#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১৮
ঢাকা শহরের মাটিতে পা দিতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে স্বাগতম জানালো স্নেহাকে। পাশেই তার ছোট লুবান। মাকে এভাবে বৃষ্টির পানি হাত-পা নাড়িয়ে উপভোগ করতে গেছে নাক ছিটকালো। খানিকটা বিরক্তি হয়ে মাকে তার গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” মমি পানি দিয়ে খেলছো কেন? তুমি কি বাচ্চা? ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার, স্টপ প্লিজ!”
স্নেহা ফিক করে হেসে দিলো। ছেলের সামনে হাটু গেড়ে বসে গাল টেনে বলল,
” এইটা আমার জম্মভূমি লুবান, আর এখানে পা রাখতেই প্রকৃতি আমাকে কিভাবে স্বাগতম জানালো দেখছো? ”
লুবান মায়ের কথা বুঝলো না। কঁপাল কুচকে রইলো শুধু। এর পর তার একটি ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো। যেতে লাগলো নিজ গন্তব্যে। যাওয়ার পথেই একটি বড় আলিশান বাগকন বাড়ি দেখে লুবান চেচালো,
” মমি দেখো, কত সুন্দর বাড়ি। বড় হয়ে আমি কাজ করে তোমাকে ঠিক এমন একটি বাড়ি গিফট করবো। ”
স্নেহা তাকালো। চোখে মুখে মেদুর ছায়া। একবার ইচ্ছে করলো লুবানকে বলতে,
” লুবান, এটি তোমার পিতার বাড়ি!”
স্নেহা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো। নাহ্! স্নেহা বলবে না। দিলশাদ যদি কেড়ে নেয় তাকে? স্নেহা তো সব সম্পর্ক ছিন্ন করেই পাড়ি জমিয়েছিলো অন্য শহরে, অন্য দেশে, অন্য পরিবেশে। স্নেহা অতীতের পাতায় ঢুবে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে বুদবুদ আর ফটফট শব্দ করেই গাড়িটি থেমে গেলো আমরিন ভিলার পাশেই। স্নেহা হতাশার শ্বাস ছাড়লো,
” এখানেই থামতে হলো?”
লুবান খুশি হলো। ধৈই ধৈই করে নেচে উঠে বেড়িয়ে গেলো গাড়ি থেকে। স্নেহা পুরাই স্তম্ভিত। কিছু বুঝার আগেই তার বাচ্চা ছেলেটি একে বারে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছুটে গেলো আমরিন ভিলার সামনেই। স্নেহা কিছুতেই বুঝতে পারছে না তার এই পুচকে ছেলেটি গম্ভীররূপ কোথায় হাড়িয়ে গেলো?
সময়টা সকাল। চারিদিকে সোনালী আলোয় ঝলমল করছে। সূর্যের কিরণ এসে ভিলায় পড়তেই তা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। সামনেই বড় ঝর্ণা থেকে পানির ফোয়ারা ছিটকে পড়ছে।দু’পাশের বাগানে শত শত ফুল। ঠিক তার উল্টো পাশেই ছোট একটি প্লে গ্রাউন্ড বানানো। ছোট লুবানের স্বপ্ন এমন একটি বাড়ি হবে, তার পাপা-মমির সাথে থাকবে এমন একটি বাড়িতে। লুবান আমরিন ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” মমি, কত সুন্দর তাই না!”
স্নেহা চাপা হাসলো। পাশেই একটি সুপার শপ দেখে ছেলে টেনে নিয়ে গেলো সেখানে। বলল,
” চল তোমার নানু আর নানা ভাইয়ার জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসি। ”
লুবান মাথা নাড়লো। মায়ের সাথে সাথে চলতে লাগলো। ভিতরে ঢুকেই লুবান বলল,
” মমি আমি একটু ঘুরে দেখছি।”
স্নেহা মাথা নাড়লো,
“ঠিক আছে, তবে বেড় হবে না শপ থেকে।”
“ওক্কে”
লুবান তার ছোট ছোট পায়ে হেঁটে যেতে লাগলো।খেলনার লাইনে এসে থামতেই, তার বয়সি এক বাচ্চা মেয়েকে লাফা- লাফিয়ে করছে, একটি পুতুলকে ধরার চেষ্টা করছে। লুবান অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে নিজেই পেরে মেয়েটিকে দিলো। মেয়েটি বাচ্চা পুতুলটি পেয়ে খুব খুশি। এতটাই যে ওকে ঝাপটে ধরে চুমু খেতে লাগলো। তা দেখে লুবান বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। এবং পিছনে ফিরে যেতেই মেয়েটি চেচিয়ে ডাকলো,
” ভাইয়া, তোমাক ধন্যবাদ। ”
লুবান পিছনে না ফিরেই বলল,
“ওয়েলকাম!”
লুবান চলে যেতে নিয়ে আবারো পিছনে ফিরে চাইলো। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মুখের আদলে হাত বুলালো। বিড়বিড় করে বলল,
” মেয়েটির সাথে আমার চেহারার এতো মিল কেন?”
লুবান আবারো পিছনে ফিরতেই মেয়েটিকে আর পেলো না। সে খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে হুট করেই কিছু একটার সাথে বেজে নিচে পড়ে যেতে নিতেই কেউ একজন ধরে ফেললো। বলল,
” তুমি ঠিক আছো? এভাবে হাটছো কেন? এখনি ব্যথা পেতে।”
লুবান লোকটির বুকের সাথে জড়িয়ে ছিলো। লুবানের বাচ্চা মনে কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো না চাইতেও লোকটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ ছোট লুবানের চোখের কোনে জল টলমল করতে লাগলো। কাঁদো কাঁদো মুখ করে মিনমিন করে বলল,
“পাপা!”
দিলশাদের কেমন জানি অনুভব হলো। বাচ্চা ছেলেটিকে তার খুব আপন মনে হতে লাগলো। অন্য দিকে, লিলিয়ান দোকানদার লোকের সাথে ঝগড়া করছে,
” আমার এই পুতুল চাই!”
” টাকা দাও নিয়ে যাও!”
” টাকা নেই!”
” তাহলে পুতুল নিতে পারবে না!”
” প্লিজ দেন, টাকা পাপা দিবে!”
” পাপা কই?
” অফিসে!”
” তাহলে পাপার সাথে এসো এখন যাও!”
লিলিয়ান ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। পুতুলটি দোকানদার হাতে নিতেই এক চিৎকার দিলো। দোকানদার হতভম্ব। লিলিয়ান এবার হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। স্নেহা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাচ্চা মেয়েটির চিৎকার শুনে কাছে জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে আম্মু কাঁদছো কেনো?”
মেয়েটি স্নেহাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরে ফেলো। বার বার স্নেহাকে বললতে লাগলো,
” মমি, মমি। ”
স্নেহার মায়া লাগলো। আহারে কত সুন্দর বাচ্চা মেয়েটি যেন একটি পুতুল। স্নেহা মেয়েটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলতে লাগলো,
” কাঁদে না আম্মু কি চাই তোমার বলো?”
লিলি পুতুলটি দেখালো। যা দোকানদারের হাতে। স্নেহা আলতো হেসে বাচ্চা মেয়েটিকে পুতুল কিনে দিলো। লিলি তো মহা খুশি। সে তার পুতুলকে জড়িয়ে ধরে স্নেহাকে বলল,
” থ্যাঙ্ক ইউ মমি, তুমি এত ভালো!”
স্নেহা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। তারপর লিলিকে আদর করে কোলে তুলে বলল,
” তোমার নাম কি বাবু?”
লিলিয়ান পুতুলের সাথে খেলতে খেলতে বলল,
” মমি লিলিয়ানের নাম ভুলে গেছো?”
স্নেহা থমকালো। নামটি শুনে। তার মনে পড়লো স্নেহার বাচ্চা পেটে থাকা কালীন ভেবেছিলো, ছেলে হলে লুবান আর মেয়ে হলে লিলিয়ান নাম রাখবে। কিন্তু তার ছেলে হলো তাই লুবান রেখেছে। তবে ইচ্ছে ছিলো যদি তার মেয়ে হয়, তাহলে সে এই নামটি রাখবে। কিন্তু আফসোস, আর এমন হবার নয়। স্নেহা বলল,
” লিলিয়ান? তোমার নাম কে রেখেছে?”
” পাপা!”
স্নেহা মুচকি হেসে বাবার জিজ্ঞেস করে,
” তুমি এখানে কার সাথে এসেছো?”
” একাই!”
” তোমার বাসা কোথায়?”
লিলিয়ান তার ছোট ছোট আঙ্গুল তুলে স্বচ্ছ কাচের বাহিরে আমরিন ভীলার দিকে। বলল,
” ওটা আমার বাড়ি।”
স্নেহার বুকে ছেদ করে উঠলো। দিলশাদের মেয়ে নাতো? স্নেহা মনের কোনে জাগ্রত হওয়া প্রশ্ন গুলো দমিয়ে রাখতে পারলো না। জিজ্ঞেস কাঁপা কাঁপা কন্ঠে করলো,
” তোমার.. তোমার বাবার নাম কি?”
লিলিয়ানের ঠোঁটে চওড়া হাসি। সে যেই বলতে নিলো তখনি পিছন থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো,
” লিলিয়ান?”
স্নেহার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। ঠান্ডা শীতল হাওয়ার স্রোত বয়ে গেল গা জুড়ে। ধীরে ধীরে পিছনে তাকালো স্নেহা। এবার যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায়। দিলশাদের সাথে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে লুবান। দিলশাদ কি তাহলে বুঝে গেছে সব? এবার তাহলে স্নেহার কি হবে?? লুবানকে কেড়ে নিয়ে যাবে নাতো দিলশাদ???? স্নেহা কি আবারো নিঃশ্ব হয়ে যাবে? একাকিত্বের গহীন অন্ধকারে মাঝে???
চলবে…