#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৪ ও ১৫
আজ শ্বশুরের আমন্ত্রণে তার সঙ্গে মাছ ধরতে এসেছে আবরার। শহর থেকে কিছুটা দূরে জারার বাবা একটা পুকুর সমেত পুরোনো বাড়ি কিনেছে। সেখানেই নিজের জামাইকে নিয়ে এসেছে। পুকুরটায় মোটামুটি ভালোই মাছ আছে। শ্বশুরের কথামতো আবরার এসেছে ঠিকই কিন্তু এ বিষয়ে ও একেবারেই অজ্ঞ, বিধায় প্রায় এক ঘণ্টায় একটাও মাছ ওর বড়শীতে ওঠেনি। এদিকে আনোয়ার সাহেব ইতিমধ্যে কয়েকটা ধরে ফেলেছে, আবরার তা দেখে আফসোস করে বললো…
‘ আব্বু, আপনার সঙ্গে আমি পারবো না। আপনি কতগুলো মাছ ধরে ফেললেন আর আমি একটাও পারলাম না ‘
‘ মাছ ধরাটা একটা আর্ট বুঝলে, এর কায়দা কানুন শিখতে একটু সময় লাগে আর একবার শিখে গেলে টপটপ ধরা যায়। তা, তুমি অবসর সময়ে কখনও মাছ ধরোনি?’
‘ আমার আসলে ফিশিং করার কখনও ইচ্ছে হয়নি, অবসর সময়ে আমি অন্যকিছু করতাম। আমি গিটার বাজাতে শিখেছি, পিয়ানোও কিছুটা বাজাতে পারি আবার আর্টও শিখেছি’
‘ এখনকার ছেলেমেয়েরা অবসর সময় কাটানোর জন্যে নানা কৃত্রিম উপায় বেছে নেয়। আমাদের সময় আমরা প্রকৃতির সঙ্গে অবসর সময় কাটাতাম। সেই সোনালী দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে’
পুরোনো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে থাকলেন আনোয়ার সাহেব, এরই মাঝে বললেন…
‘ জারাও কিন্তু খুব ভালো মাছ ধরতে পারে’
‘ রিয়েলি? ও আমায় কখনও বলেনি।আপনার মেয়ের তো তাহলে অনেক গুণ আছে বলতে হবে ‘
‘ সে তো আছেই। আসলে আমার বরাবরই মাছ ধরার প্রতি নে’শা ছিলো। মাঝে মাঝে ফিশিং করতে জারাকেও নিয়ে আসতাম। একসময় ও নিজেও শিখে ফেলে। হাই স্কুলে ওঠার পরও আমার সঙ্গে আসতো, কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিলো ‘
‘ কারণ ও আপনার ওপর অভিমান করে আছে, আমার মনে হয় সবটা জানলে ওর অভিমান ভেঙে যাবে। আপনাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে যাবে ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আনোয়ার সাহেব…
‘ জারা ওর মায়ের বিষয়ে কতটা আবেগী সে সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই, ও অনেক কষ্ট পাবে। তাছাড়া, আমি চাইনা ও ওর মাকে ভুল বুঝুক ‘
‘ কিন্তু ও যে আপনার সঙ্গে থেকেও আপনাকে ভুল বুঝছে সেটা তো ঠিক নয় আব্বু ‘
‘ জারা আমাকে ভুল বোঝে তাতে আমি কষ্ট পাইনি, বরং আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ও যদি আমার চোখের সামনে না থাকতো বা ওর মায়ের সঙ্গে চলে যেতো তাতে আমার বেশি কষ্ট লাগতো। আমি কখনও চাইনা জারা ওর মাকে ভুল বুঝুক, ও জানুক যে আমি নই বরং ওর মা আমাকে আর ওকে ছেড়ে চলে গেছিলো। একটা সময় ওর মাকে আমি অনেক ভালবাসতাম তো, তাই ওকে ওর মেয়ের চোখে ছোটো হতে দিতে চাইনা ‘
শ্বশুরের কথায় বেশ অবাক হলো আবরার, কারণ জারার মা অন্যায় করেছে জানা সত্বেও ওনার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছেনা উল্টে জারা যাতে তার মাকে ভুল না বোঝে আনোয়ার সাহেব সেই চেষ্টা করেছেন তাই জারাকে ওর মেয়ের সত্যিটা জানতে দেননি…
‘ আপনি খুব ভালোবাসতেন আপনার প্রাক্তনকে?’
‘ অবশ্যই, শুধু আমি নই আমরা দুজনেই ভালোবাসতাম। দুর্ভাগ্যবশত সময়ের সঙ্গে আমার প্রতি ওর ভালোবাসা হারিয়ে গেছিলো তাই আজ আমরা আলাদা। তাই বলে আমাদের সুন্দর সময়গুলো তো আর অস্বীকার করা যাবে না ‘
শ্বশুরের কাছে তার ভালোবাসার গল্প শুনে বিমোহিত হলো আবরার, নিজের ভালোবাসার প্রতিও কনফিডেন্স যেনো আরেকটু বাড়লো ওর। এতকিছুর পরও যদি জারার বাবা তার মাকে না ভোলে তাহলে আবরার কেনো সহজেই হার মেনে নেবে? জারা চাইলেই এতো সহজেই ওকে ছেড়ে দেবে? নাহ! সময় যতো পেরোচ্ছে ততোই যেনো আবরারের মনে জারাকে নিজের কাছে রাখার জেদ বাড়ছে কারণ এতদিনে ও এইটুকু বুঝেছে সময় এলে জারা যেতে চাইবে অবশ্যই! আবরার নিজ ভাবনায় হারিয়ে গেছিলো, তখনই আনোয়ার সাহেব বললেন…
‘ দেখো আবরার, যা হওয়ার হয়েছে আমি সেসব নিয়ে ভাবিনা কিন্তু তোমার প্রতি আমার একটাই চাওয়া থাকবে। জারাকে সবসময় ভালো রেখো, আমি চাইনা ও আর কিছুতে কষ্ট পাক ‘
‘ আপনি চিন্তা করবেন না আব্বু, আপনার মেয়ে যদিও কিছু বিষয়ে একটু জেদ দেখায় তবে আমি সামলে নেবো। তাছাড়া, আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে ভালোই আছে। একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন, এসে দেখবেন আপনার মেয়ে কেমন সংসারী হয়ে উঠেছে ‘
হাসলেন আনোয়ার সাহেব…
‘ অবশ্যই যাবো!’
তখনই আবরারের ফোন বেজে উঠলো, জারার ফোন এসেছে। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে জারা প্রশ্ন করে বসলো…
‘ কোথায় আছো তুমি? এতোবার কল করছি আর বারবার বলছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়?’
‘ আমি পুকুর পাড়ে আছি’
‘ পুকুর? পুকুরে কি করছো?’
‘ আমি আব্বুর সঙ্গে মাছ ধরতে এসেছি’
‘ কিন্তু আমি তো বেরোনোর সময়ও আব্বুকে বাসায় দেখে এলাম, তোমরা মাছ ধরতে গেলে কখন?’
‘ আমি আমার আব্বুর কথা বলিনি, আমি আমার শ্বশুর আব্বুর কথা বলছি’
‘ আমার বাবার সঙ্গে তুমি কী করছো?’
‘ জারা, এখানে নেটওয়ার্ক সমস্যা হচ্ছে। তোমার কথা ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছেনা। আমি বাড়ি ফিরে কথা বলছি’
ফোন কেটে দিলো আবরার, এদিকে জারা ভেবে পাচ্ছেনা যে ও গেছে কোথায়? জারা আজ অনেকদিন পর এলিনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, এলিনা প্রেগন্যান্সির প্রায় পাঁচ মাস চলছে তাই জারা নিজেই ওর বাড়িতে এসেছে। বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে আবরারের কথা মাথায় এসেছে জারার, আবরার আজ সকালেই বেরিয়ে গেছিলো। কিন্তু ফোন করে সঠিক জানতেই পারলো না ছেলেটা কোথায় গেছে…
‘ কীরে, কোথায় গেছে তোর বর?’
‘ বুঝলাম না কিছু, বললো আমার আব্বুর সঙ্গে নাকি পুকুরে গেছে। আবার নেটওয়ার্কের সমস্যাও নাকি ওখানে। এমন কোন জায়গায় গেছে যেখানে নেটওয়ার্ক নেই!’
‘ আংকেলের সঙ্গে? বাব্বাহ! আংকেলের সঙ্গে মনে হয় ভালো সম্পর্ক তোর হাসবেন্ডের। আমার জন তো আমার আব্বুকে দেখে এতো ভয় পায়, পাঁচ মিনিট বসে ঠিকঠাক কথাও বলতে পারেনা’
‘ সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আঙ্কেল তো যথেষ্ট রাগী তার ওপর উনি স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও মনে হয় রেগে কথা বলছেন ‘
‘ সেটাও ঠিক! তবে তুই যাই বল আবরার কিন্তু তোদের এই সম্পর্কটা একদম স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোর প্রতি এতো কেয়ারিং, আবার তোর বাবার সঙ্গেও এতো ভালো সম্পর্ক। কপাল গুণে স্বামী জুটেছে তোর ‘
‘ তা ঠিক, ওই মুহূর্তে আবরার যদি আমাকে বিয়ের অফার না করতো তাহলে ছেলেই পেতাম না বাবার শর্ত পূরণের জন্য। সবকিছু ভালোভাবেই এগোচ্ছে, আর তিন মাস মতো সময় আছে। সেটাও আশা করি ভালোভাবেই চলে যাবে ‘
‘ জারা, আমার মনে হয় তোর এইসব ছাড়াছাড়ির চিন্তা বাদ দেওয়া উচিত। একটা মেয়ে সারাজীবন একা থাকতে পারে না আর তোর কি মনে হয় এতগুলো দিন একসঙ্গে থাকার পর তুই আবরারকে ছাড়া থাকতে পারবি?’
‘ এলিনা, আমি সবকিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই প্লিজ আমাকে এইসব বলে কনফিউজড করে দিস না ‘
‘ আমি তোকে কনফিউজড করছি না জারা, বোঝানোর চেষ্টা করছি। সুন্দর একটা সংসার হয়েছে তোর, এটাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া নিছক বোকামি হবে ‘
এলিনার কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে কিছু একটা ভেবে জারা বললো…
‘ কিন্তু আমি ওর সঙ্গে থাকতে পারবো না ‘
‘ কেনো পারবি না? তোদের দুজনের মধ্যে তো ভালোই অ্যাডজাস্টমেন্ট হয়ে গেছে এতদিনে আর আমি যা দেখছি তাতে তোদের দুজনের সম্পর্কও স্বাভাবিক তাহলে সমস্যা কোথায়? দেখ জারা, একটা সম্পর্ক গড়লে যে তার ভাঙন নিশ্চিত এমন কিন্তু কোথাও লিখা নেই। তাই যদি হতো তাহলে তো পৃথিবীতে কেউ বিয়েই করতো না তাইনা?’
নিশ্চুপ রইলো জারা, এই বিষয়টা নিয়ে যে ওর মাথায় ভাবনা আসেনি সেটা বলা যায় না। আবরারের সঙ্গে থাকতে থাকতে দিনদিন ওর মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে এই বিষয়টা জারা উপলব্ধি করতে পারছে কিন্তু মন বারবার মস্তিষ্কের কাছে হেরে যাচ্ছে। যখনই এই সম্পর্ক নিয়ে জারা ইতিবাচক কিছু ভাবতে শুরু করে তখনই ওর মস্তিষ্কে নানান চিন্তা ঘুরতে শুরু করে। বারবার মনে হয় যদি কখনো আবরারের মন বদলে যায় আর ওকেও ভবিষ্যতে ওর মায়ের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তখন কি হবে? নিজেকে ওই অবস্থায় তখন সামলাতে পারবে না জারা, তাই নিজের মনকে শক্ত করে রেখেছে যে যাই হয়ে যাক। যতোই আবরারের প্রতি দুর্বলতা বাড়ুক, সেটা গোপন রাখবে আর যে সিদ্ধান্ত ও নিয়েছে সেই হিসেবেই এগোবে! আবরার দুপুরের কিছু সময় পর বাড়ি ফিরেছে, হাতের ব্যাগটা নিয়ে ওর মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। ব্যাগে ভেতর টাটকা মাছ দেখে ওর মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো…
‘ মাছ নিয়ে কোত্থেকে ফিরছিস? বাজারে গেছিলি নাকি?’
‘ না আম্মু, এগুলো জারার আব্বু মানে আমার শ্বশুর নিজের হাতে ধরে দিয়েছে’
‘ কি বলিস, মাছ ধরতে গেছিলি নাকি তোরা?’
‘ হ্যাঁ! তা, জারা বাসায় এসেছে?’
‘ অনেকক্ষণ আগেই এসেছে, বন্ধুর বাসায় গেছিলো আজকে ‘
মায়ের সঙ্গে কথা বলে ঘরে এলো আবরার, জারা তখন ল্যাপটপে কিছু একটা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলো কিন্তু আবরারকে দেখা মাত্রই সবকিছু রেখে উঠেই প্রশ্ন করে বসলো…
‘ তুমি আমার বাবার সঙ্গে কি করছিলে?’
‘ আরে, মাত্র ফিরলাম। আমাকে একটু দম ফেলতে দাও, আগেই প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলে?’
‘ দম ফেলতে ফেলতেই উত্তর দাও না, কে মানা করেছে? বাবার সঙ্গে কোথায় গেছিলে?’
‘ আমি আজ ওনার মাছ ধরার সঙ্গী হিসেবে গেছিলাম, আমরা দুজনে একসঙ্গে মাছ ধরেছি আর অনেক গল্প করেছি। এই সুযোগে তোমার সম্পর্কে অনেককিছু জানাও হয়ে গেছে ‘
‘ কি জেনেছো?’
‘ যা জানতাম না আর যেগুলো তুমি কখনও শেয়ার করোনি সেগুলো ‘
‘ আমার বাবা তোমার সঙ্গে বেশ ফ্রী মনে হচ্ছে, মাছ ধরতে উনি কখনও সেভাবে রায়ানকেও নিয়ে যান না সেখানে তোমাকে সঙ্গে যেতে বললো?’
‘ ইয়াহ! হয়তো আমাকে ওনার ভালো লাগে। অবশ্য ভালো লাগবে নাই বা কেনো? আমার মতো এমন মেয়ের জামাই উনি কোথায় পাবেন বলোতো?’
‘ হ্যাঁ সেটাই, কাজকর্ম বাদ দিয়ে শ্বশুরকে ইমপ্রেস করার জন্যে তার মাছ ধরার সঙ্গী হয়ে যেতে কোন জামাই রাজি হবে বলো?’
‘ তোমার বাবাও আমার কদর বোঝে, শুধু তুমিই বোঝো না ‘
‘ আর কিছুদিন অপেক্ষা করো, তারপর এমন একজনকে খুঁজে নিও যে তোমার কদর বুঝবে ‘
কথাটা বলেই আবারো ল্যাপটপ নিয়ে বসলো জারা, আবরার যদিও মজার ছলে বলেছিলো কিন্তু জারার থেকে হুট করে এমন একটা জবাব আসবে আশা করেনি। জারার উত্তরে আবরার বুঝলো মেয়েটা এখনও এটাকে একটা চুক্তির সম্পর্কই ভাবে, এছাড়া আর কিছুইনা! কিন্তু আবরার যে ঠিক করে নিয়েছে এতো সহজে হতাশ হবেনা, তাই জারার কথাটা তেমন সিরিয়াসভাবে নিলো না!
________________________________
অফিসে বসে আছে আবরার, বিগত দশ মিনিট যাবত একটু পর পরই ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। যেনো কারো কলের অপেক্ষা করছে। পাশে দাড়িয়ে সেক্রেটারি ইমরান জরুরি কিছু বিষয়ে কথা বলছে কিন্তু সেদিকে আবরারের মনোযোগ নেই….
‘ স্যার, আপনি আমার কথা শুনছেন?’
‘ হুমম, শুনছি ‘
‘ কিন্তু আপনি তো ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন’
‘ আমি আপনার সব কথা শুনছি, বলতে থাকুন ‘
‘ বলুনতো স্যার, এই মাত্র আমি কি বলেছি?’
সেক্রেটারির দিকে তাকালো আবরার, আসলে ওর কানে কোনো কথাই পৌঁছায়নি। উত্তর দিতে পারবে না বুঝে সত্যটাই বললো…
‘ জারার আমাকে দেড়টায় ফোন করার কথা ছিলো, এখন ১.৪০ বাজে কিন্তু এখনও ফোন এলো না?’
তাজ্জব বনে গেলো সেক্রেটারি ইমরান!
‘ মাত্র দশ মিনিটই তো দেরি হয়েছে স্যার, উনি হয়তো ব্যস্ত আছেন কোনো কাজে ‘
‘ নাহ, মেয়েটার কাছে সময়ের কোনো মূল্যই নেই দেখছি! আমিই ফোন করছি।’
জারাকে কল করার উদ্দেশ্যে ফোন হাতে নিতেই হুট করে ওর এক ক্লায়েন্ট এসে হাজির হলো। যুবতী মেয়েটি আবরারের পুরোনো ক্লায়েন্ট, প্রায়ই বড়সড় অ্যামাউন্টের জুয়েলারি অর্ডার করে সে। আসা মাত্রই আবরারকে দেখে মেয়েটি হাসিমুখে বলে উঠলো…
‘ নাইস টু সি ইউ মিস্টার আবরার, গতবার এসেছিলাম কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি ‘
‘ হ্যালো, ম্যাডাম। আপনি এসেছিলেন আমি শুনেছি, তখন আমি কিছু ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আবারো কি কোনো কাস্টমাইজ জুয়েলারি লাগবে?’
‘ ইয়াহ! শীঘ্রই বিয়ে করছি। বিয়ে থেকে শুরু করে তার আগের অনুষ্ঠানের জন্যে তিন – চার সেট জুয়েলারি লাগবে আর সেগুলো আপনার হাতেই বানাতে চাই ‘
‘ ওকে! আমি আপনাকে আমাদের ডিজাইন বুক দেখাচ্ছি, নতুন কিছু ডিজাইন আছে। আপনি সেখান থেকে সিলেক্ট করে দিন। ওর ইমরান, ওনার জন্যে এক কাপ কফি আনো ‘
‘ ইয়েস স্যার ‘
আবরার মেয়েটিকে ডিজাইন বুক বের করে দিয়ে ফোন হাতে নিলো কিন্তু ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। আবরার বুঝলো হয়তো চার্জ শেষ, বিরক্ত হয়ে চার্জার খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ও, এদিকে মেয়েটি ডিজাইন বুক খুলে বসেছে ঠিকই কিন্তু ওর নজর আবরারের দিকে। একটু পর সেক্রেটারি এসে কফি দিয়ে গেলো, মেয়েটি ডিজাইন বুক থেকে কিছু ডিজাইন বের করে আবরারকে দেখালো আর এই ডিজাইনেই একটু নতুনত্ব কিছু দিতে বললো। আবরার মেয়েটার সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রায় পনেরো – বিশ মিনিট হবে। ওদিকে জারা আবরারকে ফোন করে না পেয়ে ওর অফিসে আসে, আজকে জারা আবরারকে নিয়ে আবরারের ডিমান্ড করা হানিমুনে নিয়ে যাবে। বাসা থেকে সব প্রস্তুতি একেবারে নিয়েই এসেছে, এখান থেকে সোজা গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবে। আবরার ফোন ধরছে না দেখে জারা ওর অফিসে চলে আসে…
‘ ম্যাডাম, আপনি?’
‘ আপনার বস কোথায়?’
‘ স্যারের তো ক্লায়েন্ট এসেছে তাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, স্যার একটু আগে আপনার ফোনের..’
সেক্রেটারির পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই জারা হনহন করে আবরারের কেবিনের দিকে হাঁটা দিলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলো ভেতরে এক যুবতী ক্লায়েন্টের সঙ্গে আবরার কথায় ব্যস্ত, জারা ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো দুজনেই বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। রাগ হলো জারার, নক না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো, জারাকে দেখে রীতিমত চমকে গেলো আবরার। ও কিছু বলার আগেই ক্লায়েন্ট মেয়েটা বলে বসলো…
‘ মি. আবরার, আপনাদের এম্প্লয়রা কি এভাবেই হুটহাট বসের কেবিনে ঢুকে পড়ে? এরকম ইল ম্যানার্ড এম্প্লয় তো রাখা উচিত না ‘
‘ এক্সকিউজ মী ম্যাডাম, আমি এম্প্লয় নই। আই অ্যাম হিজ ওয়াইফ ‘
জারার কথা শুনেই মেয়েটা আবরারের দিকে তাকালো…
‘ আপনি বিয়ে করেছেন মি. আবরার? কবে করলেন? জানতেই তো পারলাম না ‘
‘ উনি বিয়ে করলো কি করলো না সেটা আপনাকে জানাতে হবে কেনো ম্যাডাম? আর ইউ সামওয়ান স্পেশাল?’
জারা যেনো হুট করেই রেগে গেছে, আবরারকে কিছু বলতেই দিচ্ছে না। এ অবস্থা দেখে অবশ্য আবরার নিজেও কিছুটা অবাক হচ্ছে….
‘ জারা? উনি আমার ক্লায়েন্ট’
‘ হুম দেখছি, আমার মনে হয় তুমি ব্যস্ত আছো। আমি নিজে অপেক্ষা করছি, কাজ শেষ করে চলে এসো ‘
আবারো হনহন করে বেরিয়ে এলো জারা, মেয়েটার হঠাৎ কি হলো বুঝলো না আবরার। এদিকে ওর ক্লায়েন্ট জারার এই আচরণে কিছুটা ভয় পেয়েছে বটে, বয়সে মেয়েটা জারার থেকে অনেকটা ছোটই বটে।
‘ মি. আবরার, আপনি ওনাকে বিয়ে কিভাবে করলেন? আপনি এত শান্ত মেজাজের সেখানে আপনার স্ত্রী এতো উগ্র মেজাজের?’
‘ এরকম কিছুনা, আমার ওয়াইফ এরকম না। ও বিজনেস সামলায়, হয়তো সেই বিষয়ে কিছু নিয়ে চিন্তিত হওয়ায় এমন বিহেভ করে ফেলেছে। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি!’
ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা শেষ করে দ্রুত চলে এলো আবরার, জারা ওর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে দেখে ও পাশের সিটে বসলো…
‘ আমরা কোথাও যাচ্ছি?’
‘ তুমি না হানিমুনে যেতে চেয়েছিলে? সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি ‘
অবাক হলো আবরার, বিনা প্রস্তুতিতেই হানিমুনে যাওয়া হচ্ছে?
‘ হোয়াট! না মানে, আমরা এখান থেকেই এভাবে চলে যাচ্ছি নাকি? প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে না?’
‘ সকল প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি আমি, তোমাকে ভাবতে হবেনা ‘
আবরার পেছনে তাকিয়ে দেখলো গাড়ির ব্যাক সিটে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ আরো কিছু প্যাকেট…
‘ এতগুলো ব্যাগ কিসের?’
‘ যেখানে যাচ্ছি সেখানে এগুলো লাগবে, আর হ্যাঁ আজ আমি ড্রাইভ করবো আজকে। গাড়ির চাবি দাও ‘
‘ আমি থাকতে তুমি কেনো ড্রাইভ করবে?’
‘আমিই করব!’
আবরার আর কথা না বাড়িয়ে চাবি দিয়ে দিলো, জারাও দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিলো…
‘ আমরা কোথায় যাচ্ছি বলবে তো?’
‘ গেলেই দেখতে পাবে ‘
ড্রাইভ করছে জারা, আবরার ওর মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছে কিছু হয়েছে কিনা। মেয়েটার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে রেগে আছে…
‘ তুমি কি আমার ওপর রেগে আছো?’
‘ রাগ করার মতো কিছু করেছো নাকি?’
‘ মনে তো হয় না আমি তেমন কিছু করেছি কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছো’
‘ এসব বাদ দাও, আচ্ছা ক্লায়েন্টদের প্রতি কিভাবে অধিক যত্নশীল হওয়া যায় তার কিছু টিপস দাও তো আমাকে ‘
‘ ওহ কাম অন জারা, তোমার নিজেরই তো কতো ক্লায়েন্ট আছে। আমি আর তোমাকে এ ব্যাপারে কি টিপস দেবো?’
‘ না, আমার অনেককিছু শেখার আছে তোমার থেকে। বিশেষ ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে ফোন বন্ধ রাখতে হয় যাতে আলাপে কোনো সমস্যা না হয়, তাই তো?’
‘ ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসলে ফোন কেনো বন্ধ করতে হবে? এরকম কোনো নিয়ম…’
এতক্ষণে আবরার বুঝলো জারার রাগ করার কারণ, ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখলো যে সময়ে ও ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত ছিলো তখন জারার অনেকগুলো কল এসেছিলো। ফোন চেক করেই হাসলো আবরার…
‘ আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছিলো, তার আগ অব্দি আমি তোমার ফোনেরই অপেক্ষায় ছিলাম ‘
কোনো জবাব দিলো না জারা, মুখ গোমড়া করে ড্রাইভ করছে মেয়েটা এদিকে আবরার সবটা বুঝতে পেরে মনে মনে ভীষণ আনন্দিত। অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছে সে, জারা আরচোখে তা দেখে বললো…
‘ হাসছো কেনো?’
‘ আনন্দে! আজকে আমার আনন্দের দিন!’
‘ মানে?’
‘ জারা, আর ইউ জেলাস?’
জোরে গাড়ির ব্রেক কষলো জারা, এমন একটা প্রশ্নের জন্যে যে মোটেও সে প্রস্তুত ছিলো না। হুড়মুড় করে বলে বসলো…
‘ আই অ্যাম নট!’
‘ ইয়েস ইউ আর!’
‘ বলছি তো না, আমি কোন দুঃখে তোমাকে নিয়ে জেলাস হতে যাবো?’
‘ কিন্তু তোমার এই রাগ তো অন্যকিছু বলছে, আমি সিওর তুমি আমাকে মেয়েটার সঙ্গে দেখে খুশি হওনি ‘
‘ আবরার, এমন কিছুই না। তুমি ভুল বুঝছো ‘
আবরার জারার কথায় যেনো পাত্তাই দিলো না। স্মিত হেসে আরাম করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বললো..
‘ যাক, কেউ একজন তাহলে আমাকে নিয়ে পসেসিভ হতে শুরু করেছে!’
এটা সত্য যে আবরারের ওপর একটু আগে অব্দিও অনেক রেগে ছিলো জারা কিন্তু এমন প্রসঙ্গ ওঠায় জারা নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো। মিনিট দুয়েক ভেবে দেখলো সত্যিই তো, ও যে আচরণ করে এসেছে সেটা তো জেলাসিরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু জারা যে এটা চায়না, আবরারের প্রতি কোনো ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করতে না চাওয়া সত্বেও কিভাবে আজ এমন কাণ্ড করে ফেললো? অস্থির হয়ে উঠলো জারা, ওকে নিশ্চুপ দেখে আবরার মজার ছলে বলে বসলো…
‘ কি ব্যাপার ম্যাডাম? ধরা পড়ে গিয়ে ড্রাইভ করার শক্তি হারিয়ে ফেললেন নাকি? আমি ড্রাইভ করবো?’
‘ দরকার নেই!’
জারা আবার ড্রাইভ করতে শুরু করলো, হাত কাঁপছে মেয়েটার! এই অবস্থা যদি দিনদিন আরো বেড়ে যায় তবে যে আবরারকে ছেড়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে, তখন কি করবে? মন ও মস্তিষ্কের সঙ্গে এ মুহূর্তে দারুন এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে জারা। পাশ থেকে আবরার ব্যস্ত তার স্ত্রীকে দেখতে, আবরারের মনে যা হতাশা ছিলো তা আজ সরে গেছে কারণ আজ ও বুঝে গেছে জারার মনে যে ওর জন্যে টান আছে। তাও একটু নয়, অনেকটা….
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]