সাঁঝের প্রেম পর্ব-১৭+১৮

0
34

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_17+18
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

নিশি এমন এক সিদ্ধান্ত নিলো যা কোনো সুস্থ মানুষ মেনে নিবেনা। নিশি সবাইকে বলল,

-আমার ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমিও ওর সাথে নিজেকে শেষ করে দিব। মা, তুর্না তোমরা কেঁদো না। তুর্নার নামে আমি একাউন্টে কিছু সেভিংস রেখে গেছি। আশা করি বছর তিনেক চলে যাবে আর ততদিনে তুর্না নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (কথাগুলো অস্বাভাবিক ভাবে বলল নিশি)
-নিশি মা কি বলছিস তুই এসব? তোর ভেতর এখন আরেকটা প্রাণ আছে। তুই কেনো ওর প্রাণ কেড়ে নিবি? এসব কথা বলিস না মা। (নিশিকে বুকে জড়িয়ে আম্মু)
-মা আমি ওরে ছাড়া থাকতে পারবনা মা, পারবনা। আমি ওরে বাঁচাতেও পারবনা। আমার রক্তের গ্রুপ যে বি পজিটিভ। এবি নেগেটিভ তো ওর রক্ত। (কাঁদতে কাঁদতে নিশি)
-নিশি তুমি কি বললা? মাহবুবের রক্তের গ্রুপ কি? (ছোট মা)
-এবি নেগেটিভ।

ছোট মা সায়েমকে নিয়ে তখন ডক্টরের কাছে যায়। কারোরই মনের অবস্থা ভাল নেই। ছোট মা ডক্টরকে জিজ্ঞেস করে,

-কত ঘণ্টার মধ্যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে?
-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে। পেশেন্টের বিপি ফল করছে, গ্লুকোজের পরিমাণ ও বেড়ে গেছে শরীরে। এ অবস্থায় আমাদের কি করা উচিৎ আমরা জানিনা। আপনারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিডনির ব্যবস্থা করুন। নয়ত পেশেন্টকে আসলেই বাঁচানো….
-না ডক্টর শুনুন। আমার ছেলেকে বাঁচতে হবে। ও তো বাবা হতে যাচ্ছে। মাহবুবের রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। আমারো এবি নেগেটিভ। আমার একটা কিডনি আমি মাহবুবকে দিতে চাই।
-হ্যা একটা কিডনি দিয়েই দুজনে বাঁচতে পারবেন কিন্তু ব্লাড গ্রুপ মিললেই হবেনা, টিস্যু ও ম্যাচ করতে হবে।
-ডক্টর যা করার তারাতারি করুন। আমার ছেলের বউটা যে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
-আম্মু কি বলছে এসব? হয়ত এতদিনকার পাপবোধ মনে আঘাত করছে! যাইহোক আজকে আমি আম্মুকে আটকাবো না। (মনে মনে অবাক সায়েম)
-আসুন তারাতারি।

মাহবুব আইসিউতে। সেই কখন থেকে মাহবুব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। নিশির বুক ফেটে যাচ্ছে মাহবুবকে এভাবে দেখতে দেখতে। ছোট্ট সংসারটা তো ভালই চলছিলো। সুখের কোনো কমতি ছিল না। তো আজ কেন এমন হলো? আরাফ আর আরাফের বউ ও হাসপাতালে চলে এসেছে। চিটাগং সিটির সবচেয়ে বড় হাসপাতালে মাহবুব ভর্তি। আরাফ চেয়েছিলো মাহবুবকে ঢাকায় নিয়ে আসতে কিন্তু নিশি দেয়নি। ভাগ্যবশত মাহবুবের ছোট মায়ের সাথে মাহবুবের টিস্যু আর ব্লাড ম্যাচ করে যায়। সায়েম সবাইকে জানায় মা ভাইয়াকে একটা কিডনি দিচ্ছে। অপারেশন শুরু জন্য হাসপাতালের রিসিপশনে মাহবুবের আব্বু চারলাখ টাকা জমা করে। দুই ঘণ্টার মধ্যে মাহবুবের অপারেশন শুরু হয়। নিশি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে আর আল্লাহকে বলছে,

-কেড়েই যখন নিবে তখন ক্ষণিকের সুখের জন্য কেনো ওকে দিয়েছিলে আল্লাহ? কেনো পিতৃহারা হবে আমার সন্তান? কোনোদিন তোমায় ভুলে যাইনি। জীবনে কখনো যদি কোনো ভাল কাজ করে থাকি তার বিনিময়ে হলেও আমার মাহবুবকে আমায় ফিরিয়ে দাও আল্লাহ। আমি না হয় মরেই যে যাব। তিনটা প্রাণ তুমি শেষ করে দিওনা খোদা। ফিরিয়ে দাও না আমার মাহবুবকে আমার কাছে। সুখের মুখ দেখিয়ে আজ দুঃখ কে কেনো আলিঙ্গন করাচ্ছো তুমি? (নিশি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেই)

সায়েম, তুর্না, মাহবুবের আব্বু সবাই কাঁদছে। কেউ কাউকে সামলানোর মতো অবস্থায় নেই। নিশি সেন্সলেস হয়ে যায়। তখন সায়েম নিশিকে কোলে নিয়ে বেডে শোয়ায়। ডক্টর নিশিকে দেখার পর বলে,

-এইভাবে চললে ওনার পেটের বাচ্চাটার ক্ষতি হয়ে যাবে। এক কাজ করি আমি ওনাকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দেই। উনি ঘুমাক। তিনঘণ্টা মেয়াদি মেডিসিন দিচ্ছি।
-যা ভাল হয় করেন। কিন্তু ভাবিকে ঠান্ডা করুন আগে।

তুর্না নিশির চুল ঠিক করে দিচ্ছে আর নিশির কপালে চুমু দিয়ে মনে মনে বলে,

-আপুর এই সুখটুকু তুমি কেড়ে নিওনা মালিক। সারাজীবন আপু আমাদের জন্য করে এসেছে। নিজে কিছুই পায়নি। আমার জীবন টাই তুমি আমার ভাইয়াকে দিয়ে দেও। বাঁচিয়ে দেও আমার ভাইয়াকে। নয়ত যে আমার আপু পাগল হয়ে যাবে। (তুর্না)

ডক্টর নিশিকে মেডিসিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। তুর্না আর মা নিশির পাশে বসা। সায়েম শুধু হাসপাতালের বারান্দায় পাইচারি করছে। সাড়ে তিনঘণ্টা পর,

-ডক্টর আমার ভাইয়া? (উত্তেজিত হয়ে সায়েম)
-He is now out of danger but সম্পূর্ণ তিনমাস ওনাকে বেড রেস্টে রাখতে হবে।
-থ্যাংকস আল্লাহ! আর আমার আম্মু?
-উনিও ভাল আছেন। ওনারো বেড রেস্টের প্রয়োজন।
-আমি ভাবিকে বলে আসছি।

সায়েম দৌড়ে নিশির কাছে যায়। হাসিমুখে নিশিকে বলে,

-ভাবি আর কেঁদোনা। ভাইয়ার অপারেশন সাক্সেসফুল। তোমার ফরিয়াদ আল্লাহ শুনেছে। এক ঘণ্টা পর ভাইয়ার সাথে দেখা করতে পারবে তুমি। নিজের আর বাচ্চাটার আর কোনো ক্ষতি করনা তুমি।
-কিহ? তোমার ভাইয়া কোথায়? (লাফ দিয়ে নিশি বেড থেকে নেমে)
-আস্তে ভাবি। ভাইয়া ওটিতেই আছে। কিছুক্ষণ পর ভাইয়াকে বেডে দেওয়া হবে।
-ছোট মা কেমন আছে?
-আম্মু ও ভাল আছে।
-আমি যে ছোট মা’র কাছে আজীবনের জন্য ঋণি হয়ে গেলাম। (নিশি চোখের পানি মুছে)

আরাফ আর আরাফের বউ নিশিকে বলে,

-এখন তো থামো পাগলি। আর কেঁদো না। মাহবুব এইসব শুনলে মারবে তোমায়। আর এসবের কি তুমি কিছুই জানতে না? একদিনে তো আর এই অবস্থা হয়নাই মাহবুবের। (আরাফ)
-না ভাইয়া আমি কিচ্ছু জানতাম না। শেষ কয়েকদিনে দেখি ওর অসুখ ভালই হয়না তাই তো হাসপাতালে এনে জানতে পেরেছি। ওর খুব ইচ্ছে হয়েছিলো আমায় রেখে চলে যাওয়ার। তাই চলে যাচ্ছিলো। একবার ওর জ্ঞান ফিরুক শুধু….

এক ঘন্টা পাঁচ মিনিট পর,

মাহবুব ওর বেডে শুয়ে আছে। কোমড়ের উপরে ব্যান্ডেজ করা। নড়াচড়া করা যাচ্ছেনা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাই অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখে। চোখ খুলেই মাহবুব আগে নিশিকে খুঁজছে। চোখ খুলে ভালকরে তাঁকাতেও পারছেনা ও। ডক্টর মাহবুবের গ্লুকোজ কমানোর জন্য ইঞ্জেকশন দিলো আর বিপি চেক করে ওষুধ দিলো। ডক্টরের মুখেও হাসি। ডক্টর নার্সকে বলে,

-ওনার ওয়াইফকে ডেকে আনুন।
-ইয়েস স্যার।

নার্স গিয়ে নিশিকে ধরে ধরে নিয়ে আসে। মাহবুব তখন চোখ বন্ধ করে হাত পা টান করে শুয়ে আছে কারণ হাতে রক্ত চলছে। নিশি এসে মাহবুবের মাথার পাশে চেয়ারে বসে। নিশি বসার পর মাহবুব চোখ মেলে তাঁকায়। নার্স সরে গিয়ে দাঁড়ায়।

-তুমি কেঁদেছো? (অক্সিজেন মাস্ক খুলে মাহবুব)
-না হেসেছি। দেখছো না আমি হাসছি? (নিশি চোখ মুছে)
-এইত তুমি কাঁদছো! আমি বেঁচে আছি কিভাবে? এতক্ষণে তো আমার জানাজা হওয়ার কথা।
-চুপ একদম! এইসব কি বলছো তুমি? কিচ্ছু হবেনা তোমার। ছোট মা তার নিজের কিডনি দিয়ে তোমায় বাঁচিয়েছে।

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_18
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

মাহবুব আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে আর নিশিকে বলছে,

-ছোট মা কিডনি দিয়েছে মানে? ছোট মা কোথায়?
-ছোট মা তিনতলায় কেবিনে আছে। আর তুমি ফোর্থ ফ্লোরে। ছোট মা ভাল আছে। এবি নেগেটিভ ব্লাড রেয়ার সেইটা তো তুমি জানো। ছোট মা ছাড়া কার কারো ব্লাডগ্রুপ তোমার সাথে ম্যাচ করত না। ফরচুনেটলি টিস্যুগুলো ও ম্যাচ করে গেছে।
-আমি মরে গেলে তো ছোট মায়ের ভাল হতো। ওনার একজন ওয়ারিশ কমে যেতো।
-ছোট মা এতটাও খারাপ না এইটা আমি তোমায় আগেও বলেছি। উনি হয়ত তোমার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছে কিন্তু মন থেকে তো চায়নি যে তুমি মরে যাও। আর বাবা সব খরচ দিচ্ছে তোমার। এই নিয়ে তুমি আর একটা কথা বলো না।
-আরাফ তুই? (পেছনে তাঁকিয়ে মাহবুব)
-শুধু তুই একবার উঠে দাঁড়া তখন দেখিস তোর হাড়গোড় কিভাবে ভাঙি। এত বড় একটা খবর তুই কাউকে জানালি না? নিজের মধ্যে রেখে দিলি? এক দুইদিনে তো আর এতটা খারাপ অবস্থা হয়নি তোর? (রেগে গিয়ে আরাফ)
-আমিই জেনেছি আড়াই মাস আগে।
-তো কি সেইটা আমাদের জানার অধিকার ছিল না মাহবুব?
-আমি ভেবেছিলাম যেদিন চলে যাব সেইদিন ই জানবি। এর আগে চিন্তা দিয়ে লাভ কি!
-ওহ ইউ জাস্ট শাট আপ! তোর সাথে আমি কোনো কথা বলতে চাইনা আর। (চোখ মুছে আরাফ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো)
-এখন কথা বলো না তুমি৷ চুপচাপ শুয়ে থাকো। তোমায় বেডরেস্ট দিয়ে দিয়েছে ডক্টর। দশ/বারোদিন পর তোমায় ঢাকা নিয়ে যাব৷ সেখানেই থাকবা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত৷

মাহবুব আর কিছু বলেনি। নিশি মাহবুবের চুলে হাত বোলাচ্ছে। নার্স এসে মাহবুবকে মেডিসিন দিয়ে গেলো। আর নিশিকে বলল,

-বাড়ির খাবার নিষেধ ওনার জন্য। হাসপাতাল থেকেই খাবার দেওয়া হবে ওনাকে। সব খাবার তরল হবে৷
-ও বাইরের খাবার খেতে পারেনা। আমি বাসা থেকেই ওর জন্য লিকুইড খাবার করে নিয়ে আসব। (নিশি)
– আপনি ডক্টরের সাথে কথা বলুন। দেখুন উনি কি বলে। (নার্স)
-ওকে আসছি আমি।

নিশি সায়েমকে নিয়ে ডক্টরের কেবিনে যায়। ডক্টর নিশিকে পার্মিশন দেয় বাড়ি থেকে খাবার দেওয়ার জন্য বাট ঝাল একদম ই থাকবেনা। মাহবুব ঝাল এমনিতেও খায় না। নিশি ডক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার পর ছোট মায়ের কেবিনে গিয়ে ওনাকে দেখে আসে। ছোট মা নিশির কাছে ক্ষমা চায় তখন নিশি রেগে যায় ছোট নায়ের উপর কারণ উনি মা। উনি কেনো ক্ষমা চাইবে? সায়েম নিশিকে বলে,

-ভাবি তোমার বাসায় যাওয়া উচিৎ। অনেক বেশি স্ট্রেস গেছে তোমার উপর। রেস্ট করা উচিৎ তোমার।
-হ্যা যাব। ছোট মা আর ওর জন্য খাবার ও বানাতে হবে। কে থাকবে ওর কাছে?
-আমি আছি, আরাফ ভাইয়া আছে। তুমি, তুর্না আর আন্টি চলে যাও৷
-আসো।

নিশি মাহবুবের সাথে দেখা করে হাসপাতাল থেকে চলে আসে। একটা গাড়ি নিয়ে তিনজন বাসায় এসে নামে। বাসায় এসে নিশি ফ্রেশ হয়ে মাহবুবের জন্য রান্না বসায়। তখন মাগরিবের আযান পরে যায়। নিশি নামাজ পড়ে সায়েমকে ফোন করে।

-তোমার ভাইয়ার কি অবস্থা? ঘুমাচ্ছে ও?
-হ্যা।
-তুমি সবসময় পাশে থেকো। আর আরাফ ভাইয়া কি আছে?
-হ্যা ভাইয়া আছে আর তিশা ভাবিও আছে। রাতে আমি আসব তোমায় নিতে৷ একা একা এসো না।
-আচ্ছা আমি তোমায় ফোন দিব নে।
-আচ্ছা।

নিশি ডাক্তারের কথা অনুযায়ী মাহবুবের জন্য রান্না করে সব প্যাক করে। তুর্না আর মা ও হেল্প করে। তুর্না নিশিকে বলে,

-আপু তুমি এখন এত কাজ করনা। যা যা করার দরকার হবে আমাকে বলো আমি করে দিব।
-আমার সমস্যা হচ্ছে না তো। সমস্যা হলে তুই করে দিস। (তুর্নার গালে হাত রেখে নিশি)
-ও একদম ঠিক কথাই বলেছে নিশি। এখন কি তুই একা যাবি?
-না সায়েম আসছে।
-রাতে কি ওইখানেই থাকবি?
-হ্যা তাছাড়া কিছু করার নেই। হাসপাতাল তো আর কাছে না।
-তোর অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। এখন তো তুই একা না।
-কেনো তোমরা শুধু বাবুর কথা ভাবছো? যে বাবুর জন্মদাতা তার কথা কি আগে ভাবা উচিৎ না? সন্তান আমার সাময়িক সুখ আর আমার স্বামী আজীবনের জন্য। আমি মোটেও এখন আমার সন্তানকে নিয়ে ভাবছি না। আমার এখন পুরো মনোযোগ আমার স্বামীর দিকে। আর মা আমি পারব। দুজনকেই সামলাতে আমি পারব।

নিশি রেডি হয়ে বসে থাকে সায়েমের জন্য। সায়েম কিছুক্ষণ পর বাসায় ঢুকে। তুর্না সায়েমকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

-ভাইয়া কেমন আছে?
-আগের চেয়ে বেটার। এখন স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে।
-আপনি খেয়েছেন?
-না এখনো খাইনি। আর ভাবি কোথায়?
-আপু ঘরে এশারের নামাজ পড়ছে। আপনি এই ফাঁকে চেঞ্জ করে আসুন।
-আমি সাথে করে একটা ড্রেস ও নিয়ে আসিনি। চেঞ্জ করে পরব কি? বাসায় যা পরেছিলাম এইটা পরেই চলে এসেছি।
-ভাইয়ার ড্রেস তো আছে।
-ও হ্যা রাইট। টেনশনে সব ভুলে গিয়েছি। আচ্ছা আমি আসছি।

সায়েম গোসল করে বের হওয়ার আগে ভাবি ভাবি করে চিল্লাচ্ছে। নিশি বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করে,

-কি লাগবে বলো?
-টাওয়েল লাগবে, ভাইয়ার শার্ট বা টি শার্ট লাগবে আর প্যান্ট বা ট্রাউজার লাগবে৷
-দাঁড়াও দিচ্ছি।

নিশি সায়েমের হাতে সবকিছু দিয়ে পুরোপুরি রেডি হয়। সায়েম বের হলে সায়েমকে বলে,

-খেতে বসো।
-সময় নেই এখন খাওয়ার!
-সারারাত লাগিয়ে তো আর খাবে না। বসো তারাতারি। তুর্না সায়েমের জামাকাপড় গুলো বারান্দায় মেলে দিস তো। (সায়েমের প্লেটে ভাত দিতে দিতে নিশি)
-এই না তুর্না তোমার কষ্ট করা লাগবেনা। আমিই দিয়ে দিব।
-না সমস্যা নেই। (তুর্না)

সায়েম খাওয়া শেষ করে নিশিকে নিয়ে বেরিয়ে যায় আর তুর্নাকে বলে যায় সাবধানে থাকতে। নিশি ওর ফোন তুর্নাকে দিয়ে যায় যাতে যেকোনো দরকার হলে কল করতে পারে। রাতে নিশি মাহবুবকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। এরপর নার্স এসে ওষুধ খাওয়ায়। মাহবুবকে খাবার খাওয়ানোর আগে ডক্টর সেইটা টেস্ট করে জানায় যে এই ধরনের খাবার ই উপযুক্ত ওনার জন্য।

টানা বারোদিন এইভাবে চলল। মাহবুব এখন সুস্থ তবে হাঁটতে পারেনা। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারেনা। ছোট মা এর ও একই দশা। মাহবুবের আব্বু নিশিকে বলে,

-আজকে তো বারোদিন। আমি এইখানে আর ওদের ট্রিটমেন্ট করাতে চাইছিনা। আমি ডক্টরের থেকে ডিসচার্জ নিয়ে ঢাকায় নিয়ে ওদের ট্রিটমেন্ট করাবো আর বাসায় রেখে।
-হ্যা বাবা আমি এইটা অনেও আগেই ভেবেছি। এখানে টাকা ও খরচ হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে স্লোলি। তাছাড়া ওরা এখন সুস্থ বলা যায়।
-হ্যা আমি ডক্টরের সাথে কথা বলছি।

ওদের ডিসচার্জ করে দেয় ডক্টর অনেক ঝামেলার পর। সায়েম ছোট মা আর মাহবুবের জন্য এম্বুলেন্স ভাড়া করে দুইটা কারণ রাস্তার ঝাঁকি বিপজ্জনক ওদের জন্য। আর কেউই সোজা হয়ে বসতে পারেনা। মাহবুবের সাথে নিশি যায় আর ছোট মায়ের সাথে বাবা। তুর্না, মা আর সায়েম একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে একই সাথে ঢাকায় চলে আসে। ক্যামেলিয়ার আম্মুকে বলে আসে নিশি ওইদিকটা দেখার জন্য। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর মাহবুব ঢাকায় আসলো। নিজের বাড়ি ও আজ অচেনা মনে হচ্ছে কারণ অনেক কিছুই পালটে গেছে বাড়ির। পাঁচতলা বাড়িটাকে সাততলা করা হয়েছে, ড্রইংরুমের পরিবর্তন, মাহবুবের ঘরটাই শুধু আগের মতো আছে তবে বেশ পরিষ্কার। গাড়ি থেকে নামিয়ে মাহবুবকে আর ছোট মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে লিফটে করে তিনতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। মাহবুব চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ানোর কিন্তু নিশি নিষেধ করে।

– ঘা শুকিয়ে গেলে যা খুশি করবা, এখন নয়। ডক্টর যেদিন ব্যান্ডেজ কাটবে সেইদিন আমি চিন্তা মুক্ত। এর আগে তোমার কোনো বারাবারি আমি বরদাস্ত করব না। (নিশি)
-ওকেহ ম্যাডাম। আর কতদিন এভাবে পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে কে জানে! (মাহবুব)

মাহবুব কে সায়েম আর নিশি ধরে বিছানায় শোয়ায়। মাহবুব বলে,

-ছোট মা কই?
-যাচ্ছি আমি। তুমি শুয়ে থাকো। এই নাও ফোন। ফোন টিপো শুয়ে শুয়ে। (মাহবুবের ফোন হাতে দিয়ে নিশি)

মাহবুবের হাতে ফোন দিয়ে নিশি চলে যায় ছোট মায়ের কাছে। ছোট মা কে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে সায়েম। নিশি তখন জিজ্ঞেস করে ছোট মা কে,

-এক খাবার খেতে খেতে বোর হয়ে গেছেন না ছোট মা?
-আর ভালো লাগছেনা এই ভেজিটেবল স্যুপ খেতে। আমায় একটু নুডুলস করে দিবা?
-হ্যা দিতে পারি কিন্তু ঝাল দিবনা নুডুলস এ। সেইটা হারাম আপনাদের মা ছেলের জন্য।
-আচ্ছা বেশ। (হেসে দিয়ে ছোট মা)

-সায়েম? সায়েম? (অন্য ঘর থেকে মাহবুব সায়েমকে ডাকছে)
-হ্যা বলো ভাইয়া। (হাফ শার্ট খোলা অবস্থায় সায়েম)
-ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ড কি?
-আমি জানিনা।
-থাপ্পর মারব ধরে। তোর ওয়াইফাই আর তুই জানিস না?
-আরে ভাইয়া পাসওয়ার্ড ই আমি জানিনা।
-আবার? (এইবার মাহবুব রেগে গেছে)
-ধুরো তোমার ফোনটা দাও। আমি কানেক্ট করিয়ে দিচ্ছি। এই দেখো পাসওয়ার্ড হচ্ছে “Ami Janina”
-এই আজব পাসওয়ার্ড কেন দিয়ে রেখেছিস? (মুখ ভেংচিয়ে মাহবুব)
-আর বলো না মানুষ কেম্নে কেম্নে যেন আমার ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড জেনে যায়। এইবার আর কেউ জানতে পারবেনা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলি আমি জানিনা। তখন ওদের রিয়েকশন ঠিক তোমার মতই হয়। (হাসতে হাসতে সায়েম)
-আজব!

নিশি ড্রেস চেঞ্জ করে মাহবুব আর ছোট মায়ের জন্য নুডুলস রান্না করলো। বাড়ির গেস্ট রুম দুইটা। একটা বেডরুম বাবা আর ছোট মায়ের আর একটা সায়েমের আর একটা মাহবুবের। একটা গেস্টরুমে সায়েম তুর্না আর মা কে থাকতে দিয়েছে। মাহবুবকে নুডুলস খাওয়াতে গিয়ে নিশি কেমন যেন করছে।

-নিশি আর ইউ ওকে?
-আসছি।

নিশি নুডুলসের বাটি রেখে দৌড়ে ওয়াশরুমে যায়। নুডুলস এ অল্প একটু মাংস দিয়েছিলো সেই গন্ধটাই নিশির সহ্য হয়নি। নিশি বমি করছে আর মাহবুব তুর্নাকে ডেকে বলছে,

-দেখো তো তোমার আপুর কি হলো!
-দেখছি ভাইয়া। তুমি বসে থাকো এখানেই।

তুর্না ওয়াশরুমে গিয়ে দেখে নিশি বেসিনের কল খুলে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখে মুখে পানি দিচ্ছে।

-বমি করেছো?
-হ্যা। হঠাৎ করে এমন হলো কেন?
-এগুলো হঠাৎ করেই হয়। এখন থেকে তোমার সব কাজ বন্ধ। ভাইয়া সুস্থ হয়ে গেছে। রান্না এখন আমি করব। এক্সাম শেষ আমার সো আমি ফ্রি আছি। তুমি ভাইয়ার সাথে বসে বসে গল্প করবা।
-হইছে!
-এখন সাবধানে বের হও।

তুর্না নিশিকে এনে খাটে বসায়। রান্নাঘরে গিয়ে তুর্না কিছু একটা খুঁজছে। সায়েম নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। তুর্না ছোট মা কে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আন্টি বাসায় কি কোনো আচার আছে? টক আচার।
-ফ্রিজে আছে দেখো। তুমি খাবা?
-না আন্টি আমি আচার খাই না। আপুকে দিতাম। আপুর শরীর ভালনা। একটু আগে বমি করেছে।
-তুমি অনেক সেন্সেবল। ফ্রিজে আছে দেখো।
-থ্যাংক ইউ আন্টি।

তুর্না একটা পিরিচে করে নিশির জন্য আচার নিয়ে যায়। মাহবুব তখন নিশিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলো। তুর্না ঘরে ঢুকে আবার পিছু ঘুরে বলে,

-এই স্যরি, স্যরি। আমি কিছুই দেখিনি।
-সমস্যা নেই এসো। শালি আধি ঘারওয়ালি। (মাহবুব)
-এইজন্যই বলে ছেলেদের মন বোঝা, নয় রে নয় সোজা। বউয়ের সামনে বলে শালি আধিঘারওয়ালি! ছিছিছি ভাইয়া!
-তোমার হাতে কি?
-ও হ্যা আপু এই নাও তোমার আচার। খাও একটু ভাল লাগবে।
-আমার টক ই খেতে ইচ্ছে করছিলো। থ্যাংক ইউ। (পিরিচটা নিয়ে নিশি আচার খেতে শুরু করে)
-আপু বিকেলে আমি একটু বের হব।
-কোথায়?
-দরকার আছে।
-একা একা যাস না। সায়েম ফ্রি থাকলে ওরে বলব নিয়ে যাবে।
-না শুধু শুধু সায়েম ভাইয়াকে বিরক্ত করে লাভ কি? আমি একাই যেতে পারব।
-যাবি কোথায়?
-ফ্রেন্ড এর বাসায়।
-আচ্ছা তাহলে যাস।

কাজের মেয়ের হেল্প নিয়ে তুর্না সেদিন সবার জন্য ডিনার বানায়। মাহবুব আর ছোট মায়ের জন্য আলাদা খাবার। নিশি হাজারবার হেল্প করতে চেয়েছে কিন্তু তুর্না দেয়নি। সন্ধ্যার পর সায়েম ঘুম থেকে উঠে কাজের মেয়েকে বলে,

-ব্ল্যাক কফি করে আন তো আমার জন্য।
-ভাইয়া একটু দেরি হবে। ভাবির বোন রান্না করছে। চুলা খালি নেই।
-কে রান্না করছে?
-তুর্না আপা।

সায়েম বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরে আসে। এসে দেখে তুর্নার চুল খোপা করা আর হাতে হলুদ,মরিচ মাখানো আর ওড়না কোমড়ে গুঁজা।

-হেই মিস চিকনী চামেলি তুমি রান্না করছো কেন? নিপা(কাজের মেয়ে) তো ছিল। (সায়েম)
-ব্যাপার নাহ। আমি করতে পারি তাই করছি। আপনার কি কিছু লাগবে?
-আপাতত এক মগ ব্ল্যাক কফি হলেই চলবে।
-আচ্ছা আপনি যান। নিপা দিয়ে আসবে।

ডিনারের আগে সবাই ড্রইংরুমে বসে গল্প করছিলো। মাহবুব আর ছোট মা হুইল চেয়ারে বসা।

-জানো তো আব্বু আমি কোনোদিন কল্পনা করিনি যে আমরা পুরো পরিবার কোনোদিন একসাথে হব। যদিও একটা এক্সিডেন্টের কারণে এইটা হওয়া তবুও আজ আমি ভীষণ খুশি। (সায়েম)
-হ্যা সেইটা আমিও ভাবিনি। তোরা দুইজনেই তো আমার সন্তান। এছাড়া তো আর কেউ নেই। তোরা বাসায় না থাকলে মনে হয় আমি বিরানভূমিতে আছি। আজ কত সুন্দর আমরা একসাথে। বাড়ির পরিবেশটাও পাল্টে গেছে। (বাবা)
-যাইহোক সেসব বাদ দাও। তুর্না তুমি আজকে রেঁধেছো নাকি? (মাহবুব)
-হ্যা ভাইয়া।
-খাওয়া যাবে তো? (মজা করে মাহবুব)
-এইভাবে লেইকফুল করনা। খেয়ে দেখো।
-মেয়েটা নিশির মতই সংসারী। বয়সের তুলনায় বেশি ম্যাচিউরড। (ছোট মা)

চলবে