সাঁঝের প্রেম পর্ব-২৫+২৬

0
34

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_25+26
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

সায়েম সকালে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অফিসে গেলো কিন্তু মনটা পরে আছে নিশির দিকেই। নিশি অসুস্থ। আসার সময় মাইসারা ও কাঁদছিলো। কোনোমতে অফিসে সবাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সায়েম অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। বাসায় এসে দেখে নিশি মাইসারাকে কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আর মাইসারাও ঘুমাচ্ছে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত শান্তি লাগলো সায়েমের। সায়েম শার্টের বোতাম খুলছিলো আর মনে মনে বলছে,

-জানিনা ভাইয়া কতটুকু সুখে বা শান্তিতে রাখতে পেরেছি নিশিকে। হয়ত তোর মতো ভালবাসা পাইনি ওর থেকে কিন্তু যেটুকু পেয়েছি সেইটুকু নিয়েই বেঁচে আছি। কেনো যেনো আমার মনে হয় আমি তোর মতো হতে পারবনা যদিও আমি সেইটা চাইনা। সত্যি তুই অনেক লাকি ছিলি ভাইয়া নিশির জন্য। ওর মতো শান্ত, ধৈর্যশীল আর স্বামীভক্ত মেয়ে হয়না।

-সায়েম বাবা লাঞ্চ করবিনা? (ঘরে ঢুকে ছোট মা)
-হুশ! আস্তে কথা বলো। মা মেয়ে ঘুমাচ্ছে৷ আমার নাম শুনলেই জেগে যাবে। (আম্মুর দিকে এগিয়ে গিয়ে সায়েম)
-আচ্ছা তুই আয়।
-নিশি জাগুক। এক সাথে খাব। আমি এখন একটু বাইরে যাব।
-কেন?
-নিশির কতকিছু নাই। মার্কেটে যাই, গিয়ে নিয়ে আসি। কোনোদিন নিজে বলেনি আমার এইটা লাগবে। আমারই দেখতে হয়।
-বাইরে যাবি তাহলে শার্ট খুলছিস কেন?
-পাঞ্জাবি পরে যাব।
-আচ্ছা যা। আর তোর শ্বাশুড়ির ওষুধ শেষ নিয়ে আসিস।
-কোন ওষুধ?
-হার্টের ওষুধ টা।
-আচ্ছা যাচ্ছি। আর তোমার কিছু লাগবেনা?
-না আমার কিছু লাগবেনা। নিশি আমার প্রতিটা জিনিস খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখে আর তোকে বলে আনার জন্য। মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো। ওর মতো ছেলের বউ হয়না৷
-হুম।

সায়েম পাঞ্জাবি, জিন্স আর স্যান্ডেল পরে বের হলো বাইরে যাওয়ার জন্য। পাঞ্জাবির হাতা বটতে গিয়ে সায়েম হাতার উলটা ভাঁঝে একটা কাগজ দেখলো। সায়েম টান দিয়ে কাগজ তুললো। পাঞ্জাবির সাইজ নাম্বার লিখা ছিলো কাগজটাতে। সায়েম ভেবেছিলো হয়ত নিশি ইচ্ছে করে কাগজ সেলাই করে রেখেছে সায়েমকে হ্যারাস করার জন্য। এইসব নিশি সবসময় করে আর সায়েমকে বলে স্বামী স্ত্রী মজা করা সুন্নত। এইসব শুনে সায়েমের অটোমেটিক হাসি চলে আসতো। সায়েম মার্কেটে গিয়ে নিশির জন্য কিছু কসমেটিকস আর থ্রি পিস কিনলো। নিশি কোনোদিন দামী থ্রি পিস পরতে চায়নি। সবসময় সাদাসিদে থাকতে পছন্দ করে। সায়েম এইবার উলটা কাজ করলো। নিশির জন্য দামী থ্রি পিস ই কিনে নিয়ে গেলো। সায়েমের তখন মনে হলো একটা বোরকাই তো নিশি পরে কয়েকমাস ধরে তখন নিশির জন্য বোরকা ও কিনলো। যদিও নিশি আজ সায়েমকে অনেক বকবে তবুও সায়েম কেয়ার করলো না। বাসায় আসার সময় সায়েম মাইসারার জন্য ও খেলনা নিয়ে আসে অনেকগুলো। বাসায় আসার পথে সায়েমের এক বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধু সায়েমকে বলে,

-বিয়ের পর তুই অনেক পালটে গেছিস সায়েম। আগে আমরা একসাথে আড্ডা দিতাম, খেলতাম, ঘুরতাম, কত্ত মজা করতাম। আর এসবের লিডার ছিলি তুই। এখন তুই নেই বলে ওইসব করাও হয়না।
-কিছু করার নেই। নিশি চায়না তাই আমি ওইসব করিনা। কিন্তু তোদের জন্য ভালবাসাটা থাকবে।
-ভাবিকে ভালো রাখিস। প্রাউড অফ ইউ বন্ধু! তোর মতো বন্ধু হয়না।
-ছাড় তো! তুই কবে বিয়ে করছিস?
-এজ সুন এজ পসিবল।

সায়েম ওর বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে বাসায় আসে। সায়েমের হাতে এতকিছু দেখে দারোয়ান এগিয়ে এসে সাহায্য করে। কিন্তু সায়েম নিষেধ করে। সায়েম ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র গুলো ড্রইংরুমে রাখলো আর তখন তুর্না বের হলো নিশির ঘর থেকে। তুর্নাকে দেখে সায়েম হেসে জিজ্ঞেস করে,

-কখন আসলা?
-এইত দশ মিনিট আগে।
-মেহরাব আসেনি?
-আসতেছে। তুমি ভালো আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
-হ্যা ভালো।
-তো হঠাৎ?
-কেন আসতে পারবনা?
-অবশ্যই পারবা। আফটার অল আমার শালিকা হও। যখন ইচ্ছা আসতে পারো।
-আগের থেকে অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে গেছো।
-ক্ষেত ছিলাম কবে?
-কোনোকালেই না! তারপরেও।
-তোমার বোন কি জেগেছে?
-হ্যা কিছুক্ষণ আগেই জেগেছে।
-তুমি মায়ের সাথে কথা বলো। আমি তোমার বোনকে দেখে আসি।
-আচ্ছা যাও।

তুর্না সায়েমের আনা জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে রাখে। মাইসারার খেলনা গুলো টেবিলের উপর রাখে আর নিশির জন্য আনা জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখে। মায়ের ওষুধ মা কে দিয়ে আসে।

-ঘুম ভাঙছে? (সায়েম)
-হ্যা। তুমি বাসায়? ছোট মা তো কিছু বলল না? (অবাক হয়ে নিশি)
-হ্যা বাসায় এসেছি লাঞ্চ টাইমে৷ উঠে ফ্রেশ হও। তোমার সাথে লাঞ্চ করব বলে আমি না খেয়ে আছি এখনো। (মাইসারাকে কোলে নিয়ে আদর করছে সায়েম)
-আসছি। (চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে নিশি)
-এভাবে তাঁকাও কেন?
-না ভাবছি কে কি বলছে।
-এহ খাই না মনে হয় একসাথে?
-হ্যা সেইটা আমি জোর করার পর।
-চাপা!
-চুপ।

সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়েই শ্বাশুড়ির ঘরে গেলো।

-মা ওষুধ পেয়েছেন?
-হ্যা বাবা।
-তুর্না মাইসারাকে ধরো। আমি আর নিশি লাঞ্চ করে আসি।
-এখনো খাও নাই তোমরা? (মাইসারাকে কোলে নিয়ে তুর্না)
-না। খেয়ে আড্ডা দিব নে। তুমি লাঞ্চ করছো?
-হ্যা করেছি।

সায়েম খাবার বেড়ে নিশি আর ওর জন্য একপ্লেটে নিয়ে গেলো। নিশি তখন মুখ মুছছিলো।

-আরে বাবা বসো না। ক্ষুধা লাগছে। (নিশিকে সায়েম বলল)
-আসছি।
-হা কর খাইয়ে দিচ্ছি।
-করলাম।
-পেট ব্যাথা কমেছে?
-হ্যা কমেছে।
-মাথা ঘুরছে?
-না।

সায়েম আর নিশি একসাথে লাঞ্চ করলো। খাওয়া শেষে সায়েম যখন রান্নাঘরে প্লেট ধুচ্ছিলো তখন দেখে মেহরাব মাইসারাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে আছে। প্লেট ধুয়ে সায়েম মেহরাবের সামনে গেলো।

– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন? (মেহরাব)
-হ্যা। তুমি ভালো আছো? (মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে সায়েম)
-হ্যা আলহামদুলিল্লাহ। আপনি আর আপু খাচ্ছিলেন তাই আর বিরক্ত করিনি।
-বিরক্ত করার কি আছে? কখন আসলা? আর দুইজন আলাদা আলাদা কেন? (সোফায় বসে সায়েম)
-আমি অফিস থেকে এসেছি আর ম্যাডাম বাসা থেকে এসেছে। আপু আসসালামু আলাইকুম। (নিশিকে সালাম দিয়ে মেহরাব)
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো ভাই? (নিশি)
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনার বোনের আদেশ আজকেই নাকি আসা লাগবে এইখানে। অনেকদিন ধরে নাকি আসেনা।
-ঠিকই তো মেহরাব। কতদিন হয়েছে বলো তো? (ছোট মা)
-আন্টি আপনি আর তুর্নাকে সায় দিয়েন না। ও যা জেদি। (মেহরাব)
-শুরু হয়ে গেছে আমার বদনাম করা? (তুর্না)
-হাহাহা মেহরাব বউয়ের বদনাম করতে নাই। জায়গামতো ধুয়ে দিবে পরে। (সায়েম)
-হ্যা সে আবার এসব ভালো বুঝে! (নিশি)

সবাই যখন গল্প করছে তখন নিশি সায়েমকে ইশারায় একটু ডাকে। সায়েম উঠে আসে নিশির কাছে৷ নিশি সায়েমকে বলে,

-একটু বাজারে যাও তো।
-কেন? কি লাগবে?
-কিছু মশলা লাগবে। রাতে রান্না করা লাগবে।
-কে রান্না করবে? (চোখ পাঁকিয়ে সায়েম)
-আচ্ছা এমন করে তাঁকাও কেন? আমি ছাড়া আর কে রান্না করবে?
-চুপ। তুমি অসুস্থ জানো না? আমি রান্না করব নে।
-হাহা তারপর সেগুলো সবাই বমি করে ফেলে দিবে।
-জ্বি না। আমি শিখছি রান্না করা।
-সাহায্য করো আমাকে তাহলেই হবে। এখন গিয়ে মশলা আনো যাও।
-লিখে দাও নয়ত ভুলে যাব।
-দিচ্ছি।

নিশি ছোট মা কে বলছে কি কি রাঁধবে আর ছোট মা হ্যা বলে যাচ্ছে। বাজার থেকে এসে সায়েম নিশিকে হেল্প করে রান্নার কাজে। তুর্না তখন মেহরাবকে ডেকে বলে,

-ওদের দেখে শিখো কিছু। সারাক্ষণ তো হুকুমজারি করেই যাও।
-আমি চাইলেও সায়েম ভাইয়া হতে পারবনা। তুমি আগে নিশি আপুর মতো হয়ে দেখাও এরপর আমি সায়েম ভাইয়া হওয়ার ট্রাই করব নে।
-কি খারাপ ছেলে রে!

রাত নয়টায়,

সায়েম নিশিকে বসতে বলে নিজেই ডায়নিং সাজাচ্ছে আর সাহায্য করছে ছোট মা আর তুর্না। সব খাবার সার্ভ হয়ে যাওয়ার পর মেহরাবকে ডেকে আনে সায়েম। সবাই একসাথে খেতে বসে কিন্তু নিশি টায়ার্ড। নিশির বদলে সায়েম সবাইকে সার্ভ করছে। তুর্না সার্ভ করতে চাইলে তুর্নাকে ধমক দিয়ে বসায় সায়েম। নতুন পাঞ্জাবিটার বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে সায়েম। সবাই ডিনার করার পর সায়েম নিশিকে খাইয়ে দিয়ে নিজে ডিনার করে। গল্প করে সবার ঘুমাতে ঘুমাতে অর্ধ রাত হয়ে যায়। মাইসারা সায়েমের কোলেই ঘুমিয়ে যায়। রাতে সবাই যে যার যার ঘরে শুতে গেলো। সায়েম দরজা লাগিয়ে পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে টি-শার্ট পরে। নিশি তখন মাইসারার ঘুমন্ত মুখে হাত বোলাচ্ছে।

-নিশি?
-হ্যা বলো।
-চাপো আমি একটু শুই। তোমাদের মা মেয়ের পুরো খাট লাগে। আমি বেচারা একটু জায়গায় পরে থাকি।
-আমার লাগেনা। তোমার মেয়েরই লাগে। সারারাত নড়াচড়া করে আর আমায় পেছাতে হয়। বাই দ্যা ওয়ে নামাজ পড়ছো?
-হ্যা ডিনারের আগেই না পড়লাম।
-ও হ্যা ভুলে গেছিলাম। গুড বয়। (হাসি দিয়ে নিশি)
-থ্যাংক ইউ। (নিশির নাকে নাক ঘষে সায়েম)
-সায়েম আমার না ঘুম আসছে না।
-দিনে ঘুমাইছো যে! জামাকাপড় গুলো পছন্দ হয়েছে?
-হ্যা কিন্তু এত দামী ড্রেস আমি পরিনা। জানো না?
-এখন থেকে পরবা। তুমি সায়েমের বউ ওকে? সায়েমের একটা প্রেস্টিজ আছে।
-প্রেস্টিজ ধুয়ে পানি খাও। আমি তো বের হইনা যে তোমার প্রেস্টিজ যাবে!
-আমার মনের প্রেস্টিজেই লাগে। আমার বউ অত্যন্ত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও এভাবে থাকে সেইটা আমার পছন্দ না।
-আচ্ছা থাকবনে গুছিয়ে।
-ভেরি গুড বউ। ঘুম পাড়িয়ে দেই?
-না ঘুম আসছে না।
-আসো তাহলে।
-কোথায়?
-বারান্দায় যাই।
-যাও আমি আসছি।

নিশি হাতখোপা করে ওড়না ছাড়াই বারান্দায় গেলো। সায়েম আর্ম চেয়ারে বসেছিলো। নিশি আসার পর নিশি কে সায়েম ওর কোলে বসালো আর নিশি আরেক চেয়ারে নিজের পা ছড়িয়ে দেয় আর মাথা রাখে সায়েমের বুকে।

-নিশি একটা কথা বলি? অনেকদিন ধরেই ভাবছি বলব বলব। কিন্তু সেই সাহস হয়না আমার। (সায়েম নিশির চুলে বিলি কাটতে কাটতে)
-হুম বলো৷
-আরেকটা সন্তান আসবেনা আমাদের?

নিশি কতক্ষণ চুপ করে থাকে। এর জবাব ও কি দিবে সেইটাই ভাবছে। সায়েম ও যে ভুল কিছু বলেছে তা নয় কিন্তু আরেকটা সন্তান আসলে সায়েম কি মাইসারাকে অবহেলা করবে? এই প্রশ্নের জবাব আগে সায়েমের থেকে নিতে হবে।

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_26
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

নিশি অনেক ভেবে চিন্তে সায়েমকে প্রশ্ন করলো,

-মাইসারাকে তখন ভুলে যাবা না তো?
-তোমার কি সেইটাই মনে হলো নিশি? (একটু ব্যথিত হয়ে সায়েম)
-মাইসারা তো তোমার নিজের মেয়ে না সায়েম। তো কেনো তুমি নিজের সন্তানের থেকে মাইসারাকে প্রায়োরিটি বেশি দিবা?
-আমার নিজের মেয়ের থেকেও বেশি মাইসারা। ও আমার ভাইয়ার মেয়ে। ভাইয়ার রক্ত মিশে আছে ওর শরীরে। আর জানো ভাইয়া কে? এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপনজন যে ছিল সে। উলটাপালটা কথা বলো না নিশি। মাইসারার জায়গা সবার উপরে।
-দ্যাটস ইট। (সায়েমের পায়ের উপর নিজের পা ছড়িয়ে দিয়ে নিশি)

মাইসারা বিছানায় ঘুমাচ্ছে আর সায়েম, নিশি বারান্দায় বসে কত রংবাহারি আলোচনা করছে! নিশি বাইরে যায়না প্রয়োজন ছাড়া। নিশিকে সায়েম বলল,

-কালকে অফিসে যাব না আমি। চলো না একটু ঘুরে আসি কোথা থেকে! একদম ই বোর হয়ে গেছি বাসায়।
-কোথায় যাবা?
-তুমিই বলো কোথায় যাবা?
-সমুদ্র দেখতে যাব।
-সেইটা তো একদিনের বিষয় নয়। তবুও তুমি যখন বলেছো তো যাব। মাইসারাও বড় হয়েছে। কক্সবাজার যাব খুব শীঘ্রই।
-সায়েম?
-বলো।
-তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম তাইনা? (সায়েমের চোখের দিকে তাঁকিয়ে নিশি)
-কেনো এই কথা বললা? (সায়েম ও নিশির দিকে তাঁকালো)
-বিয়ে করা, বাচ্চা সমেত একটা মেয়েকে তোমার বিয়ে করতে হলো। তোমার শখ, আহ্লাদ সব মাটিচাপা দিতে হলো, তোমার স্বপ্ন গুলো কাঁচের মতো এক ঝড়েই ভেঙে গেলো। এর জন্য তো শুধুই আমি দায়ী সায়েম।
-হাহাহাহাহা। আজকে তোমায় একটা সত্যি কথা বলি? (উঠে দাঁড়িয়ে সায়েম)
-বলো৷
-আমি, এই ছেলেটাকে যতটা ভালো এখন দেখছো না? ওতটা ভালো আমি ছিলাম না। চার চারটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো আমার। সারারাত এডাল্ট চ্যাটিং, সারাদিন মাস্তি এইসব করেই ভার্সিটিতে উঠলাম। তোমার বাসায় যখন তোমাকে প্রথম দেখতে গেলাম তখনো এসব চলছিলো। মাঝখানে তুর্নার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো তবুও আমি সিরিয়াস ছিলাম না। আম্মু একটু একটু জানতো আমার বিষয়ে কিন্তু বাবা জানতো না, ভাইয়া জানতো না। যেদিন ভাইয়া মারা গেলো সেইদিন থেকে আমার মনে হচ্ছিলো আমি কেন এসব করছি? ভাইয়ার মতো যদি আমিও হুট করে চলে যাই? এরপর আস্তে আস্তে সব বাজে নেশা বাদ দিলাম, চেষ্টা করলাম প্রতিদিন নামাজ পড়ার। আর ভাগ্যবশত আমার জীবনে তখন তুমি আসলা। মনের কলুষতা সব দূর করার জন্য তোমার হাতটাই যথেষ্ট ছিলো। এরপর আর আমি পিছনে ফিরে তাঁকাই নাই। আলহামদুলিল্লাহ আর আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যে উনি আমার কপালে তোমায় রেখেছেন বলে। তোমার মতো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি লাকী! অনেক বেশি লাকী! তুমি আমার জীবন নষ্ট করনি বরং পালটে দিয়েছো আমায়। দিনশেষে অনেক শান্তি পাই এইসব ভাবলে। আই লাভ ইউ! এসব বলো না আর!
-তোমার চারটা গার্লফ্রেন্ড ছিল? এখন কই তারা?
-সে খবর রেখে আমার লাভ কি? হয়ত বিয়ে হয়ে গেছে।
-কি ক্যারেক্টার ছিল তোমার! (মুখ বাঁকিয়ে নিশি)
-হেই শুধু প্রেম ই করেছি, ফিজিকাল এসল্টমেন্টে যাইনি। (নিশির হাত ধরে সায়েম)
-আর এডাল্ট চ্যাটিং তো আমি করতাম তাইনা?
-সেসব আমার অতীত ছিল। আর সত্যি বলেছি, ভুল তো কিছু বলিনি।
-হ্যা থাক৷ ঘুমাবে আসো।
-আমার সবচেয়ে বেশি ঘাম ঝড়াতে হয়েছিলো তোমায় স্বাভাবিক করতে। যেভাবে আমায় হুমকি দিতা! ভুলিনি সেসব আমি।
-আমিও ভুলিনি। সেইদিনগুলো খুব যন্ত্রনার ছিলো আমার কাছে। জানো সায়েম যতই তুমি আমার হাজবেন্ড হও বা কিছু কিন্তু মাহবুব আমার কাছে একদম ই অন্যরকম। মাহবুবের মতো করে আমায় কেউ বোঝেনি হয়তো বুঝবেও না। যাইহোক আসো।

নিশি ঘরে চলে আসে। সায়েম বারান্দার দরজা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আধশোয়া নিশিকে সায়েম প্রশ্ন করলো,

-ভাইয়াকে এখনো ভুলো নি তাইনা?

সায়েমের প্রশ্ন শুনে নিশি নিঃশব্দে হাসলো। নিশির হাসির মানে সায়েম না বুঝলেও এতটুকু বুঝেছে যে প্রশ্নটা করা ওর উচিৎ হয়নি। সায়েম লাইটস অফ করে কম্বল টান দিয়ে শুয়ে পরলো। নিশি মাইসারার উপর হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে আর সায়েম পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরেছে। নিশি ও ঘুমিয়ে গেছে।

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে,

নিশি সবাইকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছে আর মাইসারা ওর দিদুনের কোলে। সায়েম নিশিকে বলছে,

-পরটা খাব না আমি নিশি। নুডুলস বানিয়ে দাও আমায়।
-এইটা আগে বলতা। আধা ঘন্টা ফ্রি ছিলাম বানিয়ে নিতাম।
-তো এখন কি তুমি পারবেনা? না পারলে বলো আমি বাইরে গিয়ে খেয়ে আসছি। (টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সায়েম)
-এই বসো। পারব না বলেছি কি? করে দিচ্ছি এখনি। (সায়েমের হাত ধরে নিশি)
-না দরকার নাই। (সায়েম চলে গেলো)
-মানে কি? (নিশি)
-বউমা ওর কি কিছু হয়েছে? কখনো তো এইভাবে কথা বলেনা। (ছোট মা)
-জানিনা মা। হঠাৎ কি হলো?
-তোমায় বলেনি?
-না কিছুই তো বলল না। আজকে ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজেই নামাজ পড়তে চলে গেলো। এসে কফিও চাইলো না।
-তোমার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?
-কই না তো।
-আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও। মাইসারা আমার কাছে থাকুক।
-না মা সায়েম আসুক। এরপর খাব।

নিশি ঘরে গিয়ে সায়েমকে ফোন করলো। কিন্তু সায়েম ফোন ধরছে না। শেষে নিশি নুডুলস রাঁধতে বসলো। নুডুলস রান্না শেষ করে আবারো সায়েমকে কল করলো। তখনো সায়েম ফোন ধরলো না। নিশি মন খারাপ করে কাজ করছে আর বোঝার চেষ্টা করছে সায়েমের হয়েছে টা কি। সায়েম বিকেল সাড়ে তিনটায় বাসায় আসলো। সায়েমের চুল এলোমেলো, ফর্সা চেহারা রোদে পুড়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নিশি সায়েমকে জিজ্ঞেস করলো,

-সারা সকাল কোথায় ছিলে?
-তোমার জানা খুব জরুরি? (পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে সায়েম)
-হোয়াট ডু ইউ মিন সায়েম? আমার জানা জরুরি না মানে? (সায়েমের হাতের উপরের অংশ ধরে নিশি)
– গোসল করব ছাড়ো। (নিশির হাত ছাড়িয়ে সায়েম চলে গেলো)

নিশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সায়েমকে দেখেই মনে হচ্ছে ও কিছুই খায়নি এখনো আর রোদে বসেছিলো। বেশ সময় নিয়েই সায়েম গোসল করলো। নিশি বেডরুমেই বসে আছে। সায়েম টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরে এলো। সায়েম কোথাও যাবে হয়ত তাই আলমারি থেকে শার্ট আর প্যান্ট বের করছে।

-কোথায় যাবে? (নিশি)
-দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
-যেখানেই যাও। আগে খাবে আসো। (সায়েমের হাত ধরে নিশি)
-না খাব না। (হাত ছাড়িয়ে সায়েম শার্ট পরছে)
-সায়েম কি হয়েছে তোমার? কেনো এমন করছো?
-কিছুইনা। আমি বের হচ্ছি। (বডি স্প্রে করে সায়েম)
-আমি তোমায় বডি স্প্রে ইউজ করতে নিষেধ করেছিলাম সায়েম।
-সো হোয়াট? আই হ্যাভ টু গো। (শার্টের হাতা ভাঁজ করে)
-খেয়ে যাও প্লিজ।
-রাতে ফিরতে লেট হবে।

এইটুকু বলেই সায়েম চলে গেলো। নিশি তখন কি করবে বুঝছে না। নিশিও সারাদিন কিছু খায়নি। মাইসারার পেছনেই সময় কেটে গেছে। রাতে আলমারি থেকে একটা কাগজ বের করতে গিয়ে নিশির চোখে পরলো গ্রে রঙের কাতান শাড়িটা। সায়েম সবসময় বলতো গ্রে রঙে নাকি নিশিকে মানায়। সব কাজ শেষ করে রাত এগারোটায় নিশি সায়েমের প্রিয় শাড়িটা নিয়ে সাজতে বসলো৷ নিজে নিজেই শাড়ি পরলো, চুরি পরলো, সাজলো। রাত বারোটা বেজে গেছে তখন। সায়েম এখনো আসেনি আর ফোন ও বন্ধ। নিশি অপেক্ষা করতে করতে ড্রেসিংটেবিল এর উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে। মাইসারা দিদুনের ঘরে ঘুমাচ্ছে। রাত পৌনে দুইটায় সায়েম প্রচন্ড টায়ার্ড হয়ে বাসায় ফিরে। ঘরের লাইট অন করতেই দেখে নিশি ড্রেসিংটেবিল এর উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে আর সায়েমের প্রিয় রঙের শাড়িটাই পরা। সায়েম সামনে গিয়ে নিচু হয়ে দেখলো নিশির ঠোঁটে লিপস্টিক। সায়েম আস্তে করে নিশিকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ালো। নিশিও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সায়েম ফ্রেশ হয়ে মাইসারার খোঁজ করতে গেলো আবার পরোক্ষণেই ভাবলো এত রাতে কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। সায়েম বাতি নিভিয়ে জানালা খুলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সায়েম নিজেই বলছে,

-এত কষ্ট কেন হচ্ছে আমার? সবকিছু কেনো এত বিষাদ লাগছে?

জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের আগমনে নিশির ঘুম ভাঙে। শীত শীত লাগছে ভীষণ। নিশি জেগে দেখে সায়েম দাঁড়িয়ে আছে। নিশি উঠে দাঁড়ালো। পেছন থেকে সায়েমকে জড়িয়ে ধরে নিশি। সায়েম চমকে যায়।

-কোথায় ছিলে সারাদিন? (নিশি)
-তুমি উঠলে কেন?
-তোমার কি হয়েছে সায়েম? আমার সাথে এমন কেন করছো? কষ্ট হচ্ছে আমার।
-কি করেছি?

চলবে