সাঁঝের প্রেম পর্ব-২১+২২

0
48

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_21+22
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

তুর্না নিশিকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু নিশি মাহবুবকে দেখবেই। এক সময় নিশি ধৈর্য হারা হয়ে নিজেই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেলো যেখানে মাহবুবের মৃতদেহ রাখা। নিশিকে নিচে দেখে সায়েম দৌড়ে নিশির কাছে যায়।

-ভাবি? তুমি এখানে কি করছো? তুর্না তুমি ভাবিকে আসতে দিয়েছো কেনো? (সায়েম)
-আপু আমার কথা শোনেনি৷ এই অবস্থায় দৌড়ে চলে এসেছে। (কাঁদতে কাঁদতে তুর্না)

নিশি আস্তে আস্তে মাহবুবের মৃতদেহের পাশে বসে। মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরানোর পর এক মুহুর্তের জন্য নিশির হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। নিশির পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। মাহবুবের নাকে তুলো গোজা, চোখে কালো কি লাগিয়েছে ওরা? আর আগরবাতির গন্ধে পুরো বাড়ি ভরে গেছে। এখন যে নিশির চিৎকার করতে হবে সেই কথাটাই নিশি ভুলে গেছে। এক দৃষ্টিতে নিশি মাহবুবের দিকে তাঁকিয়ে আছে। মাহবুবের বাবা পাশেই ফ্লোরে বসে কাঁদছে। সায়েম পিছু ঘুরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নিশিকে তুর্না ধরে রেখেছে।

-এই তুর্না ও এভাবে শুয়ে আছে কেনো? আমাকে তো বলেছিলো ও বিকেলেই বাসায় চলে আসবে। ছোট মায়ের কাছে তো ও চিংড়ি ভুনা খেতে চেয়েছিলো। ছোট মা রান্না করে রেখেছে তো। ও কি খাবে না নাকি? শুয়ে আছে কেন এভাবে? এই মাহবুব? মাহবুউউউউউউব? (নিশি এইবার চিৎকার করছে)

ঘন্টাখানেক পর,

নিশি নিজের ঘরে শুয়ে আছে। পাশে বসে আছে তুর্না আর নিশির মা। তুর্নার চোখ ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। নিশির মা ভারী গলায় তুর্নাকে বলে,

-মাহবুবকে আজকে ফজরের নামাজের পর দাফন করবে। এতক্ষণ তুই নিশিকে দেখ। কতক্ষণ ও ঘুমিয়ে থাকে কে জানে! আমার মেয়েটাও শেষ হয়ে যাবে রে। পাঁচটা বছর কষ্ট করে পাঁচদিনো সুখে থাকতে পারলো না ও। (নিশির মা)
-আমি আছি আপুর কাছে।

সারারাত সায়েম, মাহবুবের আব্বু, ছোট মা মাহবুবের কাছে ছিলো। হয়ত মাহবুব বলছিলো তোমরা কাঁদছো কেন? আমি আছি তো। নিশিকে গাইনোকোলজিস্ট ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে ওর সেফটির জন্য। সকালে সায়েম আর সায়েমের আব্বু ফজরের নামাজ পরে নিশির ঘরে যায়। সায়েম নিশিকে ঘুম থেকে জাগায়। নিশি তখন কিছুক্ষণের জন্য সব ভুলে যায়। আবার নিশি কাঁদতে আরম্ভ করে।

-ভাবি কেঁদো না আর! আমরা ভাইয়াকে এখন জানাজার জন্য নিয়ে যাব। তুমি কি শেষ বারের মতো ভাইয়াকে দেখবানা? (সায়েম)
-আমি তো ওরে কোনোদিন শেষ বারের মতো দেখতে চাইনি সায়েম। তোমরা ওরে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবা কেনো?
-দেখো ভাবি কেউ কি চিরকাল বেঁচে থাকে? থাকে না তো? ভাইয়া নেই তো কি হয়েছে? আমরা সবাই আছি তো তোমার পাশে। প্লিজ আর কেঁদো না। একটা বার ভাইয়াকে দেখবে চলো।

নিশি কেঁদেই যাচ্ছে। সায়েমকে ওর আব্বু বলে,

-থাক! ও এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন আরো কষ্ট পাবে। এসো।

সায়েম আর সায়েমের আব্বু নিচে চলে আসে। নিশি তখন উঠে বারান্দায় দাঁড়ায়। সায়েম, সায়েমের আব্বু আর সায়েমের দুই বন্ধু মাহবুবের খাটিয়ার চার পায়া ধরে মাহবুবকে নিয়ে যাচ্ছে। নিশি তখন ওই জায়গায় চিৎকার করে বসে পরে। বারান্দার গ্রিল ধরে নিশি জোরে জোরে কাঁদছে।

-প্লিজ নিয়ে যেয়ো না ওকে। ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। দিয়ে যাও মাহবুবকে আমার কাছে প্লিজ। মাহবুব নিশিকে একা করে এইভাবে চলে যেতে পারলে তুমি??

সায়েম আর সায়েমের আব্বু জানাজা পরে মাহবুবকে দাফন করে বাসায় আসে। সায়েমকে ওর আব্বু সামলায়। বাসায় এসে সায়েম দেখে নিশি বারান্দায় বসে বসে চাকু দিয়ে হাত কাটছে। একদম এলোমেলো হয়ে আছে নিশি। চাকু দিয়ে হাত ইচ্ছেমতো পোচাচ্ছে নিশি। রক্ত ফোটা ফোটা পরছে ফ্লোরে। সায়েম দ্রুত গিয়ে নিশির হাত থেকে ছুরি নেয়।

-পাগল হয়ে গেছো তুমি ভাবি? কি করছো এসব? আম্মু? তুর্না? (সায়েম চেঁচাচ্ছে)
-আপু? এসব কি করছো তুমি? (তুর্না নিশির হাত চেপে ধরে)
-ছাড়। একদম ধরবি না আমায়। আমি মাহবুবকে ছাড়া বাঁচতে পারবনা। তাই আমিও ওর কাছে চলে যাব। (তুর্নার হাত সরিয়ে দিয়ে নিশি)
-কোথায় ছিলে তুমি? বলেছিলাম না ভাবির সাথে থাকতে? (তুর্নাকে ধমক দিয়ে সায়েম)
-আমি এতক্ষণ ছিলাম আপুর সাথে। মাত্র একটু উঠে গিয়েছিলাম।
-ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসো যাও।
-আনছি।

সায়েম নিশির হাত বেঁধে দিচ্ছে আর বলছে,

-ভাবি তুমি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো নাকি ভাইয়ার স্মৃতিকে? তুমি যে একা না! কেন এমন করছো? এই মুহুর্তে কারোরই মনের অবস্থা ভাল নেই। কে কাকে সামলাবে বলো? প্লিজ তুমি এমন পাগলামো কর না। তোমার ভেতরকার সত্ত্বাটাকে কষ্ট দিও না ভাবি। ওকে বাঁচতে দাও।

নিশি মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে। সবাই ড্রইংরুমে বসে কাঁদছে। গতকালকেও এই সময়ে মাহবুব সহ সবাই একসাথে এখানে বসে গল্প করছিলো। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে মাহবুবের আব্বু। সায়েম সবার জন্য খাবার অর্ডার করে। এরপর খাবার বাসায় আসার পর সায়েম সবার আগে নিশিকে খাওয়াতে যায়। নিশি কিছুতেই খাবেনা কিন্তু সায়েম ও না খাইয়ে ছাড়বে না নিশিকে। নিশি কিছুই খেতে পারেনি। সব বমি করে ফেলে দিয়েছে। এখন খালি পেটে নিশিকে ওষুধ খাওয়াবে কি করে? সায়েম তুর্নাকে ডেকে বলল একটু পর নিশিকে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাওয়াতে। তুর্না সেইটাই করলো। এরপর সায়েম সবাইকে খাবার দিলো। কিন্তু কেউ একটা দানা ও মুখে তুললো না। এইটা নিয়ে সায়েম আর কিছু বলল না। কারণ এইটাই স্বাভাবিক।

এইভাবে সাড়ে তিন মাস কেটে গেলো। এই সাড়ে তিনমাস নিশি তিনটা কথা কারো সাথে বলেনি। সারাক্ষণ নিজেকে ঘরবন্ধি করে রেখেছে আর কেঁদে কেঁদে চোখের পানি শেষ করে ফেলেছে। কিন্তু চোখের পানি কি আদৌ শেষ হয়? প্রেমের নেশা, ভালবাসার নেশা কি এতটাই ঠুনকো জিনিস যে এত সহজে হারিয়ে যাবে? এইদিকে সায়েম আর তুর্নার বিয়ের ডেট ও পিছানো হলো। সায়েম ফাইনাল ইয়ারের লাস্ট সেমিস্টার শেষ করেছে। এইদিকে নিশির ডেলিভারির সময় ও হয়ে গেছে। বাড়ির সবার সেইদিকে সজাগ দৃষ্টি। নিশি হাসে না, কথা বলেনা সারাক্ষণ মাহবুব মাহবুব করে। কেউ চেষ্টা করেও নিশিকে হাসাতে পারেনি, কথা বলাতে পারেনি। হঠাৎ করে নিশির এই বোবা হয়ে যাওয়া শুধুমাত্র মাহবুবের জন্য। দেখতে দেখতে সময় ও পার হয়ে যাচ্ছে আর নিশির ও ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। মেয়েকে সবার আগে কোলে নেয় সায়েম। সায়েম বাবুকে কোলে নিয়ে আম্মুকে বলে,

-দেখো মা কত সুন্দর দেখতে হয়েছে ও! একদম ভাইয়ার মতো গায়ের রঙ।
-মাশাআল্লাহ বল।
-নজর লাগবেনা মা।

মানসিক ভাবে নিশি পুরো ভেঙে পরেছে। যদি মনটা খুলে দেখা যেতো তাহলে হয়ত সেই জায়গাটা ধ্বংসস্তূপের মতো দেখাতো। মেয়ে হওয়ার পর নিশি একটু একটু স্বাভাবিক হয়। মেয়েকে নিয়েই থাকে সারাক্ষণ। নিশির কাম ব্যাক করাতে বাসার সবাই ভীষণ খুশি হয়।

একদিন বিকেলে নিশির মা আর সায়েমের মা বসে বসে গল্প করছে,

-অল্প বয়সে মেয়েটা স্বামী হারালো। মেয়েটার পুরো জীবন এখনো পরে আছে। শরীরের অবস্থা কি করেছে। ওর চোখের দিকে তাঁকানো যায় না। মা হয়ে মেয়ের এই দুর্দশা সহ্য হয় না আমার। (নিশির মা)
-এই বয়সে এত বড় শোক আসলেই মানা যায় না। নিশি কিভাবে বেঁচে আছে সেইটা আপনি, আমি দেখছি কিন্তু ওর মনের অবস্থা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি?
-আমার মেয়েটাকে চিনি আমি। সেই একুশ বছর বয়স থেকে ওর যন্ত্রণা শুরু। আজ ওর বয়স আটাশ। এই সাতটা বছর অনেক কিছু সহ্য করেছে ও। বাবা হারিয়েছে, ভালবাসা হারিয়ে আবার পেয়েছে, সুখে সংসার করছিলো ঠিক সেই সময় সব আবার তছনছ হয়ে গেলো।
-প্রায় পাঁচমাস তো হয়ে গেলো মাহবুব চলে গেছে। এই পাঁচ মাসের তিন মাসই নিশি একা ছিল। এখন মেয়েকে নিয়ে আছে। নিশিকে কি আবার বিয়ের কথা বলব?
-নিশি মানবেনা। সে কথা যে আমি ভাবিনি তা না কিন্তু ও মানবেনা।

দুজনের কথার মাঝে হঠাৎ নিশি ওর দুই মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে রেডি হয়ে ড্রইংরুমে আসে।

-বউমা কোথাও যাচ্ছো? (ছোট মা)
-হ্যা ছোট মা। মাইসারা’র প্রচুর ঠান্ডা লেগেছে। ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলাম। এখন যাচ্ছি।
-সে কি! দিদুনকে নিয়ে একা যাবে নাকি তুমি? তুর্নাকে নিয়ে যাও।
-ওর একটু পর কোচিং আছে তাই আর ওকে বলিনি। আসছি আমি ছোট মা।

নিশি বের হতে যাবে তখনি সায়েম ঘরে ঢুকে। সায়েম ব্যাগটা কাঁধ থেকে রেখেই মাইসারা কে কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করে।

-কোথাও যাচ্ছো? (সায়েম)
-হ্যা। বাবুকে ডক্টর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।
-একা যাচ্ছো?
-বাবা তুই যা তো। দিদুনকে নিয়ে ও একা যাবে। একা তো ছাড়বোই না আমি। (ছোট মা)
-সায়েম মাত্র বাসায় আসলো ছোট মা। তুমি ফ্রেশ হও সায়েম। আমি পারব।
-হইছে! আম্মু আমি যাচ্ছি। এসো।

সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিশি জুতা পরে সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নামছে। পাঁচমাসে আজ প্রথম নিশি বাইরে বের হচ্ছে। এর আগে হাসপাতালে গিয়েছিলো মাইসারাকে দুনিয়াতে আনতে। বাসার নিচে গিয়ে সায়েম রিক্সা ডাকে। নিশি আগে রিক্সায় বসে। এরপর সায়েম মাইসারাকে নিয়ে উঠে। নিশি মাইসারাকে টাওয়েল দিয়ে ঢেকে দেয়। মাহবুব চলে যাওয়ার পর সায়েম আর ফাইজলামো করেনা। একদম পরিণত ও।

-ওর এত খারাপ অবস্থা তুমি তো আগে বলনি? (সায়েম)
-ইচ্ছে করেই বলিনি।
-কোন ডক্টর দেখাবা?
-ডক্টর বিশ্বাস।
-চাইল্ড স্পেশালিষ্ট ডক্টর বিশ্বাস?
-হ্যা।
-একটা কথা বলব রাখবে?
-কি?
-আম্মুকে ডক্টর দেখানোর পর ফুচকা খেতে যাবে?
-না সায়েম। আমি চেম্বারে যাব আর সেখান থেকেই বাসায় আসব।
-প্লিজ! রিকুয়েষ্ট এইটা আমার।
-আমার ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে নেই সায়েম আর মাইসারা অসুস্থ।
-ও আমার কাছেই থাকবে। নয়ত কোনো রেস্টুরেন্টে চলো।
-না।

সায়েম আর কিছু বলেনি। বাবুকে ডাক্তার দেখিয়ে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর সায়েম নিশিকে বলে,

-তুমি কি যাবেনা ভাবি?
-না সায়েম।
-আচ্ছা তো বাসায় চলো।
-হুম।

আবার একটা রিক্সা নিয়েই ওরা বাসায় আসে। সায়েম মাইসারার জন্য ওষুধ কিনে ঘরে ঢুকে। ওষুধের প্যাকেটগুলো সায়েম নিশির হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সায়েম ওর ঘরে ঢুকতে যাবে তখন সায়েমের মা আর বাবা সায়েমকে ওনাদের ঘরে ডাকে। সায়েম আব্বু আম্মুর ঘরে যায়।

-হ্যা আম্মু বলো।
-ডক্টর কি বলল?
-মাইসারা ভাল আছে। হাল্কা ঠান্ডা লেগেছে শুধু।
-বাবা একটা কথা বলব যদি কিছু মনে না করিস!
-বল না। মনে করার কি আছে?
-তোর জীবন তো কেবল শুরু আর তুর্নার সাথেও তোর বিয়ে ঠিক করা। এইদিকে নিশি নিজেকে সম্পূর্ন একা করে ফেলেছে। পরিবারের বাইরে হয়ে গেছে ও। ঘর থেকেও বের হয়না। এখন আমি তোকে যেই কথাটা বলব হয়ত তুই সেইটা ইজিলি নিবি না বা ভাববি তোর জীবনটা আমরা নষ্ট করছি।
-কি কথা আম্মু? আর এইভাবে বলছো কেন?
-নিশিকে তোর বিয়ে করতে হবে বাবা। আমি জানি এতে তোর অনেক কষ্ট হবে কিন্তু নিজের খুশি হারিয়ে
যদি অন্যকে খুশি করা যায় সেইটাতে তৃপ্তি বেশি জানিস তো?
-অনেস্টলি একটা কথা বলছি ভাবির এই একা থাকা আমারো পছন্দ না। কিন্তু তুর্না? ওর সাথে তো আমার বিয়ে ঠিক করা!
-সেইটা আমি তুর্নাকে বুঝিয়ে বলব। কিন্তু তুই কখনো ভাবিস না যে আমরা তোর জীবন নষ্ট করে দিচ্ছি। শুধু ঘরের বউকে খুশি রাখিস।

সায়েম একটু হেসে সেখান থেকে চলে এলো। আর কিছুই বলল না সায়েম। সেই হাসির মানে কি সেইটা সায়েমই জানে। হয়ত কষ্ট থেকেই হাসি এসেছে মুখ থেকে।

রাতে ডিনার করে সায়েম নক করে নিশির ঘরে ঢুকে মাইসারাকে দেখার জন্য। নিশি তখন শুয়ে শুয়ে কাঁদছিলো আর মাইসারা ঘুমাচ্ছে। সায়েম ঢোকার সাথে সাথেই নিশি চোখ মুছে ফেলে।

-পানি মুছলেই কি ফুলা কমে যায়? যাইহোক মাইসারা কি ঘুমাচ্ছে? (সায়েম)
-হ্যা মাত্রই ঘুমালো।
-ডিনার করেছো?
-না করিনি।
-ঠু গুড। বাবু ঘুমাচ্ছে এসো ডিনার করবে।
-না সায়েম খাব না। তুমি খেয়েছো?
-হ্যা মাত্রই। তুমি যাবে নাকি আমি খাবার নিয়ে আসব এখানে?
-খাব না সায়েম। মন চাইলে পরে খেয়ে নিব।

নিশির কথা শুনে সায়েম বাইরে বেরিয়ে এলো। ডায়নিং থেকে প্লেট তুলে সেখানে ভাত, তরকারি আর ডিম নিলো। সাথে এক গ্লাস দুধ ও নিয়ে গেলো নিশির জন্য। এইটা আবার তুর্না দেখেছে। তুর্না তখন কিছুই বলেনি। সায়েম নিশিকে খাবার দিয়ে বলে,

-খেয়ে নাও। আমি বসছি।
-তুমি ঘুমাতে যাও। অনেক রাত হয়ে গেছে।
-আগে খাও তুমি। জেদ করবানা সব কিছু নিয়ে।
-আচ্ছা তুমি যাও আমি খেয়ে নিচ্ছি।
-আমার সামনে খেলে কি সমস্যা?
-সমস্যা নেই।
-তো খাও।

নিশি এতক্ষণ ডান হাত লুকিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু খাওয়ার জন্য হাত বের করতেই হাতে ব্যান্ডেজ দেখলো সায়েম। সায়েম আবার রেগে গেলো নিশির উপর।

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_22
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

নিশির হাতে ব্যান্ডেজ দেখে সায়েম প্রচন্ড রেগে গেলো। সায়েম নিশিকে জিজ্ঞেস করলো,

-ভাবি তোমার হাতে কি হয়েছে? আবার তুমি হাত কেটেছো?
-না। মাইসারার ওষুধের শিশি ভেঙে গেছে আর সেই কাঁচটুকরো তুলতে গিয়েই হাত কেটে গিয়েছে।
-কেন? বাসায় কোনো মেইড সার্ভেন্ট ছিল না?
-সায়েম তোমাকে এত ভাবতে হবেনা। আমি চামচ দিয়ে খেয়ে নিব।
-তো খাও।

সায়েম উঠে চলে আসলো নিশির ঘর থেকে। নিশি বামহাতে চামচ নিয়ে কোনোরকম খেলো কিন্তু মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারছেনা বলে মাছটা সাইড করে রেখে দিলো। তুর্না তখন নিশির ঘরে আসলো। নিশি তুর্নাকে দেখে বসতে বলল।

-আপু কি হলো? মাছ খাও নি তুমি? (তুর্না)
-না হাত কেটে গেছে তাই কাঁটা বাছতে পারছি না।
-কিভাবে কাটলো হাত?
-কাঁচ তুলতে গিয়ে।
-আমাকে তো ডাকতে পারতে! এইদিক দাও আমি মাছের কাটা বেছে দিচ্ছি।

এরপর তুর্না মাছের কাঁটা বেছে নিশিকে খাওয়ালো। সায়েম তখন ড্রইংরুমে আসলো পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেতে খেতে সায়েম দেখলো তুর্না আর নিশি একসাথে। তুর্না প্লেট নিয়ে বাইরে এসে সায়েমকে দেখেও এভয়েড করলো। সায়েম তুর্নাকে ডাক দিলো।

-তুর্না শোনো?
-জ্বি বলেন।
-ভাবি খেয়েছে?
-হ্যা খেয়েছে।
-তুমি খেয়েছো?
-হ্যা। আপনি ঘুমাতে যান না কেন? রাত তো অনেক হলো।
-হ্যা যাব। তুমি কি ফ্রি আছো?
-কেন?
-কথা ছিল তোমার সাথে।
-আচ্ছা।
-আমার ঘরের বারান্দায় আসো দুই কাপ কফি নিয়ে।
-হুম।

তুর্না সায়েমের কথা মতো দুই কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় গেলো। সায়েম তখন গ্রিলে থুতুনি রেখে চুপচাপ চেয়ারে বসেছিলো আর কি যেন ভাবছিলো। “কফি” এই শব্দে সায়েমের ভাবনায় ছেদ ঘটলো।

-হ্যা তুর্না বসো। (সায়েম)
-না ঠিক আছে। বলেন কি বলবেন।
-আম্মু কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানো?
-কি? আপুর সাথে আপনার বিয়ের সিদ্ধান্ত?
-জানো তুমি? (তুর্নার মুখের দিকে তাঁকিয়ে সায়েম)
-হ্যা জানি। আর এইটাও বলছি আপনি বিয়েতে রাজি হয়ে যান। আমার ভাগনি আর আপুর দায়িত্ব নিন। দেবর স্বামী হবে এইটা তো ইসলাম বহির্ভূত নয়, কোনো ধর্ম বহির্ভূত ও নয় এইটা। বরং আপনার সওয়াব হবে যদি আমার আপু আর ভাগনির দায়িত্ব নেন।
-তুর্না আমি সেসব ভাবছি না।
-আপনি ভাবছেন আমার কথা কি তাই তো?
-তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা। গত ছয়মাস ধরে আমি সেইটাই জানি। আর ভাবিকে আমি আমার বউ বানাবো ব্যাপারটা কি এতই সোজা? ভাবিকে বউ করা যায়? (কফিতে চুমুক দিয়ে সায়েম)
-ভেবে নেন না আপু আপনার ভাবি ছিলই না। আপু মে বি আপনার সাড়ে তিন বছরের বড় হয়। আমার একটা কথা কি রাখবেন?
-কি?
-আমার কথা আমি সাইডে রাখলাম। আমার বিয়ে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও হবে। আপু তার জীবনের মূল্যবান সময়টুকুই আমাদের পেছনে ব্যয় করেছে। কোনোদিন আমাকে বুঝতে দেয়নি কষ্ট কি বা অভাব কি! যখন যা চেয়েছি তা ই পেয়েছি। আজকে সেই আপুর ভালোর জন্য যদি আমি কিছু করতে পারি তাহলে সেইটা আমি করবই। আপুর ঋণ তো শোধ করতে পারবনা তবে আপুকে আবার আগের মতো দেখতে তো পারবো।
-আচ্ছা সব বাদ দিলাম এখন তুমি আমায় বলে দাও তো ভাবিকে বউ হিসেবে আমি ট্রিট করব কিভাবে? একটু বলে দাও প্লিজ।
-সেইটা আপনিই ভালো জানেন। সারাজীবন তো ফ্যান্টাসিতে ছিলেন, এখন বাস্তবের সম্মুখীন হলেন না হয়!
-হাহাহা আচ্ছা তুমি যাও। আর ধন্যবাদ তোমায়।
-কেনো?
-নিজের বোনের কথা এইভাবে ভাবার জন্য।
-ইটস মাই রেসপন্সিবিলিটি।

সায়েম বারান্দাতেই বসে রইলো। চেয়ারে চোখ বন্ধ করে সায়েম মনে মনে বলছে,

-ভাইয়া তুমি চলে গিয়ে কি দায়ভার সব আমার উপর ফেলে গেলে যে কি না আজীবন উড়ে উড়ে ডানা ঝাপটিয়েছি শুধু? আচ্ছা ভাইয়া ভাবিকে আমি আমার বউ বানাবো সেইটা কি তুমি মানবে? ভাবি মানবে? তোমার মাইসারা কে কি আমি বাবার আদর থেকে বঞ্চিত দেখতে পারব? যখন ও বড় হবে, স্কুলে যাবে তখন কি তোমার নামের আগে মৃত লেখাটা আমার সহ্য হবে? তাহলে আমি কি করব বলো ভাইয়া? আমি তো ভালই ছিলাম যখন ফ্যান্টাসিতে ছিলাম। কেনো তুমি আমাকে এত বড় মানসিক যন্ত্রণায় ফেললে?

সায়েম এইসব ভাবতে ভাবতেই বারান্দায় ঘুমিয়ে যায়। সবাই যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পরে।

রাত তিনটা,

নিশি ড্রইংরুমে আসে পানি নেওয়ার জন্য। ঘরের পানি শেষ হয়ে গেছে। পানি আনতে গিয়ে নিশি দেখে সায়েমের ঘরের দরজা খোলা। সায়েম কখনো দরজা খুলে তো ঘুমায় না! নিশি পানির গ্লাস হাতে নিয়েই সায়েমের ঘরে যায়। সায়েম বেডরুমে নেই, ওয়াশরুমেও নেই। শেষে নিশি সায়েমকে বারান্দায় গিয়ে দেখলো ও ঘুমাচ্ছে।

-সায়েম? সায়েম?
-হুম! (ঘুম ঘুম চোখে সায়েম)
-এখানে কেনো? ঘরে গিয়ে ঘুমাও যাও।
-এইটাই তো ঘর। (ঘুম চোখে)
-এইটা বারান্দা সায়েম। ঘরে এসে ঘুমাও।

নিশি ওতটুকু বলে চলে আসে। রাতে তো নিশি ঘুমায় ই না বরং জেগে জেগে বই পড়ে আর নামাজ পড়ে। কিন্তু এইসব কেউ জানেনা।

সকালে,,,

-আম্মু আমি বের হচ্ছি। (সায়েম)
-খেয়ে যাবি না?
-সময় নেই। মাইসারা কেমন আছে আম্মু?
-মাইসারা এখন ভালো আছে। আজকে একটু তারাতারি বাড়ি ফিরতে পারবি?
-কেনো?
-সন্ধ্যায় সবার সামনে নিশির সাথে কথা বলব বিয়ের ব্যাপারে।
-ওহ, আচ্ছা আসছি আমি।

সায়েম আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বেরিয়ে গেলো। নিশি মাইসারাকে খাওয়াচ্ছে। সায়েম সারাদিন ভেবেছে কি বলবে নিশি? মানবে তো সবকিছু? ওইদিন ভার্সটিতে ও সায়েমের মন বসেনি। যেই জায়গাটা ওর শান্তির জায়গা মনে হয় সেইটা হচ্ছে ভার্সিটি। বিকেলেই সায়েম ঘরে চলে আসে। নিশিকে দেখলেই এখন কেমন যেন লাগে সায়েমের।

সন্ধ্যায় সায়েম মাইসারাকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে খেলছে। তখন সবাই এখানে এসে বসলো। নিশি ও মাইসারার জন্য ফিডার বানিয়ে আনলো।

-আমাকে দাও আমি খাওয়াচ্ছি। (ফিডারটা হাতে নিয়ে সায়েম)

সায়েম ফিডার খাওয়াচ্ছে মাইসারাকে আর তখন সায়েমের আব্বু বলে,

-বউমা কিছু কথা বলি আজ তোমায়।
-হ্যা বাবা বলেন। (নিশি)
-ভাগ্য তো সবসময় সায় দেয় না আর সঙ্গ ও দেয়না।নয়ত আজ মাহবুব থাকতো তোমার সাথে। এইভাবে নিজের জীবন অন্ধকারে তলিয়ে দিতে না তুমি। ভালবাসা থাকলেই ভালবাসার মানুষের জন্য ভাল থাকা যায় কিন্তু তুমি তা করছো না।
-কি বলবেন বাবা?
-আমি চাই আমার দাদুভাইয়ের পিতৃ পরিচয় দিতে, তোমার জীবন নতুন করে সাজাতে।

এই কথা শোনার পর সায়েম মাথা নিচু করে ফেলে আর নিশি বাবার দিকে অবাক নয়নে তাঁকায়।

-মানে কি বাবা?
-মানে সিম্পল তুমি বিয়ে করবে। (ছোট মা)
-ছোট মা আপনি এসব কেন বলছেন?
-আমার দিদুনের জন্য।
-ছোট মা সেইটা সম্ভব না।
-কেনো সম্ভব না আপু? সব সম্ভব। তুমি সবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে হলেও সায়েম ভাইয়াকে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও।
-কিহহহহহহহ! এই মাথা ঠিক আছে তোর? (তুর্নাকে ঠাস করে চড় মেরে নিশি)

তুর্নাকে চড় মারতে দেখে সবাই হকচকিয়ে যায় কিন্তু নিজেদের সামলে নিয়ে বলে,

-নিশি জীবন তোমার এখন সেইটা বললে আমরা মানবো না। সায়েমকে তোমার বিয়ে করতে হবে। আমাদের সকলের চাওয়ার দাম দিতে হবে। (ছোট মা)
-ছোট মা সায়েম তুর্নার হবু স্বামী!! (নিশি)
-না আপু। আমি সায়েম ভাইয়াকে বিয়ে করবনা। সায়েম ভাইয়াকে তুই বিয়ে করছিস।
-এতদিন জানতাম আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এখন দেখছি বাড়ির সবাই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। দেবরের সাথে ভাবির বিয়ে! লোকে ছি ছি করবেনা? (নিশি)
-লোকে ছি ছি তো করবেই না বরং বলবে আমরা ভালো ডিসিশন ই নিয়েছি।
-ছোট মা আমি কোনোদিন এইটা মানবো না, সরি। আমার জীবনে মাহবুব ছিল, আছে আর ও ই থাকবে। আমার এই সাদা কালো জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো রঙের ছোঁয়া আমি লাগতে দিবনা।

নিশি ওতটুকু বলেই ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। সায়েম মাইসারাকে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বাড়ির সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে। সায়েম বলে,

-আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। ভাবির জীবনের পুরোটা জুড়েই ভাইয়া। সেইখানে পতঙ্গের ও ঠাঁই হবেনা আর আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ।

সায়েম মাইসারাকে ছোট আম্মুর কোলে দিয়ে উঠে যায়। বাড়ির সকলেই ভাবছে কি করা যায়! এইভাবে নিশিকে দেখবে নাকি আগের মতো ওকে সংসারী দেখবে?

ওই ঘটনার পর থেকে সায়েম নিশির সামনেও যায় না লজ্জায়। মাইসারাকে দূর থেকে আদর দিয়ে চলে আসে। নিশি সেইটা খেয়াল করে কিন্তু কিছুই বলেনা। একদিন নিশির মা নিশিকে বলে,

-মাইসারা কি বাবার পরিচয় ছাড়া বড় হবে? বাবার ভালবাসা পাবেনা ও? কেন তুই বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না!
-আপু তোমার পায়ে পরি তুমি বিয়েটা করে নিজের সংসার নতুন করে সাজাও। সায়েম ভাইয়ার তো সবই আছে। কমতি কিসের তার? আস্তে আস্তে দুজনেই মানিয়ে নিবে আর মাঝখানে আমার আম্মুর জীবনটা আরো সিকিউরড হয়ে যাবে। নয়ত ওকে যে পরে সবাই এতিম বলবে। সায়েম ভাইয়া মানসিকভাবে তৈরি। তুমি একবার রাজি হও আপু। আমার ভাগ্নিটাকে এইভাবে বাবা ছাড়া বড় করনা। আমার জীবন নিয়ে ভাবার সময় আছে অনেক কিন্তু তোমার জীবনের রঙিন সময় এইটাই আপু। মাহবুব ভাইয়া যদি দেখে তোমরা খুশি আছো তাহলে ভাইয়া ও খুশি থাকবে। মাইসারা তো ভাইয়ার প্রাণ ভ্রোমরা ছিল ও দুনিয়াতে আসার আগেই। মাইসারার জন্য হলেও অন্তত রাজি হও আপু প্লিজ। দোহাই লাগে….. (তুর্না)

চলবে