সাঁঝের প্রেম পর্ব-১+২

0
62

#সাঁঝের_প্রেম
#পর্ব__১-২
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

-নিশি আপু আমাকে একটু এই ডকুমেন্টস গুলো বুঝিয়ে দাও তো। একটু পর বস রাউন্ডে আসলে সাংঘাতিক ভাবে বকবে। (নিশির কলিগ)
-আসছি দিয়া। (নিজের ডেস্ক ছেড়ে নিশি দিয়ার সামনে গেলো)
-নিশি আপু এইত পেপারস গুলো কিছুই বুঝছিনা।
-দেখো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

নিশি দিয়ার সমস্যাগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলো ঠিক সেই সময় নিশির বস আসে রাউন্ডে। সবাই দাঁড়িয়ে গুড ইভিনিং জানায়। নিশি বসকে গুড ইভিনিং বলার পর বস নিশিকে বলে,

-মিস নিশি একবার আমার কেবিনে আসুন।
-ওকে স্যার।

নিশি বসের পেছন পেছন কেবিনে যায়। কেবিনে গিয়ে নিশি দাড়িয়ে ছিলো। তখন বস নিশিকে বসতে বলে আর নিশিকে বলে,

-মিস নিশি আপনার কাজ আর পার্ফমেন্স দেখে আমি মুগ্ধ। আপনি আমার কোম্পানিতে আসার পর সবাই এক্টিভ হয়ে গেছে। এই কোম্পানিতে আপনার অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
-কি স্যার?
-আপনার চিটাগং পোস্টিং হয়ে গেছে। পাঁচদিনের মধ্যে আপনি চিটাগং চলে যাবেন। এই নিন ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। (নিশির দিকে সার্টিফিকেট এগিয়ে দিয়ে বস)

চিটাগং এর কথা শুনে নিশি কেঁপে উঠলো। চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে আছে নিশি বসের দিকে।

-Are you okay miss Nishi? (তুড়ি মেরে বস)
-স্যার চিটাগং ছাড়া আপনি আমায় যেই জেলায় দিবেন আমি যেতে রাজি। প্লিজ স্যার পোস্টিং টা ক্যান্সেল করুন প্লিজ। (নিশির চোখ দিয়ে পানি পরছে)
-কি হয়েছে নিশি?
-কিছুনা স্যার বাট আমি চিটাগং যেতে পারবনা। (নিশি দাঁড়িয়ে যায়)
-নিশি আপনি কার সাথে কথা বলছেন জানেন? আমার মুখের উপর কেউ কথা বলেনা। হয় চিটাগং যাবেন নয় চাকরি ছেড়ে দিবেন। Now choice is your. আজকে ডিসিশন নিন এরপর কাল আমায় জানাবেন। আসতে পারেন এখন।

নিশি বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। নিজের ডেস্কে বসে নিশি কাঁদছে আর কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর অফিস ছুটি হয়ে যায়। হাতে বেনিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে নিশি। থ্রি পিসের ওড়না মাটিতে গড়াচ্ছে আর স্লিপার পরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে নিশি। যাওয়ার সময় বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে যায় নিশি। এইটাই সেই বাস স্ট্যান্ড যেটাকে নিশির জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলা চলে। কতক্ষণ বাসস্ট্যান্ডের বাসস্টপের দিকে তাঁকিয়ে থাকে ও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো চলে আসে সেখান থেকে। অনেকটা দূরে আসার পর নিশি রিক্সা নিয়ে বাসায় আসে। আসার সময় আকাশ কুসুম ভেবে নিজের মাথায় সেগুলো জটলা পাকায় নিশি। চাকরিটা তো ওর ছেড়ে দিলে চলবেনা। চাকরি ছেড়ে দিলে বোনের কলেজ খরচ কিভাবে দিবে ও? আম্মুকে দেখবে কে? নিশি সিদ্ধান্ত নেয় ও চাকরিটা করবে আর চিটাগং চলে যাবে ও। চোখের পানি মুছে নিশি দরজায় কলিংবেল বাজায়। তুর্না (নিশির ছোট বোন) এসে দরজা খোলে।

-আপু এসেছো? কখন থেকে ওয়েট করছি তোমার জন্য! (তুর্না)
-তুই পড়তে বসেছিস তো? (জুতা হাতে নিয়ে নিশি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো)
-হ্যা আপু বসেছি।
-আম্মু কোথায়?
-ঘরে।
-আচ্ছা তুই গিয়ে পড়।

নিশি ব্যাগ ডায়নিং এর উপর ফেলে আম্মুর সাথে দেখা করতে যায়। আম্মু তখন বসে বসে কুরআন পড়ছিলেন। নিশিকে দেখে পড়া থামিয়ে বললেন,

-তুই কখন এলি নিশু মা?
-এইত মাত্রই আম্মু। তুমি ওষুধ খেয়েছো?
-হ্যা। যা জামাকাপড় পালটে আয়। চা করে দেই আমি তোকে আর তুর্নাকে।
-না মা তোমায় উঠতে হবেনা পড়া থেকে৷ আমি করছি।
-সারাদিন অফিস করে এলি না তুই? তুই যা আমি আসছি।

নিশি ওর ঘরে এসে চেঞ্জ করে তুর্নার পাশে বসে। তুর্না অনেক ব্রিলিয়ান্ট ঠিক নিশির মতো। তুর্নার মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকে নিশি। ঠিক তখনি আম্মু এসে দুইবোনকে চা দিয়ে যায়। আম্মু কথায় কথায় নিশিকে বলল,

-আর কত আমাদের টানবি নিশু? এইবার কি নিজের কথা ভাববি না? (নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে আম্মু)
-তিন বছর আগে সেই ভাবনাগুলো আমায় ছেড়ে চলে গেছে আম্মু। আমি সত্যিই আর ভাববো না নিজেকে নিয়ে। তোমাদের জন্যই বাঁচব আমি। (হাসি দিয়ে নিশু)
-মাহবুব ভাইয়া কি বিয়ে করেছে আপু? (তুর্না)
-তুর্না??? কেন নিচ্ছিস ওর নাম আমার সামনে? (ধমক দিয়ে নিশু)
-স্যরি আপু। তোমার জীবনটা আমরাই নষ্ট করে দিলাম। তোমার এই জীবনের জন্য আজ দায়ী আমরাই।
-আহ তুর্না কেনো এমন কথা বলছিস তুই? তোরাই আমার সব। আব্বু চলে যাওয়ার পর এখন তোরাই আমার সব। (তুর্নাকে জড়িয়ে ধরে নিশু)
-আই লাভ ইউ আপু।
-যাইহোক আম্মু একটা ইম্পর্টেন্ট কথা বলছি। আমার চিটাগং পোস্টিং হয়ে গেছে। সেখানে যেতেই হবে আমায় নয়ত চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। (নিশি)
-কি বলছিস কি? চিটাগং যাবি তুই? (অবাক হয়ে আম্মু)
-হ্যা আম্মু যেতেই হবে। নয়ত আমার চাকরিটা চলে যাবে। আর এই চাকরিটা আমার জন্য ভীষণ ইম্পর্টেন্ট।
-তাহলে আপু আমরা কি ঢাকা থাকব?
-হ্যা৷ তুই ইন্টার শেষ করলে তোদের নিয়ে যাব আমি।
-তোমায় ছাড়া থাকব কি করে আপু?
-কয়েকটা মাসেরই তো ব্যাপার বোন। ঠিক হয়ে যাবে সব।
-হুম।

রাতে ডিনার করে নিশু আর তুর্না শুয়ে পরে। নিশু পাশ ফিরে শুয়ে ভাবছে অতীতের কথা। পাঁচটা বছরে ওর জীবনটাই পালটে গেলো। নিশু শুয়ে বিছানা খামছে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে আর মাহবুবের মুখটা বারবার মুখের সামনে ভেসে উঠছে।

“পাঁচ বছর আগে”

সকাল আটটায় ভার্সিটির বাসের জন্য ওয়েট করছে নিশি। ঘড়ি দেখছে বারবার। লং ড্রেস আর চুরিদার পরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নিশি। কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো, ঠোঁটে লিপস্টিক আর চোখে কাজল। গায়ের রঙ উজ্জ্বল আর ছিপছিপে গড়ন। সবার নজর নিশির দিকে কিন্তু নিশির কেয়ার করার সময় নেই। একটা পাবলিক ভার্সিটির বোটানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এ পড়ছে নিশি। ঠিক ৮ঃ১০ মিনিটে একজন ভিক্ষুক এসে দাঁড়ালো পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে। ছেলেটির অফিস বাস এসে গেছে তাই সে তাড়াহুড়ো করে মানিব্যাগটা বের করে দশটাকা দিয়ে বাসে উঠে যায়। নিশির চোখ যায় নিচের দিকে। একটা আইডি কার্ড পরা নিচে। নিশি দৌড়ে সেইটা হাতে নেয় আর লোকটাকে দিতে গিয়ে দেখে বাস ছেড়ে চলে গেছে। বাসে লিখা “পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড”। আর আইডি কার্ড দেখে নিশি বুঝতে পারে উনি ব্যাংকে চাকরি করেন আর ওনার নাম মাহবুব আহমেদ। নিশির বাস ও চলে আসে। তাই নিশি ভাবে কার্ডটা নিয়ে যাই আর পরে আসার সময় দিয়ে আসব। নিশি আইডি কার্ডটা নিয়েই ভার্সিটিতে যায়। বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় নিশি পদ্মা ব্যাংকে যায়। সেখানে আইডি কার্ডটা দেখানোর পর ম্যানেজার মাহবুবকে ডেকে দেয়।

-এক্সকিউজমি ভাইয়া আপনার আইডি কার্ডটা আপনি ফেলে এসেছিলেন বাসস্ট্যান্ডে ভিক্ষুককে টাকা দিতে গিয়ে। (কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে নিশু)
-ধন্যবাদ তোমায় আপু। এ কার্ডটা খুব ইম্পর্টেন্ট আমার জন্য। (কার্ডটা হাতে নিয়ে মাহবুব)
-ওকে ভাইয়া। আসি।
-শুনো একটু?
-জ্বি বলুন।
-কিছুনা বাট এগেইন থ্যাংকস।

নিশু সেখান থেকে হেসে চলে আসে। বাসায় আসার পর আব্বুর বকুনি খেতে হয় অনেক দেরি হওয়ার জন্য। কিন্তু নিশি সামলে নেয়।

-নিশি ঘুমিয়ে গেছিস? (আম্মু)
-না আম্মু। বলো। (চোখের জল মুছে কল্পনা থেকে বেরিয়ে নিশি উঠে বসে)
-মা একটা কথা রাখবি আমার?
-কি আম্মু?
-তুর্নার সামনে বলতে পারিনি। এখন বলছি বিয়ে করে নে মা। এভাবে আর থাকিস না। মাহবুবের সাথে আমি কথা বলি? জিজ্ঞেস করি ও বিয়ে করেছে কি না!
-মেরে ফেলতে চাও তুমি আম্মু আমায়? এতটা পচে গেছি আমি তোমার কাছে? কোনমুখে কথা বলবে ওর সাথে? ছোট হয়ে যাব না আমি? (চোখের পানি মুছে নিশু)
-প্রতিদিন যখন তোর ঘরটা গুছাই সকালে দেখি বালিশটা ভেজা। তোর কষ্ট কি বুঝিনা আমি মা?
-না মা বুঝো না। বুঝলে এ কথা বলতে পারতে না! (মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে নিশু)
-কাঁদিস না নিশু মা, কাঁদিস না। (মা ও কাঁদছে)

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_2
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

নিশির প্রতিটা রাতই নির্ঘুম আর অসহ্য যন্ত্রণায় কাটে। একদিকে মাহবুবের থেকে দূরে থাকার কষ্ট অন্যদিকে পরিবারের কষ্ট। নিশি পরেরদিন অফিসে গিয়ে বসকে জানিয়ে দেয় সে চিটাগং যাবে। নিশি পোস্টিং লেটার নিয়ে সেদিন অফিস শেষ করে বাড়িতে চলে আসে। বাসায় এসে সব গোছায় নিশি। কাপড় গোছাতে গোছাতে নিশি ভাবে,

-ও কি আছে এখনো চিটাগং এ? নাকি বাইরে চলে গেছে? চিটাগং গেলে কি ওকে এক নজর দেখতে পারব? কেমন আছে ও? আগে তো স্বাস্থ্য ভালো ছিলো। এখন কি চিকন হয়ে গেছে? বউ বাচ্চা নিয়ে নিশ্চই ভালো আছে ও তাইনা? আচ্ছা ওর কয়টা ছেলে মেয়ে হয়েছে? (নিশি এলোপাতাড়ি এসব ভাবছিলো)

কাপড় গুছিয়ে নিশি নামাজ সেড়ে ডিনার করে তুর্নার হোমওয়ার্ক চেক করে। তুর্না বড় বোনের দায়িত্বে বেশ ভালো ছিলো এতদিন। তুর্না নিশিকে বলল,

-আপু তুমি চলে গেলে আমায় কে দেখবে?
-আম্মু আছে তো বোন।
-তোমার অভাব কি আম্মুকে দিয়ে পূরণ হবে আপু?
-কয়েকটা মাসই তো বোন। একটু কষ্ট কর।
-হুম আপু। তুমি ঘুমাও। সকালে তো আবার ট্রেন ধরতে হবে।
-হ্যা। তুই পড়।

নিশি কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। সকালে নিশিকে স্টেশনে ছাড়তে মা আর তুর্না দুজনেই গেলো। নিশির ট্রেন ছাড়া না অবধি সেখানে ওরা দাঁড়িয়ে রইলো। আম্মুকে কাঁদতে নিষেধ করে নিশি। ট্রেনে উঠে দেখে জানালার ধারে সিট পরেছে নিশির। নিশি মুচকি হেসে সিটে বসে আর ট্রেন চলতে শুরু করে। নিশি, তুর্না আর আম্মুকে বিদায় জানিয়ে চলছে চিটাগং এর উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যাওয়ার পর নিশির মনে পরে যায় ওর প্রথম ভালবাসা, প্রথম প্রেমের কথা। নিশি শিউরে উঠে। জানালার ধারে হ্যালান দিয়ে নিশি মাহবুবের কথা ভাবতে শুরু করে।

“নিশি মাহবুবকে আইডি কার্ড ফেরত দিয়ে আসার পর বাবার হাতে অনেক বকুনি খায় দেরি হয়েছে বলে। নিশি কোনোরকম বাবাকে সামলায়। পরেরদিন বাসস্ট্যান্ডে নিশি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। নিশির চোখ বারবার মাহবুবকে খুঁজছে। একটু পরেই মাহবুব দৌড়ে বাসস্ট্যান্ডে আসে। ও ভেবেছে হয়ত বাস মিস। নিশিকে দেখে মাহবুব চশমা ঠিক করে এগিয়ে যায়। এস কালার একটা শার্ট আর প্যান্ট পরা ছিলো মাহবুব।

-এই যে আপু হ্যালো! (মাহবুব)
-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন? (চমকে গিয়ে নিশি)
-ওয়ালাইকুম সালাম। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছো?
-হ্যা ভার্সিটির বাস।
-কোন ভার্সিটি?
-জবি।
-ওহ কোন ইয়ার?
-ফার্স্ট ইয়ার, বোটানির স্টুডেন্ট।
-বাহ! ভালো তো। তোমার নাম কি?
-নিশি।
-এত সুন্দর একটা মেয়ের নাম নিশি হয় কি করে?
-সুন্দর মেয়ের নাম নিশি হয়না কেনো? (হাত মুড়িয়ে নিশি)
-নিশি মানেই তো অন্ধকার বা সাঁঝবেলা তাই। আর তুমি তো আলো।
-হাহাহাহাহা। বাস এসে গেছে আপনার!
-ও হ্যা! বাই।
-বাই।

মাহবুবের বাস চলে যাওয়ার পর নিশির ভার্সিটির বাস এলো। নিশি বাসে বসে নখ কামড়াচ্ছে আর ভাবছে,

-মজার মানুষ অনেক। কিন্তু চেহারার সাথে ক্যারেক্টারের কোনো মিল নেই। চেহারাটা কেমন যেন রাগী রাগী আর ইনোসেন্ট। উনি কি এতটা ইনোসেন্ট নাকি? হাহাহাহা। চুলগুলো আর চোখের কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা ওনার সাথে মানানসই।

নিশি ভার্সিটি থেকে ফেরার পর চেঞ্জ করে তুর্নার সাথে খেলে। তুর্না তখন ক্লাস এইটে পড়ে। নিশির বাবা প্রচন্ড রাগী আর একরোখা। কারো কথা শোনানো যায়না তাকে।

এভাবে প্রতিদিন সকালবেলা ৩/৪ মিনিট কথা হতো দুজনের। নিশির গ্যাঁজ দাঁতের হাসি মাহবুবের অনেক ভালো লাগে। মাহবুব এঞ্জয় করে অনেক নিশির পালটা জবাব গুলোকে আর নিশি মাহবুবের মজার কথায় হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত। একদিন নিশি সকালে বাসস্ট্যান্ডে আসেনি। মাহবুব সবার মাঝে নিশিকে খোঁজে কিনতু পায়না। এরপর মাহবুব চারদিকে তাঁকিয়ে মন খারাপ করে বাসে উঠে যায়। নিশির নাম্বারটা নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু কখনো ফোন করা হয়নি। ফোন কি করবে? অনেক ভেবে মাহবুব আর ফোন করেনি কিন্তু মন ও মানছে না। ওর হাসিটা তো একবার হলেও দেখতে হবে। ওর হরিণী চোখে যে আক্রমণাত্মক দৃষ্টি আছে। আস্তে আস্তে কি তবে ঘায়েল করে ফেলছে আমায়? মাহবুব নিশির নাম্বার বের করেই বসে থাকে কিন্তু ফোন দেয়না। রাতে বাসায় ফিরে মাহবুব ডিনার না করেই নিশিকে প্রথমবারের মতো ফোন দেয়। নিশি বলেছিলো ওর বাবা অনেক রাগী। যদি সে পাশে থাকে? রিং হওয়ার পর তুর্না ফোনটা রিসিভ করে।

-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? (তুর্না)
-নিশি আছে।
-হ্যা আপু আছে। আপনি কে?
-আমি তোমার আপুর ব্যাচমেট। তোমার আপুর কাছে একটা নোটস আছে আমার। ও তো আজ ভার্সটিতে আসেনি তাই আর কি! (মিথ্যে বলল মাহবুব যাতে নিশির কোনো সমস্যা না হয়)
-আপুর তো প্রচন্ড জ্বর তাই আসতে পারেনি। আপু এখন ঘুমুচ্ছে। জাগলে আমি বলব আপনার কথা। ভাইয়া আপনার নাম?
-মাহবুব।

মাহবুব ফোন কেটে দিলো। নিশির জ্বরের কথা শুনে মাহবুবের বুকে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। সেইদিন রাতে আর মাহবুব ডিনার করতে পারলো না। মন খারাপ করে মাহবুব ঘুমিয়ে যায়। রাত আড়াইটায় মাহবুবের ফোন বাজে। বালিশের নিচ থেকে মাহবুব ফোন বের করে দেখে calling from Nishi. মাহবুব ফোনটা কেটে কলব্যাক করে।

-ফোন দিয়েছিলেন আপনি? (গোঙাতে গোঙাতে নিশি)
-হ্যা। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? (টি শার্ট ঠিক করে উঠে দাঁড়ায় মাহবুব)
-হঠাৎ করেই জ্বর আসে।
-মেডিসিন খেয়েছো?
-না।
-না মানে? (হাইপার হয়ে মাহবুব)
-কালকে ডক্টর দেখিয়ে মেডিসিন খাব।
-তোমরা যেন কয়তলায় থাকো?
-সেকেন্ড ফ্লোরে।
-বিশ মিনিটের মধ্যে আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি। Somehow একটু নিচে নামো।
-কি বলছেন কি আপনি? এখন রাত আড়াইটা বাজে।(অবাক হয়ে নিশি)
-So what? আর তুমি নামতে না পারলে ঠিক আছে। আমি আসছি। রাখছি ফোন।

মাহবুব ওর ফার্স্ট এইড বক্স থেকে জ্বর, ঠান্ডা আর ব্যাথার ওষুধ নিয়ে বের হতে যাবে তখন ওর মনে পরে ওর ডাক্তার বন্ধু রিয়নের কথা। রিয়ন কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে ওষুধ গুলো দেওয়া ঠিক হবে কি না! রিয়ন হ্যা বলার পর মাহবুব চোখে চশমা পরে আর ট্রাউজার আর টি শার্ট পরেই বেরিয়ে যায়। পুরো রাস্তা ফাঁকা তবে সেইফ। মাহবুব হেঁটে হেঁটেই গেলো নিশির বাসার সামনে। সেখানে গিয়ে দেখলো গেইটের ভেতরে তিনতলার সমান মই আছে। মাহবুব নিশিকে ফোন করে বলে,

-বারান্দায় এসে দাঁড়াও।
-মানে কি? আপনি সত্যি সত্যি এসেছেন?
-মাহবুব যা বলে তা করে। তারাতারি আসো।

মাহবুব নিশির ঘরের বারান্দা বরাবর মই দাঁড় করিয়ে সেইটা দিয়ে নিশির বারান্দা অবধি উঠে। নিশি মাহবুবকে দেখে বিশ্বাস ই করতে পারছেনা। নিশির চুল এলোমেলো, শরীরে ওড়না নেই, দাঁড়াতে পারছেনা ঠিক করে। নিশির এই অবস্থা দেখে মাহবুব অন্যদিকে তাঁকিয়ে বলে,

-এগুলো এক্ষুণি খাও আর এই যে একটা কেক। (কেক আর মেডিসিন এগিয়ে দিয়ে মাহবুব)
-আপনি কি পাগল? (অস্বাভাবিক গলায় নিশি)
-হ্যা আমি পাগল। একটু পর আবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করব খেয়েছো কি না। তারাতারি রুমে যাও আর এগুলো খাও৷
-ভাইয়া এগুলো কি?
-মেডিসিন দেখতেই তো পারছো। আমি আসছি। টেক কেয়ার।

মাহবুব সেদিন চলে আসে। মইটা আবার ঠিক করে রেখে বেরিয়ে চলে আসে ও। নিশি এক দৃষ্টিতে বাইরে তাঁকিয়ে আছে। মাহবুব নিচে নেমে ইশারা করে বলল তারাতারি মেডিসিন খেতে। তাড়াহুরোয় নিশি খেয়ালই করেনি যে ওর শরীরে ওড়না নেই। নিশি তখন চরম লজ্জা পায়। এইজন্যই মাহবুব অন্যদিকে তাঁকিয়ে কথা বলছিলো? ছিহ কি হলো এইটা? তুর্না ঘুমাচ্ছে। কিছুই টের পায়নি ও। নিশি কেকের প্যাকেটের দুই পিস খেয়ে ওষুধ খায়। মাহবুব বাসায় গিয়ে ফোন করে নিশিকে জিজ্ঞেস করে,

-খেয়েছো?
-হ্যা। আপনি গিয়েছেন তো বাসায়?
-হ্যা মাত্রই।
-এই পাগলামি কখনো কেউ করে ভাইয়া? এত রাতে আপনি চলে এলেন!
-আজকে বাসস্ট্যান্ডে তোমায় না দেখতে পেয়ে সারাদিনই অস্থির ছিলাম। তোমার হাসিটা মিস করছিলাম বেশি। তোমার জ্বরের কথা শুনে আমি খেতেই পারিনি। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম এরপর তো তোমার ফোনের আওয়াজেই জাগলাম।
-কেনো? আমার জন্য কেনো আপনার এমন হবে? (নিশির বুক কাঁপছে)
-জানো তো নিশি এইটা আমারো প্রশ্ন! কেন আমার এমন হচ্ছে?
-খুব বেশি গভীরে চলে যাচ্ছেন আপনি ভাইয়া!
-হয়ত! গেলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে নিশি?
-জানিনা আমি। ঘুমান। শুভ রাত্রি।

নিশি ফোন কেটে দিয়ে কাঁপছে। মরণ প্রেম কি এভাবেই আসে? বুকের লাবডাব আওয়াজটা যে কিছুতেই কমানো যাচ্ছেনা! এ কিসের যন্ত্রণা? নিশি ওষুধ খাওয়ার জন্য ঘুমিয়ে যায়। আর মাহবুব ভয় পাচ্ছে। ওর ভয় হচ্ছে নিশিকে সত্যি কথাটা বলে কি ও ভুল করেছে? নিশি যদি এখন ওর বন্ধুত্বটাও নষ্ট করে দেয়? এসব ভেবেই মাহবুব সে রাতে আর ঘুমাতে পারেনি। পরবর্তী চারদিন নিশি ভার্সিটিতে যায়নি। কিন্তু মাহবুব ওর খোঁজ নিয়েছে। পাঁচদিনের দিন বাসস্ট্যান্ডে,,,,,,,

-নিশি তুমিইইই? সুস্থ আছো এখন? (অস্থির হয়ে মাহবুব)
-হ্যা। (একটু সরে দাঁড়িয়ে নিশি)
-আজকে বাস আসবেনা।
-কেনো?
-হরতাল হচ্ছে।
-ওহ নো!
-কথা বলবেনা আমার সাথে?
-বলছি তো। (নিচের দিকে তাঁকিয়ে নিশি)
-ঘামছো কেনো? হাত কেনো কাঁপছে? (নিশির হাতের দিকে তাঁকিয়ে মাহবুব)
-গরম তো তাই!
-পানি খাও।
-কেনো কাঁপছি আপনি বুঝবেন না! এখন আপনার সামনে আসলেই যে আমার এমন হয়। (মনে মনে নিশি)
-কি হলো খাও।
-হুম।
-বাসায় যাবেনা? আজ তো ভার্সিটিতে যেতে পারবেনা।
-অনেকদিন পর একটু ছুটি পেয়েছি। তাই তানিয়াকে নিয়ে একটু বলদা গার্ডেনে যাব ভাবছি।
-কেনো?
-প্র‍্যাক্টিক্যালের জন্য কিছু গাছ কালেক্ট করতে হবে তাই। আপনি অফিসে যাবেন না?
-নেই আজ অফিস।
-তাই টিশার্ট পরেই বেরিয়ে গেছেন?
-হুম। যাবে কিভাবে? গাড়ি তো নেই!
-রিক্সা চলে তো। রিক্সাতেই চলে যাব। বেশি দূর তো নয়।
-কাকে কল করছো?
-তানিয়াকে।
-এক মিনিট!
-কি?
-আমি যাই তোমার সাথে? (ভয়ে ভয়ে মাহবুব)
-না।
-প্লিজ!
-আপনি কেনো যাবেন? (নিশি ওড়নার সাথে আঙুল মোঁচড়াচ্ছে)
-এমনিই যাব। যাবে আমার সাথে?
-একবার না বলেছি।

এই কথা বলে নিশি হাঁটতে শুরু করলো। মাহবুব বাসস্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে রইলো।

-ম্যাম আপনার টিকেট টা দিন। (টিকেট চেকারের ডাকে ঘোর স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এলো নিশি)
-ও হ্যা এই নিন।
-ঠিক আছে।

চলবে