোনো রকম ব্যাগ হাতে নিয়ে ছুটে বেড়িয়ে যাবার জন্য উঠতেই কেউ একজন হাত টেনে ধরলো পিছন থেকে।

” হেই বিউটিফুল, ইউ মিস মি?”

স্নেহা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সামনের মানুষটিকে দেখে তার চোখ কৌটো থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। এখনকার যুগের পপ সিঙ্গার মাহাদ জেইন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, সুদর্শন যুবক বাস্তবে যেন আরো সুন্দর। স্নেহা যেন হারিয়েই যাচ্ছিলো লোকটির রূপের মায়াজালে।

” হেই, কোথায় হারিয়ে গেলে?”

স্নেহার চোখের সামনে চুটকি বাজিয়ে,ঠোঁটের কোনে মুচকি হেসে বলল কথাটুকু মাহাদ। স্নেহার যেন এবার ধ্যান ফিরলো। বলল,

” আপনি? আপনি কে..!”

মাহাদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

” কামওন বেব্স! পাঁচ বছর আগে পাত্তা দেইনি বলে এখনো না চিনার ভান করছো? আই নো কতটা পাগল ছিলে তুমি, আমার পিছনে। আর এখন এমন ভাব করছো? আমাকে চিনোই না?”

মুখ গুমরো করে ফেললো এবার মাহাদ। স্নেহার হাত ছেড়ে চেয়ারে আরাম করে বসলো। এক দৃষ্টিতে স্নেহার শরীরের আগা গোড়া খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরখ করে নিলো। স্নেহার অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে মনে কথা গুলো ঘুছিয়ে নিলো সুন্দর করে তারপর গড়গড় করে স্বগোক্তির মতো বলল,

” সরি মিস্টার মাহাদ আমি আপনাকে সত্যি চিনতে পারছি না, টিভির একজন সেলিব্রেটি বৈকি আমার মস্তিষ্ক আর কোনো ডাটা নেই, ঠিক যেমনটি আপনি বললেন।”

মাহাদ হো হো করে হেসে ফেললো। স্নেহার হাতটুকু টেনে পাশের চেয়ারটিতে বসালো অনেকটা জোর করে। তারপর বলল,

” আ’ম সরি। বাট তুমি সত্যি আমাকে ভুলে গেছো? নাকি মিথ্যা বলছো, বাহানা মারছো আমার সাথে রাইট? ”

এতটুকু বলেই আবার সাথে সাথে মুখে ভাব সিরিয়াস করে ফেললো। দু হাতের মুঠোয় ভরে নিলো স্নেহা মুখমন্ডল। বলল,

” আকৃতা, লুক.. আমি সত্যি পাগল ছিলাম, তোমার ভালোবাসাটা বুঝিনি, প্লিজ ফোরগিভ মি। জানো আমি এই পাঁচটি বছর তোমার অপেক্ষা করেছি, আন্টি যদি আমায় না জানাতো তুমি ফিরে এসেছো, আমি হয়তো জানতেই পারতাম। যা হয়েছে সব পিছে ফেলে, চলো এবার নতুন জীবন শুরু করি আমরা!”

বলেই মাহাদ জড়িয়ে ধরলো স্নেহাকে। স্নেহার সারা শরীর কেমন যেন করে উঠলো। মাহাদের স্পর্শে কেমন যেন অপবিত্র মনে হতে লাগলো। এমনটা তো কখনো হয়নি দিলশাদের স্পর্শে। তাকে মনে প্রাণে ভালোবাসে বলেই কি? স্নেহা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো মাহাদকে। সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” মি. মাহাদ। দূরে থাকুন আমার থেকে আমি আপনাকে চিনি না ব্যস! এর পরে কখনো আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না, আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না।”

বলেই গট গট করে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে। লাভ ফ্যারির বাম পাশ দিয়ে হাটার পথেই বার এরিয়ার সামনে এসে থমকালো স্নেহা। দিলশাদ বসে আছে সেখানে। ড্রীংকস করছে। দিলশাদের চোখ মুখ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। হয়তো কিছু হয়েছে। পরক্ষণেই ভাবলো, যা ইচ্ছে হোক, চুলোয় যাক, স্নেহার কি? আজ এই দিলশাদ আমরিনকে ভালোবেসে সে, ‘সর্বনাশিনী’

স্নেহা দাঁড়ালো না চলে গেলো সেখান থেকে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই আবারো পিছনে ফিরে চাইলো একবার। একি, লোকটি তো পরেই যাচ্ছে, যেনো কোনো হুঁশ নেই। স্নেহার আঁধার মনের ক্ষনিকের জন্য আলো নিভে, আবার জ্বলে উঠছে। কি করবে সে? কি করবে? মন বলছে ছুটে যা সাহায্য কর । কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে সাবধান। দিলশাদের বেহাল দেখে স্নেহা মনের কাছে হেরে গেলো। ছুটে গিয়ে ধরে ফেললো স্নেহা। দিলশাদ নেশায় ডুবে।বিড়বিড় করে বলছে,

” স্নেহা, প্লিজ কাম ব্যাক। প্লিজ ফিরে এসো। আমি জানি তুমি মরোনি। তুমি বেঁচে আছো। স্নেহা আই লাভ ইউ,ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি!”

স্নেহার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আটকে গেলো কন্ঠনালীতেই। নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল স্নেহা,

” মি. আমরিন, সামলান নিজেকে।”

দিলশাদ ফিচেল হাসলো। বিড়বিড় করতেই লাগলো। হয়তো নিজের ভাগ্যের উপর ক্ষোভটা বেশিই তার। শুরু থেকে যাকে ভালোবাসলো তাকেই কত ভাবে কষ্ট দিলো কত লাঞ্ছিত করলো । দিলশাদ এবার আর হাটার উপযোগী রইলো না। না পেরে স্নেহা লাভ ফ্যারির একটি রুম বুক করলো। দিলশাদকে রুমটিতে নিয়ে গিয়ে শুয়ে দিলো। ফর্সা মুখের আদল খানা লাল টুকটুকে হয়ে আছে দিলশাদের, চোখ গুলোও যেন রক্তবর্ণ। নিজেকে এভাবে টর্চার করে দিলশাদ কি প্রুভ করতে চাইছে? সে দেবদাস হয়ে গেছে? পারুলের জন্য নাহ্ স্নেহার জন্য? এই ভালোবাসাটুকু কই ছিলো তখন? যখন স্নেহাকে কষ্ট দিতো দিলশাদ। স্নেহা দিলশাদের মায়াবী মুখ দেখে তার হু হু করে কান্না পেলো। মনের অজান্তেই চোখ জোরা পানি টলমল করিয়ে বড় বড় পানির ফোয়ারা ছিটকে পড়লো। স্নেহার কষ্ট হচ্ছে খুব, সে যে দিলশাদকে কষ্ট দিয়ে খুব খুশি? তা মোটেও না… স্নেহা হা করে দম ছাড়লো। দিলশাদের জুতা জোড়া খুলে ভালো করে চাদর টেনে দিলে। কিছু পলক তাকিয়ে থেকে দু কদম এগিয়ে যেতেই আবার থমকালো, এবার নিজে থেকে নয়। দিলশাদ আটকিয়েছে তাকে। স্নেহার মসৃণ হাত চেপে ধরে কাতর কন্ঠে বলছে,

” স্নেহা, আমি মারা যাচ্ছি, আমাকে একা ফেলে যেও না। আই নিড’স ইউ। ”

স্নেহা ফুপিয়ে উঠলো। এইটুকুন ভালোবাসাই তোর চাওয়ার ছিলো। কই তখন তো পায়নি স্নেহা। স্নেহা হাত ছাড়িয়ে নিয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু হলো না কোনো লাভ। হেঁচকা টানে দিলশাদ স্নেহাকে তার বুকের উপর ফেললো। শক্ত করে চেপে স্নেহার নরম ঠোঁট গুলো নিয়ে নিলো নিজের ঠোঁটের আয়েত্তে। স্নেহা ছুটোছুটি করলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নিবার বৃথা চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। এদিকে দিলশাদ পাগলের মতো চুম্বন করে যাচ্ছে স্নেহা ঠোঁটে, গলায়, গালে। এমন কি দিলশাদের প্রতিটি ভালোবাসার ছাপ রেখে যাচ্ছে স্নেহার লতানো দেহে।

সময় পার হতে লাগলো। আজকের রাতটুকু স্নেহার জন্য ছিলো, অকল্পনীয়। লাভ ফ্যারির এই রুমটি আজ সাক্ষী স্নেহা আর দিলশাদের ভালোবাসার মুহুর্ত গুলোর। দিলশাদ ঘুমিয়ে আছে। খালি পিঠে স্নেহার নখের আচারের দাগ দৃশ্য মান। স্নেহা পাশেই বসে ঘুমন্ত রাজকুমারকে দেখলো। লোকটি হুঁশে ছিলো না, তবুও তার শক্তিতে স্নেহা পেরে উঠেনি। স্নেহা এবার নিজের কাপড় গুলো পড়ে নিলো। কেনো যেন আজকের এই সময়টুকু নিয়ে স্নেহার মনো কোনো অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে না। না সে পস্তাচ্ছে। তবে হে মুসাফির যখন অনেক দিনের তৃষ্ণার পর পানি পেয়ে যেমন সন্তুষ্ট লাভ করে? স্নেহা ঠিক তেমনি অনুভব করছে। লোকটি চাইলেও সে মন থেকে ঘৃণা করতে পারে না… আবার ক্ষমাও করতে পারে না….! স্নেহা ঘন কালো আকাশের দিকে চাইলো। হয়তো আজকের রাতটুকুর কথা দিলশাদের মনেও থাকবে না।

———

স্নেহা অনেক দিন পর আজ সেহেরের কাছে এসেছে। সেহেরের অবস্থা খুব বেশি একটা ভালো না। স্নেহা তার শর্ত আবারো রিপিট করতেই সেহের রাজি হয়ে যায়। ফট ফট করে সব বলতে থাকে শুরু থেকে করে চলা স্নেহার সাথে সকল অত্যচার সব কিছু, সব কিছু স্বীকার করে সে। এদিকে দিলশাদের মা বিন্দুর হোস ফিরেছে। দিলশাদের পরিবারের সকলেই ছুটে চলে এসেছে হসপিটালে। বিন্দুকে আগের মতো স্বাভাবিক দেখে তারা খুশি। ঠিক সেই মুহূর্তে বিন্দু প্রশ্ন করে উঠে এদিক সেদিক তাকিয়ে,

” দিলশাদ… স্নেহা .. স্নেহা কই?,, ঠিক আছে তো,?”

চলবে,