সাঁঝের প্রেম পর্ব-২৩+২৪

0
32

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_23+24
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

নিশিকে তুর্না, নিশির মা, ছোট মা সবাই বুঝাচ্ছে। নিশি নিজের মতো মাইসারাকে খাওয়াচ্ছে। নিশির এহেন আচরণে নিশির মা নিশির হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,

-কি বলছি তুই কি শুনছিস?
-হ্যা শুনেছি আর আমার সিদ্ধান্ত একটাই আর সেইটা হচ্ছে আমি বিয়ে করব না। বিয়ে কি বুঝো মা? ছয়টা বছর ধরে যাকে ভালবেসেছি, যাকে স্বামী হিসেবে মেনেছি তার জায়গায় অন্য কাউকে বসাবো? আমার কি মন বলে কিছুই নেই? ভালবাসা বলতে কিছুই নেই? বিয়ে মানেই কি দুটো মানুষের মিল? মনের মিল না? কবে আমি সায়েমকে নিজের স্বামীর চোখে দেখেছিলাম বলো তো? ছিহ এই কথা ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। (মাইসারাকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো নিশি)
-নিশি এখনকার সিচুয়েশন আলাদা। (ছোট মা)
-না ছোট মা। নেক্সটবার আমাকে কেউ বিয়ের কথা বললে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। এইটাই আমার শেষ কথা।

নিশির কথায় সবাই থ হয়ে গেলো। নিশি ছোটবেলা থেকেই জেদি সেইটা ওর মা জানে। কিন্তু এই সময়ে নিশির জেদটা কতটুকু যৌক্তিক? সেইটা নিয়েই সন্দিহান সবাই। এইদিকে সায়েম ও নিশির সামনে যায় না। নিজের অজান্তেই সায়েম চাইতো ভাবি ভালো থাকুক। যদি ভাবি একা ভাল থাকে তো থাকুক। সেই জায়গায় সায়েম কিছুই বলবেনা। কিন্তু দিনশেষে আদৌ কি ভাবির ভালো থাকা সম্ভব? সব পিছুটান ফেলে মেয়েকে নিয়ে থাকা সম্ভব? এখন যদি ভাবির একটা সংসার হতো তবে কি ভাবি ভাইয়াকে ভুলতে পারত না? পিছুটান ভুলতে পারত না? আঁধারের প্রেম আঁধারেই শেষ হয়ে গেলো!

দুই বছর পর ভোরবেলা,,

মাইসারার বয়স আজ দুই বছর পূর্ন হলো। জায়নামাজে বসে নিশি কুরআন পাঠ করছে। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সায়েম আর সায়েমকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে মাইসারা। মাইসারাকে জড়িয়ে ধরে আছে সায়েম। নিশির কুরআন পাঠ শেষ হলে জায়নামাজ ছেড়ে উঠে। ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখে পৌণে ছয়টা বাজে। নিশি দ্রুত জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। জানালার পর্দা সরানোর সাথে সাথে সায়েমের ঘুম ভেঙে যায়। কপাল কুঁচকে তাঁকায় সায়েম নিশির দিকে। নিশি মিষ্টি একটা হাসি দেয় সায়েমের দিকে তাঁকিয়ে। সায়েম নিশির হাসি দেখে বলে,

-আবার হাসছো তুমি? কতবার না বলেছি আমি ঘুম থেকে না উঠা পর্যন্ত পর্দা সরাবেনা? তাও সরিয়েছো কেনো?
-নামাজ না পড়ার শাস্তি এইটা। উঠো। আব্বু আবার ডাকবে এখন তোমায়। (নিশি)
-অফিস নয়টায় আর উঠব ছয়টায়? প্লিজ পর্দাটা টেনে দাও। ঘুমাই একটু। আলো লাগছে চোখে।
-উহুম পর্দা সরানো যাবেনা। রাতে তো চুরি করতে যাও নাই। তো এত ঘুম কিসের? কালকে থেকে টেনে বিছানা থেকে নামাবো নামাজ পড়ার জন্য।
-সে তুমি নামিয়ো। এখন তো পর্দা টানো। মেয়েটা নয়ত এখন উঠে যাবে।
-বলেছি না সরাবো না। (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-দাঁড়াও।

সায়েম বিছানা থেকে উঠে টি শার্ট ঠিক করে দাঁড়ায়। স্যান্ডেল পরে ও নিশির সামনে যায়। নিশি দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে যায় আর সায়েম নিশির হাত ধরে।

-তুমি নিজে পর্দা টানবা, টানো। (সায়েম)
-ছোট মা আপনার ছেলে আমায় মারছে দেখে যান। (নিশি)
-কি মিথ্যাবাদী রে! মেরেছি কোথায় বউ? এইজন্যই বলে সিনিয়র বউ ঝামেলার!
-আবার আমায় সিনিয়র বউ বলছো?
-আচ্ছা বলব না। দুই ঘণ্টা ঘুমাই? কালকে দেখেছোই তো রাতে কি করেছি!
-প্রতিদিন ই তো সেইসব কর। তোমার বিজনেস কবে যেন আমি ধুলায় মিশাইয়া দেই।
-পারবানা কারণ বিজনেস তোমার নামেই। (হাসতে হাসতে সায়েম নিশিকে জড়িয়ে ধরে)
-হইছে ছাড়ো৷ আজকে মাইসারার সেকেন্ড বার্থডে জানো?
-সেইটা কি ভুলব আমি? আমার হাতেই তো ও দুনিয়ায় এসেছে। কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আমার মেয়েটা।
-তোমার ভাইয়ার কবর যিয়ারতের জন্য যাবেনা?
-হ্যা সন্ধ্যায় যাব।
-আচ্ছা।

সায়েমকে ছাড়িয়ে নিশি রান্নাঘরে যায়। তুর্নার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আর তুর্না এ বাড়িতে থাকেনা। এখানে নিশির মা, ছোট মা, আব্বু, নিশি, সায়েম আর মাইসারা ই থাকে। নিশিকে এত সকালে রাম্নাঘরে দেখে ছোট মা বলে,

-বউমা তুমি এত সকালে কেন? সায়েম কই?
-সায়েম মাত্র উঠেছে ছোট মা।
-আজকে তো আমার দিদুনের জন্মদিন। আজকে স্পেশাল কি বানাচ্ছো?
-মা আজকে স্পেশাল কিছুই হবেনা। সায়েমকে বলব মসজিদে মিলাদ পরিয়ে দিতে। কোনো কেক বানাবো না।
-সে তুমি করনা। কিন্তু স্পেশাল কিছু রান্না তো করতে পারো?
-হ্যা সেইটা পারি।

সকাল আটটায়,

সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে আসে। মাইসারা জুস খাচ্ছে। ছোট মা আর আব্বু ড্রইংরুমেই বসা। মাইসারা সায়েমকে বলে,

-বাবাই মা যাব।
-তোমার মা রান্না করে আম্মু। তুমি আমার কোলে বস। (মাইসারাকে চুমু দিয়ে সায়েম)
-দিদুন তুমি আমার কাছে আসো। (ছোট মা)
-আমি মা যাব। (মাইসারা)
-নিশি শুনো! (সায়েম)
-আসছি। বলো। (নিশি)
-মাইসারা কাঁদছে তোমার কাছে যাবে বলে। কোলে নাও। আমি দেখছি রান্নাঘরে গিয়ে। আর আম্মু আমি না তোমায় বলেছি ২৪ ঘণ্টার জন্য একটা সার্ভেন্ট রাখতে? (সায়েম)
-পাওয়া যায় না তো।
-নিশি তো সারাদিন এসব পারেনা। মাইসারাকে দেখতে হয়, ঘরের সব কাজ ও একাই করে। প্রতিদিন চিল্লাই একটা কাজের লোক রাখো। আমার কথায় কি কোনো দাম নেই নাকি? (সায়েম)
-তোর কথা ছাড়া এ বাড়িতে কি হয় শুনি? (ছোট মা)
-আমি দুইদিনের মধ্যে এ বাড়িতে কাজের লোক দেখতে চাই। নিশি এতে না করুক বাট ওর কথা শুনবেনা।
-সকাল সকাল চেঁচাচ্ছো কেন? আমার কোনো কষ্ট হয় না কাজ করতে! তুমি কফি খাও এরপর ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি খেয়ে অফিসে যাও। (মাইসারাকে কোলে নিয়ে নিশি)
-এই তোমার কথা আর শুনব না আমি। অনেক শুনেছি। আম্মু আমি যা বলেছি সেইটাই ফাইনাল।
-আচ্ছা বাবা।

নিশির মা, ছোট মা আর আব্বু হাসছে ওদের ঝগড়া দেখে। মাইসারা একবার আম্মুর মুখের দিকে তাঁকাচ্ছে আরেকবার বাবাইয়ের মুখের দিকে। সায়েম খেয়ে দেয়ে অফিসে চলে গেলো। নিশি সায়েমের হাতে ঘড়ি পরিয়ে দিচ্ছিলো। সায়েম তখন বলে,

-আমার ফিরতে আজকে লেইট হবে।
-কখন আসবা?
-রাত একটা বাজবে।
-কিহ? এত রাত কেনো?
-একটা জরুরি কাজ আছে।
-জাবিনের সাথে? (ঠোঁটে হাল্কা হাসি টেনে নিশি)
-না নিশি। ওর সাথে আমার কি কাজ থাকবে? আমার আজকে একটা ডিল ফাইনাল হওয়ার কথা। এইজন্যই দেরি হবে।
-ওহ! অল দ্যা বেস্ট। (নিশি সরে আসে)
-নিশি তুমি আবার মুড অফ করলা? তোমায় ছুঁয়ে বলছি জাবিনের সাথে আমি খুব কম কথা বলি। নেহাৎ ভালো মেয়ে আর আমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট তাই চাকরি থেকে বের করে দিতে পারছিনা। (নিশির হাত ধরে সায়েম)
-আচ্ছা অফিসে যাও৷ সাবধানে ফিরে এসো। আশা করছি নামাজগুলো আদায় করে নিবা। আল্লাহ হাফেজ।
-হ্যা পরব নামাজ। আসছি। আল্লাহ হাফেজ। (নিশির কপালে চুমু দিয়ে সায়েম)

সায়েম মাইসারাকে কিছু না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ মাইসারা সায়েমকে বের হতে দেখলেই কাঁদবে। সায়েম অফিসে যাওয়ার পর মনে পরে ও ফাইলগুলো নিয়ে আসেনি। সায়েম সাথে সাথে নিশিকে ফোন দেয়।

-নিশি আমার ফাইলগুলো রেখে এসেছি। আব্বু কি বের হয়ে গেছে?
-এই মাত্রই বের হলো। দারোয়ান ও তো ছুটিতে আছে। কাকে দিয়ে পাঠাবো এখন?
-আচ্ছা আমিই আসছি। ড্রাইভারকে বিশ্বাস করিনা আমি।
-এই দাঁড়াও। আমি যাব তোমার অফিসে যদি তোমার প্রেস্টিজ লস না হয় তাহলে!
-কেনো আমার প্রেস্টিজ লস হবে নিশি? এইসব কি কথা বল তুমি? তুমি দেখতে খারাপ নাকি ৮০ বছরের বুড়ি? বারবার এক কথা বলো তুমি। কতবার তোমায় বলেছি আমার অফিসে আসতে? এসেছো তুমি?
-আচ্ছা আমিই আসছি ফাইল নিয়ে।
-আচ্ছা। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি বাসায়।
-হুম।
-মাইসারাকে আম্মুর কাছে রেখে এসো।
-আচ্ছা।

নিশি রেডি হয়ে সায়েমের অফিসে গেলো। হাতে এক গাদা ফাইল। নিশিকে অফিসে দেখে সিকিউরিটি সালাম দিল আর হাত থেকে ফাইলগুলো নিয়ে নিলো। নিশি সায়েমের কেবিনের দিকে যাচ্ছে আর তখনি জাবিনকে দেখে নিশি। জাবিন শর্ট স্কার্ট পরেছিলো। গায়ে ওড়না পর্যন্ত নেই। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। স্কার্টটায় লিখা ছিলো জাবিন তাই নিশি চিনতে পারলো। নিশি আর কিছু না বলে সায়েমের কেবিনে গেলো। নিশিকে দেখে সায়েম জিজ্ঞেস করে,

-মাইসারাকে আম্মুর কাছে দিয়ে এসেছো না?
-হ্যা। বাট এইসব কি চলে তোমার অফিসে?
-কি চলে?
-তোমার সুন্দরী PA জাস্ট একটা শর্ট স্কার্ট পরা, বুকে ওড়না পর্যন্ত নেই, যাচ্ছে তাই এটিটিউড! আর তুমি ওকে ভালো মেয়ে বলছিলে সকালে? এইজন্যই তোমার ফিরতে লেইট হবে আজকে বাসায়? এইসব ড্রেসে কিভাবে ওকে এলাউ কর তুমি সায়েম?
-জাবিন আমার কেবিনে এসো তারাতারি। (জাবিনকে ফোন দিয়ে সায়েম)
-ওকে স্যার।

জাবিন আসার পর নিশিকে সায়েমের কেবিনে দেখে জাবিন সালাম দেয়। নিশি সালামের উত্তর না নিয়ে সায়েমের দিকে তাঁকায়। সায়েম জাবিনকে বলে,

-উনি কে চিনো নিশ্চই!
-জ্বি স্যার। আপনার ওয়াইফ।
-নিশি তুমি কি বলবে বলো।
-সায়েম আমি কিছুই বলব না বাট নেক্সট বার আমি অফিসে এসে যেন তোমার স্টাফদের এই উলঙ্গ ড্রেসে না দেখি।
-ম্যাম এসব কি বলছেন? আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন। (জাবিন)
-সম্মান আছে তোমার? যদি থাকতো তাহলে এইভাবে পুরো অফিস ঘুরো কিভাবে? বসের সামনে আসো কিভাবে? লজ্জা করেনা? (নিশি)
-কালকে থেকে মার্জিতভাবে অফিসে আসবে জাবিন। (সায়েম)
-ওকে স্যার।

জাবিন চলে যাওয়ার পর নিশি সায়েমকে বলে,

-রাত দশটার মধ্যে তোমায় আমি বাসায় দেখতে চাই। তোমার যত টাকার ডিলই হোক না কেনো সেই ডিল আজকে ক্যান্সেল।
-এক্ষুনি ক্যান্সেল করে দিচ্ছি।

নিশি জানে সায়েম ওকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু সায়েমের কাছে ভয়টা ভালবাসা মনে হয়। সায়েম কোনোদিন বিরক্ত হয়নি নিশির উপর আর নিশি যখন যা বলেছে তাই করেছে। সায়েম কোনোদিন মেয়েদের অসম্মান করেনি আর বিয়ের পর ভুলেই গিয়েছে কিভাবে বউ ছাড়া বাইরের মেয়েদের দিকে তাঁকাতে হয়!

নিশি কিছুক্ষণ অফিসে থেকে এরপর চলে যায়। নিশি যাওয়ার পর সায়েম চেয়ারে গা এলিয়ে হাসছে। পেন্সিল হাতে ঘোরাচ্ছে সায়েম আর ভাবছে,

-নিশি ওর জীবনে আসার পর আসলেই জীবনটা পাল্টে গেছে। নিশি ওর জন্য আশীর্বাদ। নিশির কড়া শাসনগুলো কেন আমার এত ভালো লাগে? নিশিকে কি আসলেই আমি ভাল রেখেছি বা পারব ভাল রাখতে?

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_24
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

সায়েম সব কাজ শেষ না করেই দশটার মধ্যে বাসায় গেলো। সন্ধ্যায় মাহবুবের কবর যিয়ারত করতে গিয়েছিলো সায়েম। বাসায় গিয়ে দেখে নিশি মাইসারাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। সায়েমকে দেখে নিশি বলে,

-রাত একটা না বাজবে?
-তুমি বলে এসেছো দশটায় বাসায় আসতে। সেখানে একটা কি করে বাজাবো?
-ঠিক আছে। ফ্রেশ হও।
-নিশি!
-বলো৷
-না থাক পরে বলব। ফ্রেশ হয়ে আসি।

সায়েম নিশিকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। নিশিও আর জোর দিলো না। যেহেতু বলেছে পরে বলবে তাহলে পরেই বলবে। মাইসারাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিশি ডায়নিং টেবিলে গেলো। আম্মু আর আব্বু ও ডিনার করেনি। তাদেরকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে সায়েম এলো। সায়েমের চুল থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। এইটা সায়েমের অভ্যাস। গোসল করে মাথা মুছবেনা। নিশি ওর ওড়না দিয়ে সায়েমের মাথা মুছতে মুছতে বলে,

-এইটা কি ধরনের অভ্যাস তোমার সায়েম? চুল মুছো না কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
-লাগবেনা। এইটা আমার অভ্যাস।
-খেয়ে নাও।

সবাই কথা বলতে বলতে ডিনার করে। সায়েমের আব্বু সায়েমকে বলে,

-তোর মতো ছেলে যে এত সুন্দর করে বিজনেস সামলাবে সেইটা আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি শুধু ভেবেছি ছোট ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।
-সবই সিচুয়েশন আব্বু। আমিও তো কোনোদিন ভাবিনি আমি সংসার করব, টিপিকাল হাজবেন্ড দের মতো বউয়ের কথা শুনব, আজ সেগুলোই আমি করছি। আমার কাছে এখন তোমরাই ইম্পর্টেন্ট, আর কেউ নয়। (সায়েম)
-সুখে থাকিস, ভালো থাকিস। এইভাবেই সবাইকে দেখে রাখিস।
-প্রে ফর মি আব্বু।

খাবার টেবিল থেকে উঠে যাওয়ার পর সায়েম বেডরুমে গিয়ে দেখে মাইসারা মাঝখানে শুয়ে আছে। সায়েম মাইসারার কপালে চুমু দেয়। সায়েম ড্রেসিংটেবিল এ গিয়ে দেখে নিশি আর মাইসারার কি কি আছে আর কি কি নেই কারণ নিশি কোনোদিনই মুখ ফুঁটে কিছু বলেনা। এইগুলো দেখা শেষ হলেই নিশি ঘরে আসে। সায়েম তখন খাটে বসে গেমস খেলছিলো। সায়েমের পা আর বুক ভর্তি লোম। মাহবুবের ও ছিলো। মাহবুবের এই পশমের প্রশংসা নিশি কতবার করেছে তা নিশিরই জানা নেই। সায়েম খালি গায়ে বসেছিলো থ্রি কোয়ার্টার পরে। নিশিকে দেখে সায়েম মোবাইলটা রাখলো।

-সবগুলো নামাজ পড়েছো?(নিশি)
-হ্যা। ফজর টা কাযা পরতে হয়েছে।
-লাঞ্চে কি খেয়েছো?
-ফ্রাইড রাইস।
-কি যেন বলবে বলছিলে!
-তোমায় কি আমি ভালো রাখতে পেরেছি নিশি নাকি তুমি মানিয়ে নিয়েছো? (নিশির হাত ধরে সায়েম)
-এইসব কথা কেন?
-বলই না।
-না, আমি ভালো আছি।
-সত্যিই তাই?
-হ্যা।
-একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না তো!
-না, বলো।
-আজকে তুমি আমার পাশে ঘুমাবে? একটু জড়িয়ে ধরব তোমায়!
-সেই অধিকার তোমার আছেই। পার্মিশনের প্রয়োজন নেই।
-সত্যিই কি সেই অধিকার আমি রাখি? একবারো তো জিজ্ঞেস করনাই আমি ভালো আছি কি না! আচ্ছা বলো তো বিয়ে মানুষ কেনো করে?
-তুমি কেনো করেছো?
-নিশ্চই আনন্দের জন্য করিনি। যথেষ্ট কেয়ার কর তুমি আমার কিন্তু দিনশেষে কেনো যেন আমার একলা লাগে। কেনো যেন মনে হয় সব তুমি জোর করেই করছো।
-সায়েম ছয়টা বছরের স্মৃতি, সুখ, আনন্দ, দুঃখ জলাঞ্জলি দিয়ে তোমায় বিয়ে করেছি আর কেনো করেছি সেইটাও তোমার খুব ভালো জানা। তবে কেনো আজ দুই বছর পরে এই কথা বলছো? তখন কেন আমায় ফোর্স করছিলে বিয়ের জন্য? সায়েম তুমি যথেষ্ট স্মার্ট আর এডুকেটেড ছেলে। ২৬ বছরের টগবগে যুবক। অনেক সুন্দরী আর মনের মতো মেয়ে তুমি পেতে কিন্তু তুমি বিয়ে করলে আমাকে। তুমি জানতে এর পরিণতি কি হতে পারে তাও করলে। তাহলে আজ কেন বলছো তুমি শান্তিতে নেই? দূরে রেখেছি তোমায় কখনো? নাকি স্বামীর অধিকার দেইনি? কোনটা? বলো আমার ভুল কি? আমি শুধরে নিচ্ছি।
-নিশি তোমার ভুল একটাই তুমি ফিজিকাল্লি আমার সাথে আছো বাট মেন্টালি নেই। মন তোমার এখনো ভাইয়ার কাছে বাঁধা। রাতে ঘুমাও আমার বুকে কিন্তু ঘুমের মধ্যে কান্না কর ভাইয়ার নাম নিয়ে। কেনো? একটা ছেলের জন্য এইটা কি খুব শান্তির যে তার বউ তার পাশে থেকেই আগের স্বামীর নাম নিয়ে কাঁদছে? (সায়েম নিশির বাহুতে শক্ত করে ধরে)
-সায়েম আমি ব্যাথা পাচ্ছি। এইখানে গতকালকেই ইঞ্জেকশন নিয়েছি। (কুঁকড়ে উঠে নিশি)
-সরি। (নিশিকে ছেড়ে দিয়ে সায়েম)
-এইগুলোই তাহলে তোমার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে? (হাত ধরে নিশি)
-অভিযোগ নয়, মনের ক্ষোভ।

নিশি আর কিছু বলেনি। সায়েম ও ঘুমাতে যায়। সায়েম নিশিকে বলে,

-ওষুধ খেয়ে এরপর ঘুমাতে এসো। গুড নাইট।

নিশি ওর রেগুলার ওষুধ খেয়ে বিছানায় যায়। মাইসারাকে কোলে নিয়ে এক সাইডে শোয়ায় নিশি। চুলগুলো হাতখোপা করে মাঝখানে শোয় নিশি। সায়েম অপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে। নিশি সায়েমের পিঠে খোচা মারছে বাট সায়েম কোনো রেসপন্স ই করছে না। নিশির নখ দিয়ে নিশি সায়েমের পিঠে সুরসুরি দিচ্ছে কিন্তু সায়েম ঘুরছেই না। নিশি সায়েমের কানে কানে গিয়ে বলে,

-সিনিয়র বউ বুড়ি হয়ে গেছে তাই না? এইজন্য এখন আর ফিরে তাঁকাতেও ইচ্ছে করেনা?
-নিজেকে নিজেই বুড়ি বললে আমি কি বলব? ৪৯ কেজি ওজন নিয়ে নিজেকে বুড়ি বলা যায় না। (চোখ বন্ধ করেই সায়েম)
-হ্যা ৬৪ কেজি যুবকের কাছে আমি বুড়িই। জড়িয়ে ধরবা নাকি আবার কান্নাকাটি শুরু করব? এইবার তোমার বুকে না, তোমার উপরে উঠেই কাঁদব।
-পারলে উঠো।
-শিউর তো?
-১০০%! উঠো।
-ঘুরো আমার দিকে।
-ঘুরলাম।

সায়েম সোজা হয়ে শোয়ার পর নিশি সায়েমের বুকে হাত রেখে ওর উপরে উঠতে যাবে তখনি সায়েমের ফোন বাজে। নিশি ফোনটা ধরে দেখে জাবিন ফোন করেছে। নিশির মাথায় রক্ত উঠে গেলো। নিশি সায়েমকে বলল,

-লাউড দিয়ে কথা বলো।
-আচ্ছা দরকার কি এখন ওর ফোন রিসিভ করার?
-করতে বলছি কর।

সায়েম লাউড দিয়ে হ্যালো বলার পর জাবিন বলে,

-আসসালামু আলাইকুম স্যার। সরি এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করলাম।
-কি বলবে সেইটাই বল।
-আজকের জন্য আমি সরি। ম্যাম যাওয়ার পরে যা যা করেছি ম্যামের সাথে তার জন্যেও সরি। আপনি ম্যামকে বলে দিবেন প্লিজ৷
-ঠিক আছে। রাখছি।

সায়েম ফোন সুইচড অফ করে রেখে দেয়। সায়েম বিরক্ত হয়ে বলে,

-এই মেয়েটা আসলেই ডিজগাস্টিং! শুধু ওয়েল পার্ফমেন্সের জন্য বের করতে পারছিনা। এত রাতে কোনো বিবাহিত পুরুষকে কেউ কল করে বলো?
-থাক আর বলতে হবেনা৷ দোষ তোমারই। এতদিন তো আমায় বলনি ওরা এসব ড্রেস পরে অফিসে আসে?
-এইটা তো যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আমি কি বলব?
-মোটেও ব্যাক্তিগত নয়। অফিসে ইয়াং বস আছে তারপরেও এসব ড্রেসে কিভাবে আসে?
-ছিহ সন্দেহ আমাকেই?
-তো কাকে করব? আমিও একদিন শর্ট স্কার্ট পরে বাইরে যাব। দেখবো তখন তুমি কি বলো!
-ঠাস করে গালের মধ্যে দুইটা চড় মারব এইসব চিন্তাও করলে। তুমি কি থার্ড ক্লাস নাকি? জাবিন থার্ড ক্লাস তাই এইসব করে। তুমি আমার বউ হও।
-হ্যা সিনিয়র বউ।
-আবার শুরু করছে!
-ও আমি শুধু শুরু করি তাইনা?
-তো কে করে?
-ওকে ফাইন। গুড নাইট।

নিশি রাগ করে পাশ ফিরে শুয়ে পরে। সায়েম নিশিকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরে। নিশি হাত সরিয়ে দেয় বারবার আর সায়েম ও বারবারই নিশিকে ধরে। এক পর্যায়ে দুজনেই হেসে দেয়।

সকালবেলা ফজর আযানের আগে উঠেই নিশি তৈরি হয় নামাজের জন্য। সায়েম তখন আধঘুমন্ত হয়ে শুয়েছিলো।

-সায়েম উঠো। গোসল করে এসে নামাজ পরতে যাও। সায়েম! (সায়েমকে ডেকে দিয়ে নিশি)
-যাচ্ছি তো।

সায়েম ঘুম ঘুম চোখে ফ্রেশ হয়ে মসজিদে যায়। মাইসারা ঘুমাচ্ছে। এই ফাঁকে নিশি নামাজ আদায় করে নেয়। সায়েম মসজিদ থেকে আসার সময় বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতেই আসে। সায়েমকে কেউ খোঁচা মেরে কখনো বলেনা যে সিনিয়র বউ উলটা এপ্রিশিয়েট করে। সকালে সায়েম বাসায় আসার পর দেখে আম্মু মাইসারাকে খাওয়াচ্ছে আর সায়েমের শ্বাশুড়ি মাইসারাকে কোলে নিয়ে বসে আছে।

-বাহ! মেয়েকে সামলাতে দুইজন লাগে! (সায়েম)
-আর বলিস না! কি যে দুষ্ট। শুধু দৌড়াদৌড়ি করে। (আম্মু)
-মা আমার কাছে দিন।
-তুই নিশির কাছে যা। সকাল থেকেই ও অসুস্থ। শুয়ে আছে।
-কেন কি হয়েছে?
-গিয়ে দেখ।

সায়েম আর মাইসারার কাছে না গিয়ে নিশির কাছে যায়। নিশি শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। সায়েম খাটে বসে। টুপিটা হাত থেকে রেখে নিশির কপালে হাত রাখে।

-কি হয়েছে তোমার? একটু আগেও তো কথা বললা আমার সাথে। (সায়েম)
-মাথা ঘুরছে আর পেট ব্যাথা করছে।
-ব্রেকফাস্ট তো করনাই। কি খাবা?
-আমায় ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে। নয়ত সবাই কি খাবে?
-না, কিচ্ছু করতে হবেনা তোমার। নামাজ পড়তে পেরেছিলে?
-হ্যা।
-তুমি শুয়ে থাকো আমি ব্রেকফাস্ট আনাই দারোয়ান কে দিয়ে। গরম পানি ধরবা পেটে?
-না।

সায়েম দারোয়ানকে ডেকে এনে বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট আনায় সবার জন্য। আম্মু সায়েমকে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে ওর?
-পেট ব্যাথা আর মাথা নাকি ঘুরছে।
-ওষুধ দিয়েছিস?
-দিব। তুমি মাইসারাকে ওর কাছে দিও না। মাইসারা বিরক্ত করবে ওরে। তোমার কাছেই রেখো।
-তুই অফিসে যাবি?
-যাওয়া তো লাগবেই।
-নিশি একদম ই ঠিকঠাক করে খায়না।
-কেনো? (সায়েম)
-ডায়েট করে স্লিম থাকার জন্য। জিজ্ঞেস করলে বলে আপনার ছোট ছেলের সাথে মানানো লাগবে তো।
-ও কি পাগল? তুমি কিছু বলো না? (রেগে গিয়ে সায়েম)
-বললে শুনে নাকি? তোর মা বলে, আমি বলি, তুর্নাও ফোন করে বলে তারপরেও নিশি ওর কাজই করে। সারাদিনে একবার খায়।
-করাচ্ছি ওরে ডায়েট!

সায়েম নিশির জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে ঘরে যায়। এখনো সাদা পাঞ্জাবি টা খুলেনি সায়েম।

-তুমি নাকি ডায়েট কর? (সায়েম)
-কই না তো।
-একদম চড় মারব ধরে। আম্মু তো তাহলে মিথ্যে বলছে তাইনা? ডায়েট করবা আর এইভাবে অসুস্থ হবা। তাইতো?
-সায়েম আমি ডায়েটের জন্য অসুস্থ না।
-সেইটা আমি জানি। কিন্তু তুমি ডায়েট কেন কর?
-ফিট থাকার জন্যই তো।
-আজকে থেকে যেন এসব না শুনি। এখন থেকে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করব কখন কি খেয়েছো।
-আচ্ছা কর৷
-এখন হা কর এরপর ব্যাথার ওষুধ খাও।
-অফিসে যাবেনা?
-যাব।

সায়েম নিশিকে খাইয়ে দিয়ে রেডি হয়। আম্মুকে বলে,

-ওরে কোনো কাজ করতে দিবা না। সব সার্ভেন্ট কে দিয়ে করাবা। মাইসারাকে তোমার কাছে রেখো। ও শুয়ে থাকুক। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।
-ড্রাইভারকে নিয়ে যেয়ো। (নিশি)
-আচ্ছা আসছি আমি। উঠবেনা একদম। জাস্ট টাইমে খাবা। নেক্সট সাতদিন আরো বেশি বেশি খাবা। আল্লাহ হাফেজ। (নিশির কপালে কিস করে সায়েম)
-ফি আমানিল্লাহ।
-দেখো আম্মু।
-আচ্ছা তুমি যাও। (ছোট মা)

চলবে