সাঁঝের প্রেম পর্ব-৭+৮

0
47

#সাঁঝের_প্রেম
#Part_7+8
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

মায়ের মুখ থেকে “জামাই” ডাক শুনে নিশি আর মাহবুব দুজনেই মর্মাহত কারণ এইটা কখনো সম্ভব নয়। আরাফ তখন দাঁড়িয়ে যায় আর মাহবুব পেছনে ঘুরে তাঁকিয়ে একটা অর্থহীন হাসি দেয়। মাহবুবের হাসির মানে কেউ না বুঝলেও নিশি বুঝেছে৷ মাহবুব কয়েক পা এগিয়ে এসে আন্টিকে বলে,

-আন্টি এইরকম ডাক মানায় না। আপনি আমার নাম ধরেই ডাকবেন। আমি খুশি হব।
-আমি তোমায় এই নামেই ডাকব। তোমার আর নিশির সাথে আমার কথা ছিলো কিন্তু আমি বলব না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আগামীকাল তোমাদের বিয়ে। আগামীকাল সোমবার একটা শুভ দিন।
-আম্মু? (জোরে চিৎকার করে নিশি)
-একদম চুপ। কাল যদি তুই মাহবুবকে বিয়ে না করিস তাহলে যেদিকে দুচোখ যায় আমি আর তুর্না চলে যাব। তোর মতো মেয়ের আমার দরকার নাই।
-না আন্টি কারো অমতে আমি কাউকে বিয়ে করতে চাইনা। মাফ করবেন আমায়। (মাহবুব)
-তাহলে আমার কথার কোনো দাম রইলো না? (আম্মু)
-সম্ভব নয় এইটা কোনোদিন আম্মু। আমি আজীবন এভাবেই থাকব। চাইনা আমি বিয়ে করতে। (নিশি)

নিশি এ কথা বলার পর আম্মু গিয়ে নিশির গালে ঠাস করে চড় মেরে দেয়। মাহবুব আর আরাফ এইটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।

-সবসময় তোর জেদে হবেনা। তিনবছর আমাদের দেখে উদ্ধার করে ফেলেছিস আমাদের? কি ভেবেছিস তুই পাশে না থাকলে না খেয়ে মরে যেতাম? কোনোদিন ও মরতাম না। দরকার হলে ভিক্ষা করে খেতাম। (আম্মু জিদ থেকে কথাগুলো বলছে)
-আম্মু? (নিশি)
-হয় কাল তুই মাহবুবকে বিয়ে করবি নয় আমাকে আর তুর্নাকে ছাড়বি। তোর আব্বুর কথা ভাবছিস তো? আমি বলছি তুই মাহবুবকে বিয়ে করবি। আর মাহবুব তুমি কি আমার মেয়ের দায়িত্ব নিবেনা?
-আন্টি আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু এইটাও মিথ্যে না যে আমি ওকে ভালবাসি৷ (মাহবুব)
-দয়া কর বাবা। আগামীকাল তোমাদের চারহাত আমি এক করে দিতে চাই। এর মাঝে কোনো ঝামেলা আমি আসতে দিবনা।
-এভাবে বিয়ে হয়না আন্টি। আপনার মেয়ে যেখানে রাজি না, সেখানে আমি কি বলব?
-ও রাজি তো হবেই। আগামীকাল সন্ধ্যায় তোমাদের বিয়ে। আরাফ তোমরা দুজন চলে এসো। (আম্মু)

মাহবুব আর কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। আরাফ ও আন্টির সাথে কিছু কথা বলে বেরিয়ে যায়। নিশি সোফার উপর ধপাশ করে বসে পরে। তুর্না আর আম্মু দুজনেই নিশিকে ছেড়ে রেস্ট নিতে চলে যায়। সারারাত নিশি একভাবেই বসে ছিলো আর কাঁদছিলো। মা উঁকি দিয়ে দেখে গেছে কিন্তু আটকায়নি নিশিকে। মাহবুবের ও একই অবস্থা। কেউ ভাবেনি দুজন আবার এক হতে পারবে! এতকিছুর পরেও নিশি আর মাহবুব এক কি হবে? এই প্রশ্নটাই আম্মুর মাথায় ঘুরছিলো কিন্তু উনি এক করিয়েই ছাড়বেন।

পরেরদিন সকালে,

নিশি ভোরে নামাজ পড়ে জানালার গ্রিল ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। মাহবুব মসজিদ থেকে এসে আরাফকে জিজ্ঞেস করে,

-আজ কি সত্যিই নিশির সাথে আমার বিয়ে?
-হ্যা। একটু পর পাঞ্জাবি কিনতে বের হব। নিশির জন্য বিয়ের শাড়িও কেনা লাগবে। মেন্টালি স্ট্রং হ।
-মাহবুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মা নিশির গায়ে হলুদ করালো সকালে এরপর নিশিকে গোসল করিয়ে তুর্না হাতে মেহেদি পরিয়ে দিলো। আর নিশির মা বারবার মাহবুবকে ফোন করছে। নিশি সারাদিনে একটা কথাও বলেনি। যে যা বলেছে সেইটাই করেছে। দুপুরে এসে আরাফ নিশির শাড়ি আর গোল্ড প্লেটের গহনা দিয়ে যায়। বিকেলে তুর্না নিশিকে বউ সাজাতে বসে। তুর্না ওর সমস্ত মেকাপ খাটে ছড়িয়ে নেয় যাতে খুব সহজেই হাতের কাছে সব পাওয়া যায়। প্রথমে তুর্না নিশির চুলগুলো সুন্দর করে স্ট্রেইট করে। এরপর মেকাপ করে। চুলগুলো খোপা করে তাতে ফুল বেঁধে দেয়। চোখে টানা টানা কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক। শাড়িটাও লালচে খয়েরি। তুর্না নিশির পায়ে সুন্দর করে আলতা পরিয়ে দেয়। নিশির পুরো শরীরে গহনা আর নাকে বড় একটা নোলক। নিশি আজ অন্যরকম নিজেকে দেখছে। গত তিনবছরে নিশি ঠোঁটে লিপস্টিক ও ছোঁয়ায় নি। তুর্না নিশিকে দেখে বলে,

-আপু তুমি কত সুন্দর দেখেছো? কিন্তু তাও নিজেকে কেমন করে রাখতে! দেখো আজ মাহবুব ভাইয়া তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারবেনা।
-নিশি তুর্নার দিকে রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাঁকালো।

খোপা পর্যন্ত নিশির মাথায় ঘোমটা টানা। হাতে মোটা মোটা বালা আর চুরি। মায়ের আংটি খুলে মা নিশিকে পরিয়ে দেয়। নিশির যখন সব শেষ হলো তার কিছুক্ষণ পরে আরাফ আসে, পিছনে মাহবুব। নিশি নিশির ঘরে। আম্মু মাহবুবকে ড্রইংরুমে বসায়৷ আরাফ ভীষণ খুশি কারণ মান অভিমান যতই থাকুক বিয়ের পর তা ঠিক হতে বাধ্য। মাহবুব তুর্নার সাথে কথা বলছে টুকটাক। তুর্না মাহবুবকে বলছে,

-আজ থেকে তাহলে আমি তোমার শালিকা হব তাইতো দুলাভাই? (তুর্না মাহবুবকে শরবত দিতে দিতে)
-হয়ত! থ্যাংকস বাট আমি কিছুই খাব না এখন। (মাহবুব)
-মাহবুব তুই সারাদিনে কিন্তু কিছুই খাস নি! (আরাফ)
-তো? মরব না তো।
-মাহবুব তোমার জন্য আমি চিঁড়ার পোলাও বানিয়েছি। তোমার পছন্দের তো? (আম্মু)
-কিন্তু আন্টি আমি এখন কিছুই খাব না৷
-ভাইয়া আমি খাইয়ে দিচ্ছি। শালিকে না করবানা নিশ্চই? (তুর্না)
-তুর্না খাওয়াটা জরুরি না তো। (মাহবুব)
-বিয়েটা হবে কিছুক্ষণ পর৷ আপু ও আজ সারাদিন কিছুই খায় নি।
-তো তাকেই গিয়ে খাওয়াও।
-আগে তুমি খাও। আম্মু প্লেট টা দিয়ে যেয়ো আমায়।
-আচ্ছা। (আম্মু)

নিশির আম্মু প্লেটে করে চিড়ার পোলাও আর চিকেন রেজালা এনে দিলো সুন্দর করে সাজিয়ে আর আরাফের জন্য আলাদা প্লেটে। তুর্না জোর করে মাহবুবকে খাইয়ে দিলো নিজের হাতে। মাহবুব এখনো নিশিকে দেখেনি। একটু পর কাজি যখন এলো তখন তুর্না নিশিকে এনে মাহবুবের পাশে বসায়। মাহবুব মাথা নিচু করে বসে আছে। দেখেনি ও নিশিকে৷ শুধু পা দেখা যাচ্ছে। পায়ে গাঢ় আলতা পরা। কবুল বলে মাহবুব রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলো আর নিশিও৷ তুর্না তখন দুজনকেই মিষ্টি খাওয়ায়। বিয়ের পর‍ যখন মাহবুব উঠে দাঁড়ালো তখন মাহবুবের পাঞ্জাবির ব্রোঞ্জের সাথে নিশির হাতের বিয়ের মালা আটকে যায়। নিশি তখন প্রথম মাহবুবের দিকে তাঁকায় আর মাহবুব ও। মাহবুব নিশির দিকে তাঁকিয়ে তাঁকিয়েই ব্রোঞ্জ থেকে মালার সুতোটা ছুটালো কিন্তু মুখে একটাও কথা বলেনি। আরাফ তুর্নাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলছে,

-তোমায় তো একবার ওই বাসায় যেতে হবে।
-কেনো ভাইয়া?
-বাসর ঘর সাজানো হয়নি। ওরা এখান থেকে বেরোতে বেরোতে আমরা ফুল কিনে এনে সাজানোটা কমপ্লিট করে ফেলতে পারি।
-একদম ভুলে গেছি। দাঁড়ান ভাইয়া আম্মুকে বলে আসি।
-বাট ওরা যাতে টের না পায়।
-আচ্ছা।

তুর্না আম্মুকে সব বলে আরাফের সাথে বেরিয়ে যায়। আরাফ বলেছে রাতে আবার তুর্নাকে বাসায় ছেড়ে যাবে। মাহবুব জিজ্ঞেস করলো ওরা কোথায় যাচ্ছে কিন্তু তুর্না কথা কাটিয়ে নিয়ে চলে গেলো৷ ওরা যাওয়ার পর নিশির আম্মু নিশিকে আর মাহবুবকে আলাদা ঘরে পাঠায় কথা বলার জন্য। নিশি সে ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। মাহবুব ও চুপ করে থাকে। মাহবুবকে ওর ভাই কল দিচ্ছে৷ মাহবুব রিসিভ করে,

-হুম বল।
-ভাইয়া ভালো আছো? কাল থেকে তোমায় ফোন দিচ্ছি কিন্তু ধরছো না!
-ব্যস্ত ছিলাম একটু।
-কি করছো এখন?
-এইত কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করলাম।
-কিহহহহ? কাকে? কীভাবে?
-নিশিকে।
-কি বলছো তুমি ভাইয়া? মজা করছো না তো?
-নাহ।
-তুমি বাসায় আসবেনা?
-না।
-ভাইয়া, আমি আব্বু আম্মুকে বলব। তারা আসুক আর না আসুক নেক্সট উইকে আমি চিটাগং আসছি।
-আসো।
-আচ্ছা এখন তাহলে আমি রাখছি।
-বাই।

ফোন কাটার পর মাহবুব নিশিকে বলল,

-বউ সাজে তোমায় অপুর্ব লাগছে। কখনো ভাবিনি যে বিয়েটা হবে।
-নিশি চুপ।
-তুমি নাকি সারাদিন কিছু খাও নি? খেয়ে নাও। আন্টিকে বলছি খাইয়ে দিতে।
-নাহ তার দরকার হবেনা।

নিশি এই কথা বলে ঘুরতে যাবে তখনি ও মাথা ঘুরে ফ্লোরে পরে যায়। মাহবুব পেছনে ঘুরে দেখে নিশি ফ্লোরে পরে আছে। মাহবুব নিশিকে দ্রুত কোলে তুলে খাটে শোয়ায়। মাহবুব আন্টিকে ডাকছে আর নিশির চোখে মুখে পানি ছিটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নিশির জ্ঞান ফিরে আসে। নিশির জ্ঞান ফিরে আসার পর মাহবুব আন্টিকে বলে,

-সারাদিন না খেয়ে ছিলো তাই মাথা ঘুরে পরে গেছে। আন্টি আপনি ওকে খাইয়ে দিন। আমি এশারের নামাজ পড়ব।
-নামাজ পড়ার ওয়াক্ত তো শেষ তাই তুমি ওই ঘরটায় পর। আমি নিশিকে খাওয়াচ্ছি।
-হুম।

মাহবুব ইচ্ছে করেই নিশিকে খাওয়ায় নি। রাগ, জেদ, ভালবাসা সবকিছুই আছে মনের ভেতর। মাহবুব নামাজ পড়ে আরাফকে ফোন দেয়। আরাফের কাজ তখন অর্ধেক শেষ হয়েছে। আরাফ ফোন রিসিভ করেনি। মাহবুব আন্টিকে জিজ্ঞেস করে,

-নিশি এখানেই থাকবে আন্টি?
-তুমি রাখতে চাইলেও আমি রাখব না। আজ থেকে ও তোমার ঘরে থাকবে।

কথাটা শুনে মাহবুবের বুকের ভেতর একটা ভাললাগার ঢেউ বইতে শুরু করলো। কিন্তু মাহবুব বাইরে তা প্রকাশ করলো না। রাত সাড়ে দশটায় আরাফ আর তুর্না বাসায় আসে। আরাফ পরে ওদের নিয়ে যায়। নিশি যেতে চায়নি কিন্তু আম্মু পাঠিয়ে দিয়েছে। এত রাতে এই এলাকায় গাড়িও পাওয়া যাবেনা। আরাফ কই থেকে যেনো একটা রিক্সা ধরে আনলো। মাহবুব নিশিকে নিয়ে রিক্সায় করে চলে আসে আর আরাফ হেঁটে হেঁটেই আসে। চাঁদনি রাত আর সাথে নতুন বউ নিয়ে রিক্সায় ফিলিংস টাই আলাদা। মাহবুব তখন বলল,

-সব মিলে যাচ্ছে। বলেছিলাম না চাঁদনি রাতে, খোলা আকাশের নিচে দিয়ে তোমায় বউ করে নিয়ে যাব আর তোমার গাঁয়ের গহনা আর তুমি চাঁদের আলোয় ঝলমল করবে। আমি আমার কথা রেখেছি।

নিশি তখন ও চুপ করে আছে। মাহবুব বাড়ির সামনে গিয়ে রিক্সা থামায়। নিশি রিক্সা থেকে নেমে রাস্তায় হাত মেলে দাঁড়ায়। এত সুন্দর প্রকৃতি! চারদিকে পাহাড় আর মাঝে মাটির রাস্তা। পাশে একটা পুকুর যেখানে চাঁদের আলো চিকচিক করছে। মাহবুব নিশিকে বলে,

-এসো।
-হুম।

নিশি এই প্রথম ওর স্বপ্নের বাড়িতে ঢুকলো। বাড়ির প্রতিটা কোণা নিশির মনমতো শোপিস দিয়ে সাজানো। সব আসবাবপত্র নিশির পছন্দের ডিজাইনের। নিশির চোখ আটকে যায় দেয়ালগুলো দেখে। দেয়ালগুলোর এর কোণায় নিশির ছবি দিয়ে ফ্রেম করা। নিশি একবার ছোঁয় ওইটা। পুরো বাড়িটা কাঠের। শুধু ওয়াশরুমটা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি আর টাইলস করা। বাড়ির ছাদটাও কাঠের ডিজাইন করা। নিশি অভিভূত হয়ে যায়। তিনটা বেডরুম আরেকটা ডায়নিং রুম, তার পাশে রান্নাঘর। বাড়ির জানালা গুলো ও কাঠের। নিশি যখন বেডরুমে পা দিলো তখন দেখলো খাটটা ফুল দিয়ে সাজানো। নিশির ভেতরটা তখন কেঁপে উঠলো। মাহবুব ডায়নিং এই বসেছিলো। নিশি ঘরে ঢুকে ফুলগুলো ছোয়। মাহবুব তখন আসে বেডরুমে।

চলবে#সাঁঝের_প্রেম
#Part_7
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

মায়ের মুখ থেকে “জামাই” ডাক শুনে নিশি আর মাহবুব দুজনেই মর্মাহত কারণ এইটা কখনো সম্ভব নয়। আরাফ তখন দাঁড়িয়ে যায় আর মাহবুব পেছনে ঘুরে তাঁকিয়ে একটা অর্থহীন হাসি দেয়। মাহবুবের হাসির মানে কেউ না বুঝলেও নিশি বুঝেছে৷ মাহবুব কয়েক পা এগিয়ে এসে আন্টিকে বলে,

-আন্টি এইরকম ডাক মানায় না। আপনি আমার নাম ধরেই ডাকবেন। আমি খুশি হব।
-আমি তোমায় এই নামেই ডাকব। তোমার আর নিশির সাথে আমার কথা ছিলো কিন্তু আমি বলব না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আগামীকাল তোমাদের বিয়ে। আগামীকাল সোমবার একটা শুভ দিন।
-আম্মু? (জোরে চিৎকার করে নিশি)
-একদম চুপ। কাল যদি তুই মাহবুবকে বিয়ে না করিস তাহলে যেদিকে দুচোখ যায় আমি আর তুর্না চলে যাব। তোর মতো মেয়ের আমার দরকার নাই।
-না আন্টি কারো অমতে আমি কাউকে বিয়ে করতে চাইনা। মাফ করবেন আমায়। (মাহবুব)
-তাহলে আমার কথার কোনো দাম রইলো না? (আম্মু)
-সম্ভব নয় এইটা কোনোদিন আম্মু। আমি আজীবন এভাবেই থাকব। চাইনা আমি বিয়ে করতে। (নিশি)

নিশি এ কথা বলার পর আম্মু গিয়ে নিশির গালে ঠাস করে চড় মেরে দেয়। মাহবুব আর আরাফ এইটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।

-সবসময় তোর জেদে হবেনা। তিনবছর আমাদের দেখে উদ্ধার করে ফেলেছিস আমাদের? কি ভেবেছিস তুই পাশে না থাকলে না খেয়ে মরে যেতাম? কোনোদিন ও মরতাম না। দরকার হলে ভিক্ষা করে খেতাম। (আম্মু জিদ থেকে কথাগুলো বলছে)
-আম্মু? (নিশি)
-হয় কাল তুই মাহবুবকে বিয়ে করবি নয় আমাকে আর তুর্নাকে ছাড়বি। তোর আব্বুর কথা ভাবছিস তো? আমি বলছি তুই মাহবুবকে বিয়ে করবি। আর মাহবুব তুমি কি আমার মেয়ের দায়িত্ব নিবেনা?
-আন্টি আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু এইটাও মিথ্যে না যে আমি ওকে ভালবাসি৷ (মাহবুব)
-দয়া কর বাবা। আগামীকাল তোমাদের চারহাত আমি এক করে দিতে চাই। এর মাঝে কোনো ঝামেলা আমি আসতে দিবনা।
-এভাবে বিয়ে হয়না আন্টি। আপনার মেয়ে যেখানে রাজি না, সেখানে আমি কি বলব?
-ও রাজি তো হবেই। আগামীকাল সন্ধ্যায় তোমাদের বিয়ে। আরাফ তোমরা দুজন চলে এসো। (আম্মু)

মাহবুব আর কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। আরাফ ও আন্টির সাথে কিছু কথা বলে বেরিয়ে যায়। নিশি সোফার উপর ধপাশ করে বসে পরে। তুর্না আর আম্মু দুজনেই নিশিকে ছেড়ে রেস্ট নিতে চলে যায়। সারারাত নিশি একভাবেই বসে ছিলো আর কাঁদছিলো। মা উঁকি দিয়ে দেখে গেছে কিন্তু আটকায়নি নিশিকে। মাহবুবের ও একই অবস্থা। কেউ ভাবেনি দুজন আবার এক হতে পারবে! এতকিছুর পরেও নিশি আর মাহবুব এক কি হবে? এই প্রশ্নটাই আম্মুর মাথায় ঘুরছিলো কিন্তু উনি এক করিয়েই ছাড়বেন।

পরেরদিন সকালে,

নিশি ভোরে নামাজ পড়ে জানালার গ্রিল ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। মাহবুব মসজিদ থেকে এসে আরাফকে জিজ্ঞেস করে,

-আজ কি সত্যিই নিশির সাথে আমার বিয়ে?
-হ্যা। একটু পর পাঞ্জাবি কিনতে বের হব। নিশির জন্য বিয়ের শাড়িও কেনা লাগবে। মেন্টালি স্ট্রং হ।
-মাহবুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মা নিশির গায়ে হলুদ করালো সকালে এরপর নিশিকে গোসল করিয়ে তুর্না হাতে মেহেদি পরিয়ে দিলো। আর নিশির মা বারবার মাহবুবকে ফোন করছে। নিশি সারাদিনে একটা কথাও বলেনি। যে যা বলেছে সেইটাই করেছে। দুপুরে এসে আরাফ নিশির শাড়ি আর গোল্ড প্লেটের গহনা দিয়ে যায়। বিকেলে তুর্না নিশিকে বউ সাজাতে বসে। তুর্না ওর সমস্ত মেকাপ খাটে ছড়িয়ে নেয় যাতে খুব সহজেই হাতের কাছে সব পাওয়া যায়। প্রথমে তুর্না নিশির চুলগুলো সুন্দর করে স্ট্রেইট করে। এরপর মেকাপ করে। চুলগুলো খোপা করে তাতে ফুল বেঁধে দেয়। চোখে টানা টানা কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক। শাড়িটাও লালচে খয়েরি। তুর্না নিশির পায়ে সুন্দর করে আলতা পরিয়ে দেয়। নিশির পুরো শরীরে গহনা আর নাকে বড় একটা নোলক। নিশি আজ অন্যরকম নিজেকে দেখছে। গত তিনবছরে নিশি ঠোঁটে লিপস্টিক ও ছোঁয়ায় নি। তুর্না নিশিকে দেখে বলে,

-আপু তুমি কত সুন্দর দেখেছো? কিন্তু তাও নিজেকে কেমন করে রাখতে! দেখো আজ মাহবুব ভাইয়া তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারবেনা।
-নিশি তুর্নার দিকে রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাঁকালো।

খোপা পর্যন্ত নিশির মাথায় ঘোমটা টানা। হাতে মোটা মোটা বালা আর চুরি। মায়ের আংটি খুলে মা নিশিকে পরিয়ে দেয়। নিশির যখন সব শেষ হলো তার কিছুক্ষণ পরে আরাফ আসে, পিছনে মাহবুব। নিশি নিশির ঘরে। আম্মু মাহবুবকে ড্রইংরুমে বসায়৷ আরাফ ভীষণ খুশি কারণ মান অভিমান যতই থাকুক বিয়ের পর তা ঠিক হতে বাধ্য। মাহবুব তুর্নার সাথে কথা বলছে টুকটাক। তুর্না মাহবুবকে বলছে,

-আজ থেকে তাহলে আমি তোমার শালিকা হব তাইতো দুলাভাই? (তুর্না মাহবুবকে শরবত দিতে দিতে)
-হয়ত! থ্যাংকস বাট আমি কিছুই খাব না এখন। (মাহবুব)
-মাহবুব তুই সারাদিনে কিন্তু কিছুই খাস নি! (আরাফ)
-তো? মরব না তো।
-মাহবুব তোমার জন্য আমি চিঁড়ার পোলাও বানিয়েছি। তোমার পছন্দের তো? (আম্মু)
-কিন্তু আন্টি আমি এখন কিছুই খাব না৷
-ভাইয়া আমি খাইয়ে দিচ্ছি। শালিকে না করবানা নিশ্চই? (তুর্না)
-তুর্না খাওয়াটা জরুরি না তো। (মাহবুব)
-বিয়েটা হবে কিছুক্ষণ পর৷ আপু ও আজ সারাদিন কিছুই খায় নি।
-তো তাকেই গিয়ে খাওয়াও।
-আগে তুমি খাও। আম্মু প্লেট টা দিয়ে যেয়ো আমায়।
-আচ্ছা। (আম্মু)

নিশির আম্মু প্লেটে করে চিড়ার পোলাও আর চিকেন রেজালা এনে দিলো সুন্দর করে সাজিয়ে আর আরাফের জন্য আলাদা প্লেটে। তুর্না জোর করে মাহবুবকে খাইয়ে দিলো নিজের হাতে। মাহবুব এখনো নিশিকে দেখেনি। একটু পর কাজি যখন এলো তখন তুর্না নিশিকে এনে মাহবুবের পাশে বসায়। মাহবুব মাথা নিচু করে বসে আছে। দেখেনি ও নিশিকে৷ শুধু পা দেখা যাচ্ছে। পায়ে গাঢ় আলতা পরা। কবুল বলে মাহবুব রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলো আর নিশিও৷ তুর্না তখন দুজনকেই মিষ্টি খাওয়ায়। বিয়ের পর‍ যখন মাহবুব উঠে দাঁড়ালো তখন মাহবুবের পাঞ্জাবির ব্রোঞ্জের সাথে নিশির হাতের বিয়ের মালা আটকে যায়। নিশি তখন প্রথম মাহবুবের দিকে তাঁকায় আর মাহবুব ও। মাহবুব নিশির দিকে তাঁকিয়ে তাঁকিয়েই ব্রোঞ্জ থেকে মালার সুতোটা ছুটালো কিন্তু মুখে একটাও কথা বলেনি। আরাফ তুর্নাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলছে,

-তোমায় তো একবার ওই বাসায় যেতে হবে।
-কেনো ভাইয়া?
-বাসর ঘর সাজানো হয়নি। ওরা এখান থেকে বেরোতে বেরোতে আমরা ফুল কিনে এনে সাজানোটা কমপ্লিট করে ফেলতে পারি।
-একদম ভুলে গেছি। দাঁড়ান ভাইয়া আম্মুকে বলে আসি।
-বাট ওরা যাতে টের না পায়।
-আচ্ছা।

তুর্না আম্মুকে সব বলে আরাফের সাথে বেরিয়ে যায়। আরাফ বলেছে রাতে আবার তুর্নাকে বাসায় ছেড়ে যাবে। মাহবুব জিজ্ঞেস করলো ওরা কোথায় যাচ্ছে কিন্তু তুর্না কথা কাটিয়ে নিয়ে চলে গেলো৷ ওরা যাওয়ার পর নিশির আম্মু নিশিকে আর মাহবুবকে আলাদা ঘরে পাঠায় কথা বলার জন্য। নিশি সে ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। মাহবুব ও চুপ করে থাকে। মাহবুবকে ওর ভাই কল দিচ্ছে৷ মাহবুব রিসিভ করে,

-হুম বল।
-ভাইয়া ভালো আছো? কাল থেকে তোমায় ফোন দিচ্ছি কিন্তু ধরছো না!
-ব্যস্ত ছিলাম একটু।
-কি করছো এখন?
-এইত কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করলাম।
-কিহহহহ? কাকে? কীভাবে?
-নিশিকে।
-কি বলছো তুমি ভাইয়া? মজা করছো না তো?
-নাহ।
-তুমি বাসায় আসবেনা?
-না।
-ভাইয়া, আমি আব্বু আম্মুকে বলব। তারা আসুক আর না আসুক নেক্সট উইকে আমি চিটাগং আসছি।
-আসো।
-আচ্ছা এখন তাহলে আমি রাখছি।
-বাই।

ফোন কাটার পর মাহবুব নিশিকে বলল,

-বউ সাজে তোমায় অপুর্ব লাগছে। কখনো ভাবিনি যে বিয়েটা হবে।
-নিশি চুপ।
-তুমি নাকি সারাদিন কিছু খাও নি? খেয়ে নাও। আন্টিকে বলছি খাইয়ে দিতে।
-নাহ তার দরকার হবেনা।

নিশি এই কথা বলে ঘুরতে যাবে তখনি ও মাথা ঘুরে ফ্লোরে পরে যায়। মাহবুব পেছনে ঘুরে দেখে নিশি ফ্লোরে পরে আছে। মাহবুব নিশিকে দ্রুত কোলে তুলে খাটে শোয়ায়। মাহবুব আন্টিকে ডাকছে আর নিশির চোখে মুখে পানি ছিটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নিশির জ্ঞান ফিরে আসে। নিশির জ্ঞান ফিরে আসার পর মাহবুব আন্টিকে বলে,

-সারাদিন না খেয়ে ছিলো তাই মাথা ঘুরে পরে গেছে। আন্টি আপনি ওকে খাইয়ে দিন। আমি এশারের নামাজ পড়ব।
-নামাজ পড়ার ওয়াক্ত তো শেষ তাই তুমি ওই ঘরটায় পর। আমি নিশিকে খাওয়াচ্ছি।
-হুম।

মাহবুব ইচ্ছে করেই নিশিকে খাওয়ায় নি। রাগ, জেদ, ভালবাসা সবকিছুই আছে মনের ভেতর। মাহবুব নামাজ পড়ে আরাফকে ফোন দেয়। আরাফের কাজ তখন অর্ধেক শেষ হয়েছে। আরাফ ফোন রিসিভ করেনি। মাহবুব আন্টিকে জিজ্ঞেস করে,

-নিশি এখানেই থাকবে আন্টি?
-তুমি রাখতে চাইলেও আমি রাখব না। আজ থেকে ও তোমার ঘরে থাকবে।

কথাটা শুনে মাহবুবের বুকের ভেতর একটা ভাললাগার ঢেউ বইতে শুরু করলো। কিন্তু মাহবুব বাইরে তা প্রকাশ করলো না। রাত সাড়ে দশটায় আরাফ আর তুর্না বাসায় আসে। আরাফ পরে ওদের নিয়ে যায়। নিশি যেতে চায়নি কিন্তু আম্মু পাঠিয়ে দিয়েছে। এত রাতে এই এলাকায় গাড়িও পাওয়া যাবেনা। আরাফ কই থেকে যেনো একটা রিক্সা ধরে আনলো। মাহবুব নিশিকে নিয়ে রিক্সায় করে চলে আসে আর আরাফ হেঁটে হেঁটেই আসে। চাঁদনি রাত আর সাথে নতুন বউ নিয়ে রিক্সায় ফিলিংস টাই আলাদা। মাহবুব তখন বলল,

-সব মিলে যাচ্ছে। বলেছিলাম না চাঁদনি রাতে, খোলা আকাশের নিচে দিয়ে তোমায় বউ করে নিয়ে যাব আর তোমার গাঁয়ের গহনা আর তুমি চাঁদের আলোয় ঝলমল করবে। আমি আমার কথা রেখেছি।

নিশি তখন ও চুপ করে আছে। মাহবুব বাড়ির সামনে গিয়ে রিক্সা থামায়। নিশি রিক্সা থেকে নেমে রাস্তায় হাত মেলে দাঁড়ায়। এত সুন্দর প্রকৃতি! চারদিকে পাহাড় আর মাঝে মাটির রাস্তা। পাশে একটা পুকুর যেখানে চাঁদের আলো চিকচিক করছে। মাহবুব নিশিকে বলে,

-এসো।
-হুম।

নিশি এই প্রথম ওর স্বপ্নের বাড়িতে ঢুকলো। বাড়ির প্রতিটা কোণা নিশির মনমতো শোপিস দিয়ে সাজানো। সব আসবাবপত্র নিশির পছন্দের ডিজাইনের। নিশির চোখ আটকে যায় দেয়ালগুলো দেখে। দেয়ালগুলোর এর কোণায় নিশির ছবি দিয়ে ফ্রেম করা। নিশি একবার ছোঁয় ওইটা। পুরো বাড়িটা কাঠের। শুধু ওয়াশরুমটা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি আর টাইলস করা। বাড়ির ছাদটাও কাঠের ডিজাইন করা। নিশি অভিভূত হয়ে যায়। তিনটা বেডরুম আরেকটা ডায়নিং রুম, তার পাশে রান্নাঘর। বাড়ির জানালা গুলো ও কাঠের। নিশি যখন বেডরুমে পা দিলো তখন দেখলো খাটটা ফুল দিয়ে সাজানো। নিশির ভেতরটা তখন কেঁপে উঠলো। মাহবুব ডায়নিং এই বসেছিলো। নিশি ঘরে ঢুকে ফুলগুলো ছোয়। মাহবুব তখন আসে বেডরুমে।

চলবে
#সাঁঝের_প্রেম
#Part_8
#Written_By_Nilima_Zabin_Tanmona

মাহবুবকে ঘরে ঢুকতে দেখে নিশি মাহবুবকে সাইড দিলো। মাহবুব আলমারি থেকে নরমাল একটা পাঞ্জাবি আর প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে গেলো চেঞ্জ করতে। এখনো পর্যন্ত নিশি নিশ্চুপ। মাহবুব ওয়াশরুমে যাওয়ার পরেই দরজায় বেল বাজলো। নিশি দরজা খুলে দেখে আরাফ এসেছে। আরাফ নিশিকে বলে,

-ঘামছো কেনো? বেশ ঠান্ডা তো এখন।
-না ঘামছিনা।
-মাহবুব কোথায়?
-জামাকাপড় নিয়ে কোথায় গেলো দেখলাম। জানিনা কোথায় গেছে।
-চেঞ্জ করছে মনে হয় তাহলে। তুমি ফ্রেশ হবেনা?
-না। এভাবেই ভালো লাগছে।
-রাত তো অনেক হলো। ক্ষুধা লাগেনাই?
-না খেয়ে এসেছি। আপনি খেয়ে এসেছেন?
-হ্যা।

আরাফ ডায়নিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলো আর টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেলো। মাহবুব তখন টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেডরুম থেকে বের হয়। নিশি আরেকটা রুম দেখছে।

-কিরে এত দেরি করলি? (মাহবুব)
-ভাবছি কাল দুপুরের ট্রেনে বা বাসে চলে যাব।
-কেনো?
-আর তো কাজ নাই আমার। যে কাজের জন্য এসেছিলাম সে কাজ হয়ে গেছে। নিশি একটু শুনে যাও।

নিশি ডায়নিং রুমে এসে দাঁড়ায়। মাহবুব চেয়ারে পা উঠিয়ে পায়জামার নিচের অংশ ভাঁজ করছে। আরাফ বলছে,

-তোদের দুজনকেই বলছি যা হয়েছে তা তো হয়েছেই। এসব নিয়ে মান অভিমানের কোনো প্রয়োজন নাই। নিজেদের মধ্যে সব ঝামেলা মিটিয়ে নিয়ে একে অপরের পাশে থাকিস ঠিক আগের মত। নিজেদের সংসার নিজেরা বুঝে নিবি। আর নিশি তোমার কাছে আমি আমার বন্ধুটার দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। দেখো ওকে। আর মাহবুব তোকেও সেইম কথা বলছি।

দুজনেই চুপ। মাহবুব ফ্রিজ খুলে সফট ড্রিংকস এর বোতল বের করে খেতে শুরু করলো আর আরাফকে দিলো একটা। মাহবুব খেতে খেতে বলল,

-ইউ নো হোয়াট আরাফ আমি কখনো কাউকে আর কোনোকিছুতে জোর করবনা। ওর ইচ্ছে মতো ও চলবে আর আমার ইচ্ছেমতো আমি। বিয়েটা নাটকীয় ভাবে হলেও আমার জীবন কিন্তু নাটকের নিয়মে চলবেনা। ও ওর জায়গা থেকে স্বাধীন আর আমি আমার। আমার মনে হয়েছে যেহেতু একবার আমি ভুল করে ফেলেছি তাই ভুলটা শুধরে ওকে বিয়ে করাটা দরকার। ঠিক সেই চিন্তা মাথায় রেখেই ওকে বিয়ে করা। ওর যদি কখনো অন্য কোথাও বিয়ে হতো তাহলে ও নিজেকে মাফ করতে পারলেও আমি কখনোই পারতাম না। তাই ওর সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতেই ওকে বিয়ে করা।
-এগুলো কোনো কথা ভাই? (আরাফ)
-হ্যা এইগুলোই কথা।

নিশি হাসছিলো। নিশিকে হাসতে দেখে আরাফ জিজ্ঞেস করে,

-তুমি হাসছো কেন?
-কি করব ভাইয়া বলেন? আপনার বন্ধু তো আমায় দয়া করেছে না? তাই হাসছি। আমার সম্মান রক্ষার্থে বিয়েটা করেছে আপনার বন্ধু। বেশ ভালো ছিলো কথাটা।
-আরাফ ঘুমাতে আয়৷ আজাইরা কথা শোনার টাইম আমার নাই। (মাহবুব উঠে দাঁড়িয়ে)
-ঘুমাতে আয় মানে? তুই কি আমার সাথে ঘুমাবি নাকি? (দাঁড়িয়ে গিয়ে আরাফ)
-অবশ্যই।
-মাহবুব আজ তোর বাসর রাত। (আরাফ)
-সেইটা পাঁচ বছর আগে হয়ে গিয়েছে। বারবার বাসর করতে হয়না। এই চিটাগং এই সেইটা হয়েছে আর তোর ভাষায় সাঁঝের প্রেম। বাই দ্যা ওয়ে ও তো জামাকাপড় আনে নাই। আমার আলমারিতে তোমার কিছু পুরোনো জামাকাপড় আছে নিশি। আজকে রাতটা ম্যানেজ করে নিও। কাল নতুন জামা এনে দিব।

মাহবুব এইটুকু বলেই অন্য একটা ঘরে চলে যায়। বিছানা ঠিক করে মাহবুব শুয়ে পরে। আরাফ মাহবুবের পাশে গিয়ে শোয়।

-কাজটা তুই ঠিক করলি মাহবুব? ও এখন তোর বউ হয়। ও তোর থেকে স্বামীর অধিকার পায়। (আরাফ)
-আগে আমাকে স্বামী মানুক এরপর। দোস্ত মন থেকে বলছি ওকে আমি বিয়েটা করেছি ওর সম্মান রক্ষার জন্যই। তাই আমি বিয়েতে কোনো বাঁধা দেইনি। জীবনে বিয়ে না করলে কি হত? ৩০ বছর তো পেরিয়ে গেছে একা একা থেকেই। বাকি ৪০ ও কেটে যেত। ওর স্মৃতি নিয়েই থাকতাম।
-এখনো জীবনের অনেকটা সময় পরে আছে মাহবুব। নিজেকে এভাবে মেরে ফেলিস না।
-আমি অনেক আগেই মরে গেছি। নতুন করে আর মরার কিছু নাই। ঘুমা। গুড নাইট।

মাহবুব পাঞ্জাবি ঠিক করে পাশ ফিরে শুয়ে পরে। আরাফ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে আরাফ বিশ্বাস করে একদিন সব ঠিক হবে। নিশি ঘরে গিয়ে একটা একটা করে খাট থেকে ফুল ছিঁড়ে নিচে ফেলে সাথে চোখের পানি।

– এতটা ভালবাসা জমেছিলো তোমায় দেয়ার, এতটা স্বপ্ন বুনেছিলাম একটু একটু করে সেইটাও ভেঙে গেলো। প্রেমিককে বিয়ে করতে পারলে নাকি মেয়েরা অনেক ভাগ্যবতী হয়। তাহলে আমার কেনো কষ্ট হচ্ছে? (নিশি)

নিশি শরীর থেকে একটা গহনাও খুলেনি। ফুলগুলো ছিঁড়ে ফেলে খাটেই বসেছিলো বউ সাজ নিয়ে। কি মমে করে যেন নিশি জানালার বাইরে হাত দিয়ে এক টুকরা কলাপাতা ছিঁড়ে।

-কলাপাতার সংসার পাঁততে চেয়েছিলাম আমরা তাইনা? সেই কথা কি তোমার মনে আছে মাহবুব? তোমায় যখন আমি জিজ্ঞেস করতাম “কিভাবে সংসার করব আমরা?” তুমি বলতে “প্লেট কিনতে না পারলে কলাপাতায় খাব, পাতিল কিনতে না পারলে টিনের উপর রান্না করব, খাটে ঘুমাতে না পারলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ফ্লোরেই ঘুমাবো, ঘরে আসবাবপত্র কিনতে না পারলে ফ্লোরকেই আপন করে নিব।” আজ তোমার সবই আছে কিন্তু আমি নেই। নেই ভালোবাসাও। সেই ভালবাসা কোথায় গেলো তোমার? কথা দিয়েছিলে কখনো আমায় ভুলবেনা, তবে আজ কেনো করছো এমন? তুমি আমায় সম্মান রক্ষার জন্য বিয়ে করেছো? এ কথা তোমার মুখ দিয়ে আসলো কিভাবে? আমি কি এতটাই পচে গেছি তোমার কাছে?

নিশি কাঁদছে আর আপন মনে বিলাপ করছে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় নিশি ঘুমিয়ে যায়। মাহবুবের ঘুম আসছিলো না বলে মাহবুব উঠে এলো কফি বানাবে বলে। নিশির ঘরে বাতি জ্বলছে দেখে মাহবুব দরজার বাইরে তাঁকিয়ে দেখলো নিশি শুয়ে আছে। আর ফ্লোরে ফুলের স্তূপ করা। নিশির উপর চাঁদর টেনে দিয়ে, লাইট অফ করে মাহবুব রান্নাঘরে এসে কফি বানায়। ড্রইংরুমে বসে মাহবুব টিভি দেখছে আর কফি খাচ্ছে। রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। চারটার সময় মাহবুব টিভি অফ করে পেছনের জানালাটা খুলে দেয় আর কম্পিউটারের সামনে বসে। শুধু শুধু কিছুক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে ঘাটাঘাটি করে ফজরের আযান দিলে নামাজ পড়ে নেয়। আটটায় অফিস। ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে অফিসের ড্রেস নিয়ে আসে মাহবুব। নিশি তখনো ঘুমাচ্ছিলো। সাড়ে সাতটা অবধি মাহবুব সবার জন্য ব্রেকফাস্ট বানালো। পরটা, অমলেট আর চিকেন কারি। চিকেন কারি রান্নার সময় মাহবুব কাশছিলো ঝাঁঝে। তখন নিশির ঘুম ভেঙে যায় আর আরাফ ও উঠে আসে।

-কিরে কি করছিস তুই? (আরাফ)
-ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি। একটু পর বেরিয়ে যাব তো তাই তোদের খাবার বানিয়ে দিয়ে গেলাম। শেষ প্রায়। আমি রেডি হয়ে আসছি।
-আজ অফিস থেকে ছুটি নে। (আরাফ)
-রিজন?
-সবেমাত্র বিয়ে করেছিস। নিশিকে সময় দিবিনা?
-এতগুলো দিন নিজেকেই সময় দেইনি আর নিশি। আসছি আমি।

মাহবুব রেডি হয়ে এসে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে। নিশি তখন গোসল করে বের হয়। ভেজা চুলে টাওয়েল পেচিয়ে নিশি ডায়নিং এ আসে। এসে দেখে মাহবুব খাবার সার্ভ করছে।

-আমাকেও অফিসের জন্য বেরোতে হবে। (নিশি)
-As your wish. (মাহবুব)

ব্রেকফাস্ট করে মাহবুব বেরিয়ে যায়। আরাফ আর নিশি তখন বাসায়। আরাফ নিশিকে বলে,

-একটা রিকুয়েষ্ট করব রাখবে?
-জ্বি ভাইয়া বলুন।
-চাকরিটা ছেড়ে দাও। মাহবুব পছন্দ করেনা তার বউ চাকরি করবে। আর তুমি না বললেও মাহবুব তোমার আম্মু আর তুর্নাকে দেখবে।
-আমিও ভেবেছি আজই রিজাইন দিয়ে চলে আসব।তবে সেইটা আপনার বন্ধুকে খুশি করার জন্য নয়, নিজের খুশিতে।
-থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমার বের হতে হবে। তুমি ব্রেকফাস্ট করে নাও।

আরাফকে খেতে দিয়ে নিশিও খায়। মাহবুবকে ফোন করে আরাফ বেরিয়ে যায়। দশটায় অফিসে গিয়ে নিশি রিজাইন লেটার দিয়ে আসে। নিশির বস প্রচন্ড রেগে গেছে এজন্য। বাট নিশির সেইটা দেখার সময় নেই। নিশি এরপর নিজের বাসায় চলে আসে। নিশির আম্মু তখন রান্না করছিলো।

-কিরে তুই এখন? জামাই কই? (আম্মু)
-অফিসে। তোমাদের বাস টাইম কয়টায়?
-আজকে সন্ধ্যায়।
-তুর্নার এক্সাম শেষে একবারে চলে আসবে। আমরা চিটাগং এই থাকব এখন থেকে। (নিশি)
-সেইটা না চাইলেও তোকে থাকতে হবে।
-হ্যা সে তো হবেই। রিজাইন দিয়ে আসলাম এই মাত্র। (পানি খেতে খেতে নিশি)
-ভালো করেছিস। জামাই এইসব পছন্দ করেনা।
-তোমরা কি করে চলবা?
-তোর সেভিংস দিয়ে ঠিক চলে যাবে। আমিও কিছু জমিয়েছিলাম।
-আমি এই বিষয়টা নিয়ে মাহবুবের সাথে কথা বলব।
-না দরকার নেই। এখন রান্না করছি। দুপুরে খেয়ে যাবি।
-হুম।

লাঞ্চের পর…….

নিশির ফোনে মাহবুবের কল আসে। নিশি অবাক হয়নি। স্বামী হয়ত তাই দিতেই পারে। নিশি ফোন রিসিভ করে।

-লাঞ্চ টাইম তো শেষ। বাসায় কখন আসবে? (মাহবুব)
-এখনি বের হব।
-কেনো?
-বাসায় এসেই বলব।
-ইচ্ছা। আমি বাসায়। সন্ধ্যায় তোমার জন্য মার্কেট করতে যাব। আশা করছি তারাতারি ফিরবে।
-হুম।

মাহবুব ফোন কেটে দিয়ে ফোনটা সোফায় ফেলে দিলো৷ শার্টের বোতাম খুলে সোফার উপর হ্যালান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো মাহবুব। আধা ঘণ্টা পর নিশি বাসায় ঢুকলো। হাত থেকে পার্টস টা ডায়নিং এর উপর রাখলো নিশি। কিছুদূরেই মাহবুব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। রাতে ঘুমায়নি তাই ঘুমিয়ে গেছে। নিশি মাহবুব কে না ডেকে গ্লাসের আওয়াজ করলো। মাহবুবের ঘুম পাতলা তাই জেগে গেলো। টি টেবিলের উপর থেকে চশমাটা নিয়ে মাহবুব পরলো। শার্টের বোতাম লাগিয়ে বলল,

-কখন বের হবে?
-তুমি যখন চাও।
-চলো এখন।
-চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি।
-কেনো? (অবাক হয়ে মাহবুব)
-করব না তাই।
-ভালো। গুড ডিসিশন।
-হুম।

মাহবুব নিশির পছন্দেই নিশির জন্য জামাকাপড় কিনলো। মার্কেট থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে মাহবুব রানাঘরে যায় রাঁধবে বলে। নিশি তখন রান্নাঘরে গিয়ে বলে,

-তুমি বসো। আমি করছি।
-না। আমিই করি।
-আচ্ছা দুজনেই করছি।
-ইচ্ছা।

নিশি মাহবুবকে সবজি কেটে কেটে দিচ্ছিলো। মাহবুব জানে নিশি পেঁয়াজ কাটতে পারেনা। নিশি যখন পেয়াজ কাটতে যাবে তখন মাহবুব চাকুটা হাতে নিয়ে বলে,

-এইটা আমি কাটছি।
-মনে রেখেছো যে আমি পেঁয়াজ কাটতে পারিনা? (মাহবুবের দিকে তাঁকিয়ে নিশি)
-মনে না থাকার কিছু নেই।

দুজন একসাথে রান্না শেষ করে এক সাথেই ডিনার করলো। মাহবুব যখন বেডরুমে ঘুমাতে এলো না তখন নিশি পাশের ঘরে যায়। গিয়ে দেখে মাহবুব ফোন টিপছে।

-তোমার ঘরে আসবেনা? (নিশি)

চলবে