সাজিয়েছি এক ফালি সুখ পর্ব-১৬+১৭

0
152

#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৬ + ১৭

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর শহর থেকে অদূরে একটা জায়গায় এসে পৌঁছালো ওরা, গাড়ি থেকে নেমেই একটা ফার্ম হাউজ ধরনের বাড়ি নজরে পড়লো আবরারের। চারপাশে একনজর চোখ বুলিয়ে ও জারাকে প্রশ্ন করলো…

‘ এটা কোন জায়গা?’

‘ আমার পঁচিশতম জন্মদিনের উপহার ছিলো এই ফার্ম হাউজটা, বাবা আমাকে গিফট হিসেবে দিয়েছিলো। এটা আমার কাছে একটা শান্তির জায়গা বলতে পারো ‘

‘ ওয়াও, নাইস প্লেস! তা তুমি কি আমাদের হানিমুনের জন্যে এই জায়গাটা চুজ করেছো?’

‘ আমরা দুজনেই এই মুহূর্তে নিজেদের কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আছি, দু – এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়াটা তোমার বা আমার কারো পক্ষেই সম্ভব না তাই ভাবলাম এখানে দু দিন কাটালে মন্দ হবেনা ‘

‘ উম্ম, সিদ্ধান্ত মন্দ নয়। অন্তত না পাওয়ার থেকে কিছুটা পাওয়াই অনেক। আমি ভেবেছিলাম শহরের ব্যস্ত কোলাহল ছেড়ে তোমাকে নিয়ে আমার কোথাও যাওয়াই হবেনা ‘

‘ আমাদের দুজনেরই কয়েকদিন হাওয়া পরিবর্তন করা দরকার ছিলো, কয়েকদিন তোমাকেও দেখছি অনেক স্ট্রেসড আছো। এখান থেকে ঘুরে গেলে দেখবে তোমরাও কাজের প্রতি মনোযোগ আগের থেকে বেড়ে যাবে ‘

আবরার নিরবে চেয়ে জারার কথাগুলো শুনছিলো। তিন মাস আগের আর এখনকার জারার মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে, আগে মেয়েটা ওকে নিয়ে তেমন ভাবতো না। কিন্তু এখন ভাবে, ওর জন্যে চিন্তা করে। জারার এই পরিবর্তনটুকুই আবরারের জন্যে অনেক!

‘ জারা, তুমি জানো এই মুহূর্তে আমার কেমন অনুভূতি হচ্ছে?’

‘ কেমন?’

‘ তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো, আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করছো এই বিষয়গুলো আমাকে অনেকটা শান্তি দিচ্ছে। কেনো সেই কারণটা জিজ্ঞাসা করো না। তুমি যেদিন নিজেকে আমার জায়গায় ভাবতে পারবে সেদিন আমার এই অনুভূতিগুলোও বুঝবে’

ঘাড় ঘুরিয়ে আবরারের দিকে তাকালো জারা। মাঝে মাঝে এই পুরুষটির চোখের মায়ায় ডুবে যেতে মন চায় ওর, ইচ্ছে হয় সব ভুলে কি নতুন করে সব শুরু করা যায়? পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে নিলো জারা, নিজেকে যে যথাসম্ভব শক্ত রাখার চেষ্টায় আছে। এ পুরুষের মায়ায় নিজেকে কিছুতেই বাঁধা যাবেনা, নাহলে নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তে সফল হতে পারবে না। ওকে নিরব দেখে আবরার প্রশ্ন করলো…

‘ কি হলো? কিছু বলবে না?’

‘ আমার এই আইডিয়াটা কেমন লেগেছে সেটা আগে বলো?’

জারার পাশে দাঁড়িয়ে এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো আবরার…

‘ দারুন লেগেছে! অবশ্য তুমি সঙ্গ দিলে আমার জন্যে পৃথিবীর সব জায়গাই হানিমুন প্লেস হয়ে যাবে, শুধু তুমি সঙ্গে থাকলেই হবে ‘

মুচকি হাসলো জারা…

‘ আমি আগেই লোক ঠিক করে ভেতরে সব পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখেছি, ভেতরে একদম পরিষ্কার আছে। তুমি যাও, আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি ‘

‘ এই না, আমি থাকতে তুমি কেনো ব্যাগের ভার বইতে যাবে? আমি নিয়ে আসছি, তুমি ভেতরে যাও ‘

জারা ভেতরে গেলো, আবরার একটু পর গাড়ি পার্ক করে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে এলো। বাইরে থেকে দেখতে ফার্ম হাউজটা একেবারে সাদামাটা হলেও ভেতরটা বেশ সাজানো গোছানো। ভেতরের পরিবেশ দেখে বোঝাই যাচ্ছে এটি জারার বেশ যত্নে রাখা জায়গা

‘ তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি দেখি রান্নার ব্যবস্থা করি। সন্ধ্যা তো প্রায় হয়ে গেলো, আমাদের কিছু খাওয়া দরকার ‘

‘ এখন রান্নার ঝামেলায় যেতে হবে না, খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি ‘

‘ এখানে আশেপাশে রেস্টুরেন্ট নেই, দুইটা আছে তাও সেটা দূরে। ওখান থেকে আসতে আসতে পেটে আর খিদে থাকবে না। আমিই রান্না করছি ‘

‘ ওহ! ঠিক আছে, তাহলে কয়েকদিনের জন্যে স্বামীকে রেধে খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করো আর আমিও বউয়ের যত্ন আত্তি পেয়ে ধন্য হই ‘

ব্যাগ নিয়ে আবরার রুমে যাচ্ছিলো, দু পা এগিয়েই আবারো ঘুরে জারার কাছে এসে বললো…

‘ ম্যাডাম, আপনি নিজেই এবার আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না ‘

কথাটা বলেই দুষ্টু হাসি হাসলো আবরার, চোখ বড় বড় করে তাকালো জারা। তবে কি সাত পাঁচ না ভেবে হুট করে এখানে চলে এসে আবরারকে সত্যিই সুযোগ দিয়ে বসলো ও? বউয়ের নিরব চাহনি দেখে হাসলো আবরার, জারার গাল টিপে বললো…

‘ আরে! এখনই ভয় পেলে নাকি? আরে ভয় পাওয়ার আরো অনেক সময় পড়ে আছে। আপাতত একটু খাবার বানাও, অনেক খিদে পেয়েছে ‘

আবরার রুমে চলে গেলো, জারা যেনো এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলো। এবার ওর ঘোর কিছুটা কাটলো, হুট করে ওর মনে হচ্ছে ভুল করে ফেলেছে! আবরারের সঙ্গে এভাবেই চলে আসা ঠিক হয়নি, লোকটা যদি এমনকিছু করে বসে যাতে নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে যায় তখন কি হবে? এরকম হাজারো ভাবনায় মাথা জ্যাম হয়ে গেলো, নাহ! আর ভাবতে পারলো না জারা! রান্নাটা করেই একেবারে ফ্রেশ হবে, এই চিন্তা করে আগে রান্নাঘরেই গেলো। ওর চেনা এক লোক আছে, যে ওর অনুপস্থিতিতে এখানকার দেখাশুনা করে। সকালে ওনাকে বলে জারা মোটামুটি প্রয়োজনীয় বাজার করিয়ে রেখেছিলো, সেগুলো দিয়েই এখন কাজ চালাবে। ওর রান্না চলমান থাকতেই আবরার ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে হাজির। উঁকি দিয়ে দেখে নিলো কি রান্না হচ্ছে, খুন্তি নাড়তে নাড়তে জারা বললো…

‘ ভাত রান্না হয়ে গেছে। সব্জি রান্না করছি আর একটু আলু ভাজি করে নেবো, রাতের ডিনারে হালকা কিছু হলে হবে না তোমার অন্যকিছু লাগবে?’

‘ যথেষ্ট! পারলে দুটো পদ করতে পারতে। এই গরমের মধ্যে এতকিছু বানানোর প্রয়োজন নেই ‘

‘ প্রয়োজন আছে, তোমায় ভালোভাবে রান্না করে না খাওয়ালে পরে সুযোগ পেলেই তো বলবে যে আমায় টেনে এখানে নিয়ে এলে কিন্তু কোনো যত্ন নিলে না ‘

আবরার এই কথার উত্তর দেবে তার আগেই ওর ফোন একবার বেজে উঠলো, সেক্রেটারির ফোন এসেছিলো কিন্তু নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকায় কেটে গেছে

‘ আমার সেক্রেটারিকে জানাতে হবে কয়েকদিনের জন্য ছুটিতে আছি ‘

‘ হ্যাঁ, আমিও এটা বলতে চাইছিলাম। ওনাকে জানিয়ে দাও ‘

‘ ইয়াহ! নাহলে আবার ভাববে বস আমার কোথায় গায়েব হয়ে গেলো, সে তো আর জানেনা বসের বউ তার বসকে তুলে নিয়ে এসেছে হানিমুন করতে’

খুন্তি নাড়া বন্ধ করে আবরারের দিকে তাকালো জারা, তার চোখেমুখে সে কি আনন্দ! অবশ্য এ আনন্দের কারণও বেশ উপলব্ধি করতে পারছে জারা। আসার পর থেকেই আবরার সুযোগ বুঝে বারবার ‘ হানিমুন ‘ বিষয়টা জারাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বেচারীর এবার মনে হচ্ছে নিজেই যেনো খাল কেটে কুমির টেনে এনেছে! যেখানে ও নিজের অনুভূতিগুলো সামলানোর চেষ্টায় আছে সেখানে নিজেই আবরারকে সুযোগ দিয়ে বসেছে সুপ্ত অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তোলার। আগামী দিনগুলোতে কি হতে চলেছে তা ভেবে কুল কিনারা করতে পারছে না জারা….
______________________________________

সকালের নাস্তা শেষে আবরারকে নিয়ে জারা হাজির হয় ওই জায়গারই এক অনাথ আশ্রমে, আগে সময় পেলেই জারা যখন ফার্ম হাউজে আসতো তখন এখানকার বাচ্চাদের সঙ্গেও দেখা করতে আসতো। এই অনাথ আশ্রমটির অবস্থান শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় এখানে বাচ্চার সংখ্যা কম আর আশ্রমটাও খুব একটা বড় নয়। এখানকার বেশিরভাগ বাচ্চার বয়স পাঁচ থেকে বারো বছরের মধ্যে। ছোটো বাচ্চাও আছে তবে তাদের সংখ্যা কম। জারা আশ্রমের মূল বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকতেই তিন – চারজন ছেলেমেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। জারাকে যেনো কতকাল পর দেখলো ওরা, জারাও পরম আদরে ওদের আলিঙ্গন করলো। আবরার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা, বাচ্চাদের সঙ্গে জারা কতোটা ফ্রি সেটা দেখার সুযোগ এই প্রথমবার পেলো ও। জারার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বাচ্চাগুলোর আবরারের দিকে নজর পড়লো, তখনই ওদের মধ্যে থাকা বড় মেয়েটা প্রশ্ন করলো…

‘ এই ভাইয়াটা কে?’

‘ এইটা আমার হাসব্যান্ড ‘

‘ হ্যাঁ? হাসবেন্ড? আপু! তুমি বিয়ে করে নিয়েছো? তুমি না বলেছিলে বিয়ে করবে না?’

মেয়েটির কথা শুনে এক নজর আবরারের দিকে তাকালো জারা, আবরারও কিছুটা অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। তারমানে জারা এক প্রকার ঢাক ঢোল পি’টি’য়ে’ই রেখেছিলো যে কখনো বিয়ে করবেনা?

‘ হ্যাঁ বলেছিলাম, কিন্তু এখন করেছি ‘

‘ খুব ভালো করেছো আপু, ভাইয়া আপনি অনেক সুন্দর দেখতে। আপুর সঙ্গে আপনাকে অনেক মানিয়েছে ‘

মেয়েটির কথা শুনে আবরার হাসিমুখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, এরপর হাতে থাকা ব্যাগগুলো ওদের হাতে দিয়ে বললো…

‘ তোমাদের আপু তোমাদের সবার জন্যে চকলেট এনেছে, এগুলো নিয়ে যাও সবাইকে ভাগ করে দাও ‘

‘ ঠিক আছে ভাইয়া! কিন্তু তোমরা আজকে সারাদিন এখানে থাকবে তো? আমরা সবাই মিলে মজা করবো ‘

‘ অবশ্যই থাকবো! আচ্ছা, তোমরা ক্রিকেট খেলতে পারো?’

তখনই বাচ্চা ছেলেটি বলে বসলো…

‘ আমরা সবাই ক্রিকেট পারি, বিকেলে আমরা সবাই মিলে খেলি তো ‘

‘ ওয়াও! তাহলে আজ বিকেলে আমার সঙ্গে এক ম্যাচ হয়ে যাক? আমরা আজ সবাই মিলে ক্রিকেট খেলবো ‘

বাচ্চাগুলো আবরারের প্রস্তাবে রাজি হলো, আবরারের সঙ্গে হাই ফাইভ করে ওরা চকলেটের ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেলো বাকিদের ভাগ করে দেওয়ার জন্যে। ওরা যেতেই জারা বললো…

‘ বাচ্চাদের সঙ্গে দেখছি তোমার ভালোই জমে ‘

‘ আমার পরিচিত তেমন বাচ্চা নেই, আমাদের ফিহা ছাড়া আর কি। ওরাও তো আমার ভাগ্নির বয়সী অনেকটা তাই ওদের সঙ্গে কিভাবে মিশতে হয় আমি জানি। কিন্তু তুমি এখানে আসবে আগে বললে পারতে, আমিও ওদের জন্যে কিছু উপহার নিয়ে আসতাম। এটা মোটেও ঠিক করোনি তুমি ‘

‘ আমি তো আনছি, তোমার আবার আলাদা করে আনার কি দরকার?’

‘ প্রথমবার এলাম এখানে, ফার্স্ট ইম্প্রেশন বলে একটা ব্যাপার তো আছে নাকি?’

‘ তোমাকে ওরা এমনিতেই পছন্দ করেছে, আলাদা করে ইমপ্রেস করতে হবে না ‘

‘ ইয়াহ রাইট! সবাই আমাকে দেখে ইমপ্রেস হয়, শুধু আমার বউ হয় না ‘

‘ কে বললো আমি ইমপ্রেসড নই?’

আনমনেই কথাটা বলে ফেললো জারা, চোখ ঘুরিয়ে তাকালো আবরার। কয়েক মুহূর্ত পর জারা যখন উপলব্ধি করলো ও কি বলেছে তখন আর আবরারের দিকে তাকানোর সাহস হলো না ওর, আবরার কিছু বলার আগেই ও বলে উঠলো…

‘ এই অনাথ আশ্রমের মালিক নিজে এখানে উপস্থিত থেকে সবটা পরিচালনা করেন, চলো তোমাকে ওনার সঙ্গে দেখা করিয়ে আনি ‘

আবরার বুঝলো মেয়েটা এখন আর এই নিয়ে কথা বলতে চায় না তাই আর জোর করলো না। আবরার কোনো বিষয়ই জোর করে জারার ওপর চাপিয়ে দিতে চায়না, বরং ও চায় জারা ওর ভালোবাসাটা নিজেই ধীরে ধীরে উপলব্ধি করুক, গ্রহণ করতে শিখুক। ইদানিং জারার কথাবার্তা ও চালচলনে আবরার বুঝতে পারছে যে ও যা চাইছে সেটাই হচ্ছে, ওর প্রতি জারার দুর্বলতা পূর্বের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে যা ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে। কারণ অনুভূতি একবার গভীরভাবে জন্মাতে শুরু করলে তা কমেনা বরং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে!! আবরারের সঙ্গে অনাথ আশ্রমের মালিকের দেখা করিয়ে দেয় জারা, মালিক একজন ভদ্র মহিলা। বছর বারো পূর্বে স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর তৈরি করা এই অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন এরপর থেকে নিজেই পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আবরারের ভালো লাগলো, আবরার এই অনাথ আশ্রমে ডোনেশন দেওয়ার প্রস্তাবও রাখলো। শুরুতে ভদ্র মহিলা নিতে চাননি, কারণ জারা এখানে প্রতি ছয় মাস অন্তর নিজের সাধ্যমত অর্থ দান করে আর ও জারার স্বামী। কিন্তু আবরারের অনুরোধে উনি ডোনেশন গ্রহণ করতে রাজি হলেন। দুপুরের খাবারটা আজ ওরা বাচ্চাদের সঙ্গে বসেই করেছে। আশ্রমের সামনে একটা ছোটো উঠান আছে, সেখানেই বসে সবাই আজ একসঙ্গে গল্প করতে করতে লাঞ্চ করেছে। বিকেলে রোদ পড়তেই বাচ্চারা আবরারকে নিয়ে পাশের মাঠে গেলো ক্রিকেট খেলতে, জারা ও আশ্রমের মালিকও গেছে। আবরার বাচ্চাদের সঙ্গে যখন খেলায় মেতে উঠেছে, জারা কিছুটা দূরে এক বেঞ্চিতে বসে ওকে দেখছে। বাচ্চাদের সঙ্গে কি সুন্দর খেলছে। আবরারের এই ছোটো ছোটো বিষয়গুলোই জারার অনেক ভালো লাগে। ভদ্র মহিলা ছোটো একটি থলি করে বড়ই নিয়ে এসেছেন, সেখান থেকে জারার হাতে কয়েকটা দিয়ে বললেন…

‘ আশ্রমের পেছনে লাগানো বড়ই গাছটায় এ বছর প্রথম বড়ই ধরলো, খেয়ে দেখো অনেক মিষ্টি ‘

জারা বড়ই মুখে দিয়ে বুঝলো সত্যিই বেশ মিষ্টি আর স্বাদও ভালোই। বড়ই খাওয়ার ফাঁকে তারা দুজনে অন্যান্য বিষয়ে কথা বলছিলো, একসময় আলোচনা এসে থামে জারার বিয়েতে। ভদ্র মহিলা বলেন…

‘ তোমার স্বামী মানুষ হিসেবে বেশ ভালো, তার কথাবার্তা বেশ নরম। ব্যবসায়ী মানুষ তো একটু গরম মেজাজি হয় ‘

স্মিত হাসলো জারা…

‘ ওকে আমি সেভাবে কখনও গরম মেজাজে দেখিনি, কাজের জায়গায় অবশ্যই মেজাজ গরম করে হয়তো আমার সামনে প্রকাশ করে না ‘

‘ যাক! বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালো করেছো। তুমি যতোটা গুরুতরভাবে এতো বছর ধরে বলছিলে যে বিয়ে করবে না, আমি ধরেই বসেছিলাম সত্যিই বুঝি করবে না। একটা মেয়ের স্বামী থাকা অনেক দরকার ‘

ভদ্র মহিলার কথা শুনে কিছু একটা ভেবে জারা প্রশ্ন করলো…

‘ আপনারও কি এটাই মনে হয় যে একটা ছেলেকে ছাড়া একটা মেয়ে অচল? আপনিও তো এখন একা হাতে সব করছেন? নিজেকে অচল লাগে আপনার?’

ভদ্র মহিলা হাসলেন, বুঝলেন জারা এখনো হয়তো এই বিষয়টা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। উনি জারার দ্বিধা দুর করতে বললেন…

‘ আমার ব্যাপার আলাদা জারা, আমি না হয় এখন একা কিন্তু এককালে জীবনসঙ্গী আমারও ছিলো। জীবনে চলার পথে একজন সঙ্গীর অনেক দরকার, শুধু মেয়ে নয়। ছেলে মেয়ে উভয়েরই একে অপরকে প্রয়োজন স্বামী স্ত্রী হিসেবে, কারণ তারা একে অপরের পরিপূরক। একটা ছেলে ও মেয়ের বিয়ে নামক বন্ধনের পেছনে কিন্তু অনেক কারণ জড়িয়ে আছে। স্বামী স্ত্রী একে অপরকে যতোটা ভালোভাবে বুঝবে সেটা অন্য বুঝবে না, মানসিক শান্তির জন্যে হলেও একজন সঙ্গী দরকার যে ভালোমন্দ উভয় সময় সঙ্গে থাকবে। সবাই ছেড়ে গেলেও সে ছাড়বে না, শক্ত করে হাতটা ধরে রাখবে। আমার মনে হয় এই বিষয়টা তুমি কিছুটা হলেও এখন উপলব্ধি করতে পারছো যেটা বিয়ের আগে বোঝোনি ‘

ভদ্র মহিলার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলো জারা, শুনে ভেবে দেখলো। সত্যিই তো, আবরারের সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে মানসিকভাবে অনেক শান্তিতে আছে ও। নেই কোনো দুঃচিন্তা, দুর্ভাবনা, কিন্তু বিয়ের আগে সবসময় মাথায় চিন্তা ঝেঁকে বসে থাকতো। ভদ্র মহিলার কথাগুলো বিবেচনা করার পর জারা গভীর ভাবনায় মত্ত হলো, মিনিট পাঁচেক এই ভাবনায়ই বুদ হয়ে ছিলো হুট করে বাচ্চাদের চিৎকারে ওর ভাবনায় ছেদ পড়লো…খেলা শেষ হয়েছে কিছুক্ষন আগে, আবরার বেঞ্চিতে বসে হাঁপাচ্ছে। পাশেই জারা বসে আছে…

‘ আজ অনেকদিন পর খেললাম তাও আবার প্রথমবার বাচ্চাদের সঙ্গে, ভালো লাগছে!’

পানি খেতে গিয়ে বিষম লাগলো, জারা ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো…

‘ আস্তে খাও! এতো হাপিয়ে গেছো তাহলে এতক্ষণ খেলার কি দরকার ছিলো?’

ধুলোমাখা চশমাটা খুলে রুমাল বের করে মুছতে মুছতে আবরার হাসিমুখে বললো…

‘ এরকম সুযোগ সবসময় পাওয়া যাবেনা, থ্যাংকস আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্যে। নাহলে এই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতাম না ‘

কথাগুলো বলে আবরার চশমা মুছতে ব্যস্ত হলো, তখনই জারা ওর ওড়না দিয়ে আবরারের ঘর্মাক্ত কপালটা মুছে দিতে শুরু করলো। থেমে গেলো আবরার, আড়চোখে জারার দিকে দেখে নীরবে হাসলো। মেয়েটা বুঝি এবার প্রেমে পড়ছে…
____________________________________

রাতে… বাইরে বসে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলো আবরার, ভেতরে ঠিকঠাক সিগন্যাল পাওয়া যায় না। আবরারের পর জারাও শাশুড়ির সঙ্গে কিছুক্ষন কথা বললো। কথা শেষ হতেই আবরারকে বললো…

‘ আম্মুর সঙ্গে কথা তো হয়ে গেলো, এবার বরং ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও ‘

‘ রেস্ট কেনো নেবো?’

‘ আজ বিকেলে এতক্ষণ খেললে, ক্লান্ত লাগছে না?’

‘ সো হোয়াট? আমি বুড়ো হয়ে গেছি নাকি যে এইটুকু খেলাধুলা করেই ক্লান্ত হয়ে যাবো? এখনো এক বাচ্চার বাপ হতে পারলাম না, এখনই যদি এই টুকটাক খেলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি তাহলে ভবিষ্যতে কি করবো?’

হুট করে বাচ্চার কথা ওঠায় থতমত খেয়ে গেলো জারা, সবকিছু বাদ দিয়ে আবরার কি এখন ইন্ডিরেক্টলি বাবা হওয়ার ইচ্ছার কথা বলতে চাইছে? নড়েচড়ে বসলো জারা…

‘ এখানে বাচ্চার প্রসঙ্গ কোত্থেকে এলো?’

‘ তুমিই তো তুলতে বাধ্য করলে! তাছাড়া আমি ভুল কিছু বলেছি? আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে ওদের বড় হওয়াটা আমিও উপভোগ করবো ‘

‘ জারা, আমার মনে হয় এই বিষয়টা এবার ভাবা দরকার। দেখো আমার মা বাবারও বয়স হচ্ছে, তাদেরও তো ইচ্ছে করে নাতি নাতনিদের সঙ্গে খেলার তাইনা?’

‘ ত…তো তোমার ভাবার ইচ্ছে হয়েছে ভাবো। আমি কি করবো?’

‘ আমি একা যদি বাবা হতে পারতাম তাহলে তোমাকে তো বলতাম না!

‘ রাত বিরাতে এসব কি নিয়ে কথা শুরু করলে বলোতো, অদ্ভুত! ‘

আবরার হেসে জারাকে টেনে নিজের কাছে আনলো, এক পাশ থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে বসলো যাতে আর সরে যেতে না পারে..

‘ কি চাই তোমার? গার্ল ওর বয়?’

‘ আমার মেয়ে পছন্দ, কিন্তু…’

‘ গুড! আমারও বেবী গার্ল পছন্দ। অবশ্য আমার অনেকগুলো মেয়ে হলেও সমস্যা নেই। ওকে ফাইন, আমরা তাহলে দোয়া করবো আমাদের প্রথম সন্তান যেনো মেয়ে হয় ‘

মাথা নিচু করে চেয়ে আছে জারা, খানিক সময় মৌন থেকে বললো…

‘ আমার মনে হয় না আমি একজন ভালো মা হতে পারবো, ছোটো থেকে বলতে গেলে এক প্রকার মা ছাড়াই বড় হয়েছি। আমার সৎ মা শুধু নামে ছিলেন, বাবার সামনে আমাকে আদর করতেন কিন্তু দিনশেষে আমি নিজেই নিজের মতো বড় হয়েছি। মা কেমন হয়, কিভাবে তার ছেলেমেয়েকে বড় করে এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে’

আবরার বেশ খোশ মেজাজে ছিলো, কিন্তু জারার কথাগুলো শুনে মুড অফ হয়ে গেলো। ও বরাবর চেষ্টা করে যাচ্ছে জারাকে সবটা ভুলিয়ে দেওয়ার কিন্তু এতকিছুর পরেও জারা পুরোনো স্মৃতি পেছনে ফেলে আসতে পারছে না। স্বভাবতই পুরুষ মানুষের ধৈর্য্য নারীর তুলনায় কম, তবুও আবরার এতদিন ধৈর্য্য ধারণের চেষ্টা করেছে কিন্তু আজ আর কেনো যেনো পারলো না। জারাকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো…

‘ জারা, তোমার একটা গুরুতর সমস্যা কি জানো? যা চলে গেছে সেটা আঁকড়ে ধরে তুমি বাঁচার চেষ্টা করছো, বর্তমান নিয়ে ভাবছো না। মানুষ অতীতের ভালো স্মৃতিগুলো মনে রাখে, আর যদি সেগুলো খারাপ হয় তবে ভবিষ্যতের জন্যে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যাতে ওই খারাপ স্মৃতিগুলো মুছে যায়। এক তরফা চেষ্টায় কিছুই হয় না সেটা নিশ্চয়ই জানো!’

‘ আবরার, আমি সেভাবে বলতে চাইনি। আমি…’

জারার পুরো কথা না শুনেই উঠে দাঁড়ালো আবরার…

‘ রাত হয়েছে, ঘরে চলো ‘

‘ আবরার ‘

জারাকে রেখেই চলে গেলো আবরার, প্রথমবারের মতো আবরারের চোখমুখে হতাশার ছাপ দেখেছে জারা। রাগ করেছে সে! জারা নিজের দোষটা বুঝতে পারছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাদের স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রী হিসেবে থাকার কথা কিন্তু জারার অনিচ্ছার জন্যে অধিকার থাকা সত্ত্বেও আবরার জোর করেনি কখনো। হাসিমুখে জারার সব আবদার মেনে নিয়েছে কিন্তু এখন আর পারছে না। ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে হয়তো! জারা ওখানেই আরো আধ ঘন্টা মতো সময় বসে রইলো, অনেকক্ষন ভাবলো এবং প্রথমবারের মতো মন ও মস্তিষ্কের মাঝে জারা মনকে আগে রাখলো। আবরারের ইচ্ছা অনুযায়ী এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিলে তো মন্দ হয় না, যেটুকু সময় আছে তাই কাজে লাগানো যাক! পরে না হয় যা হবার দেখা যাবে….নতুন সকাল, নতুন একটি দিনের সূচনা। জারা নিজেকে কিছুটা বদল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক করেছে আবরার যেভাবে ওকে স্ত্রী হিসেবে চায় সেভাবেই বাকি আড়াই মাস সময় কাটাবে। আবরারের রাগ কমেনি, সকালে ও মর্নিং ওয়াকে চলে গেছে জারাকে না বলেই। গত রাত থেকে মুখে কুলুপ এঁটে আছে, জারা কথা বলার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু লাভ হয়নি। ও বুঝলো লোকটি এমনিতে নরম প্রকৃতির কিন্তু একবার রেগে গেলে সহজে মানে না। জারা ওর মান ভাঙ্গানোর শুরুটা করলো সকালে আবরারের পছন্দের ব্রেকফাস্ট বানানোর মধ্যে দিয়ে। ও যখন ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত তখন এলিনা ফোন করলো….

‘ কীরে, গত রাত থেকে তোকে ট্রাই করছি। শুধু বলেই যাচ্ছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না? ‘

‘ সরি রে, এখানে অনেক নেটওয়ার্ক ঝামেলা করে। কারো সঙ্গেই ঠিকঠাক কথা হচ্ছে না ‘

‘ ওহ! তাই বল! আমি আরো ভাবলাম হানিমুনে গিয়ে তোরা বুঝি একে অপরকে নিয়ে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস যে ফোন ধরার সময় পাসনি। যাই হোক, সবটা কেমন চলছে বল ‘

‘ এলিনা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বাকি সময়টা আবরারের পারফেক্ট ওয়াইফ হিসেবে কাটাবো। সংসারটা এবার গুছিয়ে করবো, একদম মন থেকে ‘

বান্ধবীর কথা শুনে ভীষন খুশী হলো এলিনা, এতদিন ধরে এটাই তো শুনতে চাইছিলো। এরই মাঝে আবরার চলে আসায় জারা ফোন কেটে দিলো। আবরার ওকে দেখা সত্বেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলো, তখনই….

‘ আবরার, আজ তোমার পছন্দের ব্রেকফাস্ট বানানো হয়েছে। আমরা একসঙ্গে খাবো!’

এই সাত সকালে জারার মুখে হাসি দেখে আবরার অবাক হলো বটে! ভ্রু কুঁচকে নিলো সে, জারাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো গত রাতে যে মেয়েটা এতোগুলো কথা বলে ওর মন খারাপ করিয়ে দিলো সেই কি তবে আজ সকালে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করছে??

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]