সর্বনাশিনী পর্ব-২০

0
466

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-২০

প্রকৃতি মানুষকে অনেক কিছু শিখায়… তেমনি বাঁচতেও শিক্ষায়। স্নেহাও শিখে গেছিলো। কিন্তু জীবন নামক গোলাক ধাঁধাঁয় আবার কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়লো। স্নেহা দিলশাদের মুখের দিকে চাইলো। ক্লান্ত শ্রান্ত চেহারা। যেন বয়স হঠাৎ করেই দশ বছর বেড়ে গেছে। হেরে যাওয়া একটা মানুষ। একজন পিতা। দিলশাদ স্নেহার বাহু ডোরে শক্ত করে চেপে ধরলো,

” স্নেহা ডোন্ট গো, প্লিজ ফোরভিম মি! ”

স্নেহা অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চাইলো,

” মনে আছে, সেদিন আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে ফেলে না যাতে, পায়ে পর্যন্ত পড়েছিলাম আপনার। আপনি শুনেন নি, তাচ্ছিল্য করে ছিলেন আমায়। আপনার এই ভালোবাসা আমার কাছে, এখন মূল্যহীন!”

দিলশাদ হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। চোখে দুটি ভর্তি জল টলটল করছে, এই বুঝি ঝুপ করে আসা বৃষ্টির মতো ঝড়ে যাবে! স্নেহার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো। তবুও নিজে সামলে নিলো। এত অবহেলা, এত কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে শিখেছে যে স্নেহা। দিলশাদের গলা ধরে এলো। স্নেহার আঙুলের মাঝে বাচ্চাদের মতো হাত দুটো ধরলো। যেন কোনো বাচ্চা বায়না করছে। দিলশাদ বলল,

” স্নেহা, আমি যা করেছি, তার জন্য আমি লজ্জিত। আমি ক্ষমা চাইছি স্নেহা। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।”

স্নেহা ফিচেল হাসলো,

” আচ্ছা করে দিবো ক্ষমা। তবে আপনাকে আমার হারিয়ে যাও সাতটি বছর ফিরিয়ে দিতে হবে। আমার পরিচয়, আমার চেহারা, আমার অস্তিত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। পারবেন? পারবেন দিতে?”

দিলশাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আলতো করেই তুলোর মতো যেন ছুটে গেলো তার হাত। সত্যি তো, দিলশাদ কখনোই পারবে না, কখনোই না। তাহলে কি দিলশাদ আরো একবার হারাবে তার স্নেহাকে? দিলশাদের এবার শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। এই বুঝি মরেই যাবে সে শ্বাসকষ্টে। দিলশাদ মাথা নত করে ফেললো। চোখের জল গড়িয়ে পরছে এবার ফ্লোরে। মুক্ত দানার মতো চিকচিক করছে লাইটের আলোয়। দিলশাদ আর চোখে তাকালো। স্নেহা চলে গেছে প্রায় দরজার কাছে। দিলশাদ নিস্তেজ হয়ে রইলো। ভাঙ্গা গলায় নিস্প্রভ চাহনিতে বলল,

” স্নেহা লুবান আর লিলিয়ানের কথাটা ভাবো?

স্নেহার পা দাঁড়িয়ে গেলো। যতটা কঠোর তার মন দিলশাদের প্রতি হয়েছে অতটা একটি মার মন তো হয় না? চাইলেও করতে পারবে না! তবে.. তবে স্নেহার মনে হচ্ছে এটাও হয়তো নতুন কোনো ফন্দি? স্নেহা তাই পিছনে না ফিরেই বলল,

” আমার একটি মাত্রই সন্তান। তার নাম লুবান। ”

দিলশাদ যতটুকু শক্ত ছিলো, এবার আর তা রইলো না। হেলে পড়লো। তার মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে তাকে কেউ হয়তো লাঠি পিটা করেছে কেউ? স্নেহা সত্যি এতটাই কঠিন হয়ে গেছে? যে নিজের মেয়েকেই চায় না সে? দিলশাদ তার ভাবনার মাঝেই ঢুবে রইলো। স্নেহা স্থান ত্যাগ করলো তাৎক্ষণিক। বুকের ভিতর তারো হাতুড়ি পেটা করছে । মনটাকে হয়তো কেউ কয়েকশ পিস করেছে কেউ কেটে? স্নেহা দৌড়ে এসে দাঁড়ালো লুবান আর লিলিয়ানের রুমের সামনে। স্বচ্ছ কাচের ভিতর ছেদ করে দেখা যাচ্ছে ছোট দুটি ফুটফুটে বাচ্চা গুলোকে। স্নেহার চোখ ভর্তি জল গড়িয়ে পড়লো। ঢুকরে উঠলো বার বার। সত্যি সত্যি কি লিলিয়ান তার অংশ? এই ছোট জানটা কি সত্যি তার মেয়ে? কিন্তু তা কি আদো সম্ভব? দিলশাদ আবারো হয়তো তাকে ঠকাচ্ছে? আবারো তাকে নিয়ে কোনো নতুন খেলায় মেতে উঠেছে? স্নেহা চোখ মুছলো। বিড়বিড় করে বলল,

” লিলিয়ান? তুমি সত্যি কি আমার মেয়ে?”

” হ্যাঁ স্নেহা, লিলি তোমার মেয়ে।”

চেনা পরিচিত এক কন্ঠ পিছন থেকে ভেসে আসতেই চমকে উঠলো স্নেহা। পিছনে ফিরে আরো এক দফা চমকালো। তারুন, আকৃতা, মাহাদ, দিলশাদের মা সকলেই উপস্থিত। তারুণ এগিয়ে এলো। মাথা নত করে বলল,

” স্নেহা, আমি… আমি লিলিকে দিলশাদের কাছে দিয়ে গেছিলাম। ”

স্নেহার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তারুনের দিকে প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে চাইলো। এই পৃথিবীর সবাই বুঝি তাকে এভাবে ঠকাবেই? তারুনের পিছন থেকে দিলশাদের মা বলল,

” স্নেহা, আমিও এই পাপ কর্মের সাথে যুক্ত স্নেহা। আমাদের আর কোনো পথ খোলা ছিলো না সামনে।”

” তাই বলে.. আপনারা আমার মেয়েকে ছিনিয়ে নিবেন?”
এই পর্যায় চেচালো স্নেহা। তারুন বলল,

” স্নেহা তখন পরিস্থিতি এমন ছিলো যে…!”

স্নেহা তারুনকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয় বলল,

” সিচুয়েশনে যেমনি ছিলো? আমি তো মা.. আমার কি জানার অধিকারবোধ টুকু ছিলো না? আমি এত বড় অভাগা? আমার একটি মেয়ে আছে তা আমি জানি না?? গ্রেট! আপনাকে তো আমি ভাই ভেবেছিলাম মন থেকে… তাহলে.. তাহলে কেন করলেন???”

সবাই চুপ করে রইলো। স্নেহা নিজে চুল টেনে ধরলো। তারপর আবার বলল,

” আমি যখন আল্ট্রা স্নো করিয়েছিলাম? তখন-ও তো আমাকে বলেছিলো আমার একটা বেবি, তার মানে, তোমরা সব প্লেন করেছিলে? আমি কাদের মাঝে আছি, প্রতিটা মানুষ ধোঁকাবাজ। আমি আর থাকবো না, কারো সাথে থাকবো না। আমার সন্তাদের নিয়ে চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো!”

বলেই স্নেহা তার বাচ্চাদের কাছে যেতে নেয়। ঠিক তখনি মাহাদ স্নেহা হাত দুটি শক্ত করে ধরে বলে,

” পাগলামি করো না স্নেহা। আমাদের কথাটা শোনো!”

স্নেহা মাহাদকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মারলো। তারপর দরজা ঠেলে যেই ভিতরে যেতে নিলো তখনি একটি বাক্যে থেমে গেলো সে,

” স্নেহা দিলশাদ মরতে বসেছিলো!”

স্নেহা পা দুটি মাটির সাথে লেগে গেলো যেন। সেখানেই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে গেল। তারুন আবার বলল,

” স্নেহা আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। দিলশাদকে বাচ্চানোর একটা রাস্তা দরকার ছিলো স্নেহা।”

স্নেহা ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে চাইলো। তারুন স্নেহার হাত টেনে চেয়ারে বসালো। আবার বলতে শুরু করলো,

” স্নেহা সত্যি বলছি, দিলশাদ তুমি চলে যাবার পর থেকেই কেমন যেন হয়েগেছিলো। খাবার দাবার ছেড়ে দিয়েছিলো। রোবটের মতো কাজ আর কাজ করে যেতো। এভাবে মানুষ কদিন বাঁচতো বলো? হঠাৎ একদিন রাতে বাসায় ফিরবার সময় ওর গাড়ি ব্রীজ ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। ক্রিটিকাল অবস্থায় হসপিটালে আনা হয়। ডাক্তার তার সব চেষ্টা করে, লাস্ট পর্যন্ত জানায়, রোগী হয়তো নিজেও আর বাঁচতে চায় না। হয়তো এটি এক্সিডেন্ট নয়, এটেম টু সুইসাইড। তার উপর দিলশাদের গুরুতর অ্যাক্সিডেন্টের সে বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ”

এতটুকু শুনেই স্নেহা আঁতকে উঠল। ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু।

” আমি না পেরেই এই পদক্ষেপটা নেই স্নেহা। দিলশাদ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছিলো। আমি ওর বন্ধু হয়ে কিভাবে এত বড় ক্ষতি হতে দেই বলো? জানো, যখন তোমার দুটো বাচ্চা আমার এই হাতে মুঠোয় ছিলো, আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর এই সুখটি যদি দিলশাদ উপভোগ করতে পারতো? তাহলে বাঁচার একটা পথ তার হতো। তাই.. তাই আমি সেদিন স্বার্থপরের মতোই, লিলিয়ানকে নিয়ে আসি। তোমাকে জানাই শুধু লুবানের কথা। বিশ্বাস করবে কি না জানি না… তবে.. দিলশাদ লিলিয়ানকে পেয়ে আবার বাঁচতে শিখলো। স্নেহা বেঁচে আছে এটা জেনেই সে সন্তুষ্ট ছিলো। স্নেহা পাঁচটি বছর কেঁটে গেছে। দিলশাদ শুধু তোমার অপেক্ষাতেই আছে। হে সে তোমাকে চিন্তে ভুল করেছিলো। নিজের ভালোবাসাকে ঊর্ধ্বে রেখেছিলো। সেহেরের প্রতারণায় যেমন তুমি শিকার হয়েছে তেমনি দিলশাদো হয়েছে! এবার কি সব ভুলে এক হওয়া যায় না?”

স্নেহা সব কিছু শুনলো। ভাবলেশহীন ভাবে এবার তাকালো সবার দিকে। উঠে দাঁড়ালো হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে নিজ সন্তানদের কাছে। লিলিয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটির গালে হাত রাখলো স্নেহা।মুখে, কঁপালে, হাতে অসংখ্য চুমু খেলো। তার মেয়ে.. সত্যি তার মেয়ে লিলিয়ান? ছোট বেলায় সে-ও বাবা-মার আদর পায়নি। না পেয়েছে ভালোবাসার মানুষটিকে। হয়ে উঠেছিলো সর্বনাশিনী। কি থেকে কি হয়ে গেলো স্নেহা? কি হয়ে গেলো স্নেহার জীবন? স্নেহা এবার কি করবে? সে কি ছেড়ে দিবে সব.. দূরে চলে যাবে লুবান আর লিলিয়ানকে নিয়ে? নাকি… আঁকড়ে ধরবে আবারো ভালোবাসার মানুষটির হাত….. স্নেহার এই মুহুর্তে কি করা উচিত????

চলবে….