সাঁঝের প্রেম পর্ব-৩+৪

0
45

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_3+4
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

টিকেট চেকার টিকেট চেক করে নিশির টিকেট ছিঁড়ে ওর কাছে দিয়ে যায়। নিশির যাত্রা তখন অর্ধেক শেষ হয়েছে। সকালে অল্প কিছু খেয়ে বের হয়েছিলো নিশি। ক্ষুধা লেগেছে ভীষণ। নিশি ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করলো। বিস্কুট আর চানাচুর খেতে খেতে বাইরের দৃশ্য দেখছিলো। চারদিকে সবুজের সমারোহ তবে আমার মনে কেনো সব ছাই হয়ে আছে? কেনো পারছিনা অতীত ভুলে সামনে আগাতে? নতুন করে কেনো পারছিনা জীবনটাকে সাজাতে? নিশি এসব ভাবতে ভাবতেই ৯ ঘণ্টা পর চিটাগং এসে পৌঁছে। তখন সন্ধ্যা নামবে নামবে। সূর্য এখনো লাল আভা ছড়াচ্ছে। ট্রেন থেকে নামার পর নিশি একটু স্বস্তি পেলো। চিটাগং শহরের সব যে তার চেনা। নিশি অফিসের পাঠানো ঠিকানায় গেলো। নিশির বস নিশিকে দুই কামড়ার একটা ফ্ল্যাট দেয় চিটাগং এ থাকার জন্য। নিশি সেখানে গিয়ে দেখলো একটা মেইড সার্ভেন্ট ও আছে। নিশি ভাবলো,

-বসকে যতটা হার্ড মনে হয় উনি ঠিক ততটা হার্ড নন।

নিশি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করলো আর মেয়েটি এসে বলল,

-নিশি আপা আপনার জন্য সব রান্না করে গেলাম। খাইয়া নিয়েন। আপনের স্যার বলছে সকালে এসে আপনাকে যাতে সব গুছায় দিয়া যাই। আমি আবার সকালে আসুম নে।
-ঠিক আছে। তোমার নাম কি?
-নুড়ি।
-তুমি খেয়ে গেছো কিছু?
-না আপা। বাসায় গিয়া খামু নে। তিনি আবার আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। একসাথেই খাই আমরা।
-তোমার স্বামী?
-হ আপা।
-আচ্ছা যাও। (হালকা হেসে নিশি)

নুড়ি যাওয়ার পর নিশি দরজা লাগিয়ে দিয়ে আসে। ফ্ল্যাটটা সুন্দর। নিশি পর্দাগুলো দিয়ে জানালা ঢেকে দেয়। রান্নাঘরে গিয়ে নিশি কফি বানায়। কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার খালি জায়গার উপর উঠে বসে নিশি। পায়ের উপর পা তুলে দুই পা ছড়িয়ে, চুলগুলো খুলে নিশি বাইরে দেখছে আর ধোয়া উঠা গরম কফি খাচ্ছে। তখনি নিশির ফোন বাজে। বস ফোন করেছে।

-গুড ইভিনিং স্যার। (নিশি)
-গুড ইভিনিং। ফ্ল্যাটটা পছন্দ হয়েছে আপনার?
-জ্বি স্যার।
-এইটা আপনার গিফট আমার পক্ষ থেকে। কাজের মেয়েটাকে যা বলবেন করে দিবে। বেতন আমি দিব।
-তার দরকার ছিলো না স্যার। আমি নিজেই নিজের কাজ করতে পারতাম।
-আই নো বাট আপনার প্রাপ্যটুকুই আমি দিয়েছি। যাইহোক পরশু থেকে আমাদের নতুন ব্রাঞ্চে জয়েনিং আপনার। অল দ্যা বেস্ট।
-থ্যাংক ইউ স্যার।

বসের সাথে কথা বলে নিশি বাসায় ফোন করে জানায় সে এসেছে। করার তো এখন কিছুই নেই তাই নিশি টিভি নিয়ে বসলো। টিভি দেখতে দেখতে হঠাৎ লোড শেডিং হয়ে গেলো। এখানে এই একটাই সমস্যা লোড শেডিং হয় বেশি। নিশি রান্নাঘরে গিয়ে মোম জ্বালালো তারপর সোফার উপর শুয়ে পা দোলাচ্ছিলো। মোমের আলোর দিকে তাঁকিয়ে নিশি ভাবছে,

-তুমি কি সত্যিই আমায় ভুলে গেছো? একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছো আমাকে তোমার থেকে? যতবার ভেবেছি তোমার কাছে যাব ততবারই যে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি আমি মাহবুব! কেনো সেদিন তুমি আমার পিছু পিছু বলদা গার্ডেন গিয়েছিলে? না গেলে কি হত?

“নিশি বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা রিক্সা নিয়ে বলদা গার্ডেন একাই যায়। সারারাস্তা অবরোধ চলছে তবে রিক্সা, আর এম্বুলেন্স চলছে। ১৪০ টাকা ভাড়া দিয়ে নিশির বলদা গার্ডেন যেতে হলো। গেইট দিয়ে ঢুকতেই নিশি দেখে মাহবুব ঘাসের উপর বসে ফোন টিপছে। নিশি হা করে তাঁকিয়ে আছে। নিশির তাঁকানো দেখে মাহবুব উঠে এসে বলে,

-মিস নিশু মুখ বন্ধ করুন নয়ত গুবড়ে পোকা ঢুকে যাবে মুখে।
-আপনাকে না আমি আসতে নিষেধ করেছিলাম? (হাঁটতে হাঁটতে নিশি)
-এইটা পাবলিক প্লেস। যে কেউ আসতে পারে। তুমি নিষেধ করলেই কি আমি শুনবো নাকি সুন্দরী? (নিশির লম্বা চুলে টান দিয়ে মাহবুব)
-ওই আপনার সমস্যা কি? আমার চুল ধরেছেন কেনো?
-লম্বা চুলে বিনুনি করতে হয়, ঝুটি না।
-আমি যা খুশি করব তাতে আপনার কি? (মাহবুব কে ধমক দিয়ে নিশি)
-কি কি গাছ লাগবে তোমার?
-আপনাকে বলে কি হবে? (দুজনেই হাঁটছে)
-ব্রায়োফ্রাইটা? পেপেরোমিয়া? টেরিস? এইসব?
-না।
-তাহলে?
-মটর লাগবে।
-এইগুলো তো ধানক্ষেতেই আগাছা হিসেবে পাওয়া যায়। এখানে আসা লাগে নাকি?
-আপনি কি আমার জন্য ধানক্ষেত করছেন নাকি?
-তুমি চাইলে করতে কতক্ষণ! ব্যাংকার আছি, কৃষক ও না হয় হলাম।
-যান তো এখান থেকে। বকবক করে আমার মাথা খাচ্ছে।
-এই যে শুনো! (পেছন থেকে ডাক দিয়ে মাহবুব)
-কি হলো আবার! (বিরক্তি নিয়ে নিশি পেছনে তাঁকালো)
-তোমার এই ভাইয়ার বউ হবা? সমস্যা নেই বিয়ের পর ভাইয়া ডাকতে হবেনা। আমিও আর তোমায় আপু বলব না। হবা কি এই ভাইয়ার বউ? (প্রায় ১২ হাত দূর থেকে মাহবুব চেঁচিয়ে বলছে। সবাই শুনে হাসছে আর কেউ কেউ হা হয়ে গেছে প্রপোজের স্টাইল দেখে)
-আপনার কি মাথায় আর্থ্রাইটিস আছে? কি বলছেন এসব? সবাই দেখছে। (মাহবুবের কাছে এসে নিশি)
-ব্রঙ্কাইটিস, আর্থ্রাইটিস সব এখন হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। তারাতারি উত্তর টা দিয়ে দাও। (নিশির চোখের দিকে তাঁকিয়ে মাহবুব)
-না আমি রাজি না। যান এখান থেকে।

নিশি ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো।

-এই তোমার মটরগাছ নিবে না?
-না।
-সমস্যা নেই আমি এনে দিব।

নিশি একটা রিক্সায় উঠলো আর সেখানে ধুম করে গিয়ে মাহবুব উঠলো।

-এই আপনি এখানে কেন? (দাঁত কটমট করে নিশি)
-তো কাকে আশা করছো তুমি এখানে? (রিক্সার হুড তুলে মাহবুব)
-নামেন তারাতারি রিক্সা থেকে। একদম পা কেটে নয়ত এখানেই ঝুলায় রাখবো আমি।
-ছুরি কিনে আনতে হবে কি? সাথে চাপাটি? (হেসে মাহবুব) মামা কাজলা ছাড়া যেখানে ইচ্ছা যাও।
-আপনি কাজলাই যান মামা। (রেগে গিয়ে নিশি)
-না। আপনি বরং টিএসসি তে চলেন। কাজলা পরে।
-আচ্ছা যাইতাছি। আজকে কিন্তু ভাড়া ডাবল দেওয়া লাগব। (রিক্সাওয়ালা)
-তোমায় আমি ৫০০ দিব। চলবে? (মাহবুব)
-আমি নেমে গেলাম। বাই।

নিশি নামতে যাবে ঠিক তখনি মাহবুব নিশির হাত ধরে। নিশিকে জোর করে রিক্সাতে বসায় রাখে মাহবুব। রিক্সার হুডে বারবার মাহবুব বারি খাচ্ছে।

-হে আল্লাহ তুমি আমায় এত লম্বা বানাইছো কেন? ঠিকমতো কি প্রেম ও করতে দিবেনা? বারবার আমায় তুমি বারি খাওয়াচ্ছো! (রিক্সার হুড ফেলে মাহবুব)
-প্রেম করছেন মানে কি? আমাকে কি আপনার প্রেমিকা মনে হয়? (দাঁত কটমট করে নিশি)
-কেন যেন বউ বউ মনে হচ্ছে অনেস্টলি স্পিকিং। (আকাশের দিকে তাঁকিয়ে মাহবুব)

নিশি মাহবুবের পাশে বসে আছে। যত পারছে মাহবুবকে এড়িয়ে চলছে কিন্তু বুকের কাঁপুনি কমাবে কি করে? নিশির হাত কাঁপছিলো যখন মাহবুব ওকে দেখছিলো। টিএসসি তে আসার পর মাহবুব রিক্সাওয়ালাকে ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বিদায় দিলো। নিশি বলছে,

-এখানে কেন এনেছেন?
-প্রেম করার বেস্ট জায়গা তো এইটাই। পাশে রমনা আছে।
-আবার প্রেমের কথা বলছেন আপনি? (হাতের পানির বোতল থেকে নিশি মাহবুবের শরীরে পানি ছুড়ে মারলো)
-মানুষ এখন কি ভাববে? (টি শার্ট ঝারতে ঝারতে মাহবুব)
-আর যাই ভাবুক আপনাকে আমার বয়ফ্রেন্ড ভাববে না।
-এক মিনিট দেখো ভাবাচ্ছি!

মাহবুব চায়ের দোকানে গিয়ে লেবু চা নিতে নিতে চা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো,

-আমি আর ওই মেয়েটা সম্পর্কে কি হতে পারি ভাই?
-এখানে তো যারা আসে সবাই বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড। আপনারা নিশ্চই ভাইবোন আসেন নি! আপনারাও বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড ই।

এই কথা শুনে নিশি চোখ ছোট করে তাঁকালো চা ওয়ালার দিকে। মাহবুব চা রেখে হাততালি দিচ্ছে আর হাসছে। এরপর মাহবুব চুলের পানি ঝারছে আর চা খাচ্ছে। আর নিশি আঁড়চোখে দেখছে মাহবুব কে। মাহবুব এরপর মাটির ভাড়ে করে নিশির জন্য চা আনলো। নিশি খেলো না। পরে ওইটা মাহবুব নিজেই খেলো।

-দেখলে চা ওয়ালা ও জানে we are boyfriend & girlfriend.
-আমি যদি আগে জানতাম আপনি এমন বদের হাড্ডি ট্রাস্ট মি আমি আপনার সাথে ফ্রেন্ডশিপ ই করতাম না।
-আমি যদি আগে জানতাম তোমাকে আমার বউ বানাবো তাহলে ট্রাস্ট মি আপু ডাকতাম না।
-শয়তান কেন আপনি এত? আমি কি বলেছি আমি আপনার বউ হব? (ঝারি দিয়ে নিশি)
-সব কথা বলেনা হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। আমিও বুঝে নিয়েছি। ওই দেখো তোমার পছন্দের হাওয়াই মিঠাই।
-খাব না।
-দাঁড়াও এখানে।

মাহবুব পাঁচটা হাওয়াই মিঠাই এনে নিশির হাতে দিলো। নিশি ফুচকা খায়না। ব্যাপার না মাহবুব শিখিয়ে দিবে খাওয়া।

-নিশি ফুচকা খাবে?
-আমি এইসব ফালতু খাবার খাই না।
-হাওয়াই মিঠাই তো খুব ভালো জিনিস তাইনা?
-ভালোই তো।
-আমি ফুচকা খাব আর তুমি দেখবে, আসো।

মাহবুব নিশির হাত ধরে গাছের নিচে বসায় আর ও ফুচকা অর্ডার করে। ফুচকার বাটি হাতে নিয়ে মাহবুব খাচ্ছে আর নিশি দেখছে।

-চাইলে খেতে পারো। অনেক টেস্টি কিন্তু। (মাহবুব)
-কখনই না।
-ঠিক আছে না খাইলা!

মাহবুবের ফুচকা খাওয়া দেখে নিশির খেতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু ও খাবেনা। কেন খাবে? মাহবুব কি ওর বয়ফ্রেন্ড লাগে নাকি যে ওর কথা শুনবে?

বের হওয়ার সময় একটা মেয়ে ফুল হাতে নিয়ে মাহবুবের সামনে আসে।

-ভাইয়া তুমি এখানে আসলা কিন্তু আমাকে দেখতে গেলা না কেন? (মেয়েটি)
-রাত্রি আসলে আমি এখনি তোমার কাছে যেতাম। ভালো আছো তুমি? স্কুলে যাও? (নিচু হয়ে বসে মাহবুব)
-হ্যা ভাইয়া প্রতিদিন যাই। এইটা কি আমার ভাবি?
-হয়নি তবে হবে। (মাহবুব)
-কি সুন্দর দেখতে! আপু এই নাও এই ফুলগুলো তোমার।
-থ্যাংক ইউ। (রাত্রির গাল টেনে নিশি)
-রাত্রি আমি এখন যাই? (মাহবুব)
-আম্মুর সাথে দেখা করবেনা?
-আন্টির সাথে আরেকদিন কথা হবে। এই নাও এইটা তুমি রাখো। (কিছু টাকা রাত্রির হাতে দিয়ে মাহবুব)
-না ভাইয়া লাগবেনা তো।
-রাখো। আসছি আমি। বাই।
-বাই মাহবুব ভাইয়া।

নিশি বেরিয়ে মাহবুবকে জিজ্ঞেস করে,

-মেয়েটি কে?
-স্ট্রিট চাইল্ড।
-আপনি কিভাবে চিনেন?
-ওর ফেমিলি আমাদের টিম ওয়ার্কে আছে তাই চিনি। আমরা বারটা ফ্রেন্ড মিলে অফিস শেষ করে সপ্তাহে তিনদিন টিএসসি তে এসে আড্ডা দেই আর ওদের খোঁজ খবর নেই। ওদের দায়িত্ব এখন আমাদের।
-নিশি আর কিছু বলল না।
-CNG চলছে। চলো CNG নিয়ে বাসায় চলে যাই।
-হুম।

মাহবুব আর নিশি দুজনের বাসাই কাজলা। মাহবুব রাস্তার মোড়ে নেমে যায় আর নিশি বাসায় চলে আসে। মাহবুব বাসায় এসে ভীষণ খুশি কারণ আজকে ও নিশিকে ওর মনের কথা বলে দিয়েছে আর দিনের অর্ধেকটা সময় নিশি আজ মাহবুবকে দিয়েছে। নিশি বাসায় এসে নখ কামড়াচ্ছে আর মাহবুবের কথা ভাবছে। মাহবুব শিউর যে নিশিও মাহবুবকে ভালবাসে কিন্তু বলছেনা। নিশি ভেবেছে মাহবুব হয়ত ফোন দিবে বাসায় আসার পর কিন্তু মাহবুব দেয়নি। পরেরদিন বাসস্ট্যান্ডে ও মাহবুব আসেনি। মাহবুবের ফোন ও বন্ধ। টানা সাতদিন মাহবুব নিশির সাথে দেখা করা বা কোনো যোগাযোগ করেনি। নিশি মাহবুবের বাড়ি চিনেনা তাই যাওয়ার সাহস করেনি। তাছাড়া মাহবুবের ফেমিলি আছে এখানে। তারা কি ভাববে! নিশি পাগল প্রায় হয়ে গেছে মাহবুবকে না দেখে। তখনি নিশি বুঝেছে ও মাহবুবকে ভালবাসে, সত্যি সত্যিই ভালবাসে।

সাতদিন পর,,

নিশি মন খারাপ করে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। মাহবুব তখন ঘড়ি ঠিক করতে করতে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। মাহবুবকে দেখে নিশি দৌড়ে সবার সামনে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। মাহবুব নিশিকে জড়িয়ে না ধরে ওর থেকে ছুটায় আর একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায় দুজন।

-কাঁদছো কেনো নিশি?
-আপনি কোথায় ছিলেন এই সাতদিন? (নিশি চোখ মুছে)
-বাসায় ছিলাম।
-অফিসে যান নি কেন? ফোন কেন অফ ছিলো?
-অফিসেও গিয়েছি আর ফোন ও অন ছিলো। (মাহবুব হাসছে)
-মানে কি? আমি পাই নাই কেন তাহলে?
-তোমার কাছে যেই নাম্বার সেইটা অফ ছিলো। আর এতদিন অফিসের বাসে যাইনি, বাইক নিয়ে গিয়েছিলাম অফিসে।
-কেন করলেন আপনি এমন?
-আজকের দিনটা প্রুফ করতে। লাভ ইজ ব্লাইন্ড নিশি। দেখলে তো থাকতে পারলেনা আমাকে ছাড়া। তুমিও আমায় ভালবাসো। প্রতিদিন আমি তোমাকে দেখেই অফিসে যেতাম বাট তুমি আমায় দেখতে না। গতকাল হলুদ রঙের থ্রি পিস পরে ছিলে না? সবুজ রঙের ওড়না আর প্লাজো?
-খাটাস লোক! (মাহবুবকে মেরে নিশি)
-তোমার বাস আজকে আগে চলে আসছে। যাও। রাতে কথা হবে। (নিশির কপালে কিস করে মাহবুব)

সেই চুমুর তোড়ে নিশি কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসে। নিশির চোখ জলে ভিজে গেছে। মোমবাতিটাও জ্বলে শেষ। কারেন্ট যে কখন এসেছে খেয়াল করেনি নিশি। আরেকটু হলে টি টেবিলের উপরে থাকা পেপারে আগুন লেগে যেত। নিশি উঠে দাঁড়িয়ে মোমবাতি নেভায়। ইচ্ছে করছে একটাবার মাহবুবের ছোয়া পেতে! মাহবুবকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে। আর সইতে না পেরে নিশি কান্না করতে করতে মাহবুবের নাম্বারে ডায়াল করেই ফেলল। রিং হচ্ছে শুনে নিশির বুক কাঁপছে। নিশি নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা।

চলবে

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_4
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

নিশি নিজেকে সামলাতে না পেরে মাহবুবকে কল করে ফেলল। নিশি আশা করেনি যে ফোন রিং হবে। ফোন রিং হওয়ার শব্দ শুনে নিশির বুক কাঁপছে। চারবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো। নিশি তখন ফ্লোরে বসে পরলো ফোনটা কানে নিয়ে।

-হ্যালো! কে বলছেন? (মাহবুব)
-নিশি চুপ করে ফোঁপাচ্ছে।
-তিনটা বছর পর কি মনে করে? (দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহবুব)
-নিশি চমকে গেলো মাহবুবের কথা শুনে।
-চমকানোর কিছু নেই মিস নিশি। হয়ত ফোন নাম্বারটা পাল্টেছেন বাট নিঃশ্বাসের শব্দ কি পাল্টাতে পেরেছেন? আপনাকে চেনার জন্য আমার ওইটুকুই যথেষ্ট! (সোফায় বসে মাহবুব)
-কেমন আছো? (কেঁদে কেঁদে নিশি)
-হ্যা খুব ভালো। যতটা ভালো থাকা উচিৎ ছিল না ঠিক ততটাই ভালো আছি। আপনি কেনো ফোন দিয়েছেন জানতে পারি? (মুখের ঘাম মুছে মাহবুব)
-কোথায় তুমি?
-আহহহ! আমার কোনো নিউজ আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য না মিস নিশি, বাধ্য না। (দেয়ালে আঘাত করে মাহবুব)
-বিয়ে করে ফেলেছো?
-কেন? সেকেন্ড বউ হয়ে আসার ইচ্ছা আছে নাকি?
-ও! তার মানে বিয়ে করে ফেলেছো! (উঠে দাঁড়িয়ে নিশি)
-পারবর্তী ছেড়ে চলে গেছে বলে তো দেবদাস হয়ে থাকা যাবেনা তাইনা?
-কথার স্টাইল আজো পালটায় নি তাইনা?
-পাল্টাবেনা তো। যাইহোক মাই ওয়াইফ ইজ ওয়েটিং ফর মি! আই হ্যাভ টু গো নাও। (চোখের পানি মুছে মাহবুব)
-ওহ শিউর!

কথাটা বলেই নিশি ফোন কেটে দিয়ে দেয়ালের সাথে হ্যালান দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। মাহবুব ও ফোন টা আছাড় মেরে ভেঙ্গে টাইটা ঢিলে করে মাথায় হাত দিয়ে সোফার উপর বসে। এইদিকে নিশি কাঁদছে আর ওইদিকে মাহবুব। নিশি কান্নার এক পর্যায়ে বলে,

-ও তো এখন সুখে আছে। আমি আর কাঁদবো না ওর জন্য। আর কখনো ভাববো না ওর কথা। আজ থেকে মাহবুব শেষ আমার জীবন থেকে।

নিশি উঠে ডায়েরিটা ছিঁড়তে গেলো কিন্তু পারলো না। মাহবুবের ছবিটা হাতে নিয়ে নিশি আবারো কান্না জুড়ে দেয়। সারারাত দুজনেরই কাঁদতে কাঁদতে শেষ হলো। পরেরদিন নিশি ফ্ল্যাটটা সুন্দর করে গোছালো আর নিজের কিছু জামাকাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করলো। মাহবুব বিয়ে করেছে শোনার পর থেকে নিশির বুকটা খা খা করছে কিন্তু বাস্তব মানতে হবে। নিশি এইটা মেনেই নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। সুখে থাকুক মাহবুব, ভালো থাকুক। নিশি সেদিন একবেলা খেয়েছে মাত্র তাও নুড়ির জোরাজুরিতে। পরেরদিন সকাল আটটায় নিশির অফিস। অফিসের গাড়ি এসে নিশিকে বাসার সামনে থেকে নিয়ে যাবে। নিশি নুড়ির দায়িত্বে সব রেখে সকালে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে অনেক কথাই ভাবে কিন্তু সেসব ভাবনা এখন অর্থহীন। অফিসের প্রথম দিন থাকায় নিশিকে সবাই ওয়েলকাম জানায়। নিশির কেবিনে গিয়ে নিশি বসে প্রথমে ফাইল চেক করে। নিজেকে সম্পূর্ণ কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেয় নিশি। তাও যে মাথা থেকে বের হচ্ছেনা মাহবুবের স্মৃতি। রাতের বেলা পাহাড়ি এলাকা ঘুরে নিশিকে বাসায় দিয়ে যায় অফিসের গাড়ি৷ নিশি বাসায় ঢুকে নুড়িকে দিয়ে কফি বানিয়ে নুড়িকে চলে যেতে বলে। এরপর নিশি একটু রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ডিনার করে তুর্না আর মায়ের সাথে কথা বলে। এইভাবে নিশির দিন কেটে গেলো নয়দিন। দশদিনের দিন কেনো যেনো নিশি অফিসে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই বাইরে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে নিশির ফ্ল্যাট। জায়গাটা অদ্ভূত সুন্দর আজ নিশি সেইটা খেয়াল করলো। গাড়ি আসার পর নিশি হাসিমুখে না গেলেও মন প্রফুল্ল রেখে অফিসে ঢুকলো। কলিগদের সাথে টুকটাক কথা বলে নিশি নিজের ডেস্কে বসলো। তখন ম্যানেজার এসে বলল,

-নিশি ইউনাইটেড ব্যাংক থেকে আজকে রিপ্রেজেনটেটিভ আসবে। আমি তো থাকব না দুপুরে। তাই আমি দায়িত্ব টা তোমার উপর দিয়ে গেলাম। তুমি ওনাদের সাথে কথা বলো আর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও। উনারা আমাদের নতুন ক্লায়েন্ট।
-ওকেহ স্যার। আমাকে ডিটেইলস গুলো দিয়ে যাবেন।
-আচ্ছা আমি তোমায় ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-ওকে স্যার আই উইল ম্যানেজ।

নিশি ফাইলগুলো দেখে দুপুরের জন্য প্রিপারেশন নেয়। লাঞ্চের পর ইউনাইটেড ব্যাংক থেকে ব্যাংকার রা আসার পর এমডি নিশিকে ডেকে পাঠায়। নিশি এমডির কেবিনে পার্মিশন নিয়ে ঢুকে। নিশির গলায় “May I come in Sir” শোনার পর একজন রিপ্রেজেনটেটিভ সাথে সাথে পেছনে ঘুরে তাঁকায়। নিশি আর ওই লোকটা দুজনেই থ হয়ে যায়। সে আর কেউ না মাহবুব ছিল! মাহবুব সামনে ঘুরে বসে। নিশি আস্তে আস্তে হেঁটে এমডির সামনে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

-স্যার ডেকেছেন? (নিশি কাঁপছে)
-হ্যা। ম্যানেজার তো নেই তাই দায়িত্ব টা আপনার। ওনারা তিনজন ইউনাইটেড ব্যাংকের রেপুটেড ব্যাংকার। আমাদের নতুন ক্লায়েন্ট ইউনাইটেড ব্যাংক। উনি মিস্টার আশরাফ, উনি আয়ুশ আর উনি মিস্টার মাহবুব।
-হ্যালো! (নিশি তড়তড় করে ঘামছে)
-হাই! (আয়ুশ এবং আশরাফ)
-মিস্টার মাহবুব আপনারা নিশির সাথে যে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারেন। নিশি তোমার কেবিনে নিয়ে যাও ওনাদের।
-প্লিজ কাম। (নিশি)

মাহবুব একবারের জন্য ও আর নিশির দিকে তাঁকায় নি। নিশির কেবিনে গিয়ে মাহবুব বসলো আর বিপরীত পাশে নিশি। নিশি পানি খাচ্ছে আর মাহবুব নিচের দিকে তাঁকিয়ে আছে।

-মিস্টার আশরাফ কি জানতে চান বলুন। (নিশি কাঁপা গলায়)
-মিস নিশি আপনার অফিসের ডেকোরেশন টা আপনার মতই সুন্দর। পছন্দ হয়েছে আমাদের। (আশরাফ)
-আশরাফের কথা শুনে রাগী লুক নিয়ে তাঁকায় মাহবুব আশরাফের দিকে।
– স্যার এনি প্রবলেম? (আয়ুশ)
-আশরাফ ইউ জাস্ট ক্রস ইউর লিমিট। কাজের কথা বলো। (ধমক দিয়ে মাহবুব)
-স্যরি স্যার।

প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলার পরও নিশির সাথে একটাও কথা বলেনি মাহবুব। নিশি যে কতটা শান্তি পাচ্ছে মাহবুবকে দেখে। অনেক পালটে গেছে ও! রোগা হয়ে গেছে প্রায়। তবে স্মার্ট আছে আগের মতই। চোখের ভাষা পালটে গেছে। সবাইকে বাই জানিয়ে মিটিং শেষ করে নিশি। মাহবুব চেয়ার থেকে উঠতেই পারছিলো না। কেনো যেন শরীর টা অসার হয়ে আসছে। নিশি মাহবুবের দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। মাহবুব ঢকঢক করে পানিটা খেলো এরপর নিশির চোখের দিকে একবার তাঁকিয়ে উঠে আসলো সেখান থেকে। নিশি টেবিলে মাথা নিচু করে শুয়ে পরলো। হয়ত হার্ট এটাক করে এখনি মারা যাবে নিশি। কিন্তু ওকেও তো মাহবুবের মতো ভালো থাকতে হবে, নিজেকে সামলাতে হবে এখন। মাহবুব চলে যাওয়ার পর পেপারস গুলোতে মাহবুবের সাইন গুলো বারবার দেখছে নিশি। মাহবুব কে দেখে ওর মনটা যতটা আনন্দে ভরে গেছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এত কাছে পেয়েও ওকে একটাবার ছুঁতে না পারার কষ্ট যে কি!

মাহবুব ও ভাবেনি নিশি চিটাগং আছে। সব ছেড়ে মাহবুব চিটাগং চলে এসেছিলো। এখানেও নিশি থাকলে ওর স্মৃতি ভুলবে কিভাবে? মাহবুব সেদিন বাসায় এসে সব ভাঙচুর করে। শুধু নিশি নিজেকে সামলে রেখেছে। মাহবুবের পরিবর্তন গুলো শুধু ভাবছে নিশি। একটা মানুষ কতটা পালটে যায় তাইনা? মাহবুব আর কখনো নিশির অফিসে যায়নি। খুব প্রয়োজনে গেলেও নিশির সাথে কথা বলেনি।

এক শুক্রবার,

নিশির অফিস ছুটি। তাই নিশি ভেবেছে আজকে একটু বের হবে। পাহাড়ে গিয়ে একটু মনটা রিফ্রেশ করবে। তাই নিশি লাঞ্চ করেই বেরিয়ে যায়। পরনে থ্রি পিস আর স্লিপার আর চুলগুলো তুলি দিয়ে ঝুটি করা। মুখে হালকা মেকাপ আছে। হেলতে দুলতে নিশি ছোট্ট একটা টিলার উপর উঠে। সেখান থেকে প্রকৃতিটা দেখে আবার নিচে এসে ঢালু জায়গা বেয়ে হাঁটতে শুরু করে নিশি। এই চিটাগং এ কত স্মৃতি মাহবুব আর নিশির। শুরুটা পূর্ণতা পায় এখান থেকে আর শেষের পূর্নতাও হয়ত এখানেই পাবে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে নিশি হঠাৎ করে খাঁদে পা দিয়ে ফেলে। পরে যাওয়ার আগেই নিশির হাত ধরে মাহবুব। মাহবুবকে দেখে ভূত দেখার মতই চমকে যায় নিশি।

-ঠিকমতো চলতে পারলে চলবেন নচেৎ বের হওয়ার দরকার নেই। (নিশির হাত ছেড়ে মাহবুব)
-তুমি এখানে? (অবাক হয়ে নিশি)
-আমারো একই প্রশ্ন আমার বাড়ির সামনে আপনি কেনো?
-কোনটা তোমার বাড়ি?
-এইটাই আমার বাড়ি। (আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মাহবুব)
-তুমি বানিয়েছো?
-হ্যা আমার বউয়ের পছন্দে।
-বাহ! তোমার বউয়ের পছন্দ আমার পছন্দের সাথে অনেক মিল।
-হতে পারে।

ওইটুকু বলে মাহবুব চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখন নিশি পেছন থেকে বলে,

-একবার কি সেই ভাগ্যবতীকে দেখাবেনা যে তোমার মত স্বামী পেয়েছে?
-কাউকে দেখানোর বস্তু ও নয়।

মাহবুব চলে যায় ওর বাড়িতে। নিশি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে আসে। মাহবুবের বাড়ি আর নিশির বাড়ি বেশি দূরে না। হেঁটে গেলে আধা ঘণ্টার দূরত্বে দুজনের বাসা। নিশি সেইদিন সন্ধায় ওর হাতটা ধোয় নি পর্যন্ত কারণ এতে মাহবুবের ছোয়া আছে। বারবার নিশি হাতটা বুলিয়েছে। কতটা ভালো লাগা কাজ করছিলো তখন যখন মাহবুব ওকে ছুঁয়েছিলো। এখন যে ওর ছোঁয়া অন্যকেউ পায়, ওর আদরের ভাগীদার যে এখন অন্য কেউ।

চলবে