সাঁঝের প্রেম পর্ব-২৭+২৮ এবং শেষ পর্ব

0
48

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_27+২৮(শেষ)
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

সায়েমকে জড়িয়ে ধরে নিশি কথা বলছে। সায়েম হু,হ্যা,ওহ তে উত্তর করছে। নিশি আবারো প্রশ্ন করে,

-তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে সায়েম?
-বাইরে।
-কেনো বাইরে ছিলে?
-জানিনা।

নিশিকে ছাড়িয়ে সায়েম সামনে আগায়। নিশি সায়েমের টি শার্ট টেনে ধরে। সায়েম চোখ বন্ধ করে থেমে যায়। সায়েম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিশি সায়েমের সামনে এসে ওর চোখের দিকে তাঁকায়।

-কিছু কি হয়েছে তোমার?
-নাহ। আমি ঘুমাই? মাথা ব্যাথা করছে।
-একটাবার বলো কি হয়েছে? আমি কি কোনো ভুল করেছি?
-না নিশি। তুমি কি ভুল করবে? বাই দি ওয়ে শাড়ি পরেছো কেনো?
-ভালো লাগছে না? (শাড়ির আচল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশি)
-ভীষণ মিষ্টি লাগছে। সেই বিয়ের দিন হাল্কা সাজে দেখেছিলাম তোমায়। এরপর তো আর সাজতে দেখিনি। আজকে হঠাৎ দেখে ভালো লাগলো। মনোমুগ্ধকর সারপ্রাইজ ও বলতে পারো।
-আচ্ছা কালকে আমি মাহবুবের কথা বলাতে কি তুমি এমন করছো?

নিশির প্রশ্ন শুনে সায়েম চুপ হয়ে গেলো। আসল কারণ তো এইটাই। কোন স্বামী চাইবে নিজের বউয়ের মুখে আরেক স্বামীর প্রশংসা শুনতে? নিজের কাছে কি খারাপ লাগবেনা? কষ্ট হবেনা? সায়েম তখনি চুপ থাকে যখন নিশি ওর সত্যিটা ধরে ফেলে। নিশির কাছে এখন সব পরিষ্কার। নিশি খাটের উপর বসে আছে মাথা নিচু করে আর সায়েম হাত ভাঁজ করে জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকার রূপ দেখছে।

-সায়েম, আমার কাছে তুমি যেমন সত্যি মাহবুব ও কিন্তু ঠিক ততটাই সত্যি। ও আমার ভালবাসা ছিলো, আমার বিশ্বাস ছিলো। কিভাবে ভুলে যাব আমি মাহবুবকে?
-আমি তোমার ভালবাসা নই? আমি তোমার বিশ্বাস নই? (একটু হেসে সায়েম)
-সায়েম আমি তোমায় কি করে বোঝাই? তুমি আমার বর্তমান।
-আচ্ছা বাদ দাও। চেঞ্জ করে এসো। ঘুমাই। ভালো লাগছে না।
-সায়েম আমি কিন্তু তোমার জন্যই সেজেছি। কতদিন পর চোখে কাজল লাগিয়েছি সেইটা তুমি দেখছো না?
-বললাম তো অনেক প্রিটি লাগছে। (নিশির গালে একহাত দিয়ে সায়েম)
-এখন তুমি আমায় কোলে নিবা।
-রিজন?
-আমি বলেছি তাই নিবা।

সায়েম নিশিকে কোলে নিলো। নিশি সায়েমের গলা জড়িয়ে ধরে আছে।

-এইবার রুফ টপে চলো। (নিশি)
-এত রাতে?
-হ্যা চলো।
-তুমি এত হাল্কা হচ্ছো কেন?
-না মুটিয়ে যাচ্ছি।

দুইজন কথা বলতে বলতে ছাদে গেলো। ছাদের ওপরে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ঘর আছে। পুরোটা ঘর খড়ের আর উপরে নীল রঙের টিন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ছোট্ট একটা বেড আছে সেখানে আর বাহারি রকমের শোপিস। মাহবুবের পছন্দের জায়গা এই ঘরটা। মাহবুবের বাবা শখ করে এই ঘরটা বানিয়েছিলেন। ছোট মায়ের ঘরের দরজা খোলা ছিলো। ছেলে আর ছেলের বউকে এইভাবে ছাদে যেতে দেখে হাসলেন তিনি। চারতলা সিঁড়ি বেয়ে সায়েম নিশিকে নিয়ে ছাদে গেলো। ছাদে যাওয়ার পর নিশি চিলেকোঠার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,

-ওইখানে নিয়ে চলো।
-ওখানে গিয়ে কি করবা? অনেকদিন ধরে ঘরটা বন্ধ। ধুলাবালি আছে।
-প্লিজ চলো।

সায়েম আবার দেড়তলা সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠায় গেলো। এইবার সায়েম খানিকটা অবাক হলো। খানিকটা না বেশ অবাকই হলো।

-এই ঘর সাজিয়েছে কে? (সায়েম নিশিকে কোল থেকে নামিয়ে)
-আমি।
-কবে?
-আজকে বিকেলে।
-কিন্তু কেনো?
-সারপ্রাইজ কি তুমিই আমায় দিয়ে যাবা? আমি দিতে পারিনা?
-ফুল কে এনে দিলো তোমায়?
-দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়েছি।
-বাগানবিলাস আমার পছন্দের ফুল। শুধু পছন্দের না খুব পছন্দের।
-সেইটা কি আমার অজানা?
-আসলেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
-বউকে থ্যাংকস দিতে হয়?
-না৷ আকাশ দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। চলো নিচে যাই।
-না। এখানেই থাকব আজ।
-মাইসারা?
-ছোট মা দেখে রাখবে মাইসারাকে।

ওদের টুকটাক কথার মাঝে বাইরে প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করলো। সায়েম দ্রুত জানালা, দরজা লক করে দিলো। বাতাসের শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছেনা। ঘরে জায়গায় জায়গায় অনেক ক্যান্ডেল রাখা । সায়েম সেগুলো ছুঁয়ে দেখছিলো আর তখনি কারেন্ট চলে গেলো। নিশি যেন এরই অপেক্ষায় ছিলো। নিশি ম্যাচ হাতে নিয়ে সবগুলো মোম জ্বালালো। এই ঘরে কেউ থাকেনা বলে এখানে আইপিএস এর সংযোগ দেওয়া হয়নি। পুরো ঘর মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো। সায়েম হঠাৎ খেয়াল করলো মোমের আলোতে নিশির চেহারা স্বর্নের মতো উজ্জ্বল করছে। লিপস্টিকের রঙটা এত দারুন কেন? নাকি ওর ঠোঁট গুলোই দারুন? ম্যাচের কাঠি ফেলে দেওয়ার পর সায়েম নিশির হাত ধরলো। নিশি সায়েমের দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু নাচালো।

-আজকে তোমায় এত চঞ্চল লাগছে কেনো? (নিশির কাছে গিয়ে সায়েম)
-আমি যেমন তেমনি তো লাগার কথা!
-না, আজকে বেশিই চঞ্চল লাগছে। (নিশির চুলগুলো খুলে দিলো সায়েম)
-না সায়েম।
-আবার না?
-ছাড়ো।
-ছেড়ে দিব?
-জানিনা।
-এইসব কিছু কি শুধুই সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এরেঞ্জ করেছো?
-তাও জানিনা।
-আমি হয়ত জানি। (নিশিকে আরো কাছে এনে সায়েম)
-না জানোনা।

বৃষ্টির ফোঁটায় টিনের চালে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। এতটাই শব্দ যে সায়েম আর নিশিকে একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে কথা বলতে হচ্ছে আর অপরজন তা শুনছে। দুই বছরে এত সুখ কি সায়েম পেয়েছিলো? নিশির আচরণ হঠাৎ এত পালটে গেলো কি করে? এইসব ভাবনা যেমন সায়েম ভাবছে আবার ভাবছে নিশি হয়ত সায়েমকে বুঝে তাই এমনটা করেছে।

সকাল সাতটায়,

সায়েম অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই ছেলে ঘুম ছাড়া হয়ত কিছু বুঝেনা। নিশি ঘুম থেকে জেগে মাইসারাকে খুঁজছে তখন ওর মনে হলো মাইসারা তো নিচে আর ও ছাদে! নিশি উঠতে যাবে তখন শাড়ির সাথে টান খেয়ে আবার শুয়ে পরে। নিশির শাড়ি প্রায় অর্ধেকটাই সায়েমের বুকের নিচে আর সায়েম উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।

-এইভাবে কি কেউ আচল জড়িয়ে ঘুমায়? (মনে মনে নিশি) সায়েম? এইই সায়েম? অনেক বেলা হয়ে গেছে। তুমিও ফোন আনোনি আর আমিও আনিনি। কয়টা বাজে দেখতে পারছি না তো। উঠো প্লিজ। (নিশি)
-আই লাভ ইউ। (নিশিকে জড়িয়ে ধরে সায়েম)
-তুমি উঠবা নাকি বেত নিয়ে আসব? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাকে স্বপ্ন দেখছো? এইইইইই! (সায়েমকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিশি)
-এইভাবে কেউ চিল্লায়? (উঠে বসে সায়েম)
-এই মাত্র কাকে আই লাভ ইউ বললা তুমি? (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-তো…. তোহা কে। (তোমাকে বলতে গিয়ে ইচ্ছে করেই তোহা বলল সায়েম যাতে নিশি রেগে যায়)
-তোহা কে?
-আমার চারটা গার্লফ্রেন্ড এর মধ্যে দ্বিতীয় টা। খুব ভালো মেয়ে জানো? কতকিছু রেঁধে খাওয়াতো আমাকে! (চোখ বন্ধ করে সায়েম)
-হারামি (একটা শোপিস ছুড়ে মেরে সায়েমের দিকে) ঘুমা তুই। আমি নিচে যাচ্ছি।
-ওই আমি তোমায় ছাড়া আর কাকে আই লাভ ইউ বলব? (নিশির হাত ধরে কাছে এনে) তোমাকেই বলেছি। তোহা নামে কাউকেই চিনিনা। ইউ আর দা বেস্ট আর কাউকে লাগবেনা। (নিশির কপালে চুমু দিয়ে সায়েম)
-এখন কি উঠবা? টি শার্ট টা পরবা? যাবা নিচে?
-আরেকটু থাকি এভাবে?
-থাকো তুমি।

সায়েমকে ধাক্কা মেরে নিশি শাড়ি, চুল সব ঠিকঠাক করে নিচে যায়। আজকে ফজরের নামাজটাও পরা হয়নি। এভাবে সারারাত জেগে রোমান্স করলে উঠবে কিভাবে? ছাদের জমে থাকা পানিগুলোতে রোদের আলো পরে চিকচিক করছে। ওই আলোতে নিশির চোখ ঝলসে যাচ্ছে। ছোট মায়ের বদৌলতে সবাই জানে নিশি আর সায়েম ছাদে রাত কাটিয়েছে। তুর্না বাসায় ছিলো বলে ব্রেকফাস্ট ওই রেডি করলো। নিশি ঘরের বেল বাজালো। তুর্না এসে দরজা খুলল। তুর্না মুখে আঙুল দিয়ে হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে। ছোট মায়ের ও মুখ উজ্জ্বল লাগছে। মাইসারাকে খাওয়াচ্ছে ছোট মা। নিশির মা ও কেনো যেনো হাসছে। নিশি এইবার বিপাকে পরে গেলো।

-বউমা কোথায় ছিলে? (ছোট মা)
-আসলে! (নিশি থতমত খাচ্ছে)
-আন্টি আমিই বলছি। খেয়াল করেছেন সায়েম ভাইয়াও কিন্তু ঘরে নেই। হয়ত ছাদে ছিলো রাতে। (তুর্না হাসছে)
-না মা আসলে কারেন্ট ছিলো না রাতে তাই গিয়েছিলাম। ঘরে গরম লাগছিলো। (নিশি)
-ও! শাড়ি পরে গিয়েছিলে আপু? (তুর্না)
-বেশি কথা বলিস। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

নিশি দ্রুত চলে যায়। নিশির যাওয়া দেখে সবাই হাসছে। ওদের হাসার মাঝেই সায়েম চলে আসে।

-আন্টি হিরো চলে এসেছে। (তুর্না)
-কে হিরো? (সায়েম)
-কেন ভাইয়া? হিরোইনের পর যে এন্ট্রি নিলো। সারারাত কোথায় ছিলা? (তুর্না)
-ছাদে।
-কেন?
-এই কেনের জবাব নাই। আমার ছাদ আমি নাকি যেতে পারব না আর তার জন্য জবাবদিহি করা লাগবে!

সায়েম দ্রুত সেই জায়গা ত্যাগ করে বেডরুমে আসলো। নিশি গোসল করছে। সায়েম ঘরের দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করছে।

-নিশি দরজা খোলো।
-কেন?
-আমি তোমার সাথে গোসল করব।
-পা ভাঙব এখন।
-ভাঙো গা। তুমি দরজা না খুললে আমি দরজাই ভেঙে ফেলবো বললাম। (টাওয়েল নাচাতে নাচাতে সায়েম)
-আচ্ছা আসো। মাথার মগজটা ভেজে খেয়ে ফেলছো তুমি আমার।
-হ্যা এখন রক্তকে সস বানাবো।
-ইডিয়েট। (সায়েমের পিঠে শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে মেরে নিশি)

ব্রেকফাস্ট টেবিলে এই প্রথম সায়েম আর নিশি একসাথে আসলো। দুজনকে দেখেই হাসিখুশি মনে হচ্ছে। তুর্না আর মেহরাব দুজন দুজনের দিকে তাঁকিয়ে হাসছে। ছোট মা আর নিশির মা খেয়ে উঠে গেছে। ঘরে হেঁটে হেঁটে মাইসারা খেলছে।

-সায়েম ভাইয়ায়ায়ায়ায়া! (তুর্না)
-কি? (সায়েম)
-কালকে কি কি করলা? শালিকা হিসেবে বলতেই পারো। (সায়েমকে চোখ মেরে তুর্না)
-কি করবো? আজব তোহ! নিশি তোমার বোন কি বলছে এসব? (মাইসারাকে কোলে নিয়ে সায়েম)
-কি বলছিস তুই? (নিশি)
-আহা আপু তুমি ঢুকো না এর মাঝে! কথা হচ্ছে ভাইয়ার সাথে।
-ঠিক আছে ঢুকলাম না। খেতে আয়।
-আসছি। খবর বের করছি ওয়েট! (তুর্না সায়েমকে বলল)
-কি আর খবর বের করবা? তুমি আবার খালামনি হবা এই ই। (সায়েম)
-হাহাহাহাহা। সেইটাই কি?
-হোপ সো। (হাসতে হাসতে সায়েম)

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_28
#Last_part
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

সায়েমের কথা শুনে তুর্না হাসবে না মজা নিবে বুঝতেছে না। শেষে তুর্না সায়েমকে ছেড়েই দিলো। বড় বোনের সাথে তো আর মজা নেয়া যায় না। সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়ে খেলছে আর মাইসারা সায়েমের সাথে কথা বলছে। নিশি সবাইকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছে আর সায়েমের দিকে তাঁকিয়ে বারবার হাসছে। সায়েম ও মাথায় হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। সায়েমের কাছে এসে নিশি বলে,

-ব্রেকফাস্ট করবানা?
-ডিনার, ব্রেকফাস্ট সব কালকে রাতেই করে ফেলেছিলাম না? এখন কি খেতে হবে? (কথাটা আস্তে করে বলল সায়েম)
-ফাজলামো রাখো। তারাতারি টেবিলে বসো। (কোনোরকম হাসি থামিয়ে নিশি)

সায়েম মাইসারাকে ফ্লোরে ছেড়ে দিয়ে খেতে বসলো। নিশি, তুর্না, সায়েম, তুর্নার হাজবেন্ড সবাই মজা করছে আর খাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষে নিশি ঘরে যায়। সায়েম তখন বই পড়ছিলো। নিশিকে দেখে সায়েম বলল,

-সেইদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার।
-কোনদিন?
-যেদিন তোমার পায়ে ধরেছিলাম বিয়ে করার জন্য।
-সেই কথা কেন মনে করছো? সেই ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত।
-জানো নিশি তোমার ভালোর জন্যই, তোমার খুশির জন্যই সেইদিন আমি পেছোতে পারিনাই। আব্বু, আম্মু, আমার শ্বাশুড়ি মা আর বিশেষ করে আমার তখনকার হবু বউ বারবার আমায় ফোর্স করছিলো যাতে তোমায় বোঝাই। শেষে এক প্রকার প্রেসার নিয়েই লাজ লজ্জা ভেঙে তোমায় বিয়ের কথা বলেই ফেললাম। এজন্য তুমি আমায় যা নয় তা বলেছিলে নিশি মনে আছে?
-আছে। (খাটের উপর বসে নিশি)
-চড় ও দিতে গিয়েছিলে। যাইহোক এই বইয়ের আহসান আর নওশিনের গল্পটা অনেকটা সেইরকম ই তাই মনে পড়ে গেলো।
-শেষ চিঠি পড়ছো?
-হ্যা। (বইটা রেখে সায়েম)
-সেইদিন আমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি হয়ত। আফসোস হচ্ছে অনেক পুরোনো অনেক কথা ভেবে।
-হ্যা নিশি আমি হয়ত ভাইয়ার মতো হতে পারিনি বাট অজস্র চেষ্টা করি তোমায় খুশি রাখার। মাঝে মাঝে হয়ত রাগ করি, অনেক কথা বলি বাট মনের কথা একটাই সেইটা হচ্ছে তোমায় খুশি দেখতে চাই এট এনি কস্ট।
-বুঝেছি সেইটা।

তুর্না আজ শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে। নিশি আবারো একা হয়ে গেলো। সায়েম যথেষ্ট চেষ্টা করে বউ আর মেয়েকে সময় দেয়ার। এক সপ্তাহ পর সায়েম সিদ্ধান্ত নেয় ওরা কক্সবাজার যাবে। বাসায় মা, বাবাকে ফেলে নিশি যেতে রাজি না কিন্তু সায়েম যাবেই। এক্ষেত্রে নিশির বাধা ও মানবেনা। শেষে সবার অনুরোধে নিশি যেতে রাজি হয়। যাওয়ার দিন নিশি কালো রঙের শাড়ি পরে। অনেকদিন পর নিশি বোরকা ছাড়া বাইরে বের হলো। ফ্লাইটে যেতে হয়েছিলো ওদের কারণ মাইসারাকে নিয়ে এতদূর জার্নি করা অসম্ভব। সায়েম একহাতে মাইসারাকে কোলে নিয়ে আছে আরেকহাতে ট্রলি টানছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সায়েম একটা ক্যাব ভাড়া করে হোটেলে উঠলো। নিশির কেনো যেন মনে হচ্ছে আগে কেনো আসলাম না ঘুরতে? আগে আসলে তো সায়েমের এই ম্যাচিউরড এটিটিউড দেখতে পেতাম। চারতলায় সায়েম আর নিশির রুম। রিসিপশন থেকে চাবি নিবে বলে নিশির কোলে মাইসারাকে দিয়ে যায় সায়েম। আর মেয়েও বাবা ভক্ত। কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। এজন্য নিশি মাইসারাকে নিয়ে একটু হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিশি শাড়ির কুচিতে পা লেগে পরে যেতে নেয়। সায়েম নিশির হাত ধরে আরেক হাতে মাইসারাকে ধরে।

-আস্তে নিশি। (সায়েম)
-কি করে পরে যাচ্ছিলাম বুঝলাম না।
-মাইসারাকে দাও আমায়। আসো তুমি। শাড়ি সাবধানে
ধরো।
-হুম।

রুমে গিয়ে সায়েম মাইসারাকে খাটে বসালো। মাইসারা আবার কান্না জুড়ে দিলো বাবা নামিয়েছে বলে।

-আম্মু আমি চেঞ্জ করব না? (মাইসারাকে আবার কোলে নিয়ে সায়েম)
-রাখো একটু। আমি শাড়িটা পাল্টে আসি।
-যাও।

একটা ঝুড়িতে অনেক চকলেটস আছে যেগুলো মাইসারা চাচ্ছে কিন্তু সায়েম ঢাকা থেকে মাইসারার জম্য চকলেটস কিনে এনেছে যেগুলো মাইসারা খায়। কারণ হোটেলের চকলেট কেমন না কেমন হয়! ট্রলি থেকে সায়েম মাইসারাকে চকলেট বের করে দিয়ে বলল,

-মা এইত তোমার চকলেট। ওইগুলো ভালো না। এইটা ভালো।
-খুলে দাও।
-আচ্ছা দিচ্ছি।

সায়েম মাইসারাকে চকলেট দিয়ে বসিয়ে শার্ট খুলল। সায়েমের পরনে শুধু প্যান্ট আর বেল্ট। সায়েমকে খালি গায়ে দেখে মাইসারা তাঁকিয়ে আছে।

-বাবা জামা! (মাইসারা)
-আম্মু তোমার আব্বু এখন গোসল করবে না?

কথাশুনে মাইসারা খিলখিল করে হাসছে আর চকলেট মাখানো হাত দিয়ে সায়েমের বুকের পশম টানছে।

-আহহহ! বাবা ব্যাথা পায় তো মা। (সায়েম)
-হাহাহাহাহা
-এত হাসছে কেন আজকে আমার বুড়িটা? (মাইসারার গাল টেনে সায়েম)
-বাবা বাইরে যাব না?
-যাব মা।

নিশি শাড়ি পালটে বাইরে আসে। থ্রিপিসের পেছনের চেইন অর্ধেক লাগিয়ে আর পারছেনা লাগাতে নিশি।

-সায়েম?
-হ্যা বলো।
-হেল্প করনা!
-ওয়েট।

সায়েম মাইসারাকে মাঝে বসিয়ে দিয়ে নিশির জামার চেইন লাগিয়ে দেয়।

-যাও গোসল করে এসো।
-দেখো মেয়ের কাজ! (বুকে হাত দিয়ে দেখিয়ে সায়েম)
-হাহাহা বুকে চকলেট লাগিয়ে দিয়েছে। ভালই করেছে।
-মেয়েটা আধো আধো কথা বলছে। ওর মুখে বাবা শুনে কি শান্তি যে পাই বলে বোঝাতে পারবনা। আচ্ছা আমি গোসল করে আসি।

সায়েম এগিয়ে যেতে নেয় তখন নিশি সায়েমের হাত ধরে। নিশি সায়েমের দিকে ফিরে সায়েমের বুকের উপর লেগে থাকা চকলেট গুলো খায়। সায়েম নিশির হাত ধরে আছে। সায়েম থ হয়ে যায়। কি করছে নিশি?

-কি হলো এইটা? (অবাক হয়ে সায়েম)
-যা হওয়ার। যাও এখন গোসল করে এসো। (ঠোঁট মুছে নিশি)

সায়েম নিশির চুলের মুঠি ধরে মুখ উঁচু করে গলার নিচে কিস করে। নিশি সায়েমের পেট খামচে ধরে। সায়েম তখন নিশিকে বুকে জড়িয়ে নেয়। নিশিও সায়েমকে জড়িয়ে ধরে। এইদিকে মাইসারা যে তাঁকিয়ে আছে সেইদিকে কারোরই হুশ নেই। মাইসারা বসে বসে খেলছে আর ওরা রোমান্স করছে। ছেলেমেয়ে ছোট থাকলেই এই এডভান্টেজ পাওয়া যায়, বড় হয়ে গেলে হিসেব করে চলতে হয়!

বিকেলে সূর্যের শেষ আলোয় সায়েম আর নিশি হাত ধরে বিচে হাঁটছে। সমুদ্র দেখে মাইসারা আনন্দে লাফাচ্ছে। সায়েম কিছুতেই মেয়েকে কোলে রাখতে পারছেনা। মেয়ে পানিতে নেমে গড়াগড়ি করবে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে মেয়েকে কোল ছাড়া করেনি সায়েম। বাতাসে নিশির খোলা চুলগুলো উড়ছে আর লম্বা চুলগুলো সায়েম ধরে ধরে ছেড়ে দিচ্ছে। পরেরদিন দুপুরে সবাই মিলে বিচে গোসল করলো। সায়েম মাইসারাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর মাইসারা ব্যস্ত পানিকে নিয়ে। নিশি ওইদিন প্রথম সায়েমের অনুমতি নিয়ে জিন্স আর লং টপস পরেছিলো আর সায়েম থ্রি কোয়ার্টার আর পাতলা টি শার্ট পরেছিলো। তিনজনের ছবি সায়েম আম্মুকে হোয়াটসঅ্যাপ করলো। ওদের খুশি দেখে বাড়ির সবাই খুশি। আম্মু বলেই ফেলল,

-আসার পর যেন শুনি আমি আবার দিদুন হব।

কথাটা শুনে সায়েম লজ্জা না পেলেও নিশি পেয়েছিলো।

সাত বছর পর,

বাড়ির পরিবেশ পালটে গেছে আর পাল্টেছে অনেক কিছুই। বেঁচে নেই নিশির মা। বুড়ো শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিয়েই নিশির জীবন। মাইসারা ক্লাস ফোরে পড়ছে আর নীলের বয়স মাত্র ছয় বছর। নীল নিশি আর সায়েমের ছেলে। নীলের বয়স পুরোপুরি ছয় হয়নি। কেবল নার্সারিতে পড়ছে ও।

-নীল বাবা আমাকে এই রঙের বক্সটা দিয়েছে। প্লিজ আমায় দিয়ে দাও ভাই। আমি বাবাকে বলব তোমায় এইরকম আরেকটা এনে দিতে। (মাইসারা)
-না। এইটা আমার। তুমি পাপার থেকে আরেকটা নিয়ে নিও। (নীল)

দুজনের ঝগড়ার মাঝে নিশি এসে বলল,

-মাইসারা ভাইকে এইটা দিয়ে দাও। তুমি তোমার বাবাকে বলো আরেকটা এনে দিতে।
-না আম্মু। এইটা বাবা আমায় গিফট করেছে। আমি কাউকে দিতে পারবনা। ভাইকে বলো না আমার সব রঙ পেন্সিল নিয়ে যেন এইটা দিয়ে দেয়। (কাঁদতে কাঁদতে মাইসারা)

সায়েম তখনি ঘরে ঢুকলো। গলার টাইটা খুলে আর শার্টের একটা বোতাম খুলে সায়েম সোফার উপর বসে পরলো। নিশি সায়েমকে দেখে ছেলে মেয়েকে বলল,

-প্লিজ তোমাদের বাবার সামনে ঝগড়া করনা। সারাদিন পর এসেছে। তোমাদের সমস্যা আমি মিটমাট করে দিচ্ছি৷ মাইসারা আম্মু তুমি এখন ঘরে যাও। আমি আসছি। (নিশি)

মাইসারা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে যাচ্ছে। সায়েম দেখছে মাইসারা চোখ মুছতে মুছতে ঘরে যাচ্ছে। সায়েম দাঁড়িয়ে গিয়ে মাইসারাকে ডাকে।

-আম্মু? (ব্লেজার খুলে সায়েম)
-জ্বি বাবা।
-এইদিকে আসো।

মাইসারা আসার পর সায়েম মাইসারার সামনে নিচু হয়ে বসে আর মাইসারার চোখের দিকে তাঁকায়।

-কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? তোমার আম্মু আবার বকেছে? (সায়েম)
-না বাবা।
-তাহলে?
-বাবা ভাই আমার রঙ পেন্সিল বক্সটা নিয়ে নিয়েছে যেইটা তুমি আমায় দিয়েছিলে। এত করে বললাম আমার সব রঙ নিয়ে এইটা দিয়ে দিতে তাও ভাইয়া শুনলো না।
-নীল এইদিকে এসো। (নীলকে চোখ রাঙিয়ে সায়েম)
-বলো পাপা। (নীল ভয়ে কাঁপছে)
-সায়েম ছেড়ে দাও। আমি দেখছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো যাও। (নিশি)
-তুমি কথা বলো না নিশি। নীল আপুকে বক্সটা দিয়ে দাও।
-আমার পছন্দ হয়েছে এইটা পাপা। (নীল)
-নীল আমি বলছিনা আপুকে এইটা দাও আর সরি বলো।

নীল মাইসারার হাতে বক্সটা দিয়ে সরি বলল।

-বাবা এইটা তো আপুকে আমি দিয়েছিলাম। তোমাকে যে এত খেলনা দেই আমি আপু কি সেইগুলো নেয়? তাহলে তুমি কেনো ওর গিফটের জিনিস নিবা? (নীলের গালে হাত দিয়ে সায়েম)
-তুমি আপুকে অনেক ভালবাসো তাইনা পাপা? এইজন্য আপুও তোমায় অনেক ভালবাসে। (নীল)
-তোমাকেও আমি ভালবাসি, শুধু আপুকে না। তোমরা দুজনেই আমার ভালবাসা। (মাইসারা আর নীলকে জড়িয়ে ধরে সায়েম) আগামীকাল তোমায় আমি এই রকমই বক্স এনে দিব।
-লাগবেনা পাপা। আপু আমায় রঙ করতে দিবে বলেছে তবে একবারে দিবেই না।
-আচ্ছা যাও। পড়তে বসো। নিশি ল্যাপটপ টা নিয়ে ঘরে এসো।

সায়েম ঘরে যাওয়ার পর নিশি কয়েক মিনিট ড্রইংরুমে বসে ভাবছে সায়েমের মন থেকে মাইসারা মুছে যায়নি বরং আরো মায়ার দাগ কেটে আছে। মাইসারাকে নীলের থেকেও বেশি ভালবাসে সায়েম তবে ছেলে মেয়েদের বুঝতে দেয়না। নিশির কাছে দুই সন্তানই সমান। সায়েমের কাছে মাইসারা একটু বেশিই প্রিয়। নিশি তখন হাসিমুখে ল্যাপটপ টা নিয়ে ঘরে যায়। জীবনের সবচেয়ে বড় চিন্তা শেষ এখন কেবলই সুখের সময়। অন্ধকার দিয়ে জীবন শুরু হলেও শেষমেশ আলোর দেখা তো পেলাম।

সমাপ্ত।