সাঁঝের প্রেম পর্ব-১৩+১৪

0
38

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_13+14
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

মাহবুব একটা ফুলের মালা হাতে নিয়ে হোটেলে ঢুকে। নিশির তরক্ষণে সাজ শেষ হয়ে গেছে। নিশি খোপায় ক্লিপ লাগাতে লাগাতে এসে দরজা খুলল। মাহবুব তখন দরজায় এক হাত রেখে হ্যালান দিয়ে নিশিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছিলো। নিশি শাড়ি ঠিক করছিলো।

-কি দেখছেন হ্যা? (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-স্যরি। (ভেতরে ঢুকে মাহবুব দরজা বন্ধ করে দিলো)
-হাতে কিসের মালা?
-ভেতরে ঢুকার সময় বাইরে দেখলাম তাই কিনে নিয়ে এলাম। তুমি তো ফরচুনেটলি খোপাও করেছো। আসো পরিয়ে দেই।

মাহবুব নিশির থেকে আরো কয়েকটা ক্লিপ নিয়ে নিশির খোপায় মালাটা পরিয়ে দিলো। মাহবুব টিপ পরা পছন্দ করেনা তাই নিশি আর টিপ পরেনি। মাহবুব টি টেবিলের উপর বসে নিশির হাঁটাচলা দেখছিলো আর নিশি মাহবুবের তাঁকানো দেখে আনইজি ফিল করছে। কিছুক্ষণ পর দুজন একসাথে ডিনার করে আসে। রুমে ঢুকে নিশি শাড়ি খোলার জন্য ওয়াশরুমে যায় কিন্তু এত পরিমাণ সেফটিপিন যেগুলো নিশি কিছুতেই খুলতে পারছেনা। শেষে ওয়াশরুমে সব এলোমেলো করে নিশি মাহবুবকে ডাকছে।

-এই শুনছেন? এইইইইই! (নিশি)
-বলো।
-একটু শুনে যান না!
-কি?
-সেফটিপিন গুলো খুলে দেন না প্লিজ। আমি পারছিনা।
-বাইরে বেরিয়ে এসো।
-আসছি।

নিশি শাড়ির আচলটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। নিশিকে এইভাবে এলোমেলো দেখে মাহবুবের হৃদয়ে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে। মাহবুব ইন্সট্যান্ট নিজেকে কন্ট্রোল করে নেয়। নিশি আনইজি ফিল করলেও কিছু করার নাই কারণ ও ফেঁসে গেছে। মাহবুব যত্ন করে নিশির শাড়ির পিনগুলো খুলছে। নিশির শরীরে মাহবুবের হাত লাগছে আর নিশি পাগল হয়ে যাচ্ছে আবার নিজেকে সামলে নিচ্ছে। মাহবুব যখন কুচির সেফটিপিন গুলো খুলতে গেলো তখন মাহবুব চোখ বন্ধ করে ফেলে কারণ ভুলটা যাতে মারাত্মক পর্যায়ে না যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। নিশির শাড়ি খোলা শেষ হয়ে গেলে মাহবুব কি মনে করে যেন নিশির চুল ও খুলে ফেলল। সাদা ফ্লোরে সেফটিপিন, কালো ক্লিপ আর ফুলগুলো ছিঁড়ে পরে আছে। মাহবুব নিশিকে দেয়ালে ঠেকিয়ে আঙুল দিয়ে ওর ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে। হাত দিয়ে নিশির চোখের কাজল নষ্ট করে।

-কি করছেন আপনি? (ভারী গলায় নিশি)
-আমি জানিনা আমি কি করছি। আমি হিপনোটাইজড নিশি! আই এম হিপনোটাইজড নিশি!
-এইটা কিন্তু চরম ভুল। ছাড়ুন।
-ভুল, শুদ্ধ এই মুহুর্তে আমি মানব না, স্যরি। (নিশির চুলের মুঠ ধরে নিশির চোখের দিকে তাঁকায় মাহবুব)

নিশিও মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে। ভুল করবেনা বলেই এত আয়োজন কিন্তু ভুল হয়েই গেলো। এর খেসারত এখন কে দিবে?

রাত একটা…..

নিশি ফ্লোরে বসে কাঁদছে আর গায়ে একটা চাদর। মাহবুব ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। নিশির লম্বা চুলে মুখ ঢেকে গেছে। মাহবুব এখন নিজেই ঘৃণায় মরে যাচ্ছে। ওর দ্বারা এত গর্হিত কাজ কিভাবে হলো? ইচ্ছে করছে এখনি তিন তলা থেকে ঝাপ দিতে। এখন যদি নিশি কন্সিভ করে যায়? ওকে তো আমি বিয়ে করব নিশ্চিত কিন্তু ওর কি হবে এখন? ওর সামনে যাব কিভাবে আমি? এই আবেগে ভুল তো করে ফেলেছি কিন্তু এখন মাশুল দিব কিভাবে? হাজারটা চিন্তা ভাবনা একসাথে জটলা বাঁধছে মাহবুবের মাথায়। মাহবুব শেষ পর্যন্ত ঘরে এসে নিশিকে বলে,

-নিশি উঠো। স্যরি বলার মুখ আমার নাই। আমি কালকেই তোমায় বিয়ে করব।
-নিশি কিছু বলছেনা।
-আমি এক্ষুণি বাইরে থেকে আসছি। তুমি ফ্রেশ হও উঠে। কাঁদবেনা একদম।

মাহবুব বাইরে গিয়ে নিশির জন্য অনেক খুঁজে ওষুধ নিয়ে আসে। এসে দেখে নিশি বসে আছে। মাহবুব নিশিকে মেডিসিনটা দিয়ে বলে,

-খাও।
-কি এইটা?
-খেতে বলছি খাও। আমি চুল আঁচড়ে দিচ্ছি।

মাহবুব চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে আর নিশি মন খারাপ করে বসে আছে। এতটা হেল্পলেস ওর আগে কখনো লাগেনি। মাহবুব এর ও সেইম অবস্থা কিন্তু নিশি যাতে ভেঙে না পরে এজন্য মাহবুব নিজেকে শক্ত রেখেছে। রাতে নিশিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মাহবুব পাইচারি করছে। তখনি ওর আরাফের কথা মনে পরে। ওর কলেজ লাইফ আর ভার্সিটি লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড আরাফ। অনেক ভালবাসে দুজন দুজনকে। সবকিছু শোনার পর আরাফ হতভম্ব হয়ে যায় কারণ মাহবুবকে দিয়ে এমন কিছু সম্ভব না। মাহবুব রীতিমতো কাঁদছে।

-দেখ মাহবুব নিজেকে সামলা। এখন তুই প্রতিষ্ঠিত। তোর কোনো ভয় নেই বউকে খাওয়ানো, পরানো নিয়ে। নিশিকে বিয়ে কর।
-হ্যা আমি ওইটাই করব। কিন্তু আমি বিয়ের কথা বলার পর ও তো আমায় কিছু বলল না।
-দেখ এইটা একটা মেয়ের জন্য অনেক সেন্সিটিভ ব্যাপার! তুই যতটা টেনসড এই মুহুর্তে তার চেয়ে হাজারগুণ টেনসড থাকা উচিৎ নিশির। তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে এই ভাবনা গুলো ভাবতো না। রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ মাহবুব!
-চুপ কর তো তুই! আমি আমার জ্বালায় মরছি।
-বিয়ে কর আগে।
-হুম।

আরাফ ও সেইম এডভাইস করলো মাহবুবকে আর তা হচ্ছে বিয়ে। মাহবুব ঘরে এসে নিশির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাঁকিয়ে স্যরি বলল। এরপর বিছানার একপাশে শুয়ে পরলো। মাহবুব সারারাত ভাবলো কি হবে এখন? আমি তো এমন কিছু চাইনি!

পরেরদিন সকালে,

নিশি ঘুম থেকে উঠে দেখে মাহবুব ঘুমাচ্ছে। হয়ত অনেক রাতে ঘুমিয়েছে তাই এতবেলা অবধি ঘুমাচ্ছে। নিশি আর ডাকেনি মাহবুবকে। নিশির ফোনে কল আসে তখন। মা ফোন করেছে। নিশি ফোনটা রিসিভ করার পরেই মা কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে,

-তুই কোথায়?
-ট্রিপে।
-কিসের ট্রিপে তুই? গত কালকে রাতে তোদের ভার্সিটির বাস ট্রিপ থেকে ফিরেছে। তোর বাবা নিজের চোখে দেখেছে। তুই তাহলে কোথায় এখন? তোর বাবা তোর জন্য কাল রাতে আমায় চড় মেরেছে। কোথায় তুই নিশি?
-নিশি চুপ করে আছে।
-নিশি দুপুরের মধ্যে বাড়ি আয় তুই। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন। এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেছিস তুই? বাবা মা কে মিথ্যে বলিস? কোথায় কোন বেহায়াগিরি করতে গিয়েছিস বল আমায়?
-আসছি আমি।

নিশি তখন হাউমাউ করে কাঁদছে। নিশির কান্নার আওয়াজে মাহবুব জেগে যায়। পেছনে তাঁকিয়ে দেখে নিশি কাঁদছে।

-কি হয়েছে? কেনো কাঁদছো তুমি? (নিশির সামনে বসে মাহবুব)
-মা ফোন করে অনেককিছু বলেছে আমায়। আসলেই আমি দুশ্চরিত্রা হয়ে গিয়েছি।
-একটা থাপ্পর মারব ধরে নিশি উলটাপালটা কথা বললে! কি হয়েছে সেইটাই বলো।

নিশি মাহবুবকে সব বলার পর মাহবুব একটু স্বস্তি পেলো। রীতিমতো হাসছে মাহবুব।

-আর ইউ ক্রেজি? আপনি হাসছেন? (নিশি)
-তোমার আম্মু মানে আমার শ্বাশুড়ি মা আমায় টেনশন ফ্রি করে দিলেন। চলো আজকেই ঢাকা ব্যাক করব। এরপর ডিরেক্ট তোমার বাসায় যাব এরপর বাকি কথা শ্বশুর আর শ্বাশুড়ির সামনে হবে।
-কি বলবেন আপনি?
-রেডি হও। আমি অনলাইনে টিকেট কাটছি।

নিশি মাহবুবের জামাকাপড় গোছালো আর নিজেরটাও গোছালো। মাহবুব টিকেট কেটে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যায়। এগারোটায় বাস। রাত তো হবেই যেতে যেতে। সন্ধ্যায় মাহবুব নিশিকে নিয়ে নিশির বাসায় যায়। নিশির বাবা চেয়ারে বসে আছে আর মা কাঁদছে। তুর্নাও চুপ করে বসে আছে। মাহবুব আর নিশিকে একসাথে দেখে নিশির মা দাঁড়িয়ে যায়। নিশির বাবা নিশির গালে ঠাস করে চড় মেরে দেয়।

-আংকেল কি করছেন আপনি? (মাহবুব)
-চুপ একদম। আমার আর আমার মেয়ের মাঝে কোনো থার্ড পার্সন এলাউ করবনা আমি। (পুরো রেগে আছে নিশির বাবা) কালকে রাতে কোথায় ছিলি? (নিশির বাবা)
-ফ্রেন্ড এর বাসায়। (নিশি)

এইটা শোনার পর নিশিকে আরো একটা সজোরে চড় মারলো নিশির বাবা। নিশি সামলাতে না পেরে পরে যায় আর দেয়ালে বারি খায়। মাহবুব নিশিকে উঠায় আর কড়া গলায় নিশির বাবাকে বলে,

-ইনাফ আংকেল! ও আপনার মেয়ে ছিলো কিছুক্ষণ আগেও কিন্তু এখন ও আমার বউ। সো আপনি এইভাবে আমার সামনে ওকে মারতে পারেন না। (মাহবুব)
-মেরিজ সার্টিফিকেট কোথায়? বিয়ে যে করেছো কাগজ কোথায়? (নিশির বাবা)
-এক্ষুণি করব। চলো নিশি। (নিশির হাত ধরে মাহবুব)
-খবরদার! ছাড়ো ওর হাত আর বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।
-যাব তবে নিশিকে নিয়ে। আর হ্যা আংকেল আমি যা তা ছেলে নই। সব পাবলিক এক্সামে র‍্যাংক করেছি আর বর্তমানে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার পদে আছি। আশা করছি আপনার মেয়েকে ভাল রাখতে পারব।
-আমার কসম নিশি যদি তুই ওই ছেলের সাথে বেরিয়েছিস আমার মরা মুখ দেখবি তুই। (বাবা)

নিশি দাঁড়িয়ে সব শুনছে। নিশি মাহবুবের হাত ছেড়ে দেয় আর মাহবুবের চোখের দিকে তাঁকিয়ে বলে,

-বাবা মানবেনা!
-সো হোয়াট? তুমি আমায় ভালবাসো না?(মাহবুব)
-না বাসেনা। বেরিয়ে যাও তুমি এই বাড়ি থেকে। আমি তোমার মতো ভন্ড ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবনা।
-আংকেল আমি আপনার কথাগুলো হজম করতে পারছিনা কারণ আপনি আমাকে যেই বিশেষণে বিষেশায়িত করছেন আমি তা নই। নিশি চলো।

নিশি মাহবুবকে বলে,

-আপনি বাসায় যান। আমি পরে জানাচ্ছি আপনাকে।
-পরে কেনো? এখন কি?
-প্লিজ বাসায় যান। (হাত জোর করে নিশি)
-ওকে আমি অপেক্ষা করছি।

মাহবুব চলে গেলো। নিশির বাবা তখন নিশির হাত ওনার মাথায় রেখে বললেন,

-কোনোদিন ওই ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখবিনা। যদি রাখিস তাহলে আমি সেইদিন মরব। আর তোর সুখের জন্য পরিবারের লাশের ভার তুই বইতে পারবি তো?
-নিশি চুপ করে আছে।
-বাবা ও অনেক ভালো ছেলে। আমি ভালবাসি ওকে। এমন কসম আমায় দিও না তুমি যেইটা আমি রাখতে পারবনা। (হাত নামিয়ে নিশি)
-একদম মেরে ফেলবো তোকে। তোর মতো মেয়েকে আমি জন্ম দিয়েছিলাম? সারারাত কোথায় নষ্টামি করে এসেছিস আর এখন বড় বড় কথা কিভাবে বলছিস? (আম্মু)
-আম্মু? তুমি বলছো এসব?
-হ্যা বলছি। বাবাকে কথা দে আর ওই ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখবিনা। (মা)
-কিন্তু কেনো? ওর দোষ কোথায়?
-দোষ নেই কিন্তু তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে তোর বাবা।
-স্যরি বাবা-মা। আমি মাহবুবকে ভালবাসি।
-আর আমি তোর বাবাকে ভালবাসি। এখন বল তুই কি করবি? স্বার্থপরের মতো নিজেরটাই ভাববি?

নিশি আর কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে আসে। মাহবুব নিশ্চিত নিশি ওর কাছেই আসবে। মাহবুব বাসায় জানায় ও একটা মেয়েকে ভালবাসে। মাহবুবের ছোট মা হইহুল্লা করে এ নিয়ে কিন্তু এতে মাহবুবের কিছু যায় আসেনা। মাহবুবের বলার দরকার তাই মাহবুব বলেছে। এইদিকে নিশি মাহবুবকে ফোন করে বলল,

-আপনি ভাল থাকবেন। আপনাকেই ভালবেসেছি আর ভালবাসবো। এইটুকুতে খুশি আমি যে আমার সর্বস্ব আপনাকে দিয়েছি। খুব ভালবাসি আপনাকে। তেমনি আমার মা ও তো ভালবাসে আমার বাবাকে। আমি যে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভাবতে পারিনা। (নিশি কাঁদছে) বাবা নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু আমিও বাবাকে শর্ত দিয়েছি আমি বিয়ে করবনা, ওনার সব কথা শুনবো।
-তাহলে আমার ঝুলি নিঃস্ব তাই তো? আমার তো কেউই ছিলনা তুমি ছাড়া। তুমিও এইভাবে চলে যাচ্ছো? পরিশেষে আমি একাই! তোমার পরিবার প্রায়োরিটি পেয়েছে কিন্তু আমি না কেনো?

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_14
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

মাহবুবের সাথে নানান তর্ক বিতর্কের পর নিশি কড়া কথায় বলে,

-আপনি বিয়ে করে নিবেন। ভুলে যান গতকালকের সন্ধ্যা আর ভুলে যান গত কয়েকমাসের স্মৃতি! আমি যে আপনার জীবন থেকে সরে এসেছি। নিজেকে আর জড়াবো না। জড়িয়ে জড়িয়ে অনেকটা প্যাঁচে গেছি তাই প্যাঁচ খুলব এখন।
-হাহাহা! তারপর? (কথাগুলো শুনে মাহবুবের চোখ থেকে পানি পরছে)
-তারপর আর কিছুইনা। দুজনার পথ আলাদা, বাড়ি আলাদা আর ঘর ও আলাদা! পাতা হবেনা আর কলা পাতার সংসার, ছিঁড়ে গেছে সেই পাতা আজ।
-নিশি আমার ধৈর্য কিন্তু শেষ! কথা দিয়েছিলে আমার হবে তবে আজ কেনো এসব বলছো? কেনো? কেনো? কেনো? (দেয়ালে আঘাত করে মাহবুব)
-আর কোনোদিন ফোন দিব না আমি আপনাকে আর আপনিও আমাকে আর ফোন দিবেন না। শেষ এখানে নিশি-মাহবুবের সাক্ষাৎ! সুখে থাকবেন হ্যা? ভালো রাখবেন সবাইকে আর বিয়েটা করে ফেলবেন।
-ওহ এইটুকুই? (মাহবুবের প্রচণ্ড রাগ লাগছে)
-হ্যা এইটুকুই।

নিশির জবাব শুনে মাহবুব ওর ফোনের সিম খুলে ভেঙে ফেলল আর ফোনটাও জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো। এরপর অনেকক্ষণ কান্না করলো মাহবুব। কারণ জীবনের সবচেয়ে ভাইটাল মোমেন্টে এসে সবচেয়ে বড় কষ্টটা ও পেলো। তিনমাস পর্যন্ত মাহবুব কারো সাথে কথা বলেনি আর নিশির সাথেও কোনো যোগাযোগ রাখেনি। এরপর এক বছর পর ছোট মায়ের সাথে ঝগড়া করে চিটাগং ট্রান্সফার হয়ে চলে আসে আর সেখানেই সেটেলড হয়ে যায়। এর মাঝে অনেকবার নিশির কথা মনে করেছে কিন্তু কোনো লাভ নেই। নিশি ভুলে গেছে তাইতো সরিয়ে দিয়েছে ওকে জীবন থেকে। আর এইদিকে নিশি ধুকে ধুকে মরছে। কোনোমতে বেঁচে আছে ও! কারণ এখন যে ওর সর্বস্ব মাহবুবকে লুটিয়ে দিয়েছে৷ আর তো কিছুই রইলো না ওর। বাবাকে প্রতিজ্ঞা করেছে ও আর মাহবুবের সাথে যোগাযোগ রাখবেনা আর কথাও বলবেনা। তাই নিজের প্রতিজ্ঞা বাঁচাতে সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করছে। এইদিকে নিশির বাবা অনেক জায়গায় নিশির জন্য পাত্র দেখেছে নিশির অনিচ্ছা সত্বেও। প্রতিবার পাত্রকে নিশি বলেছে “আমি কুমারী নই, সর্বস্ব লুটিয়ে দেওয়া কোনো এক পাগলি প্রেমিকা আমি”। এই কথা শুনে পাত্র পক্ষ বারবার রিজেক্ট করেছে নিশিকে। কিন্তু নিশির এতে বিন্দুমাত্র আফসোস ছিল না শুধু ছিল মাহবুবের প্রতি শ্রদ্ধা আর অসীম ভালবাসা।”

-ব্যাস এইভাবেই কাটিয়ে দিলাম পাঁচটা বছর। অনার্স শেষ করলাম, মাস্টার্স করলাম, জব করলাম এরপর আমি এই জায়গায়। (নিশি)
-অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে তাইনা ভাবি? (সায়েম)
-তা তো একটু আধটু করেছিই!
-আংকেল মারা গেলো কিভাবে?
-আমাদের রিলেশন ব্রেকের দেড় বছরের মাথায় বাবার হার্ট এটাক হয়। হার্ট এটাকের চারদিনের দিন বাবা মারা যায়। তখন আরো বড় টেনশন ছিলো আমার মাথায়।
-ভাল জিনিস সবসময় দেরিতেই হয় ভাবি। এত কষ্ট করেছো বলেই আজকে তুমি আমার ভাইয়ের বউ, তাও যে সে ভাইয়া নয়। এখন সে একজন সিনিয়র অফিসার।
-ফান ছাড়ো। তোমার কি কেউ নেই? (রান্না করতে করতে নিশি)
-আপাতত নেই। ভাবছি বিয়ে করব একবারে।
-এইটাই ভাল। প্রেমের ব্যাথা অনেক বড় ব্যাথা। তোমার ভাইয়া আর আমি জানি সেইটা বুঝছো।
-আমি তো কলাপাতার সংসার পাতবো না ভাবি যে ব্যাথা পাবো। আমি পাতব সিমেন্টের সংসার যার ঝালাই থাকবে আজীবন। হাহাহা।
-মানুষ হবা কবে? (হাসতে হাসতে নিশি)
-এইত বিয়ের পরেই। মাত্র পড়ি অনার্স থার্ড ইয়ারে! আরো তিনবছর!! বাপরে!
-পরে কি বাপের টাকায় বউকে খাওয়াবা নিজে কিছু না করলে?
-বউ কি হাতি নাকি যে বেশি খাবে? বাপের টাকায় চলে যাবে।
-বউ হাতি না বলেই নিজের কিছু করা লাগবে। তোমার পায়ের এখন কি অবস্থা?
-এখন জলুনি কমে গেছে। বিকেলে বের হব ভাবছি।
-না। তোমার ভাইয়া নিষেধ করে গেছে কিন্তু!
-ধুর ভাল্লাগেনা! আচ্ছা তুমি রান্না কর। আসছি আমি।

সায়েম টি শার্ট পরে আর থ্রি কোয়ার্টার এর পকেটে হাত রেখেই বাইরে চলে যায় হাঁটতে। বাড়ির আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করে সায়েম চলে আসে। নিশি রান্নাবান্না শেষ করে ঘরের সব কাজ শেষ করে নেয়। তখন তুর্না ফোন করে বলে,

-আপু মাহবুব ভাইয়া এতগুলো টাকা কেনো পাঠালো?
-কবে?
-এইত এগারোটায় টাকা সেন্ড করে আমায় কল করে বলল আমার কলেজ আর প্রাইভেট ফি যাতে দিয়ে দেই আর আম্মুর সব ওষুধপত্র যেন কিনে দেই। যা যা দরকার তা যেনো ভাইয়াকে বলি।
-আমাকে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে তাই আমি জানিনা। কত টাকা দিয়েছে?
-২০ হাজার।
-আচ্ছা আমি ওর সাথে কথা বলব নে। তোর এক্সাম প্রিপারেশন কেমন?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-ভালভাবে পড়াশোনা করবি। আম্মু কে চিল্লাচিল্লি করতে দিবিনা।
-আচ্ছা আপু। ভাইয়ার রাগ কি কমেছে তোমার উপর?
-হ্যা কমেছে।
-যাক! আম্মু এইটা নিয়া চিন্তা করছিলো অনেক। আম্মু বারবার আমাকে বলছিলো ওদের ভাব হলো নাকি কে জানে? মা হয়ে তো জিজ্ঞেস ও করতে পারিনা।
-পাকামো কম কর। (লজ্জা পেয়ে নিশি)।
-আরে আপু আস্তে। চিনি আমি তোমায় বুঝছো আর আমি কিন্তু ছোট নই হ্যা? বিয়ের বয়স হয়ে গেছে আমারো। তাছাড়া এখন বায়োলজি পড়ছি। (তুর্না হাসছে)
-আবার শুরু করলি তুই? (ধমক দিয়ে নিশি)
-আচ্ছা যাও থামলাম। ইনশাআল্লাহ দেখা হবে। আর ভাইয়াকে এখন ভাল রেখো। রাখছি আমি।
-বাই।

তুর্না ফোন কাটার পর নিশি মাহবুবকে ফোন দিলো। মাহবুব তখন অফিসে জুনিয়রদের সাথে কথা বলছিলো। মাহবুব স্ক্রিনে বউ নামটা দেখে কেটে দিলো। তখন এক জুনিয়র বলল,

-মে বি ম্যাডাম ফোন করেছে। স্যার আপনি কথা বলে আসুন। আমরা ওয়েট করছি।
-না সমস্যা নেই। কার কি প্রবলেম বল।

মাহবুব সবার ঝামেলা শেষ করে, ফাইল সাবমিট করে নিশিকে কলব্যাক করলো। তখন লাঞ্চ টাইম।

-হ্যা বলো। ফোন দিয়েছিলে?
-লাঞ্চ করছো? (নিশি)
-না করিনি এখনো। সময় পাইলে করব। বসের তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই সব আমার উপরেই বর্তিয়ে দিয়ে যায়।
-আগে খেয়ে নাও তারপর বাকি কাজ। আর শোনো
-কি?
-তুর্না ফোন দিয়েছিলো। তুমি নাকি ওরে টাকা পাঠাইছো?
-হ্যা।
-কিন্তু কেনো?
-এইটা ইউজলেস কুয়েশ্চন নিশি। আগে তো তুমি দেখতা তোমার ফেমিলিকে। এখন আমার দেখা উচিৎ আর সেইটা আমি ভালবেসেই দেখি। তুমি যদি চাকরিটা না ও ছাড়তা তাও আমি ওদের দেখতাম কারণ দে আর অলসো মাই রেসপন্সিবিলিটি।
-এইজন্য বিশ হাজার টাকা কেনো?
-যা লাগবে খরচ করবে বাকিটা পরে করবে।
-আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে এই নিয়া কোনো কথা শুনতে চাইনা।
-তোমার কোনো শ্বশুর ঘর নেই ওকে? কেউ তোমাকে কিছু বলতেও আসবেনা।
-আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও এখন। পাঁচ মিনিট পর ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছি খেয়েছো কি না!
-আচ্ছা।

মাহবুব ফোন কেটে অফিস ক্যান্টিনে গেলো। সবার সাথে কথা বলতে বলতে মাহবুব লাঞ্চ করলো। এরপর নিশিকে ফোন দিয়ে জানালো লাঞ্চ করেছে আর নিশিকে বলল ও যাতে লাঞ্চ করে নেয়। সন্ধ্যের সময় চাঁদের জ্যোৎস্না গায়ে মেখে মাহবুব বাড়ি ফিরছিলো। মাহবুবকে দেখে নিশি ওর বাঁকা দাঁতে খুব মিষ্টি একটা হাসি দেয়।

-হাসির রহস্য? (ঘড়ি খুলতে খুলতে মাহবুব)
-নাথিং।
-সায়েম কই?
-ঘরে। সারাক্ষণ ঘরেই ছিলো।
-ওহ
-কেনো?
-ফর দিজ! (নিশিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাহবুব)
-মনে আছে তোমার?
-প্রতিটা মোমেন্ট মনে আছে।
-ফ্রেশ হয়ে আসো কফি করে দেই! (মাহবুবের ভেজা শার্টের গন্ধ নিয়ে নিশি)
-এই শার্টে কি আছে এমন?
-তা তুমি বুঝবেনা।
-এই শীতেও আমি ঘামে ভিজে যাই! নিজেকে আমার মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে!
-পৃথীবির সপ্তম আশ্চর্যের তুমি একটা!
-আমি মোটেও তা নই।
-সেইটা আমি জানি ঠিক আছে! এখন আসেন আপনি।

নিশি রান্নাঘরে এসে কফি বানায় আর সায়েম নিজের ঘরেই বসে আছে। মাহবুব ফ্রেশ হয়ে সায়েমকে ডাকে ড্রইংরুমে। এরপর তিনজন মিলে আড্ডা দেয়। সায়েম মাঝে সাঝেই মাহবুবকে খোচাচ্ছিলো বিভিন্ন টপিকস নিয়ে। রাতে ডিনার করে এজ ইউজুয়াল সাড়ে দশটার মধ্যে মাহবুব শুয়ে পরেছে। নিশি প্লেটগুলো ধুয়ে এরপর ঘুমাতে আসে।

-এই মশাড়ি টানাও। (নিশি)
-পারব না। (ফোন টিপতে টিপতে মাহবুব)
-দেখো পারবনা বলবানা। আমার অনেক মশা লাগে।
-তো টানিয়ে নাও। এরোসল দেওয়ার পরেও যদি বলো মশা লাগে তো আর কি বলব?
-আমার একদম ই ভাললাগেনা মশাড়ি টানাতে। প্লিজ তুমি কর না। (মাহবুবকে ঠেলতে ঠেলতে নিশি)
-আমারো ভাল লাগেনা।
-তাহলে মশার কামড় খাও! এছাড়া আর কি!
-তুমি টানাবেনা? (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-না। আমি কোনোদিন মশাড়ি টানাইয়া ঘুমাইনাই। ঘুম আসেনা আমার শরীরে মশাড়ি লাগলে। মশার কামড় খাব তাও মশাড়ি টানাবো না।
-ঠিক আছে আমিই টানাচ্ছি। বাট তুমি মশাড়ির বাইরে ঘুমাবা।
-বাহ! এইটাই তো চাই। টানাও।

নিশি মশাড়ি টানিয়ে মাহবুবের পাশে দিয়ে মাহবুবকে মশাড়ির বাইরে বের করে দেয়। মাহবুবের পায়ের পশমগুলোতে বারবার মশাড়ি লাগছে। মাহবুব খুবই বিরক্ত হচ্ছে। নিশি একটা পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে পাশ ঘুরে শুয়ে পরে। মাহবুব মশাড়ির ভেতর ঢুকে বলে,

-এই মশাড়িকে হাজার শিকের কারাগার মনে হয় আমার! ওই! (নিশির পিঠে হাত দিয়ে)
-আবার হাত দাও কেনো? সরো তুমি! আর মশাড়ির ভেতর কেনো ঢুকছো? (মাহবুবের দিকে ঘুরে নিশি)
-তোমার চেহারা দেখার জন্য আসছি।

মাহবুব বালিশে শুয়ে পরে আর নিশি মাহবুবের বুকের উপর মাথা রেখে মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়। রাত তখন ১১ টার ওপরে। মাহবুব নিশিকে হালকা করে কিস করে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে মশাড়িটা খুলে। মশাড়িটা বারান্দার কোনায় রেখে আসে যাতে নিশি খুঁজে না পায়। এরপর নিজের অফিসের ব্যাগে থাকা একটা পকেট থেকে অনেকগুলো জিনিস বের করে মাহবুব। এরমধ্যে ৩৩ টা মোমবাতি দিয়ে পুরো ঘর সাজায় মাহবুব। ছোট ছোট মোমবাতি গুলো দিয়ে ফ্লোরে লাভ চিহ্ন আঁকে আর মাঝখানে ফুলের পাপড়ি দিয়ে লিখে নিশি মাহবুব। আর বিছানার একপাশে কতগুলো ফুল ছড়িয়ে দেয় আর নিশির গায়ে গোলাপের সুগন্ধি মেখে দেয়। পুরো ঘর সাজানো হয়ে গেলে মাহবুব নিশিকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই কোলে নেয়। মাহবুব নিশির কপালে ডিপ কিস করে।

চলবে