#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#শেষ পর্ব
” যানো স্নেহা? তোমাকে আমি সেই ছোট থেকেই দু-চোখেও দেখতে পারতাম না। অথচ ভাগ্য দেখো? সেই তুমি সারা জীবনের জন্য আমার ছেলের বউ হয়ে চলে এলে, সেটা কি মানা যায়! বলো তো?”
স্নেহা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো বড় বড় চোখ করে। সে-কি ঠিক শুনছে? ঠিক দেখছে? নাকি হ্যালুসিনেশন। স্নেহা বলল,
” মা আপনি এসব কি বলছেন? আপনি না আমাকে এত ভালোবাসতেন, এত আদর করতেন, মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন…!”
স্নেহার যেন কোনো ভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। এই সেই ব্যক্তি? যাকে স্নেহা তার মায়ের দর্জা দিয়েছিলো। বিন্দু নাক ছিটকে বলল,
” করতে হয়েছিলো রে। বাধ্য ছিলাম যে, নিজের ছেলের কাছে নিজের ইমেজটা কিভাবে নষ্ট করতাম বলতো?”
স্নেহা বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ। এতটা ছলনাময়ী কেউ হয় আজ জানলো স্নেহা।বলল,
” কিন্তু কেন মা!”
বিন্দু চিৎকার করে উঠলো,
” এই.. এই একদম মা বলবে না, একদম না। তোমার মুখে মা ডাক শুনলে না.. গা জ্বালা করে আমার। বুঝলে? সো ডোন্ট কল মা!”
স্নেহা অবুঝ চোখে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে দেখতে লাগলো বিন্দুকে। আর বিন্দু…স্নেহার চার পাশে গোল গোল করে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার উঠে এদিক-সেদিক হেটে তার র্কীর্তিকলাপ গুলো গুটাচ্ছে স্নেহাকে। স্নেহার আশ্চর্য হয়ে সব শুনচ্ছে। এবার স্নেহা মুখ খুললো,
” এতটা নিকৃষ্ট আপনি?”
বিন্দু হো হো করে হাসলো,
” তোর কল্পনার থেকেও বেশি! আচ্ছা চল তোমাকে আজ একটি গল্প বলি! একটি মেয়ের গল্প।”
বলেই এবার স্নেহার মুখোমুখি চেয়ারে বসলো বিন্দু। মুখের মাঝে গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে বলতে শুরু করলো,
” একটি মেয়ে ছিলো। যে তার কিশোরী কালেই একটি ছেলেকে মনটা দিয়ে বসে। মেয়েটি ছেলেটির জন্য বড্ড পাগল ছিলো। এতটাই যে ভাবনার বাহিরে । একবার তো এমন-ও হয়েছিলো মেয়েটি নিজের হাত কেঁটে ফেলেছিলো শুধু ছেলেটি ফোন ধরেনি বলে। বাসার সবাই যখন জানতে পারে? তখন তাদের কোনো অমত ছিলো না। চার হাত এক করে দেয় তাদের। একদিন কি হলো? তারা ঘুরতে যাচ্ছিলো। হঠাৎ রং সাইট থেকে একটি ট্রাক চলে আসায় তাদের গাড়িতে ধাক্কা লাগে। ছেলেটি বেশি আহত না হলেও মেয়েটি আহত হয়ে গেলো। এতটাই? যে ডাক্তার জানিয়ে দিলো মেয়েটি আর মা হতে পারবে না। এদিকে এমন এক খবরে দু পরিবারের সবাই হতভম্ব। মেয়েটি এমন কথা শোনার পর পাগলের মতো কাঁদলো। সে আর মা হতে পারবে না? সত্যি পারবে না? অথচ ছেলেটির বাচ্চার কি শখ! মেয়েটি হিচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। ছেলেটি সেদিন মেয়েটিকে সান্ত্বনা না দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিয়ে চলে গেলো। অথচ ছেলেটির দোষেই মেয়েটির এই হাল হলো। মেয়েটির কি হবে না হবে? কিভাবে দিন পার করবে? ছেলেটি আর তার খবর নিলোই না। উল্টো মেয়ের পরিবার কথা বলতে গিয়ে লাঞ্ছনা করে বাসা থেকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলো। এই কষ্ট সইতে না পেরে মেয়েটির বাবা স্টোক করে মারা যায়। মেয়েটি সেদিন এতটাই কষ্ট পেয়েছিলো যে, নিজেকে এক সপ্তাহ ঘর বন্দী করে রাখে। এক সপ্তাহ পর যখন বের হয়? তখন সে জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটি নাকি বিয়ে করে নিয়েছে তাউ আবার তারই ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে। এবং তারা দেশের বাহিরে চলে যায়। যা শুনু মেয়েটির প্রতিশোধের নেশা জেগে উঠে। ক্ষোভে দগ্ধ হতে থাকে। একদিন কি হলো? একটি বিয়ের ঘর এলো মেয়েটির জন্য । ছেলেটির অলরেডি একটি বাচ্চা আছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারে ছেলে। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার সময় বাচ্চাটির মা মারা যায়। এখন একটি মা প্রয়োজন বাচ্চাটির। মেয়েটির পরিবার মেয়েটির মতামত না নিয়েই বিয়ে করিয়ে দেয়। মেয়েটি জিন্দা লাশ হয়ে নতুন জীবনে পা দেয়। কিন্তু বাচ্চাটিকে যখন কোলে নেয়? তখন মাতৃত্ব জেগে উঠে। জেগে উঠে ফুটফুটে বাচ্চার ডীপ ব্লু পুতির মতো চোখ গুলো দেখে। আধো আধো মা মা বলা দেখে। মেয়েটি যেন ছেলেটির আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে আবার বাঁচতে শিখলো। এভাবে বছর ঘুরে গেলো পাঁচ। সুখের সাথেই কাঁটছিলো তার জীবন। একদিন কি হলো? বাচ্চাটি তখন পাঁচ বছর। মেয়েটি বাচ্চাকে নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে পার্কের দিকে যাচ্ছিল। সেদিন হঠাৎ করেই তার প্রাক্তন এর সাথে দেখা হয়। পুরোনো রাগ, ক্ষোভ আবারো জেগে উঠে। এবং মুহূর্তেই একটি গাড়ি দুটো মানুষকে ধাম করে মেরে দেয়। ঘটনাস্থলে দু’জন নিহত হয় এবং তার পাশে থাকা ছ’মাসের বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটিকে দেখে তাচ্ছিল্য হাসে মেয়েটি। বাচ্চাটিকে দেখে ছোট ছেলে বাচ্চাটি বলে উঠে,
‘মা এই পুতুলটি কি আমার খেলার সাথী?’
মেয়েটি তখন বাঁকা হাসে বলে,
‘নাহ্! এই বাচ্চাটি তোমার কাজের লোক হওয়ারও যোগ্য না!’
ছেলে বাচ্চাটি শুধু ড্যাব ড্যাব করে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখছিলো শুধু। সেদিন এই বাচ্চাটি মেয়েটি তাদেরই এক অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসে। আর সেখানেই হয় মেয়েটির নতুন নরকের জীবন!”
স্নেহার চোখ ভর্তি জল এপর্যায়া টুপ টুপ করে পড়তে লাগলো। বিন্দু এবার বাঁকা হেসে স্নেহার দিকে তাকালো। বলল,
” জানো? সেই মেয়েটি কে? আমি। আর ওই বাচ্চা মেয়েটি কে? তুমি।”
স্নেহা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো। তার বড় বড় চোখ দিয়ে পানির সাথে ঘৃণা বহর বইতে লাগলো। হুংকার ছেড়ে বলল,
” আপনি… আপনি আমার বাবা-মাকে মেরেছেন। আমি আপনাকে ছাড়বো না। কখনো না। ”
বিন্দু ফিক করে হাসলো,
” এতটুকু শুনে এই অবস্থা? আরো তো সিনেমা বাকি আছে বস?”
স্নেহা রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। বুন্দি আবার বলল,
” তোমাকে তালুকদার বাড়ি নিয়া। তোমার কিডনি সেহেরকে দেয়া। এসব তো আমার প্লেন ছিলো স্নেহা জানো? ”
পরক্ষণেই কিছুটা আফসোসের সাথে বলল,
” কিন্তু? দেখে আমার ছেলেটা না? তোমাকে তার দিল দিয়ে বসলো। তাই ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেই। এবং সেহেরকে তোমার জায়গায় বসিয়ে দিলশাদের সাথে পরিচয় করাই। জানো আমার তোমাকে একদম সহ্য হয় না। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে, তুমি দেখতে ঠিক তোমার মার মতো হয়েছো। তোমার মা আমাকে ঠকিয়েছে যেভাবে তোকে দেখলে না আমার শুধু বার বার… বার বার ওসব মনে পড়ে যেত। মাথায় আসতো তোমাকে মেরে দেই। কিন্তু তখন বাচ্চা ছিলা! তাই পারিনি। কিন্তু তোমার জীবন নরক বানাবার পিছনে হাতটা কিন্তু আমার ছিলো।”
স্নেহা আর সইতে পারছে না। সে নিজের হাতের বাঁধা খোলার বৃথা চেষ্টা করছে। চেঁচিয়ে যাচ্ছে,
” ডাইনি বুড়ি তুই একটা । মানুষ রূপে নর্দমার কীট!”
বিন্দু খেপে গেলো। ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিল স্নেহার গালে। স্নেহার মনে হলো দুনিয়া ঘুরছে। বিন্দু এবার স্নেহার মাথার চুল টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” হ্যাঁ আমি ডাইনি বুড়ি। জানিস এই ডাইনি বুড়ি আর কি করেছে? শোন তাহলে! সেহের আর মারিয়াকে দিয়ে তোর জীবন পদে পদে জাহান্নাম করে তুলেছে। তোর প্রথম বাচ্চা নষ্ট হয়েছে কেন জানিস? আমি চেয়েছিলাম বলে। কারণ আমি চাইনি, দিলশাদের বাচ্চা তোর গর্ভে আসুক। আমি তো সব প্লেন করে ফেলেছিলাম সব। সেহের সেদিন যদি না পালাতো? তুই এখানে থাকতি না। দেখ ভাগ্য হয়তো এটাই চেয়েছিলো তুই মরবি আমার হাতে! কিন্তু তুই তো কই মাছের প্রাণ যতবার চেষ্টা করেছি তোকে মারার? তুই ততবার বেঁচে গেছিস। আর তোর রূপের জালে গায়েল করেছিস আমার ছেলেটাকে। মাথা নষ্ট করে দিয়েছিস। আমিও কম কিসের বল? আমি তোকে নিজের ছেলের কাছে খারাপ বানাবো বলেই তো কোমাতে যাওয়ার নাটক পর্যন্ত করেছি। যদি তা না করতাম? কখনো জানতাম না.. আকৃতা শেখ হয়ে নতুন আইডেন্টিটি নিয়ে আবার ফিরে আসবি তুই। ভেবেছিলাম সেদিন মরে গেছিস তুই। কিন্তু নাহ্! ওই সেহের তো কোনো কাজেরই ছিলো না। তাই মারিয়াকে নিয়েই নতুন খক কসি। বাঁচারা মারিয়া তোর জন্য সেও ভুক্তভোগী। ওর ক্যারিয়ার তো তুই শেষ করে দিলি। ও কই যাবে বল? সুইসাইড করতে গেছিলো জানিস? তাকেই পড়ে কাজে লাগাই আবার। লাভ ফ্যারির রাতের কথা তোর মনে আছেরে স্নেহা? সেখানে মারিয়ার থাকার কথা ছিলো। কিন্তু দেখ তুই পৌঁছে গেলি। প্রেগন্যান্ট মারিয়ার হওয়ার কথা ছিলো তুই হয়ে গেলি। জানিস দিলশাদ পড়ে ঠিকি খোঁজ করেছিলো… সে রাতে তার সঙ্গে কে শুয়ে ছিলো। কিন্তু ওর জাগার আগেই আমি সব প্রমাণ নষ্ট করে দেই। দিলশাদ ওই ঔষধের জন্য ওর কিছুই মনে থাকে না। সব থেকে মজার বিষয় কি জানিস? দিলশাদ যখন শুনলাম বাবা হতে পারবে না? তখন তারুনকে আমার মিথ্যার জ্বালে ফাঁসিয়ে তোর সন্তানকে কেড়ে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু তারুণ তো আরো চালাকি করলো, তোর দুটো বাচ্চার কথা লুকালো। লিলিকে এনে ধরিয়ে দিলো। যদি জানতাম দিলশাদের ছেলে আছে? তাহলে লিলিয়ানকে আমার দরকারই ছিলো না। কারণ বংশ তো ছেলেদের দিয়ে বাড়ে, মেয়েদের না।”
এপর্যায় স্নেহার চুল ছেড়ে দেয় বিন্দু। পাশের টেবিল থেকে ধারালো একটি ছুরি নিয়ে স্নেহার হাতের উপর চাপ দেয়। স্নেহার মুখ থেকে ব্যথায় চিৎকার বেড়িয়ে আসে। স্নেহা আহত চোখে তাকায়। বিন্দ এবার অন্য হাতে চাকু ঢুকিয়ে দেয়। স্নেহা আর কিছু বলতে পারে না। তিনদিনের না খাওয়া আর এত টর্চার সইতে পারে না। নিভু নিভু চোখে হাঁপাত হাঁপাতে বলে,
” এসব কেন করলে? কি লাভ হলো? ”
বিন্দু তার আঁধা পাকা চুল গুলোয়হাত খোপা করলো।বলল,
“ওই যে বললাম?তোকে দেখলে আমার শুধু তোর বাপ-মার ধোকা দেয়ার কথা মনে পড়ে। শুধু তোকে না। তোর মেয়েটাকেও দেখলেরে। তাই তো ওকেও মারতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু লুবান এসে গেলো মাঝে। বেচারা নিজেও ব্যথা পেলো। সেদিন রেলিং থেকে লিলিয়ানকে ধাক্কাটা আমি দিয়ে ছিলাম। তোর পুঁচকে ছেলেটা একদম তার বাবার মতো বোনকে বাঁচাতে চলে আসে টেনে তুলতে গিয়ে দু ভাই বোনি একে বারে….!”
স্নেহার এবার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো। কোথা থেকে যেন শক্তি এসে গেলো? সে এতখন হাত খোলার চেষ্টা করছিলো কিন্তু পারেনি। এবার ঠিকি পারলো। হাত খুলতে পেরেই গলা চেপে ধরলো বিন্দুর। চেঁচিয়ে বলল,
” আমি তোকে ছাড়বো না তুই আমার সন্তানদের গা হাত দিয়েছিস।”
বিন্দুর শ্বাস আঁটকে আসতে লাগলো। বুড়ো হয়েছে জোড় তো নেই এখন আর আগের মতো শরীরে। তবুও হাতের পাশে থাকা চাকুটা স্নেহার পেটে ঢুকিয়ে দিলো। মুহুর্তেই রক্তের বন্যা ভেসে গেলো। স্নেহা নিজের পেটের কাঁটা অংশ চেপে ধরলো। তারপর হেসে বলল,
” আল্লাহ শয়তানকেও একদিন শেষ করবে তুই তো শুধু মানুষরে।”
স্নেহার কথায় আবারো চাকু নিয়ে তরে আসে বিন্দু। এবার পিছন থেকে চাকু কেঁড়ে নিয়ে বিন্দু এক চোখের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। বিন্দু গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করতে থাকে গলা কাঁটা মুরগীর মতো। ছটফট করতে থাকে। বিন্দু অন্য চোখ দিয়ে চাইলো। ঝাপসা চোখে ভেসে উঠলো দিলশাদের মুখ। যা দেখে কেঁপে উঠলো বিন্দু। কান্নার ভাব আরো বেড়ে গেলো যেন। নিজের ছেলেই কিনা তার চোখ টা নষ্ট করে দিলো? নিজের ছেলে? নাহ্! ওতো নিজের ছেলে নয়? সৎ ছেলে। বিন্দু কাতরাতে কাতরাতে বলল,
” দিল… তুই তোর মাকে মারলি?”
দিলশাদ তার ঠান্ডা ভাবলেশহীন স্বভাবে বলল,
” আপনি আমার মা নন। আমার মা তো জম্মের সময় মারা গেছে। ”
বিন্দু বলল,
” আমি তোকে লালনপালন করেছি…!”
দিলশাদ আগের মতোই বলল,
” তাই তো জানে মারলাম না।”
বিন্দুর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। পিছন শিশিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় মাথা নত করে নিলো বিন্দু। দিলশাদ স্নেহাকে কোলে তুলে নিলো। শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” বাবা… আশা করছি সঠিক উনি তার উচিত শাস্তি পাবে?”
শিশির পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে দিলশাদ তার লম্বা পা ফেলে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। স্নেহা দিলশাদের বুকের মাঝে নিজের মাথা চেপে রাখলো এতদিনের দুঃখ কষ্ট গুলো এত কম মনে হচ্ছে কেন? স্নেহার শান্তি লাগছে কেন এই বুকে। মনে হচ্ছে গভীর ঘুম তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ঠিক সেই মুহুর্তে বোম ব্লাস্ট করার মতো শব্দ হলো। শহর থেকে দূরে এই অন্ধকার ঘর একটি পুরোনো ভিটা ছিলো। যা এখন পুরে ছাই হচ্ছে। স্নেহা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দিলশাদ স্নেহার রক্তাক্ত মুখমন্ডলে চুমু খেলো। এত দিন পরে এই মানুষটি তার হয়েই গেলো। এবার শুধু তার মন জয় করা বাকি। কথায় বলে, যে যেমন কর্ম করে… তেমন ফল পায়। বিন্দুকে দিলশাদ ছোট থেকেই আপন মা বলেই জানতো। কিন্তু দিলশাদের এক্সিডেন্টের সময় সে জানতে পারে দিলশাদ বিন্দুর আপন ছেলে নয়। তবুও সে জানতে দেয়নি। কিন্তু এবার তো তার সন্তান আর স্নেহার জানের উপর কথা চলে এসেছে, দিলশাদ কিভাবে ছেড়ে দিবে? দিলশাদ তখন সত্যিটা জানতো না। তাহলে হয়তো এতটা কষ্ট স্নেহাকে পেতে দিতো না! দিলশাদ রক্তে মাখা স্নেহাকে নিয়ে এগিয়ে গেলো। নতুন কোনো দিনের নতুন সূচনার জন্য।
পাঁচ দিন পর…
বাড়িতে ধুমধাম করে চলছে আয়োজন। স্নেহা এখন কিছুটা সুস্থ। দিলশাদকে এ কদিন জ্বালিয়ে মেরেছে স্নেহা। যেন এত বছরের হিসাব কড়ায়গণ্ডায় নিয়েছে। যেমন ঠিক এখন! বাচ্চাদের সামনেই বায়না ধরেছে,
” আমাকে আপনার কোলে নিয়েই চলতে হবে… নয়তো আমি পালিয়ে যাবো!”
দিলশাদ শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই নিয়ে একহাজার একবারের উপরে হয়েছে এমন হুমকি দিয়েছে। খেতে গেলে, ঘুমতে গেলেও এমনকি ওয়াশরুম গেলেও স্নেহা এই হুমকি শুনতে হয়েছে তার। এই তো আজ সকালের কথা..
দিলশাদ ওয়াশরুম কেবলি ঢুকেছিলো। বাহির থেকে ধুম ধারাক্কা শুরু। স্নেহা চেচিয়ে বলছে,
” এই যে মিস্টার আমরিন? এতখন কি করেন ওয়াশরুমে? এখন যদি আমি পালিয়ে যাই এক ছুটে?”
দিলশাদের তখন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে স্নেহা আরো চেচিয়ে বলল,
” ওকে তাহলে গেলাম! টা টা.. বায় বায়…।”
দিলশাদ দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। স্নেহাকে বিছানায় আরাম করে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস চাড়ে। পরক্ষণেই স্নেহার একদম কাছে চলে আসে ফিসফিস করে বলে,
” এই যে আমাকে জ্বালাচ্ছো? পড়ে আমি শুরু করলে কিন্তু আর থামাতে পারবে না। ”
স্নেহা লজ্জা পেলো। দিলশাদকে সেখান থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
” এই স্নেহাকে জ্বালানো এখন আর এত সহজ নয় মিস্টার আমরিন!এই স্নেহাকে জ্বালালে সাথে জ্বলতে হবে।”
দিলশাদ স্নেহাকে আরো কাছে টেনে নিলো। বলল,
” জ্বলতে চাই!”
স্নেহা আবারো ধাক্কা মারলো। আর এক ছুটে পালিয়ে যেতে যেতে বলল,
” এত সহজ না মিস্টার আমরিন।”
দিলশাদ হাসলো। সকালের কথা ভেবেই। তারপর স্নেহাকে নিয়ে প্রবেশ করলো ঘরের ভিতরে। লিলিয়ান আর লুবান তাদের জন্য নিজ হাতে কেক বানিয়েছে। বাবা-মায়ের রুম সাজিয়েছে। সবাই আনন্দ ফুর্তিতে ব্যস্ত। এভাবে শান্তিতে পাঁচটি বছর কেঁটে যায়।
মারিয়া এখন রাস্তার ভিক্ষারী। একটি মার্কেটের সামনে সব সম বসে থাকে সব সময়। সায়রা এখন পাগলা সেহেরের শোকে। সেহের কই আছে না আছে তা ভেবেই চোখের জল ফেলে। শিশির এখন পাথর। বিন্দুকে সে সত্যি অনেক ভালোবেসে ছিলো। বিন্দু যে এভাবে তাকে ঠকাবে কে জানতো?
সবাই সবার কর্মের ফল পেয়েছে। যে যেমন করবে? তেমন ফল পাবে.. একেঁই তো কার্মা বলে তাই নয় কি?
আজ লুবান আর লিলিয়ানের দশ বছর। একটি বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরতে আসে তারা। লুবান লিলিয়ান একেবারে বাবা-মায়ের প্রতিছবি হয়েছে। যেমন বুদ্ধি। তেমন সুন্দর, বুদ্ধিমান। কিন্তু এখানেই এসে লিলিয়ানের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেলো। এক বৃথা লিলিয়ানকে চেপে ধরলো। লিলিয়ান বরাবরই রোগা-সোগা। ডাক্তার বলেছিলো টুইন বেবি বলেই লুবান যতটা সবল, লিলি ততটা দুর্বল। স্নেহা এই মুহুর্তে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। বৃধাকে ভালো করে দেখতে পেয়ে সে আরো আত্নকে উঠলো। এ যে আর কেউ না… বিন্দু। স্নেহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বিন্দু তো মারা গেছিলো। শিশির তো তাই বলেছিলো সবাইকে তাহলে??? তাহলে এখকনে কিভাবে?” স্নেহা ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে মেয়ের কাছে যেতে নেয়। তখনি বিন্দু বঠি বের করে ফেলে। লিলিয়ানের গলায় চেপে ধরে। লিলি মা মা বলে কাঁদতে থাকে। বৃদ্ধাশ্রমটি পাহাড়ের উপর ছিলো। নিচে বয়ে চলেছিলো গভীর স্রোতের নদী। বিন্দু লিলিয়ানকে সেখানেই টেনে নিয়ে গেলো। পাহাড়ের শেষ প্রান্ত নিয়ে গিয়ে পাগলের মতো হাসতে হাসতে বলল,
” তোর মা আমার ভালোবাসা কেড়েছে, তুই আমার ছেলেকে, আর আমি এখন তোর মেয়েকে ”
বলে উপর থেকে ঝাপিয়ে পড়লো নিচে। স্নেহা সেখানে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার লিলি… ছোট লিলি এভাবেই হারি গেলো? সে মা হয়ে শুধু চেয়ে দেখবে? নাহ্! স্নেহা নিজেও ঝাপিয়ে পড়তে নেয়। সকলেই ধরে নেয়। দুই ঘন্টা পর….
বিন্দুর লাশে সাদা কাপর দিয়ে মুড়ি দিয়া। দিলশাদ আর স্নেহা পাথর হয়ে গেছে। তাদের মেয়েকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোথাও না। দিলশাদ নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। বড় সড় বহমান স্রোতের সাথে ছোট মেয়েটিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো? কারো জানাননেই। দিন গেলো, সপ্তাহ গেল.. গেল মাস গেলো বছর… লিলিয়ানকে আর পাওয়া গেলো না। দিলশাদ সেখানেই একটি ছোট বাড়ি বানালো। প্রতিদিন নদীর পাড়ে বসে এখন মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে দুই যুগল। এক বুক আশা নিয়ে। দিলশাদ এখন ভাবে তার মেয়েটি এতই কাছে আছে। হাসছে খেলছে। আজ লুবান এসেছে নদীর ধারে। পানিতে স্পর্শ করছে। এই পানিতে তার অংশ নাকি মিশে গেছে! সত্যি কি তাই? লুবান তার বোনকে খুঁজে যাচ্ছে। এখন সে যথেষ্ঠ বড় হয়েছে। একদিন ঠিক হয়তো পাবে এটি তার বিশ্বাস আর তখন বাবা-মাকে সব থেকে সারপ্রাইজ দিবে সে। লুবান পানি স্পর্শ করলো বিড়বিড় করে বলল,
” লিলি.. কাম ব্যাক। কাম ব্যাক। ”
সমাপ্ত